নির্বাসিতের আত্মকথা – নবম পরিচ্ছেদ

হাইকোর্টের রায় বাহির হইবার পর হইতেই পুলিসের আনাগোনা একটু ঘন ঘন আরম্ভ হইয়াছিল—সাজা কমাইবার প্রলোভনে যদি কেহ কোন নূতন কথা বলিয়া দেয়! আমাদের ধরা পড়িবার পরই নানা কারণে এত কথা বাহির হইয়া গিয়াছিল যে, পুলিসের জানিবার আর বোধ হয় বেশী কিছু বাকী ছিল না! কিন্তু তথাপি পুলিস একবার নাড়া চাড়া দিয়া দেখিল আর কিছু সংগ্রহ করা যায় কিনা। নির্জন কারাবাসের সময় মানুষের মন অপরের সঙ্গে কথা কহিবার জন্য যেরূপ অস্থির হইয়া উঠে, পুলিসেরা তাহা বেশ ভাল করিয়াই জানে। দুই এক মাস যদি কাহারও সহিত কথা কহিতে না পাওয়া যায় তাহা হইলে মানুষের টিকটিকি, আরসুলার সহিতই কথা কহিতে ইচ্ছা হয়— পুলিস ত তবু মানুষ! কতকগুলো বাজে কথা কহিতে গেলে তাহার সহিত দুই একটা গোপনীয় কথাও বাহির হইবার সম্ভাবনা। • বিশ ত্রিশ জন লোকের নিকট ঘুরিলে অন্ততঃ চার পাঁচ জনের নিকট হইতে এরূপ এক আধটা কাজের কথা পাওয়া যায়! পুলিসের তাহাই ভরসা।

কথা বাহির হইবার আরও একটা কারণ এই যে, নামে ‘গুপ্তসমিতি’ হইলেও কতকটা অভিজ্ঞতা ও কতকটা অর্থের অভাবে আমাদের কার্যপ্রণালী শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া উঠিতে পারে নাই। ইউরোপীয় গুপ্তসমিতিগুলির ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ ভিন্নভিন্ন অধ্যক্ষের অধীনে থাকে; এবং এক বিভাগের লোক অন্য বিভাগের সহিত বিনা প্রয়োজনে পরিচিত হইবার অবসর পায় না। সমিতির অধ্যক্ষদের এই চেষ্টা থাকে যেন প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন কর্ম ভিন্ন অপরের কর্ম না জানিতে পারে। এইরূপ নিয়ম থাকায় এক আধজনের দুর্বলতায় সমস্ত কাজ নষ্ট হইতে পায় না। নানা কারণে সেরূপ ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে হইয়া উঠে নাই আর তাহার উপর আমাদের স্বভাবসিদ্ধ গল্প করিবার প্রবৃত্তি ত আছেই। আমাদের দেশে প্রত্যেক সমিতির ভিতর হইতে যে দুই একজন করিয়া সরকারী সাক্ষী বাহির হইয়াছিল কার্যপ্রণালীর শিথিলতাই তাহার প্রধান কারণ। দলাদলি ও পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের ফলেও অনেক সময় অনেক সমিতির গুপ্তকথা প্রকাশ হইয়া গিয়াছে। যে জাতি বহুদিন শক্তির আস্বাদন পায় নাই, তাহাদের নেতারা যে প্রথম প্রথম ক্ষমতালোলুপ হইয়া দাঁড়াইবে তাহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছুই নাই। আর নেতাদিগের মধ্যে অযথা প্রভুত্ব প্রকাশের ইচ্ছা থাকিলে অনুচরদিগের মধ্যে ঈর্ষা ও অসন্তুষ্টি অনিবার্য।

একটা সুবিধার কথা এই যে গল্প করিবার প্রবৃত্তি শুধু আমাদের মধ্যে আবদ্ধ নহে। ইউরোপীয় প্রহরীরাও প্রায় সমস্ত দিন জেলের মধ্যে বন্ধ থাকিয়া হাঁপাইয়া উঠিত। তাহাদের মধ্যেও বেশ একটু দলাদলি ছিল। একদল অপর দলকে জব্দ করিবার জন্য মাঝে মাঝে আমাদেরও সাহায্যপ্রার্থী হইত; এবং তাহাদের কথাপ্রসঙ্গে জেলের অনেক গুপ্ত রহস্ত প্ৰকাশ পাইত।

কিছুদিন এইরূপ থাকিবার পর শুনিলাম যে, Civil Surgeon আমাদের আন্দামানে পাঠাইবার জন্য পরীক্ষা করিতে আসিবেন। যথা সময়ে Civil Surgeon আসিয়া পেট টিপিয়া, চোখ দেখিয়া সাতজনের ভবনদী পারের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। সুধীর ও আমি তখন রক্ত আমাশয়ে ভুগিতেছিলাম বলিয়া আমাদের আরও কিছুদিনের জন্য অপেক্ষা করিতে হইল।

সাধারণ কয়েদীর পক্ষে নিয়ম এই যে, একবার রোগের জন্য আন্দামানে যাওয়া বন্ধ থাকিলে আরও তিন মাস অপেক্ষা করিতে হয়; কিন্তু আমাদের বেলা সে আইন খাটিল না। সরকার বাহাদুরের আদেশক্রমে আমাদের ছয় সপ্তাহের মধ্যেই পাঠাইয়া দেওয়া হইল।

কারাগৃহ হইতে একবার দেশকে শেষ দেখা দেখিয়া লইলাম। একদিন ভোরবেলা আমাদের হাতে হাতকড়ি লাগাইয়া আমাদের একখানা গাড়ীতে চড়ান হইল। দুই পাশে দুইজন সার্জেন্ট বসিল; আর গাড়ী খিদিরপুর ডকের দিকে ছুটিল।

জাহাজে উঠাইয়া দিয়া একজন সার্জেন্ট বিদ্রূপ করিয়া বলিল–Now say, my native land, farewell. আমরা হাসিয়া বলিলাম— “Au revoir।” বলিলাম বটে, কিন্তু ফিরিবার আশাটা নিতান্তই জবরদস্তি মনে হইতে লাগিল।

রাজনৈতিক কয়েদী আমরা শুধু দুইজন মাত্র ছিলাম— সুধীর ও আমি। জাহাজের খোলের মধ্যে একটা কামরায় আমরা ছিলাম; অপর কামরায় অন্যান্য কয়েদী ছিল। জাহাজের একজন বাচ্চা কর্মচারী আসিয়া আমাদের ফটো তুলিয়া লইল। বিলাতের কোন্ কাগজে সে এই সমস্ত ফটো ছাপিবার জন্য পাঠাইয়া দেয়। কথাটা শুনিবামাত্র পাগড়ীটা ভাল করিয়া বাঁধিয়া লইলাম। সস্তাদরে যদি একটা ছোট খাট বড়লোক হইয়া পড়া যায় ত মন্দ কি।

তিন দিন তিন রাত সেই জাহাজের খোলের মধ্যে চিড়া চিবাইতে চিবাইতে যাইতে হইবে দেখিয়া, সুধীর ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিল! সে একটা হাতীর মত জোয়ান—তিন মুঠো চিড়া চিবাইয়া তাহার কি হইবে? পুলিসের একজন পাঞ্জাবী মুসলমান হাওলদার বলিল-”বাবু, যদি আমাদের হাতের ভাত খাও, ত দিতে পারি।” মুসলমানদের মধ্যে সহানুভূতিও আছে, আর ভাত খাওয়াইয়া হিন্দুর জাত মরিবার ইচ্ছাও একটু একটু আছে। আমরা বলিলাম—“খুব ভাল কথা। আমাদের জাত এত পাকা যে, যে কোন লোকের হাতের ভাত খাইলেও তাহা ভাঙ্গিয়া পড়ে না।” সেখানে শিখ হাওলদারও ছিল, তাহারা ভাবিল পেটের জ্বালায় আমরা পরকালটা একেবারে নষ্ট করিতে বসিয়াছি। তাই তাহারাও আমাদের ভাত দিতে চাহিল। আমরা নির্বিবাদে উভয় দলের রান্না ভাত খাইয়া পেটের জ্বালাও থামাইলাম, ও আপনাদের উদারতাও প্রমাণ করিলাম। শিখেরা ভাবিল—“বাঙ্গালী বাবুরা বুদ্ধিমান বটে, কিন্তু উহাদের ধর্মাধর্ম জ্ঞান একেবারে নাই।” যাই হোক, ধর্ম বাঁচিল কি মরিল তাহা ঠিক জানি না কিন্তু দুটি ভাত খাইয়া সে যাত্রা প্রাণটা বাঁচিয়া গেল। জাহাজে আমাদের নোয়াখালী জেলার অনেকগুলি বাঙ্গালী মুসলমান মাল্লাও ছিল, তাহাদের হাতে রান্না ভাত ও কুমড়ার ছক্কা যেন অমৃতোপম মনে হইল।

যাই হোক, কোনও রূপে তিন দিন জাহাজে কাটাইয়া চতুর্থ দিনে পোর্টব্লেয়ারে হাজির হইলাম। দূর হইতে জায়গাটি বড়ই রমণীয় মনে হইল। সারি সারি নারিকেল গাছ, আর তাহার মাঝে মাঝে সায়েবদের বাংলোগুলি যেন একখানি ফ্রেমে বাঁধান ছবির মত। ভিতরের কথা তখন কে জানিত?

দূরে একখানা প্রকাণ্ড ত্রিতল বাড়ী দেখাইয়া দিয়া একজন সিপাহী বলিল—“ঐ কালাপানীর জেল, ঐখানে তোমাদের থাকিতে হইবে।”

জাহাজ আসিয়া বন্দরে লাগিল। ডাক্তার আসিয়া সকলকে পরীক্ষা করিয়া গেল। তাহার পর ডাঙ্গায় নামিয়া আমরা বিছানা মাথায় করিয়া বেড়ী বাজাইতে বাজাইতে জেলের দিকে রওনা হইলাম।

জেলের মধ্যে ঢুকিবামাত্র একজন স্থূলকায় খর্বাকৃতি শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আমাদের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— “So, here you are, at last! Well, you see that block yonder. It is there that we tame lions. You will meet your friends there, but mind you don’t talk.”

( এই যে এসেছ! ঐ দেখছো বাড়ীটা, ঐ খানে আমরা সিংহদের পোষ মানাই। ওখানে তোমার বন্ধুদের দেখতে পাবে, কিন্তু খবরদার, কথা ক’য়ো না )।

আমরাও শ্বেতাঙ্গটিকে একবার চক্ষু দিয়া মাপিয়া লইলাম। লম্বায় পাঁচ ফুট, আর চওড়ায় প্রায় তিন ফুট। মোট কথা, একটি প্রকাণ্ড কোলা ব্যাঙকে কোট পেন্ট লান পরাইয়া টুপি পরাইয়া দিলে যেরূপ দেখায় অনেকটা সেই রকম। তখন জানিতাম না ইনিই মহামহিম শ্রীমান্ ব্যারী, জেলের হর্তা কর্তা বিধাতা। তাঁহার বুলডগের মত মুখখানি দেখিলে মনে হয় যে কয়েদী তাড়াইতে যাঁহাদের জন্ম, ইনি তাঁহাদের অন্যতম। ভগবান নির্জনে বসিয়া ইহাকে কালাপানির জেলে কর্তৃত্ব করিবার জন্যই গড়িয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিলে Uncle Tom’s Cabin এর লেগ্রিকে মনে পড়ে।

ভবিষ্যতে তাঁহার সহিত ভাল করিয়া পরিচিত হইবার অবসর পাইয়াছিলাম কেননা প্রায় এগার বৎসর তাঁর অধীনে এই জেলে বাস করিতে হইয়াছিল।

ইনি রোমান ক্যাথলিক আইরিশ। সারা বৎসর কয়েদী ঠেঙ্গাইয়া যে পাপের বোঝা তাঁহার ঘাড়ে চড়িত, তাহা যীশু-খ্রীষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে গির্জায় গিয়া পাদরী সাহেবের পদপ্রান্তে নামাইয়া দিয়া আসিতেন। বৎসরের মধ্যে ঐ একদিন তিনি শান্ত সৌম্যমূর্তি ধরিতেন; সে দিন কোন কয়েদীকে তাড়না করিতেন না; আর বাকি ৩৬৪ দিন মূর্তিমান যমের মত কয়েদী তাড়াইয়া বেড়াইতেন।

কয়েদীদের স্বভাবের মধ্যে এই বিশেষত্ব লক্ষ্য করিয়াছি যে, দুর্দান্ত লোকদিগের প্রতি তাহারা সহজেই আকৃষ্ট হয়, এবং এইরূপ লোকদিগেরই সহজে বশ্যতা স্বীকার করে। ব্যারী সাহেবের নিকট প্রহার খাইবার পর অনেক কয়েদীকে বলিতে শুনিয়াছি–“শালা বড় মরদ হৈ।” যাহারা ভাল মানুষ তাহারা কয়েদীদের মতে স্ত্রী জাতীয়। কয়েদীরা কোন কুকার্য করিয়া ভগবানের নাম করিয়া ক্ষমা চাহিলে ব্যারী বলিতেন—“জেলখানা আমার রাজ্য; এটা ভগবানের এলাকাভুক্ত নহে। ত্রিশ বৎসর ধরিয়া আমি পোর্টব্লেয়ারে আছি; একদিনও এখানে ভগবানকে আসিতে দেখি নাই।”—ব্যারী সাহেবের মুখের কথা হইলেও ইহা সম্পূর্ণ সত্য।

জেলে পৌঁছিতে না পৌঁছিতেই আমাদের মধ্যে যাহারা ব্রাহ্মণ তাহাদের পৈতা কাড়িয়া লওয়া হইল। দেশের জেলে ঐরূপ কোনও নিয়ম না থাকিলেও কালাপানিতে ঐ নিয়মই বলবৎ। জেল জগন্নাথক্ষেত্র, এখানে জাতিভেদ মরিয়া প্রেতদশা লাভ করিয়াছে। তবে মুসলমানদের দাড়ি বা শিখের চুলে হাত দেওয়া হয় না; কিন্তু গোবেচারা ব্রাহ্মণের পৈতা কাড়িতে সবাই ক্ষিপ্রহস্ত। তাহার কারণ শিখ, মুসলমান গোঁয়ার কিন্তু ব্রাহ্মণ নিরীহ। যাই হোক, তেজহীন ব্রাহ্মণের নির্বিষ খোলসখানাকে ত্যাগ করিয়া আমরা ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশিয়া গেলাম।

জেলে ঢুকিলে প্রথমেই নজরে পড়ে বহু জাতির সমাবেশ। বাঙ্গালী, হিন্দুস্তানী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বর্মী, মাদ্রাজী সব মিশিয়া খিচুড়ী পাকাইয়া গিয়াছে। হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান সমান; বর্মীও যথেষ্ট। ভারতবর্ষে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় হিন্দুর এক চতুর্থাংশ কিন্তু জেলখানায় হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান কি করিয়া হইল তাহা স্থির করিতে গেলে উভয় জাতির একটা প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে বলিয়া মনে হয়। ব্রহ্মদেশে লোকসংখ্যা মোট এক কোটি অর্থাৎ সমস্ত বাঙ্গালীর প্রায় চার ভাগের এক ভাগ; কিন্তু এখানে বাঙ্গালী অপেক্ষা ব্রহ্মদেশীয় লোকের সংখ্যা অনেক বেশী। খুন, মারামারি করিতে ব্রহ্মদেশীয় লোক বিশেষ মজবুদ! অল্পদিন মাত্র তাহারা স্বাধীনতা হারাইয়াছে সুতরাং ভরতবর্ষের লোকের মত একেবারে শিষ্ট শান্ত হইয়া যায় নাই। হিন্দুস্থান ব্যতীত অন্য দেশের উচ্চশ্রেণীর লোকের সংখ্যা খুব কম। শিক্ষা প্রচারের আধিক্যবশতঃই হোক বা প্রকৃতির নিরীহতাবশতঃই হোক মাদ্রাজী ব্রাহ্মণ একেবারে নাই বলিলেই চলে। আমরা যে সময় উপস্থিত হইলাম তখন জেলখানার মধ্যে পাঠানের প্রাধান্য খুব বেশী। সব জাতিকে একত্র রাখার ফলে যে দুর্বল জাতিদের উপর অযথা অত্যাচার যথেষ্ট হয় তাহা বলাই বাহুল্য।

দিনকতক থাকিতে থাকিতেই দেখিলাম যে জেলখানায় দুর্বলের পক্ষে সুবিচার পাইবার কোনই সম্ভাবনা নাই। কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-সাবুদ দিবার বুকে পাটা কয়েদীদের মধ্যে বড় একটা দেখা যায় না। পরের জন্য নিজের ঘাড়ে বিপদ কে টানিয়া আনিতে যাইবে? যে যার নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাইতেই ব্যস্ত। যাহারা খোসামোদ করিতে সিদ্ধহস্ত, মিথ্যা কথা যাহারা জলের মত বলিয়া যাইতে পারে তাহারাই কর্তৃপক্ষের কাছে ভাল মানুষ এবং তাহারাই প্রভুদিগের প্রসাদ লাভে সমর্থ। আর যাহারা ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা করিয়া অপরের জন্য লড়াই করিতে যায়, তাহাদের অদৃষ্টে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত ঘটে! মিথ্যা মোকদ্দমার ফাঁদে পড়িয়া তাহারা অযথা মার খাইয়া মরে। ফলে জেলখানায় যত কয়েদী আসে, তাহার মধ্যে একজনও জেল খাটার ফলে সচ্চরিত্র হইয়া যা তাহা মনে করিবার কারণ নাই।

বাস্তবিকই কয়েদীদের ভাল করিয়া তুলিবার চোঁ সেখানকার কর্তৃ পক্ষদের মোটেই নাই বলিলে চলে। অসচ্চরিত্র লোকদিগের সচ্চরিত্র করিয়া তোলাতেই যে জেলখানার সার্থকতা সে ধারণাও তাঁহাদের আছে বলিয়া মনে হয় না। কয়েদী তাঁহাদের কাছে কাজ করিবার যন্ত্র বিশেষ, আর যে অফিসার কয়েদী ঠেঙ্গাইয়া যত বেশী কাজ আদায় করিতে পারে সে তত কাজের লোক; তাহার পদোন্নতি তত দ্রুত।

আর একটা মজার কথা এই যে, সে উল্টা রাজার দেশে মুড়ি মিছরী সব একদর–সব রকম অপরাধের জন্য দণ্ডিত কয়েদীই প্রায় এক রকম ব্যবহার পায়। কঠোর বা লঘু পরিশ্রমের সঙ্গে সব সময় অপরাধের গুরুত্বের বা লঘুত্বের বড় একটা সম্বন্ধ থাকে না। যে সময় কোথাও নারিকেল ছোবড়ার তার (coir) পাঠাইবার দরকার হয় সে সময় সকলকেই ছোবড়া কুটিতে লাগাইয়া দেওয়া হয়, আর যখন নারিকেল বা সরিষার তেলের আবশ্যক হয়, তখন একটু মোটাসোটা সকলকেই ধরিয়া ঘানিগাছে জুড়িয়া দেওয়া হয়। সবটাই ব্যবসাদারী কাগু! কয়েদী সরকার বাহাদুরের গোলাম; আপনাদের দেহের রক্ত জল করিয়া সরকারী কোষাগার পূর্ণ করাতেই তাহাদের অস্তিত্বের সার্থকতা!

অপরাধের তারতম্য অনুসারে কয়েদীকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীভুক্ত করিবার প্রথা সরকারী পুঁথিতে আছে বটে, কিন্তু কার্যকালে তাহা ঘটিয়া ওঠে না। কিসে জেলের আয় বৃদ্ধি হয়, সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট হইতে আরম্ভ করিয়া চুণো পুঁটি অফিসার পর্যন্ত সকলেরই সেই দিকে দৃষ্টি। কয়েদী মরুক আর বাঁচুক, কে তাহার খবর রাখে? ভারতবর্ষে লোকের অভাবও নাই আর মাসে মাসে জাহাজ বোঝাই করিয়া দরকার মত কয়েদী সরবরাহ করিবার জন্য বিলাতী বিচারকেরও অভাব নাই।

একবার একটী পাগলকে জেলখানায় দেখিয়াছিলাম। বেচারীর বাড়ী বর্দ্ধমান জেলায় জেলখানায় সে ঝাড়ুদারের কাজ করিত। তাহার নিজের বাড়ীর সম্বন্ধেও তাহার ধারণা অতি অস্পষ্ট; কেন যে সে সাজা পাইয়া কালাপানিতে আসিয়াছে তাহাও ভাল করিয়া বুঝিত না। একদিন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম-”তোমরা ক ভাই!” সে উত্তর করিল— “সাত।” তাহাদের নাম করিতে বলায় সে আঙ্গুলের গাঁট গণিয়া পাঁচ জনের নাম করিল। বাকী দুইজনের নাম করিতে বলায় উত্তর দিল—“ভুলে গেছি।” তাহার খাওয়া পরার বড় একটা ঠিকানা থাকিত না; কখন আপন মনে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত; কখনও বা সারাদিন রাস্তা পরিষ্কার করিয়া বেড়াইত। একটু লক্ষ্য করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, লোকটার মাথা খারাপ। তাহাকে পাগলা গারদে না দিয়া কোন্ সুবিচারক যে তাহার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের ব্যবস্থা করিয়াছেন তাহা বলিতে পারি না। এরূপ দৃষ্টান্ত জেলখানায় অনেক পাওয়া যায়।

তবে মাঝে মাঝে দুই একজন এমন ওস্তাদ মিলে যাহারা কাজের ভয়ে পাগল সাজে। একজন বাঙালীকে ঐরূপ দেখিয়াছিলাম। একদিন বেগতিক বুঝিয়া সে মাথায় কাপড় বাঁধিয়া গান জুড়িয়া দিল। চোখে চুনের সামান্য গুঁড়া লাগাইয়া চোখ দুইটা লাল করিয়া লইল; তার আবোল তাবোল বকিতে আরম্ভ করিল। ভাত খাইবার সময় মুখ ফিরাইয়া বসিয়া রহিল। প্রহরীরা তাহাকে জেলারের কাছে ধরিয়া লইয়া গেল। জেলার গোটা দুই কলা আনিয়া তাহার হাতে দিলেন। সে কলা দুটো খাইয়া পরে খোসাগুলোও মুখে পুরিয়া চিবাইতে লাগিল। জেলার স্থির করিলেন লোকটা সত্য সত্যই পাগল; তা’ না হইলে খোসা চিবাইতে যাইবে কেন? লোকটা ফিরিয়া আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—“হাঁরে, খোসা চিবুতে গেলি কেন?” সে বলিল—“কি করি বাবু সাহেব, বেটাকে ত বোকা বানাতে হবে! একটু কষ্ট না করলে কি আর পাগল হওয়া চলে?”

সকল অধ্যায়

১. নির্বাসিতের আত্মকথা – প্রথম পরিচ্ছেদ
২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ
৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৫. নির্বাসিতের আত্মকথা – পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৬. নির্বাসিতের আত্মকথা – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৭. নির্বাসিতের আত্মকথা – সপ্তম পরিচ্ছেদ
৮. নির্বাসিতের আত্মকথা – অষ্টম পরিচ্ছেদ
৯. নির্বাসিতের আত্মকথা – নবম পরিচ্ছেদ
১০. নির্বাসিতের আত্মকথা – দশম পরিচ্ছেদ
১১. নির্বাসিতের আত্মকথা – একাদশ পরিচ্ছেদ
১২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুদর্শ পরিচ্ছেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন