মানিকতলার বাগানে যখন আশ্রমের সূত্রপাত হইল তখন সেখানে চার পাঁচ জনের অধিক ছেলে ছিল না। হাতে একটিও পয়সা নাই, ছেলেরা সকলেই বাড়ি ঘর ছাড়িয়া আসিয়াছে, সুতরাং তাহাদের মা বাপদের কাছ থেকেও কিছু পাইবার সম্ভাবনা নাই। অথচ ছেলেদের আর কিছু জুটুক আর নাই জুটুক, দুবেলা দু’মুঠো ভাত ত চাই? দু’ একজন বন্ধু মাসিক কিছু কিছু সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন, আর স্থির হইল যে, বাগানে শাকসব্জীর ক্ষেত করিয়া বাকী খরচটা উঠাইয়া লওয়া হইবে। বাগানে আম, জাম, কাঁঠালের গাছও যথেষ্ট ছিল। সেগুলা জমা দিয়াও কোন্ না দু-দশ টাকা পাওয়া যাইবে? আর আমাদের খাইতেও বেশী খরচ নয়—ভাতের উপর ডাল আর একটা তরকারী, অধিকাংশ দিনই আবার ডালের মধ্যেই চারিটা আলু ফেলিয়া দিয়া তরকারির অভাব পুরাইয়া লওয়া হইত। সময়াভাব হইলে খিচুড়ির ব্যবস্থা। একটা মস্ত সুবিধা হইল এই যে, বারীন তখন ঘোরতর ব্রহ্মচারী। মাছের আঁশ বা পেঁয়াজের খোসাটি পর্যন্ত বাগানে ঢুকিবার হুকুম নাই; লঙ্কা একেবারেই নিষিদ্ধ। সুতরাং খরচ কতকটা কমিয়া গেল।
উপার্জনের আরও একটা পথ বারীন্দ্র আবিষ্কার করিয়া ফেলিল— হাঁস ও মুরগী রাখা! কতকগুলো হাঁস ও মুরগী কেনাও হইয়াছিল কিন্তু দেখা গেল যে, তাহাদের ডিম ত পাওয়াই যায় না, অধিকন্তু তাহাদের সংখ্যা দিন দিন কমিতেছে। কতক শেয়ালে খায়, কতক বা লোকে চুরি করে। অধিকন্তু আমাদের পাড়াপড়শীদের আমাদের বাগানে মুরগী রাখা সম্বন্ধে বিষম আপত্তি। একদিন একজন হাড়ি তাড়ি খাইয়া আসিয়া হিন্দুধর্মের পক্ষ হইতে দুই ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়া মুরগী পালনের যে রকম ভীষণ প্রতিবাদ করিয়া গেল, তাহাতে তাড়াতাড়ি মুরগী কয়টাকে বেচিয়া ফেলা ছাড়া আর আমাদের উপায়ান্তর রহিল না। হাড়ি বাবুটির নাম ভুলিয়া গিয়াছি। তা’ না হইলে ব্রাহ্মণ-সভায় লিখিয়া তাঁহাকে একটা উপাধি যোগাড় করিয়া দিতাম।
আমাদের বাজে খরচের মধ্যে ছিল চা। ওটা না থাকিলে সংসার নিতান্তই ফিকে ফিকে, অনিত্য বলিয়া মনে হইত। বিশেষতঃ বারীন চা বানাইতে সিদ্ধহস্ত। তাহার হাতের গোলাপী চা, ভাঙ্গা নারিকেলের মালায় ঢালিয়া চক্ষু বুজিয়া তারিফ করিতে করিতে খাইবার সময় মনে হইত যে, ভারত উদ্ধারের যে কয়টা দিন বাকী আছে, সে কয়টা দিন যেন চা খাইয়াই কাটাইয়া দিতে পারা যায়।
প্রথম দিনেই বারীন আইন জাহির করিয়া দিল যে, নিজে রাঁধিয়া খাইতে হইবে। এক আধ জন ত রাঁধিবার ভয়ে বাগান ছাড়িয়া পলাইয়া গেল! কিন্তু তা বলিয়া বাগানের ভিতর ত আর বাহিরের লোককে ঢুকিতে দেওয়া যায় না–বিশেষতঃ পয়সার অভাব। কিন্তু চিরদিন বাড়িতে মায়ের হাতের আর মেসে ঠাকুরের হাতের রান্না খাইয়া আসিয়াছি। সাধুগিরির সময় ভিক্ষা করিয়া যা খাইয়াছি তাও পরের হাতের রান্না। আজ এ আবার কি বিপদ! পালা করিয়া প্রত্যহ দুই জনের উপর রান্নার ভার পড়িল। সুতরাং আমাকেও মাঝে মাঝে রন্ধন-বিদ্যার নিগূঢ় রহস্য লইয়া নাড়াচাড়া করিতে হইত; কিন্তু ব্রাহ্মণের ছেলে হইলেও ও-বিদ্যাটা কখনও বড় বেশী আয়ত্ত করিয়া উঠিতে পারি নাই।
থালা, ঘটি, বাটির নাম গন্ধ বাগানে বড় বেশী ছিল না। প্রত্যেকের এক একটা নারিকেল মালা আর একখানা করিয়া মাটির সানকি ছিল; তাহাই আহারাদির পর ধুইয়া মুছিয়া রাখিয়া দিতে হইত। কাপড় সকলেই নিজের হাতে সাবান দিয়া কাচিয়া লইত; যাহারা একটু বেশী বুদ্ধিমান, তাহারা পরের কাচা কাপড় পরিয়াই কাজ চালাইয়া দিত।
ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের নানা জেলা হইতে প্রায় ২০ জন ছেলে আসিয়া জুটিল। তাহাদের মধ্যে ৫।৭ জন অধিকাংশ সময় কাজকর্ম লইয়া থাকিত আর যাহারা বয়সে একটু ছোট তাহারা প্রধানতঃ পড়াশুনা করিত। পড়াশুনার মধ্যে ধর্মশাস্ত্র, রাজনীতি ও ইতিহাস চর্চা, আর কর্মের মধ্যে বিপ্লবের আয়োজন। অনেক রকম ছেলে আসিয়া আমাদের কাছে জুটিয়াছিল। কলেজী বিদ্যার হিসাবে কেহ বা পণ্ডিত, কেহ বা মূর্খ; কিন্তু এখন মনে হয় যে, অনন্যসাধারণ একটা কিছু সকলেরই মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছিল, ইস্কুলে মাস্টার মহাশয়দের কাছে যেসব ছেলে পড়া মুখস্থ করিতে না পারিয়া লক্ষ্মীছাড়া বলিয়া গণ্য, অনেক সময় দেখিয়াছি তাহারা মানুষ হিসাবে “ভাল ছেলেদের” চেয়ে ঢের বেশী ভাল। ইংরাজীতে যাহাকে Adventurous বলে আমাদের বর্তমান জাতীয় জীবনে সেরকম ছেলের স্থান নাই! ঘ্যান ঘ্যান করিয়া পড়া মুখস্থ করা তাহাদের পোষায় না; কাজে কাজেই তাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাজ্যপুত্র। কিন্তু যেখানে জীবন মরণ লইয়া খেলা, যেখানে আমাদের ভাবী ডেপুটি মার্কা ছেলেরা এক পা আগাইয়া গিয়া দশ পা পিছাইয়া আসে, সেখানে ঐ “দস্যি” “বয়াটে” “লক্ষ্মীছাড়া” ছেলেগুলোই হাসিতে হাসিতে কাজ হাসিল করে।
বাগানের কাজকর্ম যখন আরম্ভ হইয়া গেল, তখন ছেলেদের বারীনের কাছে রাখিয়া দেবব্রত ও আমি আর একবার আশ্রমের উপযুক্ত স্থান খুঁজিতে বাহির হইলাম। দেবব্রতের তখন বাগানের কাজকর্মের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ কিছু ছিল না; কিন্তু তাহার মনটা তীর্থস্থানের সাধু দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল; কাজকর্ম তাহার আর ভাল লাগিতেছিল না।
প্রথমেই গিয়া এলাহাবাদে একটা প্রকাণ্ড ধর্মশালায় দুই চারিদিন পড়িয়া রহিলাম। বাজারের পুরি কিনিয়া খাই, আর লম্বা হইয়া পড়িয়া থাকি। মাঝে মাঝে এক একবার উঠিয়া এ-সাধু ও সাধুর কাছে ঢু মারিয়া বেড়াই। মাঝে একজন স্থানীয় বন্ধু জুটিয়া আমাদের ‘ঝুসি’ দেখাইতে লইয়া গেলেন। সেখানে দেখিলাম—গঙ্গার ধারে শিয়ালের মত গর্ত খুঁড়িয়া দুই চারিজন সাধু সেই গর্তের মধ্যে বাস করিতেছেন। এক জায়গায় দেখিলাম, একটি সিন্দুর মাখান রামমূর্তি; সম্মুখে ভক্তপ্রদত্ত চার পাঁচটি পয়সা, আর পাশেই একটি ছাই মাখা সাধু হাঁপানিতে ধুকিতেছে। শুনিলাম—মাটির নিচে সাধুদের সাধন-ভজনের জন্য অনেকগুলি ঘর আছে; কিন্তু আমাদের বন্ধুটীর নিকট সাধনেব যে রকম বীভৎস বর্ণনা শুনিলাম, তাহাতে দেবব্রতেরও সাধুদর্শনের আগ্রহ অনেকটা কমিয়া গেল।
প্রয়াগ হইতে বিন্ধ্যাচলে আসিয়া এক ধর্মশালায় কিছুদিন পড়িয়া রহিলাম। মাঠের মাঝখানে একখানি ছেটে কুঁড়েঘর বাঁধিয়া একজন জটাজুটধারী সাধু সেখানে থাকেন। প্রণাম করিয়া তাঁহার কাছে বসিবামাত্র তাঁহাব মুখ হইতে অনর্গল তত্ত্বকথা ও থুথু সমান বেগে ছুটিতে লাগিল। বাবাজী আহারাদির কোনও চেষ্টা করেন না; তবে তাঁহার কাছে ভক্তেরা যা প্রণামী দিয়া যায়, তাঁহার একজন গোয়ালা ভক্ত তাহা কুড়াইয়া লইয়া গিয়া তাহার পরিবর্তে সাধুকে দুধসাগু তৈয়ার করিয়া দেয়। ঐ দুধসাগু খাইয়াই তিনি জীবনধারণ কবেন। থুথু ও তত্ত্বকথা সংগ্রহ করিয়া ধর্মশালার ফিরিয়া আসিয়া দেখি, এক গেরুয়া পরিহিতা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী আমদের কম্বল দখল করিয়া বসিয়া আছেন। দেবব্রত ব্রহ্মচারী মানুষ, স্ত্রীলোকের সহিত একাসনে বসে না; সে ত ভৈরবীকে দেখিয়া প্রমাদ গণিল। এই সন্ধ্যার সময় তাহার পর্বতপ্রমাণ বিপুল দেহভার লইয়া বেচারা কম্বল ছাড়িয়া যায়ই বা কোথায়? ভৈরবীর আপাদ-মস্তক দেখিয়া দেবব্রত জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে?”
ভৈরবী—“আমি সাধুসঙ্গ করতে চাই।”
দেবব্রত—“সাধুসঙ্গ করতে চান ত আমাদের কাছে কেন? দেখছেন না আমরা বাবুলোক; আমাদের পরণে ধুতি, চোখে সোনার চশমা?”
ভৈরবী—“তা হোক, আমি জানি—আপনারা ছদ্মবেশী সাধু।”
আমরা অনেক করিয়া বুঝাইলাম যে, আমরা ছদ্মবেশীও নই, সাধুও নই, কিন্তু ভৈরবী ঠাকরুণ সেখান হইতে নড়িবার কোনই লক্ষণ দেখাইলেন না। শেষে অনেকক্ষণ তর্কবিতর্কের পর দেবব্রতই রণে ভঙ্গ দিয়া সে রাত্রি এক গাছতলায় পড়িয়া কাটাইয়া দিল।
কিন্তু ভৈরবী হইলে কি হয়, বাঙ্গালীর মেয়ে ত বটে! সকাল বেলা ঘুরিয়া আসিয়া দেখি, কোথা হইতে চাল ডাল জোগাড় করিয়া ভৈরবী রান্না চড়াইয়া দিয়াছেন। বেলা দশটা না বাজিতে বাজিতে আমাদের জন্য খিচুড়ী প্রস্তুত। কামিনী-কাঞ্চনে ব্রহ্মচর্যের ব্যাঘাত ঘটাইতে পারে কিন্তু কামিনীর রান্না খিচুড়ী সম্বন্ধে শাস্ত্রের ত কোন নিষেধ নাই; সুতরাং আমরা নির্বিবাদে সেই গরম গরম খিচুড়ী গলাধঃকরণ করিয়া ফেলিলাম। আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হইলে তবে ভৈরবী আহার করিতে বসিলেন। দেখিলাম, বাঙালীর মেয়ের স্নেহক্ষুধাতুর প্রাণটুকু গৈরিকের ভিতর দিয়াও ফুটিয়া বাহির হইতেছে।
বিন্ধ্যাচল হইতে চিত্রকূটে আসিলাম। ষ্টেশনে নামিতে না নামিতে ছোট বড় মাঝারি অনেক রকমের পাণ্ডা আমাদের উপর আক্রমণ করিল। আমরা যে তীর্থ দর্শন করিয়া পুণ্য সঞ্চয় করিতে চিত্রকূটে আসি নাই, একথা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে অনেকক্ষণ বক্তৃতা দিয়া তাহাদের বুঝাইলাম। কিন্তু তাহারা ছিনেজোঁকের মত আমাদের পিছনে লাগিয়াই রহিল। তাহাদের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার আশায় আমরা পাণ্ডাদের আস্তানা ছাড়িয়া নদীর ধারে একটা পোড়ো ঠাকুরবাড়ীতে আসিয়া আড্ডা গাড়িলাম। কিন্তু পাণ্ডাদের অদ্ভুত অধ্যবসায়। পাঁচ সাত জন আমাদের ঘিরিয়া বসিয়া রহিল। তীর্থে আসিয়া ঠাকুর দর্শন করে না—এ আবার কেমন তীর্থযাত্রী? তিন চার ঘণ্টা বসিয়া থাকিবার পর গালি দিতে দিতে একে একে সকলেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিল—কেবল একটী ১০।১২ বছরের ছোট ছেলে নাছোড়বান্দা। সে তখনও বক্তৃতা চালাইতে লাগিল। একখানি হাত আপনার পেটের উপর রাখিয়া আর একখানি হাত দেবব্রতের মুখের কাছে ঘুরাইয়া বলিল-–“দেখ বাবু—যে জীবাত্মা সেই পরমাত্মা। আমাকে খাওয়ালেই পরমাত্মার সেবা করা হবে।” পেটের জ্বালার সঙ্গে পরমার্থের এরূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের কথা শুনিয়া দেবব্রত হাসিয়া ফেলিল। বলিল—“দেখ, তোর কথাটার দাম লাখ টাকা। তবে আমার কাছে এখন অত টাকা নেই বলে তোকে এযাত্রা একটা পয়সা নিয়েই বিদায় হতে হবে।” জীবরূপী পরমাত্মা তাহাই লইয়া প্রস্থান করিল।
যে ঠাকুরবাড়ীতে আমরা পড়িয়া রহিলাম, তাহার চারিদিকে গাছে গাছে বানর ছাড়া আর কোন জীবের দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া যাইত না। সেখান হইতে প্রায় এক মাইল দূরে রেওয়ার রাজা বৈষ্ণব সাধুদের জন্য একটা মঠ তৈয়ারি করিয়া দিয়াছেন। সেখানে “আচারী” ও “বৈরাগী” প্রধানতঃ এই দুই সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব সাধুরা থাকেন। তাহাদের দুই একজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হইত।
একদিন সকাল বেলা বসিয়া আছি এমন সময় সেখানে একজন সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত। তিনি যুবা পুরুষ; বয়স আন্দাজ ৩২।৩৩; পরিচয়ে জানিলাম, তাঁহার জন্মস্থান গুজরাট; তাঁহার গুরুর আদেশ অনুযায়ী এই অঞ্চলে ঘুরিয়া বেড়ান। আমাদের যে রাজনীতির সহিত কোনও সম্পর্ক আছে তাহা তিনি কি করিয়া টের পাইলেন, ভগবানই জানেন। দুই একটা কথার পরই তিনি আমাদের বলিলেন—“দেখ, তোমরা যে মনে কর, এ অঞ্চলের লোক দেশের অবস্থা বুঝে না—সেটা মিথ্যা। সময় আসিলে দেখিবে ইহারাও ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হইয়া আছে।” আমরা কথাটা চুপ করিয়া শুনিলাম—দেখি শ্রাদ্ধ কোন্ দিকে গড়ায়। তিনি বলিতে লাগিলেন—“দেখ, তোমাদের একটা কথা বলিয়া রাখি। বিশ্বাস কর ত কথাটা খুবই বড়, আর না কর ত বাজে কথা বলিয়া ফেলিয়া দিও। জগতে ধর্মরাজ্য স্থাপনের জন্য ভগবান আবার অবতীর্ণ হইয়াছেন; তবে এখনও প্রকট হন নাই। তাঁহাকে নরদেহে টানিয়া আনিবার জন্যই যোগীদের সাধনা। সে সাধনা এবার সিদ্ধ হইবে। ভারতের দুঃখ তখনই ঘুচিবে।”
আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম—“আপনি এ সংবাদ জানিলেন কিরূপে?”
সন্ন্যাসী বলিলেন—“আমি সন্ন্যাস লইবার পূর্বে হনুমানজীর সাধন করিতাম। অনেক সাধন করিয়া কোন ফল না পাওয়ায় একবার নিরাশ হইয়া দেহত্যাগ করিতে চাই। সেই সময় হনুমানজী আমার নিকট প্রকাশিত হইয়া এই আশার সংবাদ আমাকে দিয়া যান।” ব্যাপারটা সন্ন্যাসীর মাথার খেয়াল, কি ইহার মূলে কোন সত্য নিহিত আছে তাহা ভগবানই বলিতে পারেন।
সন্ন্যাসীর নিকট হইতে আমরা বিদায় লইয়া একবার অমরকণ্টক যাইব স্থির করিলাম। বিন্ধ্য পর্বতের যেখান হইতে নর্মদার উৎপত্তি, অমরকণ্টক সেইখানে। কোন্ ষ্টেশনে নামিয়া কোথা কোথা দিয়া যে সেখানে গিয়াছিলাম এই দীর্ঘকাল পরে তার সবই ভুলিয়া গিয়াছি। শুধু মনে আছে যে, রাস্তায় একজন আসামী ভদ্রলোকের বাড়ী অতিথি হইয়। দিন দুই বেশ চব্যচোষ্য আহার করিয়াছিলাম। বহুদূর হাঁটিয়া ত’ বিন্ধ্য পর্বতের কাছে উপস্থিত হইলাম! পর্বতটা কিন্তু আমাদের ভাল লাগিল না! কেমন নেড়া-নেড়া মনে হইতে লাগিল। শৃঙ্গসম্বলিত হিমালয়ের বেশ একটা প্রাণকাড়া সৌন্দর্য আছে; বিন্ধ্যাচলের তাহার নামগন্ধ নাই। তিন চার দিন চড়াই-উৎরাইএর পর যখন অমরকণ্টকে পৌঁছিলাম, তখন দেখিলাম উহা আশ্রমের উপযুক্ত স্থান একেবারেই নয়। চারিদিকে শুধু বন-জঙ্গল, আর মাঝখানে একটা ভাঙ্গা ধর্মশালায় জনকয়েক রামায়ৎ সাধু বসিয়া গাঁজা খাইতেছে। যেখানে পাহাড় হইতে বুদ্ বুদ্ করিয়া নর্মদার ধারা বাহির হইতেছে সেখানে নর্মদা দেবীর একটি ছোট মন্দির আছে; তাহাও সংস্কারাভাবে নিতান্তই জীর্ণ। অমরকণ্টক এককালে যে বৌদ্ধদিগের তীর্থ ছিল তাহার নিদর্শন এখনও সেখানে বর্তমান। ব্রহ্মদেশীয় পাগোদার মত অনেকগুলি পুরাতন কাঠের মন্দির সেখানে রহিয়াছে। কোন কোনটির মধ্যে বুদ্ধমূর্তি এখনও প্রতিষ্ঠিত, কোথাও বা অন্য সম্প্রদায়ের সাধুরা বুদ্ধমূর্তি সরাইয়া দিয়া রাম বা কৃষ্ণমূর্তি স্থাপিত করিয়াছেন। চারিদিকে শালবন,–সেখানে বাঘের দৌরাত্ম্যও যথেষ্ট। আশপাশের গ্রাম হইতে গরু ছাগল প্রায়ই বাঘে লইয়া যায়। যখন দুই চারজন মানুষকে লইয়া বাঘে টানাটানি করে তখন রেওয়া রাজ্যের সিপাহীরা একশ বৎসর আগেকার যুঙ্গেরী বন্দুক লইয়া গোটা দুই ফাঁকা আওয়াজ করিয়া কর্তব্য পালন করে। সাধারণ লোকদেরও বাঘের হাতে মরা সহিয়া গিয়াছে। জঙ্গলে ঢুকিবাব আগে তাহারা বাঘের দেবতার পূজা দেয়, তাহার পরেও যদি বাঘে ধরে ত সেটাকে পূর্বজন্মের কর্মফলের উপর বরাত দিয়া নিশ্চিত্ত হয়। সাধুদেরও সেই অবস্থা; তবে তাঁহাবা নর্মদা পরিক্রম করিতে বাহির হইবার সময় প্রায়ই দল বাঁধিয়া বাহিব হন। এই নর্মদা-পরিক্রম আমার বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার বলিযা মনে হইল। অমরকণ্টক হইতে আরম্ভ কবিয়া পদব্রজে নর্মদাব ধারে ধারে গুজরাট পর্যন্ত যাইতে ও গুজরাট হইতে পুনরায় নর্মদার অপর পার ধরিয়া অমরকণ্টকে ফিবিয়া আসিতে চার পাঁচ বৎসর লাগে। কত সাধুই যে এই কাজ করিতেছেন তাহার ইয়ত্তা নাই। কোন কোন স্ত্রীলোককে গণ্ডি কাটিতে কাটিতে নর্মদা পরিক্রম করিতে দেখিয়াছি। ফল কি হয় জানি না। তবে এইটুকু মনে বিশ্বাস জন্মিয়া গিয়াছে যে, তাঁহাদের শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার শতাংশের একাংশ পাইলে আমরা মানুষ হইয়া যাইতাম! অমরকণ্টকের চারিধাবে দশ বারো ক্রোশ পর্যন্ত বনে জঙ্গলে ঘুরিলাম। পুরাতন সংস্কৃত গ্রন্থে চণ্ডাল-পল্লীর যে রকম বিবরণ পাওয়া যায় সেরূপ কতকগুলি পল্লীও দেখিলাম। সেখানকার পালিত কুকুরগুলি প্রায় একক্রোশ আমাদের তাড়া করিয়া আসিয়াছিল। নদীর ধার ধরিয়া ছুটিতে ছুটিতে এক জায়গায় বাঘের পায়ের ছাপ ও সদ্য নিঃসৃত রক্তচিহ্নও দেখিলাম। ভবিষ্যতে আন্দামানে যাইতে হইবে সে কথা যদি তখন জানিতাম, তাহা হইলে ছুটিয়া পালাইবার চেষ্টা না করিয়া বাঘের আশায় সেইখানেই বসিয়া থাকিতাম। কিন্তু সে যাত্রা বাঘও দেখা দিল না, আর ঘুরিয়া ঘুরিয়া আমাদের আশ্রমের উপযোগী স্থানও কোথাও মিলিল না। পাহাড় হইতে অগত্যা নামিতে হইল। নামিয়াই দেখিলাম—বারীনের চিঠি বলিতেছে “শীঘ্র ফিরিয়া এস!”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন