আর্থার কোনান ডয়েল
টেবিলের ওপরে একটা কাচের পাত্রে কী একটা তরল রাসায়নিক পদার্থ ফুটছিল। পদার্থটার বেজায় বিটকেল গন্ধ। হোমস সেই ফুটন্ত পদার্থটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে ছিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, হোমসের লম্বা শরীরটা ক্রমেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। ওর মাথা বুকের কাছে নেমে এসেছে। পেছন থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন একটা অদ্ভুত অচেনা পাখি স্থির দৃষ্টিতে কিছু একটা লক্ষ করছে। অনেকক্ষণ একই ভাবে থাকবার পর হোমস হঠাৎ বলে উঠল, “ওয়াটসন, তুমি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসার বাজারে টাকা লগ্নি করবে না বলেই শেষ পর্যন্ত ঠিক করলে?”
আমি চমকে উঠলাম। তাজ্জব কাণ্ড। হোমসের এই অদ্ভুত, যা নাকি প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার কথা আমি জানি। তা সত্ত্বেও আমার মনের এই গোপন কথাটা যে ও কী ভাবে টের পেল, তা ভেবে ঠিক করে উঠতে পারলাম না।
“তুমি কী করে ব্যাপারটা জানলে?” আমি হোমসকে জিজ্ঞেস করলাম।
হোমস যে-টুলের ওপর বসে ছিল সেটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিল। ওর হাতে একটা টেস্টটিউব। টিউবের থেকে হুহু করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। খুশিতে হোমসের চোখদুটো চিকচিক করছে। বুঝলাম আমার কথায় ভারী মজা পেয়েছে।
“তা হলে ওয়াটসন স্বীকার করছ তো, যে, বেকুব বনে গেছ?”
“স্বীকার করছি।”
“আমার উচিত তুমি যে বেকুব বনে গেছ, এই কথা একটা কাগজে লিখিয়ে নিয়ে তোমাকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া।”
“এ কথা বলছ কেন?”
বলছি এই জন্য যে, পাঁচ মিনিট পরেই তুমি বলবে যে ব্যাপারটা যাকে বলে জলবৎ তরল সোজা।”
“না আমি কখনওই তা বলব না।”
টেস্টটিউবটা ঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে হোমস বলতে আরম্ভ করল। ওর হাবভাব, বলার ধরনধারণ দেখে মনে হল যেন কলেজের অধ্যাপক কেমিস্ট্রির ক্লাসে ছেলেদের সামনে বক্তৃতা করছেন। “দেখো ওয়াটসন, যে-কোনও একটা সূত্র থেকে একটা সিদ্ধান্ত করতে পারলে সেই সিদ্ধান্ত থেকে আর-একটা এবং তার থেকে আরও একটা এবং এই ভাবে পর পর অনেকগুলো সিদ্ধান্ত করাটা মোটেই কোনও শক্ত কাজ নয়। এই সিদ্ধান্তগুলোর প্রত্যেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই পর্যন্ত করে যদি প্রথম সূত্রটা আর শেষ সিদ্ধান্তটা ঠিক রেখে মধ্যের সব সিদ্ধান্তকে উড়িয়ে দেওয়া যায়, আর সেই সূত্রটি এবং শেষ সিদ্ধান্তটি কারও কাছে বলা যায় তো, সে তোক অবাক হয়ে যাবেই যাবে। এখন তোমার বাঁ হাতের তর্জনী আর বুড়োআঙুলের মাঝখানটা ভাল করে দেখলেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনিতে তুমি তোমার জমানো অর্থ লগ্নি করতে চাও না।”
“এ দুটোর মধ্যে সম্বন্ধটা যে কী তা বুঝতে পারলাম না।”
“না বুঝতে পারাটাই স্বাভাবিক। সম্বন্ধটা আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। মাঝখানের হারানো সূত্রগুলো বলে দিলেই বুঝতে পারবে। (১) কাল রাত্রে যখন তুমি ক্লাব থেকে ফিরে এলে তখন তোমার বাঁ হাতের বুড়োআঙুল আর তর্জনীর মধ্যে দাগ লেগে ছিল। (২) বিলিয়ার্ড খেলার সময় কিউকে সোজা রাখবার জন্যে তুমি ওইখানে চক রেখে দাও। (৩) তুমি থার্স্টন ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলো না। (৪) সপ্তাহ চার আগে, তুমি আমাকে বলেছিলে যে, থার্স্টন দক্ষিণ আফ্রিকার একটা সম্পত্তির মালিকানা পেতে পারে, যদি তুমি তার অংশীদার হও। (৫) তোমার চেকবইটা আমার ড্রয়ারে চাবি বন্ধ আছে। আর সে চাবি তুমি চাওনি। (৬) এই ব্যাপারে তুমি তোমার টাকা খাটাতে চাও না।”
“সব ব্যাপারটাই অত্যন্ত সহজ সরল,” আমি বললাম।
একটু বিরক্ত হয়ে হোমস বলল, “সেই কথাই তো বললাম। প্রত্যেক সমস্যাকেই বুঝিয়ে বললে অত্যন্ত সহজ সরল বলে মনে হয়। আচ্ছা, তোমাকে একটা সমস্যা দিচ্ছি। দেখো, এটার কোনও অর্থ বের করতে পারো কিনা।”
টেবিলের ওপরে একটা কাগজ ছুড়ে দিয়ে হোমস তার রাসায়নিক পরীক্ষায় মন দিল। আমি কাগজটা তুলে নিলাম। কাগজটা দেখে আমি তো থ।’ কতগুলো ছবি আঁকা। তার না আছে মাথা, না আছে মুন্ডু।”
কাগজটা দেখে আমি বললাম, “এ কোনও ছোট ছেলে নিজের খেয়ালে এঁকেছে। এর কোনও মানে নেই।”
“তুমি তাই মনে করছ?”
“হ্যাঁ, এ ছাড়া আর কী? এর কোনও মানে আছে নাকি?”
“মানে আছে কি না তা জানবার জন্যে নরফোকের রিভলিং ম্যানরের মিঃ হিলটন ক্যুবিট খুবই আগ্রহী। এই কাগজটা সকালের প্রথম ডাকে এসেছে। মিঃ ক্যুবিট পরের ট্রেনেই এসে পড়বেন। ওই শোনো, ওয়াটসন, কে যেন দরজার বেল টিপলেন। ইনিই যদি সেই মিঃ হিলটন ক্যুবিট হন তা হলে আমি মোটেই আশ্চর্য হব না।”
সিঁড়িতে ভারী পায়ের ধপ ধপ শব্দ শুনতে পেলাম। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক। গায়ের রং টকটকে লাল। দাড়ি-গোঁফ নিঁখুত ভাবে কামানো। নীল উজ্জ্বল চোখ। দেখলেই বুঝতে পারা যায়, ভদ্রলোক এমন জায়গায় থাকেন সেখানে বেকার স্ট্রিটের মতো ধোঁয়াশা নেই। ভদ্রলোক ঘরে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ঘরের আবহাওয়াটাই যেন পালটে গেল। আমাদের সঙ্গে করমর্দন করে ভদ্রলোক যেই চেয়ারে বসতে গেলেন, অমনি তাঁর দৃষ্টি পড়ল টেবিলের ওপর রাখা সেই কাগজটার ওপর, যেটা আমি একটু আগেই দেখছিলাম।
ভদ্রলোক হোমসকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিঃ হোমস, এটার কোনও মানে বের করতে পারলেন কি? আমি শুনেছি আপনি যত উদ্ভট রহস্যের খোঁজ করে বেড়ান। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ রকম উদ্ভট রহস্যের সন্ধান আপনিও খুব বেশি পাননি। আমি কাগজখানা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে করে আপনি এর একটা হদিস করতে পারেন।”
হোমস বলল, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা যে একটু অদ্ভুত ধরনের তাতে কোনও সন্দেহই নেই। প্রথম বার দেখলে মনে হয়, কোনও ছোট ছেলে তার মনের খেয়ালে কাগজের ওপর এই নাচুনে লোকগুলোর ছবি এঁকেছে। সাধারণ ভাবে এই কাঁচা হাতের আঁকা ছবিগুলোর কোনও মানে আছে বলে মনে হয় না।…প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই কাগজটার ওপর আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?”
“মিঃ হোমস, আমি কোনও গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু আমার স্ত্রী দিচ্ছেন। এইটে পাবার পর থেকে তিনি ভয়ে একেবারে আধমরা হয়ে গেছেন। মুখে কিছু বলছেন না বটে, তবে তাঁর চোখ-মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি যে, তিনি ভয় পেয়েছেন। আর সেই জন্যই আমি এই ব্যাপারে ফয়সালা করতে চাই।”
হোমস সূর্যের আলোর সামনে কাগজটা তুলে ধরল। কাগজটা খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একটা পাতা। পেনসিলে আঁকা ছবিগুলো এমনি ভাবে সাজানো:

হোমস অনেকক্ষণ ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কাগজটা যত্ন করে তার পকেট-বইয়ের ভেতর মুড়ে রেখে দিল।
“মনে হচ্ছে, এই রহস্যটা সব দিক দিয়েই বেশ অভিনব আর চিত্তাকর্ষক তদন্ত হয়ে উঠবে। মিঃ ক্যুবিট, আপনার চিঠিতে আপনি আমাকে কিছু কিছু খবর দিয়েছেন। কিন্তু আমার এই বন্ধু ডঃ ওয়াটসন কিছুই জানেন না। আপনার সব কথা আপনি এঁর সামনে আবার বলেন যদি তো খুব ভাল হয়।”
হোমসের কথায় আমাদের অতিথি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “আমি মোটেই ভাল বক্তা নই। আমার কথা শুনতে শুনতে যদি আপনাদের মনে কোনও খটকা লাগে তো বলবেন। আমি যথাসম্ভব গুছিয়ে বলারই চেষ্টা করব।…গত বছর আমার বিয়ে হয়েছে। আমি সেই ঘটনা দিয়েই আমার কথা বলতে শুরু করি। তবে গোড়ায় একটা কথা পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই। আমি যাকে বলে ধনী লোক, তা নই, তবে রিডলিং থর্পে আমরা পাঁচশো বছর টানা বাস করে আসছি। ওই অঞ্চলে আমাদের চেয়ে মানী লোক আর কেউ নেই। বলতে গেলে গোটা নরফোকেই আমাদের নাম সকলে জানে। গত বছর জয়ন্তী উৎসব দেখবার জন্যে আমি লন্ডনে এসেছিলাম। আমি রাসেল স্কোয়ারে একটা বোর্ডিং হাউসে উঠেছিলাম। ওখানে উঠেছিলাম, কেন না আমাদের অঞ্চলের ভিকার পার্কার ওখানে ছিল। ওই বোর্ডিং হাউসে প্যাট্রিক, এলসি প্যাট্রিক নামে এক আমেরিকান তরুণীও ছিলেন। আমার সঙ্গে ওই তরুণীর আলাপ পরিচয় হয়। তারপর লন্ডনে থাকতে থাকতেই আমি ওকে বিয়ে করি। লন্ডন থেকে যখন আমি নরফোকে ফিরে এলাম, তখন আমি একজন রীতিমতো বিবাহিত ভদ্রলোক। আপনি হয়তো ভাবছেন যে, এই ভাবে বিয়ে করাটা আমার পক্ষে ঠিক হয়নি। আমার বংশগৌরবের কথা সকলেই জানে, আর এই তরুণী তো যাকে বলে অজ্ঞাতকুলশীলা। কিন্তু যদি এলসির সঙ্গে আপনার কখনও সাক্ষাৎ হয়, তো আপনি বুঝতে পারবেন কেন আমি তাকে বিয়ে করেছি।
“এ ব্যাপারে এলসিও আমার সঙ্গে খোলাখুলি ব্যবহার করেছে। সে আমাকে বার বার সবকিছু বিচার বিবেচনা করে দেখতে বলেছিল। সে আমাকে বলেছিল, ‘এক সময় আমার জীবনে এমন কিছু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল, যারা মোটেই ভাল লোক নয়। তাদের কথা আমি একদম ভুলে যেতে চাই। সত্যি কথা বলতে কী আমি আমার অতীত জীবনের সবকিছুই ভুলে যেতে চাই। পুরনো দিনের কথা মনে করলে আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি যদি আমাকে বিয়ে করো তো এ কথা বলতে পারি যে, আমার জন্যে তোমাকে কখনও লজ্জা পেতে হবে না। তবে আমার অতীত-জীবন সম্বন্ধে তুমি কোনও দিন কোনও কথা জানতে চেয়ো না। যদি আমার কথা মেনে নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না হয়, তো তুমি একাই নরফোকে ফিরে যাও। আমি যেমন একলা আছি তেমনই একলাই থাকব।’…বুঝলেন, আমাদের বিয়ের ঠিক আগের দিন এলসি আমাকে এই সব কথা বলল। আমি বললাম যে, আমি তার সব কথায় রাজি আছি। আজ পর্যন্ত আমি আমার কথার খেলাপ করিনি।
“আমাদের প্রায় এক বছর হল বিয়ে হয়েছে। আমরা বেশ সুখে শান্তিতেই আছি। কিন্তু মাসখানেক আগে, জুন মাসের শেষাশেষি, প্রথম গোলমালের সূত্রপাত হল। একদিন আমেরিকা থেকে আমার স্ত্রী’র নামে একটা চিঠি এল। আমি আমেরিকার ডাকটিকিট নিজে দেখেছি। চিঠিটা পেয়েই আমার স্ত্রী একদম ভয়ে কাঠ। চিঠিটা পড়েই সে ফায়ারপ্লেসের আগুনে ছুড়ে ফেলে দিল। এ বিষয়ে সে আমাকে কোনও কথা বলেনি। আমিও কোনও প্রশ্ন তাকে করিনি। কথা যখন দিয়েছি, সেটা রাখতেই হবে। কিন্তু তারপর থেকে সে সব সময়ই কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আছে। ওর চোখ-মুখে সব সময়েই একটা আশঙ্কার ভাব। যেন সাঙঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেল বুঝি। সব-সময়েই যেন মনে মনে সে বিপদের জন্যে তৈরি হয়ে আছে। আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বললে ও ভালই করত। আমার চাইতে বড় বন্ধু তার আর কেউ নেই। কিন্তু এলসি নিজের থেকে কিছু না বললে আমিও কিছু বলতে পারি না। তবে একটা কথা হলফ করে বলতে পারি, এলসি অত্যন্ত সত্যবাদী ও সৎ মহিলা। ওর অতীত জীবনে যে-ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, তার জন্যে ও কোনও মতেই দায়ী নয়। আমি নরফোকের একজন অতি সাধারণ গেঁয়ো লোক। তবে আমার বংশের মর্যাদাকে আমি যে ভাবে রক্ষা করতে জানি, তা সারা ইংল্যান্ডে খুব বেশি লোক জানে বলে আমার মনে হয় না। আর এ কথাটা এলসি খুব ভাল করেই জানে। আমাকে বিয়ে করবার আগেই সে আমার মনের ভাব জানত। আমার খুব বিশ্বাস যে, এলসি এমন কোনও কাজ কখনওই করবে না, যা আমার বংশগৌরবের ক্ষতি করতে পারে।
“যাকগে, এইবার আসল ঘটনায় আসি। সপ্তাহখানেক আগে, গত মঙ্গলবার, আমি লক্ষ করলাম যে, একটা জানলার কাচে এই রকম কতগুলো নাচওলা ছবি আঁকা রয়েছে। ছবিগুলো খড়িতে আঁকা। আমার মনে হল, আস্তাবলের দেখাশোনা যে করে সেই ছোকরাই এই ছবিগুলো এঁকেছে। তাকে ডেকে পাঠালাম। সে দিব্যি করে বলল যে, এ ব্যাপারের আদ্যন্ত সে কিছুই জানে না। এটা যে রাত্রিবেলায় এসে কেউ এঁকে দিয়ে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যাই হোক আমি সেই ছবিগুলো মুছে দিতে বললাম। পরে আমি এই ঘটনার কথা এলসিকে বলি। আমার কথা শুনে এলসি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সে আমাকে কাকুতিমিনতি করে বলল যে, এ রকম ছবি আমার নজরে পড়লে আমি যেন অবশ্যই তাকে দেখাই। সত্যি কথা বলতে কী, এলসির ভাবগতিক দেখে আমি নিজেই থ হয়ে গেলাম। এরপর সপ্তাহখানেক আর কোনও ঘটনা ঘটেনি। ছবি আঁকা কোনও কাগজও আসেনি। গত কাল সকালে বাগানে যে-সূর্য ঘড়ি আছে তার কাছে এই কাগজটা পড়ে ছিল। কাগজটা আমিই দেখতে পাই। আমি কাগজটা এনে এলসিকে দেখাই। কাগজটা দেখেই এলসি অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর থেকে এলসি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব। চোখে-মুখে তার ভয়ের ছাপ। আর তখনই আমি আপনাকে চিঠি লিখি আর চিঠির সঙ্গে ওই কাগজটা পাঠিয়ে দিই। এ এমনই একটা আজগুবি ব্যাপার যে, আমার পক্ষে পুলিশের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। পুলিশ হেসেই সব ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবে। তাই আমি আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমি আগেই আপনাকে বলেছি যে, আমি ধনী লোক নই, তবে আমার স্ত্রী’র যদি কোনও বিপদ হয় তো সেই বিপদ থেকে তাকে বাঁচাবার জন্যে আমি আমার শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত খরচা করতে রাজি আছি।”
মিঃ হিলটন ক্যুবিট একজন অসাধারণ মানুষ। খাঁটি ইংরেজ বলতে যা বোঝায় ভদ্রলোক তাই। সহজ, সরল, সহৃদয়। ওই সুন্দর নীল চোখ আর সারল্যে ভরা মুখ। ভদ্রলোকের কথাবার্তায় চোখে-মুখে, হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনি স্ত্রীকে খুব ভাল বাসেন। হোমস খুব মন দিয়ে মিঃ ক্যুবিটের কথা শুনছিল। ক্যুবিট চুপ করে ওর দিকে তাকালেন। হোমস কোনও কথা না বলে চুপ করেই রইল।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর হোমস বলল, “মিঃ কুবিট, এই অবস্থায় আপনার কি মনে হয় না যে, সব ব্যাপারটা নিয়ে আপনার স্ত্রী’র সঙ্গে খোলাখুলি ভাবে একটা আলোচনা করাই ভাল? এর গোপন কথা যদি কিছু থাকে তা জেনে নেওয়াই উচিত।”
হিলটন ক্যুবিট তাঁর বিরাট মাথাটা নাড়লেন।
“মিঃ হোমস, প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই। এলসি যদি বলতে চাইত তো ও নিজে থেকেই কথাটা আমাকে বলত। ও যদি স্বেচ্ছায় না বলে তো জোর করে ওর কাছ থেকে কথা জেনে নিতে আমি চাই না।…কিন্তু আমার কী কর্তব্য তা ঠিক করার অধিকার আমার আছে। আর তা আমি করবই।”
“তা হলে মিঃ ক্যুবিট আমি আপনাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করব। আচ্ছা, আপনাদের পাড়ায় বা ওই অঞ্চলে নতুন কোনও লোককে সম্প্রতি দেখেছেন কি?”
“না।”
“আমার মনে হয় আপনাদের রিডলিং থর্প গ্রামটি যাকে বলে বেশ নির্জন। নতুন কোনও লোক এলে তা নিশ্চয়ই গ্রামের কারও না কারও চোখে পড়বে।”
“হ্যাঁ, আমাদের গ্রামে কেউ এলে অবশ্যই সে খবর চাপা থাকবে না। তবে আমাদের গ্রাম থেকে অল্প দূরেই কিছু ঘরবাড়ি আছে, যেখানে বাইরে থেকে লোকেরা প্রায়ই দু’-চার দিনের জন্যে হাওয়া বদলাতে আসে।”
“এই ছবিগুলো বোধহয় এক ধরনের হিয়েরোগ্লিফ। আর তা যদি হয় তো এগুলোর মানে আছে। আর তা যদি না হয়, মানে এগুলো যদি কেউ খেয়ালখুশিতে এলোমেলো ভাবে এঁকে থাকে, তো এর অর্থ বের করা যাবে না। তবে এগুলো যদি ভেবেচিন্তে নির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি অনুসরণ করে আঁকা হয়ে থাকে, তো এর অর্থ বের করতে আমি পারবই। কিন্তু এই কাগজের টুকরোর লেখাটা এত ছোট যে, এর থেকে কোনও অর্থ বের করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আপনি আমাকে যে-তথ্য দিলেন তাও মোটেই যথেষ্ট নয়। আমার পরামর্শ যদি চান তো বলি যে, আপনি নরফোকে ফিরে যান। যদি ইতিমধ্যে আর কোনও এই ধরনের ছবি আঁকা কাগজ আপনার নজরে পড়ে তো তার হুবহু নকল করে নেবেন। আপনার বাড়ির জানলায় চক দিয়ে যে-ছবি আঁকা ছিল, তার যদি একটা নকল পাওয়া যেত তো বড় ভাল হত। এ ছাড়া যা আপনাকে করতে হবে তা হল সাবধানে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে চেষ্টা করবেন পাড়ায় কোনও অচেনা লোককে দেখতে পাওয়া গেছে কিনা। যখনই নতুন কোনও তথ্য আপনার হাতে আসবে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। এই মুহূর্তে আমি আপনাকে আর কোনও পরামর্শ দিতে পারছি না। তবে এর মধ্যে যদি হঠাৎ কোনও নতুন ঘটনা ঘটে তো আমাকে জানাবেন, আমি তৎক্ষণাৎ আপনার ওখানে চলে যাব।”
মিঃ হিলটন ক্যুবিটের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর থেকেই হোমস ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল। দেখেই বোঝা যায় যে, ও খুব চিন্তিত। হিলটন ক্যুবিটের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ক’দিন হয়ে গেল। হোমস সেই রকমই চুপচাপ। শুধু মাঝে মাঝেই পকেট বুক থেকে সেই ছবি আঁকা কাগজটা বের করে স্থির দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। দিন পনেরোর মধ্যে হোমস ওই প্রসঙ্গে একটি কথাও উচ্চারণ করল না। হঠাৎ একদিন আমি যখন বেরোবার জন্যে তৈরি হচ্ছি হোমস বলে উঠল, “ওয়াটসন, তুমি বরং এখন ঘরেই থাকো।”
“কেন?”
“কেন না, আজ সকালেই আমি হিলটন ক্যুবিটের কাছ থেকে একটা তার পেয়েছি। সেই যে হিলটন ক্যুবিট, সেই ছবি আঁকা কাগজের ব্যাপারটা, মনে আছে তো। উনি লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনে এসে পৌঁছোবেন একটা বেজে কুড়ি মিনিটে। উনি এক্ষনি এসে পড়লেন বলে। ওঁর টেলিগ্রাম থেকে যা জানতে পেরেছি, তার থেকে মনে হচ্ছে ওখানে বড় রকমের কিছু একটা ঘটেছে।”
আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আমাদের নরফোকের মক্কেল লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশন থেকে একটা ভাড়া গাড়ি ধরে সোজা আমাদের আস্তানায় এসে হাজির। মিঃ ক্যুবিটকে দেখলেই বোঝা যায় যে, ভদ্রলোক রীতিমতো চিন্তিতই নন, খুব মনমরাও বটে। চোখের দৃষ্টিতে ক্লান্তির ছাপ। কপাল কুঁচকে আছে।
“মিঃ হোমস, এই ব্যাপারটা আমার স্নায়ুর ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করছে।” কথাগুলো বলেই ভদ্রলোক হতাশ ভাবে একটা আরামকেদারায় বসে পড়লেন। “অচেনা, অজানা কিছু লোক কোনও একটা মতলব হাসিল করবার জন্যে আপনাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলছে এই রকম চিন্তা যে-কোনও লোককেই অস্থির করে তুলবে। তার ওপর যদি জানতে পারেন যে, তাদের এই কাণ্ডকারখানা আপনার স্ত্রীকে তিলে তিলে মেরে ফেলছে, তা হলে মনের কী রকম অবস্থা হয় বলুন তো? আমার চোখের সামনে আমার স্ত্রী ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কি কেউ সহ্য করতে পারে?”
“আপনার স্ত্রী কি কোনও কথা আপনাকে বলেছেন?”
“না মিঃ হোমস, সে কোনও কথাই আমাকে বলছে না। এক এক সময়ে আমার মনে হয়েছে এলসি যেন কোনও একটা কথা আমাকে বলি বলি করেও বলতে পারছে না। বলাটা ঠিক হবে কিনা সে বিষয়ে ও মনস্থির করতে পারছে না। আমি অনেক সময় তাকে কথার খেই ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। তাতে ও আরও চুপ করে গেছে। ও প্রায়ই আমার কাছে আমাদের বংশের প্রাচীনত্ব, আমাদের বংশের গৌরব, ঐতিহ্য এই সব প্রসঙ্গ তুলেছে। আমার মনে হয়েছে এইবার বোধহয় ও কিছু বলবে। কিন্তু না। পরক্ষণেই ও প্রসঙ্গ বদলে ফেলছে।”
“কিছু কিছু কথা আপনি তো নিজেই জানতে পেরেছেন।”
“হ্যাঁ, আমি অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। আমি আরও অনেকগুলো ছবি-আঁকা কাগজ পেয়েছি। সেগুলো সঙ্গে করে এনেছি। আপনি দেখুন, যদি কোনও কিনারা করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, সেই লোকটাকে আমি দেখতে পেয়েছি।”
“কাকে? যে-লোকটা ছবি আঁকে তাকে?”
“হ্যাঁ, যখন লোকটা ছবি আঁকছিল, সেই সময়ে তাকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম। সব কথাই আমি একে একে আপনাকে বলছি। আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ফিরে যাবার পরের দিনই আমি আমার বাড়ির ভেতরে যে-মালখানা আছে তার দরজায় একসার ছবি দেখতে পাই! মালখানার কালো দরজায় খড়ি দিয়ে আঁকা ছবি। মালখানার দরজাটা আমার বাড়ির সোজাসুজি। বাড়ির যে-কোনও জানলা থেকে তাকালেই সেটা চোখে পড়বে। আমি সেটার হুবহু নকল করে এনেছি। এই যে সেই কাগজটা।” ভদ্রলোক একটা কাগজের ফালি টেবিলের ওপর রাখলেন। কাগজের ফালিতে এই ছবিগুলো আঁকা ছিল:
“চমৎকার! চমৎকার!” হোমস বলে উঠল। “এরপর কী হল বলুন।”
“যখন নকল করা হয়ে গেল আমি মূল ছবিগুলো মুছে ফেললাম। কিন্তু ঠিক দু’দিন পরে আবার একসার ছবি আমার নজরে পড়ল। সেটার নকলও আমি এনেছি। এই যে সেই নকলটা।”

হোমস খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল। তারপর দু’হাত ঘষতে ঘষতে বলল, “আমাদের হাতে অনেক তথ্যই এসে গেছে দেখছি।”
“তিন দিন পরে আমাদের বাগানের সূর্য-ঘড়ির ওপরে একটা মোড়ক-করা কাগজে আবার ওই ধরনের ছবি কুড়িয়ে পাই। এই যে সেই কাগজটা। দেখছেন ছবিগুলো আঁকার ধরন একদম এক। এই কাগজটা পাবার পর আমি ঠিক করলাম যে, এরপর থেকে ঘাপটি মেরে বসে থাকব, যাতে করে যে ছবি আঁকছে তাকে হাতেনাতে ধরতে পারি। আমি রিভলভার সঙ্গে নিয়ে আমার বসবার ঘরের জানলার সামনে বসে রইলাম। এখান থেকে গোটা বাগানটা, মালখানার দরজা সবই স্পষ্ট দেখা যায়। রাত্তির তখন দুটো হবে। চার পাশ অন্ধকার। বাইরে অল্প অল্প জ্যোৎস্না। হঠাৎ আমার পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার স্ত্রী। বিছানা থেকে উঠে এসেছে। সে আমাকে শুয়ে পড়বার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আমি তাকে সোজাসুজি বললাম যে, কে আমাদের সঙ্গে এই ধরনের বদমাইসি করছে তা আমি দেখতে চাই। আমার স্ত্রী বলল যে, এটা নিশ্চয়ই রসিকতা করে কেউ করছে। এটাকে কোনও রকম গুরুত্ব দেওয়াই উচিত নয়।
‘“এ ব্যাপারটায় তুমি যদি সত্যি সত্যি বিরক্ত বোধ করো, তবে বেশ তো চলো না আমরা কোথাও থেকে কিছু দিনের জন্যে বেড়িয়ে আসি? তা হলে এই বাজে রসিকতার অত্যাচার সহ্য করতে হবে না।’ আমার স্ত্রী বলল।
“আমি বললাম, ‘এ তুমি কী বলছ? একটা খারাপ লোকের বাজে রসিকতার ভয়ে আমরা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাব? পাড়ার লোকেরা একথা শুনলে যে আমাদের নিয়ে তামাশা করবে।’
“আমার কথা শুনে আমার স্ত্রী বলল, ‘ঠিক আছে এখন তো তুমি শোবে এসো, কাল সকালে না হয় এ সম্বন্ধে কথাবার্তা বলা যাবে।’
“হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম যে, কথা কইতে কইতে আমার স্ত্রীর সাদা মুখ আরও সাদা হয়ে গেল। আমার কাঁধের ওপর ওর একটা হাত ছিল। ও সেই হাত দিয়ে আমার কাঁধটা শক্ত করে চেপে ধরল। মালখানার কাছে অন্ধকারে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ভাল করে লক্ষ করতে দেখলাম যে, কালো ছায়ামূর্তি অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে মেরে এসে মালখানার দরজার সামনে উবু হয়ে বসল। আমি রিভলভার তুলে নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার স্ত্রী তার গায়ের সব জোর দিয়ে আমাকে জাপটে ধরল। আমি তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী’ও নাছোড়বান্দা। শেষকালে যখন আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে মালখানার দরজার কাছে এলাম, তখন সেই ছায়ামূর্তিও উধাও। কিন্তু লোকটা যে এসেছিল তার প্রমাণ পেলাম। দরজার পাল্লায় একই রকমের নৃত্যরত মানুষের ছবি। এই ধরনের ছবি এর আগে আমি দেখেছি। তার নকলও নিয়েছি। সুতরাং ওই ছবি চিনতে আমার ভুল হয়নি। আমি সমস্ত বাগান তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম কিন্তু লোকটার কোনও হদিস করতে পারলাম না। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে, আমি যখন ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম তখন ও কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে ছিল। এটা ধরতে পারলাম, কেন না পর দিন সকালে আমি যখন মালখানার দরজার কাছে গেলাম তখন আরও কতকগুলো নতুন ছবি দেখতে পেলাম। এই ছবিগুলো আগে ছিল না।”
“সেই ছবিগুলোর নকল আপনার কাছে আছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু এটা খুবই সংক্ষিপ্ত। আমি সেটা নকল করে এনেছি। এই যে সেই নকলটা।” মিঃ হিলটন ক্যুবিট পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিলেন। কাগজে এই ছবিগুলো আঁকা ছিল:

হোমস বলল, “আচ্ছা ভেবে বলুন তো এই ছবিগুলো আগের ছবিগুলোর সঙ্গে আঁকা হয়েছিল, নাকি আলাদা আঁকা ছিল।” লক্ষ করলাম উত্তেজনায় হোমসের চোখদুটো ঝকঝক করছে।
“এই ছবিগুলো দরজার অপর পাল্লায় আঁকা ছিল।”
“চমৎকার। এই খবরটা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এইবার আমার মনে হচ্ছে যে, আশার আলো দেখতে পেয়েছি। যাই হোক, আগে আপনি আপনার কথা শেষ করুন।”
“না, আমার আর কিছু বলার নেই। তবে সেই রাত্রে আমি আমার স্ত্রী’র ওপর অসম্ভব চটে গিয়েছিলাম। সে রাতে ও বাধা না দিলে আমি ওই ছুঁচোটাকে ধরে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতে পারতাম। আমার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যে, পাছে ওই ছুঁচোটার কোনও ক্ষতি হয়। তাই বোধহয় আমার স্ত্রী আমাকে যেতে দিতে চায়নি। তবে আমার স্ত্রী যে ওই লোকটাকে চেনে এবং ওই ছবিগুলো এঁকে ওই লোকটা যা বলতে চাইত তার মানেও যে আমার স্ত্রী বোঝে, সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। আমার স্ত্রী’র কথা থেকে, তার হাবভাব থেকে, আমি নিঃসন্দেহ যে, আমার পাছে কোনও বিপদ হয় সেই চিন্তাতেই বেচারা অস্থির। এই হল আমার কাহিনী। এখন আপনি আমাকে বলুন আমি কী করব। আমার নিজের ইচ্ছে যে, আমার খামারের জনাছয়েক লোককে বাগানের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। তারপর বাছাধন যখন আসবে তখন তাকে ধরে আচ্ছা করে ঠেঙিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিই।”
হোমস বলল, “না, ঠ্যাঙানি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এ জটিল ব্যাপার।…আচ্ছা, আপনি লন্ডনে কত দিন থাকতে পারেন?”
“আমাকে আজ ফিরে যেতেই হবে। কোনও অবস্থাতেই আমি আমার স্ত্রীকে একলা ফেলে রাখতে পারি না। ও খুব ভয় পেয়ে গেছে। আমাকে বার বার অনুরোধ করছে আমি যেন অবশ্যই ফিরে যাই।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে আপনি যদি থাকতে পারতেন, তা হলে দু’-এক দিন পর আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারতাম। যাই হোক, আপনি ওই কাগজগুলো রেখে যান। আমার মনে হচ্ছে, দু’-চার দিনের মধ্যেই আমি আপনার ওখানে যেতে পারব, আর আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারব।”
যতক্ষণ আমাদের মক্কেল ঘরে ছিলেন, ততক্ষণ শার্লক হোমস খুব শান্ত ভাবে কথাবার্তা বলছিল। আমি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে, যে-কোনও কারণেই হোক, হোমস ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ক্যুবিট ঘর থেকে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে হোমস ছবি-আঁকা কাগজের টুকরোগুলোকে একসঙ্গে করে নানা রকম হিসেব করতে লেগে গেল।
ঘণ্টা-দুই হোমস ওই কাগজগুলো নিয়ে মত্ত হয়ে রইল। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নানা রকম ছবি আর হরফ লিখতে লাগল। হোমস এমনই মশগুল হয়ে পড়ল যে, আমি যে জলজ্যান্ত একটা লোক ঘরে বসে রয়েছি, সে কথা যেন সে বেমালুম ভুলেই গেল। যখনই হোমস সঠিক সমাধানের দিকে এগোচ্ছিল, তখন সে হয় মনের খুশিতে শিস দিয়ে উঠছিল, অথবা গান করছিল। কখনও কখনও আবার খুব গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে থাকছিল। তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, কোথাও এসে হোমস আটকে গেছে। শেষকালে হোমস চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। ওর হাবভাব দেখে বুঝলাম যে, হোমস বেশ খুশি হয়েছে। তারপর হোমস একটা টেলিগ্রামের ফর্মে মস্ত একটা টেলিগ্রাম লিখল। “আমার এই টেলিগ্রামের উত্তর যদি আমি যা আশা করছি তাই হয়, তবে ওয়াটসন, তোমার ডায়েরির পাতায় একটা নতুন ধরনের রহস্য সমাধানের ঘটনা লিখে রাখতে পারবে। আমার বিশ্বাস, আগামী কাল আমাদের নরফোকের বন্ধুকে এমন কিছু খবর দিতে পারব যার থেকে তার জীবনে যে-উৎপাত শুরু হয়েছে তার অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে, ব্যাপারটা জানবার জন্যে আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু হোমসের স্বভাব আমি জানি। রহস্যের সমাধানটা যে কী, এবং কী ভাবে রহস্যের সমাধান হল, তা সে নিজে থেকে যখন বলবে তখনই জানতে পারা যাবে। তার আগে হাজার প্রশ্ন করলেও তার কাছ থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। তাই আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম, যতক্ষণ না হোমস নিজের থেকে আমাকে কিছু বলে।
কিন্তু হোমসের টেলিগ্রামের উত্তর আসতে অনেক দেরি হল। মাঝের দুটো দিন হোমস ঘরের ভেতর উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারি করত। আর দরজার বেল বাজলেই কান-খাড়া করে থাকত। দ্বিতীয় দিন সন্ধের ডাকে হিলটন ক্যুবিটের একটা চিঠি এল। সবকিছুই চুপচাপ। শুধু সেই দিন সকালে সূর্য-ঘড়ির স্তম্ভের গায়ে একটা নতুন চিত্রলিপি পাওয়া গেছে। এটা আকারে বেশ বড়। লিপির অনুলিপি চিঠির সঙ্গে দেওয়া ছিল। সেটা এই রকম:

হোমস কাগজটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কতকগুলো নৃত্যরত ভৌতিক মূর্তি যেন। দেখলেই অস্বস্তি হয়। তারপর হঠাৎ ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। দেখো তো ওয়াটসন, আজ রাত্রে নর্থ ওয়ালশাম যাবার আর কোনও ট্রেন আছে নাকি?”
আমি টাইম টেবিলটা দেখলাম। “নাহ, শেষ গাড়ি ছেড়ে গেছে।”
“তা হলে আমরা কাল সকাল সকাল উঠে প্রথম যে-ট্রেন পাব সেটাই ধরব। বুঝলে ওয়াটসন,” হোমস বলল, “আমাদের ওখানে হাজির থাকাটা বিশেষ দরকার।…ওই বুঝি যে-টেলিগ্রামটার জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে আছি, সেটা এল। এক মিনিট, মিসেস হাডসন, এর উত্তর দিতে হবে কিনা দেখি।…নাহ, আমি যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। যে-খবর পেলাম, তাতে আমাদের পক্ষে আর এক মিনিট দেরি করাও উচিত নয়। আমাদের সহজ সরল বন্ধুটি জানেন না, তার চার পাশে কী প্রচণ্ড ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে রয়েছে।”
শেষ পর্যন্ত তাই হল। এই গল্পের যে এমন সাঙঘাতিক পরিণতি হবে তা গোড়াতে আমি আঁচ করতে পারিনি। যে-জিনিসটা নেহাতই ছেলেমানুষি বা বাজে রসিকতা বলে মনে করেছিলাম, তার কী করুণ পরিণতি। আমি যদি আমার পাঠকদের এই পরিণতি না শুনিয়ে অন্য পরিণতির কথা শোনাতে পারতাম, তা হলে কী ভালই না হত। কিন্তু আমি তো কাল্পনিক কোনও কাহিনী বলছি না। এ হল নিছক সত্য। তাই ঘটনা যা যা ঘটেছে এবং যেমন যেমন ঘটেছে, তা যতই দুঃখজনক হোক, তা বলতেই হবে। আমাকে ইচ্ছে না করলেও লিখতে হবে কেমন করে, কী পরিস্থিতিতে, কী দুর্ঘটনা ঘটল, যার জন্যে সমস্ত ইংল্যান্ডবাসীর মুখে মুখে রিডলিং থর্পের ম্যানর হাউসের কথা আলোচিত হতে লাগল।
আমরা নর্থ ওয়ালশাম স্টেশনে নেমে আমাদের গন্তব্যস্থলে যাবার রাস্তার খোঁজ করতেই স্টেশনমাস্টার ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনারাই কি লন্ডনের ডিটেকটিভ?”
ভদ্রলোকের কথায় হোমস যে বেজায় চটে গেছে, তা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। “এ কথা জিজ্ঞেস করার কারণ জানতে পারি কি?”
“কেন না নরউইচের পুলিশ ইন্সপেক্টর মার্টিন একটু আগে এদিক দিয়ে গেলেন। আপনারা কি তা হলে সার্জেন? আমি যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা হয়তো এখনও বেঁচে আছেন। আপনারা যদি তাড়াতাড়ি করেন তা হলে তাঁকে হয়তো বাঁচাতেও পারেন। অবশ্য ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে পারবেন কিনা জানি না।”
হোমসের মুখ অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গেল।
“আমরা রিডলিং থর্প ম্যানরেই যাচ্ছি। তবে সেখানে কী ঘটেছেনা ঘটেছে তা জানি না।” স্টেশনমাস্টার বললেন, “সাঙঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। মিঃ হিলটন ক্যুবিট আর তাঁর স্ত্রী দু’জনেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কাজের লোকেরা বলছে যে, ভদ্রমহিলা প্রথমে স্বামীকে গুলি করেন। তারপর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মিঃ ক্যুবিট মারা গেছেন। মিসেস ক্যুবিটের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। ইস, কী কাণ্ড! এত দিনের পুরনো আর এত নামী বংশে কী সব যাচ্ছেতাই ব্যাপার।”
হোমস একটি কথাও আর বলল না। সোজা গিয়ে একটা ভাড়া-গাড়িতে উঠে পড়ল। স্টেশন থেকে রিডলিং থর্প সাত মাইল। এই সাত মাইল হোমস একটি কথাও বলল না। হোমসকে এত বেশি ভেঙে পড়তে আগে কখনও দেখিনি। এর আগে ট্রেনেও লক্ষ করেছিলাম যে, হোমস খুবই অস্থির হয়ে রয়েছে। খবরের কাগজটা আঁতিপাতি করে পড়ছিল। এখন তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হওয়ায় সে একদম চুপ হয়ে গেছে। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে হোমস বসে ছিল। তার মন খুব খারাপ। অথচ আমরা যে-রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম, সেখানে দেখবার মতো অনেক কিছু রয়েছে। চার পাশে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে ‘কটেজ’ আর চার্চের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে ইস্ট অ্যাভলিয়ার একই ছবি। আমরা চলছি তো চলছি। শেষকালে নরফোকের সমুদ্রতীর চোখে পড়ল। আরও কিছুটা যাবার পর আমাদের গাড়োয়ান চাবুকটা তুলে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, “ওই যে রিডলিং থর্প ম্যানর হাউস।”
আমাদের গাড়ি সোজা গিয়ে পোর্টিকোর কাছে থামল। গাড়ি থেকে নামতেই মালখানার কালো দরজাটা চোখে পড়ল। একটু দূরেই সেই সূর্য-ঘড়িটাও দেখতে পেলাম। এই রহস্যের সঙ্গে ওই সূর্য-ঘড়িটা আর মালখানার দরজাটা ভীষণ রকম জড়িয়ে গেছে। আমরা পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন এক ছোটখাটো ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের চলাফেরার মধ্যে বেশ একটা সতর্ক অথচ ক্ষিপ্র ভাব আছে। তিনি নিজেই এসে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করলেন। জানলাম, ইনিই নরফোক পুলিশ স্টেশনের ইন্সপেক্টর মার্টিন। আমার সঙ্গীর সঙ্গে যখন পরিচয় হল, তখন তিনি রীতিমতো হাঁ হয়ে গেলেন।
“সে কী মিঃ হোমস, এই খুনোখুনির কাণ্ড ঘটেছে আজ ভোর তিনটেয়, আর আপনি লন্ডনে বসে এরই মধ্যে খবরই বা পেলেন কী করে আর এখানে হাজিরই বা হলেন কী করে?”
“আমি এই রকম একটা কিছু ঘটতে পারে আশঙ্কা করেছিলাম। আর সেটা যাতে না ঘটে, সেই চেষ্টা করতেই সকাল হতেই লন্ডন থেকে বেরিয়ে পড়েছি।”
“তা হলে আপনি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভেতরের খবর কিছু জানেন বলে মনে হচ্ছে। আমি যত দূর খবর পেয়েছি, তাতে মিঃ আর মিসেস ক্যুবিট যাকে বলে আদর্শ স্বামী-স্ত্রী ছিলেন।”
ইন্সপেক্টর মার্টিনের কথার জবাবে হোমস বলল, “আমার হাতে শুধু নৃত্যরত লোকগুলির ছবির তথ্য আছে। এ সম্পর্কে আমি পরে আলোচনা করব। ইতিমধ্যে যে দুর্ঘটনাকে চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারলাম না, সেটার কিনারা করতে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি সেটা আপনাকে জানাতে চাই। যাতে ন্যায়বিচার হয়, সেই জন্যেই আমি এসব কথা আপনাকে বলছি। আপনি কি এই রহস্য সমাধানে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন, নাকি আমরা আলাদা আলাদা ভাবে তদন্ত করব?”
ইন্সপেক্টর বললেন, “আপনি আর আমি একই মামলায় একই সঙ্গে তদন্ত করছি এ আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার।” ইন্সপেক্টরের গলার আন্তরিকতা আমার কান এড়াল না।
“তা হলে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে কী ঘটেছিল, সেটা শুনেই আমি অকুস্থলে যেতে চাই।”
ইন্সপেক্টর মার্টিন বেশ বিচক্ষণ লোক। উনি হোমসের কাজকর্মে কোনও বাধা দিচ্ছিলেন না। উলটে হোমস যা করছিল সেগুলো খুব মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। স্থানীয় ডাক্তার ভদ্রলোক মিসেস হিলটন ক্যুবিটকে দেখে নেমে এলেন। ভদ্রলোকের বেশ বয়স হয়েছে। মাথার চুলগুলো সব শন-সাদা। তিনি বললেন যে, ভদ্রমহিলার আঘাত খুব গুরুতর বটে, তবে তাঁর প্রাণের আশঙ্কা নেই। বুলেট তাঁর মস্তিষ্কের সামনেটা ছুঁয়ে গেছে। তাই জ্ঞান হতে হয়তো দেরি হবে। তবে গুলিটা উনি নিজে ছুড়েছিলেন না অন্য কেউ ওঁকে লক্ষ্য করে ছুড়েছিল সে বিষয়ে ডাক্তারবাবু হলফ করে কিছু বলতে চাইলেন না। তবে একটা কথা ঠিক যে, গুলিটা খুব কাছ থেকেই ছোড়া হয়েছে। ঘরে একটাই পিস্তল। পিস্তল থেকে দুটো গুলিই ছোড়া হয়েছে। মিঃ হিলটন ক্যুবিটের হৃৎপিণ্ডে গুলিটা গিয়ে সোজা লাগে। তবে এমনও হতে পারে যে, মিঃ ক্যুবিট প্রথমে তাঁর স্ত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন এবং তারপর নিজে আত্মহত্যা করেন। মিসেস ক্যুবিটও এ কাজ করে থাকতে পারেন। রিভলভারটা দু’জনের দেহের মাঝখানে পড়ে ছিল।
হোমস জিজ্ঞেস করল, “মিঃ ক্যুবিটের মৃতদেহ কি সরানো হয়েছে?”
“না, মিসেস ক্যুবিটকে ছাড়া কোনও কিছুই সরানো বা নড়ানো হয়নি। মিসেস ক্যুবিটকে তো ওখানে ওই অবস্থায় ফেলে রাখা যায় না। তা হলে ওঁকে বাঁচানো যেত না।”
“ডাক্তার আপনি এখানে কখন এসেছেন?”
“সেই ভোর চারটের সময়।”
“আর কেউ?”
“হ্যাঁ, এই কনস্টেবলটি।”
“আপনারা কোনও কিছুতে হাত দেননি?”
“না।”
“আপনি খুব বুদ্ধির কাজ করেছেন। আপনাকে কে খবর দিয়েছিল?”
“সন্ডার্স বলে যে কাজের মেয়েটি আছে, সে।”
“বাড়িতে যে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে সে খবরটাও কি সে-ই দিয়েছিল?”
“হ্যাঁ। সে আর মিসেস কিং বলে রাঁধুনিটি, তারাই খবর দেয়।”
“তারা এখন কোথায়?”
“খুব সম্ভবত রান্নাঘরে।”
“তা হলে গোড়ায় তারা কী বলে, সেটাই শোনা যাক!”
পুরনো হলঘরে আমরা জড়ো হলাম। ওক কাঠের প্যানেল করা ঘর। বিরাট বিরাট সব জানলা। প্রাচীন ঘরটা আজ বিচারসভার রূপ নিয়েছে। হোমস একটা পুরনো ধাঁচের বড় চেয়ারে বসল। তার শুকনো মুখের দিকে তাকালেই নজর পড়ে যায় তার চোখে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সেই চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়, হোমসের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হল, যে-মক্কেলকে সে বাঁচাতে পারেনি তার হত্যাকারীকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে তার মক্কেলের আত্মার শান্তি ঘটানো। সেই ঘরে হোমস ছাড়া আমি ছিলাম আর ছিলেন ইন্সপেক্টর মার্টিন, সেই বৃদ্ধ ডাক্তার আর-এক জন মোটাসোটা কনস্টেবল।
মহিলা দু’জন ওদের বক্তব্য মোটামুটি সহজ সরল ভাবেই বলল। দুম করে একটা শব্দ হয় আর তাতেই ওদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। প্রথম শব্দটা হবার এক মিনিট পরেই আর একটা শব্দ হয়েছিল। ওরা পাশাপাশি ঘরে শোয়। মিসেস কিং সন্ডার্সের ঘরে ছুটে যায় এবং দু’জনে নীচে নেমে আসে। পড়ার ঘরের দরজা খোলা ছিল। ঘরের মধ্যে টেবিলের ওপরে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। বাড়ির কর্তা ঘরের মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন। তাঁর দেহে প্রাণের কোনও চিহ্ন ছিল না। জানলার কাছে বাড়ির গিন্নি দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে পড়ে ছিলেন। তিনি ভীষণ রকম আহত হয়েছিলেন। মুখের এক দিকটা রক্তে একদম ভেসে যাচ্ছিল। উনি তখন খুব হাঁফাচ্ছিলেন। কথা বলার মতো অবস্থা ওঁর ছিল না। ঘরের ভেতরে আর ঘরের সংলগ্ন বারান্দা তখন ধোঁয়ায় ভরতি হয়েছিল। ঘরের জানলা ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। এ ব্যাপারে সন্ডার্স এবং মিসেস কিং দু’জনেই একমত হল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ও পুলিশে খবর পাঠিয়ে ছিল। তারপর কাজের লোকেদের ডেকে এনে ওরা গিন্নিকে ধরাধরি করে ওঁর ঘরে নিয়ে যায়। হ্যাঁ, সে রাতে কর্তা-গিন্নি দু’জনেই যে বিছানায় শুয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। মিসেস ক্যুবিট শোবার পোশাক পরেননি। মিঃ ক্যুবিট স্লিপিং স্যুটের ওপর ড্রেসিং গাউন পরে ছিলেন। না, ঘরের কোনও জিনিসপত্র সরানো হয়নি। না ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কখনও ঝগড়াঝাঁটি হতে ওরা দেখেনি, ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে বলেও শোনেনি। ওঁদের মধ্যে খুব মিল ছিল।
লোকজনদের সাক্ষ্য থেকে এর বেশি আর কিছু জানা গেল না। ইন্সপেক্টর মার্টিনের কথার উত্তরে সবাই একবাক্যে বলল যে, সব দরজাই বন্ধ ছিল। সুতরাং বাড়ি থেকে কারও পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। হোমসের কথার উত্তরে ওরা বলল যে ওপর থেকে নামবার সময়েই সিঁড়িতে ওরা বারুদের গন্ধ পেয়েছিল। হোমস ইন্সপেক্টরকে বলল, “এই কথাটা আপনি অবশ্যই মনে রাখবেন। চলুন, এবার আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সবকিছু পরীক্ষা করে দেখি।”
ঘরটা ছোট। তিন দিকে বইয়ের আলমারি। জানলার কাছে একটা সাধারণ রাইটিং টেবিল। সেই জানলা দিয়ে বাগানটা দেখতে পাওয়া যায়। ঘরে পা দিতেই মিঃ ক্যুবিটের মৃতদেহর দিকে আমাদের নজর পড়ল। ভদ্রলোকের বিরাট শরীরটা ঘরের মাঝখানে পড়ে ছিল। ওঁর জামাকাপড়ের অবস্থা দেখে মনে হল যে, উনি বোধহয় বিছানা থেকে তাড়াহুড়ো করে উঠে এসেছেন। গুলিটা সামনে থেকে ছোড়া হয়েছিল। সোজা হৃৎপিণ্ডে ঢুকে গুলিটা আটকে গেছে। বুঝলাম ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন। যন্ত্রণা পাননি। ওঁর ড্রেসিং গাউনে বা হাতে বারুদের দাগ নেই। ডাক্তারবাবুর কথা অনুযায়ী মিসেস ক্যুবিটের মুখে বারুদের দাগ আছে, হাতে নেই।
“বারুদের দাগ না থাকাটা কিছুই প্রমাণ করে না। তবে দাগ থাকলে অবশ্য অন্য কথা হত,” হোমস বলল। “যদি গুলির মধ্যে বারুদ ভাল ভাবে ঠাসা না থাকে, তবেই গুলি ছুড়লে অনেক সময় বারুদের গুঁড়ো পেছন দিকে ছিটিয়ে যেতে পারে। ভাল গুলি হলে অনেকগুলো গুলি ছুড়লেও বারুদের দাগ হাতে পড়বে না। মিঃ ক্যুবিটের দেহ এখন সরিয়ে ফেলতে পারেন।…ডাক্তার, মিসেস ক্যুবিটের শরীরে যে-গুলিটা আঘাত করেছিল সেটা কি আপনি পেয়েছেন?”
“গুলিটা বের করতে হলে একটা জটিল অপারেশন করতে হবে। রিভলভারে তো চারটে গুলি রয়েছে, তা হলে নিশ্চয়ই দুটো গুলি খরচ হয়েছে।”
“তাই মনে হয় বটে,” হোমস বলল। “জানলার এক কোণে ওই যে গুলিটা লেগে আছে সেটা কী করে ওখানে গেল, তাও বোধকরি আপনি ব্যাখ্যা করতে পারেন?”
হোমস বোঁ করে ঘুরে গিয়ে একটা জানলার দিকে তার লম্বা সরু আঙুলটা বাড়িয়ে দিল। দেখলাম, জানলার নীচের দিকের পাটায় একটা বুলেটের গর্ত।
ইন্সপেক্টর মার্টিন আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন, “আপনি ওটা কী করে দেখতে পেলেন?”
“আমি তো এটাই খুঁজছিলাম।”
“চমৎকার”, ডাক্তারবাবু গদগদ স্বরে বলে উঠলেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন। তা হলে তৃতীয় একটা বুলেট ছোড়া হয়েছিল। আর তার মানে এখানে তৃতীয় একজন লোক হাজির ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে লোকটি কে এবং কী ভাবেই বা সে পালাল?”
“এই প্রশ্নের উত্তরটাই এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে,” শার্লক হোমস উত্তর দিল। “ইন্সপেক্টর মার্টিন, আপনার মনে আছে বোধহয় যে, বাড়ির কাজের মেয়েরা বলেছে যে, সিঁড়িতে নামতে নামতেই তারা বারুদের গন্ধ পেয়েছিল। আমি তখনই বলেছিলাম যে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
“হ্যাঁ স্যার। কিন্তু আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারিনি।”
“এর থেকে বুঝতে পেরেছিলাম যে, ঘরের জানলা-দরজা দুই-ই খোলা ছিল। তা না হলে বারুদের গন্ধ অত তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ছড়িয়ে যেত না। ঘরের ভেতর এক ঝলক হাওয়া বয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। ঘরের জানলা-দরজা খুব অল্প সময়ের জন্য যে খোলা ছিল, এ বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহই নেই।”
“এ কথাটা আপনি কী ভাবে প্রমাণ করবেন?”
“প্রমাণ করব মোমবাতি দিয়ে। লক্ষ করুন মোমবাতিটা গলে যায়নি।”
“দারুণ,” ইন্সপেক্টর মার্টিন বলে উঠলেন, “দারুণ!”
“যখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, ঘটনা ঘটবার সময় ঘরের জানলা খোলা ছিল, তখনই বুঝতে পারলাম যে, সেই সময়ে তৃতীয় একজন লোকও হাজির ছিল। জানলার বাইরে থেকে সে নিশ্চয়ই গুলি ছুড়েছিল। সেই লোকটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে সে গুলি ওই জানলায় বিঁধে যাবার আশঙ্কা খুব বেশি। আমি সেই গুলির দাগটা খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম।”
ইন্সপেক্টর মার্টিন একটু থেমে বললেন, “কিন্তু জানলাটা এ ভাবে বন্ধ হল কী করে?”
“মহিলাদের স্বভাবই হল জানলা-দরজা ভাল করে বন্ধ করা। আরে আরে, ওখানে ওটা কী?”
পড়ার টেবিলের ওপর মহিলাদের একটা হাতব্যাগ পড়েছিল। রুপোর হাতল-লাগানো কুমিরের চামড়ার একটা ছোট অথচ ভারী সুন্দর হাতব্যাগ। হোমস ব্যাগটা খুলে টেবিলের ওপর উপুড় করে ফেলল। ব্যাগের ভেতরে রবার-লাগানো কুড়িটা পঞ্চাশ পাউন্ডের নোট। এ ছাড়া আর কিছু নেই।
ব্যাগ আর টাকার বান্ডিলটা ইন্সপেক্টরের হাতে তুলে দিয়ে হোমস বলল, “এগুলো ভাল করে রাখুন। বিচারের সময় এগুলো কাজে লাগবে।…এখন আমাদের কাজ হল, এই তৃতীয় বুলেটটা সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর করা। জানলার কাঠের চোকলা যে ভাবে উঠে গেছে তাতে মনে হচ্ছে যে গুলিটা ঘরের ভেতর থেকে ছোড়া হয়েছিল। আমি একবার মিসেস কিং-এর সঙ্গে কথা বলতে চাই।…আচ্ছা মিসেস কিং, আপনি বলছিলেন যে, একটা জোরালো শব্দ শুনে আপনার ঘুম ভেঙে যায়। জোরালো বলতে আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন? দ্বিতীয় যে শব্দটা শুনেছিলেন প্রথম শব্দটা কি তার চেয়ে জোরে হয়েছিল?”
“না, সে কথাটা আমি জোর করে বলতে পারছি না।”
“আমার বিশ্বাস ব্যাপারটা সেই রকমই ঘটেছিল। ইন্সপেক্টর মার্টিন, এই ঘর থেকে আর নতুন কিছু জানবার নেই। চলুন, এইবার আমরা বাগানটা ভাল করে দেখে আসি। হয়তো সেখান থেকে নতুন কিছু খবর জানা যাবে।”
পড়ার ঘরের জানলার কাছে একসার ফুলগাছ লাগানো। সেই ফুলগাছের কাছে যেতে আমরা সকলেই চমকে উঠলাম। ছোট ছোট ফুলগাছগুলোর ওপর কে যেন মই চালিয়ে দিয়েছে। নরম মাটির ওপর পায়ের দাগ। পুরুষমানুষের পায়ের ছাপ। ছাপগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, লোকটির চেহারা বিরাট আর তার পায়ের জুতোটা ছুঁচোলো। হোমস বাগানের প্রত্যেকটি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল। এক সময়ে বেশ খুশি হয়ে শিস দিয়ে উঠল। তার হাতে একটা পোড়া লম্বাটে জিনিস।
“আমি এই রকমই ভেবেছিলাম। রিভলভারের সঙ্গে ইজেকটর লাগানো ছিল। এই সেই তিন নম্বর বুলেটটা। ইন্সপেক্টর মার্টিন, আমার মনে হচ্ছে যে, আমাদের তদন্ত সম্পূর্ণ হয়ে গেল।”
শার্লক হোমসের কাজের ধারা আর গতি দেখে ইন্সপেক্টর মার্টিন একদম স্তম্ভিত। গোড়ার দিকে তদন্তের ব্যাপারে তিনি নাক গলাবার চেষ্টা করছিলেন। খানিক পর সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে হোমস যা করছিল তিনি তাই মেনে নিচ্ছিলেন।
“আপনি কাকে সন্দেহ করছেন, মিঃ হোমস?”
“সে কথায় পরে আসব। এই খুনের ব্যাপারের অনেক রহস্যই এখন আপনাকে খুলে বলতে পারিনি। তবে যে-হেতু আমার নিজের মতো কাজ করে আমি একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছোতে পেরেছি, তাই বলি, বাকিটাও আমাকে নিজের মতো করতে দিন।”
“সে আপনার ইচ্ছে। আমি খুনিকে ধরতে পারলেই খুশি।”
“আমি ব্যাপারটাকে মোটেই ঘোরালো করে তুলতে চাই না। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে কথা বলে আমি সময় নষ্টও করতে চাই না। এখন হচ্ছে, যাকে বলে, কেবল অ্যাকশন। এই রহস্য সমাধানের সব সূত্রই আমার হাতে। মিসেস ক্যুবিটের জ্ঞান যদি না-ও ফেরে, তবুও কাল রাত্রে যা যা ঘটেছে, তা আমি প্রমাণ করতে পারব। আর তার দ্বারাই অপরাধীর সাজা হবে। তার আগে আমাকে জানতে হবে যে, এখানে ‘এলরিজেস’ বলে কোনও হোটেল কাছাকাছি আছে কিনা।”
বাড়ির লোকজনদের ডেকে প্রশ্ন করা হল। কিন্তু ওই নামে কোনও হোটেল আছে বলে কারও জানা নেই। শেষ পর্যন্ত যে-ছেলেটা আস্তাবল পরিষ্কার করে, সে বলল যে, ইস্ট রাস্টন থেকে অনেক দুরে ওই নামে একজন চাষি থাকে।
“আচ্ছা, ওই চাষি যে-বাড়িতে থাকে সেটা কি বেশ নির্জন জায়গায়?”
“হ্যাঁ, খুব নির্জন।”
“তা হলে কাল রাত্রে এখানে যে-সব কাণ্ড ঘটেছে তার খবর ওখানে পৌঁছোয়নি?”
“খুব সম্ভব নয়।”
হোমস কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। একটা রহস্যময় হাসি ওর মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
“শোনো বাছা, আস্তাবলে যাও, আর একটা ঘোড়াকে লাগাম জিন পরিয়ে নিয়ে এসো। একটা চিঠি এক্ষুনি তোমাকে এলরিজের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।”
হোমস জামার পকেট থেকে নৃত্যরত ছবি ও কাগজগুলো বের করল। পড়ার ঘরের টেবিলে সেই কাগজগুলো ছড়িয়ে রেখে সে অনেকক্ষণ ধরে কী সব করল। বিশেষ করে বলে দিল যে, এটা যেন যার নাম লেখা আছে কেবলমাত্র তার হাতেই দেওয়া হয়। আর তাকে যদি কেউ কোনও প্রশ্ন করে সে যেন উত্তর না দেয়। খামটা দেখলাম। কাঁপা কাঁপা আঁকাবাঁকা অক্ষরে নাম-ঠিকানা লেখা। হোমসের নিজের লেখার ধরনের সঙ্গে কোনও মিল নেই। খামের ওপর লেখা—মিস্টার অ্যাবে স্লেজি এলরিজের খামার। ইস্ট রাস্টন। নরফোক।
হোমস বলল, “ইন্সপেক্টর, আমার মনে হয় আপনি হেড আপিসে খবর পাঠিয়ে একজন বেশ শক্ত সমর্থ কনস্টেবলকে আনিয়ে নিন। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, তবে বলছি যে, আপনার আসামি খুব সাঙঘাতিক প্রকৃতির লোক। এই ছেলেটির হাতেই আপনি বরং একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিন। ওয়াটসন, দুপুরের পরেই যদি এখান থেকে লন্ডন ফেরবার কোনও ট্রেন থাকে তো আমরা সেই গাড়িটাই ধরব। লন্ডনে আমি একটা খুবই জরুরি রাসায়নিক পরীক্ষা শেষ না করেই চলে এসেছি। এই রহস্যের যবনিকা পড়তে আর দেরি নেই।”
ছেলেটি চিঠি নিয়ে চলে গেল। হোমস বাড়ির অন্য সব কাজের লোকেদের ডেকে বলল, যদি অচেনা কোনও লোক এসে মিসেস ক্যুবিটের খোঁজ করেন তো তাঁকে যেন মিসেস ক্যুবিটের আঘাতের কথা জানানো না হয়। আর তাঁকে যেন সোজাসুজি বসবার ঘরে নিয়ে আসা হয়। প্রতিটি লোককে ডেকে আলাদা আলাদা করে হোমস এই কথাগুলি বলল। তাদের সাবধান করে দিয়ে বলল যে, তারা যেন কিছুতেই তার কথা অমান্য না করে। এরপর হোমস আমাদের নিয়ে বসবার ঘরে এল। বলল, এখন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করবার নেই। দেখা যাক, এরপর কী ঘটে। ডাক্তারবাবুর রুগি দেখতে যাবার তাড়া ছিল। তিনি চলে গেলেন। আমি আর ইন্সপেক্টর মার্টিন বসে রইলাম।
“আমি ঘণ্টাখানেক আপনাদের জমিয়ে রাখতে পারি,” বলে হোমস তার চেয়ারটা টেবিলের কাছে টেনে আনল। তারপর পকেট থেকে সেই অদ্ভুত নাচনেওলা লোকেদের ছবিগুলো বের করে টেবিলের ওপর রাখল। “ওয়াটসন, তোমার কাছে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, তুমি এতক্ষণ তোমার সহজাত কৌতূহলকে চেপে রাখতে পেরেছ। ইন্সপেক্টর, আপনার কাছে সব ব্যাপারটাই দারুণ আকর্ষণীয় মনে হবে, কেন না আপনার চাকরি জীবনে এ রকম অদ্ভুত আর জটিল রহস্যের সন্ধান আর পাবেন বলে মনে হয় না। আপনাকে আমি সব কথা খুলে বলছি। আমার সঙ্গে মিঃ হিলটন ক্যুবিটের পরিচয় কী সূত্রে হল, তা আপনার জানা দরকার।”
হোমস প্রথম দিকের ঘটনার কথা ইন্সপেক্টরকে খুলে বলল, “এই দেখুন, আমার সামনে সেই বিচিত্র ছবিআঁকা কাগজগুলো রয়েছে। এগুলোকে সহজেই ছেলেমানুষি খামখেয়ালিপনা বলে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত, যদি না এই ছবির মধ্য দিয়ে একটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনার পূর্বাভাস পাওয়া যেত। পৃথিবীতে যত রকমের গুপ্তলিপির চলন আছে, তা সবই মোটামুটি ভাবে আমার জানা। এ বিষয়ে আমি একটা বইও লিখেছি। তাতে প্রায় একশো ষাটটি গুপ্তলিপি পাঠোদ্ধারের হদিস দেওয়া আছে। এই লিপি যাঁরা আবিষ্কার করেন তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, এই ছবিগুলো দেখে লোকে যেন মনে করে এগুলো কোনও ছেলেমানুষের আঁকা কাঁচা হাতের ছবি। এর মধ্যে কোনও লুকোনো অর্থ নেই।

“কিন্তু যখনই বুঝতে পারলাম যে, এগুলো গুপ্তলিপি আর তার এক একটা ছবি এক একটা হরফ, তখন গুপ্তলিপি বিশ্লেষণ করে ছকে ফেলে এর পাঠোদ্ধার করতে আমার দেরি হল না। এবং লিপিটা এত ছোট যে, তার থেকে এই ছবিটার মানে ছাড়া আর কোনও কিছু বুঝতে পারলাম না। ওই ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি ‘E’ হরফের জন্য। আমরা জানি, ইংরেজিতে E এই হরফটার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সামান্য একটা লাইন লিখতে গেলেও E ব্যবহার করতেই হয়। প্রথম লিপিতে পনেরোটা ছিল। তার মধ্যে এই ছবিটা আছে চারবার। তাই ধরে নিলাম যে e-ই হবে। অবশ্য কোনও কোনও ছবিতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে লোকটার হাতে একটা পতাকা আছে। আবার কোনও কোনও ছবিতে পতাকাটা নেই। পতাকাটা যে ভাবে আছে, তার থেকে আমার ধারণা হয়েছে যে, ওটা যতি-চিহ্ন। লাইনটা যে শেষ হল তাই বোঝাচ্ছে। এই ভাবে আমি এগোতে শুরু করলাম।

“কিন্তু এর পরই আসল গোলটা বাধল। E-এর পর T, A, O, I, N, S, H, R, D আর I এই হরফগুলোর ব্যবহার মোটামুটি একই। তবে T, A, O, আর I-এর ব্যবহার অন্যগুলোর চাইতে সামান্য বেশি। কিন্তু এই চারটের ব্যবহার প্রায় সমান। তাই যে-ছবিগুলো আছে তাদের বিশ্লেষণ করে কোনও হদিস পেলাম না। সুতরাং নতুন কোনও নমুনা না পাওয়া পর্যন্ত আমার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। মিঃ হিলটন ক্যুবিটের সঙ্গে আমার যখন দ্বিতীয় বার দেখা হল, তখন তিনি আমাকে আরও দুটি এই ধরনের লেখ দিলেন। আর-একটা লেখা দিলেন, যেটা আমার ধারণা, একটি মাত্র শব্দ। কেন না, এখানে কোনও পতাকা ছিল না। এখন শেষে যে লেখাটার কথা বললাম, তার পাঁচটা অক্ষরের মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ অক্ষরটা E। শব্দটা never, lever বা sever বা অন্য কিছু হতে পারে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে, এটা কোনও একটা আর্জির জবাব। সব কিছু বিচার করে আমি সিদ্ধান্ত করলাম, এটা নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলারই লেখা। আমার বিশ্লেষণ নির্ভুল বিবেচনা করে ঠিক করলাম, এই তিনটে হল N, V এবং R.

“এখনও পর্যন্ত ব্যাপারটার কোনও কিনারা করতে পারছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আর তার ফলে আমি আরও অনেকগুলো অক্ষর পড়ে ফেলতে পারলাম। আমার মনে হল যে, যদি এই সব বার্তা কোনও মহিলার উদ্দেশে পাঠানো হয়ে থাকে, এবং তাই হয়েছে বলে আমার ধারণা, তবে এই লিপির মধ্যে elsti নামটা অবশ্যই থাকবে। আর তা যদি হয়, তবে দুটো E-এর মধ্যে তিনটি অক্ষর থাকলে সেটাই ELSIE হবার সম্ভাবনা। খুঁজতে খুঁজতে তিনটে বার্তার নীচে একই ধরনের ছবি পেলাম, যার গোড়ায় ও শেষে E, এই ভাবে L, S আর I এই তিনটে অক্ষর পড়ে ফেললাম। কিন্তু বাকিগুলোর কী হবে। চারটে লিপিতে দেখলাম elsie-এর আগে একটিমাত্র শব্দ আছে। আর সেই শব্দটির শেষে E আছে। এই শব্দটা নিশ্চয়ই come। আর E তে শেষ হওয়া যে-সব চার অক্ষরের শব্দ আছে সেগুলোর কোনওটাই ওই শব্দের মতো নয়। যখন CO, আর M এই তিনটে অক্ষর পড়ে ফেললাম তখন আমি প্রথম যে লিপিটা এসেছিল, সেটা পড়তে চেষ্টা করলাম। প্রথম লিপিটা এই রকম:
M. ERE. E, SL. NE
“প্ৰথম অক্ষরটা A হওয়াই সম্ভব বলে আমার ধারণা হল এবং এই অক্ষরটা এই ছোট্ট বার্তাটিতে তিন বার ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় শব্দের প্রথম হরফটা H হওয়াই সম্ভব বলে আমার মনে হল। আর তা যদি হয় তো লিপিটার পাঠ মোটামুটি দাঁড়াল এই রকম:
“AM HERE A. E. SLANE. নামের শেষ অক্ষরটা Y হওয়াই স্বাভাবিক। তা হলে শেষ পর্যন্ত যা দাড়াল, তা হল AM HERE A. E. SLANEY। অনেকগুলো অক্ষরই পড়ে ফেলার দরুন আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। আমি দ্বিতীয় বার্তাটা পড়ে ফেললাম। সেটা এই রকম A. ELRL. ES। ফাঁকা জায়গা দুটোয় T আর G বসালে মোটামুটি একটা মানে খাড়া করা যায়। মানেটা বেশ লাগসই হয়, যদি দ্বিতীয় শব্দটা কোনও বাড়ি বা হোটেলের নাম হয়। আমার মনে হল, পত্ৰলেখক কোন জায়গায় রয়েছে সেই কথাটাই এখানে বলা হয়েছে।”
ইন্সপেক্টর মার্টিন আর আমি হোমসের কথা গোগ্রাসে গিলছিলাম। যে-ব্যাপারটার মাথামুন্ডু কিছুই আমরা বুঝতে পারিনি, হোমস সেটা কত সহজেই বুঝে ফেলেছে।
“আপনি তখন কী করলেন স্যার?” ইন্সপেক্টর মার্টিন প্রশ্ন করলেন।
“আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, এই অ্যাবে স্লেনি নিশ্চয়ই কোনও আমেরিকান। কেন না, এই নামটা আমেরিকানদের মধ্যেই বেশি চালু। আর সব গোলমালের সূত্রপাত হয়েছিল আমেরিকা থেকে আসার পর। আমি আরও অনুমান করলাম যে, এর ভিতরে নিশ্চয়ই কোনও অপরাধ-সংক্রান্ত ব্যাপার আছে। ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে নিজের অতীত জীবনের কথা বলতে না চাওয়াটাও আমার ধারণাটিকে ঠিক বলে প্রমাণ করে। তাই আমি নিউ ইয়র্ক পুলিশের কর্তা আমার বন্ধু উইলসন হারগ্রিভকে টেলিগ্রাম করলাম। আমি তার কাছ থেকে জানতে চাইলাম যে অ্যাবে স্লেনি বলে কাউকে সে চেনে কিনা। হারগ্রিভ কী লিখছে শুনুন, ‘শিকাগোর সব চাইতে জঘন্য অপরাধী।’ যে-দিন এই টেলিগ্রামটা পেলাম, সেই দিনই সন্ধেবেলা হিলটন ক্যুবিট স্লেনির কাছ থেকে পাওয়া শেষ চিঠিটা আমায় দিয়ে গেলেন। আমার পদ্ধতিতে পড়তে চিঠিটা এই রকম দাঁড়াল: ELSIE. RE. ARE TO MEET THY GO, শূন্য স্থানে যদি P আর D বসানো যায় তা হলে এই চিঠির বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে যায়। বুঝলাম পাজিটা ভয় দেখিয়ে কাজ উদ্ধার করতে চায়। শিকাগোর গুন্ডাদের কাজের ধারা আমার অজানা নয়। আমি বুঝলাম যে, স্লেনি আর দেরি করতে চায় না। যা করবার তা ও চটপট সেরে ফেলতে চায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু ও সহকারী ডঃ ওয়াটসনকে নিয়ে নরফোকে চলে এলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে ইতিমধ্যে যা ঘটবার তা ঘটে গেছে।”
ইন্সপেক্টর গদগদ কণ্ঠে বললেন, “এ রকম একটা রহস্যের মোকাবিলায় আপনার সঙ্গে কাজ করা একটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই আমি যদি খোলাখুলি ভাবে কিছু কথা বলি তো দয়া করে অপরাধ নেবেন না। আপনাকে কারও কাছে কোনও কিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হবে না, কিন্তু আমাকে হবে। সত্যি যদি এই অ্যাবে স্লেনি, যে কিনা এলরিজে রয়েছে, সে যদি খুনি হয় আর আমি অকুস্থলে থাকা সত্ত্বেও সে যদি এখান থেকে পালিয়ে যায়, তবে আমার ওপরওলারা আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন না।”
“না, অযথা ভয় পাবেন না। ও পালাবার চেষ্টা করবে না।”
“আপনি কী করে জানলেন?”
“ও যদি পালায় তো ও যে অপরাধী, সে কথাটা প্রমাণ হয়ে যাবে।”
“তা হলে চলুন, ওকে গ্রেফতার করে ফেলি।”
“ও এক্ষুনি এখানে এসে পড়বে বলে মনে হয়।”
“ও এখানে আসবে কেন?” আপনার কথাটা মানতে পারলাম না, মিঃ হোমস। আপনি আসতে বলেছেন বলেই ও এখানে আসবে? আমার তো মনে হয় যে, আপনার চিঠি পেয়ে ও ঘাবড়ে গিয়ে এখান থেকে সরে পড়বে।
“আমার মনে হয়, কোন টোপ দিলে ও খাবে সেটা আমি ধরতে পেরেছি।…আমার যদি খুব ভুল না হয় তো ওই বোধহয় স্লেনি আসছে,” শার্লক হোমস বেশ খুশি হয়ে বলে উঠল।
সামনের রাস্তা দিয়ে একজন দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটি খুব লম্বা। বেশ সুদর্শন। গায়ের রং ময়লা। লোকটির গায়ে ছাই রঙের ফ্ল্যানেলের স্যুট। মাথায় পানামা টুপি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। খাড়া নাকটা সামনের দিকে উদ্ধত ভাবে এগিয়ে আছে। লোকটির হাতে একটা মোটা বেতের লাঠি। লোকটি এমন ভাবে হাঁটছে যেন এ বাড়িটা ওর নিজের। লোকটা বেশ জোরে বেলটা টিপল।
হোমস চুপি চুপি বলল, “আসুন, এইবেলা আমরা দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। এই রকম লোককে মোকাবিলা করতে গেলে খুব সাবধান হতে হয়। ইন্সপেক্টর, হাতকড়াটা ঠিক করে রাখুন। ওর সঙ্গে কথাবার্তা যা বলবার, তা আমিই বলব।”
আমরা বোধহয় মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে এ কথাটা ঠিক যে, এ রকম দমবন্ধ করা মিনিটের কথা আমি জীবনে ভুলব না। তার পরই দরজা খুলে গেল। লোকটি ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল। আর চোখের পলকে হোমস তার পিস্তলটা লোকটির মাথায় চেপে ধরতেই ইন্সপেক্টর মার্টিন হাতকড়াটা পরিয়ে দিল। সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, লোকটি কিছু বুঝবার আগেই সে ইঁদুরের মতো জাঁতাকলে পড়ে গেল। লোকটি আমাদের দিকে খানিকক্ষণ স্থির ভাবে চেয়ে রইল। আর তারপর হো হো করে হেসে উঠল।
“নাহ, এবার আপনারা সত্যিই আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, এবার শক্ত ঘানির পাল্লায় পড়েছি। কিন্তু আমি তো মিসেস হিলটন ক্যুবিটের চিঠি পেয়েই এখানে এসেছি। তিনি নিশ্চয়ই কিছু জানেন না। আপনারা যদি বলেন যে, তিনিই আমাকে এই ভাবে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছেন, আমি তা বিশ্বাস করব না।”
“মিসেস হিলটন ক্যুবিট খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তিনি বেঁচে উঠবেন কিনা বলা শক্ত।”
লোকটি আর্তনাদ করে উঠল। সেই চিৎকারে গোটা বাড়িটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল।
লোকটা চিৎকার করে বলল, “আপনি ভুল বলছেন। মিঃ ক্যুবিট আহত হয়েছেন, মিসেস ক্যুবিটের কিছু হয়নি। এলসিকে কেউ আঘাত করতেই পারে না। আমি হয়তো ওকে শাসিয়েছি, কিন্তু ওর মাথার একগাছি চুল স্পর্শ করার কথাও আমি ভাবতে পারি না।”
“ওঁর স্বামীর দেহের পাশে উনি পড়ে ছিলেন। উনি সত্যিই খুব বেশি রকমের চোট পেয়েছেন।”
হোমসের কথা শুনে লোকটি হতাশ ভাবে সোফায় বসে পড়ল। তারপর কড়ালাগানো দু’হাতে মুখ গুঁজে রইল কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় নিজেই কথা বলতে লাগল। ওর ধরা ধরা গলার স্বর শুনে বুঝতে পারলাম যে, বেচারা একদম ভেঙে পড়েছে।
“আপনাদের কাছে আর আমার গোপন করার কিছুই নেই,” ও বলল। “আমাকে যদি কেউ গুলি করে মারতে চায়, আর সেই কারণে আমি যদি আত্মরক্ষার জন্যে গুলি ছুড়ে থাকি, তা হলে তা আইনের বিচারে কোনও অপরাধ নয়। কিন্তু আপনারা যদি ভেবে থাকেন যে, আমি কোনও ভাবে ওই মহিলাকে কষ্ট দিয়েছি তা হলে আপনারা আমাকেও চেনেন না আর ওই মহিলাকেও চেনেন না। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। এই ইংরেজটি আমাদের মধ্যে এসে পড়ল কেন? আমার সঙ্গে ওর প্রথমে বিয়ের ঠিক হয়েছিল আর তাই ওকে নিয়ে যাবার জন্যে আমি এসেছি।”
তিরস্কারের ভঙ্গিতে হোমস ওকে বলল, “আপনার ভয়েই ভদ্রমহিলা আমেরিকা থেকে পালিয়ে আসেন। ইংল্যান্ডে এসে তিনি একজন সৎ লোককে বিয়ে করেছিলেন। আপনি ওঁকে তাড়া করে ওঁর জীবনকে অশান্তিতে ভরিয়ে তুলেছিলেন। আপনি হয়তো জানেন না যে, ভদ্রমহিলা ওঁর স্বামীকে যেমন ভালবাসতেন তেমনই শ্রদ্ধাও করতেন। আপনি একজন সৎ নাগরিককে খুন করেছেন আর এক মহীয়সী মহিলাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। মিঃ অ্যাবে স্লেনি, এর জন্য আপনাকে আইনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।”
“এলসি যদি মারা যায়, তা হলে আমার যাই হোক না কেন, কিছু এসে যায় না,” অ্যাবে স্লেনি কথাটা নিজের মনেই বলল। তারপর হাতের মুঠো খুলে একটা দুমড়ানো কাগজের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখুন মশাই, আপনি আমাকে ধাপ্পা দিতে চাইছেন বলে মনে হচ্ছে।
এলসি যদি মরণাপন্নই হবে, তো সে এই চিঠি লিখল কী করে?”
কথাটা শেষ করেই ও কাগজের টুকরোটা আমাদের দিকে ছুড়ে দিল।
“আপনাকে এখানে টেনে আনবার জন্যে এই চিঠি আমি লিখেছি।”
“আপনি লিখেছেন? আমাদের দলের বাইরে এই গুপ্তলিপির কথা কেউ জানে না। আপনি জানলেন কী করে?”
“একজন মানুষ যদি মাথা খাটিয়ে কোনও কিছু আবিষ্কার করে তবে চেষ্টা করলে আর-একজনও সেটা বের করতে পারে।…যাই হোক মিঃ স্লেনি, আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে নরউইচ থেকে গাড়ি আসছে। আপনি অনেক অন্যায় করেছেন। তবে যাবার আগে আপনি অন্তত একটা ভাল কাজ করে যান। আপনি অকপটে স্বীকার করুন যে, যা ঘটেছে তার জন্যে মিসেস হিলটন ক্যুবিট কোনও মতেই দায়ী নন।”
“এর চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না। সত্যি কথা খুলে বললেই বোধহয় আমি এ যাত্রা রক্ষা পেতে পারি।”
ইন্সপেক্টর মার্টিন বললেন, “একটা কথা আপনাকে বলা দরকার। এখন আপনি যা বলবেন তা আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হতে পারে।”
“সে ঝুঁকি নিতে আমি রাজি আছি। এলসিকে আমি খুব ছোটবেলা থেকেই জানি। ওর বাবার নাম প্যাট্রিক। প্যাট্রিকের একটা দল ছিল। দলে আমরা মোট সাত জন ছিলাম। এই গুপ্তলিপি প্যাট্রিক বুড়োই মাথা খাটিয়ে বের করে। সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হয়, কোনও বাচ্চা ছেলে বুঝি নৃত্যরত কয়েকজন লোকের ছবি আঁকবার চেষ্টা করেছে। আমাদের দলের কাজকর্মের কিছু কিছু খবর এলসি রাখত। কিন্তু আমাদের কাজকর্ম তার ভাল লাগত না। এলসির কিছু সৎপথে আয় করা টাকা ছিল। সেই টাকা নিয়ে সে ইংল্যান্ডে চলে এল। আমি যদি অন্য কোনও কাজ করতাম, তা হলে এলসি হয়তো আমাকেই বিয়ে করত। প্রথমে আমি ও কোথায় গেছে জানতে পারিনি। ওই ইংরেজটির সঙ্গে বিয়ে হবার পর আমি এলসির খোঁজ পাই। আমি ওকে চিঠি লিখি। কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি। তারপর আমি এখানে চলে আসি। যখন দেখলাম চিঠিতে কোনও কাজ হচ্ছে না, তখন আমি এই গুপ্তলিপিতে আমার কথা এমন ভাবে লিখতে লাগলাম যাতে লেখাগুলো ওর নজরে পড়ে।
“প্রায় মাসখানেক হল আমি এখানে এসেছি। আমি ওই বাড়ির নীচের তলায় একখানা ঘর নিয়ে আছি। ঘরটার সুবিধে হচ্ছে যে, কাউকে না জানিয়ে যখন তখন বাইরে যাওয়া-আসা করা যায়। আমি প্রত্যেক রাত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতাম। কিন্তু কিছুতেই এলসির সঙ্গে সামনাসামনি যোগাযোগ করতে পারতাম না। অথচ আমার লেখাগুলো যে ওর চোখে পড়েছে, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। কেন না, একটা চিঠির জবাব ও দিয়েছিল। তারপর আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি ওকে শাসাতে লাগলাম। শেষকালে আমাকে ও খুব কাতর ভাবে একটা চিঠি লিখল। ও আমাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করল। শেষকালে এলসি একদিন বলল যে, রাত্রে ওর স্বামী যখন ঘুমোবে তখন ও আমার সঙ্গে দেখা করবে। তারপর ও সত্যি সত্যিই এল। আমাকে কিছু টাকা দিয়ে ও ভাগাতে চাইল। আমার ভয়ানক রাগ হয়ে গেল। আমি কোনও ভাবনাচিন্তা না করে ওর হাত ধরে টানলাম। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে ওর স্বামী এসে হাজির হল। এলসি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। আমি লক্ষ করেছিলাম যে, ওর স্বামীর হাতে পিস্তল আছে। ভয় দেখিয়ে পালাবার জন্যে আমি এলসির স্বামীর দিকে আমার পিস্তল তাক করলাম। ও আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। আমিও ছুড়লাম। ওর গুলিটা আমার গায়ে লাগেনি, কিন্তু আমার গুলিটা ওকে ঘায়েল করল। ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি, এই হল আসল ব্যাপার। তারপর আজ সকালে ছেলেটি যখন ওই চিঠি নিয়ে গেল, তখন আমি খুশিতে ডগমগ করতে করতে এখানে এসে হাজির হলাম। আর আপনাদের হাতে ধরা পড়লাম।”
ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে গিয়েছিল। মার্টিন অ্যাবে স্লেনিকে বললেন, “এবার থানায় যেতে হবে।”
যাবার আগে ওর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে কি?”
“না, উনি এখন অজ্ঞান হয়ে আছেন। মিঃ হোমস, আশা করব যে এই রকম জটিল রহস্যের তদন্তের ব্যাপারে আপনার সাহায্য পাব।”
গাড়িটা ওদের নিয়ে চলে গেল। পিছন ফিরে তাকাতেই টেবিলের ওপর কাগজের মোড়কটা আমার নজরে পড়ল। এই কাগজের টোপ দিয়েই হোমস স্লেনিকে টেনে এনেছিল।
হোমস হেসে বলল, ‘দেখো তো ওয়াটসন, চিঠিটা পড়তে পারো কিনা।”
কাগজে কিছুই লেখা নেই, শুধু কতকগুলো নৃত্যরত লোকের ছবি এই ভাবে সাজানো:

“আমি যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছি সেই ভাবে যদি পড়ো”, হোমস বলল, “তা হলে এর মানে দাঁড়ায় COME HERE AT ONCE। আমি জানতাম এই বার্তা এই ভাবে পাঠালে স্লেনি না এসে থাকতে পারবে না। আমার আনন্দ এইটুকু যে, গুন্ডাদের গুপ্তলিপির সাহায্যেই একটা বদমাশকে পাকড়াও করলাম। চলো, এবার যাওয়া যাক। তিনটে চল্লিশের ট্রেনটা ধরতে পারলে সন্ধের আগেই বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে যাব।”
শেষ করার আগে দুটো কথা বলা দরকার। অ্যাবে স্লেনির ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় আর মিসেস ক্যুবিট সুস্থ হয়ে উঠে তাঁর স্বামীর যাবতীয় অর্থ ব্যয় করেন গরিব লোকেদের সাহায্যের জন্য।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন