আবু সয়ীদ আইয়ুব
সহজাত বৃত্তির তাড়নায় নয়, গরজে প’ড়ে, দায়ে ঠেকে, মানুষকে হতে হ’ল যূথবদ্ধ। কারণ শিকার এবং পরে চাষবাসের কাজে দেখা গেল দলের সুবিধা অনেক। কিন্তু দলে বাস করতে হলে সম্পূর্ণ নিজের খেয়াল-খুশি মতো থাকা যায় না, কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে হয়, ব্যক্তিস্বার্থের উপরে স্থান দিতে হয় দলের স্বার্থকে। অর্থাৎ এক প্রকার চারিত্র্যনীতি হ’ল যৌথ জীবনের অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু সেটা চারিত্র্যনীতির ভ্রূণাবস্থা, প্রকৃত মর্যালিটি তাকে বলা যায় না। যূথ ছিল তখন ব্যক্তিরই সম্প্রসারিত সত্তা। আদিম মানুষ নিজের স্বকীয় ব্যক্তিসত্তা বিষয়ে খুব সচেতন নয়; যূথের সঙ্গে অনেকটা একাত্ম এবং একদেহ সে, নিজেকে যৌথ দেহের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ ভাবাটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। যৌথ জীবনযাত্রার তাগিদে যে-চারিত্র্যনীতি সে পালন করতে বাধ্য তার গোড়ার কথা হ’ল ব্যষ্টির ইচ্ছাকে সমষ্টির ইচ্ছার অর্থাৎ বিধি-নিষেধের অধীন জ্ঞান করা। এই শিক্ষাই প্রত্যেকটি শিশুকে দেওয়া হয় ট্রাইবল সমাজে। তবু যদি আশৈশব শিক্ষা বা শেখানো অভ্যাস লঙ্ঘন ক’রে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যৌথ প্রথার বিরুদ্ধাচরণ ক’রে বসে তবে সে যূথের বা যূথপতির দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে দণ্ডিত হয়। এহেন বিধিনিষেধ যে প্রকৃত চারিত্র্যনীতি নয় তা আরো সহজে প্রতিপন্ন হয় যূথ-বহির্ভূত মানুষের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে মৎস্যন্যায় ছাড়া আর কোনো ন্যায়-অন্যায়ের কথাই ওঠে না প্রাসভ্য ট্রাইবল সমাজ-ব্যবস্থায়।
সভ্য সমাজে কি খুব একটা ওঠে? আমরা আধুনিক যুগের মানুষেরা অনেক দিক থেকে নিঃসন্দেহে সমুন্নত; চাঁদে কমোনট্ পাঠানোর আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ ক’রে এনেছি, এক কুকুরের মুণ্ডু কেটে আর-এক কুকুরের ঘাড়ে জুড়ে দিতে পারি, মরুভূমিতে ফসল ফলাতে পারি, একটি হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়ে একটা গোটা শস্যশ্যামল দেশকে মরুভূমি ক’রে দিতে পারি, ইত্যাদি। কিন্তু চারিত্রনৈতিক দিক দিয়ে যে বড় বেশি এগিয়েছি এমন ভাববার কারণ নেই। সভ্য সমাজের চারিত্র্যনীতির মুখোশটি সুন্দর কিন্তু মুখোশ খুললে ট্রাইবলিজম্-এর বিকট মুখখানি দেখা যায়। ট্রাইবের জায়গা নিয়েছে রেস, নেশন এবং ধর্মসম্প্রদায়—তফাত এইটুকু। শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গকে, নর্ডিক ইহুদিকে, বর্ণ-হিন্দু চণ্ডাল এবং মুসলমানকে পুরো মানুষ ব’লে গণ্য করতে সব ক্ষেত্রে প্রস্তুত নয়, অভ্যস্তও নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনো রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে বিবেকের বা মর্যালিটির ধার ধারে না; একমাত্র আন্তর্জাতিক নীতি কূটনীতি অর্থাৎ ঠকবাজি। জাতিতে জাতিতে পরিচয় কখনো খড়্গে খড়্গে ভীম পরিচয়, কখনো বা শঠে শাঠ্যম্ সমাচরেৎ।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো প্রকার চারিত্র্যনীতি আজও গ’ড়ে ওঠে নি। কিন্তু আন্তর্ব্যক্তিক ক্ষেত্রেও দেখা যায় আমরা একে অপরের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করি সুফলের প্রত্যাশায়— তা সে হাতে হাতে হোক বা রয়ে-বসেই হোক; নিদেনপক্ষে পরকালের বা পরজন্মের হিসাব-নিকাশ তো আছেই। অথবা আমরা সৎ না হলেও শিষ্ট হয়ে যাই ভয়ের চোটে— লোকনিন্দার ভয়ে, পুলিসের ভয়ে, প্রতিহিংসার ভয়ে, নরকের ভয়ে। যদিও ইতিপূর্বে একাধিক মহাপুরুষ ব’লে গেছেন— মানুষকে ভালোবাসো, নিছক ভালোবেসে, কোনো প্রকার লাভ-ক্ষতির কথা মনে না রেখে, মানুষের উপকার করো। গৌতম বুদ্ধ বা যীশু খ্রীস্টের মতো ধর্মোপদেষ্টারা লক্ষ লক্ষ মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন, মৌখিক আনুগত্য পেয়েছেন; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁদের নীতি-উপদেশ পালন করে নি লাখে একজনও। সাধারণ মানুষের পক্ষে আদৌ পালন করা সম্ভব কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
যে-অর্থে আমরা অত্যন্ত আপন জনকে (বন্ধুকে, প্রিয়াকে, সন্তানকে) ভালোবাসি, সেই অর্থে বা তার খুব কাছাকাছি কোনো অর্থে কি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে— বুদ্ধি, রুচি ও চরিত্র নির্বিশেষে সবাইকে— ভালোবাসতে পারি? মানুষটা বিদেশী ও বিভাষী হলে ব্যাপারটা আরো অসম্ভব ঠেকে। দু-চারজন মহাপুরুষ হয়তো পারেন, কিন্তু, শুধু তাঁদের নিয়ে তো চারিত্র্য-নীতি তৈরী হয় না। গ্রীক ভাষা ও খ্রীস্টীয় ধর্মশাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন এক বিদেশী অধ্যাপকের মুখে শুনেছি যে নিউ টেস্টামেন্টের বিধান ‘love thy neighbour’ যে-গ্রীক বাক্যের অনুবাদ তাতে অনুজ্ঞাসূচক শব্দটি ঠিক ‘ভালোবাসো’-র প্রতিশব্দ নয়, বরঞ্চ ‘সুবিবেচনাপূর্বক বা ন্যায়সম্মত ব্যবহার করো’-র কাছাকাছি তার অর্থ। এটা সংগত কথা, এবং এই অর্থে উক্ত বিধানটা শুধু কতিপয় মহাপুরুষ নয়, সকলের মান্য ও আচরণীয় হতে পারে। স্বভাবে মেজাজে রুচিতে যে-মানুষটি একান্ত অপ্রিয় তার সঙ্গেও আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারি, অন্তত সেইরূপ শিক্ষা দিতে পারি নিজেকে। তাই কান্ট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, প্রকৃত শ্রেয়োনীতি আলোকপ্রাপ্ত স্বার্থান্বেষণ কিংবা সর্বজনীন প্রেমের উপর প্রতিষ্ঠেয় নয়, তার মূল স্তম্ভ হ’ল প্রত্যেকের বাঁচবার, সুখী হবার, নিজেকে নিজের মতো ক’রে প্রস্ফুটিত করবার অধিকার স্বীকার করা— শুধু মুখে নয়, অন্তরে ও আচরণে। অন্যের সঙ্গে দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তোমার মনে যেন এমন ভাব না থাকে যে সে তোমার কোনো ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, দূর বা নিকট, স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্র। মানুষ মাত্রেই উপেয় (end), কেউ কারো স্বকীয় উদ্দেশ্যসাধনের উপায়মাত্র নয়।
মোটকথা, শ্রেয়োনীতি সহজাত বৃত্তির প্রকাশবিশেষ বা জীবনধর্মের প্রকারভেদ নয়, অন্য এক স্তরের ব্যাপার। আমরা স্বভাবতই যে-স্তরে বাস করি সেখানে ‘আমি’ যেন কেন্দ্রস্থিত, অন্য সবাই আমারই কোনো-না-কোনো সম্ভাব্য হিতার্থে আমার চারিদিকে চক্রাকারে ঘুরছে। প্রয়োজন হলে এবং সামর্থ্য থাকলে আমি তাদের ব্যবহার করতে পারি আমার স্বার্থসিদ্ধির জন্য। শ্রেয়োনীতিক মানুষকে এই জৈবনীতির উপরে উঠে এমন এক স্তরে উপনীত হতে হয় যেখানে সে আর কেন্দ্রে নয়, পরিধিতে। প্রকৃতপক্ষে সেখানে কেন্দ্র-পরিধির উপমা খাটে না, সেখানে স্বার্থ এবং পরার্থকে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অপরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে, সমদৃষ্টিতে দেখতে হয়। এই স্তরে ওঠা মানুষের সাধ্যাতীত নয়, কিন্তু কারো পক্ষে সহজসাধ্যও নয়। যৌথ জীবনযাত্রায় এ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
তেমনি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে আমাদের দৃষ্টি ও উপলব্ধিকে প্রাত্যহিক জীবনের স্তর থেকে আর্টের স্তরে নিয়ে যেতে। পরিবর্তনের মাত্রাটা আরো অধিক, আমাদের উঠতে হয় আরো এক ধাপ উপরে। শ্রেয়োনীতিক মানুষ স্বার্থপ্রণোদিত না হলেও কর্মলিপ্ত। কিন্তু শিল্পী মানুষ কর্মভার থেকে এবং অন্যকে কর্মে উদ্বোধিত করার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কর্তব্য অবশ্য শিল্পী এড়াতে পারেন না; কারণ, শিল্পজীবনের বাইরেও তাঁর একটা জীবন আছে। কিন্তু শিল্পীরূপে তিনি কর্মজীবনের দায়-দায়িত্বের এবং তার মানসিক পটভূমির ঊর্ধ্বে। দরজায় দাঁড়ানো মানুষ, গলির কালো কুৎসিত আইবুড়ো মেয়ে কিংবা নেড়ি কুত্তা সবই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে; কিন্তু এসবের পিছনে কোনো বৃহত্তর সত্যের ইঙ্গিত, সর্বমানবিক এবং মানবোত্তর কোনো রহস্যের কম্পমান যবনিকা যদি দেখতে না পান তাহলে তো তিনি কবি নন, সাংবাদিক মাত্র।
বিশেষত, দুঃখ ও পাপের চেতনা কর্মী এবং কবির একই প্রকার হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কর্মীকে শুধু খোলা চোখে নয়, উত্তল কাচের ভিতর দিয়ে একটু বড় ক’রে দেখতে হয় অমঙ্গলের চেহারাটা, দৃষ্টিকে একাগ্র করতে হয় সেই স্থানে যেখানে মানুষ দুঃখ পাচ্ছে— যে-দুঃখের প্রতিকার সম্ভব, যেখানে অন্যায় ঘটছে— যে-অন্যায়ের প্রতিরোধ অত্যাবশ্যক। কর্মীর অমঙ্গলবোধ মাত্রাতিরিক্ত হলে লাভ বই ক্ষতি নেই। কিন্তু কবির পক্ষে এই অতিরেক শুধু অনাবশ্যক নয়, অযথার্থ, সুতরাং অনর্থকারী। একটি ছোট ছেলের ছোট দুঃখকেও সমগ্র মানবজাতির ভূত-ভবিষ্যতের এমনকি অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিরাট পরিপ্রেক্ষিতে দেখলেই তাঁর দেখাটা সত্য হয়। অথচ সেভাবে দেখতে গেলে কাছেই এবং এই মুহূর্তেই যে-দুঃখ বা পাপ উপস্থিত তা ছোট হয়ে দেখা দেয়, সুতরাং প্রতিরোধশক্তি এবং সংগ্রামস্পৃহা জাগাতে সক্ষম হয় না। কিন্তু তাতে কি কবিতার খুব ক্ষতি হবে? কবি তো সমাজ-সংস্কারক নন; তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের— স্বার্থবুদ্ধিপ্রণোদিত ও সংগ্রামলিপ্ত মানুষের দৃষ্টির, অনুভূতির এবং কল্পনার ক্ষুদ্রতা ঘুচিয়ে সব কিছুকে তার যথার্থ, অর্থাৎ খণ্ডের নয় পূর্ণের, পরিপ্রেক্ষিতে উপলব্ধি করতে শেখাবেন, এর চেয়ে বেশি কোনো প্রত্যাশা রাখি না তাঁর কাছ থেকে। তার মানে এক ধরনের সংস্কার অবশ্য চাই আমরা, কিন্তু সে-সংস্কার বাইরের নয়, অন্তরের। কবির কাছে আমরা চাই হৃদয়ের সেই পরিশুদ্ধি যাকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন রেক্টিফিকেশন অফ হিউম্যান ইমোশন্স্।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই উক্তির মধ্যে উহ্য রয়েছে আর-একটি মূল্যবান কথা: অনুভূতিও ঠিক কিংবা বেঠিক হতে পারে। জানি না ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিজে ‘রাইট ইমোশন’ বলতে সেইসব হৃদয়াবেগই বুঝেছিলেন কিনা যা শ্রেয়োনীতিক জীবন-যাত্রার অধিকতর উপযোগী ক’রে তোলে আমাদের। আমি কিন্তু কথাটাকে একটু ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করেছি। আমার মতে কবির হৃদয়াবেগ সত্য হওয়া চাই— শুধু এই অর্থে নয় যে হৃদয়াবেগটি বানানো বা কাল্পনিক হবে না (কাল্পনিক হলেও কি কবিতার কিছু এসে যায়?); সত্য হওয়া চাই মানে যথার্থ (যথা + অর্থ, অর্থের অবজেক্টের— অনুগামী) হওয়া চাই; বহির্জগতের যে-অবস্থা বা ঘটনার সঙ্গে সেই হৃদয়াবেগটি যুক্ত, তার সঙ্গে শুধু কার্যকারণিক সংযোগ নয়, নান্দনিক সামঞ্জস্য থাকা চাই। ধরুন কোনো তরুণী মহাভারত বা ম্যাকবেথ পাঠ ক’রে ব’লে উঠলেন— ‘কী মিষ্টি!’ ঐ তরুণীর মনে সত্যি মিষ্টত্ববোধ জেগে থাকলেও বলব, অনুভূতিটা সত্য নয়, কারণ বিষয়ের সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। যে-হৃদয়াবেগ একটি গোলাপ ফুল দেখে বা কোকিলের ডাক শুনে জেগে থাকলে যথোপযুক্ত হ’ত, সেই হৃদয়াবেগ হিমালয় পর্বত বা মহাসমুদ্রের তরঙ্গগর্জনের সামনে অত্যন্ত বেখাপ, অযথার্থ।
বোদলেয়রের কাব্য বিষয়ে ইতিপূর্বে নালিশ জানিয়েছি। সে-নালিশের মূল কথা ছিল যে তাঁর কবিতায় প্রকাশিত অনুভূতির বাদী সুরটি সত্য নয়। বোদলেয়রের অনুভূতি সত্যি ঐ সুরে বাঁধা ছিল কিনা প্রশ্নটা অবান্তর। উপরন্তু, এ-বিষয়েও আমার কোনো সন্দেহ নেই যে বোদলেয়রের যেমন অনিবার্য ভঙ্গি ও অনবদ্য ভাষায় তাঁর বাস্তবিক কিংবা কাল্পনিক অনুভূতিগুলিকে প্রকাশ করেছেন, তেমন প্রকাশের উৎকর্ষ খুব কম কবির কবিতায় পাই আমরা। কিন্তু তাঁর অনুভূতির তো একটা বিষয় ছিল, সে-বিষয়ের সঙ্গে অনুভূতির সামঞ্জস্য (আমাদের আলংকারিকদের ভাষায় ‘ঔচিত্য’) আমি খুঁজে পাই না। মানবজীবন অথবা সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দুর্বোধ্য হতে পারে, দুঃখ, নৈরাশ্য বা ত্রাস জন্মাতে পারে, কিন্তু তার সম্বন্ধে তুচ্ছতা বা একঘেয়েমির (‘monotone et petit’) বোধকে বলব অনুভূতির অযথার্থতা, অসত্যতা। বস্তু বা অবস্থাবিশেষ সংগতভাবেই আমাদের বিরক্তিকর, ন্যক্কারজনক বা কদর্য লাগতে পারে; কিন্তু সমগ্র জীবন ও অনন্ত জগৎ তাই নয়। অবশ্য শারীরিক কিংবা মানসিক বৈগুণ্যে কখনো কখনো এক সার্বিক বিতৃষ্ণার ভাব জাগতে পারে যে-কোনো লোকের মনে। বোদলেয়রের প্রতিভা এই বিকারকে স্বাস্থ্য জ্ঞান করতে শিখিয়েছে, এই অসংগত ভাববৈকল্যকে শ্রদ্ধেয় ও সযত্নে পালনীয় ক’রে তুলেছে অত্যাধুনিক কবি ও সমালোচকদের কাছে।
কেউ যদি বলেন— জগৎটা না হয় ভালোই হ’ল, মানুষ মোটের উপর সুখী, এবং মানবজীবন আত্মস্ফুরণের বিচিত্র সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল— কিন্তু তবু যদি আমার কিছুই ভালো না লাগে, জগতের দিকে তাকালেই বমি আসে, তবে আমি আমার সেই স্বকীয় বিবমিষা কবিতায় প্রকাশ করব না কেন? এবং প্রকাশ যদি সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ হয় তাহলে সে কবিতা উঁচুদরের কবিতা ব’লে গণ্য হবে না কেন? প্রশ্নটা একটু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে এর মধ্যে কোথাও ফাঁকি আছে, হয় পরের নয় নিজের চোখে ধুলো দেওয়া হচ্ছে। যদি আমার জাগতিক অনুভূতি আর জগতের প্রকৃত অবস্থার মধ্যে এমনতর মৌলিক গরমিল সত্যিই থাকে, তবে আমার সে-অনুভূতি হয় ঘোরতর চিত্তবিকারের লক্ষণ নয় তো নিছক ফাজলামি ব’লে ধার্য হবে। তার প্রকাশে কলানৈপুণ্য থাকলে রচনাটি উপাদেয় হতে পারে, প্রশংসনীয় হতে পারে, কিন্তু কিছুতেই মহৎ ব’লে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না। আধুনিক কবিতার দাবি কি শুধু এই কালোয়াতির জন্য বাহবার দাবি? আমার তা মনে হয় না; কোনো সিরিয়স কবির দাবিই এত অকিঞ্চিৎকর হতে পারে না।
কীটস সুন্দরের উপাসক ছিলেন এবং সুন্দরকে সত্যের সঙ্গে এক ক’রে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সমীকরণে আস্থা রাখার জন্যে তিনি প্রয়োজন বোধ করলেন সত্যের (অর্থাৎ বাস্তব সত্তার) সীমানাকে চারিদিক থেকে গুটিয়ে ফেলার, তাঁর সৌন্দর্যের ধ্যানমূর্তিকে খণ্ডিত করতে পারে এমন যাবতীয় তথ্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেবার। রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিকতা ছিল ভিন্ন ছাঁচে ঢালাই করা; তিনি কিছুই বাদ দিতে চান না, দৃষ্টিকে সংকুচিত নয়, সম্প্রসারিত করতেই উদ্যোগী। কারণ তাঁর বিশ্বাস জগৎকে টুকরো টুকরো ক’রে, এক-একটি টুকরোকে সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেখলেই আমরা দেখব কোথাও সুন্দর (ছোট, সীমিত অর্থে— মনোহর বা প্রীতিকর অর্থে— সুন্দর) কোথাও বা অসুন্দর। কিন্তু উপস্থিত দেশকালের ক্ষুদ্র সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ না রেখে, কিসে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয় আর কিসে ব্যাহত এসব গণনা পরিহার ক’রে, যদি খণ্ডকে সমগ্রের মধ্যে দেখতে চেষ্টা করি, তবে তার যে-রূপটি আমাদের চোখে ধরা দেবে তাকে খুব বড় অর্থে সুন্দর বলতেই হয়।
একটা গাছকে যদি খুব নিকটে দাঁড়িয়ে তন্নতন্ন ক’রে দেখি তবে দেখব তাতে কত ফোকর, তার বাকল কত জায়গায় শুকিয়ে কুঁকড়ে বাঁকাচোরা এলোমেলো রেখায় বিকৃত, কত অংশ তার পচা, পূতিগন্ধময়। কিন্তু একটু দূরে দাঁড়ালে সমগ্র গাছের এবং আরো দূরে স’রে এলে সমগ্র বনভূমির সৌন্দর্য সহজেই উপলব্ধ হয়। প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে এহেন নান্দনিক দূরত্ব রক্ষা করা মোটেই শক্ত নয়। কিন্তু মানুষের বেলা নিজেকে দূরে সরিয়ে সমস্ত মনুষ্যজাতির বিরাট নাট্যলীলাকে নিরাসক্ত নান্দনিক দৃষ্টিতে উপলব্ধি করার মতো মন তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন! নাটকের অভিনেতা যেমন অভিনয়কালে তার নিজ ভূমিকার সঠিক রূপায়ণে এতই নিবিষ্টচিত্ত থাকে যে সমস্ত নাটকের রসরূপটি তার চোখে ধরা দেয় না, তেমনি আমরা যখন জীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের ইষ্টানিষ্ট, সমাজের হিতাহিত বিচার ও সাধনে অত্যন্ত ব্যাপৃত, তখন মানবজীবন-নাট্যের মহান— ট্র্যাজিক হলেও মহান— রসরূপটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না। উৎসর্গ-এর ৩৭-সংখ্যক কবিতায় (‘আলোকে আসিয়া এরা লীলা ক’রে যায়’) এই ভাবটি ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এবং শান্তিনিকেতন মন্দিরে প্রদত্ত এক অভিভাষণে আরও বিস্তারিত ক’রে বলেছেন: ‘মানুষ আমাদের এত অত্যন্ত কাছে যে তার সমস্ত ছোটকে আমরা বড় ক’রে দেখি… আমরা মানবসংসারের ভিতরে আছি বলেই তার বাষ্পরাশির ভয়ংকর ঘাতসংঘাত সর্বদাই বড় ক’রে প্রত্যক্ষ করছি। আধিব্যাধি, দুর্ভিক্ষ-দারিদ্র্য, হানাহানি, কাটাকাটির মন্থন কেবলই চারিদিকে চলছে… সংসারের সমস্ত বেদনা আমাদের অত্যন্ত কাছে এসে বাজে; যেখানে সামঞ্জস্য বিদীর্ণ হচ্ছে সেইখানে আমাদের দৃষ্টি পড়ে, কিন্তু সেই সমস্তকেই আত্মসাৎ ক’রে নিয়ে যেখানে অনন্ত সামঞ্জস্য বিরাজ করছে সেখানে সহজে আমাদের দৃষ্টি যায় না।’[১]
এই সামঞ্জস্য, এই সৌন্দর্য, সাহিত্যনীতিক দৃষ্টিতেই প্রতিভাত, শ্রেয়োনীতিক দৃষ্টিতে নয়। যদি কর্মীর চোখেও সব-কিছু সুসম্বদ্ধ ও সুসংগত এবং সুমহান কোনো পূর্ণ সত্তার অঙ্গ রূপে প্রতিপন্ন হ’ত তবে কর্তব্যের কোনো মানে থাকত না, কর্তব্য পালনের কোনো প্রেরণা খুঁজে পাওয়া যেত না। শ্রেয়োনীতির বিচারে সামঞ্জস্য সিদ্ধ নয়, সাধ্য; আমাদেরই হিতৈষণা ও হিতকর্মের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু শিল্পীর দূরে সরিয়ে নেওয়া চোখ এবং দূরে-মেলে-দেওয়া দৃষ্টি দিয়ে আমরা কেবল প্রাকৃতিক নয়, মানবিক জগৎকেও দেখতে পারি। তেমন ক’রে দেখলেই সত্যকে সুন্দর ব’লে জানা সম্ভব।
এই কথাটা গভীর দুঃখের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন একটি স্মরণীয় কিন্তু বিস্মৃতপ্রায় কবিতায়। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর যখন সমস্ত জীবন তাঁর চোখে একেবারে অন্ধকার দেখাচ্ছিল, কোথাও লেশমাত্র সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি নিজের দুঃখকে পৃথিবীর দুঃখের প্রতীক ঠাউরে নিজেরই কবি-সত্তাকে সম্বোধন ক’রে বলছেন— আমরা সাধারণ মানুষেরা তো চারিদিককার দুর্দৈবের চাপে জরজর, কিন্তু তুমি তো আমাদের মতো উপস্থিত দেশকালের ছোট গণ্ডির ভিতরে বন্দী নও, তুমি তো সকল মেঘের ঊর্ধ্বে উঠে দেখতে পাও অনাগত উষার প্রথম আলো। সেই বার্তা আমাদের শোনাও, সেই চোখ আমাদের ফুটিয়ে তোলো।
আজি দেখো ওই পূর্ব-অচলে চাহিয়া, হোথা
কিছুই না যায় দেখা—
আজি কোনো দিকে তিমিরপ্রান্ত দাহিয়, হোথা
পড়ে নি সোনার রেখা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর।
আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে—
কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে।
মরীচিকা লয়ে জুড়াব নয়ন আপনারে দিব ফাঁকি,
সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি।
ওগো আমাদের এই ভয়াতুর বেদনা যেন
তোমারে না দেয় ব্যথা।
পিঞ্জরদ্বারে বসিয়া তুমিও কেঁদো না যেন
লয়ে বৃথা আকুলতা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর।
সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া,
সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া—
‘নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ কহো আমাদের ডাকি,
মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান আমরা খাঁচার পাখি। (উৎসর্গ— ৩১)
সকলের এবং সর্বক্ষণ না হলেও বহুলোকের জীবনের একটা বড় অংশ দুঃখের মধ্যেই অতিবাহিত হয় এটা অস্বীকার করবার জো নেই। রবীন্দ্রনাথও অস্বীকার করেন না। কিন্তু আধুনিকেরা এই তথ্যটাকে স্বীকার করেন প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও বিতৃষ্ণার সঙ্গে; রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি অনেকটা প্রশান্ত। অমঙ্গলের প্রতি কর্মীর ক্রোধ ও ধিক্কার স্বাভাবিক; শুধু স্বাভাবিক নয়, আবশ্যক। কিন্তু কবি কেন এত ক্রোধ ও ধিক্কার পোষণ করবেন— তাও জগতের যতটুকু অংশে অমঙ্গলের অধিষ্ঠান শুধু তার প্রতি নয়, সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি? এই বিশ্বজাগতিক ধিক্কারের ভাবটা যদি প্রবল হয়ে ওঠে তবে কবির মধ্যে কর্মী-মানুষটা কি বেঁচে থাকবে? আর বোদলেয়রের মতো শক্তিমান কবিরা যদি তাঁদের সার্বিক বিবমিষাকে সমাজময় ছড়িয়ে দিতে থাকেন তা হলে কি তাঁরা সমস্ত সমাজের কর্মশক্তিকে, শুধু কর্মশক্তি কেন, জীবনীশক্তিকেও পঙ্গু ক’রে দেবেন না? ন্যক্কার রসের কবিদের একবার ভেবে দেখা উচিত— যা তাঁরা সৃষ্টি করছেন এবং যা ধ্বংস করছেন, দুটো কি তুল্যমূল্য।
রবীন্দ্রনাথ আধুনিক কাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখছেন: ‘একটি মেয়ের সুন্দর হাসির খবর কোনো কবির লেখায় যদি পাই তা হলে বলব এ খবরটা দেবার মতো বটে কিন্তু তার পরেই যদি বর্ণনায় দেখি, ডেন্টিস্ট এলো, সে তার যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা ক’রে দেখল— মেয়েটির দাঁতে পোকা পড়েছে, তা হলে বলতে হবে এটাও খবর বটে কিন্তু সবাইকে ডেকে ডেকে বলবার মতো খবর নয়। যদি দেখি কারো এই কথাটা প্রচার করতেই বিশেষ ঔৎসুক্য তা হলে সন্দেহ করব তারও মেজাজে পোকা পড়েছে।’[২]
এ নিয়ে অবশ্য তর্ক উঠতে পারে— ভালো লাগা যেমন সত্য, খারাপ লাগাও তেমনি সত্য, মুক্তোর মতো দত্তপক্তির সৌন্দর্য নিয়ে যদি কবিতা লেখা যায় তবে পোকা-পড়া দাঁতের কুশ্রীতাও কবিতার বিষয় হবে না কেন? কখনোই হবে না তা নয়, কবি নিরাসক্ত চোখে দুটোকেই দেখবেন এবং দুটোর কথাই তাঁর কাব্যে ঘোষণা করবেন, এতে কারো আপত্তি হতে পারে না। আপত্তি ওঠে যখন দেখি যে এ-যুগের কবি— অধিকাংশ কবি— চারিদিকে কেবল পোকা-পড়া দাঁত-ই দেখতে পাচ্ছেন, কারো সুন্দর হাসি আর তাঁদের চোখে পড়ছে না। আধুনিকতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের একটা অভিযোগ এই ছিল যে, আধুনিকেরা নৈর্ব্যক্তিকতার দাবি করেন অথচ তাঁদের দৃষ্টি মোটেই নৈর্ব্যক্তিক নয়, কুৎসিতের প্রতি রীতিমতো আসক্ত তাঁরা, এবং ‘বিশ্বের প্রতি এই উদ্ধত অবিশ্বাস ও কুৎসার দৃষ্টি এও আকস্মিক বিপ্লবজনিত একটা ব্যক্তিগত চিত্তবিকার।’
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে রোম্যান্টিক কবিদের যেমন সুন্দরের প্রতি পক্ষপাত ছিল, কাউন্টর-রোম্যান্টিকদের তেমনি কদর্য্যের প্রতি পক্ষপাত জন্মেছে; সেই সঙ্গে এটাও তর্কাতীত যে জগতে যেমন সব-কিছু সুন্দর নয়, তেমনি সব-কিছু কদর্যও নয়। তবে কাব্য-রচনার বেলা বেছে বেছে কেবল সুন্দরকে অথবা কেবল কদর্যকে ধ্যানদৃষ্টির সামনে রাখার মূলে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিহিত রয়েছে। সেটাই বিচার্য।
যে-বিষয়টিকে নিয়ে কোনো গীতিকবিতা গ’ড়ে ওঠে সে-বিষয়টি আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ নয়, তার একটি সাংকেতিক বা প্রতীকী ভূমিকা থাকে কবিতার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টই জানাচ্ছেন যে কবি যখন কোনো সুন্দর বস্তুকে নিয়ে কবিতা লেখেন তখন তার সৌন্দর্যে ‘আমরা যেটিকে দেখি কেবল সেটিকেই দেখি এমন নয়, তাহার যোগে আর সমস্তকেই দেখি; মধুর গান সমস্ত জল-স্থল আকাশকে, অস্তিত্বমাত্রকেই মর্যাদা দান করে। যাঁহারা সাহিত্য-বীর তাঁহারা অস্তিত্বমাত্রের গৌরব ঘোষণা করিবার ভার লইয়াছেন।’৩ পক্ষান্তরে, যাঁদের মনে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কদর্যতার প্রত্যয় বদ্ধমূল, যাঁরা অস্তিত্বমাত্রের অগৌরবই ঘোষণা করবার ভার নিয়েছেন, তাঁদের কাছে ‘নর্দমার ক্লেদাক্ত ফেনা’, ‘স্বেদস্রাবী বক্র বিষধর’, ‘বজ্রনখ পেচক’ ইত্যাদিই প্রতীক হিসাবে অনেক বেশি গ্রাহ্য হবে, ভালোমন্দে-মেশা বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বেছে নেবেন কুৎসিত এবং ক্লেদাক্তকেই। খোলা চোখে অপক্ষপাত নিরাসক্ত নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়ে মানুষের জীবনধারার দিকে তাকিয়ে আধুনিকেরা দেখলেন যে, দুঃখ ও পাপের সংখ্যা তিন-চল্লিশ নয়, সাতান্ন নয়, একেবারে নিরানব্বই (তুল্য: ‘আমার মতে জগৎটাতে ভালোটারই প্রাধান্য/মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন’)— এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রোম্যান্টিকদের বিপরীত সত্য বিশ্বের মহান রহস্যময়তাও তাঁদের খণ্ড অভিজ্ঞতায় শুভ ও সুন্দরের প্রাচুর্য থেকে লব্ধ নয়। সারাজীবনের পরিব্যাপ্ত অভিজ্ঞতায় আমরা ভালোমন্দ দুই-ই পাই, তাদের আনুপাতিক সংখ্যা বা মাত্রা নির্ধারণ করা অসম্ভব।
সুন্দর-কুৎসিত, পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ, জীবন-মৃত্যু নিয়ে সমগ্র বিশ্বজগৎটা আমাদের ধ্যানদৃষ্টির সম্মুখে একটা দুর্ভেদ্য রহস্যময় সাবলাইম দৃশ্য রচনা করবে কিংবা তুচ্ছ, কদর্য, ন্যক্কারজনক ও বীভৎস দৃশ্য— এটা একেবারে গোড়ার কথা, মৌলিক প্রত্যয়ের, হার্দ্যোপলব্ধির বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা; এরই উপর রচিত হয় আমাদের সমগ্র জীবনবোধ ও জগৎদর্শন, আধুনিকরা যদি ভাবেন যে তাঁরা রোম্যান্টিকদের রঙিন চশমা খুলে ফেলেছেন তবে তাঁরা ভুল ভাবছেন। দুই রঙের চশমার মধ্যে তাঁরা ধূসরটাকে পছন্দ ক’রে চোখে লাগিয়েছেন— এই পর্যন্ত। তর্কের দ্বারা বোঝানো যাবে না যে তাঁদের ধূসর দৃষ্টি মিথ্যা, কিন্তু মূল্যবোধের নিরিখে সে-দৃষ্টির অসারতা, নান্দনিক ও শ্রেয়োনীতিক অনৌচিত্য, ধরা পড়ে। ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের দৃষ্টি আমাদের সমস্ত জীবনকে পঙ্গু ক’রে দেয়, এবং আমার মতে সাহিত্যকেও। আগ্রহ ও উদ্দীপনার দৃষ্টি জীবনে সার্থকতার অবকাশ সৃষ্টি করে, এবং সাহিত্যে মহত্ত্বের। কোনো সাহিত্য মহৎ কিনা তা কেবলমাত্র সাহিত্যিক বিচারে নিষ্পত্তি করা যায় না, যদিও সে-রচনা সাহিত্য হয়ে উঠেছে কিনা তার বিচার সাহিত্যের ঘরোয়া ব্যাপার— এলিয়টের এই উক্তিটির সারবত্তা বর্তমান প্রসঙ্গে বিচার্য। ঘৃণার সাহিত্যে উৎকর্ষের প্রমাণ পেয়েছি আমরা; মহত্ত্বের স্বাক্ষর কি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে?
দুঃখের কারণ যতদিন থাকবে দুঃখও থাকবে ততদিন। কতকগুলো কারণ চিরদিন থাকবে না অবশ্য। দারিদ্র্য, জীবিকার অনিশ্চয়তা, ব্যাধি, প্রবলের অত্যাচার, প্রতাপশালীর খামখেয়াল— দুঃখের এই কারণগুলি অনতিদূর ভবিষ্যতে বিদূরিত হবে ভরসা করা যায়। অন্তত হওয়াটা আমাদের আয়ত্তের বাইরে নয়; আমাদেরই একক ও সম্মিলিত চেষ্টার উপর নির্ভরশীল। জগৎ ও জীবনের প্রতি যে-মনোপ্রতিন্যাস থেকে এই চেষ্টার উদ্ভব, সেই প্রতিন্যাসকে বাঁচিয়ে রাখার গভীর প্রয়োজন আশা করি কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু দুঃখের সব কারণ অপনেয় নয়। প্রকৃতির উপর আমাদের আধিপত্য বাড়বে, কিন্তু মানুষ কোনোদিন সৌরজগতের অধিপতি হবে না। যাকে আমরা বলি অ্যাসিডেন্ট তার সংখ্যা কমবে বটে, কিন্তু দুর্দৈবের হাত থেকে বিজ্ঞান আমাদের একেবারে মুক্ত ক’রে দেবে এ-আশা বাতুলতা। ব্যাধি না থাকলেও জরা তো থাকবে; যৌবনের পর থেকে আমরা দিনে দিনে ক্ষয় হবই; এবং মৃত্যু তো জীবনেরই একটি পর্যায়ের নাম। তার চেয়েও দারুণতর ব্যাপার প্রিয়জনের মৃত্যু। এসব অপ্রতিরোধ্য দুঃখকে জীবন-সঙ্গী ব’লে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, তাদের সঙ্গে সহজ মনে ঘর-সংসার করতে শিখতে হবে আমাদের। মানুষের এই অসহায় দশা, যাকে জোসেফ নীড় হ্যাম বলেছেন তার ‘ক্রীচারলিনেস’, কোনো সমাজ-বিপ্লবের বা পাঁচ কি পঞ্চাশ সালা পরিকল্পনার দ্বারা প্রতিকার্য নয়। কিন্তু তা নিয়ে গদ্যে পদ্যে নাটকে চিত্রে কান্নাকাটি করা, ভগবানকে বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে গাল পাড়া অশোভন। শোভন প্রতিক্রিয়া হবে চির-হতাশ প্রেমিক ইয়েটসের প্রতিক্রিয়া—
I could recover if I shrieked
My heart’s agony
To passing bird, but I am
Dumb from human dignity.
মানুষের মর্যাদাবোধ এবং আত্মসম্ভ্রম সাহিত্য থেকে হারিয়ে গেলে জীবন থেকেও হারিয়ে যাবে। তখন আমরা কী নিয়ে বাঁচব, নর্মান মেলারের নায়কের মতন কি সবাই হিপস্টর হয়ে যাব?
শাস্ত্রমানা ধার্মিকদের মধ্যে অনেকের ধ্রুব বিশ্বাস যে ঈশ্বর যখন একাধারে পরম মঙ্গলময় এবং অনন্ত শক্তিমান তখন তাঁর সৃষ্ট জগৎ সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত থেকেই পরিপূর্ণ ও পরোৎকৃষ্ট, দোষ-ত্রুটির লেশমাত্র তাকে স্পর্শ করে নি। কোথাও কোনো দোষ যদি আমাদের চোখে পড়ে তবে সেটা আমাদের চোখেরই দোষ; যারা দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন তাঁরা সর্বত্রই কেবল মঙ্গল আর আনন্দই দেখতে পান। রবীন্দ্রনাথের মনও এক সময়ে এই ধর্ম-মতেই সায় দিত:
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।
তরুণ বয়সের ব্রাহ্মসংগীতে এমনতরো ভাব একাধিকবার প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এটি রবীন্দ্র-মানসের স্থায়ীভাব নয়, পরিণত বয়সের মেজাজের সঙ্গে এর মিল নেই। জাগতিক অমঙ্গল ও অপূর্ণতার চেতনা তাঁর শেষপর্বের কাব্যে খুবই প্রকট, কিন্তু গীতাঞ্জলি পর্বেও সে-চেতনার উপস্থিতি লক্ষণীয়, বিশেষত ঐ সময়কার গদ্য রচনায়। ‘দুঃখের তত্ত্ব আর সৃষ্টির তত্ত্ব যে একেবারে একসঙ্গে বাঁধা। কারণ অপূর্ণতাই তো দুঃখ এবং সৃষ্টি যে অপূর্ণ। সেই অপূর্ণতাই বা কেন? এটা একেবারে গোড়ার কথা। সৃষ্টি অপূর্ণ হইবে না, দেশে-কালে বিভক্ত হইবে না, কার্য-কারণে আবদ্ধ হইবে না এমন সৃষ্টিছাড়া আশা আমরা মনেও আনিতে পারি না। অপূর্ণের মধ্য দিয়া নহিলে পূর্ণের প্রকাশ হইবে কেমন করিয়া?’[৪] পূর্ণের প্রকাশ যে একদিন হবেই সে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না গীতাঞ্জলি পর্বের গদ্যে ও পদ্যে। পরে সন্দেহের ঘনায়মান ছায়া দেখা যায়। বলাকায় সে-ছায়া অত্যন্ত ক্ষীণ এবং প্রায় অলক্ষ্য, কিন্তু নবজাতক-এ এতই ঘনকৃষ্ণ যে ধ্রুবের আলো খুব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় না— দেখতে হলে চোখকে অভ্যস্ত করতে হয় ঐ কাব্যের নাক্ষত্রিক তিমিরে।
আকারহীন বাষ্পপুঞ্জ থেকে ইতস্তত ছড়ানো নীহারিকা, নীহারিকা থেকে নক্ষত্ররাশি, কয়েকটি নক্ষত্রে গ্রহ-চন্দ্র, কয়েকটি গ্রহে (হয়তো বা একটিতেই) প্রাথমিক জীবাণু, সেই অণু-বীক্ষণীয় জীবাণু থেকে বহু কোটি বৎসরের বহুমুখী এবং মাঝে মাঝে পথভ্রষ্ট বা অবরুদ্ধ বিবর্তনের চূড়ান্ত পরিণাম মানুষ। মানুষের জন্মকাল ধার্য করা হয় দশ লক্ষ বৎসর পূর্বে। কিন্তু আজো সে আপনার জান্তব পূর্বপুরুষের সঙ্গে নাড়ির যোগ ছিন্ন ক’রে উঠতে পারে নি। হয়তো মানুষ হতে আরো দশ লক্ষ বৎসর লাগবে তার— অর্থাৎ অনাবিল বুদ্ধিচালিত ও সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ হতে। ইতিমধ্যে দুঃখের ও পাপের প্রাচুর্য না দেখলেই আশ্চর্য হবার কথা। বরঞ্চ এই অপ্রতিহত-প্রায় জড়ের ও জড়বুদ্ধির আধিরাজ্যে অকস্মাৎ বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, শোয়াইৎসর বা গান্ধীর মতো মহাপুরুষের অভ্যুদয়ে আমাদের বিস্ময় লাগে, বিস্ময়ের আনন্দে গান গেয়ে উঠি:
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস—
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
পাগল ওগো, ধরায় আস।
এই অকুল সংসারে,
দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
বিস্ময় ও শ্রদ্ধা আরও প্রগাঢ় হয় যখন দেখি যে শুধু কয়েকজন মহাপুরুষ নয়, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষও বার বার প্রাণ তুচ্ছ ক’রে ঠেকিয়েছে পশুশক্তির স্পর্ধিত পুনরভ্যুদয়কে। হিটলারী দানবিকতার ভাবী কথক কাকা বীভৎস রসের সাহিত্য রচনা করলেন; প’ড়ে আমরা তারিফ করেছি, ভেবেছি এমনি ক’রে লিখতে হয় যুগোপযোগী উপন্যাস। অথচ এই দানবিক শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে এগিয়ে এলো ইংলণ্ড, মার্কিন ও রুশ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, প্রাণের মূল্যে তাকে পরাজিত করল। ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের পতনের পর কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে এত বড় অভিশাপ পৃথিবীর বুকের উপর থেকে উঠে যাবে মাত্র পাঁচ বছরের সংগ্রামে? অথচ এই বিপুল সংখ্যক মানুষের অমিত বীর্যের কাছে শক্তিমদমত্ত ফ্যাসিজমের সমূহ বিপর্যয় তো তেমন কোনো সাড়া জাগাল না আধুনিক সাহিত্যে। কেন এই পক্ষপাত? জীবনে যখন শুভ ও সুন্দরের আবির্ভাব ঘটে তখন কেন আজকের সাহিত্যিকেরা নীরব থাকেন? একালের বীণার তার কি কেবল অশুভের আঘাতেই ঝংকার তুলবে?
.
দুঃখ ও পাপের চিত্র তাঁর কাব্যে যথোপযুক্তরূপে পরিস্ফুট নয়— এ-কথা স্বীকার ক’রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমি যে ‘রসতীর্থ-পথের পথিক’, ‘আমি রোম্যান্টিক’, জগতের সমস্ত কালিমার যথাযথ চিত্রণ তো আমার কাজ নয়। তবে তোমরা যদি ভাবো বাস্তব জগতের নিরতিশয় পীড়িত এবং বীভৎস চেহারাটা আমার চেনা নয়, তা হলে ভুল করছ; কিন্তু সে-পরিচয়ের যথার্থ প্রকাশের ক্ষেত্র কাব্য নয়, কর্ম।
যেথা ঐ বাস্তব জগৎ
সেখানে আনাগোনার পথ
আছে মোর চেনা।
সেখাকার দেনা
শোধ করি— সে নহে কথায় তাহা জানি—
তাহার আহ্বান আমি মানি।
দৈন্য সেথা, ব্যাধি সেথা, সেথায় কুশ্রীতা,
সেথায় রমণী দস্যুভীতা—
সেথায় উত্তরী ফেলি পরি বর্ম;
সেথায় নির্মম কর্ম; (নবজাতক—“রোম্যান্টিক”)
দুঃখ ও পাপের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে পরিচিত হয়েও জীবনের ঐ কঠোর তথ্যগুলিকে তাঁর কাব্যে খুব বড় ক’রে দেখান নি কেন— উপরের পক্তিগুলি তারই কৈফিয়ত।
দুঃখ ও পাপের অতি বাস্তব সত্তাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তাতে সাড়া না দিয়েও পারি না। সে-সাড়া নান্দনিকও হবে, শ্রেয়োনীতিকও হবে। কিন্তু আগেই বলেছি যে, দুই প্রকার সাড়াতে অমঙ্গল-চেতনার প্রকৃতি হবে ভিন্ন। যথোপযুক্ত শ্রেয়োনীতিক প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন দুঃখ ও পাপের কালো দাগগুলিকে বড় ক’রে দেখা। নান্দনিক দৃষ্টি কিন্তু পড়বে দিগন্তব্যাপী সমগ্র পরিপ্রেক্ষিতের উপর; তার মাঝ-খানকার কয়েকটি বিশেষ ছাপকে বাড়িয়ে দেখলে জগৎচিত্রে বর্ণসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সমস্ত চিত্রটা বিকৃত হয়ে যায়। আধুনিক সাহিত্যবীররা শ্রেয়োনীতিক ক্রোধ আর ঘৃণা এবং তজ্জনিত অতিরঞ্জিত বর্ণপ্রলেপনকে তাঁদের সাহিত্যে স্থান দিয়ে পরিপ্রেক্ষিতের ঠিক এই বিকৃতিই ঘটাচ্ছেন। তাতে শুধু সাহিত্যই বিকৃত হচ্ছে না, সাহিত্যিক এবং পাঠক উভয়েরই কর্মজীবনও বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। শ্রেয়োনীতির মেজাজকে সাহিত্যনীতিতে টেনে আনলে মর্যালিটি এবং আর্ট উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
যা সংগতভাবে আমাদের ক্রোধ বা ঘৃণা জাগাতে পারে এমন অনেক কিছু ঘটে এই অপূর্ণ (ইম্পারফেক্ট) জগৎ-সংসারে; ঘটবারই কথা। ঈশ্বর কেন এমনটা ঘটতে দিলেন ব’লে অভিমান ক’রে, রাগ ক’রে, সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে গাল পাড়তে থাকাটা ছেলে-মানুষি; ইচ্ছাকৃত ছেলেমানুষি তাঁদের বেলা যারা ঈশ্বরে আদৌ বিশ্বাস করেন না অথচ গতায়ু ঈশ্বরকে পুনরুজ্জীবিত ক’রে হাজির করেন তাঁদের কাব্যে— উষ্মা প্রকাশ আর দুর্বাক্য প্রয়োগের লক্ষ্য রূপে। অলংকার হিসাবে ঈশ্বরের স্থান হতে পারে কাব্যে; তাতে দোষ নেই। কিন্তু আলংকারিক (অর্থাৎ কাল্পনিক) ঈশ্বরের উপর তো আর সত্যিকার রাগ হয় না। তবে সত্যিকার রাগ কার উপর,— জড়প্রকৃতির উপর, ইলেকট্রো-ম্যাগ্নেটিক ইকুয়েশন কিংবা কেমিক্যাল ফর্মুলার উপর? তাও তো সম্ভব নয়। তবে কি মানুষের উপরই? সেটা সম্ভব বটে। কিন্তু মনুষ্যকৃত অন্যায় অত্যাচারের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু রাগের বা ঘৃণার কবিতা লেখা অসংগত। সেখানে কবিকে হতে হবে কর্মী, অন্তত তাঁর পাঠকের কর্মশক্তি উদ্বুদ্ধ করার দিকে মনোযোগী হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে সাহিত্য হবে ফলিত সাহিত্য, মার্ক্সিস্ট সাহিত্য। অতিশয় মূল্যবান জিনিস, তবে তা বিশুদ্ধ সাহিত্য নয়। বিশুদ্ধ সাহিত্য-রচয়িতা কর্মের দায় থেকে মুক্ত। কিন্তু আর-একটি অবশ্যম্ভাবী দায়িত্ব বর্তায় তাঁর উপর— সত্যের দায়িত্ব, নান্দনিক যাথার্থ্যের দায়িত্ব।
একজন তরুণ কবি সম্প্রতি লিখেছেন:
একদা স্বপ্নের সঙ্গে ছিল লুকোচুরি
অহরহ কবিতার চোর-চোর বুড়ি-বুড়ি খেলা।
এখন শব্দের সঙ্গে খেলা
এখন শব্দই স্বপ্ন,
চৌমাথার ভিড় থেকে ফুসলিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে
একটি শব্দকে ধরে কোনোভাবে ঘরে নিয়ে আসা।[৬]
নিছক স্বপ্নের সঙ্গে খেলা চুকে-বুকে গেছে, ভালোই হয়েছে। কিন্তু কাব্যের পূর্ণ ভাণ্ডার থেকে স্বপ্ন বাদ দিলে কি হাতে থাকে শুধু শব্দ, আর কিছুই না? ভয়ে ভয়ে তরুণ কবিদের বলি, একটু ভালো ক’রে হাতড়ে দেখুন, আরো কিছু পাবেন। এত বড় ভাণ্ডার, কত কাল ধ’রে কত দেশ জুড়ে নন্দিত তার গৌরব; তাতে কি স্বপ্নের ফাঁকি আর শব্দের কারচুপি ছাড়া আর কিছুই ছিল না? ছিল। দেশ-কালের সীমায় ধরে না এমন মহীয়ান, বিজ্ঞানের সন্ধানী আলো পৌঁছয় না এমন গুহাহিত সত্য ছিল, তার ভয়ংকর-মধুর রূপের আভাস ছিল, সত্যদৃষ্টি লাভ করার জন্য আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা ছিল, হর্ষবিহ্বল ও যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয়ের উদ্বেলতা ছিল। কোথায় গেল সে-সব? শুধু চোর-চোর বুড়ি-বুড়ি খেলা ক’রে এত বড় দায়িত্ব তাঁরা এড়িয়ে যাবেন— এটা তো ভালো ঠেকছে না। মুজতবা আলীর মুখে শুনেছি কলকাতার কোনো এক ছাত্রদল শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। মুজতবারা গেলেন অধ্যাপক তুচির কাছে ম্যাচ দেখার ছুটি চাইতে। তুচি বললেন, তোমরা বড় হয়েছ, কলেজে পড়ছ, খেলা নিয়ে এত মাতামাতি কেন? বালঃ ক্রীড়তি। আধুনিক কবিদের কাছে আমারও সেই একই নিবেদন– শব্দের খেলা নিয়ে এত মাতামাতি করবেন না; বালঃ ক্রীড়তি। হালফ্যাশনের কবিতা লিখতে বা পড়তে অনেক বিদ্যাবুদ্ধি লাগে, তদুপরি অনেক পরিশ্রম। তাই খেলাটা যে উঁচুদরের এবং বিদগ্ধজনোচিত সেকথা কবুল করতেই হবে। তবু খেলা। পক্ষান্তরে, আমি কাব্যরসাস্বাদনকে জীবনের মহত্তম উপলব্ধির অন্যতম জ্ঞান করি। এরূপ জ্ঞান করাটা হয়তো সেকেলে। হোক তা। একেলে হবার জন্য সর্বস্বান্ত হতে ‘আমার মন নয় রাজী’। কবিতা থেকে কী পেলাম আর কী পাই নি তার হিসাব আমার মতো অকবি কাব্যরসিককে মেলাতেই হয়।
সত্যমিথ্যার ধার ধারে না কবিতা একথা যদি আধুনিকেরা বলতে চান তবে বলুন, মানতে না পারলেও শুনতে প্রস্তুত আছি। ক্রিকেট কিংবা শব্দের খেলা স্থায়ী আনন্দ না দিলেও সাময়িক আমোদ তো দিতেই পারে। কিন্তু যখন দেখি তাঁরা সত্যের ধার ধারেন না ব’লেই ছোটেন মিথ্যার কাছে বড় অঙ্কের ঋণে নিজেকে আদ্যোপান্ত জড়াতে, তখন প্রতিবাদ না ক’রে পারি না। সমস্ত জগৎকে এবং মানুষমাত্রকে শুভ ও সুন্দর ব’লে জানাটা যদি হয় স্বপ্নবিলাস, তবে সমস্ত জগৎকে এবং মানুষমাত্রকে ঘৃণ্য ও বীভৎস ব’লে জানানোটা দুঃস্বপ্নবিলাস। পাখির গান, চাঁদের আলো, সুন্দরীর হাসি নিয়ে কাব্যে বাড়াবাড়ি করা যদি ন্যাকামি ব’লে নিন্দিত হয়, তবে মানুষের দুঃখ ও পাপ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কঠোরতর ভাষায় ধিক্কৃত হওয়া উচিত, কারণ সে-বাড়াবাড়ির ফল হবে দারুণতর। দারুণতর হবে বিশেষত এই জন্য যে অধুনাতম সাহিত্যিক অমঙ্গলবিলাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দেখি মধ্যযুগের আদি-পাপ সংক্রান্ত উন্মূলিতপ্রায় ডগমার বা তার বিকৃততর সংস্করণের পুনরুজ্জীবন। মানুষের স্বভাবে এমন এক চিরজন্মগত দোষ অবশ্যতই বিদ্যমান যাতে ক’রে কোনো কালেই সে মানুষ হয়ে উঠবে না, আত্ম-রতিতে, পরশ্রীকাতরতায়, কপটতায়, হিংসায় নিমজ্জিত হয়ে থাকবে দূরতম ভবিষ্যতেও, এক পাপ ছাড়লে অন্য ঘৃণ্যতর পাপে লিপ্ত হবে— নবযুগের এই কুসংস্কারকে সুশিক্ষিত মানুষের মনে বদ্ধমূল ক’রে তার কর্মপ্রেরণাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট ক’রে দেওয়াটা আধুনিক সাহিত্যের এক দূরপনেয় কীর্তি।
খ্রীষ্টানরা তবু গ্রেস-এ বিশ্বাস করতেন, অর্থাৎ বিশ্বাস করতেন— ঈশ্বরের অপার করুণা একদিন দেখা দেবেই, এবং তখন সব-কিছু শুদ্ধ নির্মল নিষ্পাপ হয়ে যাবে। কিন্তু নিরীশ্বরবাদের সঙ্গে আদি-পাপের ডগমা যুক্ত হলে যোগফলটা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। ম্যাটার ও মোমেন্টাম্ যেমন রূপ বদলায় কিন্তু পরিমাণে একটুও কমে-বাড়ে না, দুঃখ ও পাপও যদি তেমনি শুধু নব নব রূপ পরিগ্রহ ক’রে চলে কিন্তু অনন্ত কালের মধ্যে তার মাত্রা বিন্দুমাত্রও না কমে, এবং পদার্থবিজ্ঞানের পূর্বোক্ত মূলনীতির মতো এই চারিত্র্য-বৈজ্ঞানিক আপ্তবাক্যটিকেও যদি আমরা অকাট্য সত্য ব’লে মানি, তবে কিসের জন্য প্রাণপাত করব, কোনো হিতকর্ম করতে গিয়ে কেনই বা সুখস্বাচ্ছন্দ্য ধনপ্রাণ বিপন্ন করব? এই অতি ঘৃণ্য ভূতলে শ্রেয় যদি শুধু দুঃসাধ্য নয়, একেবারে অসাধ্য হয়, তা হলে ঋণং কৃত্বা হুইস্কিং পিবেৎ কিংবা সনাতন দড়ি কলসীর সন্ধান করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না ভূতল-বাসীদের। এমনতর চূড়ান্ত নীতিবাক্য আধুনিক সাহিত্যিকেরা প্রচার করতে চান বা না চান, এটাই কি বোদলেয়ার পরবর্তী এবং তদনুপ্রাণিত সাহিত্যের ফলশ্রুতি হয়ে দাঁড়ায় না? বলা বাহুল্য, আমি সমগ্র আধুনিক সাহিত্যের কথা বলছি না এখানে, তার একটি মূল ধারার— বিতৃষ্ণা এবং বিবমিষার ধারার কথাই আলোচনা করছি।
.
১ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— শান্তিনিকেতন, ২, পৃ ২৩১, ২৩৩, ২৩৫
২ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— সাহিত্যের পথে, পৃ ১৪৮
৩ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— সাহিত্য, পৃ ৭৯
৪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— ধর্ম, পৃ ৯৮
৫ কবিপুরুষ ও কর্মীপুরুষের দ্বৈধ এবং তাঁর নিজের ব্যক্তিস্বরূপের ক্রমপরিণতিতে কবিসত্তা যেমন বিকশিত কর্মীসত্তা তেমন প্রস্ফুটিত নয় এই বেদনা রবীন্দ্রনাথের কাব্যে বারে বারে অভিব্যক্ত হয়েছে। তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ পত্রপুট-এর বারো সংখ্যক কবিতা।
জীবনের পথে মানুষ যাত্রা করে
নিজেকে খুঁজে পাবার জন্যে।
গান যে মানুষ গায়, দিয়েছে সে ধরা, আমার অন্তরে;
যে মানুষ দেয় প্রাণ, দেখা মেলে নি তার।
দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ
ছায়ায় পরিকীর্ণ,
যেন পাহাড়তলীতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর।
… … …
মৃত্যুর গ্রন্থি থেকে ছিনিয়ে ছিনিয়ে
যে উদ্ধার করে জীবনকে
সেই রুদ্র মানবের আত্মপরিচয়ে বঞ্চিত
ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি
অপরিস্ফুটতার অসম্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে।
৬ তারাপদ রায়— “স্বপ্নের কবিতা”, দেশ, ১লা এপ্রিল, ১৯৬৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন