৯. শেষ পর্বের কবিতা ২

আবু সয়ীদ আইয়ুব

উত্তীর্ণ-সপ্ততি রবীন্দ্রনাথ ঐ বয়সের শারীরিক ক্ষয়-ক্ষতি ও রোগযন্ত্রণা এবং ঐ সময়কার ঘোরতর ‘সভ্যতার সংকট’-জনিত মানসিক গ্লানি সত্ত্বেও মনের গভীর তলে আদর্শনিষ্ঠা, মূল্যবোধ ও ধর্মবিশ্বাস (faith) বাঁচিয়ে রেখেছিলেন; তাঁর শেষ পর্বের বাণী সর্বময় প্রত্যাখ্যানের, বিতৃষ্ণার বা বিদ্রূপের বাণী নয়। দুটি কথা কিন্তু মনে রাখতে হবে এ-প্রসঙ্গে। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস বলতে কোনো পূর্ব যুগাগত ধর্মমতের প্রতি আনুগত্য বোঝায় না,[১] বোঝায় তাঁর ‘আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে’ পাওয়া কঠিন সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা।

দ্বিতীয়ত, তিনি যেমন কোনো প্রাচীন বা প্রচলিত ধর্মমতকে সম্পূর্ণ নিজের বলে স্বীকার করতে পারেননি, তেমনি তাঁর জীবনের তথা কাব্যের কোনো-এক পর্যায়ে অভিব্যক্ত ধর্মচিন্তা বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে তার সমস্ত জীবনের পক্ষে ধ্রুব বলে মেনে নিতে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল।[২]

ব্রহ্মসংগীতের ‘নিখিলভারধারণ বিশ্ববিধাতা’র গীতাঞ্জলির ‘পরান সখা, বন্ধু’র সাক্ষাৎ মেলে না শেষ পর্বের কাব্যে। সে শূন্য আসন পূর্ণ করলেন যে দুই দেবতা তাঁদের কথাই বোধ করি কবি বলতে চেয়েছেন পত্রপুট-এর “পনেরো” সংখ্যক কবিতার শেষ ভাগে:

সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে
মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।

‘মনের মানুষ’-এর কথা সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে “মানুষের ধর্ম” ও “Religion of Man” – যথাক্রমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৩৩) ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৩০) প্রদত্ত বক্তৃতামালায়। “শান্তিনিকেতন” নামক দুই খণ্ড পুস্তকে সংকলিত আশ্রম মন্দিরে প্রদত্ত (১৯০৮-১৯১৪) বক্তৃতাবলীর সঙ্গে “মানুষের ধর্ম”-এর তুলনা করলে ঐ সময়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তায় এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। ‘মনের মানুষ’ কথাটা বাউল গান থেকে নেওয়া, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করেছেন; সেই অর্থ বোঝাবার জন্য বলেছেন – ‘এক মানুষ’, ‘মহামানব’, ‘বিশ্বমানব’, ‘পূর্ণ পুরুষ’, ‘The Eternal Man’, ইত্যাদি। শেষ পর্বের দ্বিতীয় আরাধ্য দেবতা ‘মহাকাল’, ‘রুদ্র’, ‘ভীষণ’, ‘ভৈরব’, ‘নটরাজ’, ‘খেলার গুরু’ প্রভৃতি নামে অভিহিত। এই দেবতার আবির্ভাব গদ্যে বিরল, কিন্তু শেষ পর্বের কাব্যে তাঁকে প্রায়ই পাওয়া যায়। অপরপক্ষে মহামানব যতখানি ভাবুক রবীন্দ্রনাথের ধ্যেয়, ততখানি কবি রবীন্দ্রনাথের নন।

আমার এই শেষের উক্তিটির মহৎ ব্যতিক্রম “শিশুতীর্থ”, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা, নিঃসন্দেহে তাঁর শ্রেষ্ঠ গদ্যকবিতা (অথচ লিপিকার কয়েকটি ছোট ছোট রচনা বাদ দিলে এটাই তাঁর প্রথম গদ্যকবিতা)। এই দশ পৃষ্ঠার ঠাসবুনোন রচনায় আছে মহাকাব্যের সুবিস্তৃত পটভূমি, মহোচ্চ ভাব ও অনুভব, আছে বলিষ্ঠ ভাষার গম্ভীর ঝংকার। সেই এপিক ভাব ও ধ্বনিধারার সঙ্গে মিশেছে লিরিকের সূক্ষ্ম আবছা ইঙ্গিতময়তা। দুই বিপরীত ঠাটের রাগিণীর যুগলবন্দি শুধু নয়, তারই সঙ্গে তাল রেখে চলে চিত্রকল্পের দ্রুত পটপরিবর্তন–-মানবিক ও প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ-আঁকা ক্যানভাসগুলি একটার পর একটা চোখের সামনে আসে আর সরে যায়।

ভাবতে অবাক লাগে যে, এমন আশ্চর্য সার্থক কবিতা প্রথমে লেখা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। মিউনিকের নিকটবর্তী ওবেরামের্গান নামক গ্রামে যীশু খ্রীষ্টের জীবনলীলা অবলম্বনে রচিত একটি প্যাশন-প্লে দেখে কবি তার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। পরে তা বাংলায় রূপান্তরিত হয়; অনূদিতও বলা যায়, কারণ দুটোর ভাব ও বিষয়বস্তু একই। কিন্তু শিল্পোৎকর্ষে আসমান-জমিন তফাত। মূল ইংরেজি মোটের উপর নৈরাশ্যজনক; পড়ে কোনো ধারণাই হয় না বাংলা ভাষায় এই কবিতাটি কী মহিমা লাভ করেছে। মালার্মের উক্তিটি মনে পড়ে – ‘poetry is written with words, not with ideas’। ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মহৎ ভাবের যথাযোগ্য শব্দবাহন খুঁজে পাননি; বাংলায় তাঁর অতুলনীয় বাকসিদ্ধি ঐ ভাবকে রসসৃষ্টির উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

প্রাগৈতিহাসিক প্রাসভ্য নগ্ন হিংস্রতার কাল থেকে সেই সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্নাবৃত স্বর্ণযুগ পর্যন্ত যখন ‘মহামানব’ জন্মলাভ করবে – মানবজাতির ইতিহাস-যাত্রা বিধৃত হয়েছে অল্প কয়েকটি বলিষ্ঠ রেখায়। কবিতার সূত্রপাত নাটকীয় এবং প্রতীকী:

রাত কত হল?
উত্তর মেলে না।
কেননা, অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে, পথ অজানা,
পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই।
পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো;
স্তূপে স্তূপে মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেছে;
পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা গুহায় গর্তে সংলগ্ন,
মনে হয় নিশীথরাত্রের ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।

মানুষের স্বভাবে রয়েছে এক অবিরাম অথচ অঋজু গতি – পশু থেকে দেবতার দিকে। কিন্তু পথ দীর্ঘ ও বন্ধুর। রাত কত হল, আদিমযুগের তামসিকতা কতটুকু কাটল? – কোনো উত্তর নেই এই উৎকণ্ঠিত প্রশ্নের। শুধু এইটুকু বোঝা যায় যে পথ এখনো অনেক বাকি রয়েছে। প্রকৃতির (জীব ও জড় প্রকৃতির) রাক্ষসী মায়া বিভীষিকা বিস্তার করে। বিপুল সংখ্যক মানুষ পরস্পর বিদ্বেষে অন্ধ, হিংসায় উন্মত্ত; জড় প্রকৃতির, মূঢ় সংস্কারের, স্বার্থান্বেষী অধিনেতার দাস তারা:

সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো
ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে,
মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে
বিভীষিকার উল্কি পরানো।
কোনো-এক সময়ে অকারণ সন্দেহে কোনো-এক পাগল
তার প্রতিবেশীকে হঠাৎ মারে,
দেখতে দেখতে নির্বিচার বিবাদ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দিকে দিকে।

শেষের পঙক্তিগুলির উপর সেই সময়কার অতি জঘন্য হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার ছায়া পড়েছে। মাঞ্চুরিয়াতে আক্রমণকারী জাপানী ফৌজের বীভৎস আচরণের সংবাদও এসে পৌঁছেছিল বোধ হয়। স্মরণ থাকতে পারে যে, প্রথম মহাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণও একটি হত্যাকাণ্ড, সম্ভবত কোনো-এক পাগলের হাতেই।

এই তমসাচ্ছন্ন, জড়বুদ্ধি মানবজাতির মধ্যেই দেশে দেশে যুগে যুগে দেখা দেন সক্রেটিস, গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রীষ্ট, মোহনদাস গান্ধীর মতো মহাপুরুষেরা; আসেন প্রজ্ঞা ও প্রেমের বাণী নিয়ে, জনসমাজে স্বীকৃতি, প্রতিষ্ঠা, আনুগত্য লাভও করেন তাঁরা। কিন্তু বেশিদিনের জন্য নয়। জনতা কিংবা কুলপতিরা বিদ্রূপের অট্টহাস্য দিয়ে আঘাত করে তাদের শিক্ষাকে, কখনো বা হত্যা করে বসে শিক্ষাদাতাকেই। তারপরে মূঢ়ের দল আবার নেমে যায় তাদের আদিম স্বভাবের নিম্ন ভূমিতে। অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে। অমানুষিকতা যখন চরমে পৌঁছয় তখন ‘বাতাসে যূথীর মৃদু গন্ধ’ – সেই প্রকৃতির পরিহাস:

জনতার মধ্য থেকে কে-একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে
অধিনেতার দিকে আঙুল তুলে বললে,
‘মিথ্যাবাদী, আমাদের প্রবঞ্চনা করেছ।’
ভর্ৎসনা এক কণ্ঠ থেকে আরেক কণ্ঠে উদগ্র হতে থাকল।
তীব্র হল মেয়েদের বিদ্বেষ, প্রবল হল পুরুষদের তর্জন।
অবশেষে একজন সাহসিক উঠে দাঁড়িয়ে
হঠাৎ তাকে মারলে প্রচণ্ড বেগে।
অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না।
একজনের পর একজন উঠল, আঘাতের পর আঘাত করলে,
তার প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
রাত্রি নিস্তব্ধ।
ঝর্নার কলশব্দ দূর থেকে ক্ষীণ হয়ে আসছে।
বাতাসে যূথীর মৃদুগন্ধ।

দৃশ্যের পর দৃশ্যে দেখানো হয়েছে মানুষের স্বভাবে পশুই অধিপতি, দেবতা প্রচ্ছন্ন, অনুত্থিত। তবু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস হারান না, চেয়ে থাকেন সেই অনাগত কালের দিকে যখন মানুষ জয় করবে তার পশুস্বভাবকে। অবতার বা মহাপুরুষ নন, ঘরে ঘরে ভূমিষ্ঠ হবে পূর্ণ পুরুষ, পূর্ণ মনুষ্যত্বের চিরজীবিত আদর্শ। “শিশুতীর্থ”-তে ত্রাণকর্তাদের মহিমান্বিত ব্যর্থতাই দেখতে পাই; যে-নবজাতকের অভ্যুদয় শেষ কয়েকটি ছত্রে ঘোষিত তিনি কোনো ত্রাণকর্তা, পীর-পয়গম্বর, ঋষি বা অবতার নন, তিনি চিরমানব:

মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু
উষার কোলে যেন শুকতারা।
দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।
কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে:
‘জয় হোক মানুষের, ঐ নবজাতকের, ঐ চিরজীবিতের।’

‘এই মাতা কে?’ – প্রশ্ন করেছেন শশিভূষণ দাশগুপ্ত, এবং ঠিকই উত্তর দিয়েছেন: ‘মাতা বসুন্ধরা। সমস্ত সৃষ্টি আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করিয়া আছে কবে মাতা বসুন্ধরা তাঁহার তৃণশয্যায় মানবশিশু কোলে করিয়া বসিয়া থাকিবেন; সেই মানবশিশুর মধ্যে ঘনীভূত হইয়া রূপ লাভ করিবে সৃষ্টির সকল অর্থ। কিন্তু যে-মানবশিশুর মধ্যে সৃষ্টির সকল অর্থ দেখতে পাওয়া যাবে তিনি এখনো জন্মাননি, ‘পূর্ণ পুরুষ আগন্তুক; তাঁর রথ ধাবমান; কিন্তু তিনি এখনো এসে পৌঁছননি’।

মানুষের ক্ষুদ্র দেহ,
যন্ত্রণার শক্তি তার কী দুঃসীম।
সৃষ্টি- ও প্রলয়- সভাতলে—
তার বহ্নিরসপাত্র
কী লাগিয়া যোগ দিল বিশ্বের ভৈরবীচক্রে
বিধাতার প্রচণ্ড মত্ততা— কেন
এ দেহের মৃভাণ্ড ভরিয়া
রক্তবর্ণ প্রলাপের অশ্রুস্রোতে করে বিপ্লাবিত।
(রোগশয্যায়-“পাঁচ”)

বিশ্বের ভৈরবীচক্রে মানুষের ক্ষুদ্র দেহ তার বহ্নিরসপাত্র নিয়ে কিসের জন্য যোগ দিল, শুধু কি অপরিমেয় যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য? সেই ক্ষুদ্র দেহের মৃভাণ্ড ভরে উপচে পড়ছে ‘রক্তবর্ণ প্রলাপের অশ্রুস্রোত’ – এ কি কেবল ‘বিধাতার প্রচণ্ড মত্ততা’, কোনো অর্থ নেই তার? কোনো অর্থই খুঁজে পাওয়া যাবে না মানুষের সত্তার বাইরে; সে-অর্থ তো পাওয়ার জিনিস নয়, দেওয়ার জিনিস। মানুষ আপন অপরাজেয় সাধনার দ্বারা সমস্ত সৃষ্টিকে যদি অর্থবান করে তুলতে না পারে তবে সে-সৃষ্টি বিধাতার প্রচণ্ড মত্ততা রূপেই প্রতিভাত হতে থাকবে সুস্থ মূল্যবিচারে। একদিন রবীন্দ্রনাথ প্রেমের ভাষায় বলেছিলেন, ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর এ প্রেম হত যে মিছে।’ আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন – আমায় নইলে এ সৃষ্টি হত মিছে। শুধু ‘আমায় নইলে’ নয়, আমি যদি একে আপন তপস্যার মূল্যে, প্রাণের মূল্যে, সত্য না করতে পারি তবে এ-সৃষ্টি মিথ্যাই থেকে যাবে। মানুষ জগৎ সৃষ্টি করেনি, কিন্তু জগৎকে মূল্যযুক্ত (charged with value – ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং’-এর অর্থও কি তাই নয়?) করে তুলবার দায়িত্ব মানুষেরই:

প্রতিক্ষণে অন্তহীন মূল্য দিল তারে
মানবের দুর্জয় চেতনা,
দেহদুঃখ-হোমানলে
যে অর্ঘ্যের দিল সে আহুতি—
জ্যোতিষ্কের তপস্যায়
তার কি তুলনা কোথা আছে?

সবার উপরে মানুষ সত্য – হিউম্যানিজম-এর এই মূল কথাটা উপরে উদ্ধৃত কবিতায় এবং শেষ পর্বের আরো কয়েকটি কবিতায় যত উদ্দীপ্ত, যত জ্বালাময় ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গদ্যে বা পদ্যে তেমন করে আর কেউ বলেছেন বলে তো মনে করতে পারছি না।

ভগবান কোথায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রশ্নের উত্তরে উপনিষদ বলেছেন – স্বে মহিম্নি, আপন মহিমায়। সেই ভাষায় রবীন্দ্রনাথও বলছেন মানুষের সত্যপ্রতিষ্ঠা তার মহিমায়, তার পূর্ণতায়। মনুষ্যজাতির দেবকল্পনার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে তার আপন পূর্ণতার আদর্শকে গড়ে তুলবারই ইতিহাস; আপন পরিপূর্ণ বিকাশের চরম আদর্শকে মানুষ ভগবান বলে জেনেছে চিরকাল। যখন অখণ্ড প্রতাপকেই মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ স্তর ভেবেছে, তখন শক্তির পূজা করেছে; যখন শ্রেয়োনীতিক আদর্শ তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে তখন ভগবান হয়েছেন পরম মঙ্গলময়, প্রেমময়। অবশ্য ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায় এমন সব উপাদান দিয়েও দেবমূর্তি গড়া হয়েছে ‘শ্রেয়োনীতিতে যা গর্হিত, সৌন্দর্যের আদর্শে যা বীভৎস। তাকে বলব ভ্রান্ত উত্তর (আমার চরম মূল্য কোথায় – এই প্রশ্নের ভ্রান্ত উত্তর।) এবং মানুষের কল্যাণের জন্য সকল রকম ভ্রমকেই যেমন শোধন করা দরকার এখানেও তাই।’[৭] অর্থাৎ দেবতা যে কেবল যুগে যুগে ধরাধামে অবতীর্ণ হচ্ছেন তাই নয়, যুগে যুগে স্বধামে পরিশুদ্ধ বা সমুন্নতও হচ্ছেন – মানুষেরই আত্মশুদ্ধি ও ক্রমোন্নতির অব্যর্থ পরিণাম-স্বরূপ। কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম – কোন দেবতা আমার যথার্থ দেবতা – এ-প্রশ্ন সর্বকালের। কিন্তু কেমন করে জানব আজকের দিনে কোন দেবতা সত্য, সত্যই পূজনয়; আর কোন দেবতা ইতিমধ্যে হবিদানের অযোগ্য হয়ে পড়েছেন? তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মানুষের দেবতার শ্রেষ্ঠতার বিচার মানুষেরই পূর্ণতার আদর্শ থেকে।’[৮]

পূর্ণ পুরুষের যে-চরম আদর্শ আমাদের মনে বিরাজিত, তাকে ভগবানের শত রূপের একটি রূপ মাত্র বলা যেতে পারত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার চেয়েও বেশি বলতে চান, বলতে চান ভগবান শব্দ দ্বারা এ ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। এর বাইরে যদি কোনো অভিধা থাকে ঐ শব্দের তবে তা আমাদের ধারণার সম্পূর্ণ অতীত, সুতরাং তাকে মানা না-মানা দুই-ই সমান। দেশ-বিদেশের ধর্মশাস্ত্র ভগবানকে যত মানবোত্তীর্ণ বিশ্বাতিগ রূপেই কল্পনা করুক না কেন, বস্তুত, মনুষ্যত্ববিকাশের চরম আদর্শ ছাড়া ভগবানের আর কোনো মানে নেই।[৯] শেষ জীবনে মানবোত্তীর্ণ কোনো অধ্যাত্ম সত্তায় বিশ্বাস করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব ছিল না এ-কথা একাধিকবার স্পষ্ট ভাষায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন: ‘আমার মন যে-সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্র আছে – তিনি নিখিল মানবের আত্মা। তাকে সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন, তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই।’[১০] সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম সত্য মানুষের মধ্যেই নিহিত; তার বাইরে যেমন কোনো পরম শ্রেয় নেই, তেমনি কোনো পরম সত্যও নেই: ‘জীবমানব কেবলই তার অহং-আবরণ মোচন করে আপনাকে উপলব্ধি করতে চাইছে বিশ্বমানবে। বস্তুত সমস্ত পৃথিবীরই অভিব্যক্তি আপন সত্যকে খুঁজছে সেইখানে, এই বিশ্বপৃথিবীর চরম সত্য সেই মহামানবে।[১১]

সৌরজগতের আরম্ভকালের বহু শত কোটি বৎসর পরে মানুষের সূচনা, তাই সে চরম মূল্য ও পরম সত্যের আধার হতে পারে না – এমন ভাবা ভুল। ক্ষুদ্রায়তন ও ক্ষণজীবী বলে এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে তার তাৎপর্য মোটেই সীমিত নয়। ‘মানুষের ক্ষুদ্রতা বিচার করে কোনো কোনো পণ্ডিত অভিভূত হয়ে পড়েন। পরিমাণকে অপরিমেয় সত্যের চেয়ে বড় করা একটা মোহ মাত্র।’[১২] মানুষের দুর্জয় চেতনা সেই অপরিমেয় সত্য।

‘ভগবান’ এবং ‘মহামানব’ শব্দদ্বয় যদি সমার্থবাচক হয় এবং মহামানব মানবত্বের চরম আদর্শ রূপেই সত্য হন, তবে কি একথা মানতে আমরা বাধ্য নই যে, ভগবান মানুষের মনের একটি ধারণামাত্র (সে-ধারণার মূল্য যতই হোক), মনের বাইরে তিনি সত্য নন? কারণ আদর্শ আমরা তাকে বলি যা ইতিমধ্যেই সিদ্ধ নয়, মানুষের নিত্যনিয়ত সাধনার দ্বারা অল্পে অল্পে অনন্ত কাল ধরে বাস্তবে রূপায়িত হয়ে চলেছে। ভগবানের সত্তা কি তবে আমাদেরই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার অক্ষম চেষ্টার উপর নির্ভরশীল, কাজেই সে-চেষ্টার সম্যক্ চরিতার্থতার পূর্বে তিনি পূর্ণ সত্য নন?

ভগবান বা পূর্ণ পুরুষ মানবোত্তীর্ণ কিছু নন, একথা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি আমাদের মনগড়া বা মনোগত ব্যাপার মাত্র। আমরা এখানে একটি জটিল তত্ত্বে এসে পৌঁছচ্ছি। পরম মূল্য একাধারে বিষয়গত ও বিষয়ীগত ব্যাপার, মনের মধ্যে সত্য, আবার মনের বাইরেও সত্য। কোনো দার্শনিক আলোচনায় না গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক সমাধানটাই এখানে খুব সংক্ষেপে দেওয়ার চেষ্টা করব:

মানুষের সত্তায় দ্বৈধ আছে। একদিকে সে জীব, জৈবধর্ম পালন করে, প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা চালিত হয়। অন্যদিকে সে জীববিজ্ঞানের বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য নয়। স্বভাবের তাগিদকে অগ্রাহ্য করে প্রেয়ের উপর স্থান দেয় শ্রেয়কে, সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারত যে-দিকে সে-দিকে না গিয়ে পা বাড়ায় সেই দুরত্যয় ক্ষুরধার পথে যে-পথে তার ধনপ্রাণ প্রিয়জন সবই বিপন্ন। সচরাচর এমনটা ঘটে না, তবু ঘটে। কী সেই প্রবল শক্তি যা তাকে স্বাভাবিকের ইস্পাতে-বাঁধা মসৃণ সড়ক থেকে যেন ডিরেল করে নিয়ে যায় দুঃসাধ্য আদর্শের উপল-বন্ধুর অজানা ভূমিতে যেখানে কোনো পথই কাটা হয় নি? ‘জ্যোতির্বিদ দেখলেন কোনো গ্রহ আপন কক্ষপথ থেকে বিচলিত। নিঃসন্দেহ মনে বললেন, অন্য কোনো অগোচর গ্রহের অদৃশ্য শক্তি তাকে টান দিয়েছে। দেখা গেল, মানুষের মন আপন প্রকৃতি-নির্দিষ্ট প্রাণধারণের কক্ষপথে আবৃত্তি করে চলছে না। অনির্দিষ্টের, স্বভাবের অতীতের দিকে ঝুঁকছে।’ মানুষের বেলা এ অগোচর গ্রহের নাম ভগবান এবং সংজ্ঞা পূর্ণ মনুষ্যত্বের আদর্শ। এই গ্রহটি ইউরেনস নেপচুনের মতো দূরবীনে-দেখা মাপজোখ-করা বাস্তব নয়, অথচ কাল্পনিক বা মনের ব্যাপার মাত্র বলে তাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনের বাইরেও তা সত্য, যদিও সেই সহজ অর্থে সত্য নয় যে-অর্থে প্রচলিত ধর্মমতগুলিতে অতিমানব ভগবানের অস্তিত্ব অবধারিত ও বিঘোষিত হয়ে থাকে।

.

শেষ দশকের অন্য ধ্যেয় দেবতা রুদ্রনটরাজ। গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতাকে বলা হয়েছে বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন; প্রতিতুলনায় শেষ পর্বের কবিতাকে বলা যেতে পারে শৈব-ভাবাপন্ন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এ-সব উক্তি স্পষ্টতই শর্তাধীন। প্রথমত, গীতাঞ্জলি পর্বে যতখানি ভাবৈক্য পাওয়া যায়, শেষ পর্বে (পরিশেষ থেকে শেষ লেখা পর্যন্ত) তা অনুপস্থিত; সেই পর্বের দ্বৈত-সাধনার কথাই বর্তমান অধ্যায়ে আমার আলোচ্য। দ্বিতীয়ত, গীতাঞ্জলির ভাব বৈষ্ণব-ঘেঁষা হলেও ঠিক বৈষ্ণবীয় নয়। পদাবলীর সঙ্গে গীতাঞ্জলির সাদৃশ্য যতখানি, বৈসাদৃশ্য তার চেয়ে বেশি। তেমনি শেষ পর্বের ভাবের সঙ্গে কোনো প্রচলিত শৈব মতের মিল খুঁজতে যাওয়া পণ্ডশ্রম। বৈষ্ণবই হন আর শৈবই হন, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই।

এই সময়ে যে-চিত্রটি রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে ফিরে ফিরে আসছে তা অপ্রকাশ থেকে প্রকাশে উচ্ছিত এবং প্রকাশ থেকে অপ্রকাশে বিলীন হয়ে যাওয়ার চিত্র – নীহারিকাপুঞ্জের সৃষ্টি ও প্রলয়ে যেমন, সভ্যতার উত্থান-পতনে তেমনি, তেমনি কোনো মহাকবির দেশজোড়া প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিহ্ন বিলুপ্তিতে। নক্ষত্রসভায় এবং মানবসমাজে এ অন্তহীন বিরতিহীন চক্রগতির কেন্দ্রবিন্দুটি কিন্তু স্থির:

মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি।
তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে
উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি,
আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে।
প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত-অব্যক্তের চক্রনৃত্য,
তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে
তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে।
হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা। (শেষ সপ্তক-“সাত”)

যে-দেবতার কাছে কবি দীক্ষা চাইছেন তিনি মানুষের প্রতি মমতাশূন্য; সৃষ্টিতে তাঁর যেমন ঔদাসীন্য, প্রলয়েও তেমনি। জড়জগতে ও প্রাণলোকে যে-বিপুল ‘অপচয়’ ঘটে আসছে চিরকাল ধরে, তাকে বলেছেন ‘আপন সৃষ্টির পরে বিধাতার নির্মম অন্যায়’ নবজাতক-এর একটি কবিতায়।

এই দীক্ষার আর-এক রূপ প্রকাশ পেয়েছে শেষ সপ্তক-এর বাইশ-সংখ্যক কবিতায়। কবি নিজের রক্তমাংসের প্রাত্যহিক স্বরূপের প্রতি নির্মম হতে চান; তাঁর দেহ-মনকে অধিকার করে আছে যে ‘অনেক কালের বুড়ো, কত যুগের ক্ষুধা ওর, কত তৃষ্ণা’, তার গ্লানিকর অস্তিত্বটাকে দূরে ঠেলে দিতে চান:

আমি আজ পৃথক হব।
ও থাক ঐখানে দ্বারের বাইরে—
ঐ বৃদ্ধ, ঐ বুভুক্ষু।
… … …
আমি দেখব ওকে জানলায় বসে
ঐ দূরপথের পথিককে,
… … …
দেখব যেমন করে পুতুলনাচ দেখে।

এখানে সন্ন্যাসী শিব এক হয়ে গেছেন নিজেরই অন্তরতম শুদ্ধতম সত্তার সঙ্গে – বেদান্তের পরিভাষায় যাকে ‘সাক্ষী চৈতন্য’ বলা যেতে পারে; একটু পরে ঐ কবিতায় ‘আমি’র পরিচয় দিচ্ছেন পাকা বৈদান্তিকের মতো:

মুক্ত আমি, স্বচ্ছ আমি, স্বতন্ত্র আমি,
নিত্যকালের আলো আমি,
সৃষ্টি-উৎসের আনন্দধারা আমি,

কিন্তু তার পরেই যে-কথাটা যোগ করলেন, কোনো বৈদান্তিক ‘পরম-আমি’ সম্বন্ধে সে-কথা ভাবতে পারেন না। বলছেন – ‘অকিঞ্চন আমি’। ‘আমি’ যা-কিছু ভালোবাসি, ভোগ করি, যাতে আহত ও পীড়িত হই, পুড়ে মরি – সব-কিছুই ছাড়ব, ছেড়ে একেবারে মুক্ত পুরুষ হয়ে যাব, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বোধ করব – ‘অকিঞ্চন আমি, আমার কোনো কিছুই নেই’। যে-কবি পরিপূর্ণ জীবনের ও সুন্দর ভুবনের জয়গান করেছেন বাল্যকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত, ‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় এ পৃথিবীর ধূলি’ যাঁর আদি ও অন্তিম মন্ত্র, তাঁর মুক্তি দূরে সরে গিয়ে নয়। ‘অহংকারের প্রাচীর’ ভাঙতে চাইবেন তিনি স্বভাবতই, কিন্তু বৈদান্তিক অর্থে নয়, বিশুদ্ধ বিমুক্ত আত্মা হয়ে যাওয়ার জন্যে নয়। ‘আমার কোনো কিছুই নেই’-এর ভিতরের কথাটা রিক্ততা নয়, ঋদ্ধি – সব-কিছুই আমার, সব-কিছু ভালোবাসি আমি, সব-কিছুর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই, এক হয়ে যেতে চাই। ‘কুড়িয়ে আনা ছড়িয়ে ফেলা, একি তোমার একই খেলা’ – এ খেলায় রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন তাঁর ‘খেলার গুরু’র সঙ্গে। সব-কিছুকে ধরে রাখা এবং ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে, অনুরাগ ও নির্বেদের মধ্যে, রক্তমাংসের মানুষ ও শুদ্ধাত্মার মধ্যে যে-দ্বন্দ্ব, সে-দ্বন্দ্বের বোধ ও বেদনা কবির, দার্শনিকের নয়। দ্বন্দ্ব এবং দ্বন্দ্বের জ্বালাই হয়ে ওঠে কবিতা; সমাধানের নৈর্ব্যক্তিক, নিরাসক্ত অনুসন্ধিৎসা থেকে জন্মলাভ করে দর্শন।

উপরে উদ্ধৃত কবিতাটি শুধু গদ্য ছন্দে নয়, প্রায় গদ্যেই লেখা। বন্ধন ও মুক্তির, অনুরাগ ও বৈরাগ্যের দ্বন্দ্ব সংশয়াতীত কবিতা হয়ে উঠেছে আকাশপ্রদীপ-এর “পঞ্চমী”তে।–

ভাবি ব’সে ব’সে
গত জীবনের কথা
কাঁচা মনে ছিল
কী বিষম মূঢ়তা।
শেষে ধিক্কারে বলি হাত নেড়ে,
যাক গে সে-কথা যাক গে।

কবিতার একেবারে গোড়াতেই পরম বৈরাগ্য, যে-বৈরাগ্যের কাছে তরুণ প্রেমের সব সুখদুঃখ নিছক মূঢ়তা বলে ঠেকবার কথা। কিন্তু কবিতার বক্তব্য মোটেই তা নয়। মূঢ়তা বলে নিন্দিত তরুণ বয়সের প্রেম নয়; প্রিয়াকে সম্পূর্ণ পাইনি বলে দুঃখ করাটা, যখন যেটুকু পেয়েছিলাম তাই নিয়ে খুশি না হওয়াটাই বিষম মূঢ়তা হয়েছিল।

তরুণ বেলাতে যে খেলা খেলাতে
ভয় ছিল হারবার,
তারি লাগি, প্রিয়ে, সংশয়ে মোরে
ফিরিয়েছ বারবার

তখন এ-ছলনাটা বড় দুঃখের মনে হয়েছিল, প্রচণ্ড নালিশ ছিল সেদিন – তুমি নিজের সবটুকু ভালোবাসা অসংকোচে দাওনি কেন, কেন অহংকারের দেওয়াল ভাঙতে পারলে না। কিন্তু আজ–

পরিতাপে জ্বলি আজ আমি বলি,
সিকি চাঁদনীর আলো
দেউলে নিশার অমাবস্যার
চেয়ে যে অনেক ভালো।

অথচ কবিতার শেষে কবি জানাচ্ছেন – বয়স গিয়েছে, এ-সব ভেবে হাসিই পাচ্ছে এখন; একটু যেন অহংকার করে বলছেন:

দীর্ঘ পথের শেষ গিরিশিরে
উঠে গেছে আজ কবি
সেথা হতে তার ভূতভবিষ্য
সব দেখে যেন ছবি
ভয়ের মূর্তি যেন যাত্রার সঙ,
মেখেছে কুশ্রী রঙ।
দিনগুলি যেন পশুদলে চলে,
ঘণ্টা বাজায়ে গলে।
কেবল ভিন্ন ভিন্ন
সাদা কালো যত চিহ্ন!

কিন্তু এ-অহংকারের ভিত বড় কাঁচা, ফ্রয়েডীয়রা যাকে বলেন ‘ইচ্ছাপূরক ভাবনা’, অনেকটা তাই। দর্প কিন্তু কবি নিজের হাতেই চূর্ণ করেছেন পূর্ববর্তী স্তবকে মুক্তকণ্ঠে মেনে নিয়ে যে, বিগত দিনের কথা ভেবে আজও তাঁর অনুতাপ-পীড়িত হৃদয় হায় হায় করে ওঠে:

আজ খুলিয়াছি
পুরানো স্মৃতির ঝুঁলি
দেখি নেড়েচেড়ে
ভুলের দুঃখগুলি।
হায় হায় এ কী, যাহা কিছু দেখি
সকলি যে পরিহাস্য।

আজও মন উতলা হয়ে ওঠে সেই বোকামির দিনগুলিকে ফিরে পাওয়ার জন্য –

এসো ফিরে এসো সেই ঢাকা বাঁকা হাসি,
পালা শেষ করো আসি।
যদি-বা—
মূঢ় বলিয়া করতালি দিয়া
যাও মোরে সম্ভাষি।

তবু আর একবার ফিরে এসো। যিনি উঠে গেছেন বৈরাগ্যের শেষ গিরিশিরে, যেখান থেকে গত জীবনের দিনগুলিকে কেবল সাদা-কালো পশুদলের মতো দেখবার কথা—সে হৈম শিখরে এ বিষণ্ণ হুতাশ কেন? একটু বেখাপ্পা নয় কি?

এ-সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও শেষ পর্বের রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিক সাধনা ছিল সেই ‘নির্মম’ দেবতাকে নিজের অন্তরে উপলব্ধি করার, যিনি পরম দ্রষ্টা, পরম সাক্ষী, অবিচলিত আনন্দপূর্ণ ধ্যানদৃষ্টি দিয়ে দেখছেন নক্ষত্ররাজির ভাঙাগড়া, মানবজাতির উত্থান-পতন—যেন সারা বিশ্ব জুড়ে অনাদ্যন্ত কাল ধরে এক সংঘাতমুখর তীব্রসুখদুঃখময় মহানাটকের অভিনয় চলেছে তারই সম্ভোগের জন্য। ‘অত্যন্ত নিবিড়ভাবে আমার অন্তরে একটা অনুভূতি এল; সামনে দেখতে পেলুম নিত্যকালব্যাপী একটি সর্বানুভূতির অনবচ্ছিন্ন ধারা, নানা প্রাণের বিচিত্র লীলাকে মিলিয়ে নিয়ে একটি অখণ্ড লীলা। নিজের জীবনে যা বোধ করছি, যা ভোগ করছি, চারদিকে ঘরে ঘরে জনে জনে মুহূর্তে মুহূর্তে যা-কিছু উপলব্ধি চলেছে, সমস্ত এক হয়েছে একটি বিরাট অভিজ্ঞতার মধ্যে। অভিনয় চলেছে নানা নটকে নিয়ে, সুখ-দুঃখের নানা খণ্ডপ্রকাশ চলেছে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রায়; কিন্তু সমস্তটার ভিতর দিয়ে একটা নাট্যরস প্রকাশ পাচ্ছে এক পরম স্রষ্টার মধ্যে যিনি সর্বানুভূঃ। এতকাল নিজের জীবনে সুখ-দুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেছে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে। এমনি করে আপনা থেকে বিবিক্ত হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করা মাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল। তখন জীবনলীলাকে রসরূপে দেখা গেল কোনো-এক রসিকের সঙ্গে এক হয়ে।’[১৪]

এই একই অনুভূতির প্রকাশ আরোগ্য-র ৯-সংখ্যক কবিতায়, সেখানেও কবি জীবনলীলাকে দেখছেন কোনো রসিক পরম স্রষ্টার সঙ্গে এক হয়ে। সেই পরম দ্রষ্টা নটরাজ; এবং লীলা শুধু মানব-জীবনে আবদ্ধ নয়, ‘আতসবাজির খেলা আকাশে আকাশে / সূর্য তারা লয়ে / যুগ-যুগান্তের পরিমাপে।’ এই আতসবাজির খেলায় কবিও এসেছিলেন ‘ক্ষুদ্র অগ্নিকণা নিয়ে / এক প্রান্তে ক্ষুদ্র দেশে কালে।’ কবিতার মধ্যে কিন্তু কবির ভূমিকায় একটা রূপান্তর ঘটে, অভিনেতা থেকে তিনি হয়ে ওঠেন দর্শক, নট থেকে নটরাজ:

দেখিলাম, যুগে যুগে নট নটী বহু শত শত
ফেলে গেছে নানারঙা বেশ তাহাদের
রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে।
দেখিলাম চাহি
শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্য প্রাঙ্গণে
নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।

দর্শকসুলভ নির্লিপ্তির আরো সার্থক রূপায়ণ পরিশেষ-এর “খেলনার মুক্তি”। ছেলে-ভুলানো রূপকথার ভাষায় লঘু পরিহাসের মধ্যে তির্যকভাবে এসে পড়েছে গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, সেই উপলব্ধিজনিত মৃদু বিষণ্ণ নৈরাশ্য। কবিতাটি আর কিছু নয়, একটি পুতুলের বিয়ে না-হওয়ার গল্প:

এক আছে মণি দিদি,
আর আছে তার ঘরে জাপানি পুতুল,
নাম হানাসান—

সেই জাপানি পেশোয়াজ-পরা হানাসানের সঙ্গে বিলেত থেকে আনা কোমরে তলোয়ার বাঁধা জাঁদরেল এক রাজপুত্রের

কাল হবে অধিবাস, পরশু হবে বিয়ে।

কিন্তু বিয়ের আগের রাত্রে কোথা থেকে এলো কালো চামচিকে, ঘরময় ঘুরে ঘুরে ওড়ে আর ‘সঙ্গে তার ঘোরে ছায়া’। তারপরে হানাসানকে নিয়ে যথারীতি চম্পট দিল মেঘের দেশে ‘যেখানে খেলনার স্বর্গ’। কাণ্ডকারখানা দেখে স্বভাবতই পলাতকা কনের মাতৃস্বরূপিণী মণির কান্না, আঙিনায় বটগাছতলায় গিয়ে ব্যাঙগমার কাছে কাকুতি-মিনতি—’হেই দাদা, হেই ব্যাঙগমা’, আমাকেও নিয়ে চলো, হানাসানকে ফিরিয়ে আনি গে। কিন্তু হানাসানকে কি আর পাওয়া যায়, সে যে মেঘে মেঘে রঙে রঙে ছড়িয়ে পড়েছে ‘নানাখানা’ হয়ে। কী হবে তাহলে?

মণি বলে, ‘ব্যাঙগমা দাদা,
এদিকে বিয়ে যে ঠিক,
বর এসে কী বলবে শেষে?’
ব্যাঙগমা হেসে বলে,
‘আছে চামচিকে ভায়া,
বরকেও নিয়ে দেবে পাড়ি।
বিয়ের খেলাটা সেও
মিলে যাবে সূর্যাস্তের শূন্যে এসে
গোধূলির মেঘে।’
মণি কেঁদে বলে, ‘তবে
শুধু কি রইবে বাকি কান্নার খেলা?’
ব্যাঙগমা বলে, ‘মণি দিদি,
রাত হয়ে যাবে শেষ,
কাল সকালের ফোটা বৃষ্টিধোয়া মালতীর ফুলে
সে খেলাও চিনবে না কেউ।’

জীবনভরা সর্বজনীন ব্যর্থতার আর-একটি আশ্চর্য চিত্রণ সেঁজুতি-র “তীর্থযাত্রিণী”। এক বৃদ্ধা নামজপ ঝুলি হাতে নিয়ে ‘জীবনের পথে শেষ আধক্রোশটুকু’ পার হওয়ার জন্য সারাদিন ধরে বসে আছে স্টেশনে কোনো তীর্থগামী ট্রেন ধরবার জন্য। তারই রিক্ত জীবননাট্যের অকিঞ্চন কাহিনী কয়েকটি রেখায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই দু-পৃষ্ঠার কবিতার মধ্যভাগে:

যে যৌবনখানি
একদিন পথে যেতে বল্লভের দিয়েছিল আনি
মধুমদিরার রসে বেদনার নেশা;
দুঃখে-সুখে-মেশা।
সে-রসের রিক্ত পাত্রে আজ শুষ্ক অবলো—
মধুপগুঞ্জনহীন যেন ক্লান্ত হেমন্তের বেলা।

সে রিক্তপাত্র বহুদূরে রইল পড়ে। কোনো পূর্ণ কুম্ভের দুর্মর আশায় আজ অন্য এক বহুদূরের জন্য ভোর থেকে সে বসে আছে, বসে বসে ভাবছে অতীতের রিক্ততার কথা, কিন্তু ভবিষ্যতের পূর্ণতার আভাসে মন আছে ভরপুর:

পরিত্যক্ত একা বসি ভাবিতেছে, পাবে বুঝি দূরে
সংসারের গ্লানি ফেলে স্বর্গ-ঘেঁষা দুর্মূল্য কিছুরে।
হায়, সেই কিছু
যাবে ওর আগে আগে প্রেতসম, ও চলিবে পিছু
ক্ষীণালোকে; প্রতিদিন ধরি-ধরি করি তারে;
অবশেষে মিলাবে আঁধারে।

এ-সব কবিতার মূল সুর বৈরাগ্যের, যে-চিত্ত প্রকাশ পেয়েছে তাকে বিবাগী চিত্ত বলা যেতে পারে বইকি।১৫ কিন্তু মনে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথ প্রথমত এবং শেষতও অনুরাগেরই কবি। তবে তাঁর অনুরাগের রঙ গৈরিক এবং বিবাগী চিত্ত বিশ্বপ্রেমিক। কাব্যে এই দুই বিপরীত ভাবের পরস্পর সম্পূরণ বিষয়ে তিনি যে খাঁটি কথাটি বলেছেন সেটিও এখানে স্মরণীয়: ‘কবির কাজ এই অনুরাগে মানুষের চৈতন্যকে উদ্দীপ্ত করা। …কবির কাব্যে সুরের অসংখ্য বৈচিত্র্য। কিন্তু সমস্তের সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু থাকা চাই, যার ইঙ্গিত ধ্রুবের দিকে, সেই বৈরাগ্যের দিকে যা অনুরাগকেই বীর্যবান ও বিশুদ্ধ করে।’১৬ এই কথাটাই গানের ভাষায় একদিন বলেছিলেন:

চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি,
চেয়ো না, চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি।
রাখিতে চাহ, বাঁধিতে চাহ যাবে, আঁধারে তাহা
মিলায় বারে বারে—
বাজিল যাহা প্রাণের বীণা-তারে
সে তো কেবলি গান, কেবলি বাণী।

সবই চলে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে কালের স্রোতে, তবু মুহূর্তের জন্যেও যে-দৃশ্য ফুটে ওঠে চোখের সামনে তার একটি রসরূপ আছে, সেটি আনন্দস্বরূপ। তা-ই ধ্রুব, তাই ধরে রাখার যোগ্য; আর কিছু নয়।

এটা বিশুদ্ধ কবিমনেরই কথা। কিন্তু ভাবুক কবি জানেন যে, ক্ষণিকতম ঘটনাও মহাকালের মধ্যে বিধৃত, সব কিছুর ক্ষয় আছে তবু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনাদ্যন্তকালব্যাপী যে-সত্তা (the universe viewed sub specie aeternitatis), তা অক্ষয়। সেই মহাকালের কাছে দীক্ষা নিয়েছেন যে-কবি, তিনিও চলমানের মাঝখানে ধ্রুব কেন্দ্রবিন্দুটির সন্ধান পেয়েছেন। তাঁর মনের মধ্যে আর একটি মন আছে, নয়নের পিছনে আর একটি নয়ন—যার কথা উপনিষদকাররা বলে গেছেন। কিন্তু শেষ পর্বের কাব্যে যেটা সবচেয়ে লক্ষণীয় তা ধ্রুবতায় আত্মনিমজ্জন নয়, ধ্রুব ও ক্ষণিকের মধ্যে রবীন্দ্রমানসের টানাপোড়েন, তাঁর দ্বিধাবিভক্ত মূল্যবোধ। কখনো ধ্রুব মহাকাল পান পুষ্পার্ঘ্য, কখনো অমৃতভরা ধাবমান মুহূর্তগুলি।

শেষ সপ্তক-এর একুশ-সংখ্যক কবিতা আরম্ভ হয়েছে ‘অযুত নিযুত কোটি কোটি বৎসরের মাপে’ যে-কাল মাপা হয় তারই নিঃসীম পটে আঁকা ‘ঝাঁকে ঝাঁকে জ্যোতিষ্ক পতঙ্গ’-এর আসা-যাওয়ার চিত্রকল্পে। দ্বিতীয় স্তবকে দৃশ্যবদল হয়, দেখা যায় ‘ছোট ছোট কালের পরিমণ্ডলে’ একের পর এক দর্পোদ্ধতপ্রতাপ কত সভ্যতা বুদ্বুদের মতো উঠল জেগে। সেই সব যুগের ‘আকাঙ্ক্ষার বেদনাকে’ অমর করতে চেয়েছিলেন তখনকার কবিরা। কিন্তু আজ সে বুদ্বুদগুলি যেমন ‘মরুবালুর সমুদ্রে নিঃশব্দে মিশে গেছে, তেমনি ‘নীরব হয়েছে কবির মহাকাব্য’।

মনে হয় এইখানে কবিতা শেষ হবে। ‘নক্ষত্রলোকের নিমেষহীন আলোকের নিচে’ লতাবিতানে বসে কবি বললেন, ‘নমস্কার করি মহাকালকে’ (‘মহাকাল’ শিব ও অনাদ্যন্ত কাল—উভয় অর্থদ্যোতনা বহন করছে)। কিন্তু কবিতা এখানেই শেষ হলো না। ‘নমস্কার’ যেন অক্ষর মহাকালের চরণ এড়িয়ে চলে গেল অধরা মুহূর্তের বেদীতলে। সন্ন্যাসী মহাকালের কাছে যিনি দীক্ষা চেয়েছিলেন, তিনি ধন্য হলেন অমৃতভরা মুহূর্তগুলির অপরিমেয় ঐশ্বর্য পেয়ে:

অমরতার আয়োজন
শিশুর শিথিল মুষ্টিগত
খেলার সামগ্রীর মতো
ধুলায় পড়ে বাতাসে যাক উড়ে।
আমি পেয়েছি ক্ষণে ক্ষণে অমৃতভরা
মুহূর্তগুলিকে—
তার সীমা কে বিচার করবে?
তার অপরিমেয় সত্য
অযুত নিযুত বৎসরের
নক্ষত্রের পরিধির মধ্যে
ধরে না।

মহাকালের ভক্তকবি শেষ পর্বের একাধিক কবিতায় নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়েছেন ক্ষণিকের পায়ে, ‘অনিত্যের বুকে অসীমের হৃৎস্পন্দন’ শুনতে পেয়েছেন। গতি ও সমাপ্তি, ধ্রুব ও ধাবমান, শাশ্বত ও ক্ষণিকের দ্বন্দ্ব কোথায় যেন মিলেছে এক পরম ঐক্যে—কবি বুঝেছেন অথচ বোঝাতে পারছেন না, অথবা বুঝেছেন কিনা তাও ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না, কিন্তু একটা অস্পষ্ট বোধ তাকে একাধারে তৃপ্ত ও ব্যাকুল করে রেখেছে। তার আরো দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক:

এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি
মনে মনে ভাবি, এ কি ক্ষণিকের ‘পরে
অসীমের বরদান,
আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে
দিন হলে অবসান।
একদা শিশিররাতে
শতদল তার দল ঝরাইবে
হেমন্তে হিমপাতে,
সেই যাত্রায় তোমারো মাধুরী
প্রলয়ে লভিবে গতি।
এতই সহজে মহাশিল্পীর
আপনার এত ক্ষতি
কেমন করিয়া সয়,
প্রকাশে বিনাশে বাঁধিয়া সূত্র
ক্ষয়ে নাহি মানে ক্ষয়। (সানাই—”ক্ষণিক”)

প্রেয়সীকে মনে হয় সে আমার জন্মান্তরের জানা,
যে-কালে স্বর্গ, যে-কালে সত্যযুগ,
যে-কাল সকল কালেরই ধরা-ছোওয়ার বাইরে।
তেমনি এই-যে সোনায় পান্নায় ছায়ায় আলোয় গাঁথা
অবকাশের নেশায় মন্থর আষাঢ়ের দিন,
বিহ্বল হয়ে আছে মাঠের উপর ওড়না ছড়িয়ে দিয়ে,
এর মাধুরীকেও মনে হয় আছে তবু নেই,
এ আকাশ-বীণায় গৌড়-সারঙের আলাপ,
সে আলাপ আসছে সর্বকালের নেপথ্য থেকে। (পুনশ্চ—“সুন্দর”)

ক্ষণকাল থেকে আবার দৃষ্টি ফেরানো যাক মহাকালের দিকে। যে সন্ন্যাসী মহাকাল, যে নিস্তব্ধ একাকী নটরাজের কথা রবীন্দ্রনাথ অন্তিম পর্বে বার বার বলেছেন, তাঁকেও মানবোত্তীর্ণ ঊর্ধ্ব গগনচারী কোনো দেবতা বলে আমার মনে হয় না। এঁর সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের পূর্বোদ্ধৃত বাক্যটি প্রযোজ্য—’…কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন, তবে সেকথা বোঝবার শক্তি আমার নেই।’ আমাদের প্রত্যেকের অন্তরের গভীরে একটি ধ্যানী শিব রয়েছেন, যিনি রাত্রির আকাশে সংখ্যাগণনার অতীত নক্ষত্র-নীহারিকাকে এবং অনন্ত দেশকালের মধ্যে অবস্থিত সমগ্র মনুষ্যজাতির ভূতভবিষ্যৎকে নির্লিপ্ত অথচ তন্ময় চোখে দেখছেন। আমারই অন্তর্যামী মহতো মহীয়ান ‘আমি’-র চোখে আমার এই ক্ষুদ্র ‘আমি’-কে তুচ্ছাতি-তুচ্ছ দেখাবে। তবু এই ক্ষুদ্র ‘আমি’-র পক্ষে সম্ভব কোনো দুর্লভ রসোত্তীর্ণ বা জ্ঞানোত্তীর্ণ মুহূর্তে সেই অনাসক্ত অনন্ত অক্ষর দৃষ্টিলাভ করা। কিন্তু সে শাশ্বত মুহূর্তও ধাবমান; শিল্পীর রসমূর্তিতে বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না, যোগীর ধ্যানদৃষ্টিতে তাকে অক্ষয় করার জন্য আজীবন কঠোর তপস্যার প্রয়োজন।

কর্মেও মানুষ পূর্ণ হয়, ধ্যানেও পূর্ণ হয়। আমাদের মধ্যে দুটি ভিন্ন সত্তা রয়েছে—কর্মী ও ধ্যানী (জ্ঞানী এবং শিল্পী উভয়ই ধ্যানী পুরুষেরই ঈষৎ ভিন্ন প্রকাশ; প্রতিতুলনায় কর্মী মানুষের ব্যক্তিস্বরূপের উপাদান ও সংগঠন আলাদা)। তাদের ভিন্নতা মৌলিক। সাধনার এই মার্গদ্বয় আমাদের সামনে খোলা আছে; দুটি কতকটা পরস্পর সম্পূরক হতে পারে, কিন্তু ঠিক সুসমঞ্জস নয়। ধ্যানদৃষ্টি সুপ্রতিষ্ঠিত হলে কর্মোদ্যম কমে আসে; বৈদান্তিকেরা কর্মসন্ন্যাসের কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে, কর্মে নিবিষ্ট হতে হলে দৃষ্টিকে গুটিয়ে নিয়ে আসতে হয় উপস্থিত কর্মক্ষেত্রের সীমিত পরিধিতে। গীতাও জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পেরেছেন বলে তো মনে হয় না; শ্রীঅরবিন্দের গীতাভাষ্য পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে তিনি ওই মার্গদ্বয় দুই ভিন্ন পার্সনালিটি টাইপের জন্য নির্দেশ করেছেন। একই মানুষের মধ্যে দুই বিষম টাইপ সহবাস করতে পারে, তবু দুটি পথ এক নয়।

কর্মী ও জ্ঞানীর (তথা শিল্পীর) অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা ইতিপূর্বে বলেছি, আবারও বলব। আপাতত যা বলতে চাই সেটা এই যে, রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের দুই আরাধ্য দেবতা মানবিক সাধনার দুই ভিন্ন পথের দুটি চরম গন্তব্যস্থল। এই উভয় সাধনমার্গেই তাঁর গতি ছিল অক্লান্ত, তবু উভয়ের গন্তব্যে কোনো বিশ্বাতিগ অদ্বৈত সত্তার সন্ধান পান নি তিনি। পেলে হয়ে যেতেন বৈদান্তিক। আর যা-ই হোক, শংকরাচার্যের পথ রবীন্দ্রনাথের পথ নয়। সব পথ তাঁর অবশ্য একদিন প্রেমময় ও মঙ্গলময় ভগবানে মিলেছিল। কিন্তু চিরকাল মেলে নি।

শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক ও মানসিক ক্লেশ যেমন অত্যধিক ছিল, জাগতিক দুঃখ ও পাপের মাত্রাও তেমনি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে। তখন যদিও তাঁর মন বহু নিরুত্তর প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ ও হতাশায় ভারাক্রান্ত ছিল, তবু তিনি তাঁর সহজাত মানসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্বের ভারসাম্য হারান নি—যেমন হারিয়েছিলেন বহু সমকালীন পাশ্চাত্য সাহিত্যরথী। নটরাজের ধ্যান তাঁকে এক প্রকার বৈরাগ্যমাখা স্থিতপ্রজ্ঞ প্রশান্তি দিয়েছিল; অন্য দিকে মানুষের অপরাজেয় শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনায় বিশ্বাস তাঁকে তিক্ত নৈরাশ্যের কবল থেকে রক্ষা করেছিল মৃত্যুদিন অবধি। ‘নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্যপ্রাঙ্গণে’ যেমন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ‘নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী’, তেমনি দুই মহাযুদ্ধে নির্বাপিতপ্রায় মনুষ্যত্বের ভস্মস্তূপে দেখতে পেয়েছিলেন চিরমানবকে।

এমন উপেক্ষা মরণেরে,
হেন জয়যাত্রা
বহ্নিশয্যা মাড়াইয়া দলে দলে
দুঃখের সীমাস্ত খুঁজিবারে
নামহীন জ্বালাময় কী তীর্থের লাগি—

এ-দৃশ্য সমগ্র ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো কালে কোনো দেশে একজন মানুষও যদি ‘নিজ মর্ত্যসীমা’ চূর্ণ করে থাকে, দুঃখের সীমান্ত খুঁজতে বেরিয়ে থাকে, তবে সেইখানে আমরা দেখতে পেয়েছি ‘নক্ষত্রের ইঙ্গিত’ ভুল হয় নি, সেই একটি মানুষ মনুষ্যত্বকে রক্ষা করেছে দ্বিপদবিশিষ্ট পশুত্বের গ্রাস থেকে, বলে গেছে—এ-জগৎ স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন নয়, কাফকার উপন্যাস নয়।

.

১ ‘শাস্ত্রে যা লেখে তা সত্য কি মিথ্যা বলতে পারি নে, কিন্তু সে-সমস্ত সত্য অনেক সময়ে আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী—বস্তুত আমার পক্ষে তার অস্তিত্ব নাই বললেই হয়।’ রবীন্দ্র-রচনাবলী ১১, পৃ ২৪৯

২ ‘আমার ধর্ম আমার জীবনেরই মূলে; সেই জীবন এখনও চলছে, কিন্তু মাঝখানে কোনো-এক সময়ে তার ধর্মটা এমনি থেমে গিয়েছে যে তার উপরে টিকিট মেরে তাকে জাদুঘরে কৌতূহলী দর্শকদের চোখের সম্মুখে ধরে রাখা যায়—এটা বিশ্বাস করা শক্ত।’ রবীন্দ্র-রচনাবলী ১০, পৃ ১৮৬

৩. অপূর্ণ শক্তির এই বিকৃতির সহস্র লক্ষণ
দেখিয়াছি চারিদিকে সারাক্ষণ,
চিরন্তন মানবের মহিমারে তবু
উপহাস করি নাই কভু। (নবজাতক – “জয়ধ্বনি”)

৪ ‘তা ছাড়া যেমন আগেই লক্ষ্য করেছি, তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) রয়েছে ত্রাণকর্তায় বিশ্বাস, সে বিশ্বাস শেষ দিককার লেখায় অধিক স্পষ্ট।’—শিশিরকুমার ঘোষ: রবীন্দ্রনাথের উত্তরকাব্য, পৃ ২২২

৫ শশিভূষণ দাশগুপ্ত: উপনিষদের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ, পৃ ১২৫

৬ মানুষের ধর্ম, পৃ ১৪

৭ মানুষের ধর্ম, পৃ ১১

৮ মানুষের ধর্ম, পৃ ১১

৯ ‘Whatever character our theology may ascribe to him (God), in reality he is the infinite ideal of Man towards whom men move in their collective growth.’ The Religion of Man, p. 165

১০ মানুষের ধর্ম, পৃ ৯১

১১ মানুষের ধর্ম, পৃ ৭১

১২ মানুষের ধর্ম, পৃ ৭১

১৩ মানুষের ধর্ম, পৃ ২৫

১৪ মানুষের ধর্ম, পরিশিষ্ট, পৃ ৮৯

১৫ (ক) ‘এই “বিবাগী-রাগিণী”ই রবীন্দ্র-কবিপুরুষের প্রাণের রাগিণী—ইহাই রবীন্দ্রকাব্যের আদি ও অন্ত্য সুর।’—মোহিতলাল মজুমদার: রবি-প্রদক্ষিণ, পৃ ৫৭

(খ) ‘রবীন্দ্র-কবিপুরুষের বাণী বৈরাগ্যের বাণী, তাহার সুর বিবাগী চিত্তের সুর। এই বিবাগী বৈরাগী চিত্রই শেষ পর্যন্ত নিজের আজীবন সাধনাকেও কোনো আসক্তি কোনো মোহবন্ধনে বাঁধিল না, দিল ধরণীর গৈরিক ধুলায় অসীম বৈরাগ্যের দিকবিহীন পথে উড়াইয়া।’—নীহাররঞ্জন রায়: রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূমিকা, (৫ম সং) পৃ ২৫০

১৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী ১০, পৃ ২১৫

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন