নির্বাসিতের আত্মকথা – প্রথম পরিচ্ছেদ

১৯০৬ খ্রীস্টাব্দে তখন শীতকাল। আসর বেশ গরম হইয়া উঠিয়াছে। উপাধ্যায় মহাশয় সবে মাত্র ‘সন্ধ্যা’য় চাটিম চাটিম বুলি ভাঁজিতে আরম্ভ করিয়াছেন; অরবিন্দ জাতীয় শিক্ষার জন্য বরোদার চাকরি ছাড়িয়া আসিয়াছেন; বিপিন বাবুও পুরাতন কংগ্রেসী দল হইতে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন; সারা দেশটা যেন নূতনের প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে। আমি তখন সবেমাত্র সাধুগিরির খোলস ছাড়িয়া জোর করিয়া মাস্টারিতে মনটা বসাইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় এক সংখ্যা “বন্দেমাতরম্” হঠাৎ একদিন হাতে আসিয়া পড়িল। ভারতের রাজনৈতিক আদর্শের কথা আলোচনা করিতে করিতে লেখক বলিয়াছেন— “We want absolute autonomy free from British control.” আজকাল এ কথাটা হাটে মাঠে ঘাটে বাজারে খুব সস্তা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, কিন্তু সেকালে বড় বড় রাজনৈতিক পাণ্ডারাও মুখ ফুটিয়া কথাটা বাহির করিতেন না। একেবারে ছাপার অক্ষরে ঐ কথাগুলি দেখিয়া আমার মনটা তড়াং করিয়া নাচিয়া উঠিল। সেকালের নেতারা ভাজিতেন ঝিঙ্গা, আর বলিতেন পটোল। যখন Self-government সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতেন, তখন তাহার পিছনে colonial কথাটা জুড়িয়া দিয়া শ্যাম ও কুল দুই-ই রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেন। তাহাতে আইনও বাঁচিত, হাততালিও পড়িত।

কিন্তু আমার কেমন পোড়া অদৃষ্টের লিখন! ঐ ছাপার অক্ষরগুলা ভোঁ ভোঁ করিয়া কানের ভিতর ঘুরিতে ঘুরিতে একেবারে মাথায় চড়িয়া বসিল। মনটা কেবল থাকিয়া থাকিয়া বলিতে লাগিল—“আরে ওঠ, ওঠ, সময় যে হয়ে গেল!” সেরাত্রে আর ঘুম হইল না। শুইয়া শুইয়া স্থির করিলাম, এসব কথার মূলে কিছু আছে কিনা খোঁজ লইতে হইবে। সত্যই কি এর সবটা শুধু বচন? খোঁজ লইতে বাহির হইয়া যে সমস্ত অদ্ভুত অদ্ভুত গুজব শুনিলাম, তাহাতে চক্ষু স্থির হইয়া গেল। পাহাড়ের কোন্ নিভৃত গহ্বরে বসিয়া নাকি লাখ দুই নাগা সৈন্য তলোয়াড় শানাইতেছে; হাতিয়ার সবই মজুত, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশও নাকি প্রস্তুত; শুধু বাংলা পিছাইয়া আছে বলিয়া তাহারা কাজে নামিতে একটু বিলম্ব করিতেছে। হবেও বা।

সেই সময় কলিকাতা হইতে “যুগান্তর” কাগজখানা বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে। লোকে কানাকানি করে যে যুগান্তরের আড্ডাটা নাকি একটা বিপ্লবের কেন্দ্র। বিপ্লবের নাম শুনিয়াই অনেক যুগের সঞ্চিত রোমান্স আমার মনের মধ্যে ঢেউ খেলিয়া উঠিল; ফ্রান্সের রবসপিয়ের হইতে আরম্ভ করিয়া আনন্দমঠের জীবানন্দ পর্যন্ত সবাই এক একবার মনের মধ্যে উঁকি মারিয়া গেল। এ দেশে যাহারা বিপ্লব আনিবে, ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের যাহারা মূর্তবিগ্রহ, সেগুলি কি রকমের জীব তাহা দেখিবার বড় আগ্রহ হইল। আমি ঘরের কোণে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিব, আর পাঁচজনে মিলিয়া রাতারাতি ভারতটাকে স্বাধীন করিয়া লইবে, এতো আর সহ্য করা যায় না!

কলিকাতা যুগান্তর অফিসে আসিয়া দেখিলাম ৩/৪টি যুবক মিলিয়া একখানা ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া ভারত উদ্ধার করিতে লাগিয়া গিয়াছেন। যুদ্ধের আসবাবের অভাব দেখিয়া মনটা একটু দমিয়া গেল বটে, কিন্তু সে ক্ষণেকের জন্য। গুলি-গোলার অভাব তাঁহারা বাক্যের দ্বারাই পূরণ করিয়া দিলেন। দেখিলাম, লড়াই করিয়া ইংরেজকে দেশ হইতে হটাইয়া দেওয়া যে একটা বেশী কিছু বড় কথা নয়, এবিষয়ে তাঁহারা সকলেই একমত। কাল না হয় দুদিন পরে যুগান্তর অফিসটা যে গবর্নমেন্ট হাউসে উঠিয়া যাইবে, সেবিষয়ে কাহারও সন্দেহমাত্র নাই। কথায়, বার্তায়, আভাসে, ইঙ্গিতে এই ধারণাটা আমার মনে আসিয়া পড়িল যে, এসবের পশ্চাতে একটা দেশব্যাপী বড় রকমের কিছু প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে।

দুই চারিদিন আনাগোনা করিতে করিতে ক্রমে “যুগান্তরের” কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হইল। দেখিলাম— প্রায় সকলেই জাতকটি ভবঘুরে বটে। দেবব্রত (ভবিষ্যতে স্বামী প্রজ্ঞানন্দ নামে ইনি প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন) বি-এ পাশ করিয়া আইন পড়িতেছিলেন; হঠাৎ ভারত উদ্ধার হয়-হয় দেখিয়া আইন ছাড়িয়া “যুগান্তরের” সম্পাদকতায় লাগিয়া গিয়াছেন। স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেনও সম্পাদকদের মধ্যে একজন। অবিনাশ এই পাগলদের সংসারে গৃহিণী-বিশেষ। যুগান্তরের ম্যানেজারি হইতে আরম্ভ করিয়া ঘরসংসারের অনেক কাজের ভারই তাহার উপর। বারীন্দ্রের সহিত আলাপ হইতে একটু বিলম্ব হইল, কেন না সে তখন ম্যালেরিয়ার জ্বালায় দেওঘরে পলাতক। পরে তাহার হাড় ক’খানার উপর চামড়া জড়ানো শীর্ণ শরীর, মাঠের মত কপাল, লম্বা লম্বা বড় বড় চোখ, আর খুব মোটা একটা নাক দেখিয়াই বুঝিয়াছিলাম যে, কল্পনা ও ভাবের আবেগে যাহারা অসম্ভবকে সম্ভব করিয়া তোলে, বারীন্দ্র তাহাদেরই একজন। অঙ্কশাস্ত্রের জ্বালায় কলেজ ছাড়িয়া অবধি সারেঙ্গ বাজাইয়া, কবিতা লিখিয়া, পাটনায় চায়ের দোকান খুলিয়া এযাবৎ অনেক কীর্তিই সে করিয়াছে। বড় লোকের ছেলে হইয়াও বিধাতার কৃপায় দুঃখ-দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতা হইতে বঞ্চিত হয় নাই। এইবার ৫০ টাকা পুঁজি লইয়া যুগান্তর চালাইতে বসিয়াছে। দেখা হইবার পর তিন কথায় সে আমাকে বুঝাইয়া দিল যে, দশ বৎসরের মধ্যে ভারত স্বাধীন হইবেই হইবে।

ভারত-উদ্ধারের এমন সুযোগ ত’ আর ছাড়া চলে না! আমিও বাসা হইতে পুঁটলি-পাঁটলা গুটাইয়া যুগান্তর আফিসে আসিয়া বসিলাম।

কিছুদিন পরে দেবব্রত ‘নবশক্তি’ আফিসে চলিয়া গেল। ভূপেনও পূর্ববঙ্গে ঘুরিতে বাহির হইল। সুতরাং যুগান্তর সম্পাদনের ভার বারীন্দ্র ও আমার উপরেই আসিয়া পড়িল। আমিও “কেষ্ট বিষ্টু”-দের মধ্যে একজন হইয়া দাঁড়াইলাম।

বাংলার সে একটা অপূর্ব দিন আসিয়াছিল। আশার রঙ্গীন নেশায় বাঙালীর ছেলেরা তখন ভরপুর। “লক্ষ পরানে শঙ্কা না মানে, না রাখে কাহারো ঋণ।” কোন্ দৈব স্পর্শে যেন বাঙালীর ঘুমন্ত প্রাণ সজাগ হইয়া উঠিয়াছিল। কোন্ অজানা দেশের আলোক আসিয়া তাহার মনের যুগযুগান্তের আঁধার যেন মুছিয়া দিয়াছিল। “জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।”— রবীন্দ্রনাথ যে ছবি আঁকিয়াছেন তাহা সেই সময়কার বাঙালী ছেলেদের ছবি। সত্যসত্যই তখন একটা জ্বলন্ত বিশ্বাস আমাদের মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিয়াছিল। আমরাই সত্য; ইংরেজের তোপ, বারুদ, গোলাগুলি, পল্টন, মেসিন গান—ওসব শুধু মায়ার ছায়া! এ ভোজবাজির রাজ্য, এ তাসের ঘর—আমাদের এক ফুৎকারেই উড়িয়া যাইবে। নিজেদের লেখা দেখিয়া নিজেরাই চমকিয়া উঠিতাম; মনে হইত যেন দেশের প্রাণ-পুরুষ আমাদের হাত দিয়া তাঁহার অন্তরের নিগূঢ় কথা ব্যক্ত করিতেছেন।

হু হু করিয়া দিন দিন যুগান্তরের গ্রাহকসংখ্যা বাড়িয়া যাইতে লাগিল। এক হাজার হইতে পাঁচ হাজার, পাঁচ হাজার হইতে দশ হাজার, দশ হাজার হইতে এক বৎসরের মধ্যে বিশ হাজারে ঠেকিল। ছোট প্রেসে ত আর অত কাগজ ছাপা চলে না। লুকাইয়া অন্য প্রেসে ছাপান ভিন্ন গত্যন্তর রহিল না।

ঘরের কোণে একটা ভাঙ্গা বাক্সে যুগান্তর বিক্রয়ের টাকা থাকিত। তাহাতে চাবি লাগাইতে কখন কাহাকেও দেখি নাই। কত টাকা আসিত আর কত টাকা খরচ হইত, তাহার হিসাবও কেহ লইত না। যুগান্তর আফিসে অনেকগুলি ছেলেও মাঝে মাঝে আসিয়া খাইত ও থাকিত। তাহাদের বাড়ি কোথায়, তাহারা কি করে, এসংবাদ বড় কেহ রাখিত না। এইটুকু শুধু জানিতাম যে, তাহারা “স্বদেশী”; সুতরাং আমাদের আত্মীয়।

বাহিরে যাইবার সময় বাড়ির সুমুখে দুই একটি লোককে প্রায়ই দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতাম, আমাদের দেখিলে তাহারা কেহ আকাশ পানে চাহিত, কেহ সম্মুখের চায়ের দোকানে ঢুকিয়া পড়িত, কেহ বা শীস দিতে দিতে চলিয়া যাইত। শুনিতাম-সেগুলি নাকি সি-আই-ডির অনুগৃহীত জীব। সি— আইডি! ফুঃ! কে কার কড়ি ধারে?

দিন এইরূপে কাটিতে লাগিল। একদিন সরকার বাহাদুরের তরফ হইতে একখানা চিঠি আসিয়া হাজির হইল যে, যুগান্তরে যেরূপ লেখা বাহির হইতেছে তাহা রাজদ্রোহ-সূচক। ভবিষ্যতে ওরূপ করিলে আইনের কবলে পড়িতে হইবে। আমরা ত হাসিয়াই অস্থির! আইন কিরে, বাবা? আমরা ভারতের ভাবী সম্রাট, গবর্ণমেন্ট হাউসের উত্তরাধিকারী—আমাদের আইন দেখায় কেটা?

একদিন কিন্তু সত্য সত্যই পালে বাঘ পড়িল। ইন্সপেক্টর পূর্ণ লাহিড়ী জনকতক কনষ্টেবল্ লইয়া যুগান্তর আফিসে খানাতল্লাশী করিতে আসিলেন। যুগান্তরের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করিবার পরওয়ানাও তাঁহার সঙ্গে ছিল। কিন্তু সম্পাদক কে? এ বলে ‘আমি,’ ও বলে ‘আমি’। শেষে ভূপেনই একটু মোটা-সোটা ও তাহার বেশ মানানসই রকমের দাড়ি আছে বলিয়া, তাহাকেই সম্পাদক বলিয়া স্থির করা হইল। ভূপেন যখন আদালতে সাফাই গাহিয়া আপনাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিল না, তখন দেশে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে একটা খুব হৈ চৈ পড়িয়া গেল। এ কাণ্ডটা নূতন আজগুবী কাণ্ড বটে! ভূপেন যাহাতে ত্রুটি স্বীকার করিয়া নিষ্কৃতি পায়, সরকারী পক্ষ হইতে সে চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু ভূপেন রাজী হইল না। ফলে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড তাহাকে এক বৎসরের জন্য জেলে ঠেলিয়া দিলেন।

এই সময় হইতে দেশে রাজদ্রোহের মামলার ধুম লাগিয়া গেল। দুই সপ্তাহ যাইতে না যাইতেই যুগান্তরের উপর আবার মামলা শুরু হইল এবং যুগান্তরের প্রিন্টার বসন্ত কুমারকে জেলে যাইতে হইল।

একে একে এরূপ অনেকগুলি ছেলে জেলে যাইতে লাগিল। তখন বারীন্দ্র বলিল–“এরূপ বৃথা শক্তিক্ষয় করিয়া লাভ নাই। বাক্যবাণে বিদ্ধ করিয়া গবর্ণমেন্টকে ধরাশায়ী করিবার কোনও সম্ভাবনা দেখি না। এতদিন যাহা প্রচার করিয়া আসিলাম, তাহা এইবার কাজে করিয়া দেখাইতে হইবে।” এই সঙ্কল্প হইতেই মানিকতলার বাগানের সৃষ্টি।

মানিকতলায় বারীন্দ্রদের একটা বাগান ছিল। স্থির হইল যে, একটা নূতন দলের উপর যুগান্তরের ভার দিয়া যুগান্তর আফিসের জনকত বাছাই বাছাই ছেলে লইয়া ঐ বাগানে একটা নূতন আড্ডা গড়িতে হইবে। যাহাদের সংসারের টান নাই, অথবা টান থাকিলেও অকাতরে তাহা বিসর্জন দিতে পারে, এরূপ ছেলেই লইতে হইবে। কিন্তু ধর্ম-জীবন লাভ না হইলে এরূপ চরিত্র প্রায় গড়িয়া উঠে না; সেই জন্য স্থির হইল যে, বাগানে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। আমি তখন সাধুগিরির ফেরত আসামী; সুতরাং পুঁথিগত মামুলী ধর্মশিক্ষার উপর আমার যে বড় একটা গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তা নয়। বারীন্দ্র কিন্তু নাছোড়বান্দা। গেরুয়ার উপর তাহার তখন অসীম ভক্তি। একজন ভাল সাধু-সন্ন্যাসীকে ধরিয়া আমাদের দলে পুরিতে পারিলে তাহার শিক্ষায় দীক্ষায় যে ছেলেদের ধর্মজীবনটা গড়িয়া উঠিবে, এই আশায় সে সাধু খুঁজিতে বাহির হইয়া পড়িল। কি করিব, সঙ্গে আমিও চলিলাম। কিন্তু যাই কোথা? আমাদের পাল্লায় পড়িবার জন্য কোথায় সাধু বসিয়া আছে? বরোদায় থাকিবার সময় বারীন্দ্র শুনিয়াছিল যে, নর্মদার ধারে কে নাকি একজন ভাল সাধু আছে। অতএব চলো সেইখানে। তাহাই হইল। কিন্তু যে আশা লইয়া আসিয়াছিলাম, তাহা মিটিল না। সাধুজী তাঁহার কাটা জিহ্বাটি উল্টাইয়া তালুতে লাগাইয়া দমবন্ধ করিয়া থাকিতে পারেন। শুনিলাম—তিনি নাকি ঐরূপে ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে ক্ষরিত সুধাধারা পান করিয়া থাকেন। বিশ পঞ্চাশ রকমের আসনও তিনি আমাদের বাৎলাইয়া দিলেন, রকম বেরকমের ধৌতি বস্তির কসরত্ত দেখাইতে ভুলিলেন না। কিন্তু আমাদের পোড়া মন তাহাতে উঠিল না।

দুই তিন দিন বেশ মোটা মোটা ঘৃতসিক্ত রুটি ও অড়হর ডাল ধ্বংস করিয়া আমরা তাঁহার আশ্রম হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। বারীন্দ্র কিন্তু নিরুৎসাহ হইবার পাত্র নয়। আমায় বলিল—“দেখ, গিরিডির কাছে কোথায় একজন সাধু আছেন শুনেছি। তুমি একবার সেইখানে গিয়ে খোঁজ কর; আর-রাস্তায় কাশীতেও একবার ঢু মেরে যেয়ো। আমি এই অঞ্চলে আরও দিন কতক দেখি।” আমি ‘তথাস্তু’ বলিয়া গিরিডি যাত্রার নাম করিয়া সটান মানিকতলায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দিন কয়েক পরে শুনিলাম—বারীন আর একটি সাধুকে পাকড়াও করিয়াছে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি ঝাসীর রাণীর পক্ষ হইয়া ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। তারপর সাধু হইয়া চুপচাপ এতদিন সাধন-ভজন করিতেছিলেন। বারীদের সংস্পর্শে আবার সেই বহুদিনের নির্বাপিতপ্রায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। বারীন্দ্র তাহাকে বলিল—“ঠাকুর, তুমি আমায় একখানা গেরুয়া কাপড় আর কানে যা হয় একটা মন্তর ফুঁকে দাও; বাকি সবটা আমিই করে নেব।” সাধু বারীনকে বড় ভালবাসিতেন; তিনি তাহাতেই রাজী হইলেন। বারীন সাধুর নিকট যথাশাস্ত্র মন্ত্রদীক্ষা লইল। কিছুদিন পরে বারীনকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম—“সাধু কি মন্ত্র দিলেন?” বারীন্দ্র বলিল—“ভুলে মেরে দিয়েছি।” যাই হোক, বারীন্দ্র তাঁহাকে লইয়া মধ্যভারতের কোনও তীর্থস্থানে একটা আশ্রম গড়িবার সঙ্কল্প করে; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে জলাতঙ্করোগে বাবাজীর মৃত্যু হওয়ায় সে সঙ্কল্প আর কাজে পরিণত হইল না।

কিছুদিন পরে বারীন্দ্র আর একজন সাধুর নিকট হইতে সাধন লইয়। দেশে ফিরিল। ঐ সাধুটি মধ্যভারত ও বোম্বাই অঞ্চলে একজন সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া প্রসিদ্ধ। পরে তাঁহাকে আমিও দেখিয়াছি। তিনি যে অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন যে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

বারীন্দ্র ফিরিয়া আসিবার পর একটা আশ্রম গড়িবার ঝোঁক আমাদের ঘাড়ে খুব ভাল করিয়াই চাপিল। কিন্তু মনের মত জায়গা মিলিল না। শেষে স্থির হইল, যতদিন না ভাল জায়গা পাওয়া যায় ততদিন মানিকতলার বাগানেই আশ্রমের কাজ চলুক।

অধ্যায় ১ / ১৪

সকল অধ্যায়

১. নির্বাসিতের আত্মকথা – প্রথম পরিচ্ছেদ
২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – তৃতীয় পরিচ্ছেদ
৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৫. নির্বাসিতের আত্মকথা – পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৬. নির্বাসিতের আত্মকথা – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৭. নির্বাসিতের আত্মকথা – সপ্তম পরিচ্ছেদ
৮. নির্বাসিতের আত্মকথা – অষ্টম পরিচ্ছেদ
৯. নির্বাসিতের আত্মকথা – নবম পরিচ্ছেদ
১০. নির্বাসিতের আত্মকথা – দশম পরিচ্ছেদ
১১. নির্বাসিতের আত্মকথা – একাদশ পরিচ্ছেদ
১২. নির্বাসিতের আত্মকথা – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৩. নির্বাসিতের আত্মকথা – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৪. নির্বাসিতের আত্মকথা – চতুদর্শ পরিচ্ছেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন