আমাদের নিজেদের অন্তর্বিরোধের ফলে আমরা অনেক দিন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের অত্যাচারে বাধা দিতে পারি নাই। শেষে কষ্টের যখন বাড়াবাড়ি আরম্ভ হইল, তখন নিজেদের বিরোধ চাপা দিয়া ধর্মঘটের আয়োজন আরম্ভ হইল। এ বিষয়ে প্রধান উদ্যোক্তা শ্রীমান নন্দগোপাল। নন্দগোপাল পাঞ্জাবী ক্ষত্রিয়। দীর্ঘকায় সুপুরুষ, ১২৪-ক ধারায় অভিযুক্ত হইয়া দশ বৎসরের জন্য দ্বীপান্তরিত হন। তিনি ঘানিতে যাইয়া এক নূতন কাণ্ড করিয়া বসিলেন। প্রথমেই বলিলেন “অত জোরে ঘানি ঘুরান আমার পোষাইবে না।” ঘানি সাধ্যমত আস্তে আস্তে ঘুরিতে লাগিল; ফলে দশটার মধ্যে তেলের এক-তৃতীয়াংশও পেষা হইল না। দশটার সময় নীচে আসিয়া সাধারণ কয়েদীরা পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়া লইয়া আবার কাজ করিতে ছুটে। দশটা হইতে বারোটা পর্যন্ত আইন অনুসারে আহার ও বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট থাকিলেও কাজ পাছে শেষ না হয় এই ভয়ে তাহারা বিশ্রাম লইতে সাহস করে না। কাজ শীঘ্র শেষ হইলে হাত পা ছড়াইয়া একটু জিরাইতেও পায়। নন্দগোপালের সে ভয় নাই। পেটি অফিসার আসিয়া তাড়াতাড়ি খাইয়া লইবার জন্য তাঁহার উপর হুকুম জারি করিল। নন্দগোপাল তাহাকে স্মিতদনে স্বাস্থ্যনীতি বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, তাড়াতাড়ি আহার করিলে পাকস্থলীর বিশেষ অনিষ্টের সম্ভাবনা; আর দশ বৎসর যখন তাঁহাকে সরকার বাহাদুরের অতিথি হইয়া থাকিতেই হইবে, তখন কোনও কারণে তিনি আপনার স্বাস্থ্যভঙ্গ করিয়া সরকারের বদনাম করিতে অপারগ। জেলার সাহেবের কাছে রিপোর্ট পৌঁছিল; তিনি আসিয়া দেখিলেন নন্দগোপাল ধীরে ধীরে গ্রাস পাকাইয়া বত্রিশ দাতে চৌষট্টি কামড় মারিয়া এক গ্রাস গলাধঃকরণ করিতেছেন। খুব খানিকটা তর্জন গর্জন করিয়া তিনি নন্দগোপালকে বুঝাইয়া দিলেন যে, কাজ যথা সময়ে শেষ করিতে না পারিলে বেত্রাঘাত অনিবার্য। নন্দগোপাল নিতান্ত ভদ্রভাবে স্বাস্থ্যনীতি পুনরাবৃত্তি করিয়া জেলার সাহেবকে মধুর হাস্যে জানাইলেন যে, সরকার বাহাদুর যখন দশটা হইতে বারোটা পর্যন্ত আহার ও বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, তখন তিনি ত নিজে সে আইন ভঙ্গ করিবেনই না, অধিকন্তু জেলার সাহেবও যাহাতে সে আইন ভঙ্গ না করেন সে বিষয়েও দৃষ্টি রাখিবেন। বলা বাহুল্য, জেলার সাহেবের অঙ্গ জুড়াইয়া দ্রব হইয়া গেল। তিনি তর্জন গর্জন করিয়া মানে মানে প্রস্থান করিলেন। আহারাদি যথাসময়ে শেষ করিয়া নন্দগোপাল কুঠরীতে গিয়া ঢুকিলেন। বিব্রত পেটি অফিসার ভাবিল এইবার বুঝি কাজ আরম্ভ হইবে। নন্দগোপাল কিন্তু একখানি কম্বল লইয়া আস্তে আস্তে বিছানা পাতিয়া শুইয়া পড়িলেন। অজস্র গালাগালিতেও তাঁহার বিশ্রামের ব্যাঘাত হইল না। Passive resistanceএ তিনি মহাত্মা গান্ধিরও গুরু। বারোটার সময় উঠিয়া নন্দগোপাল আরও একঘণ্টা ঘানি ঘুরাইলেন, যখন দেখিলেন যে, বালতিতে প্রায় পনেরো পাউণ্ড তেল হইয়াছে তখন বাকি নারিকেল বস্তায় বন্ধ করিয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। কাজের ত অর্ধেক মাত্র হইয়াছে, বাকি অর্ধেক এখন করিবে কে? নন্দগোপাল বলিলেন, “যাহার খুসি সেই করিবে। আমি সত্যই কলুর বলদ নই যে, সমস্ত দিনই তেল পিবিব। দিনে ত ছয় পয়সারও খোরাক পাই না, তা ত্রিশ পাউণ্ড তেল পিষিব কেমন করিয়া?”
কর্তৃপক্ষ মহলে একটা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। তর্জন গর্জন অনেক হইল; কিন্তু নন্দগোপাল নির্বিকার পরমপুরুষের মত নিষ্পন্দ এবং সদা স্মিতবদন। নন্দগোপালের নিকট হইতে ত্রিশ পাউণ্ড তেল বাহির হইবার কোন আশাই নাই দেখিয়া সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব তাঁহাকে পায়ে বেড়ী দিয়া অনির্দিষ্ট কালের জন্য (till further orders) কুঠরীতে বন্ধ রাখিতে আজ্ঞা দিলেন।
এইরূপে আরও এক মাস কাটিল। ইতিমধ্যে জেলার সাহেব নন্দগোপালের সহিত একটা রফা করিয়া ফেলিলেন। বলিলেন যে, চার দিন পুরা কাজ করিলে তিনি ভবিষ্যতে তাঁহাকে ঘানি খুরান হইতে অব্যাহতি দিবেন। নন্দগোপালও রাজি হইয়া অল্পাধিক পরিমাণে অপরের সাহায্যে চার দিন পুরা কাজ দাখিল করিয়া সে-যাত্রা নিষ্কৃতি পাইলেন।
এ নিষ্কৃতির আনন্দ কিন্তু অধিক দিন স্থায়ী হইল না। অল্পদিন পরেই আবার তাঁহাকে বড় ঘানিতে তেল পিষিতে দেওয়াতে তিনি সে কাজ করিতে অস্বীকৃত হন। ফল—বেড়ি ও কুঠরী বন্ধ। হুকুম হইল সকলকে পুনরায় তিন দিনের জন্য জেলে খানি ঘুরাইতে হইবে; একে ত আমরা সকলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেলে আবদ্ধ, তাহার উপর প্রত্যহ ঘানির বিভীষিকা। সকলেই বুঝিলেন যে, কাজকর্ম সম্বন্ধে একটা সুবিধা রকমের পাকা বন্দোবস্ত করিয়া না লইতে পারিলে পোর্টব্লেয়ারেই ভবলীলা সাঙ্গ করিতে হইবে। সাজা ত আছেই, ‘তবে আর নিজের হাতে নিজেকে শাস্তি দেওয়া কেন? অনেকেই এবার ঘানিতে কাজ করিতে অস্বীকার করিলেন। ধর্মঘট আরম্ভ হইল।
কর্তৃ পক্ষও রুদ্রমূর্তি ধরিলেন। জেলখানা ভরিয়া সে এক আনন্দোৎসব পড়িয়া গেল। সাজার উপর সাজা চলিতে লাগিল। চার দিন কঞ্জিভক্ষণ ও সাত দিন দাঁড়া হাতকড়ি, ইহাই সাধারণতঃ সাজার প্রথম কিস্তি। গুঁড়া চাউল ফুটন্ত -গরম জলে ঢালিয়া দিলে যে সুখাদ্য প্রস্তুত হয়, তাহাই আমাদের কঞ্জি। তাহাই মাপিয়া এক এক পাউণ্ড করিয়া দিনে দুইবার খাইতে দেওয়া হয়, এবং কয়েদী কোনও উপায়ে আর কিছু সংগ্রহ করিয়া খাইতে না পায় সে বিষয়ে কড়া পাহারা থাকে জেলের শাস্ত্র অনুসারে চার দিনের অধিক এ কঞ্জি (penal diet)-খাওয়াইবার নিয়ম নাই; কিন্তু কর্তৃপক্ষের আমাদের উপর দয়ার আধিক্যবশতঃই হোক আর যে কারণেই হোক উল্লাসকর, নন্দগোপাল ও হোতিলালকে বারো তেরো দিন এই কঞ্জি খাওয়াইয়া রাখা হয়। ১৯১৩ সালে যখন শ্রীযুক্ত রেজিনাল্ড ক্র্যাডক পোর্টব্লেয়ার পরিদর্শন করিতে যান, তখন নন্দগোপাল তাঁহার নিকট এই সম্বন্ধে অভিযোগ করেন; কিন্তু সাজা দিলেও কর্তৃপক্ষগণ টিকিটে এ সম্বন্ধে কোনও কথা লিখেন নাই। জেলার সাহেবও অম্লানবদনে বলিলেন যে, অভিযোগ মিথ্যা। সুতরাং ফল কিছুই হইল না। জেলারের বিরুদ্ধে কয়েদীর কথা কোন কালেই প্রমাণিত হয় না।
সাজার পর সাজা চলিতে লাগিল; নানা রকমের বেড়ীর পালা শেষ করিয়া আমাদের কুঠরীতে বন্ধ করা হইল। তাহারও একটু রকমারি আছে। সাধারণ কয়েদীদের কুঠরী-বন্ধ করা হইলে তাহারা নীচে আসিয়া স্নানাহার করিতে পারে; অপর কয়েদীদের সঙ্গে কথাবার্তা কহিবারও তাহাদের বাধা নাই। এখন নূতন আজ্ঞা, প্রচারিত হইল যে, আমাদের সঙ্গে কেহু কথা কহিলে তাহাকে দণ্ডনীয় হইতে হইবে। সুতরাং নামে পৃথক কারাবাস ( separate confinement ) হইলেও কার্যতঃ আমাদের পক্ষে উহা নির্জন কারাবাস ( solitary confinement ) হইয়া দাঁড়াইল। অনেককেই তিন মাস বা ততোধিক কাল এইরূপ কুঠরী-বদ্ধ অবস্থায় কাটাইতে হইল।
অনেকেরই এই সময় স্বাস্থ্যঙ্গ হইতে লাগিল। একে পোর্টব্লেয়ারে ম্যালেরিয়ার প্রচণ্ড প্রকোপ; জ্বরজাড়ি লাগিয়াই আছে, তাহার উপর আমাশয় সুরু হইল। কর্তৃপক্ষও বোধ হয় ভাবিলেন যে, ব্যবস্থার একটু পরিবর্তন দরকার। সেই জন্য আমাদের মধ্যে বাছিয়া বাছিয়া জন কয়েককে করোনেশন উৎসবের সময় জেলের বাহিরে Settlementএ পাঠান হইল। বারান্দ্র গেলেন Engineering files, অর্থাৎ রাজমিস্ত্রীর সহিত মজুরী করিতে, উল্লাসকর গেলেন মাটি কাটিয়া ইট বানাইতে, কেহ গেলেন জঙ্গলে ( Forest Department ) কাঠ কাটিতে; কেহ বা রিক্শ টানিতে; আর কেহ বা গেলেন বাঁধ বাঁধিতে।
আমাদের কিন্তু অদৃষ্টগুণে ‘উল্টা বুঝিলি রাম’ হইয়া দাঁড়াইল। জেলখানার মধ্যে কাজ যতই কঠোর হোক না কেন, সরকার হইতে নির্দিষ্ট খোরাক পাওয়া যাইত, আর জল-বৃষ্টিতে বেশী ভিজিতে হইত না। বাহিরে গিয়া সে সুখটুকুও চলিয়া গেল! প্রাতঃকালে ৬টা হইতে ১০টা ও অপরাহ্ণে ১টা হইতে ৪০টা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম ত করিতেই হয়; অধিকন্তু রৌদ্রে পুড়িতে ও বৃষ্টিতে ভিজিতে হয়। বিশেষতঃ পোর্টব্লেয়ারে বৎসরে সাত মাস বর্ষাকাল, তাহার উপর জঙ্গলে জোঁকের উপদ্রব। জঙ্গলে কাজ করিবার ভয়ে কত লোক যে পলাইতে চেষ্টা করিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই।
একেত এই কষ্ট, তাহার উপর পুরা খোরাক মিলে না। কয়েদীর খোরাক চুরি হইয়া বাজারে ও গ্রামে গ্রামে বিক্রীত হয়। সাধারণ কয়েদী হইতে ইউরোপীয় কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই এই চুরির কথা বেশ জানেন; কিন্তু চুরি কখনও বন্ধ হয় না। অধিকাংশ কর্মচারীই ঘুষখোর; সুতরাং এ চুরি-রোগের প্রতিকার নাই। সাধারণ কয়েদী ইহার বিরুদ্ধে সহজে কিছু বলিতে চায় না; কেননা সে বিলক্ষণ জানে যে, মুখ খুলিলেই তাহাকে বিপদে পড়িতে হইবে।
রোগীর জন্য জেলের বাহিরে চারিটি হাসপাতাল; সেগুলি বাঙালী Asst. Surgeonএর তত্ত্বাবধানে বলিয়া চীফ কমিশনার কর্ণেল ব্রাউনিং আদেশ দিলেন যে, আমাদের অসুখ হইলে আমরা সে সমস্ত হাসপাতালে যাইতে পারিব না; আমাদিগকে জেলে ফিরিয়া আসিতে হইবে। জ্বরে ঝুঁকিতে ঝুঁকিতে বিছানা ও থালা, বাটী ঘাড়ে করিয়া পাঁচসাত-দশ মাইল হাঁটিয়া আসা বড় সুবিধার কথা নয়। আর জেলে আসিয়াই বা সুচিকিৎসা কোথায়? হাসপাতাল সংলগ্ন কতকগুলি ছোট ছোট কুঠরীর মধ্যে আমাদের দিনে প্রায় একুশ ঘণ্টা পড়িয়া থাকিতে হইত; আর সেই কুঠরীর মধ্যেই একটি গামলায় মল-মুত্র ত্যাগের বন্দোবস্ত। বৃষ্টির সময় পিছন-দিকের ঘুলঘুলি দিয়া জলের ছাট আসিবার বেশ সুব্যবস্থা আছে কিন্তু কুঠুরীতে বিশুদ্ধ বায়ু সঞ্চালনের তেমন উপায় নাই। ১৯২০ সালে জানুয়ারী মাসে যে জেল কমিশন পোর্টব্লেয়ার পরিদর্শন করিতে যান, তাঁহারা এই কুঠরীগুলির বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিয়া এগুলির সংস্কার করিতে বলেন।
এত দিন আমরা ভাবিয়াছিলাম যে, বুঝি জেলের বাহির হইতে পারিলেই আমাদের দুঃখ কতকটা ঘুচিবে; কিন্তু সে আশা এবার নির্মূল হইল। আমাদের জন্য জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ; সাধারণ কয়েদী ক্রমে ওয়ার্ডার, পেটি অফিসার বা লেখাপড়া জানিলে মুসি হইয়া কঠোর কর্ম হইতে অব্যাহতি পায়; কিন্তু আমাদের সে পথও বন্ধ।
এক এক করিয়া প্রায় সকলেই ক্রমে বাহিরের কাজ করিতে অস্বীকৃত হইয়া জেলে ফিরিয়া আসিলেন।
এই সময় একটি শোচনীয় ঘটনা ঘটিল। ইন্দুভূষণ উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করিল। তাহার বলিষ্ঠ শরীর কঠোর পরিশ্রমেও কখন কাতর হয় নাই; কিন্তু জেলখানার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপমানে সে যেন দিন দিনই অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিল; মাঝে মাঝে বলিত—’জীবনের দশটা বৎসর এই নরকে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।’ একদিন রাত্রে সে নিজের জামা ছিঁড়িয়া দড়ি পাকাইয়া পিছনের ঘুলঘুলিতে লাগাইয়া ফাঁসি খাইল। রাত্রেই জেলের সুপারিনটেনডেন্টকে টেলিফোন করা হইল, কিন্তু পরদিন বেলা ৮টা পর্যন্ত তাঁহার দেখা মিলিল না। সে দিন রাত্রে জেলারের সহিত যে সমস্ত প্রহরী ইন্দুভূষণের কুঠরীতে ঢুকিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে অনেকে বলিল, যে, তাহার গলায় হাঁসুলিতে ( neck ticket ) একখণ্ড লেখা কাগজ বাঁধা ছিল। সত্যমিথ্যা ভগবান জানেন, কিন্তু সে কাগজের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। পরে আমরা জেলার সাহেবকে ঐ কাগজের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তিনি তাহার অস্তিত অস্বীকার করেন। পরে ইন্দুভূষণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাহার মৃত্যু সম্বন্ধে তদন্ত করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টের নিকট আবেদন করিলে পোর্টব্লেয়ারের ডেপুটী কমিশনারের উপর ঐ ভার অর্পিত হয়। ফলে কিন্তু কিছুই হইল না। ব্যাপারটা হ-য-ব-র-ল হইয়া চাপা পড়িয়া গেল।
এই সময়ে অনেকেই কাজের তাড়ায় বাহির হইতে ভিতরে চলিয়া আসিতে লাগিলেন। উল্লাসকরও তাহাই করিলেন। তাঁহাকে রৌদ্রে ইট তৈয়ার করিতে দেওয়া হইয়াছিল। সেখান-কার হাসপাতালের যিনি Junior Medical Officer তিনি বলিলেন যে উল্লাসকরের রৌদ্রে কাজ করা সহ্য হইবে না। কিন্তু বাঙালী ডাক্তারের কথা গোরা Overseer সাহেব গ্রাহ্য করিবেন কেন? উল্লাসকরকে সেই কার্যেই বহাল রাখা হইল। ফলে তিনি কাজ করিতে অস্বীকৃত হইয়া পুনরায় জেলে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন যে, শুধু পীড়নের ভয়ে কাজ করিতে হইলে মনুষ্যত্ব সঙ্কুচিত হইয়া যায়; সাজার ভয়ে কাজ করিতে তিনি রাজী নহেন। তাঁহার সাত দিন দাঁড়া হাতকড়ির ব্যবস্থা হইল। কিন্তু সাত দিন আর পূর্ণ হইল না। প্রথম দিনই বেলা ৪টার সময় হাতকড়ি খুলিতে গিয়া পেটি অফিসার দেখিল যে, উল্লাসকর জ্বরে অজ্ঞান হইয়া হাতকড়িতে ঝুলিতেছে। তখনই তাঁহাকে হাসপাতালে পাঠান হইল। রাত্রে শরীরের উত্তাপ ১০৬ ডিগ্রী পর্যন্ত চড়ে। প্রাতঃকালে দেখা গেল যে জ্বর ছাড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু উল্লাসকর আর সে উল্লাসকর নাই। আসন্ন বিপদের মধ্যেও যিনি চিরদিন নির্বিকার, তীব্র যন্ত্রণায় যাঁহার মুখ হইতে কখনও হাসির রেখা মুছে নাই, তিনি আজ উন্মাদরোগগ্রস্ত।
জেলখানার প্রকৃত মূর্তি যেন সেই দিন আমাদের চক্ষে ফুটিয়া উঠিল। বাঁচিয়া দেশে ফিরিবার ত আর আমাদের কোনও আশা নাই—কেহ ফাঁসি খাইয়া মরিবে, কেহ বা পাগল হইয়া মরিবে। আর যদি মরিতেই হয় তবে আর স্বহস্তে এই যন্ত্রণার বোঝা উঠান কেন? প্রায় সকলেই স্থির করিলেন যে, যত দিন আমাদের জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা করা না হয় তত দিন কাজ কর্ম করা হইবে না। এদিকে আমরা ultimatum দিয়া তাল ঠুকিয়া মরিয়া হইয়া রহিলাম, ওদিকে কর্তৃপক্ষও তাঁহাদের তূণ হইতে চোখা চোখা বাণ হানিতে আরম্ভ করিলেন।
বেশ একচোট গজকচ্ছপের যুদ্ধ বাধিয়া গেল। ইহার কিছু পুর্বে চুঁচুড়ার ননীগোপাল ও ঢাকার পুলিনবাবু প্রভৃতি তিন চার জন আসিয়া পৌঁছিলেন! ননীগোপাল ছেলেমানুষ হইলেও তাহাকে ঘানি প্রভৃতি কঠোর কর্ম দেওয়া হয়। সেও বাধ্য হইয়া ধর্মঘটে যোগ দিল। অন্য সকল কয়েদী হইতে পৃথক করিয়া আমাদের এক আলাদা ব্লকে বন্ধ রাখিয়া কর্তৃপক্ষ আমাদের উপর বাছা বাছা পাঠান প্রহরী নিযুক্ত করিলেন। খাদ্যের পরিমাণ আরও কমাইয়া দেওয়া হইল, এবং যাহাতে আমরা পরস্পরের সহিত কোনরূপ কথাবার্তা চালাইতে না পারি সে বিষয়েও সতর্কতার অভাব রহিল না। পায়খানায় গিয়া পাছে কথা কহি সে জন্য সম্মুখে প্রহরী খাড়া থাকিত। কিন্তু বাঁধন বেশী শক্ত করিতে গেলে অনেক সময় ছিঁড়িয়া যায়; আর আইনের প্রতি যাহাদের ভক্তি নাই, শুধু ভয় দেখাইয়া তাহাদের আইন মানাইবার চেষ্টা বিড়ম্বনা মাত্র।
আমরা প্রধানতঃ তিনটা জিনিষ চাহিলাম— ভাল খাওয়া-পরা, পরিশ্রম হইতে অব্যাহতি ও পরস্পরের সহিত মেলামেশার সুবিধা।
মধ্যে চার পাঁচ কুঠরী ব্যবধান রাখিয়া এক এক জনকে বন্ধ করা হইল। ফলে কথাবার্তা আগে আস্তে আস্তে হইতেছিল, এখন চীৎকার করিয়া চলিতে লাগিল। হাতকড়িতে ঝুলাইয়া রাখিলেও মানুষের মুখ ত আর বন্ধ করা যায় না। কর্তৃপক্ষের অবস্থা যেন সাপে ছুঁচো ধরা গোছ হইয়া দাঁড়াইল। সুনাম বা prestigeএর খাতিরে আমাদের আবদার শুনাও চলে না, আর এদিকে ধর্মঘটও ভাঙ্গে না। এমন সময়ে আমাদের নূতন সুপারিনটেনডেন্ট বদলি হইয়। পুরাতন সুপারিনটেনডেন্ট ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার পরামর্শে চীফ কমিশনার আমাদের জন কয়েককে সহজ কাজ দিয়া জেলের বাহিরে পাঠাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিলেন। আমরা বলিলাম যে, সকলকে যদি জেলের বাহিরে পাঠান হয় তাহা হইলে আমরা বাহিরে কাজ করিতে স্বীকৃত হইব, নচেৎ পুনরায় জেলে ফিরিয়া আসিব।
প্রায় দশ বারো জনকে নারিকেল গাছের পাহারাওয়ালা করিয়া বাহিরে পাঠান হইল। নারিকেল গাছ সরকারী সম্পত্তি, তাহা হইতে নারিকেল না চুরি যায় ইহা দেখাই পাহারাওয়ালার কাজ। কাজ খুব সহজ, কিন্তু সকলকেই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রাখা হইল, পাছে পরস্পর দেখা শুনা হয়।
জেলখানায় কিন্তু ধর্মঘট চলিতে লাগিল। নন্দগোপাল ও ননীগোপালকে কিছুদিন পরে Viper দ্বীপে একটা ছোট জেলে বদলি করা হইল। সেখানে গিয়া ননীগোপাল আহার ত্যাগ করিল। জেল হইতে সকলকে বাহিরে পাঠাইবার যে কথা ছিল, তাহা আর কার্যে পরিণত হইল না।
এদিকে যাঁহাদিগকে জেলের বাহিরে কাজ করিতে পাঠান হইয়াছিল, তাঁহারাও একজোটে কর্মত্যাগ করিলেন। পরস্পরের ঠিকানার সন্ধান লইয়া ধর্মঘটের আয়োজন করিতে প্রায় এক মাস অতিবাহিত হইল। তিন মাসের সাজা লইয়া তাঁহারা যখন জেলে ফিরিয়া আসিলেন, তখন দেখা গেল যে, জেলখানার ধর্মঘট প্রায় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। নিরাশ হইয়া অধিকাংশ লোকেই কাজ করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। ননীগোপালকে চার দিন অনশনের পর জেলে ফিরাইয়া আনা হইল; নাকে রবারের নল পুরিয়া তাহার অল্প অল্প দুগ্ধপানের ব্যবস্থা করা হইল, পাছে সে মরিয়া গিয়া কর্তৃপক্ষের বদনাম করে। সেবারকার ধর্মঘটের কর্মভোগের বোঝা ননীগোপাল, বীরেন প্রভৃতি দুই তিনটী ছেলেকেই বহিতে হয়। সাজার পর সাজা খাইয়া বিফলমনোরথ হইয়া একে একে সকলেই ধর্মঘট ছাড়িল; শেষে একা ননীগোপাল যেন মরণ পণ করিয়া বসিল।
দিনের পর দিন কাটিয়া গেল, ননীগোপাল কঙ্কালের মত শীর্ণ হইয়া পড়িল, কিন্তু আপনার গোঁ ছাড়িল না। যখন সে দেড় মাসের অধিককাল অনশনক্লিষ্ট, তখনও তাহাকে দাড় করাইয়া হাতকড়িতে ঝুলাইয়া রাখিতে কর্তৃপক্ষের সঙ্কোচ বোধ হয় নাই। ফলে দেখিতে দেখিতে আবার Hunger strike ছড়াইয়া পড়িল এবং কর্তৃপক্ষের শত সাবধানতা সত্ত্বেও ইন্দুভূষণ, উল্লাসকর, ননীগোপালের কথা দেশের কানে আসিয়া পৌঁছিল। সংবাদপত্রে সে বিষয় আলোচনার ফলে গবর্ণমেণ্ট ডাক্তার Lukis সাহেবকে তদন্তের জন্য পোর্টব্লেয়ারে পাঠান। Lukis সাহেবের রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই, কিন্তু তাঁহার রিপোর্টের ফলে উল্লাসকরকে মাদ্রাজের পাগলা গারদে পাঠাইয়া দেওয়া হয় এবং অপর সকলেও অল্পদিনের জন্য একটু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে।
ননীগোপালকেও অনেক বুঝাইয়া সুঝাইয়া তাহার বন্ধু-বান্ধবেরা আহার করিতে স্বীকৃত করান এবং ইহার অল্পদিন পরেই যাঁহারা তিন মাসের সাজা লইয়া জেলখানায় আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের সময় উত্তীর্ণ হওয়ায় তাঁহাদিগকে আবার জেলের বাহিরে পাঠাইয়া দেওয়া হইল।
ধর্মঘটের প্রথম পর্ব এইখানেই সমাপ্ত হইল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন