আবু সয়ীদ আইয়ুব
এই ভরা সরোবরের কাব্য রবীন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে দিল স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে জাপান এবং আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। অনেকে মনে করেন এই পর্বের রচনাই রবীন্দ্র-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ ফসল। কিন্তু বহুবিধ শস্যের ফসল ফলেছে রবীন্দ্র-মানসের বিশাল ক্ষেত্রে, সেইসব বিভিন্ন শস্যের আপেক্ষিক মূল্যবিচার সহজ নয়। তবু আমার বিশ্বাস যে, শ্রেষ্ঠতর ফসল ফলেছিল তাঁর শেষ দশকের কর্ষণে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ভক্তি-কাব্যেও আমার অ-ভক্ত মন মুগ্ধ; তা নিয়ে যে-সমস্যার উদয় হয় তার আলোচনা একটু পরেই করব।
গীতাঞ্জলি পর্বের রচনাতে দুঃখ ও অমঙ্গলকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে গ্রহণ করেছেন তা এই পর্বেরই বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন বলা ভুল হবে; কিংবা জাগতিক দুঃখদুর্দশারূপ তমসার একেবারে পরপারে আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে দেখতে পাচ্ছেন, তাও ঠিক নয়। দুঃখের বেশেই দেবতা নেমে আসেন ভক্তের দ্বারে:
দুখের বেশে এসেছ বলে
তোমারে নাহি ডরিব হে।
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা
নিবিড় করে ধরিব হে।
অথবা দুঃখই মেজরাব হয়ে গভীর রাতে হৃদয়ের তন্ত্রীতে যে-গান বাজিয়ে তোলে সে-গানই মিলনের সেতু রচনা করে:
লুটিয়ে পড়ে সে গান মম ঝড়ের রাতের পাখি সম
বাহির হয়ে আসো তুমি অন্ধকারে।
আর-কিছু না, গলায় যে-ছিন্ন মালাটি মিলন-রাত্রির শেষে শয্যাতলে প’ড়ে ছিল, সেটুকু চেয়ে নিতেও পারে নি ভীরু প্রণয়িনী দ্বিধায় লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে চুপটি ক’রে দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু যাওয়ার সময়ে এ কী দিয়ে গেল সে-নিষ্ঠুর, সে-ভয়ানক প্রেমিক? এই কি তার প্রেমের দান, মিলন-রজনীর স্মৃতিচিহ্ন?
ভোরের পাখি শুধায় গেয়ে
‘কী পেলি তুই নারী’।
নয় এ মালা, নয় এ থালা,
গন্ধজলের ঝারি,
এ যে ভীষণ তরবারি।
বুকের মাঝে তবু রাখতে হবে এ-বেদনার দানকে। বজ্রহেন ভারী তরবারি আগুনের মতো জ্ব’লে উঠে বুক পুড়িয়ে ফেলে, তবুও মনে হয় না যথেষ্ট হয়েছে আঘাত। কঠিনতর বেদনায় টনটন ক’রে উঠুক বুকের পাঁজরগুলো:
আরো আঘাত সইবে আমার
সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবন-
তারে ঝংকারো।
আঘাতকে এড়িয়ে চলা আর নয়, ভয় করার তো সত্যি কিছু নেই, এগিয়ে গিয়ে বুক পেতে নিতে হবে সব-ক’টি বাণ:
ও নিঠুর,     আরো কি বাণ
তোমার তূণে আছে?
তুমি     মর্মে আমায়
মারবে হিয়ার কাছে?
আর-এক প্রকার দুঃখের কথা গীতাঞ্জলিতে বারে বারে বলা হয়েছে। সে-দুঃখ জীবননাথের দেওয়া দুঃখ নয়, তাঁকে না-পাওয়ার দুঃখ। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘গীতাঞ্জলিতে দেখিতেছি এই উন্মুখর অধীর প্রতীক্ষা বিরহের ক্রন্দনে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছে। বিরহের বেদনা, দেবতাকে একান্ত না-পাওয়ার দুঃখ গীতাঞ্জলির গানগুলির উপর সুগভীর ছায়াপাত করিয়াছে।’[২] সুগভীর কিন্তু সুমধুর। বিরহ চিরন্তন হলে দুঃখ দুর্বিষহ হ’ত। কিন্তু যে-বিরহ মিলনেরই সম্ভাবনায় মদির, তা মিলনেরই পূর্বাস্বাদন, তিক্ত হলেও সুস্বাদু।
তুমি যদি না দেখা দাও
করো আমায় হেলা
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল বেলা।
এ-অনুযোগ ব্যর্থ হবার নয়, ব্যর্থ হবে এমন আশঙ্কা নেই অনুযোগকারিণীর মনে। যদি থাকত তবে তার প্রকাশ হ’ত অন্য ভাষায়, এই আবদারের সুর তাতে বেমানান হ’ত।
দূরের পানে মেলে আঁখি
কেবল আমি চেয়ে থাকি
পরান আমার কেঁদে বেড়ায়
দুরন্ত বাতাসে।
‘দুরন্ত’ শব্দটা লক্ষণীয়। যে-বাতাসের সঙ্গে পরান কেঁদে বেড়ায় তাকে ছোট্ট ছেলের মতো আদর ক’রে বলা হচ্ছে ‘দুরন্ত’। এ-কান্না তো গুমরে-ওঠা কান্না নয়। এই মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় যাঁর জন্য প্রতীক্ষা তিনি আসবেনই, খুব গোপন চরণ ফেলে, ‘সবার দিঠি এড়ায়ে’ আসবেন। যে-পথের দুই দিকে দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে’ সেই নির্জন পথে প্রতীক্ষমাণার ঘরের সম্মুখে এসে দাঁড়াবেন। তার পরে যদি বিরহিণী ব’লে ওঠেন:
হে একা সখা, হে প্রিয়তম
রয়েছে খোলা এ ঘর মম
সমুখ দিয়ে স্বপন সম
যেয়ো না মোরে হেলায় ফেলে।
তখন কি আমাদের মনে খুব সন্দেহ থাকে যে উদাসীন অতিথি একবার একটুক্ষণের জন্য ঘরেও প্রবেশ করবেন? আর যদি হেলায় ফেলে চলেই যান, দিন বৃথাই কাটে, রাত গভীর হয়, প্রহরের পর প্রহর পথ চেয়ে থাকতে হয়, তবু:
প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে;
দেখা না পাই,
পথ চাই,
সেও মনে ভালো লাগে।
কারণ জানাই তো আছে যে উদাসীন সত্যই উদাসীন নন, তিনি আসতেই ইচ্ছুক; আর যখন আসেন, ‘অরুণবরন পারিজাত হাতে’ নিয়ে আসেন। বাধা তাঁর দিক থেকে নয়। বাধা এই যে পাশে এসে বসলেও নিদ্রাকাতরা হতভাগিনীর ঘুম ভাঙে না; কখনও বা নেহাত আলসেমিতেই পেয়ে বসে:
কতবার আমি ভেবেছিন্ন উঠি উঠি,
আলস ত্যজিয়া পথে বাহিরাই ছুটি;
উঠিন্ন যখন তখন গিয়েছ চলে।
এই অবিক্ষুব্ধচিত্ত স্থিতহৃদয় বিরহিণীর বিরহ-দুঃখে কি সুখের আমেজ যথেষ্ট লাগে নি? ‘বিরহ মধুর হ’ল আজি মধুরাতে’, শুধু কোনো বিশেষ রাতে নয়, সব রাতেই মধুর।
রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি পর্বে দুঃখের কথা খুবই ভাবছেন, কিন্তু সে-দুঃখ একান্তভাবে নিজেরই। আগেই বলা হয়েছে যে গীতাঞ্জলির কবি নিজেকে এবং তাঁর জীবনবল্লভকে নিয়ে সর্বান্তঃকরণে ব্যাপৃত, প্রায় সমস্ত কবিতা এই নিভৃত দ্বিরালাপের কবিতা। দৈবাৎ কোথাও যদি শুনি:
চরণভরে কাঁপে ধরা,
অগ্নিবাণে তূণ যে ভরা,
জীবনদেবতা মেতেছে আজ
মরণ-উৎসবে।
তবে হঠাৎ ভ্রম হয়, কবি বুঝি সমস্ত পৃথিবীর, সকল মানুষের সর্বনাশের কথাই ভাবছেন। কিন্তু পরবর্তী শ্লোক সে-ভুল ভেঙে দেয়, অগ্নিবাণে ‘আমার’ই ‘বক্ষ বিদীর্ণ’ হচ্ছে, ‘আমার’ই মরণ নিয়ে এ মরণ-মহোৎসব; আর সে-মরণকে নিয়ে তো কোনো দুর্ভাবনা নেই, কারণ:
মরণ-দুখে জাগাব মোর
জীবন-বল্লভে।
সর্ব মানবের দুঃখের কথা রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন নৈবেদ্য-এ, আবার ভাববেন বলাকায়—ভক্তিপর্বের দুই প্রান্তবর্তী কাব্যে। ইতিমধ্যে কেবল ‘তুমি’ আর ‘আমি’ একান্তে আসীন, সমাজ সংসার মিছে না হলেও বহু দূরে স’রে গেছে। প্রমথনাথ বিশী ঠিকই বলেছেন: ‘সর্ব মানবের সহিত একাত্মবোধ… গীতাঞ্জলি পর্বে বাধাগ্রস্ত।’ কিন্তু তা থেকে কি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে ‘নৈবেদ্য প্রকাশের পরে অর্থাৎ ১৯০২ হইতে বলাকার কবিতা রচনার সময় ১৯১৪ পর্যন্ত, এই দ্বাদশ বৎসর রবীন্দ্র প্রতিভার বনবাস?[২]’ মানবমুখিতা রবীন্দ্রপ্রতিভার একটি ধারা, একমাত্র ধারা নয়।
.
১ নীহাররঞ্জন রায়— রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূমিকা (৫ম সংস্করণ), পৃ ১১
২ প্রমথনাথ বিশী— রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ, ১ম খণ্ড, পৃ ১৭ ও ২১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন