নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ

নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বারীনের চিঠি পাইয়াই তল্পিতল্পা গুছাইয়া রওনা হইলাম। তন্নির মধ্যে লোটা কম্বল আর তল্লার মধ্যে একগাছা মোটা লাঠি। সুতরাং বেশী দেরি হইবার কোনও কারণ ছিল না! বাগানে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম একেবারে “সাজ সাজ রব পড়িয়া গিয়াছে। যে সমস্ত নূতন ছেলে আসিয়া জুটিয়াছে, উল্লাসকর তাহাদের মধ্যে একজন। প্রেসিডেন্সী কলেজের রসেল সাহেব বাঙ্গালীর ছেলেদের গালি দিয়াছিল বলিয়া উল্লাসকর একপাটী ছেঁড়া চটীজুতা বগলে পুরিয়া কলেজে লইয়া যায় এবং রসেল সাহেবের পিঠে তাহা সজোরে বখশিস দিয়া কলেজের মুখদর্শন বন্ধ করিয়া দেয়। তাহার পর কিছুদিন বোম্বাই-এর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ঘুরিয়া আসিয়া দেশ গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। সে সময় কিংসফোর্ড সাহেব একে একে সব স্বদেশী কাগজওয়ালাদের জেলে পুরিতেছেন। পুলিসের হাতে এক তরফা মার খাইয়া দেশসুদ্ধ লোক হাঁফাইয়া উঠিয়াছে। যাহার কাছে যাও, সেই বলে—“নাঃ, এ আর চলে না। ক’ বেটার মাথা উড়িয়ে দিতেই হবে।” তথাস্তু। পরামর্শ করিয়া স্থির হইল, যখন সাহেবদের মধ্যে বড়লাট আণ্ড, ফ্রেজারের মাথাটাই সব চেয়ে বড়, তখন তাঁহারই মুণ্ডপাতের ব্যবস্থা আগে করা দরকার। কিন্তু লাট সাহেবের মাথার নাগাল পাওয়া ত সোজা কথা নয়। ডিনামাইট কাট্রিজ লাটসাহেবের গাড়ীর তলায় রাখিয়া দিলে কাজ চলিতে পারে কি না তাহা পরীক্ষার জন্য চন্দননগর ষ্টেশনের কাছাকাছি রেলের উপর গোটা কয়েক ডিনামাইট কাট্রিজ রাখিয়া দেওয়া হইল। কিন্তু উড়া ত দূরের কথা— ট্রেণখানা একটু হেলিলও না। শুধু কাট্রিজ ফাটার গোটা দুই ফট্ ফট্ আওয়াজ শুন্যে মিলিয়া গেল, লাট-সাহেবের একটু ঘুমের ব্যাঘাত পর্যন্ত হইল না। দিন কতক পরে শোনা গেল যে, লাট সাহেব রাঁচি না কোথা হইতে কলিকাতায় স্পেশাল ট্রেণে ফিরিতেছেন। মেদিনীপুরে গিয়া নারায়ণগড় ষ্টেশনের কাছে ঘাঁটী আগলান হইল। বোমা বিদ্যায় যিনি পণ্ডিত তিনি পরামর্শ দিলেন যে, রেলের জোড়ের মুখের নীচে মাটির মধ্যে যেন বোমাটা পুঁতিয়া রাখা হয়। তাহার পর সময়মত তাহাতে “স্লো ফিউজ” লাগাইয়া আগুন ধরাইয়া দিলেই কার্যোদ্ধার হইবে। কিন্তু লাট সাহেবের এমনি অদৃষ্টের জোর যে, বোমা পুঁতিবার দিন আমাদের ওস্তাদজী পড়িলেন জ্বরে, আর যাঁহারা কেল্লা ফতে করিতে ছুটিলেন তাঁহারা একেবারে “ও রসে বঞ্চিত গোবিন্দদাস”। কাজেই বোমা ফাটিল, রেলও বাঁকিল, কিন্তু গাড়ী উড়িল না! তবে ইঞ্জিনখানা নাকি জখম হইল; এবং খড়গপুর ষ্টেশন হইতে আর একটা ইঞ্জিন লইয়া গিয়া লাট-সাহেবের স্পেশালকে টানিয়া আনিতে হইল।

এই গাড়ী-ভাঙ্গা পর্ব সাঙ্গ হইবার পর চারিদিকে গুজব রটিয়া গেল যে রুশিয়া হইতে নাকি এদেশে নিহিলিষ্টের আমদানী হইয়াছে। একদিন আমার আত্মীয় একজন বৃদ্ধ সরকারী কর্মচারীর মুখে শুনিলাম যে তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে জানিতে পারিয়াছেন যে, ইউরোপ হইতে এদেশে নিহিলিষ্টরা আসিয়াছে। ঐ নিহিলিষ্ট দলের একজন যে তাঁহার সম্মুখে বসিয়া নিতান্ত ভাল মানুষটির মত চা খাইতেছে একথা জানিতে পারিলে বৃদ্ধ কি করিতেন কে জানে? যাই হোক, পুলিশেব কর্তারা গাড়ী ভাঙ্গার আসামী ধরিবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়া দিলেন। সুতরাং আসামীর অভাব হইল না। জনকতক রেলের কুলিকে ধরিয়া চালান করা হইল; তাহারা নাকি পুলিশের কাছে আপনাদের অপরাধও স্বীকাব কবিল। জজ সাহেবের বিচাবে তাহাদেব কাহারও পাঁচ, কাহারও বা দশ বৎসব দ্বীপান্তরের হুকুম হইল। পুলিসেব রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়া যখন লোককে বিনা বিচারে অন্তরীণে রাখা হয়, আর লাট সাহেব হইতে আরম্ভ করিয়া সরকাবী পেয়াদা পর্যন্ত পুলিসকে নির্ভুল প্রতিপুন্ন করিবার জন্য একেবারে পঞ্চমুখে বক্তৃতা জুড়িয়া দেন, তখন ঐ নারায়ণ-গড়ের ব্যাপার মনে করিয়া আমাদের হাসিও পায়, কান্নাও আসে।

এই সময় পুলিসের ঘোরাঘুরি একটু বাড়িয়াছে দেখিয়া আমাদের মনে হইল যে, কিছুদিনের জন্য বাগানে বেশী ছেলে রাখিয়া কাজ নাই। উল্লাস প্রভৃতি আমরা চার পাঁচ জন দেশটা একটু ঘুরিয়া দেখিবার জন্য বাগান হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। কলিকাতা হইতে গয়া গিয়া বাঁকিপুর পৌঁছিবার পর একদল উদাসী সম্প্রদায়ের পাঞ্জাবী সাধুর সহিত মিশিবার সুবিধা হইয়া গেল।

গুরু নানকের প্রথম পুত্র শ্রীচাঁদ এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ইহাদের মাথায় লম্বা লম্বা জটা; গায়ে ছাই মাখা; কোমরে একটু কম্বলের টুকরা পিতলের শিকল দিয়া আঁটা। গাঁজার কলিকা অষ্ট প্রহর সকলকার হাতে হাতেই ঘুরিতেছে। যাঁহারা ইহাদের দলপতি, দেখিলাম একশো আট ছিলিম গাঁজা না খাইলে তাঁহাদের মুখ দিয়া কথাই বাহির হয় না। তামাকু সেবনও ইহারা করিয়া থাকেন, তবে তাহাও এমনি প্রচণ্ড যে তাহাতে একটান মারিলেই আমাদের মত পার্থিব জীবের মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইতে হয়। গাঁজা ও তামাকের এই সদ্‌ব্যবহার দেখিয়াই বোধ হয় গুরুগোবিন্দ সিং শিখদের মধ্যে গাঁজা ও তামাক খাওয়া রহিত করিয়া দিয়া যান।

সাধুদের দলে একটী দশ বারো বৎসরের, আর একটি পনেরো ষোল বৎসরের বাচ্ছা সাধু দেখিলাম। আমাদের দেশের সৌখিন ছেলেরা যেমন কামাইয়া গোঁফ তোলে, ইহারাও তেমনি চাঁচর কেশে আটা লাগাইয়া জটা বানায়। সংসারটা যে মরীচিকা, তা ইহারা এত অল্প বয়সে কি করিয়া আবিষ্কার করিয়া ফেলিল, জানিবার জন্য আমার বড় কৌতূহল হইল। শেষে জানিলাম যে, ইহারা গরীবের ছেলে, সাধু হইলে পেট ভরিয়া খাইতে পাইবে বলিয়া ইহাদের মা বাপ ইহাদের সাধুর দলে ভর্তি করিয়া দিয়াছে।

সাধুরা ভোর বেলা উঠিয়া স্নান করে; অর্থাৎ মাথা ছাড়া আর সর্বাঙ্গ ধুইয়া ফেলে। দশ বারো দিন অন্তর জটা এলাইয়া এক এক বার মাথা ধুইবার পালা আসে। মেয়েদের খোঁপা বাঁধার চেয়ে ইহাদের জটাবাঁধা আরও জটিল ব্যাপার। পাকের পর পাক রাখিয়া চুলের গুছি দিয়া আঁটিয়া কেমন করিয়া সাজাইলে জটাগুলি বেশ চূড়ার মত মানানসই দেখায়, তাহা ঠিক করা একটা দস্তুরমত ললিত শিল্পকলা। সকালবেলা স্নানের পর ধুনি জ্বালিয়া সকলে গায়ে ছাই মাখিতে লাগিয়া যায়; সঙ্গে সঙ্গে স্তোত্র পাঠও চলে। বেলা আটটা নয়টার সময় ‘কড়াপ্রসাদের’ বন্দোবস্ত। সত্যপীরের সিন্নি হইতে আরম্ভ করিয়া মা কালীর প্রসাদ পর্যন্ত এ বয়সে অনেক রকম প্রসাদই খাইয়াছি। কিন্তু এই কড়াপ্রসাদের তুলনা নাই। এটা আমাদের হালুয়ার পাঞ্জাবী সংস্করণ। অনিত্য সংসারে এই ভগবৎ প্রসাদই যে সার বস্তু তাহা খাইতে না খাইতেই বুঝিতে পারা যায়; এবং সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি-রসে ভিজিয়া মনটা উদাস হইয়া আসে। মধ্যাহ্নে তোফা মোটা মোটা নরম নরম ঘৃতসিক্ত পাঞ্জাবী রুটি ও ডাল—এবং রাত্রিকালেও তদ্বৎ। দেখিতে দেখিতে চেহারাটা বেশ একটু লালাভ হইয়া উঠিল, আর মাঝে মাঝে মনে হইতে লাগিল যে, মানিকতলার বাগানে পোড়া খিচুড়ীর মধ্যে আর ফিরিয়া গিয়া কাজ নাই। এই সাধুদের মধ্যেই জটাজুট রাখিয়া বৈরাগ্যসাধনায় লাগিয়া যাই! কিন্তু কপাল যাহার মন্দ, তাহার এত সুখ সহিবে কেন?

নেপালে ‘ধুনি সাহেব’ নামে উদাসী সম্প্রদায়ের এক তীর্থস্থান আছে। সাধুরা সেইখানে তীর্থ দর্শন করিতে যাইতে-ছিলেন। আমরা স্থির করিলাম তাঁহাদের সহিত রওনা হইব। কিন্তু আমাদের শ্রীঅঙ্গে তখন এক একটা গেরুয়া আলখেল্লা আঁটা; এবং উদাসী সম্প্রদায়ের ঐ গেরুয়াটা সম্বন্ধে বিষম আপত্তি। গেরুয়া পরা সাধুদের উপর তাঁহাদের বেশ একটু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আছে। তাঁহাদের নিজেদের ছাই-মাখা অবধূত-মার্গকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন। সে কথাটা আমাদের জানা ছিল না; তাহা হইলে গেরুয়া না পরিয়া খানিকট। ছাই মাখিয়াই বসিয়া থাকিতাম। কিন্তু এখন উপায়? একজন প্রবীণ সাধু এই দুরূহ সমস্যার মীমাংসা করিয়া বলিলেন যে, আমরা যদি তাঁহাদের নিকট দীক্ষা লইয়া উদাসীদের সেবকরূপে গণ্য হই, তাহা হইলে গেরুয়ার সঙ্গে একটা রফা করা যাইতে পারে। আমরা ভক্তিগদগদকণ্ঠে তাহাই করিতে স্বীকৃত হইলাম। আমাদের দীক্ষা দিবার আয়োজন হইল। একজন সাধু একটা বড় বাটীতে একবাটী চিনি গুলিয়া লইয়া আসিলেন। যিনি মঠাধ্যক্ষ তিনি ঐ চিনি গোলায় আপনার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ডুবাইয়া আমাদের তাহা খাইতে দিলেন। আমরা চোঁ চোঁ করিয়া তাহা খাইয়া ফেলিবার পর বৃদ্ধ আমাদের “এক ওঙ্কার সৎনাম কর্তাপুরুষ” প্রভৃতি মন্ত্রপাঠ করাইয়া আমাদের পিঠে এক একটা চড় মারিয়া বলিয়া দিলেন যে, আজ হইতে আমরা উদাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। দীক্ষা কার্য সুসম্পন্ন হওয়ায় আমাদের গেরুয়ার দোষ খণ্ডিত হইল। আমরাও ভক্তি, বিস্ময় ও পুলক ভরে আমাদের নূতন গুরুজীর পদধূলি মাথায় লইয়া কড়া প্রসাদের অনুসন্ধানে বাহির হইয়া পড়িলাম।

তীর্থদর্শনে যাত্রা করিলাম আমরা পাঁচ সাতজন বাঙ্গালী, আর ঐ ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন পাঞ্জাবী সাধু। কিন্তু রেলওয়ে ষ্টেশন হইতে নামিবার পর যখন হাঁটাপথ আরম্ভ হইল, তখন বুঝিলাম, ব্যাপারটা নিতান্ত সুবিধার নহে। কুশী নদীর ধারে ধারে গভীর জঙ্গল; আর তাহার মাঝ দিয়া পাঁচ ছয় দিন ধরিয়া প্রত্যহ পনেরো ষোল ক্রোশ করিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে আমার পায়ে ত গোদ নামিয়া গেল! কিন্তু সাধুদের ক্লান্তি নাই, অবসাদ নাই, কাতরোক্তি নাই। দিনের পর দিন তাহারা রোদ মাথায় করিয়া অবলীলাক্রমে চলিয়াছে।

“তরাই” অতিক্রম করিয়া ক্রমে নেপালে একটা ছোট শহরে আসিয়া পৌঁছিলাম। জায়গাটার নাম হনুমান নগর। অধিবাসী প্রায় সমস্তই হিন্দুস্থানী : অনেকগুলি মাড়োয়ারীর দোকানও আছে; কিন্তু রাজকর্মচারীরা সমস্তই গুর্খা। শহরের রাস্তা ঘাটগুলি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন; এবং বড় রাস্তার ধারে ধারে ফুট-পাথও আছে। নেপালকে ছেলেবেলা হইতে আমার একটু “জঙ্গলী” বলিয়া ধারণা ছিল; আজ সে ধারণা অনেকটা কাটিয়া গেল। স্বাধীন হিন্দুরাজার রাজ্যে আসিয়া পৌঁছিয়াছি, এই কথা ভাবিয়া মনটা যেন তোলপাড় করিতে লাগিল। ভক্তিভাবে নেপালের মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া হাঁ করিয়া খুব খানিকটা স্বাধীন দেশের হাওয়া খাইয়া লইলাম। দেশটা বাস্তবিকই বড় সুন্দর!

পাড়াগাঁয়ের পাশ দিয়া যাইবার সময় দেখিলাম যে, চালাঘরগুলি আমাদের দেশের চালা ঘরের চেয়ে ঢের বেশী পুশ্রী। যে দিকে চাও, যেন সৌন্দর্যের ঢেউ খেলিতেছে, কোথাও একটু বিষাদ বা দৈন্যের ছায়ামাত্র নাই। গ্রামবাসীরা সাধুদের বিশেষ ভক্ত। একদিন চলিতে চলিতে জ্বরাক্রান্ত হইয়া একটা গ্রামের ধারে মাঠের উপর পড়িয়াছিলাম। আমার সঙ্গীটি গ্রামের মধ্যে জল আনিতে গিয়া তাঁহার প্রকাণ্ড লোটা ভরিয়া দুধ লইয়া আসিলেন। তৃষ্ণার্ত সাধুকে কি জল দেওয়া যায়! শুনিলাম নেপালে সাধুদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। ক্ষুধায় কাতর হইলে সাধুরা যে কোন স্থান হইতে আহার্য উঠাইয়া লইতে পারেন। তাহার জন্য তাঁহারা রাজদ্বারে দণ্ডনীয় হ’ন না।

‘ধুনি সাহেবে’ উপস্থিত হইয়া দেখিলাম— চারিদিকে শুধু শাল বন আর শাল বন! একজন উদাসী সাধু—বাবা প্রীতম দাস—বহুকাল পূর্বে এইখানে সিদ্ধিলাভ করেন বলিয়া তাঁহার ধুনি আজ পর্যন্ত সেখানে জ্বলিতেছে; এবং সেই ধুনি হইতেই এইস্থানের নামকরণ হইয়াছে। অনেক রকম অদ্ভুত অদ্ভূত গল্প শুনিলাম। বাবা প্রীতম্ দাসের দুই শিষ্য তাহার নিকট হইতে আম খাইতে চাহিলে তিনি সিদ্ধির বলে দুটি শাল গাছে আম ফলাইয়া দিয়াছিলেন, আব সেই অবধি সেই ছুটি শাল গাছে নাকি এখনও দুই একটা আম ফলে। গঞ্জিকাসিদ্ধি কি সোজা কথা!

তিন দিন সেই সিদ্ধপুবীতে বাস করিয়া আবার নরলোকে ফিরিয়া আসিলাম। বাঁকীপুরে আমাদের তুই চারিজন বন্ধুবান্ধব জুটিয়াছিলেন। তাঁহাবা রাজগৃহে আমাদের থাকিবার জন্য মঠ বানাইয়। দিতে চাহিলেন কিন্তু বাংলাদেশের মাটি আমাদে নাড়ী ধরিয়া টানিতেছিল। আমরা রওনা হইয়া পড়িলাম। ফিরিবার পথে একখানা কাগজে পড়িলাম যে, ঢাকাব ম্যাজিষ্ট্রেট এলেন সাহেবকে কে গুলি করিয়াছে। বুঝিলাম এবার শ্রাদ্ধ অনেক দূর গড়াইবে!

বাগানে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম বারীন সেখানে নাই। সে কংগ্রেস উপলক্ষে সুরাত গিয়াছে। সুরাতে যে সেবার একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটিবে তা’ মেদিনীপুরের কনফারেন্সে গিয়াই বুঝিতে পারিয়াছিলাম! দুই একদিন পরে বারীন ফিরিয়া আসিল। সুরাতে নরম, গরম, অতি-গরম সব রকম নেতারাই একত্র হইয়াছিলেন। তাঁহাদের সহিত কথাবার্তা কহিয়া বারীন যাহা সার-সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল তাহা সে এক কথায় বলিয়া দিল—“চোর, বেটাবা চোর।”

সমস্বরে আমরা ধ্বনি করিয়া উঠিলাম-

“কেন? কেন? কেন?”

বারীন বলিল—“এতদিন স্যাঙ্গাতেরা পট্টি মেরে আসছিলেন যে, তাঁরা সবাই প্রস্তুত; শুধু বাংলাদেশের খাতিরে তাঁরা বসে আছেন। গিয়ে দেখি না সব টু টু। কোথাও কিছু নেই; শুধু কর্তারা চেয়ারে বসে বসে মোডলি কচ্ছেন। ভু’ একটা ছেলে একটু আধটু কাজ করবার চেষ্টা করছে, তা’ও কর্তাদের লুকিয়ে। খুব কসে ব্যাটাদেব শুনিয়ে দিয়ে এসেছি!”

এতদিন শুনিয়া আসিতেছিলাম বর্গিরা একেবারে খাপ খুলিয়া বসিয়া আছেন; আর আজ এই সব ফক্কিকারের কথা শুনিয়া মনটা বেশ খানিকটা দমিয়া গেল। কিন্তু বারীন বলিল—

“কুছ পরোয়া নেই। ওরা যদি সঙ্গে এল তো এল; আর তা যদি না হয়—‘ত একলা চলরে’। আমরা বাংলা দেশ থেকেই পাঁচ বছরের মধ্যে গরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে দেব! লেগে যাও সবে আজ থেকে ছেলে জোগাড় করতে।”

সুতরাং চারিদিক হইতেই একটা হৈ হৈ রৈ রৈ সাড়া পড়িয়া গেল। ক্রমাগতই নূতন নূতন ছেলে আসিয়া জুটিতে লাগিল; কিন্তু আমাদের পিছে যে পুলিস লাগিয়াছে, এ সন্দেহ করিবারও নানা কারণ ঘটিল। ছেলেদের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রাখিবার চেষ্টাও হইল, কিন্তু অতগুলো বাড়ী ভাড়া করিবার পয়সা কোথায়? ছেলেদের খাইবার পয়সা জোটানই যে মুস্কিল! শেষে বৈদ্যনাথের কাছে মাঠের মাঝখানে একটা ছোট বাড়ী ভাড়া করিয়া সেই খানেই বোমার আড্ডা উঠাইয়া লইয়া যাওয়া স্থির হইল। বাগানটা প্রধানতঃ নূতন ছেলেদের পড়াশুনা করিবার আড্ডা হইয়া রহিল। বোমার আড্ডায় উল্লাসকর আড্ডাধারী হইয়া বসিল; আমি ষষ্ঠীবুড়ি হইয়া বাগানে ছেলেদের আগলাইতে লাগিলাম। বারীন চিরদিনই কর্মী পুরুষ; তাহাকে এক জায়গায় স্থির হইয়া বসিবার হুকুম বিধাতা দেন নাই। সে সমস্ত কর্মের কেন্দ্রগুলি তদারক করিয়া ছুটাছুটি করিতে লাগিল।

এই সময় একটা দুর্ঘটনায় আমাদের মন বড় খারাপ হইয়া গেল। আমাদের একটা ছেলে বোমা ফাটিয়া মারা পড়ে। আমাদের যতগুলি ছেলে ছিল, তাহাদের মধ্যে সেইটাই বোধ হয় সব চেয়ে বুদ্ধিমান। তাহার প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা কি ছিল যে, যে তাহাকে দেখিয়াছে সেই ভাল না বাসিয়া থাকিতে পারে নাই! তাহার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া মাথার মাঝখান হইতে কোমর পর্যন্ত মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়া কি যেন একটা সড়াৎ করিয়া নামিয়া গেল। একটা অন্ধ রাগ আর ক্ষোভে মনটা ভরিয়া গেল। মনটা শুধু আর্তনাদ করিতে করিতে বলিতে লাগিল— “সব চুলোয় যাক, সব চুলোয় যাক্!”

বৈদ্যনাথে তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। সেখানে মন টিকিল না। অন্ধকার পথ যে দিন দিন আরও অন্ধকারময় হইয়া উঠিতেছে তাহা বেশ বুঝিলাম।

কিন্তু উপায় নাই—চলিতেই হইবে। অনশন, অৰ্দ্ধাশন, আসন্ন বিপদ ও প্রিয়জনের ভীষণ মৃত্যুর মধ্য দিয়া এ দুর্গম পথ অতিক্রম করিতেই হইবে। এ বিবাহের যে এই মন্ত্ৰ!

বাহিরে কাজকর্ম তুমুল বেগে চলিতে লাগিল; কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা শক্তির অভাব অনুভব করিতে লাগিলাম। এই যে অকূল সমুদ্রে পাড়ি দিয়া চলিয়াছি, ইহার শেষ কোথায়? এই যে এতগুলো ছেলেকে ক্রমশঃ মরণের মুখে ঠেলিয়া লইয়া চলিয়াছি, মরণের ভয়টা কি আমাদের নিজেদের মন হইতে সত্যসত্যই মুছিয়া গিয়াছে? আর তাও যদি না হয়, ত দিনের পর দিন অন্ধের মত ছেলেগুলোকে কোথায় টানিয়া লইয়া যাইব? পথ যে নিজেদের চোখেই ক্রমশঃ অন্ধকার হইয়া উঠিতেছে! বারীনের মনে এ সময় কি হইত ঠিক জানি না। কোন দুঃসাহসের কার্যে তাহাকে এ পর্যন্ত কখনও ভয়ে পিছাইয়া আসিতে দেখি নাই। তবে সেও যেন মাঝে মাঝে নিজের ভিতর ঢুকিয়া শক্তি সংগ্রহের জন্য ব্যাকুল হইয়’ উঠিত বলিয়া মনে হয়। একটা কিছুর উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিলে আমাদের কাঁধের বোঝাটা যেন একটু হালকা হইয়া যাইত। এই জন্যই বোধ হয় যে সাধুটীর নিকট গুজরাটে সে দীক্ষা লইয়াছিল, তাঁহাকে এই সময় একবার বাংলাদেশে আসিবার জন্য সে অনুরোধ করিয়া পত্র লেখে।

১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সাধুটী মানিকতলা বাগানে আসিয়া উপস্থিত হন। দুই চারিদিন আমাদের সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া তিনি বলিলেন—“তোমরা যে পন্থা ধরিয়াছ তাহা ঠিক নহে। অশুদ্ধ মন লইয়া একাজে লাগিলে খানিকটা অনর্থক খুনোখুনির সম্ভাবনা। এ অবস্থায় যাহারা দেশের নেতৃত্ব করিতে চায়, তাহাদের অন্ধের মত কাজ করা চলিবে না। ভবিষ্যতের পরদা যাঁহাদের চোখের কাছ হইতে কতকটা সরিয়া গিয়াছে, ভগবানের নিকট হইতে যাঁহারা প্রত্যাদেশ পাইয়াছেন, তাঁহারাই এ কাজের যথার্থ অধিকারী। তোমাদের মধ্যে জন কয়েককে এই প্রত্যাদেশ পাইবার জন্য সাধনা করিতে হইবে।”

সাধনার ফরমাইস শুনিয়া ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। প্রত্যাদেশ না অশ্বডিম্ব! ইংরেজের সহিত যুদ্ধ করিব তাহার মধ্যে আবার ভগবানকে লইয়া এত টানাটানি কেন?

সাধু বলিলেন— “সকলের জন্য এ সাধনা নয়, শুধু নেতাদের জন্য। যাহারা দেশের লোককে পথ দেখাইবে, তাহাদের নিজেদের পথটা জানা চাই। দেশ স্বাধীন করিতে হইলেই যে খুব খানিকটা রক্তারক্তি দরকার,—এ কথাটা সত্য নাও হইতে পারে।”

বিনা রক্তপাতে যে দেশোদ্ধার হইবে এ কথাটা আমাদের নিতান্ত আরব্য উপন্যাসের মত মনে হইল! আমরা একটু বিজ্ঞতার হাসি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—“তাও কি সম্ভব?”

সাধু বলিলেন— “দেখ বাবা, যে কথা আমি বলিতেছি, তাহা জানি বলিয়াই বলিতেছি। তোমরা যে উদ্দেশ্যে কাজ করিতেছ, তাহা সিদ্ধ হইবে, কিন্তু যে উপায়ে হইবে ভাবিয়াছ, সে উপায়ে নয়। আমার বিশ বৎসরের সাধনার ফলে আমি ইহাই জানিয়াছি। চারিদিকের অবস্থা এক সময় এমনি হইয়া দাঁড়াইবে যে, সমস্ত রাজ্যভার তোমাদের হাতে আপনা হইতেই আসিয়া পড়িবে। তোমাদের শুধু শাসন-ব্যবস্থা প্রণালী গড়িয়া লইতে হইবে মাত্র। আমার সঙ্গে তোমরা জন কতক এস; সাধনার প্রত্যক্ষ ফল যদি কিছু না পাও, ফিরিয়া আসিও।”

সে-দিন সাধু চলিয়া যাইবার পর আমাদের মধ্যে বিষম তর্কাতর্কি বাধিয়া গেল। বারীন ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল— “কিছুতেই নয়। কাজ আমি ছাড়বো না। বিনা রক্তপাতে ভারত উদ্ধার—এটা ওঁর খেয়াল। সাধুর আর সব কথা মানি, শুধু ঐটে ছাড়া।”

আমার মনটা কিন্তু সাধুর কথায় বেশ একটু ভিজিয়াছিল দেখাই যাক না, রাস্তাটা যদি কোন রকমে একটু পরিষ্কার হয়! নিজের সঙ্গে বেশ একটা বোঝাপড়া না হইলে কোন কাজেই যে মন যায় না!

আমি আর তুই একটি ছেলেকে লইয়া সাধুর সঙ্গে যাইব বলিয়া স্থির করিলাম। সাধু আর একদিন বারীনকে বুঝাইতে আসিলেন কিন্তু পরের উপদেশ লইবার সু-অভ্যাস বারীনের একেবারেই নাই। কোন রকমে বারীনকে বাগাইতে না পারিয়া শেষে সাধু বলিলেন—“দেখ, এ রাস্তা যদি না ছাড়, ত তোমাদের অল্পদিনের মধ্যে ভীষণ বিপদ অনিবার্য।”

বারীন দুই হাত নাড়িয়া বলিল—“না হয় ধরে ঝুলিয়ে দেবে—এই বৈ ত নয়! তার জন্য ত প্রস্তুত হয়েই আছি।”

সাধু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—“যা ঘটবে—তা মৃত্যুর চেয়েও ভীষণ!”

সে-দিনের সভা ঐ খানেই ভঙ্গ হইল। সাধু ফিরিয়া যাইবার দিন স্থির করিলেন! কিন্তু সে-দিন যতই নিকটবর্তী হইয়া আসিল, আমার পা-ও যেন ততই বাগান ছাড়িয়া উঠিতে চাহিল না। স্ত্রী, পুত্র, ঘর, বাড়ী ছাড়িয়া আসিয়াছি, সেটা তত কঠিন বলিয়া মনে হয় নাই; কিন্তু যাহারা আমাদের দেখিয়া মা বাপের স্নেহ, ভবিষ্যতের আশা, এমন কি প্রাণের মমতা পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়াছে, তাহাদের ছাড়িয়া আজ কোথায় পলাইব? অনেক আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রীতি, উৎসাহ এই বাগানের সঙ্গে জড়িত হইয়া গিয়াছে; আজ সেই জিনিস ছাড়িয়া কোন্ অজানা দেশে আপনার লক্ষ্য খুঁজিতে বাহির হইব? নির্দিষ্ট দিনে সাধুর সহিত আর আমাদের যাওয়া হইল না। মার্চ মাসের মাঝামাঝি তিনি একাই ক্ষুণ্ন মনে ফিরিয়া গেলেন।

সকল অধ্যায়

১. নির্বাসিতের আত্মকথা – প্রথম পরিচ্ছেদ
২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ
৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৫. নির্বাসিতের আত্মকথা – পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৬. নির্বাসিতের আত্মকথা – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৭. নির্বাসিতের আত্মকথা – সপ্তম পরিচ্ছেদ
৮. নির্বাসিতের আত্মকথা – অষ্টম পরিচ্ছেদ
৯. নির্বাসিতের আত্মকথা – নবম পরিচ্ছেদ
১০. নির্বাসিতের আত্মকথা – দশম পরিচ্ছেদ
১১. নির্বাসিতের আত্মকথা – একাদশ পরিচ্ছেদ
১২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুদর্শ পরিচ্ছেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন