নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

বিধি যাহার প্রতি বাম, তাহার মরিয়াও নিস্তার নাই। আমরা বাহিরে রহিলাম বটে, সুখে দুঃখে একরূপ দিন কাটিতে লাগিল, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই আবার জেলখানা হইতে গোলমালের সংবাদ পাইলাম-উৎপীড়িত হইয়া ননীগোপাল আবার কর্ম ত্যাগ করিয়া বসিয়াছে!’ শাস্তিস্বরূপ তাহাকে চটের কাপড় পরিতে দেওয়ায় সে তাহা পরিতে অস্বীকৃত হয়! জোর করিয়া তাহার জাঙ্গিয়া কাড়িয়া লইয়া তাহাকে কুঠরীর মধ্যে চটের জাঙ্গিয়া দেওয়া হয়, কিন্তু সে “Naked we came out of our mother’s womb and naked shall we return—‘মায়ের পেট থেকে নগ্ন এসেছি, নগ্নই ফিরে যাব’ এই মন্ত্র আওড়াইতে আওড়াইতে চটের জাঙ্গিয়া ফেলিয়া দিয়া উলঙ্গ হইয়া বসিয়া থাকে! গলার টিকিট ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দেয়, চীফ কমিশনার কাছে আসিলে দাঁড়ায়ও না, সেলামও করে না। কি চাও জিজ্ঞাসা করিলে বলে— “কিছু চাই না” ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছেলেটা কি শেষে পাগল হইয়া গেল?—এই ভাবনাই সকলের মনে উঠিল। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেল—না, জ্ঞান বেশ টন্‌টনে আছে। ইংরাজ যখন নিজের খুসিমত আইন-আদালত বানাইয়াছে, সে সকল ব্যবস্থার সহিত যখন তাহার দেশের লোকের কোনও সম্বন্ধ নাই, তখন কেন যে সে এই সমস্ত আইন হ্যায়তঃ ধর্ম তঃ মাথা পাতিয়া মানিয়া লইতে বাধ্য এ প্রশ্নের মীমাংসা লইয়াই ননীগোপাল ব্যস্ত। তাহার ধর্ম বুদ্ধি যাহাতে সায় দেয় না, শুধু প্রাণটা বাঁচাইবার জন্য সে কেন সে কাজ করিতে যাইবে? প্রাণ রাখিতে রাখিতেই যেখানে প্রাণাত্ত হইতে হয়, সেখানে প্রাণের মূল্য কতটুকু?

ভগবান যাহার মনের উপর স্বাধীনতার ছাপ লাগাইয়া দিয়াছেন, অতি বড় প্রচণ্ড শাসনকর্তাও তাহার শরীরকে চিরদিন পরাধীন করিয়া রাখিতে পারে না, এই আশ্বাস ও অভয় ভিন্ন আমরা প্রশ্নের আর যে কি উত্তর দিব—তাহা খুঁজিয়া পাইলাম না।

এদিকে আমাদেরও কপাল ভাঙ্গিল। কলিকাতার কাগজে এই সময় আন্দামানের রাজনৈতিক কয়েদীদিগের অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা হইতেছিল; কর্তৃপক্ষের ধারণা—আমরাই সে সমস্ত সংবাদ পাঠাইতেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমরাও যে সকল বিষয়ে আইন-কানুন মানিয়া চলিতে পারিতাম তাহা নহে। পেটের জ্বালায় নানা স্থান ঘুরিয়া আমাদের ফলটা পাকড়টা ও মুখরোচক কিছু কিছু আহার্য সংগ্রহ করিতে হইত, আর সাধারণ কয়েদীদের সহিত মেলা একরূপ অসম্ভব বলিয়াই আমাদের লুকাইয়া লুকাইয়া বন্ধুবান্ধুবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করিলে প্রাণ হাঁপাইয়া উঠিত। কর্তারা হয় তাহা বুঝিলেন না, অথবা না বুঝিবার ভাণ করিয়া আমাদের বিপদে ফেলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন— সে কথা ভগবানই জানেন।

একদিন সুপ্রভাতে চারিদিকে তল্লাসীর ধূমধাম পড়িয়া গেল। আমাদের থাকিবার বসিবার শুইবার সব স্থান পুলিসে ঘেরাও করিয়া ফেলিল। মাণিকতলা বাগানের একটা প্রহসনাত্মক পুনরাভিনয় — tempest in a tea pot হইয়া গেল। দুই একখানা বাজে চিঠি ও এক আধটা কবিতা ভিন্ন আর কিছুই মিলিল না কিন্তু চীফ কমিশনারের আদেশ মত আমাদের সকলকেই জেলে পাঠান হইল। ক্ৰমে নানারূপ গুজব শুনিতে লাগিলাম, আমরা নাকি বোমা বানাইয়া পোর্টব্লেয়ার উড়াইয়া দিয়া একখানা সরকারী steamer পাকড়াও করিয়া পলাইয়া যাইবার সংকল্প করিতেছিলাম; আর অন্তর্যামী চীফ কমিশনার লালমোহন সাহা নামক এক হিতৈষী কয়েদীর কথায় সেই আসন্ন বিপদ হইতে তাঁহার রাজ্যটীকে রক্ষা করিবার জন্য এই সুবন্দোবস্ত করিয়াছেন। চীফ কমিশনার জেলে আসিলে আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম—“কর্তা, ব্যাপারখানা কি? অধীনদের উপর এ অযথা আক্রমণ কেন?” কর্তা নিতান্ত ভাল মানুষটীর মত বলিলেন—“আমি কিছুই জানি না। ইণ্ডিয়া গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে যেরূপ আদেশ পাইয়াছি, সেইরূপ করিয়াছি।”

ভাল, এ কথার আর উত্তর কি! কিন্তু কিছুদিন পরে শুনিলাম—আমাদের সহিত মিশিত বা কথাবার্তা কহিত বলিয়া বাহিরের অনেক লোককে সাজা দেওয়া হইতেছে, এবং পুলিসের একজন সাক্ষী কোথা হইতে গ্রামোফোনের পিন, লোহার টুকরা প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়া নিঃসংশয়ে আমাদের বোমা সৃষ্টির দুরভিসন্ধি প্রমাণ করিয়া ফেলিয়াছে। নারায়ণগড়ে লাট সাহেবের ট্রেণ ভাঙ্গা লইয়া যখন জনকতক নিরপরাধ লোক দণ্ডিত হয়, তখন হইতেই আমরা পুলিসের অপার মহিমার কথা বেশ জানিতাম। সুতরাং কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করিলাম— “আমাদের বিরুদ্ধে যদি কোনও সন্দেহ বা প্রমাণ থাকে, তাহা হইলে এইরূপ চোরাগোপ্তা চাল না চালিয়া আমাদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হয় না কেন?” কর্তারা কিন্তু এ কথার কোনও উত্তর না দিয়াই মুখ টিপিয়া চলিয়া গেলেন। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলাম।

মাস কয়েক পরে সার রেজিনাল্ড ক্র্যাডক্ (Sir Reginald Craddock) পোর্টব্লেয়ার পরিদর্শন করিতে যান। আমরা ভাবিলাম, খুব কাপ্তেন পাকড়াইয়াছি; এইবার আমাদের যা’ হয় একটা ব্যবস্থা হইবে। তাঁহার নিকট দুঃখের কাহিনী আরম্ভ করিতে না করিতে চীফ কমিশনার নিজ মূর্তি ধরিয়া বলিয়া ফেলিলেন, “তোমরা বাহিরে রাজদ্রোহের পরামর্শ (Conspiracy) করিতেছিলে।”

আমরা জবাব দিলাম, “তাই যদি আপনার ধারণা, ত প্রথমে যখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম তখন ভাল মানুষ সাজিয়া ‘জানি না’ বলিয়াছিলেন কেন? আর সে কথা বলিবার পরে যদি আমাদের অপরাধের প্রমাণ পাইয়া থাকেন, ত প্রকাশ্য আদালতে আমাদের বিচার করিতে এত সঙ্কোচ বোধ করেন কেন?” সার রেজিনাল্ড মুখ টিপিয়া হাসিতে হাসিতে উত্তর দিলেন—“কি জান,—এ সব কথার প্রমাণ হয় না।”

ননীগোপালও তাহার সমস্ত ইতিহাস বিবৃত করিল; মহামান্য ক্র্যাডক সাহেব শুধু উত্তর করিলেন-“তুমি সরকারের শত্রু; তোমাকে মারিয়া ফেলাই উচিত ছিল।”

“তাই যদি উচিত, ত আইন-আদালতের এ ঠাট সাজাইয়া রাখিয়া বৃথা পয়সা খরচ কেন? কাজটা সংক্ষেপে সারিলেই ত ছিল ভাল।”

বিচার ত এইখানে সাঙ্গ হইয়া গেল। এখন উপায়? নিরুপায়ের যিনি উপায়, তিনি না মুখ তুলিয়া চাহিলে আর গত্যন্তর নাই। কিন্তু এবার তাঁহারও সিংহাসন বুঝি টলিয়াছিল।

এক এক. করিয়া প্রায় সকলেই পুনরায় কাজ-কর্ম ছাড়িয়া দিল। জেলের কর্তৃপক্ষ সাজা দিয়া যখন হাঁপাইয়া পড়িলেন, তখন যাঁহারা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত নন তাঁহাদিগকে ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট বিচারের জন্য পাঠাইয়া দিলেন। ডেপুটি কমিশনার Lowis সাহেবের উপর সেই ভার পড়িল। তিনি বিচারের পূর্বে একদিন ধর্মঘটের কারণ সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিয়া অনুসন্ধান করিতে আসিলেন।

আমাদের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করা হইয়াছিল তাহা শুনিয়া তিনি বলিলেন, ইণ্ডিয়া গবর্ণমেন্টের ইচ্ছা যে, আমাদের প্রতি সাধারণ কয়েদী অপেক্ষা ভাল ব্যবহার করা না হয়; এ বিষয়ে পোর্টব্লেয়ারের কাহারও কোনও হাত নাই। “কিন্তু সাধারণ কয়েদীর যে সমস্ত সুবিধা আছে, আমাদের সে সমস্ত কিছুই নাই। সাধারণ কয়েদী লেখাপড়া জানিলে আফিসে ভাল কাজ-কর্ম পায়; তাহারা লেখাপড়া না জানিলেও ওয়ার্ডার, পেটি অফিসার হইতে পারে, আমরা যে সে সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত। অপরে পাঁচ বৎসর পরে মাসে বারো আনা করিয়া মাহিনা পায় এবং দশ বৎসর পরে নিজে উপার্জ্জন করিয়া খাইতে পারে, আর আমাদের যে চিরদিনই জেলে পচিয়া মরিবার ব্যবস্থা!” Lowis সাহেব উত্তর করিলেন যে, এ সমস্ত ব্যবহার ও দায়িত্ব ইণ্ডিয়া গবর্ণমেন্টের। একজন জিজ্ঞাসা করিলেন—“সাহেব, ভাল করিবার কোন অধিকারই তোমাদের নাই; শুধু কি সাজা দিবার অধিকারটুকুই হাতে রাখিয়াছিলে?”

সাহেব হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন-“ কি করিব? জেলের শাস্তি, discipline ত রক্ষা করিতে হইবে।”

“ন্যায়ই হোক, অন্যায়ই হোক, disciplineটা রক্ষা করিতেই হইবে, মোট কথা এই, না?”

সাহেব এ কথায় কোনও উত্তর দিলেন না। ব্যাপারটা কি তাহা তিনি বেশই জানিতেন; কিন্তু তিনিও ত সরকারী চাকর। তাই কাহারও একমাস, কাহারও তিন মাস, কাহারও বা ছয় মাস সাজা বাড়াইয়া দিয়া চলিয়া গেলেন। ভবিষ্যতে একবার ইহার সহিত আমাদের দেখা হইয়াছিল। কথাপ্রসঙ্গে উল্লাসকরের কথা উঠিলে তিনি বলেন—“Ullaskar is one of the noblest boys I have ever seen, but he is too idealistic।” “উল্লাসের মত মহাপ্রাণ ছেলে খুব কম দেখিয়াছি, তবে সে বড় বেশি উচ্চভাবপ্রবণ।” অথচ চাকরীর খাতিরে তাঁহাকে উল্লাসকরকে সাজা দিতেও হইয়াছিল।

Discipline আইন-কানুন রক্ষার জন্য ত সাজা, কিন্তু ক্রমশঃ সেই শান্তিরক্ষাই দায় হইয়া উঠিল। আমাদের দেখা-দেখি সাধারণ কয়েদীদের মধ্যেও ধর্মঘটের দল বাড়িয়া উঠিল। জেলের কাজকর্মের ক্ষতি হইতে লাগিল। কর্তৃপক্ষ দেখিলেন, একটা কিছু না করিলেই নয়।

রাজনৈতিক অপরাধীর মধ্যে যাঁহারা মেয়াদী কয়েদী (term convict) তাঁহাদের সাত আট জনকে হঠাৎ একদিন দেশের জেলে পাঠাইয়া দেওয়া হইল, এবং যে জেলার আমাদের গালাগালি দিতেও কুণ্ঠিত হন নাই, তিনিই একদিন নিতান্ত ভদ্রভাবে আমাদের ধর্মঘট ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করিয়া বলিলেন—“Now you can retreat with honour”.

“এখন তোমরা আপন সম্মান বজায় রেখে কাজে নেমে পড়তে পার।” তিনি নাকি সংবাদ পাইয়াছেন যে, অধিকাংশ মেয়া কয়েদীকে দেশের জেলে পাঠাইয়া দেওয়া হইবে; এবং যাঁহারা পোর্টব্লেয়ারে থাকিয়া যাইবেন তাঁহাদের কাজ-কর্ম ও আহারাদির একটু বিশেষ ব্যবস্থা হইবে।

আমরা বলিলাম—“তথাস্তু, কিন্তু দুই মাসের মধ্যে যদি আপনাদের বিশেষ ব্যবস্থার নমুনা না দেখা যায়, তাহা হইলে পুনমূর্ষিক হইয়া আমরাই বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া লইব।”

এইরূপে উভয় পক্ষে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ায় ধর্মঘটের দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত হইল।

অল্পদিনের মধ্যে আলিপুরের বারীন্দ্র, হেমচন্দ্ৰ ও আমি ঢাকার পুলিনবিহারী ও সুরেশচন্দ্র এবং নাসিকের সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয় ও যোশী ভিন্ন অপর সকলকে দেশের জেলে পাঠাইয়া দেওয়া হইল।

মেয়াদী কয়েদীদিগকে যখন ভারতবর্ষে পাঠাইয়া দেওয়া হইল, তখন আমরা কতকটা নিশ্চিন্ত হইলাম। যে ছয় সাত জন বাকি রহিলাম, তাহাদের যখন পোর্টব্লেয়ারে থাকিতেই হইবে তখন আর বেশী গোলমাল করিয়া লাভ কি? ছাড়া পাইবার যখন কোন আশাই নাই, তখন মরণের অপেক্ষায় শান্তভাবে দিন কাটানই ভাল!

কিন্তু অদৃষ্টে সে শান্তি আমাদের ছিল না। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ বাধিয়া গেল। ভারতবর্ষে যে চাঞ্চল্যের স্রোত আসিয়া ধাক্কা মারিল তাঁহার ফলে লাহোর ষড়যন্ত্রের উৎপত্তি ও ‘গদর’ দলের প্রায় পঞ্চাশ জনের পোর্টব্লেয়ারে আগমন। পল্টনের অনেক শিখ সিপাহীও রাজনৈতিক অপরাধে দণ্ডিত হইল। বাংলা দেশ হইতেও পনেরো ষোল জন আসিল। ফলে পোর্টব্লেয়ারের জেলখানা এবার রাজনৈতিক কয়েদীতে ভরিয়া এ সুখের নরক গুলজার হইয়া উঠিল। ইহাদের মধ্যে চার পাচ জন ভিন্ন অপর কাহাকেও ঘানি ঘুরাইতে দেওয়া হয় নাই কিন্তু নারিকেলের ছোবড়া পেটাও বড় কম পরিশ্রম নহে। তাহার উপর আর এক উপসর্গ এই যে, সরকারী খোরাকে ইহাদের পেট ভরে না। একে ত প্ৰকাণ্ড প্রকাণ্ড লম্বা চওড়া পাঞ্জাবী, তাহার উপর অনেকেই বহুদিন আমেরিকায় থাকার ফলে যথেষ্ট পরিমাণে মাংসাদি খাইতে অভ্যস্ত। সুতরাং দুইখানা রুটী ও এক বাটী ভাত ইহাদের পেটের এক কোণে কোথায় তলাইয়া যায় তাহার সন্ধানও পাওয়া যায় না। বিশেষতঃ অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার পাত্রও ইহারা নহেন। সুতরাং অল্পদিনের মধ্যেই জেলের কর্তৃ পক্ষগণের সঙ্গে ইহাদের নরম গরম খটাখটি বাধিয়া উঠিল।

ঝান্সির পরমানন্দকে লইয়াই ঝগড়া আরম্ভ হইল। কি একটা কথা লইয়া তাঁহাকে জেলারের নিকট লইয়া যাওয়া হয়। জেলার আপনার কর্তৃত্ব জানাইয়া যে ওজনের কথা কহিলেন পরমানন্দও সেই ওজনের কথা ফিরাইয়া দিলেন। মুখোমুখি শেষে হাতাহাতিতে দাঁড়াইল। বিচারে পরমানন্দের বিশ ঘা বেত্রদণ্ড হওয়ায় ধর্মঘট আরম্ভ হইল। কিন্তু তাহা অনেক দিন স্থায়ী হইল না। জেলার নিজেই সকলকে বুঝাইয়া শুঝাইয়া ভবিষ্যতে সদ্ব্যবহার করিবার আশা দিয়া সে ধর্মঘট ভাঙ্গাইয়া দিলেন।

অসন্তোষের বীজ কিন্তু মরিল না। দিন কতক পরে সামান্য কারণে আবার গোলমাল বাধিল। রবিবারে কয়েদীদের ছুটী, সেদিন আপন আপন বস্ত্রাদি পরিষ্কার ভিন্ন অন্য কর্ম হইতে তাহাদিগকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পোর্টব্লেয়ারে কিন্তু সেদিন জেলের উঠানে ঘাস ছিড়িতে হয়। একে ত ছুটীর দিন সমস্ত দুপুর বেলা কয়েদীদিগকে কুঠরীর মধ্যে বদ্ধ থাকিতে হয়, তাহার উপর সকাল বেলা ঘাস ছিঁড়িয়া বেড়াইতে হইলে তাহাদের ছুটি নিতান্তই নামমাত্র হইয়া দাঁড়ায়। আমেরিকার ‘গদর’ পত্রিকার সম্পাদক জগৎত্রাম প্রভৃতি কয়েকজন এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করিয়া রবিবারে ঘাস ছিড়িতে অস্বীকৃত হন। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের বিচারে তাঁহাদের প্রত্যেকের ছয় মাস করিয়া বেড়ি ও কুঠরীবদ্ধ হওয়ার দণ্ড হয়। বলা বাহুল্য, লঘু পাপে এই গুরুদণ্ড দেখিয়া কেহই বিশেষ প্রীত হন নাই। তাহার পর, দিনের পর দিন যখন কষ্টের মাত্রা কমিবার কোনই সম্ভাবনা দেখা গেল না, তখন অনেকেই আবার কাজকর্ম ত্যাগ করিলেন। এই সময় একটা ব্যাপার লইয়া বড় গোলমাল হয়। একজন বৃদ্ধ শিখের সহিত জেলের প্রহরীদিগের বিবাদ হয়; তিনি বলেন যে, প্রহরীরা তাঁহাকে কুঠরীর মধ্যে লইয়া গিয়া অত্যন্ত প্রহার করে। সত্য মিথ্যা ভগবান জানেন, ফলে কিন্তু তিনি দুই এক দিনের মধ্যে কঠিন রক্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হইয়া হাসপাতালে আসেন। সেখানে যক্ষ্মারোগের সূত্রপাত হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মারা পড়েন। সেখানকার অনেকের বিশ্বাস যে, গুরুতর প্রহারই তাঁহার মৃত্যুর কারণ, কিন্তু কর্তৃপক্ষ একথার সত্যতা অস্বীকার করেন। এই ব্যাপারের কোনও প্রতিকার হইল না ভাবিয়া চার পাঁচ জন আহার ত্যাগ করিলেন। পৃথ্বী সিং তাঁহাদের অগ্রণী। তাঁহাকে নাক দিয়া জোর করিয়া দুধ খাওয়াইয়া দেওয়া হইত। এ অবস্থায় তিনি পাঁচ মাস থাকেন। অন্য দেশে হইলে একটা হুলস্থুল পড়িয়া যাইত কিন্তু পোর্টব্লেয়ারের সংবাদ কে রাখে? সেখানে দুই দশ জন কয়েদী মরিলেই বা কাহার কি আসে যায়?

শিখদের মধ্যে আরও তিন চার জন এই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হইয়া তুই তিন মাস ভুগিয়া মারা যান। পূর্বেই বলিয়াছি জেলে ঢুকিবার সময় শ্যামদেশ হইতে ধৃত পণ্ডিত রামরক্ষার পৈতা কাড়িয়া লওয়া হয় বলিয়া তিনি আহার ত্যাগ করিয়াছিলেন; এই সময় যক্ষ্মারোগে তাঁহারও মৃত্যু হয়। অব্যাহতির অন্য কোন উপায় না দেখিয়া একজন একখণ্ড সিস। খাইয়াও মরিয়াছিলেন।

যাঁহারা মরিলেন তাঁহারা ত বাঁচিয়া গেলেন; যাঁহারা পাগল হইয়া জীবস্তু মরিয়া রহিলেন, তাঁহাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। বালেশ্বর মোকর্দমার যতীশচন্দ্র পাল তাঁহাদের অন্যতম। কুঠরীবদ্ধ অবস্থায় তিনি একেবারে উন্মাদ হইয়া যান। তাঁহাকে পাগলা গারদে পাঠান হয়; পরে ভারতবর্ষে লইয়া আসা হয়। এখন বহরমপুর পাগলা গারদে তাঁহার দিন কাটিতেছে।

এরূপ ঘটনার সংখ্যা নাই। কাহার কথা ছাড়িয়া কাহার কথা লিখিব? ছত্র সিংহ নামে একজন শিখ লায়লপুর খালসা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। দেশে তাঁহার অপরাধ কি জানি না; কিন্তু পোর্টব্লেয়ারে তাঁহাকে প্রথম হইতে কুঠরীবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। ধর্মঘট লইয়া যখন গোলযোগ চলিতেছিল তখন তিনি একদিন উত্তেজিত হইয়া সুপারিনটেনডেন্টকে আক্রমণ করিবার চেষ্টা করেন বলিয়া প্রবাদ। ফলে প্রহরীগণ তাঁহাকে মারিতে মারিতে অজ্ঞান করিয়া ফেলে। তাহার পর তাঁহাকে কুঠরীতে পোরা হয়; তাহা হইতে তাঁহাকে দুই বৎসরের অধিক কাল আর বাহির করা হয় নাই। বারান্দার এক কোণে জাল দিয়া ঘিরিয়া তাঁহার জন্য পিঁজরা প্রস্তুত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল; সেই পিঁজরার মধ্যেই তাহাকে আহার, ভাঁড়ে শৌচ প্রস্রাবাদি ত্যাগ, রাত্রিকালে নিদ্রা যাইতে হইত। ইহাতে স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়া তাঁহাকে ক্রমে মরণাপন্ন হইতে হইয়াছিল, এ কথা বলাই বাহুল্য। আর একজন শিখ অমর সিং-এরও ঐরূপ অবস্থা।

মৃত্যুর হার যখন ক্রমে বাড়িতেই চলিল তখন কর্তৃপক্ষদিগের একটু হুঁস হইল। অনেককে অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ ( দড়ি পাকান ) দেওয়া হইল। জগতরাম বহুদিবস পৃথক-কারাবাসের ( separate confinement ) ফলে শিরোরোগে ভুগিতেছিলেন, তাঁহাকে ও অপর দুই এক জনকে ছাপাখানার কাজ দেওয়া হুইল। দয়ানন্দ কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ভাই পরমানন্দ ধর্মঘটে কখনও যোগ দেন নাই বলিয়া তাঁহাকে হাসপাতালে কম্পাউণ্ডার করিয়া দেওয়া হইল। কিন্তু অধিক দিন সে দুখ তাঁহাকে ভোগ করিতে হইল না। তাঁহার স্ত্রী তাঁহার চিঠি হইতে এক অংশ উদ্ধৃত করিয়া সংবাদপত্রে রাজনৈতিক কয়েদীদিগের অবস্থা সম্বন্ধে লিখিয়া পাঠান। চীফ কমিশনার ইহাতে বিশেষ অসন্তুষ্ট হইয়া পরমানন্দকে বিনা বিচারে হাজতে বন্ধ করিলেন। পরমানন্দ বলেন যে, তাঁহার এই চিঠি যথারীতি জেলের সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের হাত দিয়া পাস হইয়া গিয়াছিল। সে কথা অবিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই, কিন্তু তথাপি পরমানন্দ লাঞ্ছনা হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন না। সকলেই একটা অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাইতে লাগিলেন।

সকল অধ্যায়

১. নির্বাসিতের আত্মকথা – প্রথম পরিচ্ছেদ
২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ
৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৫. নির্বাসিতের আত্মকথা – পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৬. নির্বাসিতের আত্মকথা – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৭. নির্বাসিতের আত্মকথা – সপ্তম পরিচ্ছেদ
৮. নির্বাসিতের আত্মকথা – অষ্টম পরিচ্ছেদ
৯. নির্বাসিতের আত্মকথা – নবম পরিচ্ছেদ
১০. নির্বাসিতের আত্মকথা – দশম পরিচ্ছেদ
১১. নির্বাসিতের আত্মকথা – একাদশ পরিচ্ছেদ
১২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুদর্শ পরিচ্ছেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন