বাংলা ভাষায় “উঠতে লাথি, বসতে ঝাঁটা” বলিয়া যে একটা কথা আছে তাহার অর্থ যে কি তাহা জেলখানায় দুই চারি দিন থাকিতে থাকিতেই বেশ বুঝিতে পারিলাম। একেত আমাদের পরস্পরের সহিত কথা কহিবার জো নাই; তাহার উপর যেখানে আমাদের রাখা হইয়াছিল সেখানে শুধু মাদ্রাজী আর ব্রহ্মদেশীয় লোক! কাহারও কথার এক বর্ণও বুঝিবার উপায় নাই। আহারের ব্যবস্থা দেখিলে প্রবল বৈরাগ্য উপস্থিত হয়। রেঙ্গুন চালের ভাত ও মোটা মোটা রুটি, এ না হয় এক রকম চলে; কিন্তু কচুর গোড়া, ডাঁটা ও পাতা, চুপড়ি আলু, খোসা-সমেত কাঁচা কলা ও পুঁই শাক, ছোট কাঁকর আর ইন্দুরনাদি এক সঙ্গে সিদ্ধ করিয়া যে পরম উপাদেয় ভোজ্য প্রস্তুত হয়, তরকারীর বদলে তাহার ব্যবহার করিতে গেলে চক্ষে জল না আসে, বাঙলা দেশে এমন ভদ্রলোকের ছেলে এ দুর্ভিক্ষের বৎসরেও বড় বিরল।
কাজ কর্মের ব্যবস্থাও বেশ চমৎকার। কালাপানিতে প্রচুর পরিমাণে নারিকেল জন্মায়। সেগুলি সবই সরকারী সম্পত্তি। সেই জন্য সেখানে প্রধানতঃ নারিকেল লইয়াই কারবার। নারিকেলের ছোবড়া পিটিয়া তার বাহির করা ও তাহা হইতে দড়ি পাকান, শুষ্ক নারিকেল ও সরিষা ঘানিতে পিষিয়া তেল বাহির করা, নারিকেলের মালা হইতে হুকার খোল প্রস্তুত করা-–এই সমস্তই জেলখানার প্রধান কাজ। এ ভিন্ন এখানে বেতের কারখানাও আছে; প্রধানতঃ অল্পবয়স্ক ছেলেরাই কাজ করে।
ঘানি ঘুরান ও ছোবড়া পেটাই সব চেয়ে কঠিন। আমাদের মধ্যে বারীন্দ্র ও অবিনাশ নিতাশু দুর্বল ও রুগ্ন বলিয়া তাহা-দিগকে দড়ি পাকাইতে দেওয়া হইল; অপর সকলের ভাগ্যে ছোবড়া পেটা মিলিল। সকাল বেলা উঠিয়া শৌচকর্মের কিঞ্চিৎ পরেই সকলকে অন্ন বা “কব্জি” গলাধঃকরণ করিয়া “ল্যাঙ্গোটি” আঁটিয়া ছোবড়া পিটিতে বসিয়া যাইতে হয়। প্রত্যেককে বিশটী নারিকেলের শুষ্ক ছোবড়া দেওয়া হয়। একখণ্ড কাঠের উপর এক একটী ছোবড়া রাখিয়া একটী কাঠের মুগুর দিয়া তাহা পিটিতে পিটিতে ছোবড়াটী নরম হইয়া আসে। ছোবড়াগুলি পিটিয়া নরম হইলে তাহাদের উপরকার খোসা উঠাইয়া ফেলিতে হয়। তাহার পর সেইগুলি জলে ভিজাইয়া পুনরায় পিটিতে হয়। পিটিতে পিটিতে ভিতরকার ভুসি ঝরিয়া গিয়া কেবলমাত্র তারগুলিই অবশিষ্ট থাকে। এই তারগুলি রৌদ্রে শুকাইয়া পরিষ্কার করিয়া প্রত্যহ এক সেরের একটী গোছ। প্রস্তুত করিতে হয়।
প্রথম দিন ছোবড়া পেটা ব্যাপারটা হাঁ করিয়া বুঝিতেই আমাদের অনেকক্ষণ গেল; তাহার পর পিটিতে গিয়া দেখিলাম হাতময় ফোস্কা পড়িয়া গিয়াছে। সমস্ত দিন মাথা খুঁড়িয়া কোন রকমে আধ পোয়া তার প্রস্তুত করিলাম। অষ্টমীর পাঁঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে যখন বেলা তিনটার সময় কাজ দাখিল করিতে হাজির হইলাম, তখন দাঁতখিচুনির বহর দেখিয়াই চক্ষু স্থির হইয়া গেল। গালাগালিটা নির্বিবাদে হজম করিবার সু-অভ্যাস কস্মিনকালেও ছিল না; আজ বিদেশে এই শত্রুপুরীর মধ্যে কঠোর পরিশ্রম ও গালাগালি সম্বল করিয়া দীর্ঘজীবন কাটাইতে হইবে ভাবিয়া যেন প্রাণটা হাঁপাইয়া উঠিতে লাগিল। আর সে গালাগালির বা কি বাহার! শরৎবাবুর কি একখানা বইএ পড়িয়াছিলাম যে গালাগালিতে হিন্দুস্থানীর মত লম্বা জিহ্বা আর কোন জাতির নাই। তাঁহাকে একবার পোর্টব্লেয়ারে গিয়া ভাষাতত্ত্বের অনুশীলন করিতে আমাদের সবিনয় অনুরোধ। হিন্দুস্থানীর সহিত পাঞ্জাবী, পাঠান ও বেলুচ মিশিয়া যে অমৃতের উৎস সেখানে খুলিয়া দিয়াছে, তাহার আস্বাদন একবার যাহার অদৃষ্টে ঘটিয়াছে, সেই মজিয়াছে। সাত জন্ম সে ভাষা চর্চা করিলেও আমাদের দেশের হাড়ী, বাগ্দী পর্যন্ত সে রসে সম্যক অধিকারী হইতে পারিবে কি না সন্দেহ। বীভৎসতার মধ্যে এত রকমারি থাকিতে পারে, পূর্বে তাহা জানিতাম না।
মাঝে মাঝে এক আধজন প্রহরী একটু ভাল কথাও বলিত। একদিন সন্ধ্যার সময় গালাগালি খাইয়া মুখ চূণ করিয়া কুঠরির মধ্যে বসিয়া আছি এমন সময় একজন পাঠান প্রহরী জিজ্ঞাসা করিল— “বাবু, কি হয়েছে?” আমি গালাগালি খাওয়ার কথা বলিলাম। সমস্ত শুনিয়া সে বলিল—“দেখ বাবু, আমি প্রায় চার পাঁচ বৎসর এই জেলে আছি। গালাগালি খেয়ে যারা মন গুমরে বসে থাকে তারা হয় পাগল হয়ে যায়, নয় ত মারামারি করে ফাঁসি যায়। ওসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভাল। খোদাতালার হুকুমে এমন দিন চিরকাল থাকবে না।” অযাচিত উপদেশ প্রায়ই ভাল লাগে না, কিন্তু পাঠানের মুখে খোদাতালার নাম সে রাত্রে বড় মিষ্ট লাগিয়াছিল। মানুষ যখন সব আশ্রয় হারাইয়া দিশেহারা হইয়া পড়ে তখন অগতির গতিকে তাহার মনে পড়ে। সেই জন্যই জেলখানায় দেখিতে পাই যে যাহারা দুর্দান্ত পাষণ্ড তাহারাও এক একগাছা মালা লইয়া নাম জপ করে। প্রথম প্রথম এসব দেখিয়া বড় হাসি পাইত। তাহার পর মনে হইতে লাগিল—ইহাতে হাসিবার কি আছে? আর্ত ভক্তও ত ভগবানের ভক্তের মধ্যে গণ্য।
ছোবড়া পিটিয়া, কচু পাতার তরকারী ও গালাগালি খাইয়া “এক রকমে ত দিনগত পাপক্ষয় করিতে লাগিলাম; কিন্তু উপদেবতাদের দৌরাত্মে ক্রমে জীবন প্রায় অতিষ্ঠ হইয়া উঠিতে লাগিল। দেশের জেলে যেমন ‘মেট’ ও কালাপাগড়ী, কালা-পানিতে সেইরূপ warder, petty officer, tindal ও জমাদার। সাধারণ কয়েদীই পাঁচ সাত বৎসর সাজ। কাটিবার পর এই সব পদে উন্নীত হয়; কিন্তু কালাপানিতে ক্ষুদ্র বৃহৎ বহুবিধ কর্মের ভার ও কর্তৃত্ব ইহাদের উপর ন্যস্ত। যমরাজার কারাধ্যক্ষের ইহারাই প্রহরী। ছেলেবেলায় একজন মুরসিক বাঙালী বক্তার মুখে শুনিয়াছিলাম যে, যিনি “আষ্টে পিক্টে” মারেন তিনিই “মাষ্টার”। আমারও সেইরূপ মনে মনে একটা বেশ বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে “প্রহার” শব্দের সহিত “প্রহরী” শব্দের নিশ্চয় একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। গালাগালি ও মারপিটে ইহারা সকলেই সিদ্ধহস্ত। “রামলাল ফাইলে টেড়া হইয়া বসিয়াছে। দাও উহার ঘাড়ে দুইটা রদ্দা; মুস্তফা আওয়াজ দিবামাত্র খাড়া হয় নাই, অতএব উহার গোঁফ ছিড়িয়া লও! বকাউল্লার পায়খানা হইতে ফিরিতে বিলম্ব হইয়াছে অতএব তিন ডাক্ত লাগাইয়া উহার পশ্চাদ্দেশ ঢিলা করিয়া দাও।” এইরূপ বহুবিধ সদ্যুক্তি প্রয়োগে তাঁহারা জেলখানার শাস্তি (discipline) রক্ষা করেন।
কয়েদীরা অনেক সময় গলার মধ্যে গত করিয়া পয়সা-কড়ি লুকাইয়া রাখে; নানারূপে অত্যাচার করিয়া কয়েদীর নিকট হইতে সেই পয়সার ভাগ আদায় করাই প্রহরীদের প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের ত পয়সা-কড়ি নাই, আমরা যাই কোথায়? বারীন্দ্র নিতান্ত জীর্ণশীর্ণ বলিয়া হাসপাতাল হইতে তাহার প্রত্যহ বারো আউন্স দুগ্ধ পাইবার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের petty officer খোয়েদাদ মিঞার মুখে সেই দুধটুকু ঢালিয়া দিয়া তবে সে অত্যাচারের হাত হইতে নিস্তার পাইত! খোয়েদাদ একজন প্রচণ্ড নমাজী মোল্লা; পুরাদস্তুর “খোদাকা বন্দা।” তিনি তাঁহার গোঁফছাটা মুখখানির মধ্যে দুধটুকু ঢালিয়া দিতে দিতে বলিতেন—“ইয়াঃ বিসমিল্লা! খোদানে কেয়া আজব, চিজ পয়দা কিয়া!”
আরও বিপদের কথা এই, এ সকল অত্যাচারের প্রতিকার নাই। রক্ষকই যেখানে ভক্ষক সেখানে প্রাণ বাঁচে কিরূপে?
এইরূপে ছয় মাস যাইতে না যাইতে নাসিক, খুলনা ও এলাহাবাদ হইতে দশ বারো জন রাজনৈতিক কয়েদী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সর্বসমেত আমাদের সংখ্যা হইল প্রায় বিশ বাইশ জন।
এই সময় আমাদের ভাগ্য-গগনে নূতন জেল সুপারিন-টেণ্ডেণ্টরূপী এক ধূমকেতুর উদয় হইল। আমাদের কপাল এইবার পুরাপুরি ভাঙ্গিল। তিনি আসিবার কিছুদিন পরেই আমাদের জনকতককে ঘানিতে দিয়া তেল পিষাইবার ব্যবস্থা করিলেন। উল্লাসকরকে যে সরিষা পিষিবার ঘানিতে জোড়া হইল তাহা অনেকটা আমাদের কলুর বাড়ীর দেশী ঘানির মত; আর হেমচন্দ্র, সুধীর, ইন্দু প্রভৃতি বাকি কয়জনকে যে ঘানিতে পাঠান হইল তাহা হাত দিয়া ঘুরাইতে হয়। প্রত্যহ এক একজনকে দশ পাউণ্ড সরিষার তেল বা ত্রিশ পাউণ্ড নারিকেল তেল পিষিয়া প্রস্তুত করিতে হয়। মোটা মোটা পালোয়ান লোকও ঘানি ঘুরাইতে হিমসিম খাইয়া যায়; আর আমাদের যে কি দশা হইল তাহা মুখে অবর্ণনীয়। জেলের যে অংশে তেল পেষা হয় দুইজন পাঠান পেটী অফিসার তখন সেখানকার হর্তাকর্তা। সেখানে ঢুকিবামাত্র তাহাদের মধ্যে একজন তাহার বদ্ধমুষ্টি আমাদের নাকের উপর রাখিয়া বেশ জোর গলায় বুঝাইয়া দিল যে কাজকর্ম ঠিক ঠিক না করিতে পারিলে সে আমাদের নাকগুলি ঘুসার চোটে থ্যাবড়া করিয়া দিবে। কিন্তু নাকের ভবিষ্যৎ দুর্দশার কথা ভাবিয়া সময় নষ্ট করিবার উপায় নাই। তাড়াতাড়ি কাধের উপর পঞ্চাশ পাউণ্ড নারিকেলের বস্তা ও হাতে একটা বালতি লইয়া তেতলায় চড়িয়া কাজ আরম্ভ করিতে হইবে। আর সে ত কাজ নয়; রীতিমত মল্লযুদ্ধ। আট দশ মিনিটের মধ্যেই দম চড়িয়া জিভ শুকাইতে আরম্ভ হইল। এক ঘণ্টার মধ্যেই গা হাত পা যেন আড়ষ্ট হইয়া উঠিল। রাগের চোটে মনে মনে সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট সাহেবের পিতৃশ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করিতে লাগিলাম, কিন্তু সে নিষ্ফল, আক্রোশ। একবার মনে হইল ডাক ছাড়িয়া কাঁদিলে বুঝি এ জ্বালা মিটিবে, কিন্তু লজ্জায় তাহাও পারিলাম না। দশটার ঘণ্টার পর যখন আহার করিতে নীচে নামিলাম, তখন হাতে ফোস্কা পড়িয়াছে, চোখে সরিষার ফুল ফুটিতেছে আর কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকিতেছে। প্রথমেই দেখিলাম বৃদ্ধ হেমচন্দ্র এককোণে চুপচাপ বসিয়া আছেন। জিজ্ঞাসা করিলাম-“দাদা, কি রকম?” দাদা হাত দু’খান। দেখাইয়া বলিলেন—“দারুভূতো মুরারি।” কিন্তু হাত দুখানা আড়ষ্ট হইয়া দারুময়ই হোক আর পাষাণময়ই হোক, তাঁহার মনের জোর কখনও একবিন্দু কমিতে দেখি নাই। দুঃখকষ্ট হাসিমুখে সহ্য করিতে, তীব্র যন্ত্রণার মাঝখানে অবিচলিতভাবে ভবিষ্যৎ কর্তব্য স্থির করিতে হেমচন্দ্র একরূপ অদ্বিতীয়। হেমচন্দ্রকে আত্মহারা হইতে কেহ বড় একটা দেখে নাই। যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া যখন কেহ কেহ একটা যা-হয়-কিছু করিয়া ফেলিবার সঙ্কল্প করিয়াছে তখন হেমচন্দ্রই আপনার মনের বল তাহাদের মধ্যে সংক্রামিত করিয়া তাহাদিগকে নিরস্ত করিয়াছেন।
অতটা মনের জোর আমাদের ছিল না। একে ত আন্দামান নিকোবর ম্যানুয়াল অনুসারে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর মানে পঁচিশ বৎসর এইরূপ কর্মভোগ; তাহার পরও খালাস পাওয়া সরকার বাহাদুরের ইচ্ছাধীন। মনে হইতে লাগিল গলায় একগাছা দড়ি লাগাইয়া না হয় ঝুলিয়া পড়ি; কিন্তু সাহসে কুলাইল না। কাজে কাজেই যথাসাধ্য তেল পিষিয়া সরকারী তেলের গুদাম ভর্তি করিতে লাগিলাম।
এক দিনের দুর্দশার কথা বেশ মনে পড়ে। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘানি ঘুরাইয়াও ত্রিশ পাউণ্ড তেল পুরা করিতে পারিলাম না। হাত পা এমনি অবশ হইয়া গিয়াছে যে, মনে হইতেছিল বুঝি বা মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাই। তাহার উপর সমস্ত দিন প্রহরীদের কাছে কাজের জন্য গালি খাইয়াছি। সন্ধ্যাবেলা আমাকে জেলারের নিকট লইয়া গেল। জেলার ও সুশ্রাব্য ভাষায় আমার পিতৃশ্রাদ্ধ করিয়া পশ্চাদ্দেশে বেত লাগাইবার ভয় দেখাইলেন। ফিরিয়া আসিয়া যখন ভাত খাইতে বসিলাম তখন খাইব কি, দুঃখ ও অভিমানে পেট ফুলিয়া কণ্ঠরোধ করিয়া দিয়াছে। একজন হিন্দু প্রহরীর মনে একটু দয়া হইল; সে বলিল—“বাবুলোক তকলিফমে হৈ; খানা জাস্তি দেও।” কথাগুলা শুনিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিবার প্রবৃত্তি হইল। নিজের গলাটা নিজের হাতে চাপিয়া ধরিলাম। এ সময় লাথি ঝাঁটা সহ্য করা যায়; কিন্তু সহানুভূতি সহ্য হয় না।
রবিবারেও কর্মের হাত হইতে নিস্কৃতি নাই। নীচে হইতে বালতি বালতি জল উঠাইয়া দোতলা ও তেতলার বারান্দা নারিকেল ছোবড়া দিয়া ঘসিয়া পরিষ্কার করিতে হইত। একদিন ঐরূপ পরিষ্কার করিবার সময় দেখিলাম উল্লাসকর কিছু দূরে কাজ করিতেছে। কথা কহিবার হুকুম নাই, তবু কথা কহিবার বড় সাধ হইল। দুই এক পা করিয়া অগ্রসর হইয়া উল্লাসের কাছাকাছি গিয়া তাহাকে ডাকিবামাত্র আমার পিঠের উপর গুম্ করিয়া একটা বিষম কিল পড়িল। পিছনে মুখ ফিরাইবা মাত্র গালে আর এক ঘুসি! যমদূতসদৃশ পাঠান প্রহরী মহম্মদ সা এইরূপে সরকারী হুকুম তামিল ও জেলের শান্তিরক্ষা করিতেছেন।
সেবার কিছুদিন এইরূপে কাটাইয়া ঘানির হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলাম। কিন্তু জেলার নাছোড়বান্দা। দিন কতক পরেই আবার ঘানিতে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু আমি তখন মরিয়া হইয়া দাঁড়াইয়াছি। একেবারে সাফ জবাব দিয়া বসিলাম—“আমি খানি পিষব না, তুমি যা করতে পার কর।” জেলার ত অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিলেন। একটা কুঠরীতে বন্ধ রাখিয়া পর্যায়ক্রমে হাতকড়ি, বেড়ী ও কঞ্জির (penal diet) ব্যবস্থা হইল। শেষে শরীর যখন নিতান্তই ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইল তখন আবার ছোবড়া পিটিবার অধিকার পাইলাম কিন্তু ছোবড়া পিটিয়াই কি শাস্তি আছে? প্রহরী, বিশেষতঃ পাঠান ও পাঞ্জাবী মুসলমানেরা স্থির করিয়া লইয়াছিল যে আমাদের দাবাইতে পারিলেই কর্তৃপক্ষের প্রিয়পাত্র হওয়া যায়। কাজেই তাহারা সর্বদা আমাদের বিপদে ফেলিবার জন্য সচেষ্ট হইয়া থাকিত। ছোটখাট খুঁটিনাটি লইয়া যে কতজনকে বিপদে পড়িতে হইয়াছে তাহার আর ইয়ত্তা নাই। একদিন কুঠরীর মধ্যে পায়ে বেড়ী দিয়া শুষ্ক ছোবড়া পিটিতেছি। দারুণ গ্রীষ্মে ও কঠোর পরিশ্রমে মাথা হইতে পা পর্যন্ত ঘামের স্রোত ছুটিয়াছে, ছোবড়া পিটিবার মুগুর মাঝে মাঝে লাফাইয়া লাফাইয়া আমরই মাথা ভাঙ্গিয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় কুঠরীর বাহিরে একজন পাঞ্জাবী মুসলমান প্রহরীকে দেখিয়। ছোবড়াগুলো ভিজাইবার জন্য একটু জল চাহিলাম। সে একেবারে দাঁতমুখ খিঁচাইয়া জবাব দিল—“না, না, হবে না, ঐ শুকনো ছোবড়াই পিট্তে হবে।” আমারও মেজাজটা বড় সুবিধার ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—“জল না হয় নাই দেবে, কিন্তু অত দন্ত বিচ্ছেদ করছ কেন? প্রহরী রুখিয়া দাঁড়াইল, “কেয়া, গোস্তাকি করতা?” আমি দেখিলাম এখন আর হটিয়া যাওয়া চলে না। বলিলাম—“কেন, তুমি নবাবজাদা নাকি?” বলিবামাত্র প্রহরী জানালা দিয়া হাত বাড়াইয়া আমার গলার হাঁসুলি ধরিয়া এমনি টান মারিল যে, জানালার লোহার গরাদের উপর আমার মাথা ঠুকিয়া গেল। রাগটা এত প্রচণ্ড হইয়া উঠিল যে, লোকটা যদি কুঠরীর ভিতরে থাকিত তাহা হইলে হয়ত তাহার মাথার মুগুর বসাইয়া দিতাম। কিছু একটা না করিলেই নয়, কিন্তু করিবই বা কি? শেষে তাহার হাতখানা চাপিয়া ধরিয়া এমনি কামড় বসাইয়া দিলাম যে তাহার হাত কাটিয়া ঝর ঝর করিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। হাত লইয়া সে জেলারের কাছে নালিশ করিতে ছুটিল কিন্তু রাস্তার মাঝখানে আমাদের বন্ধু একজন হিন্দু পেটি অফিসার ( petty officer) তাহাকে কতকটা ভাল কথা বলিয়া কতকটা ভয় দেখাইয়া ফিরাইয়া লইয়া আসিল। প্রহরীদের সঙ্গে আরও ভুএকবার এইরূপ ঝগড়া হইয়াছে কিন্তু দেখিয়াছি যাহাদের নিকট তাহারা হারিয়া যায় তাহাদেরই ভক্ত হইয়া পড়ে। দুর্বলের উপর নির্যাতন সব জায়গায়ই হয় আর সে নির্যাতন পাঠানেরাই বেশী করে। কিন্তু পাঠানদের সহস্র দোষ সত্ত্বেও একটা গুণ দেখিয়াছি যে, যাহাকে একবার বন্ধু বলিয়া স্বীকার করিয়া লয়, নিজের মাথায় বিপদ লইয়াও তাহার সাহায্য করে। তাহাদের মধ্যে নৃশংসতা যথেষ্ট আছে, কিন্তু তাহাদের মনের দৃঢ়তা আমাদের দেশের লোকের চেয়ে অধিক। ধর্ম ঘটের সময় জেলার আমাদের দাবাইবার জন্য আমাদের উপর পাঠান প্রহরী লাগাইয়া দিত কিন্তু পাঠান অনেক সময় বিশেষ ভাবে আমাদের বন্ধু হইয়া উঠিত! জেলে দলাদলির অন্ত নাই। প্রবল দলকে আপনাদের স্বপক্ষে রাখিয়া আমরা আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা করিতাম।
হিন্দুমুসলমানের ভেদটা জেলখানার মধ্যে মাঝে মাঝে তীব্র হইয়া উঠিত। স্বধর্মীদের উপর টানটা মুসলমানদের মধ্যে স্বভাবতঃই একটু বেশী; সেজন্য জেলের মধ্যে কর্তৃত্বের জায়গা-গুলা যাহাতে মুসলমানদের হাতেই থাকে এজন্য তাহারা সর্বদা চেষ্টা করিত। অধিকন্তু নানা প্রলোভন দেখাইয়া তাহারা হিন্দুকে মুসলমান করিতে পারিলেও ছাড়িত না। কোনরূপে হিন্দুকে মুসলমান ভাণ্ডারীর খানা খাওয়াইয়া তাহার গোঁফ ছাটিয়া দিয়া একবার কলমা পড়াইয়া লইতে পারিলে বেহেস্তে যে খোদাতাল্লা তাহাদের জন্য বিশেষ আরামের ব্যবস্থা করিবেন এ বিশ্বাস প্রায় সকল মোল্লারই আছে। আর কালাপানির আত ভক্তদের মধ্যে মোল্লারও অসদ্ভাব নাই। কাজে কাজেই হিন্দুর ধর্মান্তর গ্রহণ লইয়া উত্তর সম্প্রদায়ের ধর্মধ্বজীদের মধ্যে প্রোয়ই ঝগড়াঝগড়ি চলিত i একজন হিন্দু বিশেষতঃ ব্রাহ্মণের ছেলে যদি খানি পিষিতে যায় তাহা হইলে পাঁচ সাতজন মোল্লা মিলিয়া তাহাকে নানারূপ বিপদে ফেলিবার ষড়যন্ত্র করে আর সে যদি মুসলমান হয় তাহা হইলে যে কিরূপ পরম সুখে দিন কাটাইতে পারিবে সে সম্বন্ধে নানারূপ প্রলোভন দেখায়। মুসলমানদের মত আর্যসমাজীরাও জেলের মধ্যে প্রচার কার্য্য চালাইতে থাকে এবং ধর্ম ভ্রষ্ট হিন্দুকে আর্যসমাজভুক্ত করিয়া লইবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে। সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে সেরূপ কোন আগ্রহ দেখা যায় না। তাহারা দল হইতে বাহির করিয়া দিতেই জানে, নূতন কাহাকেও দলে টানিয়া লইবার সামর্থ্য তাহাদের নাই। এই দলাদলির ফলে আর কিছু হোক আর নাই হোক, হিন্দুর টিকি ও মুসলমানের দাড়ী সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়া গিয়াছে। বাংলার নিম্নশ্রেণীর মধ্যে যাহারা দেশে কস্মিনকালেও টিকি রাখে না তাহারাও কালাপানিতে গিয়া হাত দেড়েক টিকি গজাইয়া বসে আর মুসলমানেরা তুলিয়া দুলিয়া “আলীর সহিত হনুমানের যুদ্ধ” “শিবের সহিত মহম্মদের লড়াই” “সোনাভান বিবির কেচ্ছা” প্রভৃতি অদ্ভুত অদ্ভুত উপাখ্যান পাঠ করিয়া পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করিতে লাগিয়া যায়। আমরা হিন্দু মুসলমান সকলকার হাত হইতেই নির্বিচারে রুটি খাই দেখিয়া মুসলমানেরা প্রথম প্রথম আমাদের পরকালের সদগতির আশায় উল্লসিত হইয়া ‘উঠিয়াছিল, হিন্দুরা কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল; শেষে বেগতিক দেখিয়া উভয় দলই স্থির করিল যে আমরা হিন্দুও নই মুসলমানও নই—আমরা বাঙালী। রাজনৈতিক কয়েদী মাত্রেরই শেষে সাধারণ নাম হইয়া উঠিল—বাঙালী।
দুঃখের কথা, লজ্জার কথাও বটে যে দলাদলিটা শুধু সাধারণ কয়েদীদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না; রাজনৈতিক কয়েদীদের মধ্যেও দলাদলির অভাব ছিল না। আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইবার সঙ্গে সঙ্গেই দলাদলির বেশ পুষ্টি হইতে লাগিল। যাঁহারা টলষ্টয়ের (Tolstoy) Resurrection নামক গ্রন্থখানি পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা জানেন যে, সে পুস্তকখানিতে বিপ্লবপন্থী-দিগের মনস্তত্ত্বের কিরূপ চিত্র বর্ণিত হইয়াছে। সে বর্ণনা যে কত সত্য তাহা নিজেদের দলের দিকে লক্ষ্য করিয়াই বুঝিতে পারিলাম। বাস্তবিকই সাধারণ বিপ্লবপন্থীরা নিজেদের একটু বড় করিয়াই দেখে। একটু অহঙ্কার ও আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বেশী করিয়া থাকে বলিয়াই হয়ত তাহারা কাজে অগ্রসর হইতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় তাহাদের চরিত্রে যতখানি তীব্রতা থাকে ততখানি গভীরতা থাকে না। তাহারা সাধারণত: কল্পনাপ্রবণ ও একদেশদর্শী; এবং তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই neurotic । রাজনৈতিক কয়েদীদের মধ্যে নূতন ছেলে আসিলেই আমি সন্ধান লইতাম যে তাহাদের পিতৃকুলে বা মাতৃকূলে তিন পুরুষের মধ্যে কেহ বায়ুরোগগ্রস্ত ছিলেন কি না? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বায়ুরোগের ইতিহাস পাইতাম। আমার পুরাতন বন্ধুবৰ্গ কথাটা শুনিয়া আমার উপর চটিয়া যাইবেন, কিন্তু ক্রোধের সেরূপ অপব্যয় করিবার কোনও কারণ নাই, কারণ আমিও তাঁহাদের দলভুক্ত এবং আমার পিতামহী বায়ু-রোগগ্রস্ত ছিলেন।
বিপ্লবপন্থীদিগের এই চরিত্রগত বিশেষত্ব জেলের বাহিরে কাজকর্মের উত্তেজনায় অনেক সময় চাপা পড়িয়া থাকে কিন্তু জেলের ভিতর অন্যরূপ উত্তেজনার অভাবে তাহা নানারূপ নিরর্থক দলাদলির রূপ ধরিয়া দেখা দেয়। কোন্ দল বেশী কাজ-করিয়াছে, কোন দল ফাঁকি দিয়াছে, কোন নেতা সাঁচ্চা আর কোন্ নেতা ঝুটা—এরূপ গবেষণার আর অন্ত ছিল না! এবং প্রায় প্রত্যেক দলই আপনাকে ‘আদি ও অকৃত্রিম’ বলিয়া প্রমাণ করিবার জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে সত্য মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিত। এই প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টার সহিত প্রাদেশিক ঈর্ষা মিশিয়া ব্যাপারটাকে বেশ বীভৎস করিয়া তুলিত। জাতীয় সম্মিলন ও ভারতীয় একতার দোহাই দিয়া কত অদ্ভুত জিনিস যে প্রচার করিবার চেষ্টা হইতু তাহার আর ইয়ত্তা নাই। মারাঠী নেতারা মাঝে মাঝে প্রমাণ করিতে বসিতেন যে যেহেতু বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরম্” গানে সপ্তকোটী কণ্ঠের কথা আছে, ত্রিশ কোটী কণ্ঠের কথা নাই, এবং যেহেতু বাঙালী কবি লিখিয়াছেন “বঙ্গ আমার, জননী আমার” সেই হেতু, বাঙালীর জাতীয়তাবোধ অতি সঙ্কীর্ণ। একজন পাঞ্জাবী আর্যসমাজী নেতা তাঁহার বাঙালী-বিদ্বেষ প্রচার করিবার আর কোন রাস্তা না পাইয়া একদিন বলিয়াছিলেন যে, যেহেতু রামমোহন রায় এদেশে ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন করিবার জন্য ইংরাজ গবর্ণমেণ্টকে পরামর্শ দিয়াছিলেন সেহেতু তিনি দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। এরূপ যুক্তির পাগলা গারদ ভিন্ন আর অন্য উত্তর নাই। মারাঠী নেতাদের মনে এই বাঙালী-বিদ্বেষের ভাবটা কিছু বেশী প্রবল বলিয়া মনে হয়। ভারতবর্ষে যদি একতা স্থাপন করিতে হয় তাহা হইলে তাহ! মারাঠার নেতৃত্বেই হওয়া উচিত—ইহাই যেন তাঁহাদের মনোগত ভাব। হিন্দুস্থানী ও পাঞ্জাবীরা গোঁয়ার, বাঙালী বাক্যবাগীশ, মাদ্রাজী দুর্বল ও ভীরু—একমাত্র পেশোয়ার বংশধরেরাই মানুষের মত মানুষ—নানা যুক্তি তর্কের ভিতর দিয়া এই সুরই ফুটিয়া উঠিত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন