শুধু কাজ লইয়া যাহাদের একতার বাঁধন, কাজ ফুরাইলেই তাহাদের একতাও ফুরাইয়া আসে। ধরা পড়িবার পর আমাদের কতকটা সেই দশা ঘটিয়াছিল। যাঁহারা বিপ্লবপন্থী তাঁহারা সকলেই এক ভাবের ভাবুক নহেন।
দেশের পরাধীনতা দূর হওয়া সকলেরই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু স্বাধীন হইবার পর দেশকে কিরূপ ভাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে তাহা লইয়া যথেষ্ট মতভেদ ছিল। তাহার পর আমরা যে ধরা পড়িলাম, তাহা কতটা আমাদের নিজেদের দোষে, আর কতটা ঘটনাচক্রের দোষে—তাহা লইয়াও আমাদের মধ্যে তীব্র সমালোচনা চলিত! বাহিরে কাজকর্মের তাড়ায় যে সমস্ত ভেদ চাপা পড়িয়া থাকিত, ধরা পড়িবার পর তাহা ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল।
একদল শুধু ধর্মচর্চা লইয়াই থাকিতেন; আর যাঁহারা রাজনীতির উপাসক তাঁহারা ঐ দলকে ঠাট্টা করিয়া দিন কাটাইতেন। ঐ সময় আমাদের মধ্যে হেমচন্দ্ৰ “ভক্তিতত্ত্ব কুজঝটিকা” কথাটার সৃষ্টি করেন। হেমচন্দ্রের বিশ্বাস যে ভক্তিতত্ত্বে প্রবেশ লাভ করিলে মানুষের বুদ্ধি ঘোলাটে হইয়া যায়, আর সে কাজের বাহির হইয়া পড়ে। ডকের মধ্যে বসিয়া উভয় দলেরই বিচার কার্য চলিত। দেবব্রত ধর্মতত্ত্ব ব্যাখা করিতেন, হেমচন্দ্র ধার্মিকদিগের নামে ছড়া ও গান বাঁধিতেন। বারীন্দ্র এককোণে দু’একটি অনুচর লইয়া কখনও বা ধর্মালোচনা করিত কখনও বা চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিত। আমি উভয় দলেরই রসাস্বাদন করিয়া ফিরিতাম।
এই হট্টগোল ও দলাদলির মধ্যে একেবারে নিশ্চল স্থাণুর মত বসিয়া থাকিতেন— অরবিন্দ বাবু। কোন কথাতেই হাঁ, না, কিছুই বলিতেন না। জেলের প্রহরীদের নিকট হইতে তাঁহার আচরণ সম্বন্ধে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনিতে পাইতাম। কেহ বলিত তিনি রাত্রে নিদ্রা যান না, কেহ বলিত তিনি পাগল হইয়া গিয়াছেন! ভাত খাইবার সময় আরসুলা টিকটিকি ও পিঁপড়াদের ভাত খাইতে দেন;
স্নান করেন না, মুখ ধোন না, কাপড় ছাড়েন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারটা জানিবার জন্য বড় কৌতূহল হইত; কিন্তু তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার সাহস কুলাইত না। মাথায় মাখিবার জন্য আমরা কেহই তেল পাইতাম না; কিন্তু দেখিতাম যে অরবিন্দ বাবুর চুল যেন তেলে চক্চক্ করিতেছে। একদিন সাহসে ভর করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—“আপনি কি স্নান করবার সময় মাথায় তেল দেন?” অরবিন্দ বাবুর উত্তর শুনিয়া চমকিয়া গেলাম। তিনি বলিলে –”আমি ত স্নান করি না।” জিজ্ঞাস করিলাম—“আপনার চুল তবে অত চক্চক্ হয় কি করে?” অরবিন্দ বাবু বলিলেন—“সাধনের সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরে কতকগুলা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আমার শরীর থেকে চুল বসা ( fat ) টেনে নেয়।”
দুই একজন সন্যাসীর ওরূপ হইতে দেখিয়াছি; কিন্তু ব্যাপারটা ভাল করিয়া বুঝি নাই। তাহার পর ডকের মধ্যে একদিন বসিয়া থাকিতে থাকিতে লক্ষ্য করিলাম যে অরবিন্দ-বাবুর চক্ষু যেন কাচের চক্ষুর মত স্থির হইয়া আছে; তাহাতে পলক বা চাঞ্চল্যের লেশ মাত্র নাই। কোথায় পড়িয়াছিলাম যে চিত্তের বৃত্তি একেবারে নিরুদ্ধ হইয়া গেলে চক্ষে ঐরূপ লক্ষণ প্রকাশ পায়। দুই একজনকে তাহা দেখাইলাম; কিন্তু কেহই অরবিন্দ বাবুকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিল না। শেষে শচীন আস্তে আস্তে তাঁহার কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘আপনি সাধন করে কি পেলেন? অরবিন্দ সেই ছোট ছেলেটীর কাঁধের উপর হাত রাখিয়া হাসিয়া বলিলেন,–”যা খুঁজছিলাম, তাই পেয়েছি।”
তখন আমাদের সাহস হইল, আমরা তাঁহার চারিদিকে ঘিরিয়া বসিলাম। অন্তর্জগতের যে অপূর্ব কাহিনী শুনিলাম তাহা যে বড় বেশী বুঝিলাম তাহা নহে; তবে এই ধারণাটী হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়া গেল যে, এই অদ্ভুত মানুষটীর জীবনে একটা সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। জেলের মধ্যে বৈদান্তিক সাধনা শেষ করিয়া তিনি যে সমস্ত তান্ত্রিক সাধনা করিয়াছিলেন তাহারও কতক কতক বিবরণ শুনিলাম। জেলের বাহিরে বা ভিতরে তাঁহাকে তন্ত্রশাস্ত্র লইয়া কখনও আলোচনা করিতে দেখি নাই। এ সমস্ত গুহ্য সাধনের কথা তিনি কোথায় পাইলেন জিজ্ঞাসা করায় অরবিন্দ বাবু বলিলেন যে, একজন মহাপুরুষ সূক্ষ্মশরীরে আসিয়া তাঁহাকে এই সমস্ত বিষয় শিক্ষা দিয়া যান। মোকর্দমার ফলাফলের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন— “আমি ছাড়া পাব।”
ফলে তাহাই হইল। মোকর্দমা আরম্ভ হইবার এক বৎসর পরে যখন রায় বাহির হইল তখন দেখা গেল সত্যসত্যই অরবিন্দ বাবু মুক্তি পাইয়াছেন! উল্লাসকর ও বারীদের ফাঁসির, আর দশজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের হুকুম হইল। বাকি অনেকের পাঁচ সাত দশ বৎসর করিয়া জেল বা দ্বীপান্তর বাসের আদেশ হইল। ফাঁসির হুকুম শুনিয়া উল্লাসকর হাসিতে হাসিতে জেলে ফিরিয়া আসিল; বলিল,—“দায় থেকে বাঁচা গেল।” একজন ইউরোপীয় প্রহরী তাহা দেখিয়া তাঁহার এক বন্ধুকে ডাকিয়া বলিলেন— Look Look, the man is going to be hanged and he laughs! (দেখ, লোকটার ফাঁসি হইবে তবু সে হাসিতেছে)। তাঁহার বন্ধুটি আইরিশ; তিনি বলিলেন— “Yes, I know; they all laugh at death” (হাঁ, আমি জানি; মৃত্যু তাহাদের কাছে পরিহাসের জিনিস। )
১৯০৯ এর মে মাসে রায় বাহির হইল। আমরা পনের ষোল জন মাত্র বাকি রহিলাম; বাকি সবাই হাসিতে হাসিতে বাহিরে চলিয়া গেল। আমরাও হাসিতে হাসিতে তাহাদের বিদায় দিলাম; কিন্তু সে হাসির তলায় তলায় একটা যেন বুকফাটা কান্না জমাট বাঁধিয়া উঠিতেছিল। জীবনটা যেন হঠাৎ অবলম্বনশূন্য হইয়া পড়িল। পণ্ডিত হৃষীকেশ মূর্তিমান বেদান্তের মত বলিয়া উঠিলেন—“আরে কিছু নয়, এ একটা দুঃস্বপ্ন।” হেমচন্দ্ৰ বুকে সাহস বাঁধিয়া বলিলেন—“কুচ পরোয়া নেহি, এ ভি গুঞ্জর যায়েগা” ( কোন ভয় নেই, এদিনও কেটে যাবে ) বারীন্দ্র ফাঁসির হুকুম শুনিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল—“ সেজদা ( অরবিন্দ) বলে দিয়েছে, ফাঁসি আমার হবে না।” আমিও সকলকার দেখাদেখি হাসিলাম; কিন্তু বীরের মন যে ধাতু দিয়া গঠিত হয়, আমার মন যে সে ধাতু দিয়া গঠিত নয় তাহা এইবার বেশ ভাল করিয়াই দেখিতে পাইলাম। মনটা যেন নিতান্ত অসহায় বালকের মত দিশেহারা হইয়া উঠিল। বাকি জীবনটা জেলখানাতেই কাটাইয়া দিতে হইবে! উঃ! এর চেয়ে যে ফাঁসি ছিল ভাল। ভগবানের দোহাই দিয়া যে নির্বিবাদে দুঃখকষ্ট হজম করিব সে উপায়ও আমার ছিল না। ভগবানের উপর বিশ্বাসটা অনেক দিন হইতেই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। ছেলেবেলা একবার বৈরাগ্যের ঝুলি কাঁধে লইয়া সাধু সাজিতে বাহির হইয়াছিলাম। তখন ভগবানের উপর ভক্তি, বিশ্বাস ও নির্ভরের ভাব বেশ একটা ছিল। মায়াবতীর মাঠে স্বামী স্বরূপানন্দের নিকট নিগুণ ব্রহ্মবাদে দীক্ষিত হইবার পর ধীরে ধীরে সে ভক্তি ও বিশ্বাস কোথায় উড়িয়া গেল! স্বামিজী বিদ্রূপ ও যুক্তিতর্কের তীক্ষ্ণবাণে বিদ্ধ করিয়া যেদিন আমার ভগবানটিকে নিহত করেন সে দিনের কথা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে।
এই বিশাল মায়া-সমুদ্রর মাঝখানে একাকী ডুব সাঁতার কাটিতে কাটিতে সম্পূর্ণ হিমাঙ্গ হইয়া ওপারে নির্বিকল্প সমাধিতে উঠিতে হইবে ভাবিয়া আমার রক্ত একেবারে শীতল হইয়া গিয়াছিল! নির্বিকল্প সমাধির মধ্যে ডুব দিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া থাকার নামই মুক্তি-এ তত্ত্ব আমার মাথার মধ্যে বেশী দিন রহিল না। চরম তত্ত্ব বলিয়া একটা কিছু মানুষ আপনার মধ্যে পাইয়াছে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ উপস্থিত হইল! মনে হইতে লাগিল নির্বিকল্প সমাধি হইতে আরম্ভ করিয়া জাগ্ৰত অবস্থা পর্যন্ত সব অবস্থাগুলাই অনন্তের এক একটা দিক মাত্র; এ দুই অবস্থার উপরে ও নীচে এরূপ অনন্ত অবস্থা পড়িয়া আছে। সেই অনন্তের মধ্যে এমন একটা কিছু সত্য আছে যাহা মানুষের জীবনে কর্মরূপে আপনাকে অভিব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতেছে। সুতরাং জীবনকে ছাড়িয়া পলাইতে যাইব কেন? সমাধির চেয়ে কর্ম কিসে ছোট?
কর্মকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য করিয়া স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়াছিলাম। শ্ৰীযুক্ত লেলে আসিয়া যখন আমাদের মধ্যে ভক্তিমূলক সাধনা প্রবর্তিত করিতে চেষ্টা করেন তখন মহাবিজ্ঞের ন্যায় তাঁহার ভক্তিবাদকে হাসিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলাম। সবটাই যখন সেই অনন্তের মূর্তি, তখন ভগবানের যে রূপ জগতে মূর্ত তাহা ছাড়িয়া অন্য রূপ ধ্যান করিবার সার্থকতা কি? লেলে তখন শুধু এই কথাটা বলিয়াছিলেন— “যাহা বলিতেছ তাহা যদি বুঝিয়া থাক, তাহা হইলে আর আমার বুঝাইবার কিছু নাই; কিন্তু অদ্বৈতের মধ্যে দ্বৈতেরও স্থান আছে, এ কথা ভুলিওনা।”
আজ যখন বিধাতা জোর করিয়া কর্মক্ষেত্র হইতে অপসারিত করিয়া দিলেন, তখন নিজের মধ্যে কোন অবলম্বনই খুঁজিয়া পাইলাম না। একটা অজ্ঞাতপূর্ব আশ্রয় পাইবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠিলাম : প্রাণটা কাতর হইয়া বলিতে লাগিল—“রক্ষা কর, রক্ষা কর।”
বিপদে পড়িলে আর কিছু লাভ না হোক, মানুষ নিজেকে চিনিবার অবসর পায়। কঠোর নিষ্পেষণের মধ্য দিয়া ধীরে ধীরে তাহাই আরম্ভ হইল। সেসন্স কোর্টের রায় বাহির হইবার পর হইতেই আমাদের পায়ে বেড়ী লাগাইয়া কুঠরীর মধ্যে ফেলিয়া রাখা হইল। সমস্ত দিন চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার সময় এক একবার মনে হইত যেন পাগল হইয়া গেলাম। মাথার ভিতর উন্মত্ত চিন্তার তবঙ্গ যেন মাথা ঘামাইয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিতেছে। সমস্ত দিন কাহারও সহিত কথা কহিবার জো নাই।
একদিন সন্ধ্যার সময় এইরূপ চুপ করিয়া বসিয়া আছি এমন সময় পাশের কুঠরীতে একটি ছেলে চীৎকার করিয়া গান গাহিয়া উঠিল। তাল মান লয়ের সহিত সে গানের বড় একটা সম্বন্ধ নাই; কিন্তু সে গান শুনিয়া খুব এক চোট হো হো করিয়া হাসিয়া আর মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া আমার প্রচণ্ড মাথাধরা ছাড়িয়া গিয়াছিল তাহা বেশ মনে পড়ে। গান শুনিয়া চারিদিক হইতে ইউরোপীয় প্রহরীরা ছুটিয়া আসিল; এবং পরদিন সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের বিচারে বেচারার চারিদিন চালগুড়া সিদ্ধ (penal diet) খাইবার ব্যবস্থা হইল।
আর একটি ছেলে একদিন দেওয়াল হইতে চুণ খসাইয়া দরজার গায়ে লিখিয়া রাখিল—“Long live Kanailal!” তাহারও চারিদিন সাজা হইল।
প্রহরীদের মধ্যে সকলেই আমাদের জব্দ করিবার চেষ্টায় ফিরিত। কিন্তু দু একজন বেশ ভালমানুষও ছিল। আমাদের মধ্যে যাহারা সাজা পাইত তাহাদের জন্য একজন ইউরোপীয় প্রহরীকে পকেটে করিয়া কলা লুকাইয়া আনিতে দেখিয়াছি। চুপি চুপি কলা খাওয়াইয়া বেচারা পকেটে পুরিয়া খোসাগুলি বাহিরে লইয়া যাইত।
একজন লম্বা চওড়া হাইলাণ্ডার প্রহরী মাঝে মাঝে আমাদের জ্বালাতন করিয়া আপনার প্রহরীজন্ম সার্থক করিত। আমরা তাহার নাম দিয়াছিলাম “Rufian warder”; মাঝে মাঝে সে আমাদের বক্তৃতা দিয়া বুঝাইয়া দিত যে, সে ও তাহার স্বজাতিরা ভারতবর্ষকে সভ্য করিবার জন্য এখানে আসিয়াছে। কিন্তু সকলের চেয়ে মিষ্টমুখ সয়তান ছিল চিহ্ন, ওয়ার্ডার স্বয়ং। সে আবার মাঝে মাঝে ধর্মের তত্ত্বকথাও আমাদের শুনাইত; এবং আশা দিত যে, জীবনের বাকী কয়টা দিন সৎ হইয়া চলিলে স্বর্গে গিয়া আমরা ইংরাজের মত ব্যবহারও পাইতে পারি। হায়রে ইংরাজের স্বর্গ! জেলখানার মধ্যে গালাগালি, মারামারি সবই সহ্য হয়; কিন্তু ইহাদের মুখের ধর্মের বক্তৃতা সহ্য করা দায়!
আমাদের মধ্যে হেমচন্দ্র চিত্র-বিদ্যায় বেশ নিপুণ। তিনি দেওয়ালের চুন, ইটের গুড়া ঘসিয়া নানারূপ রং প্রস্তুত করিয়া সুন্দর সুন্দর ছবি দেওয়ালের গায়ে আঁকিয়া রাখিতেন! প্রহরীদের অত্যাচার হইতে বাঁচিবার জন্য মাঝে মাঝে কাগজের উপর নখ দিয়া নানারূপ ছবিও তাহাদিগকে আঁকিয়া দিতেন।
যাঁহারা চিত্রবিদ্যায় নিপুণ নন, তাঁহারা মাঝে মাঝে দেওয়ালের গায়ে কবিতা লিখিয়া মনের খেদ মিটাইতেন। একদিন এক কুঠরীর মধ্যে গিয়া দেখিলাম, একজন অজ্ঞাতনামা কবি দেওয়ালের গায়ে দুঃখ করিয়া লিখিয়াছেন—
ছিঁ ড়িতে ছিঁড়িতে পাট      শরীর হইল কাঠ
সোনার বরণ হৈল কালি।
প্রহরী যতেক বেটা     বুদ্ধিতে বোকা পাঁটা
দিন রাত দেয় গালাগালি।।
আমাদের সে সময় কাজ ছিল পাট-ছেঁড়া।
মাঝে লাঝে এক একটি বেশ ভাল কবিতাও নজরে পড়িত। আমার মনের ফাঁদে কবিতা প্রায় ধরা পড়ে না; কিন্তু এই ছুইছত্র কিরূপে আটকাইয়া ছিল—
“রাধার দুটী রাঙ্গা পায়
অনন্ত পড়েছে ধরা—
উঠে ভাসে কত বিশ্ব
চিদানন্দে মাতোয়ারা।”
হায়রে মানুষের প্রাণ! জেলের কুঠরীর মধ্যে বন্ধ থাকিয়াও রাধার দুটি রাঙ্গা পায় আছাড় খাইয়া পড়িতেছে!
সেসন্স কোর্টে রায় বাহির হইবার পর হইতেই হাইকোর্টে আমাদের আপিলের শুনানি চলিতেছিল। নভেম্বর মাসে রায় বাহির হইল। উল্লাসকর ও বারীন্দ্রের ফাঁসির হুকুম বন্ধ হইয়া যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের হুকুম হইল। অনেকের কারাদণ্ড কমিয়া গেল, কেবল হেমচন্দ্রের ও আমার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড পূর্ববৎই রহিয়া গেল।
পাছে দড়ি পাকাইয়া ফাঁসি খাই সেই ভয়ে আমাদের পাট ছিঁড়িতে দেওয়া বন্ধ হইয়া গেল।
অল্পদিনের মধ্যেই যাহারা দীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত, তাহারা ভিন্ন অপর সকলকে ভিন্ন ভিন্ন জেলে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। আমরা আন্দামানের জাহাজের প্রত্যাশায় বসিয়া রহিলাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন