নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ধর্মঘটের ফলে সরকার বাহাদুরের সঙ্গে আমাদের যে রফা হইল তাহার মোদ্দা কথা এই যে, আমাদের চৌদ্দ বৎসর কালাপানির জেলে বন্ধ থাকিতে হইবে। চৌদ্দ বৎসরের পর আমাদের জেলেব বাহিরে ছাড়িয়া দেওয়া হইবে আর তখন আমাদিগকে কয়েদীর মত পরিশ্রম করিতে হইবে না। জেলখানার ভিতরেও আমরা বাহিরের কয়েদীর মত নিজের নিজের আহার রাঁধিয়া খাইতে পারিব ও বাহিরের কয়েদীর মত পোষাক পরিতে পারিব অর্থাৎ জাঙ্গিয়া, টুপি ও হাতকাটা কুর্তা না পরিয়া কাপড় ও হাতাওয়ালা কুর্তা পরিতে পাইব আর মাথায় একটা চার হাত লম্বা কাপড়ের পাগড়ী জড়াইবার অধিকার পাইব। অধিকন্তু দশ বৎসর যদি আমরা ভাল ব্যবহার করি অর্থাৎ ধর্মঘটে যোগ না দিই বা জেলের কর্তাদের সহিত ঝগড়া না করি তাহা হইলে দশ বৎসর কয়েদ খাটিবার পর সরকার বাহাদুর বিবেচনা করিবেন আমাদের আরও অধিক দুখে রাখিতে পারেন কি না! জাঙ্গিয়া ছাড়িয়া আট হাতি মোট। কাপড় পরিয়া বা মাথায় পাগড়ী বাঁধিয়া আমাদের মুখের মাত্রা যে কি বাড়িয়া গেল তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তবে নিজের হাতে রাঁধিবার অধিকার পাইয়া প্রত্যহ কচুপাতা সিদ্ধ খাইবার দায় হইতে কতকটা অব্যাহতি পাইলাম! সঙ্গে সঙ্গে কঠিন পরিশ্রমের হাতও এড়াইলাম। বারীন্দ্রকে বেতের কারখানার তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হইল; হেমচন্দ্রকে পুস্তকাগারের অধ্যক্ষ করা হইল আর আমি হইলাম ঘানি-ঘরের মোড়ল। প্রাতঃকাল ১০টা হইতে ১২টার মধ্যে রন্ধন ও আহারাদি শেষ করিয়া লইবার কথা; কিন্তু ঐ অল্প সময়ের মধ্যে সব কাজ সারিয়া লওয়া অসম্ভব দেখিয়া আমরা সাধারণ ভাণ্ডারা (পাকশালা) হইতে ভাত ও ডাল লইতাম; শুধু তরকারীটা নিজেদের মনোমত রাঁধিয়া লইতাম। রন্ধন-বিদ্যায় হেমচন্দ্রের ওস্তাদ বলিয়া নামডাক ছিল। প্রকৃতপক্ষে মাংস, পোলাও প্রভৃতি নবাবী খানা তিনি বেশ রাঁধিতে পারিতেন, তবে সোজাসুজি তরকারি রাঁধিতে আমাদের চেয়ে বেশী পণ্ডিত ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। একদিন একটা মোচা পাইয়া বহুকাল পরে মোচার ঘণ্ট খাইবার সাধ হইল। কিন্তু কি করিয়া রাঁধিতে হয় তাহা ত জানি না। মোচার ঘণ্ট রাঁধিবার জন্য যে প্রকাণ্ড কনফারেন্স বসিল তাহাতে রন্ধনপ্রণালী সম্বন্ধে কাহারও সহিত কাহারও মত মিলিল না। বারীন্দ্র বলিল-“আমার দিদিমা হাটখোলার দত্তবাড়ীর মেয়ে এবং পাকা রাঁধুনী, সুতরাং আমার মতই ঠিক।” হেমচন্দ্ৰ বলিল—“আমি ফ্রান্সে গিয়ে ফরাসী রান্না শিখে এসেছি, সুতরাং আমার মতই ঠিক।” আমাদের সব স্বদেশী কাজেই যখন বিদেশী ডিপ্লোমার আদর অধিক তখন আমরা স্থির করিলাম যে, মোচার ঘণ্ট রান্নাটা হেমদাদার পরামর্শ মতই হওয়া উচিত। আমি গম্ভীর ভাবে রাঁধিতে বসিলাম, হেমদা কাছে বসিয়া আরও গম্ভীর ভাবে উপদেশ দিতে লাগিলেন। কড়ার উপর তেল চড়াইয়া যখন হেমদা পেঁয়াজের ফোড়ন দিয়া মোচা ছাড়িয়া দিতে বলিলেন, তখন তাঁহার রন্ধন-বিদ্যার ডিপ্লোমা সম্বন্ধে আমার একটু সন্দেহ হইল। মোচার ঘণ্টে পেঁয়াজের ফোড়ন কি রে বাবা? এযে বেজায় ফরাসী কাণ্ড! কিন্তু কথা কহিবার উপায় নাই। চুপ করিয়া তাহাই করিলাম। মোচার ঘণ্ট রান্না হইয়া যখন কড়া হইতে নামিল তখন আর তাহাকে মোচার ঘণ্ট বলিয়া চিনিবার জো নাই। দিব্য তোফা কাল রং আর চমৎকার পেঁয়াজের গন্ধ! খাইবার সময় হাসির ধূম পড়িয়া গেল। বারীন্দ্র বলিল—“হ্যাঁ, দাদা একটা ফরাসী chef de cuisine বটে; দিদিমা আমার এমনটি রাধিতে পারিত না।” হেমদ। হাটবার পাত্র নহেন। তিনি বলিলেন—“ঐ ত তোমাদের রোগ! তোমরা সবাই দিদিমা-পন্থী। দিদিমা যা করে গেছেন তা আর বদলাতে চাও না।” মোচার ঘণ্ট যেদিন রন্ধনের গুণে মোচার কাবাব হইয়া দাঁড়াইল, তাহার দিন কতক পরে একবার যুক্ত রাঁধিবার প্রস্তাব উঠিয়াছিল। কিন্তু ভুক্ত রাঁধিবার সময় কি কি মসলা দিতে হয় সে বিষয়ে মতদ্বৈধ রহিয়া গেল। হেমদা’ বলিলেন যে তরকারীর মধ্যে এক আউন্স কুইনাইন মিক্সচার ফেলিয়া দিলেই তাহা ভুক্ত হইয়া যায়। আমাদের দেশের যে সমস্ত নবীনা গৃহিণী পাঁচ খণ্ড পাকপ্রণালী কোলে করিয়া রাখিতে বসেন, রাঁধিবার এই অভিনব প্রণালীটা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন। ব্যাপারটা যদি সত্য হয় তাহা হইলে এই ম্যালেরিয়া-প্রপীড়িত দেশে তাঁহারা একাধারে আহার ও পথ্যের আবিষ্কার করিয়া অমর হইয়া যাইতে পারিবেন। দাদারও জয় জয়কার পড়িয়া যাইবে।

রাঁধিবার জন্য আমরা জেল হইতে কিছু কিছু তরকারী লইতাম, তবে তাহার মধ্যে চুবড়ী আলু আর কচুই প্রধান। কাজে কাজেই বাজাব হইতে মাঝে মাঝে অন্য তরকারী আনাইয়া লইতে হইত সরকার বাহাদুরের নিয়মানুযায়ী আমরা মাসিক বেতন পাইতাম বারো আনা। আমরা শারীরিক দুর্বল ছিলাম বলিয়া জেলের কর্তৃপক্ষগণ আমাদের প্রত্যেককে বারো আউন্স করিয়া দুধ দিয়া তাহার আংশিক মূল্য স্বরূপ মাসিক আট আনা কাটিয়া লইতেন। বাকি চার আনার উপর নির্ভর করিয়া আমাদের সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতে হইত। কিছুদিন পরে জেলের মধ্যে একটা ছাপাখানা স্থাপন করিয়া বারীজের উপর তাহার তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হয় আর হেমচন্দ্রকে বই-বাঁধাই বিভাগের অধ্যক্ষ করিয়া দেওয়া হয়। সেই সময় সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব উহাদের প্রত্যেককে মাসিক পাঁচ টাকা করিয়া ভাতা দিবার জন্য চীফ কমিশনারের অনুমতি চান। পাঁচ টাকার নাম শুনিয়াই চীফ কমিশনার লাফাইয়া উঠিলেন। কয়েদীর মাসিক ভাতা পাঁচ টাকা। আরে বাপু। তাহা হইলে ইংরেজরাজ যে ফতুর হইয়া যাইবে! অনেক লেখালেখির পর মাসিক এক টাকা করিয়া বরাদ্দ হইল। যথা লাভ!

ক্রমে ক্রমে আমাদের রান্নাঘরের পাশে একটি ছোট পুদিনার ক্ষেত দেখা দিল; তাহার পর দুই চারিটা লঙ্কা গাছ, এক আধটা বেগুন গাছ ও একটা কুমড়া গাছও আসিয়া জুটিল। এ সমস্ত শাস্ত্রবিরুদ্ধ ব্যাপার ঘটিতে দেখিয়া জেলার মাঝে মাঝে ভাড়া করিয়া আসিত; কিন্তু সুপারিনটেনডেন্টের মনের এক কোণে আমাদের উরর একটু দয়ার আবির্ভাব হইয়াছিল। তিনি এ সমস্ত ব্যাপার দেখিয়াও দেখিতেন না। জেলারের প্রতিবাদের উত্তরে বলিতেন— ‘এরা যখন চুপ চাপ কবে আছে, তখন এদের আর পিছু লেগো না।’ এরূপ দয়া প্রকাশের কারণও ঘটিয়াছিল। কর্তৃপক্ষের আট ঘাট বন্ধ রাখিবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে দেশের খবরের কাগজে তাহাদের কীর্তি-কাহিনী প্রকাশ হইয়া পড়িত। তাহাতে তাঁহাদের মেজাজটা প্রথম প্রথম বিলক্ষণই উগ্র হইয়া উঠিত; কিন্তু শেষে অনেকবার ঠেকিয়া ঠেকিয়া তাঁহারাও শিখিয়াছিলেন যে কয়েদীকে বেশী খাটাইয়া লাভ নাই।

মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হইবার প্রবলতর কারণ জার্মানীর সহিত ইংরাজের যুদ্ধ। যুদ্ধ বাধিবার অল্পদিনের মধ্যেই কর্তাদের মুখ যেন শুকাইয়া গেল। কয়েদীদের তাড়া করিবার প্রবৃত্তি বড় বেশী রহিল না। অষ্ট্ৰীয়ার রাজপুত্রের হত্যাকাণ্ড হইতে আরম্ভ করিয়া প্যারী নগরীর কুড়ি মাইলের মধ্যে জার্মান সৈন্যের আগমন সংবাদ সবই আমরা জেলের ভিতরে বসিয়া পাইতেছিলাম। শেষে যখন এমডেন আসিয়া মাদ্রাজের উপর গোলা ফেলিয়া চলিয়া গেল তখন ব্যাপারটা আর সাধারণ কয়েদীর নিকট হইতে লুকাইয়া রাখা সম্ভবপর হইল না। ইংরাজের বাণিজ্য ব্যাপারে যে যথেষ্ট ক্ষতি হইতেছে তাহা কয়েদীদের বুঝিতে বাকি রহিল না। আগে পিপা পিপা নারিকেল ও সরিষার তৈল পোর্টব্লেয়ার হইতে রপ্তানী হইত, এখন সে সমস্তই গুদামে পচিতে লাগিল। জেলে ঘানি চালান বন্ধ হইয়া গেল। শেষে যখন কয়েদীর নিকট হইতে নানারূপ প্রলোভন দেখাইয়া যুদ্ধের জন্য টাকা সংগ্রহ (war loan) করা হইতে লাগিল তখন পোর্টব্লেয়ারে গুজব রটিয়া গেল যে, ইংরাজের দফা এবার রফা হইয়া গিয়াছে। জেলের দলাদলি ভাঙ্গিয়া গিয়া শত্রুমিত্ৰ সবাই মিলিয়া জার্মানীর জয় কামনা করিয়া ঘন ঘন মালা জপিতে আরম্ভ করিল। জার্মানীর বাদসা নাকি হুকুম দিয়াছে যে, সব কয়েদীকে ছাড়িয়া দিতে হইবে! সাহেবদের আরদালীরা আসিয়া খবর দিতে লাগিল যে, আজ সাহেব সংবাদপত্র পড়িতে পড়িতে কাঁদিয়া ফেলিয়াছে, কাল সাহেব না খাইয়া বিছানায় মুখ গুজিয়া পড়িয়াছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। ঝাঁকে ঝাঁকে ভবিষ্যদ্বক্তা জুটিয়া গেল। কেহ গল, পীর সাহেব স্বপ্ন দেখিয়াছেন যে, ১৯১৪ সালে ইংরেজে ভরা ডুবিবে, কেহ বলিল এ কথা ত কেতাবে স্পষ্টই লেখা আছে! মোটের উপর সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই একই আলোচনা চলিতে লাগিল।

কয়েদীদের মনের ভাব শেষে কর্তৃপক্ষেরও অগোচর রহিল না। ইংরেজ যে যুদ্ধে হারিতেছে না এ কথা প্রমাণ করিবার জন্য জেলের সুপারিনটেন্‌ডেন্ট আমাদিগকে বিলাতের ‘টাইমস্’ পত্রের সাপ্তাহিক সংস্করণ পড়িতে দিতেন। কিন্তু টাইমসের কথা বিশ্বাস করাও ক্রমে দায় হইয়া উঠিল। টাইমসের মতে ইংরাজ ও ফরাসী সৈন্য প্রত্যহ যত মাইল করিয়া অগ্রসর হইতেছিল মাস কতক পরে তাহা যোগ দিয়া দেখা গেল যে, তাহা সত্য হইলে ইংরাজ ও ফরাসী সৈন্যদের জার্মানী পার হইয়া পোলাণ্ডে গিয়া উপস্থিত হওয়া উচিত ছিল; অথচ পোলাও ত দূরের কথা, রাইন নদীর কাছাকাছি হওয়ার কোন সংবাদ পাওয়া যাইতেছে না। সাধারণ কয়েদীরা ইংরাজে স্বপক্ষে কোন কথা কহিলে একেবারে খাপ্পা হইয়া উঠিত। কর্তারা যে মিথ্যা খবর ছাপাইয়া তাহাদের পট্টি দিতেছে এ বিষয়ে আর কাহারও সন্দেহ মাত্র ছিল না!

নূতন নূতন যে সমস্ত কয়েদী দেশ হইতে আসিতে লাগিল তাহারা নানা প্রকার অদ্ভুত গুজব প্রচার করিয়া চাঞ্চল্য আরও বাড়াইয়া তুলিল। এক দল আসিয়া আমাদের সংবাদ দিল যে তাহারা বিশ্বস্তসূত্রে দেশ হইতে শুনিয়া আসিয়াছে যে এমডেন পোর্টব্লেয়ারের জেলখানা ভাঙ্গিয়া দিয়া রাজনৈতিক কয়েদীদের লইয়া চলিয়া গিয়াছে। আমাদিগকে সশরীরে সেখানে উপস্থিত দেখিয়াও তাহারা বিশ্বাস করিতে চাহিল না যে গুজব মিথ্যা! তাহারা যে ভাল লোকের কাছে ও কথাটা শুনিয়াছে! শ্রুতির চেয়ে প্রত্যক্ষটা ত আর বড় প্রমাণ নয়!

ক্রমে পাঠান ও শিখ পল্টনের অনেক লোক বিদ্রোহেব অপরাধে পোর্টব্লেয়ারে আসিয়া পৌঁছিল। তাহাদের কেহ কেহ বা মেসোপোটেমিয়া হইতে আসিয়াছে। পাঠানদের মুখে মুখে এনভার বে’র দৈব শক্তি সম্বন্ধে যে সব চমৎকার গল্প প্রচারিত হইতে লাগিল তাহা শুনিয়া কয়েদীদের বুক আশায় দশ হাত হইয়া উঠিল। এনভার যে তোপের সম্মুখে দাঁড়াইলে নাকি খোদার কোদূতে তোপের মুখ বন্ধ হইয়া যায়। তিনি আবার নাকি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়া একদিন মুলতান সরিফে আসিয়া -অচিরে জগদ্ব্যাপী মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা দিয়া গিয়াছেন। জার্মানীর বাদশাও নাকি কলমা পড়িয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন।

এ সব কথার প্রতিবাদ করিয়া কয়েদীদের বিদ্বেষভাজন হওয়া ছাড়া আর অন্য কোনও ফল নাই দেখিয়া আমরা চুপ করিয়া থাকিতাম। তবে যথাসম্ভব সত্য ব্যাপার জানিবার জন্য সংবাদপত্র জোগাড় করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেলাম। গদর দলের শিখেরা পোর্টব্লেয়ারে কয়েদী হইয়া আসিবার পর পাছে জেলের মধ্যে দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়, সেই ভয়ে জেলে পাহারা দিবার জন্য দেশী ও বিলাতী পল্টন আমদানি করা হইয়াছিল। বিলাতী পল্টনের মধ্যে আইরিশ অনেক ছিল। আর তাহারা যে ইংরেজের বিশেষ শুভার্থী ছিল তাহাও নয়। হুতরাং সংবাদপত্র সংগ্রহ করা একেবারে অসম্ভব ছিল না। তা’ ছাড়া নূতন নূতন যে সমস্ত রাজনৈতিক কয়েদী আসিতে লাগিল তাহাদের নিকট হইতেও দেশের অবস্থা বুঝিতে পারিতাম। এমডেন ধরা পড়িবার পরে একটা গুজব শুনিয়াছিলাম যে, ঐ জাহাজে যে সমস্ত কাগজপত্র পাওয়া গিয়াছিল তাহার মধ্যে পোর্টব্লেয়ারের একটা প্ল্যান ছিল : বোধ হয় ভবিষ্যতে কোনরূপ আক্রমণের ভয় হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য পোর্টব্লেয়ারে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হইয়াছিল ও দুই চারিটা তোপের আমদানি করা হইয়াছিল।

পোর্টব্লেয়ারে মিলিটারী পুলিসের মধ্যে পাঞ্জাবীর সংখ্যাই অধিক, এবং তাহাদের মধ্যে শিখও যথেষ্ট। পাছে গদর দলের শিখেরা মিলিটারি পুলিসের সহিত কোনরূপ ষড়যন্ত্র করিয়া একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধায়, এই চিন্তায় পোর্টব্লেয়ারের কর্তারা যেন একটু চঞ্চল হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। এই ভয়ে জেলের ভিতরকার শিখদিগের উপর তাঁহাদের ব্যবহার বেশ একটু কঠোর হইয়া দাঁড়াইত। একে ত আমেরিকা প্রত্যাগত শিখদিগের রুটী ও মাংস খাওয়া অভ্যাস; জেলের খোরাক খাইয়া তাহাদের পেটই ভরে না; তাহার উপর মাথার লম্বা লম্বা চুল ধুইবার জন্য সাবান ও সাজিমাটী কিছুই পায় না। শেষে যখন তাহাদের উপর ছোট ছোট অত্যাচার সুরু হইল তখন তাহাদের মধ্যে ছত্র সিং ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া সুপারিনটেনডেন্টকে আক্রমণ করিবার চেষ্টা করে! বেচারীকে তাহার ফলে দুই বৎসর কাল পিঁজরার মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে হয়। ধর্মঘটও পুনরায় আরম্ভ হইল। কিন্তু যে সকল নেতা শিখদিগকে ধর্মঘট করিবার জন্য উত্তেজিত করিলেন তাঁহারাই কার্যকালে সরিয়া দাঁড়াইলেন। শেষে দলাদলির সৃষ্টি হইয়া ধর্মঘট ভাঙ্গিয়া গেল। যুদ্ধ থামিয়া গেলে আমাদের ভাগ্যবিধাতা আমাদের জন্য কোন নূতন ব্যবস্থা করেন কি না তাহাই দেখিবার জন্য সকলেই উদ্‌গ্রীব হইয়া বসিয়া রহিল।

সকল অধ্যায়

১. নির্বাসিতের আত্মকথা – প্রথম পরিচ্ছেদ
২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ
৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৫. নির্বাসিতের আত্মকথা – পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৬. নির্বাসিতের আত্মকথা – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৭. নির্বাসিতের আত্মকথা – সপ্তম পরিচ্ছেদ
৮. নির্বাসিতের আত্মকথা – অষ্টম পরিচ্ছেদ
৯. নির্বাসিতের আত্মকথা – নবম পরিচ্ছেদ
১০. নির্বাসিতের আত্মকথা – দশম পরিচ্ছেদ
১১. নির্বাসিতের আত্মকথা – একাদশ পরিচ্ছেদ
১২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুদর্শ পরিচ্ছেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন