সাধু চলিয়া যাইবার পর আবার ভাঙ্গা মন জোড়া দিয়া কাজ কর্মে লাগিয়া গেলাম। আমরা তখন স্থির করিয়াছিলাম যে, দেশময় নিজেদের কেন্দ্র স্থাপন করিয়া দেশের শক্তি বেশ সংহত করিয়া তাহার পর বিপ্লবের কার্য আরম্ভ করিয়া দিব। কিন্তু দেশের লোকের মাথায় তখন খুন চাপিয়াছে। সুদূর আদর্শের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া নীরবে সমস্ত লজ্জা, অপমান, নির্যাতন সহ্য করা যে কত কঠোর সাধনা সাপেক্ষ তাহা ভুক্তভোগী ভিন্ন কেহ বুঝিবে না। দেশের সে শিক্ষা তখনও হয় নাই,—এখনও হইয়াছে কি?
অর্থ সংগ্রহ করা ক্রমে বিষম দায় হইয়া উঠিল। কাজ বাড়িতেছে; ছেলের সংখ্যাও বাড়িতেছে—কিন্তু টাকা কোথায়? এক আধ জন ধনবান কাপ্তেন না পাকড়াইলে ত আর কাজ চলে না! · কিন্তু তাহাদের তুষ্ট করিতে গেলে এক আধটা বড় লাট বা ক্ষুদে লাটের ঘাড়ে বোমা ফেলিতে হয়!
যাতায়াতের ব্যয় সঙ্কোচ করিবার জন্য বোমার আড্ডা দেওঘর হইতে কলিকাতায় উঠাইয়া আনা হইল। সেখানে যাহাতে লোকের গতিবিধি কম হয় ও পুলিসের নজর না পড়ে সেই জন্য ভবানীপুরে আর একটি বাড়িতে পুরাতন ছেলেদের রাখিয়া দিবার ব্যবস্থা করা হইল। বাগানে রহিল প্রধানতঃ নূতন ছেলেরা।
কিন্তু শত চেষ্টায়ও পুলিসের দৃষ্টি আমরা এড়াইতে পারিলাম না।
পুলিশ যে আমাদের সন্দেহ করিয়াছে একথা মনে করিবার নানা কারণ ঘটিতে লাগিল। দেখিলাম বাগানের আশে-পাশে রকম বেরকমের অজানা লোক ঘুরিতেছে। রাস্তা চলিবার সময়ও দুই একজন পিছে পিছে চলিয়াছে! একদিন চলিতে চলিতে হঠাৎ পিছন ফিরিয়া দেখিলাম, একজোড়া প্রকাণ্ড গোঁফের উপর হইতে দুইটা গোল গোল চোখ আমার দিকে প্যাট প্যাট করিয়া চাহিয়া আছে। যেদিকে যাই, চোখ দুইটা আমার পিছে পিছে ছুটিতে লাগিল। শেষে ভিড়ের মধ্যে মিশিয়া গিয়া সেদিন কোনরূপে সে শনির দৃষ্টি হইতে নিষ্কৃতি পাইলাম।
মানিকতলার সব-ইনস্পেক্টর বাবুও মাঝে মাঝে বাগানে আসিয়া আমাদের সহিত আলাপ করিয়া যাইতেন, কিন্তু আমরা তাঁহাকে বৃথাই সন্দেহ করিতাম। তিনি বাগানটীকে শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মচারীর আশ্রম বলিয়াই জানিতেন।
এই রকমে আরও একটা মাস কাটিল। শেষে মোজাফরপুরে বোমা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গেই বাগানের পরমায়ু ফুরাইল!
***
সেদিনের কথা আমার চিরকালই মনে থাকিবে। একে বৈশাখ মাস, দারুণ রৌদ্র। তাহার উপর সমস্ত দিন টো টো করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া যখন সন্ধ্যার পর বাগানে ফিরিয়া আসিলাম, তখন হাত পা এবং পেট সকলেই সমস্বরে আমাকে বাপান্ত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। স্বয়ং যমরাজ যদি তাঁহার মহিষটীর স্কন্ধে চড়িয়া আমাকে তখন তাড়া করিয়া আসিতেন, তাহা হইলেও আমি এক পা নড়িয়া বসিতাম কিনা সন্দেহ। সকলেরই প্রায় ঐ এক দশা। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা; দুটী রাঁধিয়া না খাইলে নয়। আমাদের ত আর রাঁধুনী বা চাকর ছিল না যে, ঘুরিয়া আসিয়া বাড়া ভাতের থালে বসিয়া যাইব। ভাত রাঁধা, কাপড় কাচা, ঘর ঝাঁট দেওয়া সবই আমাদের নিজের হাতে করিতে হইত। ছেলেরা তাড়াতাড়ি রাখিতে বসিয়া গেল, আর আমরা কল্পনার রথে চড়িয়া ভারত উদ্ধার করিতে বাহির হইলাম। কিন্তু সেদিন আমাদের উপর শনির এমন খরদৃষ্টি যে, ভাত নামাইবার সময় হাঁড়ি ফাঁসিয়া সব ভাত মাটিতে পড়িয়া গেল। ছেলেরা হোঃ হোঃ করিয়া হাসিয়া উঠিল। আমি বুঝিলাম, সে দিন মা লক্ষ্মী আর অদৃষ্টে অন্ন লেখেন নাই। পেটে তিনটা কিল মারিয়া উপুড় হইয়া ছুইয়া পড়িলাম। কিন্তু বারীন্দ্র চিরদিনই উদ্যোগী পুরুষ; দমিবার পাত্র নয়; সে সেই রাত দশটার সময় জ্বালানী কাঠের অভাবে খবরের কাগজ জ্বালাইয়া ভাত রাঁধিতে গেল! রাত এগারটার সময় ভাত খাইতে বসিতেছি এমন সময় আমাদের এক বন্ধু কলিকাতা হইতে নাচিতে নাচিতে উপস্থিত। কি সংবাদ? তিনি ভাল লোকের কাছে খবর শুনিয়া আসিয়াছেন যে, বাগানে শীঘ্রই পুলিসের খানাতল্লাস হইবে; সুতরাং আমাদের বাগান ছাড়িয়া অন্যত্র চলিয়া যাওয়া উচিত। তথাস্তু; কিন্তু এ রাতে ত ঠ্যাং ধরিয়া টানিয়া বাহির না করিলে কেহ বাগান ছাড়িতে রাজী হইবে না। স্পুতরাং স্থির হইল যে কাল সকালেই সকলে আপন আপন পথ দেখিবে। বারীন্দ্র কিন্তু কয়েকজন ছেলেকে লইয়া সেই রাত্রেই কোদাল ঘাড়ে করিয়া যে দুই চারটা রাইফেল ও রিভলবার বাহিরে পড়িয়াছিল সেগুলাকে মাটীর তলায় পুঁতিয়া রাখিয়া আসিল। আমাদের শুইতে রাত বারোটা: বাজিয়া গেল।
***
রাত্রি যখন প্রায় চারটা, তখনও কতকটা গ্রীষ্মের জ্বালায়, কতকটা মশার কামড়ে শুইয়া শুইয়া ছটফট করিতেছি। এমন সময় শুনিলাম যে কতকগুলা লোক মস্ করিয়া সিঁড়িতে উঠিতেছে; আর তাহার একটু পরেই দরজায় ঘা পড়িল— গুম্ গুম্ গুম্। বারীন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিতেই একটা অপরিচিত ইউরোপীয় কণ্ঠে প্রশ্ন হইল; —
“Your name?”
“Barindra Kumar Ghose”
হুকুম হইল—“বাঁধো ইসকো।”
বুঝিলাম, ভারত উদ্ধারের প্রথম পর্ব এইখানেই সমাপ্ত। তবুও মানুষের যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। পুলিশ প্রহরীরা ঘরে ঢুকিয়া যাহাকে পাইতেছে তাহাকেই ধরিতেছে, কিন্তু ঘর তখনও অন্ধকার। ভাবিলাম — Now or never. আর এক দরজা দিয়া বারান্দায় বাহির হইয়া দেখিলাম, চারিদিকে আলো জ্বালিয়া পুলিস প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে। রান্নাঘরের একটা ভাঙ্গা জানালা দিয়া বাহিরে লাফাইয়। পড়া যায়; সেখানে গিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম নীচে দুইজন পুলিস প্রহরী। হায়রে! অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়! অগত্যা বারান্দার পাশে একটা ছোট ঘর ছিল, তাহারই মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। ঘরটা ভাঙ্গাচুরা কাঠ কাঠরায় পরিপুর্ণ; আরসুলা ও ইন্দুর ভিন্ন অপর কেহ সেখানে বাস করিত না। চাহিয়া দেখিলাম, একটা জানালার সম্মুখে একখানা জরাজীর্ণ চটের পরদা ঝুলিতেছে। তাহারই আড়ালে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া জানলার ফাক দিয়া পুলিস গ্রহরীদিগের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। সে রাতটুকু যেন আর কাটে না।
ক্রমে কাক ডাকিল : কোকিলও এক আধটা বোধ হয় ডাকিয়াছিল। পূর্বদিক একটু পরিষ্কার হইলে দেখিলাম বাগান লাল পাগড়ীতে ভরিয়া গিয়াছে। কতকগুলো গোরা সার্জেন্ট হাতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চাবুক লইয়া ঘুরিতেছে। পাড়ার যে কয়জন কোচম্যান জাতীয় জীবকে খানাতল্লাসীর সাক্ষী হইবার জন্য পুলিসের কর্তারা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন তাহারা এক বিপুলকায় ইন্সপেক্টর সাহেবের পশ্চাৎ ‘হুজুর, হুজুর’ করিতে করিতে ছুটিতেছে। পুকুর ঘাটের একটা প্রকাণ্ড আমগাছের তলায় আমাদের হাতবাঁধা ছেলেগুলা জোড়া জোড়া বসিয়া আছে; আর উল্লাসকর তাহাদের মধ্যে বসিয়া ইন্সপেক্টর সাহেবের ওজন তিন মণ কি সাড়ে তিন মণ এই সম্বন্ধে গবেষণা-পূর্ণ বিচার আরম্ভ করিয়া দিয়াছে।
ক্রমে ছয়টা বাজিল, সাতটা বাজিল; আমি তখনও পর্দা-নসিন বিবিটির মত পর্দার আড়ালে। ভাবিলাম, এ যাত্রা বুঝি কর্তারা আমাকে ভুলিয়া যায়! কিন্তু সে বৃথা আশা বড় অধিক ক্ষণ পোষণ করিতে হইল না। আমাদের অতিকায় ইন্সপেক্টর সাহেব জুতার শব্দে পাশের ঘর কাঁপাইতে কাপাইতে আসিয়া আমার ঘরের দরজা খুলিয়া ফেলিলেন। পাছে নিশ্বাসের শব্দ হয় সেই ভয়ে আমি নাক টিপিয়া ধরিলাম কিন্তু বলিহারী পুলিসের ঘ্রাণশক্তি! সাহেব সোজা আসিয়া আমার লজ্জা-নিবারণী পর্দাখানি একটানে সরাইয়া দিলেন। তারপরেই চারিচক্ষের মিলন—কি স্নিগ্ধ! কি মধুর! কি প্রেমময়! সাহেব ত দিগ্বিজয়ী বীরের মত উল্লাসে এক বিরাট “Hurrah” ধ্বনি করিয়া ফেলিলেন। সেই ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চার পাঁচজন পার্ষদ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। কেহ ধরিল আমার পা, কেহ ধরিল হাড়, কেহ ধরিল মাথা। তাহার পর কাঁধে তুলিয়া হুশূধ্বনি করিতে করিতে আমাকে একেবারে হাতবাঁধা ছেলের দলের মাঝখানে বসাইয়া দিল। আমার হাত বাঁধিবার হুকুম হইল। যে পুলিস প্রহরী আমার হাত বাঁধিতে আসিল— হরি! হরি! সে যে আমাদের ‘বন্দেমাতরম্’ আফিসের ভূতপূর্ব বেহারা! কতকাল সে আমাকে বাবু বলিয়া সেলাম করিয়া চা খাওয়াইয়াছে। আজ আমার হাত বাঁধিতে আসিয়া সে বেচারীও লজ্জায় মুখ ফিরাইল।
এদিকে খানাতল্লাসী করিতে করিতে গত রাত্রের পোঁতা, রাইফেল ও বোমাগুলি বাহির হইয়া পড়িল। আর কোনও জিনিস কোথাও পোঁতা আছে কি না জানিবার জন্য পুলিস ছেলেদের উপর উৎপীড়ন আরম্ভ করিতেছে দেখিয়া বারীন্দ্র ইন্সপেক্টর জেনারেল প্লাউডেন সাহেবের নিকট নালিস করে। সাহেব হাসিয়া সে কথা উড়াইয়া দেন। বলেন — “You must not expect too much from us” “আমাদের নিকট হইতে বড় বেশী কিছু আশা করিও না।”
সেদিন ভিন্ন ভিন্ন থানায় লইয়া গিয়া আমাদিগকে আবদ্ধ রাখা হইল। অদৃষ্টে তিনখানা পুরী ভিন্ন আর কিছু জুটিল না। পরদিন প্রাতঃকালে সি-আই-ডি পুলিস আফিসে গিয়া শুনিলাম যে, বাগান ভিন্ন আরও দুই তিন স্থানে তল্লাসী করা হইয়াছে এবং আমাদের সহিত সংশ্রব ছিল না এরূপ অনেক লোকও ধৃত হইয়াছেন। ডেপুটী সুপারিন্টেণ্ডেন্ট রামসদয় বাবু আমাদিগকে দিদিশাশুড়ীর মত আদর যত্ন করিয়া তুলিয়া লইলেন। তাঁহার হাতে বাঁধা একটা প্রকাণ্ড ঢোলকের মত মাদুলী বাহির করিয়া বলিলেন যে, তিনি খ্যাতনামা সাধক কমলাকান্তের বংশধর; আর ঐ মাদুলীর মধ্যে কমলাকান্তের সর্ববিঘ্নবিনাশন পদধূলি বিদ্যমান। আমাদের মাথায় সেই মাদুলীটি ঠেকাইয়া আশীর্বাদ করিয়া কখনও হাসিয়া কখনও বা কাঁদিয়া কমলাকান্তের বংশধরটি আমাদের বুঝাইয়া দিলেন যে, তাঁহার মত সুহৃদ আমাদের আর ত্রিভুবনে নাই। তিনি নাকি আমাদের কাজকর্মের সহিত গভীর সহানুভূতিসম্পন্ন! তবে কি করেন, পেটের দায়-ইত্যাদি। বাগবাজারের আর একজন ইন্সপেক্টর বাবু অশ্রুনীরে গণ্ড প্লাবিত করিয়া আধ আধ স্বরে আমাদের জানাইয়া দিলেন যে, আমাদের ধরিয়া তিনি যে কসাইবৃত্তি করিয়াছেন তাহার জন্য তিনি মর্মে মর্মে পীড়িত! বলা বাহুল্য আমাদের নিকট হইতে স্বীকারোক্তি ( Confession ) বাহির করাই এ সমস্ত অভিনয়ের উদ্দেশ্য। আইন কানুন সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা যেরূপ প্রচণ্ড তাহাতে আমাদিগকে বধ করিতে তাঁহাদের বড় অধিক বেগ পাইতে হইল না। উল্লাস বলিল যে, যে সমস্ত বাহিরের লোক বিনা কারণে আমাদের সঙ্গে ধরা পড়িয়াছে তাহাদের বাঁচাইবার জন্য আমাদের সব সত্য বলা দরকার। উল্লাসের ধারণা সত্যকথা বলিলেই ধর্মাত্মা পুলিস কর্মচারীরা তাহা বিশ্বাস করিয়া বেচারাদের ছাড়িয়া দিবে। বারীন্দ্র বলিল—“আমাদের দফা ত এইখানেই রফা হইল, এখন আমরা যে কি করিতেছিলাম তাহা দেশের লোককে বলিয়া যাওয়া দরকার।” এই সমস্ত কথা লইয়া বিচার বিতর্ক চলিতেছে, এমন সময় রায় বাহাদুর রামসদয় একখণ্ড হাতেলেখা কাগজ লইয়া ঘরে ঢুকিলেন। মহা উৎসাহে বলিলেন— “এই দেখ বাবা, হেমচন্দ্রের Statement; সে সব কথাই স্বীকার করেছে।” বলা বাহুল্য, কথাটা সর্বৈব মিথ্যা; হেমচন্দ্রের বলিয়া যে Statementটা তিনি আমাদের শুনাইলেন তাহা একেবারেই তাঁহার মনগড়া। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির অবস্থা তখন এমনই শোচনীয় যে, সমস্ত ব্যাপারটা যে আমাদের নিকট হইতে স্বীকারোক্তি বাহির করিবার জন্য অভিনয়মাত্র, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমরা দুই একটা ঘটনা সম্বন্ধে আমাদের দায়িত্ব স্বীকার করিয়া সে রাত্রের জন্ম নিষ্কৃতি পাইলাম।
পরদিন দুপুর বেলা যখন আমাদের লালবাজার পুলিস কোর্টে হাজির করা হইল তখন ধর-পাকড়ের উত্তেজনা অনেকটা কমিয়া গিয়াছে; ছেলেদের মধ্যে অনেকেরই মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। একটি ছেলে কাছে আসিয়া বলিল—“দাদা, পেটের জ্বালাতেই মরে গেলুম! কাল সমস্ত দিন পেটে ভাত পড়েনি। হুপুর বেলা শুধু ছটি মুড়ি খেতে দিয়েছিল।” বারীন্দ্র লাফাইয়া উঠিল। কাছেই ইন্সপেক্টর বিনোদ গুপ্ত দাঁড়াইয়া ছিলেন; তাঁহাকে বলিল—“বাপু আমাদের ফাঁসি মাসি যা কিছু দিতে হয় দাও; ছেলেগুলোকে এমন ক’রে দগ্ধাচ্ছ কেন?” বিনোদ গুপ্ত. তাড়াতাড়ি—“এই, ইয়া ল্যাও, উয়া ল্যাও” করিয়া একটি সাবইন্সপেক্টর বাবুর উপর খাবার আনিবার জন্য হুকুম চালাইলেন; সাবইন্সপেক্টর বাবুটি হেড কন্সটেবল ও হেড কন্সটেবলটির একজন অভাগা কন্সটেবলের উপর হুকুম হাজির করিয়া সরিয়া পড়িলেন। ফলে পুনঃ পুনঃ তাগাদায় এক গ্লাস জল ভিন্ন আর কিছু আসিয়া পৌঁছিল না। বিনোদ গুপ্তকে সে কথা জানাইলে তিনি একজন কাল্পনিক কন্সটেবলের উপর ভাঁটার মত চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া অজস্র গালিবর্ষণ করিতে করিতে কোথায় যে অন্তর্হিত হইলেন তাহা আমরা খুঁজিয়াও পাইলাম না।
পুলিস-কোর্টের লীলা সাঙ্গ হইবার পর আমাদের গাড়ীতে পুরিয়া আলিপুরের ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে হাজির করা হইল। ম্যায়তঃ ধৰ্ম্মতঃ আমি স্বীকার করিতে বাধ্য যে রাস্তায় পুলিস কর্মচারীরা আমাদের দুই খানা করিয়া কচুরী ও একটা করিয়া সিঙ্গাড়া খাইতে দিয়াছিলেন, এমন কি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের কাছে Statement করিবার সময় গলা যাহাতে না শুকাইয়া যায় সেইজন্য কাহাকে কাহাকেও এক এক গ্লাস জল পর্যন্ত দিয়াছিলেন। তবে সেটা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট ধমক খাইবার পর।
কোর্টে গিয়া দেখিলাম ম্যাজিষ্ট্রেট বার্লি (Birley) সাহেব বিকট বদনে উঁচু তক্তের উপর বসিয়া আছেন। মুখখানি যেন সাদা মার্বেল পাথর দিয়া বাঁধান। দেখিলে মনে হয় যেন একটি মূর্তিমান শাসনযন্ত্র। তিনি আমাদের Statementগুলি লিখিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“তোমরা কি মনে কর তোমরা ভারতবর্ষ শাসন করিতে পার?”
কথাটা শুনিয়া এত দুঃখের মধ্যেও একটু হাসি আসিল। “জিজ্ঞাসা করিলাম—“সাহেব, দেড়শ বছর পূর্বে কি তোমরা ভারত শাসন করিতে? না, তোমাদের দেশ হইতে আমরা শাসনকর্তা ধার করিয়া আনিতাম?”
সাহেবের বোধ হয় উত্তরটা তত ভাল লাগিল না। তিনি খবরের কাগজের সংবাদদাতাদের বারণ করিয়া দিলেন যে, আমাদের সহিত তাঁহার এ সমস্ত কথাবার্তাগুলা যেন ছাপা না হয়।
কোর্ট হইতে গাড়ীবন্ধ হইয়া যখন আলিপুর জেলের দরজার কাছে হাজির হইলাম, তখন সন্ধ্যা। জেল তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে; অন্নব্যঞ্জনও প্রায় ফুরাইয়া গিয়াছে। কিন্তু জেলার বাবু কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়া এক এক মুঠা ভাত ও একটু করিয়া ডাল আমাদের খাইতে দিলেন। প্রায় দুই দিন অনাহারের পর সেই এক মুঠা ভাতই যেন অমৃত বলিয়া মনে হইল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন