আবু সয়ীদ আইয়ুব
‘পরিশেষ’ আর ‘পুনশ্চ’ প্রকাশিত হয় এক মাসের ব্যবধানে; দুটোরই রচনাকাল ১৩৩৮-৩৯। ‘পরিশেষ’ নাম শুনলে মনে হয় বইখানা যেন পূর্ববর্তী কাব্যধারার সমাপ্তি-ঘোষণা; রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এটাই তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ, এরপর কবিকর্ম থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করবেন। মুখবন্ধ-স্বরূপ “প্রণাম” কবিতাটিতে সেই ইঙ্গিত রয়েছে—‘এই গীতিপথ-প্রান্তে, হে মানব, তোমার মন্দিরে/ দিনান্তে এসেছি আমি নিশীথের নৈঃশব্দ্যের তীরে/ আরতির সান্ধ্যক্ষণে’। নৈঃশব্দ্যের তীরে এসে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করলেন নতুন এক ভাবসমুদ্র।
নতুন এক রীতিরও (কবি যার কাব্যিক নাম দিয়েছেন ‘গদ্যিকা রীতি’) প্রবর্তন হয় ঐ দুখানি বইতে, কিন্তু ভাবের দিক থেকে পরিবর্তন আরও লক্ষণীয়। সংশয়, প্রশ্ন, ‘নৈরাশ্যের তীব্র বেদনা’, মানসিক দ্বন্দ্ব, তিক্ততা (রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যতখানি তিক্ত হওয়া সম্ভব), সেই সঙ্গে ‘সন্ন্যাসী মহাকালের কাছে দীক্ষা-গ্রহণ’ একদিকে এবং অন্যদিকে পুরোদস্তুর মানবিকতাবাদ— এসবেরই সূত্রপাত ঐ দুখানি পর্বান্তকারী কাব্যে। এর কিছুই হয়তো একেবারে নতুন নয়, প্রথম পর্বেও এসব ভাবের সাক্ষাৎ মেলে। কিন্তু তখনকার কিঞ্চিৎ অপরিণত মনের সে-উপলব্ধি সম্পূর্ণ স্বকীয় ছিল না, পাশ্চাত্ত্য রোম্যান্টিক অ্যাগনির অল্প-বিস্তর সংক্রমণ দেখা যায় ‘মানসী-চিত্রা’র যুগে, তৎপূর্বে তো বটেই। প্রকাশভঙ্গি শিথিল না হলেও শক্ত হয়নি মাংসপেশি, শব্দের জাদুকরি ছিল, গৃহস্থালি ছিল না; ভাবালুতা দোষও চোখে পড়ে— অবশ্য সে-যুগে তা দোষ বলে গণ্য হতো না। পূর্বোক্ত ভাবপুঞ্জকে মাত্রায় ও গুণে, অনুভবে ও অভিব্যঞ্জনায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ পর্বের কাব্যে এমন এক স্তরে তুলে দিয়েছেন যাকে নতুন বলে অভ্যর্থনা করতেই হয়।
‘বলাকা’ রচনাকালে প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘দুঃখের বিরাট স্বরূপ’ দেখে বলেছিলেন বটে—‘তুফানের মাঝখানে/ নূতন সমুদ্রতীর-পানে/ দিতে হবে পাড়ি’, কিন্তু ঠিক তখনই নতুন সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়নি, চেনা সাগরেই তরী বাওয়ার নতুনতর কৌশলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল আরও কিছুকাল। যে-অজানা দেশের ইঙ্গিত ছিল ‘বলাকা’তে, তার সাক্ষাৎ পাই না ‘পূরবী’ কিংবা মহুয়ায়; বরঞ্চ মনে হয় আমরা যেন ‘মানসী’র ভাবলোকেই ফিরে গেছি, তফাত মোটের ওপর কলাকৌশলেই। নতুন পর্বারম্ভের স্বাক্ষর ‘পরিশেষ-পুনশ্চ’-র আগে সুস্পষ্ট নয়।
‘পূরবী-মহুয়া’তে কবি যেন ভাষা ও ছন্দের উৎকর্ষের দিকেই অধিকতর মনোযোগী। সে-মনোনিবেশ শিথিল হয়নি ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশপ্রদীপ’, ‘নবজাতক’ পর্যন্ত, যদিও তার পূর্বেই রবীন্দ্রকাব্যের ঋতুপরিবর্তন ঘটে গেছে। তারপর কঠিন পীড়া ও দেহযন্ত্রণার মধ্যে নতুনতর সৃষ্টির পালা আরম্ভ হল। আমরা সেই অন্তিম পর্বে এসে পৌঁছই যখনকার রচনাকে বৈদিক মন্ত্রকাব্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, শিশিরকুমার ঘোষ যার আরও সঠিক সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘সারাৎসার কাব্য’ এবং সেই কাব্যের চরিত্র-বর্ণনায় ডি. এইচ. লরেন্স-এর পত্রাবলি থেকে উদ্ধৃত করেছেন:
‘Everything can go but the stark, bare, rocky directness of statement that alone makes poetry to-day.’
কিন্তু এই পর্যায়ের শেষেও ভাবের গতি কিংবা আঙ্গিকের বিবর্তন থামত এমন তো মনে হয় না। ‘শেষ লেখা’-র অপ্রত্যাশিত বাঁকে এসে আমরা যখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি নতুন এক কাব্যদিগন্ত দেখতে পাওয়ার প্রত্যাশায় ঠিক তখনই এই চির-পথিকের পথ চলা অকস্মাৎ থেমে গেল একটি বাহ্য কারণে। রোগশয্যা, আরোগ্য কিংবা শেষ লেখা-র লেখনী ক্লান্ত নয় মোটেই; এ-কাব্যগুলির পাতায় পাতায় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা আছে, জরা নেই, মানসিক জরা একেবারে অনুপস্থিত। যিনি ‘অসুস্থ দেহের মাঝে ক্লিষ্ট রচনার যে প্রয়াস’ তাই দেখছেন ‘অনন্ত আকাশে’, তাঁর সেই স্বচ্ছ নির্ভীক দৃষ্টিশক্তি ও রচনাভঙ্গিকে অসুস্থ বা ক্লিষ্ট বলবে কে?
আধুনিক সমালোচকরা যথার্থই বলেছেন, যে-কবিতায় একই বা এক-জাতীয় অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে তার চেয়ে উঁচু দরের বলে গণ্য হবে সেই কবিতা যাতে একাধিক বিভিন্ন ভাবের সমাবেশ ঘটেছে (অবশ্য যদি অনুভূতির প্রকাশ দুটোতে সমান রূপদক্ষতার সঙ্গে হয়ে থাকে)। আরও উঁচু দরের কবিতায় আমরা পাই বিপরীতের সন্নিপাত, যেমন কীটস-এর ‘নাইটিংগেল’-এ, হপকিন্স-এর ভক্তিকাব্যে, এলিয়ট-এর ‘ফোর কোয়ার্টেস্’-এ। রিলকে বলেছিলেন, ‘টেরিব্লনেস’ এবং ‘ব্লিস’ একই সত্তার এপিঠ-ওপিঠ— এই উপলব্ধিটি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পাওয়া যাবে তাঁর শেষ দুখানি কাব্যগ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রান্তিক’-এর ১০ সংখ্যক কবিতায় আক্ষেপ করেছেন যে, তাঁর পরমায়ু শেষ হয়ে এল অথচ ‘চরমের কবিত্ব মর্যাদা’ তিনি পাননি, কারণ ‘জাগিল না মর্মতলে ভীষণের প্রসন্ন মুরতি’।
ভীষণের প্রসন্ন মূর্তি যে দুর্লভ ধ্যানদৃষ্টির সম্মুখে উদ্ঘাটিত হবে তারই জন্য সর্বান্তঃকরণের আকুতি তাঁর শেষ পর্বের কাব্যকে— ‘পরিশেষ’ থেকে ‘শেষ লেখা’ পর্যন্ত— আশ্চর্য সার্থকতা দান করেছে। প্রথম পর্বের কাব্যেও ‘ভীষণ’ একেবারে অনুপস্থিত নন, কিন্তু ভীষণ সেখানে ভীষণই (যেমন ‘ছবি ও গান’-এর “আর্তস্বর” ও “নিশীথ জগত”-এ, ‘মানসী’-র “নিষ্ঠুর সৃষ্টি” ও “সিন্ধু-তরঙ্গ”-এ), এবং মধুর মধুরই— তার উদাহরণ অজস্র। তবে সে-পর্বের কবিতা মোটের ওপর মধুর রসেরই কবিতা। মাঝে মাঝে অভিজ্ঞতা ও কল্পনা অন্য পথে গিয়েছে, কিন্তু তা ক্বচিৎ, এবং সে ক্বচিৎ-আভাসিত অসুন্দরের বা অশুভের ছায়া পড়েনি কবির সমস্ত হৃদয়মনের ওপর। ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’-র কাব্যরসে বৈচিত্র্যের অভাব নেই, এমনকি একই কবিতায় অনেক সময় বিবিধ রসের সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু বিপরীতের টানে কবির মন দীর্ণ হয়নি তখন। নৈরাশ্য ও বিষাদের যতটুকু ধুলো-বালি দেখা দিয়েছিল ‘মানসী’র যুগে, তাও মুছে গেল ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বে এসে। ভক্তিরসে আপ্লুত এই মধ্য পর্বের কাব্যে ভীষণের চেহারা দেখা যায় না তা নয়, কিন্তু তাকে আর ভীষণ বলে চেনাই যায় না। হোক সে ‘ভীষণ তরবারি’ তবু সে যে প্রিয়তমের অভিসার-রাত্রির দান, তাকে বুকে চেপে ধরতে হবে যদি-বা বুক কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মোটের ওপর তখন রুদ্রের দক্ষিণ মুখই দেখা গিয়েছিল, তবে সেই প্রসন্ন মুখের ‘আনন্দ-আবেশ’-ভরা প্রকাশ ‘খেয়া’ থেকে ‘গীতালি’ পর্যন্ত গূঢ় ও বিশ্বস্ত ব্যঞ্জনায় অতুলনীয়।
অবশ্য ঐ একই সময়ে তিনি রচনা করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রতীকী নাটক ‘রাজা’। ‘রাজা’-র প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে সহচরী সুরঙ্গমার সঙ্গে রানী সুদর্শনার সংলাপে পড়ি:
সুদর্শনা। রাজাকে তখন তোর কী মনে হত?
সুরঙ্গমা। উঃ, কী নিষ্ঠুর, কী নিষ্ঠুর, কী অবিচলিত নিষ্ঠুরতা!
সুদ। সেই রাজার ‘পরে তোর এত ভক্তি হল কী করে?
সুর। কী জানি মা! এত অটল, এত কঠোর বলেই এত নির্ভর, এত ভরসা। নইলে আমার মতো নষ্ট আশ্রয় পেত কেমন করে।
সুদ। তোর মন বদল হল কখন?
সুর। কী জানি কখন হয়ে গেল। সমস্ত দুরন্তপনা হার মেনে একদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তখন দেখি, যত ভয়ানক ততই সুন্দর।
এবং শেষ দৃশ্যে সুদর্শনা রাজার কাছে আত্মনিবেদন করে বলছেন: ‘তুমি সুন্দর নও প্রভু, সুন্দর নও। তুমি অনুপম।… যাবার আগে আমার অন্ধকারের প্রভুকে, আমার নিষ্ঠুরকে, আমার ভয়ানককে প্রণাম করে নিই।’ কিন্তু রাজা কিসে ভয়ানক, কোথায় নিষ্ঠুর, তার প্রকাশ নাটকে স্পষ্ট নয়। যা স্পষ্টরূপে ফুটেছে তা রাজার আত্মগোপন করে থাকার ইচ্ছা— যতদিন রানীর চোখ কেবল সুন্দরকে খুঁজছে ততদিন রাজা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে থাকবেন। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ অনুমানে জেনেছিলেন কোথায় যেন ভয়ানক কিছু আছে, নিষ্ঠুর কিছু ঘটছে, কিন্তু সেই নিষ্ঠুর-ভয়ানকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি তখন।
ভয়ানককে আবার দেখা গেল— অন্ধকারে নয়, আলোতেই দেখা গেল— ‘বলাকা’ কাব্যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিকায়। ‘বলাকা’ রবীন্দ্রকাব্যের ইতিহাসে একটি সন্ধিস্থল। মহাযুদ্ধের প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে রবীন্দ্র-কবিপুরুষ খানিকটা দিশাহারা বোধ করেছিল। এত বড় নিদারুণ অভিঘাতকে সহজভাবে গ্রহণ করার যথোপযুক্ত প্রস্তুতি ছিল না ‘গীতাঞ্জলি’র কবির চিন্তায় বা অনুভূতিতে। তাই ‘নৈবেদ্য’তে যেমন, ‘বলাকা’তেও তেমনি জগৎ-জোড়া দুঃখ ও পাপের চেহারাটাকে কবি সহনীয় করে নিতে চাইলেন তাকে ঈশ্বরকৃত শাস্তিবিধানরূপে দেখে— একথা আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এই সহজ সমাধানের ব্যর্থতা তাঁর ধর্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত করল, তাঁর সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গি গেল পালটে।
‘বলাকা’ প্রকাশিত হয় ১৩২৩ সালে, ‘পরিশেষ’ ও ‘পুনশ্চ’ ১৩৩৯-এ। অবশেষে এই ষোলো বছর পরে আমরা সেই ‘নূতন সমুদ্রতীর’-এর কাছে পৌঁছলাম যার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল ‘বলাকা’র ৩৭ সংখ্যক কবিতায়। কয়েকটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কবিতার ব্যঞ্জনা একটু তলিয়ে দেখলে এই নতুন তীরের পরিচয় পেতে আমাদের সুবিধে হবে। প্রগতিসাহিত্যবাদীদের কল্যাণে ‘পরিশেষ’-এর “প্রশ্ন” কবিতাটি বহুল খ্যাতি লাভ করেছে। মার্কসবাদী অর্থে এর মধ্যে বৈপ্লবিক কিছু নেই, কিন্তু রবীন্দ্রমানসের বিকাশে এই কবিতার ভূমিকা ক্রান্তিকারী। এ তো প্রশ্ন নয়, চ্যালেঞ্জ। এ ‘দয়াহীন সংসারে’ এমন বীভৎস পাপ অনেক ঘটে যা কোনো মতেই ক্ষমার যোগ্য নয়, এমন মনুষ্যত্ববর্জিত পাপী আছে আমরা যাদের কিছুতে ভালোবাসতে পারি না। অথচ ঈশ্বরের প্রেরিত দূতেরা বলে গেলেন, ক্ষমা করো সবে, বলে গেলেন ভালোবাসো। ইতিহাসের পাতায় এঁদের নাম লেখা রইল, এঁদের অনুগামীদের সংখ্যা অনেক, কিন্তু কবি তাঁদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন কেবল একটি ব্যর্থ নমস্কার জানিয়ে। তাই কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে যে-ব্যথিত প্রশ্নটি উচ্চারিত হল—‘তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’—তার অন্তরালে একটি অনুচ্চারিত প্রশ্ন রয়েছে: তোমার প্রেরিত দূতেরা কেন এমন অন্যায় উপদেশ দিলেন? আরও উহ্য প্রশ্ন: তোমার সৃষ্টিতে এমন পাপ কেন যা ক্ষমার যোগ্য নয়, এমন মানুষ কেন যাদের ভালোবাসা যায় না কিছুতেই। এ-সব উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত প্রশ্ন ‘নূতন সমুদ্রতীর’-এর দিকনির্দেশক।
‘পরিশেষ’-এর আর একটি কবিতা “ছোটো প্রাণ”-এ কবি মেনে নিচ্ছেন যেখানে ‘সৈন্যবাহিনী বিজয়কাহিনী / লিখে ইতিহাস জুড়ে’ সেখানে আঘাত-সংঘাত, হিংস্রতা ও বর্বরতা অনিবার্য, সেখানে ‘ভাঙা চোরা যত হোক / তার লাগি বৃথা শোক’। কিন্তু মেনে নিতে পারছেন না যখন সহসা ঝঞ্ঝার বা বোমার আঘাতে আর্ত বিলাপ ওঠে নিভৃত কোনো পল্লির ছোটো একটি কুটির থেকে মায়ের কোলে শিশু যেখানে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে। কবিতাটি শেষ হয় এমন একটি বিক্ষুব্ধ প্রশ্নে আস্তিকের মনে যার কোনো উত্তর নেই, সান্ত্বনা নেই:
হে রুদ্র, কেন তারো ‘পরে হানো,
কেন তুমি নাহি জানো
নির্ভয়ে ওরা তোমাকে বেসেছে ভালো,
বিস্মিত চোখে তোমারি ভুবনে
দেখেছে তোমারি আলো।
এই কাব্যগ্রন্থে একই রূপকল্পের তিনটি কবিতা রয়েছে— তার মধ্যে দুটির নামও একই, – “সান্ত্বনা”; তৃতীয়টির নাম “চিরন্তন”। তিনটি কবিতাই মানুষের (‘নিখিল মানবের’) দুঃসহ দুঃখ ও ঘৃণ্য পাপের তীব্র চেতনায় সংরক্ত:
প্রতারণার ছুরি
পাজর কেটে করে চুরি
সরল বিশ্বাস;
………..
নিরাশ দুঃখে চেয়ে দেখি
পৃথিবীব্যাপী মানব-বিভীষিকা
কিংবা,
যে-দুঃখ নিহিত আছে
অপমানে শঙ্কায় লজ্জায়,
কোনো কালে যার অন্ত নাই,
আজি তাই
নির্যাতন করে মোয়ে।
দুঃখের কথা রবীন্দ্রনাথ অনেক বলেছেন, কিন্তু কোনো কালে যে-দুঃখের অন্ত নেই সে-দুঃখের কথা কি আগে বলেছেন? মানুষের পাপের সঙ্গে পরিচয় তাঁর যথেষ্ট ঘটেছিল, কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মানববিভীষিকা কি ইতিপূর্বে এমন মুক্ত চোখে দেখেছেন তিনি? ‘সোনার তরী’-র একটি সনেটে— তখনকার রচনাধারায় কতকটা প্রক্ষিপ্তভাবে— বলেছিলেন বটে:
জানি না, কী হবে পরে, সবই অন্ধকার
আদি অন্ত এ সংসারে— নিখিল দুঃখের
অন্ত আছে কি না আছে।
কিন্তু সোজাসুজি কখনো বলেননি যে, নিখিল দুঃখের কোনো-কালেই অন্ত নেই।
এই নির্যাতন থেকে মুক্তি খোঁজা, কোথাও কোনো কণ্ঠে একটু সান্ত্বনার বাণী শুনতে চাওয়া স্বাভাবিক, উক্ত কবিতাত্রয়ে তার প্রকাশও আন্তরিক। যেটা একটু অস্বাভাবিক ঠেকে তা এই যে, এমন নিদারুণ দুঃখের বিভীষিকায় তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পান এত সহজে— একটি পাখির ডাকে বা একটি বনস্পতির পত্রমর্মরে। রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম পর্বে এটা অস্বাভাবিক ঠেকত না, কিন্তু শেষ পর্বে ঠেকে। অন্ধকার যত ঘন হোক, ঝড়-তুফান যত ভয়ংকর হোক, ডাকলেই কাণ্ডারি এসে হাল ধরবেন— ‘বলাকা’ ও তৎপূর্ববর্তী যুগে এমন প্রত্যয় ছিল মনে। কিন্তু আজ যখন কবি জানেন, ‘সহায় কোথাও নাই’ এবং সকল প্রার্থনাই ব্যর্থ হবে, তখন আকাশ থেকে অকস্মাৎ মানবোত্তীর্ণ আনন্দ ও শান্তির বার্তা বহন করে আনে মানবেতর প্রাণীবিশেষ— এটা কি বিচিত্র নয়?
“সান্ত্বনা” নামের দ্বিতীয় কবিতাটিতে এবং “চিরন্তন”-এ কীটসের “Ode to a Nightingale”-এর ভাবচ্ছায়া পড়েছে। কীটস কিন্তু অবগত ছিলেন যে, এই জগতের—
‘Where youth grows pale, and spectre-thin, and dies;
Where but to think is to be full of sorrow
And leaden-eyed despairs-’
প্রতিকারহীন অন্তহীন বেদনা কেবল মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকা যায় বুলবুলির গান শুনে, কিন্তু সে-গানে জগৎ-যন্ত্রণার কোনো স্থির চূড়ান্ত সান্ত্বনা খোঁজা বৃথা। তাই তাঁর কবিতা শেষ হয় বুলবুলিকে বিদায়-সম্ভাষণে; গান আর শোনা যায় না, বুলবুলিটি কি উড়ে গেল মাঠ নদী পাহাড় পেরিয়ে দূরের কোনো উপত্যকায়, নাকি যে-গানের মধুরিমায় কবি তাঁর সব ব্যথা দুঃখ ভুলেছিলেন, তা কেবল দিবাস্বপ্নই ছিল, একটি কর্কশ শব্দের (‘forlorn’) আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল?
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন পিনাঙের রাস্তা দিয়ে মোটর হাঁকিয়ে যেতে যেতে পীড়িত কল্পনার চোখে চেয়ে দেখছেন ‘পৃথিবীব্যাপী মানব-বিভীষিকা’, ভেবে পাচ্ছেন না ‘কে বাঁচাবে আপন-হানা অন্ধ মানুষেরে’, তখনই পার্শ্ববর্তী কোনো অশোক শাখা থেকে একটি কোকিল ডেকে ওঠে, আর সেই কোকিলের ডাক
পরশ করে প্রাণে
যে-শান্তিটি সব-প্রথমের,
যে-শান্তিটি সবার অবসানে,
যে-শান্তিতে জানায় আমায়
অসীম কালের অনির্বচনীয়,–
‘তুমি আমার প্রিয়’।
কবিতার এই বাঁক ফেরাটা যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি অবাস্তব। “সান্ত্বনা” নামক দ্বিতীয় কবিতাটির পরিণামও তদ্রূপ। মানুষের জীবনের অন্তবিহীন দুঃখ যখন তাঁকে ‘নির্যাতন’ করছে, তখন সহসা অদৃশ্য কোন্ এক পাখির গান এল কানে, আর রবীন্দ্রনাথের মনে হল—
আদিম আনন্দ যাহা এ বিশ্বের মাঝে,
যে-আনন্দ অন্তিমে বিরাজে,
………….
আমারে দেখালে পথ তুমি তারি পানে
এই তব অকারণ গানে।
এ কেমন করে সম্ভব হল?
মানুষের জীবনে— ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে— দুঃখ, পাপ, মূঢ়তা ও হিংস্রতার অন্ত নেই; অথচ প্রকৃতি শান্ত, সুন্দর, নিষ্কলুষ। তাই কি মনুষ্যলোকে কোনো আশা, কোনো সান্ত্বনা খুঁজে না পেয়ে কবি মানুষ থেকে দৃষ্টি ফেরান প্রকৃতির দিকে, ‘সান্ত্বনার চির-উৎস’ খুঁজে পান তারই বর্ণে, গন্ধে, গানে? অনেক সময়ে তাই যেমন পূর্বোক্ত দুটি কবিতাতে। রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘেঁটে তার আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করা যায়, এমনকি, একেবারে শেষ দিককার রচনা থেকেও। ‘সেঁজুতি’র “যাবার মুখে” কবিতাটাই ধরা যাক। কবি যখন বেশ খানিকটা উত্ত্যক্ত হয়ে বলছেন:
যাক এ জীবন, পুঞ্জিত তার জঞ্জাল নিয়ে যাক।
……………….
নিয়ে যাক যত দিনে-দিনে-জমা-করা
প্রবঞ্চনায়-ভরা
নিষ্ফলতার সযত্ন সঞ্চয়।
তখন সহজেই অনুমেয় যে, এই পুঞ্জিত জঞ্জালটা মানবিক। অথচ যখন ‘সকল-কিছুর অবশেষেতে’-ই অক্ষয় মূল্য বহন করে বাকি যা রয় তার কথা বলছেন, তখন দেখা যায়, তালিকাটি সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক:
আমার দুয়ারে আঙিনার ধারে ঐ চামেলির লতা
কোনো দুর্দিনে করে নাই কৃপণতা।
ওই-যে শিমুল, ওই-যে সজিনা, আমারে বেঁধেছে ঋণে-
কত-যে আমার পাগলামি পাওয়া দিনে
কেটে গেছে বেলা শুধু চেয়ে-থাকা মধুর মৈতালি,
নীল আকাশের তলায় ওদের সবুজ বৈতালিতে।
……………
যে মন্ত্রখানি পেয়েছি ওদের সুরে
তাহার অর্থ মৃত্যুর সীমা ছাড়ায়ে গিয়েছে দূরে।
একদিন রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন, ‘সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা করে পৃথিবীটা বস্তুত যেমন, তাকে তেমনি করেই জানবার সাহস থাকা চাই। ছাঁট-দেওয়া সত্য এবং ঘর-গড়া সামঞ্জস্যের প্রতি আমার লোভ নেই।’[২] সেই কথাটা স্মরণ করে বলতে চাই— কোকিলের আলো-ভরা কণ্ঠে বা বনের রহস্যময় পত্রমর্মরে যদি-বা আমরা শুনতে পাই ‘যে-শান্তিটি সব-প্রথমের,/যে-শান্তিটি সবার অবসানে’ তারি স্নিগ্ধ বার্তা, তবু সে-বার্তা কি ছাপিয়ে উঠতে পারে মনুষ্যসমাজ থেকে যে আর্ত চিৎকার ওঠে তার বিরূপ সাক্ষ্যকে? প্রাকৃতিক সুষমা আর মানবিক বিভীষিকা যদি বিপরীত সুর যোজনা করে বিশ্বের ঐকতানে, তবে তার মধ্যে একটি সুরকেই শুদ্ধ বা মূল সুর ভাববার কি কোনো কারণ আছে? মানুষের কানে মানুষের সুরই যদি বেসুর বাজে তবে প্রকৃতির বসন্তবাহার কি তাকে শেষ সান্ত্বনা দিতে পারবে? প্রমথনাথ বিশী ঠিকই বলেছেন: ‘ভগবদ্বিশ্বাসীগণের মধ্যে যাঁহারা ভক্তের হৃদয়কেই ভগবৎ-লীলার একমাত্র আসর মনে করেন, ইতিহাসের মধ্যে তাঁহার পদক্ষেপ স্বীকার করেন না বা সে পদক্ষেপ সম্বন্ধে উদাসীন, তাঁহাদের কর্তব্য সহজ। কিন্তু যাঁহারা ভগবানকে ভক্ত ও ভগবানের খেলাঘরেই আবদ্ধ রাখেন না, মনে করেন যে বৃহৎ ইতিহাসের উত্থানপতনেও তাঁহার লীলা তরঙ্গিত, কবিবর্ণিত সর্বজনীন বীভৎসতা ও ব্যভিচারের মধ্যে কী ভাবে ভগবদভিপ্রায় ব্যক্ত হইতেছে তাহা ব্যাখ্যা করিবার দায় তাঁহাদের। কিন্তু কাজটি সহজ নয়।’ প্রকৃতির সৌন্দর্যের দিকে মনোনিবেশ করলেও কাজটি মোটেই সহজ হয় না। সহজ হয় না, একথা রবীন্দ্রনাথ নিজে ভালোভাবে জানতেন। বহুকাল পূর্বে ‘আত্মপরিচয়’-এ লিখেছিলেন: ‘অনন্ত আকাশে বিশ্বপ্রকৃতির যে শান্তিময় মাধুর্য-আসনটা পাতা ছিল, সেটাকে হঠাৎ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে বিরোধবিক্ষুব্ধ মানবলোকে রুদ্রবেশে কে দেখা দিল? এখন থেকে দ্বন্দ্বের দুঃখ, বিপ্লবের আলোড়ন।’ তাই আমার মনে হয় যে-সব কবিতায় তিনি মানব-বিভীষিকাকে সহনীয় করে নিতে চেয়েছেন চামেলি-সজনের সবুজ বৈতালিতে বা পাখির কণ্ঠে প্রিয়-সম্বোধন শুনে, সেখানে তাঁর কল্পনা কবিত্ব-মণ্ডিত হলেও দৃষ্টি সত্যসন্ধানী নয়।
এর চেয়ে অকুতোভয়, সত্যের কঠিনতম রূপকে মেনে নিতে অকুণ্ঠিত নয় কি আলবের কামুর শিল্পদৃষ্টি? কামুও প্রাণ দিয়ে প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন, তার রূপলাবণ্যে অনাধুনিক মাত্রায় মুগ্ধ ছিলেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জানতেন যে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এমন কোনো পরম কল্যাণময় অনন্ত শক্তির সাক্ষ্য দেয় না যার মধ্যে মানুষের চূড়ান্ত পরিত্রাণের লেশমাত্র অঙ্গীকার আমরা খুঁজে পেতে পারি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মানুষের জীবন অসুন্দরই থাকবে যতদিন না আমরা তাকে সুন্দর করে তুলতে পারি, দুঃখ ও পাপে মগ্ন থাকবে যতদিন না আমরা তার দুঃখমোচন ও কলুষহরণ করতে সক্ষম হই। এ-কাজ মানবোত্তীর্ণ কোনো মঙ্গলবিধানকর্তার সাধ্য নয়, তেমন বিধানকর্তা নেই কোথাও।
শেষ পর্বের রবীন্দ্রনাথেরও স্থায়ী এবং মৌলিক বিশ্বাস অনুরূপ ছিল। তার পরিচয় আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে পাব। মাঝে মাঝে অবশ্য তাঁর বিগত দিনের ‘পিতানোঽসি-বোধ’, ভক্তিপর্বের ‘দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা/তোমারে যেন না করি সংশয়’ ভাব ছিটকে এসে পড়ে শেষ পর্বেও। পড়বেই তো; বহুকাল যে-প্রত্যয় মনে দৃঢ় ছিল, যে-হৃদয়াবেগ প্রবল ছিল, তা জীবনের শেষ দশকে একেবারে ধুয়ে-মুছে যাবে— এমন প্রত্যাশা আমরা করতে পারি না। তবে রবীন্দ্রনাথই বারে বারে বুঝিয়েছেন যে, তাঁর ধর্ম-বিশ্বাস একটা সজীব, সচল পদার্থ, তার ওপর টিকিট মেরে জাদুঘরে রেখে দেওয়ার মতন অটল রূপ সে কখনও ধারণ করেনি। আর মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে লেখা তাঁর দীর্ঘ কাব্য-জীবনের শেষ জবানবন্দীতে প্রকৃতিকে বলেছেন ‘ছলনাময়ী’:
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত
রবীন্দ্রনাথের মহৎ প্রতিভাও কি প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের দ্বারা মাঝে মাঝে প্রবঞ্চিত হয়নি, মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে পড়েনি? আমার তো মনে হয় উপরে উদ্ধৃত কবিতায় সেই বেদনাই প্রকাশ পেয়েছে।
‘বলাকা’-র ১৯ সংখ্যক কবিতার (‘আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে’) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন— ‘বলাকা’ শীর্ষক অধ্যায়ে তার কিছু আলোচনা ইতিপূর্বেই করেছি— সেটাকেও প্রকৃতির ছলনাময়ী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের সাক্ষ্যরূপে ভাবা যেতে পারে, অন্তিমকালে কবি স্বয়ং হয়তো তাই ভেবেছিলেন।
সমস্ত পৃথিবীটা যদি-বা সদ্যফোটা ফুলের মতো সুন্দর হয়, বাহ্য প্রাকৃতিক দৃশ্যে সৌন্দর্যের ওপর এমফ্যাসিস যদি-বা স্পষ্টতই পড়ে থাকে, তাতে কি প্রমাণ হয় যে মানুষের ব্যক্তিসত্তা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে মিলিয়ে যাবে না? সুন্দরতম পরিবেশে কুৎসিততম পাপ ও দুর্বিষহতম দুঃখ ঘটেই থাকে। রূপে, গন্ধে, বর্ণে অতি মনোহরা বসুন্ধরার কোলে তার অসহায় সন্তানেরা মুহূর্তের নিরর্থকতায় নিঃশেষ হয়ে যাবে— এটা ভয়ংকর হলেও অসম্ভব নয়। প্রকৃতির মনোহারিতা কিছুই প্রমাণ করে না; তার মধ্যে এত বড় প্রমাণ দেখতে পাওয়া মানেই হচ্ছে প্রকৃতির নিপুণ হাতে পাতা বিচিত্র ছলনাজালে ধরা দেওয়া। ফুল্ল অশোক শাখায় বসে কোকিল যত বিমল সুরেই ডাকুক, তার ‘গভীর রমণীয়’ সুরব্যঞ্জনা কবিকে বলতে পারে ‘তুমি আমার প্রিয়’, কিন্তু এ-আশ্বাস দিতে পারে না যে, মানববিভীষিকার পরপারে বিশ্বের আদিতে ও অন্তে পরম শান্তি বিরাজমান। এমনতর কবিকল্পনা ছোটো অর্থে সুন্দর হতে পারে কিন্তু কোনো মহৎ অর্থে নয়, কারণ তাতে জগতের কঠিন সত্যকে একটু মোলায়েম করে নেওয়ার দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
পূর্বোদ্ধৃত কবিতার পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলিতে কবি বলছেন:
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।
প্রকৃতি বিষয়ে পর পর দুই আপাতবিপরীত উক্তিতে (ছলনাময়ী ও পথপ্রদর্শক) সত্যিই কিন্তু কোনো বিরোধ নেই। প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষকে মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে ফেলে তখনই যখন তাতে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ভাবে বিশ্বের বিধানে সব-কিছুই সুন্দর, আপাতত না হলেও বস্তুত মানব-ভাগ্যের অনুকূল। কিন্তু জ্যোৎস্না রাত্রে চামেলির গন্ধ-জাতীয় সহজ মনোহারিতা থেকে চোখ তুলে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর দিকে যখন সে তাকায় তখন ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ’ থেকে মুক্ত হয়। কারণ নাক্ষত্রিক জগৎ মনোহর নয়, সাব্লাইম; শুধু তার কল্পনাতীত দূরত্ব ও আকারই নয়, তাতে যে অভাবনীয় শক্তিসমূহের আঘাত-সংঘাত, সৃষ্টি-প্রলয় নিরন্তর চলছে তা আমাদের জানিয়ে দেয় যে, অনন্ত অনাদ্যন্ত বিশ্ব সেই বিরাট অর্থে ‘সুন্দর’— ‘নিষ্ঠুর’ ও ‘ভয়ানক’-ও যার অভিধাভুক্ত। রবীন্দ্রনাথ এই নিষ্ঠুর ও ভয়ানককে প্রণাম জানিয়েছিলেন বহুকাল পূর্বে রানী সুদর্শনার মুখে, আজ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আবার তাকে প্রণাম জানাচ্ছেন। ভয়ানক এবং সুন্দরকে একত্র দেখতে পাওয়া তাঁর জীবনের ‘শেষ পুরস্কার’। এই পুরস্কার যে পেয়েছে—
সত্যরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে।
রবীন্দ্রপ্রতিভার শেষতম অভিব্যক্তি থেকে ফেরা যাক ‘পরিশেষ’-এর “সান্ত্বনা” নামক অন্য কবিতাটিতে (‘যে বোবা দুঃখের ভার’)। ঐ বইয়ের সান্ত্বনা-বিষয়ক পূর্বোল্লিখিত অন্য দুটি কবিতা থেকে বেশ একটু আলাদা এর সুর, রোম্যান্টিক ভাবাবেগের সঙ্গে মিশেছে আইরনির বোল। মানুষের অসহায় অপ্রতিকার্য দুঃখকষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে কবি কল্পনা করছেন, ‘সর্ব দুঃখ সন্তাপ’ যখন ‘উদার মাটির বক্ষোদেশে’ নেমে যাবে তখন সেই মাটিতে—
বনস্পতি প্রশান্ত গম্ভীর
সূর্যোদয়-পানে তোলে শির,
পুষ্প তার পত্রপুটে
শোভা পায় ধরিত্রীর মহিমামুকুটে।
একে প্রকৃতির পরিহাস ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে? সে-পরিহাসকে মেনে নিয়ে কবিতার শেষে ‘সুন্দরের ভৈরবী রাগিণী’-র কথা বলেছেন কবি:
বোবা মাটি, বোবা তরুদল,
ধৈর্যহারা মানুষের বিশ্বের দুঃসহ কোলাহল
স্তব্ধতায় মিলাইছে প্রতি মুহূর্তেই,—
নির্বাক সান্ত্বনা সেই
দেখিলাম সব ব্যথা প্রতিক্ষণে লইতেছে জিনি
সুন্দরের ভৈরবী রাগিণী।
‘আরোগ্য’-র ছোটো একটি কবিতা ২৫ সংখ্যা তার শিরোনাম:
বিরাট মানবচিত্তে
অকথিত বাণীপুঞ্জ
অব্যক্ত আবেগে ফিরে কাল হতে কালে
মহাশূন্যে নীহারিকাসম।
সে আমার মনঃসীমানার
সহসা আঘাতে ছিন্ন হয়ে
আকারে হয়েছে ঘনীভূত,
আবর্তন করিতেছে আমার রচনা-কক্ষপথে।
চিত্রকল্পটি সুন্দর, সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করে, রবীন্দ্রনাথের মতো কবির রচনায় তার পৌনঃপুনিক উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত নয়। ‘নবজাতক’-এর “কেন” শীর্ষক কবিতায়ও এর প্রয়োগ সার্থক হয়েছে। চিত্রকল্পটি কিন্তু অনেক বেশি বেদনাময় ও মর্মগ্রাহী হয়ে ওঠে যখন ‘বাণীধারা’ রূপান্তরিত হয় অশ্রুধারায়:
অশ্রুধারার ব্রহ্মপুত্র
উঠছে ফুলে ফুলে
তরঙ্গে তরঙ্গে;
সংসারের কূলে কূলে
চলে তার বিপুল ভাঙাগড়া
দেশে দেশান্তরে।
চিরকালের সেই বিরহতাপ, চিরকালের সেই মানুষের শোক,
নামল হঠাৎ আমার বুকে;
এক প্লাবনে থরথরিয়ে কাপিয়ে দিল
পাঁজরগুলো—[৫]
সব ধরণীর কান্নার গর্জনে
মিলে গিয়ে চলে গেল অনন্তে,
কী উদ্দেশে কে তা জানে।
অকথিত বাণীপুঞ্জ যেমন মহাশূন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মানুষের দুঃখশোকের অশ্রুধারাও কি তেমনি দেশে দেশান্তরে তরঙ্গে তরঙ্গে ফুলে ফুলে উঠছে যুগ যুগ ধরে? কী উদ্দেশে? দুটি চিত্রকল্পের তাৎপর্য কিন্তু এক নয়, প্রশ্নের তীব্রতাও ভিন্ন। অকথিত বাণীপুঞ্জ বায়বীয় নেবুলার মতো মহাকাশে ভ্রাম্যমাণ— এই কল্পনাটি কৌতুকপ্রদ, তার বেশি কিছু নয়। কী উদ্দেশে তা কবিবিশেষের চিত্তে ঘনীভূত হয়ে শিল্পরূপ পরিগ্রহ করে, আবার মহাশূন্যে হারিয়ে যায়— প্রশ্নটি সাহিত্যিক কৌতূহল প্রকাশ করে মাত্র। কিন্তু দেশে দেশে যুগে যুগে দুঃখের তরঙ্গ ফুলে ফুলে উঠছে— এটা কল্পনা নয়, নিষ্ঠুর বাস্তব। ‘কী উদ্দেশে’ প্রশ্নটিও নিছক কৌতূহলব্যঞ্জক নয়, একটি ধর্মনীতিক বিচার তাতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে— এমন তো হওয়া উচিত ছিল না তবু এমনটা হল কেন, কার কোন্ নিগূঢ় উদ্দেশ্য সাধন করছে এই অশ্রুধারার ফুলে-ফুলে-ওঠা ব্রহ্মপুত্র?
প্রশ্ন ও বিচারের ইঙ্গিত আরও উঁচু পর্দায় ওঠে বীথিকার “দুর্ভাগিনী” কবিতায়। “বিশ্বশোক”-এর প্রশ্ন উত্তরের সম্ভাবনা-রহিত ছিল না, প্রশ্নকর্তার মনের কোণে একটুখানি আশা রয়েছে যে এই জাগতিক শোকের এবং সেই শোকতরঙ্গের দ্বারা একজন ব্যক্তির হৃদয়কে হঠাৎ প্লাবিত করে দেওয়ার কারণপরম্পরার মধ্যে হয়তো কোনো মহাকল্যাণময় উদ্দেশ্য নিহিত আছে, যদিও সে-উদ্দেশ্য আমাদের মানুষী বুদ্ধির কাছে মোটেই পরিষ্কার নয়। কিন্তু **”দুর্ভাগিনী”**র ‘কেন, ওগো কেন’ স্পষ্টতই সেই চিরপ্রশ্ন-সমূহের অন্যতম যার ‘বেদীসম্মুখে চিরনির্বাক রহে বিরাট নিরুত্তর’। কবির সব দিক থেকে দুর্ভাগিনী কন্যার শেষ ভরসা ছিল দীপ্তিমান তরুণ পুত্র নীতীশ। সেই নীতীশ জার্মানির এক হাসপাতালে যক্ষ্মারোগের অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় ভুগে ভুগে মারা গেল— তারই মৃত্যুসংবাদ পেয়ে এই কবিতাটি রচিত। কিন্তু সেটা উপলক্ষ্য মাত্র, কবিতার বিষয়বস্তু একটি ব্যক্তির শোক নয়; অথবা সেই ব্যক্তির অশেষ দুঃখ জগতের দুঃসহতম দুঃখ ও হতাশার প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে ঐ কবিতায়। ‘দুঃখের স্তম্ভিত নীরন্ধ্র অন্ধকার’-কে মহিমান্বিত করে দেখানোই প্রারম্ভিক উদ্দেশ্য ছিল মনে হয়: ‘তোমার সম্মুখে এসে, দুর্ভাগিনী, দাঁড়াই যখন/নত হয় মন।’ কিন্তু পরবর্তী পঙ্ক্তিতেই প্রলয়ের কথা বলা হয়েছে, ‘যেন ভয় লাগে/প্রলয়ের আরম্ভেতে স্তব্ধতার আগে।’ কোন্ প্রলয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন কবি?
ফিরিছ বিশ্রামহারা ঘুরে ঘুরে,
খুঁজিছ কাছের বিশ্ব মুহূর্তে যা চলে গেল দূরে;
… … … …
দেবতা যেখানে ছিল সেথা জ্বালাইতে গেলে ধূপ,
সেখানে বিদ্রূপ।
এর পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলিতে আর কোনো আড়ালই রইল না, শুধু বিশ্বই ভেঙে পড়ছে না, তার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের দেবতার ওপর বিশ্বাসও ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে:
সর্বশূন্যতার ধারে
জীবনের পোড়ো ঘরে অবরুদ্ধ দ্বারে
দাও নাড়া;
ভিতরে কে দিবে সাড়া।
মূর্ছাতুর আঁধারের উঠিছে নিঃশ্বাস,
ভাঙা বিশ্বে পড়ে আছে ভেঙে-পড়া বিপুল বিশ্বাস।
কবিতার শেষে যে-বিদ্রোহী যন্ত্রণা চিৎকার করে ওঠে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে, তা কি কেবল কবিতার নায়িকারই মনের কথা:
তুমি স্থির সীমাহীন নৈরাশ্যের তীরে
নির্বাক অপার নির্বাসনে।
অশ্রুহীন তোমার নয়নে
অবিশ্রাম প্রশ্ন জাগে যেন—
কেন, ওগো কেন!
সীমাহীন নৈরাশ্যের তীরে নির্বাসিত শুধু দুর্ভাগিনী কন্যা নন, “দুর্ভাগিনী”-রচয়িতাও; বহু দূরে ছেড়ে এসেছেন সেই ভক্তি-শ্যামল মানস-ভূমি ‘জীবন যেখানে ছিল ফুলের মতো’, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি সহজে বলতে পারতেন ‘দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন / পার আছে রে— এই সাগরের / বিপুল ক্ৰন্দন’ ।
‘কেন’ শব্দটি শেষ পর্বের কাব্যে বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নতুন এক কবি-পুরুষের পরিচয় লাভ করছি। কেবল সংখ্যা-গণনার দিক দিয়ে এই শব্দটি যে আগের চেয়ে খুব বেশি লক্ষণীয় তা নয়। ‘কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ’, ‘কেন নিবে গেল বাতি’, ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’, ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে / কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে / এমন গানে গানে’, ‘নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে / তারি মধু কেন মন-মধুপে খাওয়াও না’, ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না / শুকনো ধুলো যত’— ইত্যাদি শত শত ‘কেন’-সংবলিত কবিতা ও গান মনে আসে পূর্ব যুগের রচনা থেকে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে একটু আগে উদ্ধৃত “দুর্ভাগিনী” কবিতার শেষ ছত্রের ‘কেন, ওগো কেন’-র তুলনা করলেই দেখা যাবে ‘কেন’ শব্দের অর্থব্যঞ্জনায় যুগান্তর এসেছে। “প্রশ্ন” শীর্ষক একাধিক কবিতা পাওয়া যাবে শেষ পর্বে; নবজাতক-এর একটি কবিতার নাম “কেন”। কবিতাটির বিষয়বস্তু কবির নবার্জিত জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে নেওয়া। জড়জগতে, প্রাণীলোকে, মানবেতিহাসে এমন প্রভূত, অপরিমেয় অপচয় (‘আপন সৃষ্টির ‘পরে বিধাতার নির্মম অন্যায়’) কেন? মহাযুদ্ধে, খণ্ডযুদ্ধে, গৃহযুদ্ধে মনুষ্যজাতির পৌনঃপুনিক মূঢ় আত্মজিঘাংসাই রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে পীড়িত করেছে, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে সমস্ত সৌর জগৎ এবং যাবতীয় নক্ষত্রলোকের অবধারিত ‘তাপমৃত্যু’র বিভীষিকা। সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে, ধর্মে-কর্মে মানুষ যদি-বা উপরে উঠতে পারে এবং যতই উপরে উঠুক, এমন দিন আসবেই যখন মানুষের তথা প্রাণীমাত্রের প্রাণধারণ আর সম্ভব হবে না— সূর্যের অবধারিত তাপক্ষয়ের পরিণামস্বরূপ। এ-বিষয়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের সুদৃঢ় প্রাগুক্তি রয়েছে। তার পরে আবার যদি নীহারিকা-সৃষ্টির পালা শুরু হয় তবে বৈজ্ঞানিক নিয়ম মতে আবারও সেই সার্বিক ‘তাপমৃত্যু’ ঘটবে।
নিত্য নিত্য এমনি কি
অফুরান আত্মহত্যা মানবসৃষ্টির নিরন্তর প্রলয়বৃষ্টির
অশ্রান্ত প্লাবনে।
নিরর্থক হরণে ভরণে
মানুষের চিত্ত নিয়ে সারাবেলা
মহাকাল করিতেছে দ্যুতখেলা
বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন—
কিন্তু, কেন।
পরবর্তী স্তবকে অনুরূপ আর-একটি প্রশ্নের কথা বলা হয়েছে— ‘প্রথম বয়সে কবে ভাবনার কী আঘাত লেগে / এ প্রশ্নই মনে উঠেছিল জেগে’। তরুণ কবি জানতে চেয়েছিলেন, ‘বিশ্বের কোন্ কেন্দ্রস্থলে / মিলিতেছে প্রতি দণ্ডে পলে / …জীবনের মরণের নিত্যকলরব’। কিন্তু সেই প্রথম বয়সেরও কল্পিত নিরসন এই নয় যে ‘ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরকন্দর-মাঝে’ অখণ্ড পূর্ণতা বিরাজিত। সেখানে বিরাজ করে কেবল একটি ‘প্রতিধ্বনিমণ্ডল’, এবং সেই প্রতিধ্বনিমণ্ডলে ‘বাঁধে বাসা / চতুর্দিক হতে আসি জগতের পাখা-মেলা ভাষা’। কবিতার এই অংশে (কোনো অংশেই) অখণ্ড পূর্ণতা বা লাভক্ষতির হিসাব মেলাবার কোনো কথা নেই—যদি না আমরা অখণ্ডতা বা হিসাবের মিল খুঁজে পাই মানুষের চিত্ত নিয়ে ‘বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে’ অনন্তকাল ধরে যে দ্যূতখেলা চলছে তার বিষয়ে কবি যে-কাব্যরচনা করেন সেই কাব্যের অক্ষয় সৌন্দর্যে। কারণ কবি বলছেন সেই প্রতিধ্বনিমণ্ডল থেকে—
বহু যুগযুগান্তের কোন্ এক বাণীধারা
নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠেকি পথহারা
সংহত হয়েছে অবশেষে
মোর মাঝে এসে।
কিন্তু মহাকালের নিরর্থক দ্যূতখেলার মধ্যে এই যে যুগযুগান্তের বাণীধারা এসে কবিচিত্তে সংহত হয়ে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর কাব্যের জন্ম দিল, তার মধ্যেও কি সৃষ্টির অর্থ এবং সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব? সম্ভব হ’ত যদি সর্বত্যাগী অপব্যয়ের মধ্যে এইটুকু সঞ্চয়ও থাকত। কিন্তু এই বাণীধারার প্রতিও মহাকাল সমান নির্দয়। তাই নিয়ে কবির শেষ প্রশ্ন:
প্রশ্ন মনে আসে আরবার,
আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার—
রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে
চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে?
উজাড় করিয়া দিবে তার
পান্থের পাথেয়পাত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার—
ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভাণ্ড-হেন?
কিন্তু, কেন।
প্রশ্নটা প্রকৃতপক্ষে এই নয় যে, এই বাণীধারার সূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে কি না। সে-আলংকারিক প্রশ্নের উত্তর উহ্য রয়েছে কিন্তু মোটেই অস্পষ্ট নয়— হয়ে যাবেই। ঐ উত্তর থেকেই আসল প্রশ্নের উৎপত্তি— ‘কিন্তু কেন’? এই রূপহারা গতিবেগের প্রেত-লোকে এইটুকু পাথেয়ের পাত্রও কেন উজাড় ক’রে দিতে হবে ‘আপন স্বল্পায়ু বেদনায়’? এ-প্রশ্নও শূন্যে বাজতে থাকবে, ‘ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর’।
‘ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর’ যে-কবিতার শেষ পক্তি, তা কিন্তু নবজাতক-এর ভিন্ন একটি কবিতা, নাম “প্রশ্ন”। আরো গভীর, হতাশ, হৃতবিশ্বাস তার সুর। একজন তরুণ কবি-সমালোচক আপত্তি তুলেছেন— ঐ কবিতার অনেক অংশ একটি সম্ভাব্য কবিতার পদ্য-ভাষ্য মাত্র, কবিতা হয়ে ওঠে নি। “কেন” সম্পর্কে এ-ধরনের আপত্তি আরও সোচ্চার হতে পারত। গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে তার বিস্তারিত উত্তর দেবার চেষ্টা করেছি। এখানে শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, রবীন্দ্রনাথের কানেও এমনতর আপত্তির কথা পৌঁছেছিল— তাঁর শেষ দিককার কবিতা নাকি চিন্তাগর্ভ, হৃদয়-সঞ্জাত নয়, সেই কারণে বিশুদ্ধ কবিতা নয়। এই আপত্তির উত্তরে তিনি নিজে যে-সংক্ষিপ্ত প্রশ্নাত্মক বাক্যটি ধূর্জটী-প্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন তা স্মরণীয় এবং অবিস্মরণীয়: ‘চিন্তাগর্ভ কথার মুখে কোনোখানে অচিন্তের ইঙ্গিত কি লাগল না?’ আমি শুধু যোগ করব যে, মহৎ কবিতা আমরা তখনই পাই যখন কোনো গভীর চিন্তাগর্ভ কথা তৎসম্ভূত ও তদাবরক হৃদয়ানুভূতির বিস্তৃত পরিমণ্ডল-সুদ্ধ ব্যক্ত হয়। অনুভূতি না থাকলে কবিতা হয় না, কিন্তু অনুভূতিমাত্র কবিতার সম্বল নয়, শুধু চিত্রকল্প অর্থাৎ অপ্রতীকী চিত্রকল্পও নয়। কাব্যের উপাদানগুলি কবিতার মধ্যে অর্থবান না হয়ে উঠলে কবিতা হয় না। রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কবিতা এই মানদণ্ডে বিচার্য। রবীন্দ্র-পরবর্তীদেরও।
রোগশয্যায়-এর ৭ ও ৮ সংখ্যক কবিতা পরস্পর-সম্পূরক; একই কবিতার দুই স্তবকও বলা যেতে পারে। এই যুগ্মকবিতার শিরোনামা হতে পারত ‘মনে হয়’— দুটি কবিতার মূলে রয়েছে ঐ ‘মনে হওয়া’। মনে হয় যা তার মধ্যে প্রত্যক্ষত পরম আশ্রয়ের স্বীকৃতি রয়েছে, অন্ধকার ছিন্ন ক’রে আলোরই জয় হবে, অন্তহীন কাল ক্ষীণপ্রাণ মানুষের দায় স্বীকার ক’রে নেবে— এমনতর ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু তারই মধ্যে আবার ঐ অঙ্গীকার নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার, আকাশের মুখ পাণ্ডুবর্ণ হয়ে ওঠার অনিবার্যতাও সুনির্দেশিত। প্রতীকী কাব্যের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই সংক্ষিপ্ত, ঘনসন্নিবদ্ধ যুগ্ম কবিতার সমস্তটাই উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
৭
গহন রজনী-মাঝে
রোগীর আবিষ্ট দৃষ্টিতলে
যখন সহসা দেখি
তোমার জাগ্রত আবির্ভাব,
মনে হয়, যেন
আকাশে অগণ্য গ্রহতারা
অন্তহীন কালে
আমার প্রাণের দায় করিছে স্বীকার;
তার পরে জানি যবে
তুমি চলে যাবে,
আতঙ্ক জাগায় অকস্মাৎ
উদাসীন জগতের ভীষণ স্তব্ধতা।
৮
মনে হয় হেমন্তের দুর্ভাষার কুাটিকা-পানে
আলোকের কী যেন ভর্ৎসনা
দিগন্তের মূঢ়তারে তুলিছে তর্জনী।
পাণ্ডুবর্ণ হয়ে আসে সূর্যোদয়
আকাশের ভালে,
লজ্জা ঘনীভূত হয়,
হিমসিক্ত অরণ্যছায়ায়
স্তব্ধ হয় পাখিদের গান।
যাবতীয় দ্যাবাপৃথিবী থেকে আশ্রয়ের শেষ চিহ্নটাও কি মুছে গেছে? নইলে বিনিদ্র গভীর রাত্রে প্রিয়জন কেউ অল্প-ক্ষণের জন্য শুশ্রূষার কাজে ঘরে এলে কেন মনে হয় গ্রহতারা সস্নেহে কথা ব’লে উঠেছে, আর চ’লে গেলেই সমস্ত জগৎ একেবারে উদাসীন হয়ে যায়? এমন উপলব্ধির তাৎপর্য কী? আশার রেশটুকু ধরে রাখার কী অপরিসীম ব্যাকুলতা; অথচ কবিতার মধ্যে আশ্বাসের বাণী একবার শুধু আলোকের ভর্ৎসনায় সোচ্চার হয়ে উঠেই থেমে যায়, তার পরে কবির চারিদিকে রয় কেবল উদাসীন জগতের ভীষণ স্তব্ধতা— যে-স্তব্ধতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাস্কালের সেই বিখ্যাত উক্তি: ‘অনন্ত আকাশের স্তব্ধতা আমার চিত্তে আতঙ্ক সঞ্চার করে।’ দ্বিতীয় স্তবকে আলোর ভৎসনা শুনে স্বভাবতই আশা জাগে— কুাটিকা স’রে যাবে বুঝি। কিন্তু যায় না; বরঞ্চ সূর্যোদয়ই ফ্যাকাশে হয়ে আসে। ভোরের আলোর ক্ষীণাভাসটুকু দেখতে পেয়ে অরণ্যের পাখিরা গান গেয়ে উঠেছিল, সে-গানও থেমে যায়, সারা পৃথিবীর স্তব্ধতা সব-কিছুকে গ্রাস করে। এমনি এক সর্বগ্রাসী নিস্তব্ধতার মধ্যেই কি ডুইনো এলিজি-র প্রথম পঙ্ক্তিটি উচ্চারিত হয়েছিল—
Who, if I cried, would hear me among the angelic orders?
রবীন্দ্রনাথ ও রিলকে, এ-শতাব্দীর দুই মহান কবির সেই একই চূড়ান্ত ঘোষণা:
…For Beauty’s nothing
but beginning of Terror we’re just able to bear,
and why we adore it so is because it serenely
disdains to destroy us. Each single angel is terrible.
অস্থির সত্তার রূপ ফুটে আর টুটে,
‘নয় নয়’ এই বাণী ফেনাইয়া মুখরিয়া উঠে।
মুক্তাকাশে দেখো চেয়ে প্রলয়ের আনন্দ স্বরূপ।
ওরে শোকাতুর, শেষে
শোকের বুদ্বুদ তোর অশোক সমুদ্রে যাবে ভেসে।
সানাই-এর বেশির ভাগ কবিতা প্রেমের, রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা ও গান এ-বইয়ের অন্তর্ভুক্ত— ‘ভালোবাসা এসেছিল / এমন সে নিঃশব্দ চরণে’, ‘এসেছিলে তবু আসো নাই, তাই / জানায়ে গেলে’, ‘তব দক্ষিণ হাতের পরশ / করো নি সমর্পণ’, ‘তোমায় যখন সাজিয়ে দিলেম দেহ’, ‘পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ, যবে ভাবিনু মনে’, ইত্যাদি। সানাই মধুর রসের শেষ কাব্যগ্রন্থ, কবির বয়স তখন আশির কাছাকাছি। এই শেষ দাক্ষিণ্যের মাঝখানে হঠাৎ চমকে উঠি একটি ছোট্ট কবিতায় এসে। কোনো (কোন্?) “ব্যথিতা”কে নিয়ে ঐ নাম দিয়ে লেখা এ-কবিতা:
জাগায়ো না, ওরে জাগায়ো না।
ও আজি মেনেছে হার
ক্রুর বিধাতার কাছে।
সব চাওয়া ও যে দিতে চায় নিঃশেষে
অতলে জলাঞ্জলি।
দুঃসহ দুরাশার
গুরুভার যাক দূরে
কৃপণ প্রাণের ইতর বঞ্চনা।
কী সে বঞ্চনা যার স্বরূপ বোঝাতে গেলে ‘ইতর’ শব্দটি ব্যবহার না করলেই নয়? কে তাকে ইতরভাবে বঞ্চিত করেছিল? তারই ‘কৃপণ প্রাণ’– গানের ভাষায় যা হয়েছে ‘অকিঞ্চন জীবন’? কিন্তু প্রাণকে ইতর বলা মানে তো প্রকৃতিকে ইতর বলা। প্রকৃতি কি স্বয়ংচালিত, অনীশ্বরবিহিত? তৃতীয় পঙ্ক্তিতে বিধাতাকে স্পষ্ট অদ্ব্যর্থ ভাষায় ‘ক্রূর’ বলা হয়েছে। কেমন ক’রে রবীন্দ্রনাথ— বিশ্বযুদ্ধ লোক যাঁকে গীতাঞ্জলি-রচয়িতা ভক্ত কবি ব’লেই চেনে— এই শব্দগুলি এক বঞ্চিতার দুঃখ বর্ণনা করতে অসংকোচে ব্যবহার করলেন, এবং তার একটি অন্তত সোজাসুজি ঈশ্বরের প্রতি আরোপ করলেন?[৭]? কোন্ কশাঘাততুল্য ব্যক্তিগত কিংবা সমাজগত অভিজ্ঞতা (বা অভিজ্ঞতার স্মৃতি) তাঁকে শেষ জীবনে অন্তত একবারের মতোও ব্ল্যাফেমির আশ্রয় নিতে বাধ্য
শেষ পর্বের কবিতার ফলশ্রুতি কি তবে এই যে,
অন্তিম দশকে রবীন্দ্রনাথের মন হয়ে উঠেছিল সর্বব্যাপী দুঃখ ও পাপ বিষয়ে অতীব চেতন, সত্য-শিব-সুন্দরের পরমতা বিষয়ে সন্দিহান, মঙ্গলময় বিধাতার অস্তিত্ব সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সর্বতোভাবে নিরাশ, নিরুৎসাহ, নিরানন্দ? না।
.
১ শিশিরকুমার ঘোষ— রবীন্দ্রনাথের উত্তরকাব্য, পৃ ১৯২
২ রবীন্দ্র-রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ ১৮৯
৩ প্রমথনাথ বিশী— রবীন্দ্র-সরণী, পৃ ৩৯৯
৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ ১৯৪
৫ ‘বুঝতে পারছি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে সুরেন পেরে উঠবে না, এত কষ্ট পাচ্ছে। নানারকম কষ্টের ভিতর দিয়ে ওর জীবনটা গেল। অমন মানুষের ভাগ্যে এত কষ্ট ঘটতে পারে একথা ভাবলে অত্যন্ত ধিক্কার জন্মায় বিশ্ববিধানের উপর।’ চিঠিপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, আষাঢ় ১৩৩৯। পুনশ্চ-এর “বিশ্বশোক” কবিতাটির রচনার তারিখ ১১ ভাদ্র, ১৩৩৯।
৬ এই কবিতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন, “এই লীলার সংগতি কোন্খানে? বলছেন ‘ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর-কন্দর মাঝে’ যা কিছু দেওয়া এবং হারানোর হিসাব মিলছে। সবসুদ্ধ ক্ষয় নেই, অখণ্ড পূর্ণতা বিরাজিত।”—সাম্প্রতিক, পৃ ১৯০
৭ এই কবিতাটিতে সুর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে অনেকটা বদলে দিয়েছিলেন। ‘ও আজি মেনেছে হার ক্রুর বিধাতার কাছে’ হয়েছে ‘ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ্যের পায়ে’ এবং ‘কৃপণ প্রাণের ইতর বঞ্চনা’র সংস্কৃত রূপ হচ্ছে ‘অকিঞ্চন জীবনের বঞ্চনা’। অথচ সানাই-এর কবিতাতে মেয়েটির নির্দোষ অসহায় ও অসহ ব্যথার যে অব্যর্থ প্রকাশ, গীতবিতান-এর গানের ভাষায় তার সিকি ভাগও সম্ভব হয় নি। গানের অধিক সংখ্যক শ্রোতার কথা স্মরণ ক’রে কি এই ভাষাশুদ্ধি? না কি তাঁর মনে হয়েছিল কবিতার ছন্দ যতখানি জোরালো এবং অনাবৃত শব্দের আঘাত সইতে পারে, গানের সুর ততখানি পারে না, সুর চায় অপেক্ষাকৃত মোলায়েম, নিরীহ ভাষার বাহন?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন