আর্থার কোনান ডয়েল
আমার বন্ধু শার্লক হোমসের স্বভাবের একটা দিক আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। তার ভাবনাচিন্তায় কোথাও এতটুকু অস্পষ্টতা বা গোলমাল নেই। তার মতো নিখুঁত গাণিতিক মন আর দ্বিতীয় কোনও মানুষের আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। জামাকাপড়ে তার কোনও বাবুয়ানা নেই বটে, তবে সে ছিমছাম পোশাক পরতেই ভালবাসে। কিন্তু উলটো দিকে সে অত্যন্ত এলোমেলো অগোছালো স্বভাবের মানুষ। তার সঙ্গে এক ঘরে যে বাস করবে, তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া কিছু অসম্ভব নয়। এর থেকে কেউ যেন মনে না করেন যে, আমি খুব সেজেগুজে ফিটফাট থাকতে ভালবাসি। আফগানিস্তানে যুদ্ধের ডাক্তার হিসেবে আমাকে প্রায় ভবঘুরের মতো থাকতে হত। আর তার ফলে আমার নিজের স্বভাবেও খানিকটা ছন্নছাড়া ভাব এসে গিয়েছিল। যদিও জানি ডাক্তারের স্বভাবে এ ধরনের দোষ থাকা উচিত নয়। কিন্তু হোমসের সঙ্গে তুলনা করলে আমাকে বেশ পরিষ্কার গোছদার লোকই বলবে। বিশেষ করে যদি দেখি যে, কোনও লোক কয়লার ঝুড়িতে তার সিগার রেখে দিয়েছে, কিংবা চটির পা গলাবার জায়গায় পাইপের তামাক রেখেছে, কিংবা চিঠিপত্র একটা বড় ছুরি দিয়ে কাঠের আলমারির গায়ে আটকে রেখেছে, তখন সত্যিই আমার মনে হয় যে, আমার অনেক গুণ আছে। আমার ধারণা, পিস্তল বা রিভলভারের টিপ ঠিক করতে হলে খোলা জায়গায় গিয়েই প্র্যাকটিস করাই উচিত। কিন্তু এক এক দিন হোমসের অদ্ভুত খেয়াল চাপত। সে ঘরের মধ্যে তার বসবার চেয়ারটা দেওয়ালের কাছে সরিয়ে নিয়ে এক বাক্স কার্তুজ আর পিস্তলটা নিয়ে বসে উলটো দিকের দেওয়ালে পিস্তলের গুলি ছুড়ে ছুড়ে একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিকের মতো V, R. খোদাই করত। আমার মনে হত যে, এ রকম করায় আমাদের ঘরের সৌন্দর্যও বাড়ত না, বা ঘরের আবহাওয়া বারুদের গন্ধে কিছু মনোরম হয়ে উঠত না।
আমাদের ঘরের চারদিকে নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, কোনও-না-কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়ানো টুকরোটাকরা সামগ্রী সব সময়েই ছড়ানো থাকে। তার ফলে হয় কী, মাখন রাখবার জায়গায় মাখন ছাড়া অন্য যে-কোনও জিনিসই পাওয়া যায়। সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে হোমসের কাগজপত্র নিয়ে। কোনও কাগজেই, বিশেষত সে কাগজ যদি কোনও অপরাধের ঘটনার সঙ্গে জড়ানো থাকে, তো সে কাগজ হোমস কিছুতেই নষ্ট করতে চায় না। তার ফলে প্রায়ই পাহাড়প্রমাণ কাগজ আমাদের ঘরে জমে যায়। দু’-এক বছর অন্তর কোনও দিন খেয়াল হলে হোমস ঘরের কাগজপত্র ঠিকঠাক করে রাখত। আমি হয়তো এর আগে অন্য কোথাও হোমসের স্বভাবের আর-একটা দিকের কথা লিখেছি। সেটা হচ্ছে এই যে, হোমস যখন কোনও কাজ করত, তখন তাকে দেখে মনে হত না, সে ক্লান্তি কাকে বলে তা জানে। তখন সে খাওয়া-ঘুম-বিশ্রাম সব একদম ভুলে যেত। কিন্তু এক এক সময়ে তার কী যে হত, তখন সে চুপচাপ সোফায় বসে হয় বই পড়ত, না-হয় বেহালা বাজাত। মাঝে মাঝে আবার শুধুই চুপ করে বসে থাকত। আর এই জন্যে মাসের পর মাস ঘরের মধ্যে কাগজ জমে জমে পা ফেলবার আর জায়গা থাকত না। কিন্তু সমস্যাটা হল এই যে, হোমসের মত না নিয়ে এই কাগজপত্র আবার সরানো যায় না।
শীতকাল। আগুনের ধারে আমরা বসেছিলাম। একটু আগে হোমস তার টুকরো খবরের খাতায় কাগজের কাটিং গঁদ লাগিয়ে জোড়া শেষ করেছে। আমি সাহস করে বললাম, “যদি কাগজপত্রগুলো একটু গুছিয়ে ফেলো তো ঘরটা বাসযোগ্য হয়, কী বলো হোমস?”
হোমস আমার কথায় ‘না’ বলতে পারল না। খুব দুঃখিত মুখ করে সে উঠে গেল। তারপর তার শোবার ঘর থেকে একটা টিনের বাক্স টানতে টানতে নিয়ে এল। বাক্সটা ঘরের মাঝখানে রেখে হোমস উবু হয়ে বসে বাক্সর ঢাকনাটা খুলে ফেলল। দেখলাম বাক্সটার দুইয়ের তিন ভাগ কাগজে বোঝাই। বান্ডিল করে সব লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা।
“ওয়াটসন”, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হোমস বলল, “এর মধ্যে তোমার লেখার অনেক মশলা আছে। বাক্সে কী আছে জানলে তুমি আমাকে সেগুলোই বের করতে বলতে। এই কাগজপত্রগুলো ঢুকিয়ে দিতে বলতে না।”
আমি বললাম, “এই এ সব তোমার রহস্য সমাধানের কাগজপত্র? আমি কতদিন ভেবেছি, এই সব তদন্তের ‘নোটস’ যদি আমার কাছে থাকত, কী ভালই না হত!”
“হ্যাঁ বন্ধু। এ কেসগুলো যখন আমার হাতে এসেছিল তখন আমার জীবনীকারের সঙ্গে তো পরিচয় হয়নি। ভেবো না যে, সব রহস্যেরই আমি ফয়সালা করতে পেরেছিলাম। এর মধ্যে টারলটন খুনের ব্যাপারটা আছে। ভ্যামবেরি মদওলার কেসটাও আছে। সেই বৃদ্ধা রুশ মহিলাকে নিয়ে যে কান্ড হয়েছিল সেটাও আছে। আর রিকোলেত্তি আর তার জাঁহাবাজ স্ত্রীর ব্যাপারটা। আ! আর এটা একটা বেশ জমাটি রহস্যভেদ বলতে পারো।”
হোমস বাক্সর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তলা থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করল। সাধারণ একটা বাক্স। ছেলেদের খেলনা রাখার বাক্স যে রকম হয়, সেই রকম। ঢাকনাটা ঠেলে খুলতে হয়। বাক্সটার ভেতর থেকে হোমস একটা ভাঁজ-করা কাগজ, একটা পুরনো ধরনের পেতলের চাবি, একটা লম্বা সুতো-জড়ানো কাঠের গোঁজ আর দাগ-ধরা তিনটে রেকাবি বের করল।
হোমস হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এগুলো সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়?”
“অদ্ভুত ধরনের জিনিস।”
“খুবই অদ্ভুত ধরনের জিনিস। আর এই জিনিসগুলোর সঙ্গে যে-কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে সেটা কিন্তু আরও অদ্ভুত।”
“এই জিনিসগুলোর মধ্যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে বলো?”
“বরং এই জিনিসগুলোই ইতিহাসের অংশ এটা বলাই সঙ্গত।”
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
শার্লক হোমস জিনিসগুলো একটা একটা করে তুলে টেবিলের একধারে রেখে দিল। তারপর নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তাকে দেখে মনে হল, যে-কোনও কারণেই হোক, সে খুব খুশি হয়েছে।
“মাসগ্রেভদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে নিয়ে যে-রহস্য গড়ে উঠেছিল, এই জিনিসগুলো সেই রহস্যভেদের সূত্র বলতে পারো।”
মাসগ্রেভদের এই ব্যাপারটার কথা হোমস আগে আমাকে দু’-একবার বলেছে। কিন্তু সব কথা খুলে কখনও বলেনি।
আমি বললাম, “মাসগ্রেভদের কথা তোমার কাছে এর আগেও শুনেছি। ব্যাপারটা যদি তুমি আমাকে খুলে বলো তো, ভাল হয়।”
“কী বলছ হে? কাগজপত্র এই রকম নোংরা ভাবে ঘরময় ছড়ানো থাকবে? তোমার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবার ইচ্ছেটা দেখছি খুব জোরালো নয়। যাই হোক, তুমি যদি এই কেসের কথা লেখো, তো ভালই হবে। এই মামলাটায় এমন অনেকগুলো পয়েন্ট আছে যা আমি নিজে কোনও কেসে পাইনি, কোথাও পড়িয়োনি। আমি যে-সব ছোটখাটো রহস্য সমাধান করেছি, সেগুলোর কথা যদি লেখো, তো এই ঘটনাটার কথাও লেখা উচিত।
‘“গ্লোরিয়া স্কট’ জাহাজটার কথা তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই হতভাগ্য ভদ্রলোকটি, যিনি আমাকে আমার বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতাকে গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগাবার কথা প্রথম বলেন, তাঁর কথাও তো তোমাকে বলেছি। এখন তো আমার নাম হয়েছে, খাতির হয়েছে। সাধারণ লোকই বলো আর পুলিশই বলো, যখন কোনও রহস্যের কূল পায় না, তখন আমার কাছে ছুটে আসে। এক হিসেবে বলতে পারো, ন্যায়বিচার না পাওয়ার শেষ ভরসা আমিই। এটা পুলিশও জানে, সাধারণ লোকও জানে। তোমার সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয়েছিল, সে কথা তো তুমি ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ নাম দিয়ে ছাপিয়েছ, তখন তো আমার মোটামুটি নামডাক হয়ে গেছে। কিন্তু গোড়ায় গোড়ায় আমাকে যে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে, কত ধৈর্য ধরতে হয়েছে, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
“আমি যখন প্রথম লন্ডনে আসি, তখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কোণে মনটেগু স্ট্রিটে ঘর নিয়েছিলাম। সেই সময়ে আমি কেবল পড়ছি। বিশেষ করে বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখার সম্বন্ধে যতদূর জানা যায়, তা জানতে চেষ্টা করেছি। আর কখন একটা রহস্য অনুসন্ধানের সুযোগ আসবে, তার আশায় বসে থেকেছি। দু’-একটা কেস যা আসত, সেগুলো সবই বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত লোকের দৌলতে। কেন না, কলেজের শেষের দিকে আমার বন্ধুরা আমার বিশ্লেষণপদ্ধতি সম্বন্ধে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। আমার জীবনের তিন নম্বর কেস হল মাসগ্রেভদের অনুষ্ঠানের রহস্য সমাধান। এই কেসের তদন্ত করতে গিয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আমার নজরে পড়েছিল। এই কেসের সঠিক সমাধানের ওপরে এমন কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বলতে গেলে একজনের জীবন-মরণের সমস্যা জড়িয়ে ছিল। আমার মনে হয়, এই রহস্য ভেদ করতে পারাই আমার গোয়েন্দা-জীবনের প্রথম বেশ বড় রকমের সাফল্য।
“রেজিনাল্ড মাসগ্রেভ আমার সঙ্গে একই কলেজে পড়ত। তার মুখ চেনা ছিল আমার। লক্ষ করতাম যে, ক্লাসের অন্য ছাত্ররা ওকে মোটেই পছন্দ করত না। সকলের ধারণা ছিল, ও খুব অহংকারী। আমার অবশ্য মনে হত, ও খুব লাজুক ধরনের ছেলে। চট করে কারও সঙ্গে মিশতে পারত না। আর সেটাকে সহপাঠীরা অহংকার বলে ভুল করত। রেজিনাল্ডের চেহারাটা খুব ভাল ছিল। একেবারে রাজার মতো দেখতে। টিকলো লম্বা নাক। বড় বড় চোখ। ব্যবহারটি ভারী সুন্দর, যেমন ভদ্র, তেমনই সংযত। আসলে ও আমাদের দেশের খুব প্রাচীন বংশের ছেলে। ওরা অবশ্য ওই বংশের ছোট তরফের। ষোলোশো সালের কোনও এক সময়ে ওরা উত্তর ইংল্যান্ডে ওদের গ্রাম ছেড়ে সাসেক্সের পশ্চিমে হারলস্টোনে চলে আসে। ওই অঞ্চলে ওদের চেয়ে পুরনো বাসিন্দে আর কেউ নেই। রেজিনাল্ডের চেহারায়, তার চোখেমুখে পশ্চিম সাসেক্সের আবহাওয়ার ছাপ পড়েছে। ওকে দেখলেই আমার বহু পুরনো খিলান দেওয়া গম্বুজওয়ালা, মোটাসোটা গরাদে-ঘেরা জমিদারবাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার কথাবার্তা হত। সুযোগ পেলেই ও আমার কাজের ধারা সম্বন্ধে প্রশ্ন করত। বুঝতাম যে, আমার কাজের ব্যাপারে ওর খুব কৌতূহল আছে।
“প্রায় বছর-চারেক ওর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ একদিন সকালবেলায় ও মনটেগু স্ট্রিটের বাসায় এসে হাজির। দেখলাম, ওর স্বভাবে আচারে-ব্যবহারে কোনও বদল হয়নি। পোশাক-পরিচ্ছদে সেই রকমই বাবু। কথাবার্তায় সেই রকম ধীরস্থির।
“মাসগ্রেভের সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে আমি বললাম, ‘তারপর রেজিনাল্ড, তোমার কী খবর?’
“তুমি শুনেছ বোধহয় যে, বছর-দুয়েক হল আমার বাবা মারা গেছেন। তারপর থেকে আমি হারলস্টোনেই আছি। জমি-জায়গা সবই আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়। এখন আবার আমি জেলাপরিষদের মেম্বার হয়েছি। ভীষণ কাজের চাপ। হোমস তোমার খবরাখবর আমার কানে আসে। ওহ, তোমার অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ, চুলচেরা বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে আমরা তো তাজ্জব বনে যেতাম। শুনেছি তুমি এখন ওই ক্ষমতাকেই জীবিকা করেছ।
‘“হ্যাঁ! বলতে পারো, আমি বুদ্ধি বেচে খাই।’
‘“বাহ। খুব ভাল হয়েছে। তোমার পরামর্শই এখন আমার বিশেষ দরকার। হারলস্টোনে কতকগুলো উদ্ভট ব্যাপার ঘটেছে। পুলিশ তো কোনও হদিসই করতে পারেনি। অদ্ভুত ব্যাপার। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না।’
“ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই আমার তখনকার মনের অবস্থা বুঝতে পারছ। আমি দম বন্ধ করে রেজিনাল্ডের কথা শুনতে লাগলাম। মাসের পর মাস চুপচাপ বসে আছি। মনে হল, এত দিন ধরে যে-ধরনের সুযোগের জন্যে আমি হাপিত্যেশ করে বসে আছি, সেই সুযোগ বুঝি এল। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, অন্যেরা যে-রহস্যের সমাধান করতে পারেনি, সে রহস্যের সমাধান আমি করতে পারব। এত দিন পরে আমার মনের ইচ্ছে বোধহয় পূর্ণ হতে চলেছে।
“আমি রেজিনাল্ডকে বললাম, ‘তুমি সব কথা আমাকে খুলে বলো।’
“রেজিনাল্ড যে-চেয়ারে বসে ছিল, সেটা আমার কাছে টেনে আনল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে লাগল, ‘তুমি জানো বোধহয়, আমি বিয়েটিয়ে করিনি। তবে একে তো আমাদের বাড়িটা খুব পুরনো, তার ওপর বাড়িটাও খুব বড়। তাই বাড়ি পরিষ্কার রাখবার জন্যে আমাকে অনেক লোকজন রাখতে হয়েছে। তা ছাড়া ওখানে শিকারেরও খুব সুবিধে আছে। প্রায়ই শিকার করতে বন্ধুবান্ধব পরিচিত লোকেরা আসে, আর আমার বাড়িতে থাকে। সবসুন্ধু আট জন কাজের মেয়ে, এক জন নায়েব, দু’জন আর্দালি আর এক জন সাধারণ ফাইফরমাশ খাটবার লোক আছে। এ ছাড়া বাগান আর আস্তাবলের জন্যে অন্য লোক আছে।
‘“এই যে লোকেদের কথা বললাম, এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন কাজ করছে নায়েব। এর নাম ব্রান্টন। আমার বাবার আমলের লোক। ব্রান্টন একটা স্কুলে পড়াত। তারপর সে চাকরি ছেড়ে দেয়। আমার বাবা তাকে চাকরি দেন। লোকটি যেমন সৎ তেমনই পরিশ্রমী। অল্প দিনের মধ্যেই এমন হল যে, ব্রান্টনকে ছাড়া আমাদের সংসার অচল। ব্রান্টনকে দেখে মনে হত, ভাল বংশের ছেলে। চেহারাটি সুন্দর। ও আমাদের বাড়িতে কুড়ি বছরেরও বেশি কাজ করছে। তবে ওর বয়স বেশি নয়। খুব বেশি হলে বছর-চল্লিশেক হবে। ও অনেকগুলো ভাষা জানে। আর হেন বাজনা নেই, যা বাজাতে পারে না। এ রকম একজন গুণী লোক যে হারলস্টোনের মতো জায়গায় সামান্য নায়েবের চাকরি করে খুশি থাকবে, তা ভাবাই যায় না। হয়তো অলস প্রকৃতির লোক বলেই শহর থেকে দূরে ওই জায়গাটা ওর এত ভাল লেগে গিয়েছিল। যাই হোক, আমাদের বাড়িতে যারা আসে তারা সকলেই ব্রান্টনকে পছন্দ করে।
“ব্রান্টনের চরিত্রে একটা বড় দোষ আছে। সেটা হল, একটু বেশি মাত্রায় আমুদে। বুঝতেই পারছ, ওর নানা গুণের জন্যে বন্ধুর সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। কিছু দিন আগে ব্রান্টনের স্ত্রী মারা গেছেন। হঠাৎ একদিন আমি শুনলাম, সে র্যাচেল হাওয়েল বলে আমাদের যে-কাজের মেয়েটি আছে তাকে বিয়ে করবে। তবে পরে এ সম্বন্ধে আর কিছু শুনিনি। ওদের বিয়েও হয়নি। মেয়েটা খুব ভাল। তবে ওয়েলসের লোকেদের যা স্বভাব, র্যাচেল একটু বদরাগী। কিছু দিন আগে র্যাচেলের ব্রেন ফিভার হয়েছিল। এখন সেরে গেছে বটে তবে চেহারা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। ওকে দেখলে কষ্ট হয়। ইতিমধ্যে একদিন শুনলাম, ব্রান্টন নাকি আমার জন্তুজানোয়ারের দেখাশোনা করার যে লোকটি আছে তার মেয়েকে বিয়ে করবে। কিন্তু এরই মধ্যে একটা সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। যার ফলে ব্রান্টনকে বরখাস্ত করতে আমি বাধ্য হয়েছি।
‘“ব্যাপারটা যা ঘটেছে তোমাকে বলছি: ব্রান্টন খুবই বুদ্ধিমান। আর এই অতি বুদ্ধিই তার পতনের কারণ হয়েছে। বুদ্ধি বেশি বলে ওর জানবার আগ্রহটা বেশি। এমনকী, যে-সব ব্যাপারে ওর নাক গলানোর কোনও দরকার নেই, সেসব ব্যাপারেও নাক গলাবে। তার এই অনুচিত কৌতূহল যে তাকে কত দূর বা কত নীচে নিয়ে যেতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না।
‘“আমাদের বাড়ি বেশ বড়। গত বৃহস্পতিবার রাত্রে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি, কিছুতেই ঘুম আসছে না। হয়েছিল কী, সে দিন রাতের খাওয়াদাওয়ার পর আমি দুধ ছাড়া কড়া এক কাপ কফি খেয়েছিলাম। আর তাতেই ঘুম গেল চটে। রাত দুটো অবধি চেষ্টা করেও যখন ঘুম এল না, তখন বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। ঘরের আলো জ্বেলে ভাবলাম সন্ধেবেলায় যে-বইটা পড়ছিলাম, সেটাই পড়ি। বইটি নীচের বিলিয়ার্ড রুমে ফেলে এসেছিলাম, আমি বইটা আনতে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে একটা বারান্দা। সেই বারান্দার একপ্রান্তে একটা ঘর। সেটা লাইব্রেরি আর আমাদের অস্ত্রাগার বলতে পারো। বারান্দায় পা দিতেই আমি দেখতে পেলাম, লাইব্রেরি ঘরের দরজা খোলা। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে। আমি তো রীতিমতো অবাক। এ কী কাণ্ড! আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি লাইব্রেরির আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার মনে হল, নিশ্চয়ই তা হলে চোর এসেছে। আমাদের হারলস্টোনের বাড়ির দেওয়ালে সাজাবার জন্যে অনেক পুরনো পুরনো তরোয়াল, ছোরাছুরি সব টাঙানো আছে। আমি দেওয়াল থেকে একটা ভারী কুড়ুল পেড়ে নিলাম। তারপর আমার হাতের মোমবাতিটা সেইখানে নামিয়ে রেখে পা টিপে টিপে লাইব্রেরি ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম।
‘“লাইব্রেরির মধ্যে ব্রান্টন। সেজেগুজে সে একটা আরামকেদারায় বসে রয়েছে। তার দুই হাঁটুর ওপর একটা কাগজ ছড়ানো। দূর থেকে দেখে মনে হল, কোনও ম্যাপট্যাপ হবে। ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে ব্রান্টন গভীর ভাবে চিন্তা করছিল। টেবিলের এক কোণে একটা ছোট মোমবাতি জ্বলছিল। সেই মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় দেখলাম, ব্রান্টন বাইরে যাবার পোশাক পরে আছে। হঠাৎ সে উঠে পড়ল। তারপর একটা আলমারির কাছে উঠে গিয়ে আলমারির তালা খুলে সেখান থেকে একটা কাগজ বের করে নিল। তারপর চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর কাগজটা বেশ ভাল করে বিছিয়ে সেটাকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ব্রান্টন আমাদের পারিবারিক কাগজপত্র এ ভাবে দেখছে দেখে আমার প্রচণ্ড রাগ হল। আমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লাম। ব্রান্টন চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। ভয়ে তার মুখটা সাদা হয়ে গিয়েছিল। তার হাতে যে-ম্যাপের মতো দেখতে কাগজটা ছিল সেটা সে চট করে জামার মধ্যে পুরে নিল।
“ ‘আমি বললাম, ‘তোমাকে আমরা এত বিশ্বাস করি আর তুমি কিনা এই রকম নোংরা কাজ করলে! কালই তুমি আমার চাকরি ছেড়ে চলে যাবে।’
‘“ব্রান্টন মাথা নিচু করে আমাকে অভিবাদন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দেখে মনে হল, সে একদম ভেঙে পড়েছে। টেবিলের ওপর মোমবাতিটা তখন জ্বলছিল। সেই আলোতে ব্রান্টন আলমারি থেকে যে-কাগজটা বের করেছিল, সেটা দেখলাম। কাগজটা দামি বা গোপনীয় কিছু নয়। একটা কাগজে কিছু প্রশ্ন আর তার উত্তর লেখা। আমাদের বংশে একটা অনুষ্ঠান চালু আছে। সেটাকে ‘মাসগ্রেভ-অনুষ্ঠান’ বলে। এই অনুষ্ঠান একদম আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠান। এটা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের বংশে চলে আসছে। প্রত্যেক মাসগ্রেভকে একটা বয়সের পর এই আচার পালন করতেই হয়। এই ব্যাপারে আমাদের বংশের লোকেদের ছাড়া প্রাচীন ইতিহাস বা পুরাতত্ত্বে যাদের উৎসাহ আছে, তাদের হয়তো কিছু কৌতূহল হলেও হতে পারে। কিন্তু এটার থেকে কারও কিছু লাভ হবে বলে তো মনে হয় না।’
“আমি রেজিনাল্ডকে বললাম, ‘কাগজটার কথায় আমরা পরে আসব।’
“একটু ইতস্তত করে রেজিনাল্ড বলল, ‘বেশ, তুমি যা বলছ তাই হবে।…যাই হোক, আমি আলমারিটা চাবি দিয়ে দিলাম। ব্রান্টন চাবিটা টেবিলে রেখে গিয়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি এমন সময় দেখলাম ব্রান্টন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
“ ‘ধরা ধরা গলায় সে বলল,“সার, আমি অপমান সহ্য করতে পারব না। জীবনে আমি সব সময় নিজের আত্মমর্যাদা বাঁচিয়ে চলেছি। এই বয়সে যদি মান খোয়াতে হয় তো আমি মরে যাব। আমার মৃত্যুর জন্যে আপনিই দায়ী হবেন। আজ যে কাণ্ড ঘটে গেল, তারপর আপনি যদি আমাকে আর রাখতে না পারেন, তবে ভগবানের দিব্যি আমাকে এক মাস সময় দিন। এক মাস পরে আমি চাকরি ছেড়ে চলে যাব। লোকে জানবে আমিই ইস্তফা দিয়ে চলে গেলাম। এখানে অনেকে আমাকে চেনে, তারা যেন জানতে না পারে যে, বদনাম মাথায় করে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।”
“ ‘আমি বললাম, “দেখো, তুমি যা করেছ এরপর তোমার জন্যে এত দরদ আমার নেই। তুমি খুব অন্যায় কাজ করেছ। যাক, যে-হেতু তুমি অনেক দিন আমাদের বাড়িতে কাজ করেছ আমি তোমাকে পাঁচজনের সামনে অপমান করতে চাই না। এক মাস সময় আমি তোমাকে দিতে পারি না। বড়জোর এক সপ্তাহ দিতে পারি, এর মধ্যে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলে চাকরি ছেড়ে দিতে পারো।”
“ ‘ব্রান্টন খুব কাতর ভাবে বলল, “মাত্র এক সপ্তাহ! না, না, আমাকে অন্তত পনেরোটা দিন সময় দিন।”
“ ‘আমি বললাম, “না, এক সপ্তাহের বেশি একটি দিনও নয়। জানবে, তোমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছি।”
“ ‘আর কোনও কথা না বলে ব্রান্টন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দেখলাম, সে খুব ভেঙে পড়েছে। আমিও আলো নিভিয়ে দিয়ে চলে এলাম।”
“রেজিনান্ড একটু থেমে আবার বলে চলল, ‘দু’দিন কেটে গেল। আমিও আর সেই রাত্তিরের কথা তুলিনি। ব্রান্টন রোজ সকালে আমার কাছে এসে সে দিন কী কী কাজ করতে হবে জেনে যেত। তিন দিনের দিন সে সকালবেলা আমার কাছে এল না দেখে আশ্চর্য হলাম। সকালবেলা জলখাবারের পালা চুকিয়ে খাবারঘর থেকে বেরিয়েছি এমন সময় র্যাচেল হাওয়েলের সঙ্গে দেখা। হোমস, তোমাকে বোধহয় আগে বলেছি যে র্যাচেলের খুব অসুখ করেছিল। ওকে দেখে আমার মনে হল, ওর বোধহয় আবার শরীর খারাপ হয়েছে।
“ ‘আমি বললুম, “দেখো র্যাচেল, তোমার আরও কিছু দিন বিশ্রাম নিয়ে শরীরটা ঠিক করে নেওয়া দরকার। শরীরে বল পেলে আবার কাজ কোরো।”
“ ‘আমার কথা শুনে র্যাচেল এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যে, আমার মনে হল, ওর বোধহয় মাথার গোলমাল হয়ে গেছে। ও বলল, “না, আমার শরীর ঠিক আছে।”
“ ‘আমি বললাম, “ঠিক আছে। ডাক্তারবাবু কী বলেন শোনা যাক। তুমি এক্ষুনি কাজ বন্ধ করে ঘরে গিয়ে বোসো…ভাল কথা, ব্রান্টনকে বলে যাও যে, সে যেন এক্ষুনি একবার আমার সঙ্গে দেখা করে।”
“ ‘র্যাচেল বলল, “নায়েবমশাই তো চলে গেছেন।”
“ ‘আমি বললাম, “চলে গেছেন? কোথায় গেছেন?”
“র্যাচেল বলল, “তিনি চলে গেছেন। তাঁকে কেউ দেখেনি। উনি ওঁর ঘরে নেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনি চলে গেছেন, চলে গেছেন,” বলতে বলতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পাগলের মতো হাসতে লাগল। ওর ব্যাপারস্যাপার দেখে আমি তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি লোকজনদের ডেকে পাঠালাম। র্যাচেলকে তো জোর করে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ও আর তখন হাসছিল না। কাঁদছিল। আমি ব্রান্টনের খোঁজে গেলাম। সত্যিই, ব্রান্টন নেই। তার ঘরের বিছানা দেখে মনে হল যে, বিছানায় সে কাল শোয়নি। তাকে রাত্তিরবেলায় কেউ ঘর থেকে বেরোতেও দেখেনি। একতলার দরজা-জানলা সব বন্ধ ছিল। কী করে ব্রান্টন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল সেটা বোঝা গেল না। তার কাপড়জামা, টাকাপয়সা ঘুড়িটাড়ি সবই তার ঘরে রয়েছে। শুধুমাত্র যে-কালো পোশাকটা সে বেশির ভাগ সময় পরত, সেটা নেই। তার জুতোজোড়া রয়েছে, কিন্তু চটিজোড়া নেই। রাত্তিরের অন্ধকারে ব্রান্টন তা হলে গেল কোথায়? আর তার হলই বা কী?
“ ‘আমরা তো সারা বাড়িটা, নীচের তলার ভাঁড়ারঘর থেকে, ছাদের চিলেকোঠা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু ব্রান্টনের টিকির হদিসও পেলাম না। আমাদের বাড়িটা আগেই বলেছি, খুব পুরনো। বলতে পারো একটা গোলকধাঁধার মতো। মূল বাড়িটায় এখন আর আমরা কেউ থাকি না। সেই দিকের ঘরগুলো এমনিই পড়ে আছে। আমরা সেই পুরনো বাড়ির অবশ্য যে-ঘরগুলো আছে সেগুলো খুঁজে দেখলাম। কিন্তু ব্রান্টনের চিহ্নমাত্র পেলাম না। ব্রান্টনের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছিল না। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কেন ব্রান্টন নিজের জিনিসপত্র ফেলে রেখে এ ভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল। আর তা ছাড়া ও গেলই বা কোথায়? পুলিশকে খবর দিলাম। কোনও ফল হল না। রাত্তিরবেলা বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা বাড়ির চারপাশে অনেক খুঁজলাম, কিন্তু কোনও সন্ধানই পেলাম না। এরই মধ্যে আরও একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল।
‘দিন-দুয়েক হল র্যাচেলের খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। কখনও জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিল, কখনও বা পাগলের মতো কাণ্ড করছিল। ওর জন্যে একজন নার্স ঠিক করে দিয়েছিলাম। ব্রান্টন উধাও হবার দিন-তিনেক পরে এক রাত্তিরে র্যাচেল একটু সুস্থ বোধ করছিল। তাই ওর কাছে যে-নার্সটি ছিল সে আরামকেদারায় বসে বিশ্রাম করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে উঠে নার্স দেখল ঘরের জানলা খোলা, বিছানা খালি, র্যাচেল নেই। নার্স তখনই ছুটে গিয়ে আমাকে খবর দেয়। আমি দু’জন আর্দালিকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খুঁজতে বেরিয়ে গেলাম। র্যাচেল যে কোন দিকে গেছে তা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। ওর ঘরের জানলার নীচে থেকে টানা ওর পায়ের ছাপ চলে গেছে মাঠ পেরিয়ে একটা পুকুরের কাছ পর্যন্ত। তারপর আর পায়ের দাগ নেই। সেইখান থেকে একটা নুড়ি ফেলা রাস্তা বেরিয়েছে। পুকুরটা আট ফুট গভীর। যখন দেখলাম যে, র্যাচেলের পায়ের ছাপ পুকুরধার পর্যন্ত এসে থেমে গেছে, তখন আমার মনে কী অবস্থা হল, তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারবে।
‘“যাই হোক, আমি তো লোক দিয়ে পুকুরে জাল ফেললাম। র্যাচেলের দেহ বা কোনও কিছুই পাওয়া গেল না। জালে উঠে এল একটা কাপড়ের থলি। থলির ভেতর পাওয়া গেল বহুকালের পুরনো মরচে-ধরা রংচটা একতাল ধাতু আর কতকগুলো ঘষা পাথরের নুড়ি বা কাঁচের গুলি। পুকুরটা তোলপাড় করেও আমরা আর কিছু পাইনি। তারপর কাল সারা দিন ধরে আমরা সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খোঁজ করেছি, কিন্তু র্যাচেল বা ব্রান্টন কাউকেই পাওয়া যায়নি। পুলিশও খুঁজছে বটে, তবে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। সেই জন্যে আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তুমিই আমার শেষ ভরসা।’
“ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে, কী অধীর আগ্রহে আমি রেজিনাল্ডের কথা শুনছিলাম। ঘটনাগুলো সত্যিই খুবই অদ্ভুত। খাপছাড়া ঘটনা। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম এই এলোমেলো খাপছাড়া ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে নিতে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে কি কোনও যোগাযোগ আছে? থাকলে সেটা কী?
“নায়েব চলে গেছে। কাজের একটি মেয়ে অদৃশ্য হয়েছে। এই মেয়েটির সঙ্গে নায়েবের বিয়ের কথা হয়েছিল। যে-কোনও কারণেই হোক, সে বিয়ে ভেঙে যায়। মেয়েটির দেশ ওয়েলসে। এরা খুব জেদি আর রাগী হয়। নায়েব গা-ঢাকা দেবার পর ওই মেয়েটি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। মেয়েটি একটা থলিতে পুরে অদ্ভুত কিছু বস্তু পুকুরে ফেলে দিয়ে গেছে।…এই হচ্ছে ঘটনা। এই ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই জটিল রহস্যের উদঘাটনের সূত্র কোনটা? কোন পথে এগোলে ফল পাব?
“আমি মাসগ্রেভকে বললাম, ‘যে-কাগজটা ব্রান্টন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল সে কাগজটা আমার চাই।’
“মাসগ্রেভ বলল, ‘আমাদের এই যে পারিবারিক আচার, এটার কোনও মানে আছে বলে মনে হয় না। পাগলামি বলতে পারো। তবে অনেক দিনের প্রথা। যাই হোক, আমার কাছে একটা নকল আছে। এতে কতকগুলো প্রশ্ন আর উত্তর লেখা আছে। তুমি দেখতে পারো।’
“এই যে কাগজটা ওয়াটসন দেখছ, এটা মাসগ্রেভ আমাকে দিয়েছিল। মাসগ্রেভ বংশের প্রত্যেক সন্তানকে এই আচার পালন করতেই হয়। আমি তোমাকে প্রশ্ন আর উত্তরগুলো পড়ে শোনাচ্ছি:
‘“এটা কার ছিল?’
‘“যে চলে গেছে তার।’
‘“এটা কে পাবে?’
‘“যে আসবে সে পাবে।’
‘“সেটা কোন মাস?’
‘“প্রথম থেকে শুরু করে ষষ্ঠ মাস।’
‘“সূর্য তখন কোথায় ছিল?’
‘“ওক গাছের মাথায়।’
‘“ছায়া তখন কোথায় ছিল?’
‘“এলম গাছের নীচে।’
‘“কী ভাবে যেতে হয়েছিল?’
‘“উত্তর দিকে দশ আর দশ, পুবে পাঁচ আর পাঁচ, দক্ষিণে দুই আর দুই, পশ্চিমে এক আর এক, তারপর নীচে।’
‘“এটার জন্যে আমরা কী দেব?’
‘“আমাদের যা কিছু আছে সব।’
‘“কেন আমরা এটা দেব?’
‘“বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবার জন্যে।’
“মাসগ্রেভ বলল, ‘মূল কাগজটায় কোনও তারিখ নেই। তবে লেখার ভঙ্গি আর বানান দেখে মনে হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হবে। আমার মনে হয়, এই রহস্য-ভেদ করার ব্যাপারে এই কাগজটা তোমার কোনও কাজেই লাগবে না।’
“আমি বললাম, ‘আর কিছু না হোক, এটা একটা রহস্য তো বটে। বোধহয় প্রথমটার চেয়ে বেশিই ইন্টারেস্টিং। এমন হতে পারে যে, এই রহস্যের সমাধান করতে পারলে দ্বিতীয় রহস্যটারও ফয়সালা হয়ে যাবে। রেজিনাল্ড, কিছু মনে কোরো না, তোমার পূর্বপুরুষদের চাইতে ব্রান্টন ঢের বেশি বুদ্ধিমান লোক।’
“রেজিনাল্ড মাসগ্রেভ বলল, ‘দেখো হোমস, তোমার কথাটা ঠিক ধরতে পারলাম না। আমার মনে হয়, কাগজটার বিশেষ কোনও মূল্য নেই।’
‘“কিন্তু আমার ধারণা, এই কাগজটা বিশেষ মূল্যবান। আর তোমার নায়েব ব্রান্টনও সেটা বুঝতে পেরেছিল। তোমার হাতে সে রাতে ধরা পড়বার আগে সে নিশ্চয়ই এই কাগজটাই দেখছিল।’
‘“খুবই সম্ভব। আমরা তো কাগজটাকে লুকিয়ে রাখিনি।’
‘“আমার মনে হচ্ছে শেষ বারে ব্রান্টন কাগজটা মুখস্থ করছিল। আর ওর কাছে যে কাগজটা ছিল, সেটা একটা ম্যাপ কিংবা নকশা। আসল লেখাটার সঙ্গে ও ওই ম্যাপ বা নকশাটা মিলিয়ে নিচ্ছিল।’
‘“তাই হবে। তবে আমাদের বংশের ওই অদ্ভুত আচারে ওর এত কৌতূহল কেন? আর ওই উদ্ভট প্রশ্ন আর উত্তরের মানেই বা কী?’
“আমি বললাম, ‘এই কাগজের লেখার মানে বোঝাটা মোটেই শক্ত নয়। এখন ও কথা থাক। তোমার আপত্তি না থাকলে আমরা প্রথম যে-ট্রেন পাব সেটা ধরে সাসেক্স যাব। এর পরের যে-কাজ সেটা ওখানে গিয়ে করতে হবে।’
“ও দিন বিকেলে আমরা দু’জনে হারলস্টোন পৌঁছে গেলাম। ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই কোথাও-না-কোথাও ওই বিখ্যাত বাড়িটার কথা পড়েছ বা বাড়িটার ছবি দেখেছ। বাড়িটা দেখতে ‘এল’ অক্ষরের মতো। লম্বা দিকটা নতুন। আর ছোট দিকটাই মূল বাড়ি। ওই অংশটা থেকে নতুন দিকটা আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে। মূল বাড়ির ঠিক মাঝখানে একটা ছোট দরজা। দরজার ওপরের খিলেনে ১৬০৭ খোদাই করা। তবে বাড়ির কড়িবরগা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, বাড়িটা ১৬০৭ সালের ঢের আগে তৈরি হয়েছিল। পুরনো বাড়িটার দেওয়ালগুলো খুব পুরু আর জানলাগুলো ভীষণ ছোট ছোট। সেই জন্যেই বোধহয় গত শতাব্দীতে এই নতুন বাড়িটা করা হয়েছিল। এখন পুরনো বাড়িটা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাড়িটার চার দিকে সুন্দর বাগান। তাতে দামি দামি গাছ। বাড়িটার থেকে আন্দাজ দু’শো গজ দূরে রাস্তার ধারে একটা পুকুর। পুকুরটার কথা তো আগেই বলেছি।
“ওয়াটসন, আমি গোড়াতেই একটা কথা বুঝেছিলাম। সেটা হল রেজিনাল্ড যদিও তিনটে সমস্যার কথা বলছে, আসলে সমস্যা একটাই। আর মাসগ্রেভদের পারিবারিক যে-আচার তার মানেটা যদি বুঝতে পারি তা হলে ব্রান্টন আর র্যাচেলের উধাও হওয়ার ব্যাপারটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি প্রথমে মাসগ্রেভদের ওই ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কেন ব্রান্টন এই উদ্ভট প্রশ্ন আর উত্তর লেখার কাগজটার সম্বন্ধে এত কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল? নিশ্চয়ই সে এর মধ্যে এমন একটা মানে খুঁজে পেয়েছিল, যেটা রেজিনাল্ডের বাপ-ঠাকুরদা ধরতে পারেননি। ব্রান্টন নিশ্চয়ই জানত যে, এই কাগজটার থেকে তার বেশ কিছু লাভ হবে। কিন্তু এই কথাগুলোর মানেটা কী? আর মানে বুঝে ব্রান্টনের লাভটাই বা হল কী?
“রেজিনাল্ডের কাগজটা পড়ে আমি আর-একটা জিনিসও বুঝতে পেরেছিলাম। সেটা হল, কাগজে যে-হিসেবটা দেওয়া আছে, সেটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছোবার মাপ। আর সেই জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারলে যে-কথাটা মাসগ্রেভরা এমনভাবে গোপন রেখেছে, সেটা বোঝা আমার পক্ষে মোটেই কষ্টকর হবে না। দুটো নিশানা ওই লেখাটাতেই দেওয়া আছে। একটা নিশানা হল ওকগাছ আর একটা হল এলমগাছ। ওকগাছটাকে নিয়ে কোনও সমস্যাই হল না। বাড়িটার ঠিক সামনে রাস্তার বাঁ দিকে একটা বিরাট ওকগাছ। ওই জায়গাটায় আরও ওকগাছ আছে, তবে এটার তুলনায় সেগুলো যেন নেহাতই চারাগাছ। অতবড় প্রকাণ্ড ওকগাছ আমি আগে দেখিনি।
“গাছটার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমি রেজিনাল্ডকে বললাম, ‘তোমাদের ওই কাগজটা যখন লেখা হয় তখন ওই ওকগাছটা ওইখানেই ছিল?’
“রেজিনাল্ড বলল, ‘যতদূর জানি ওটা নরম্যান কংকোয়েস্টের সময়ও ছিল। গাছটার গুঁড়ির বেড় কত জানো? তেইশ ফুট।’
“রেজিনাল্ডের কথায় আমার একটা নিশানা স্থির হয়ে গেল।
“আমি বললাম, ‘কাছাকাছি কোথাও একটা প্রাচীন এলমগাছ আছে?’
‘“ওই যে ওই দিকে দেখছ, ওখানে একটা খুব বুড়ো এলম ছিল। কিন্তু বছর-দশেক আগে বাজ পড়ে গাছটা মরে যায়। তারপর গাছটার গুঁড়ি থেকে কেটে ফেলা হয়।’
‘“গাছটা কোথায় ছিল তুমি দেখাতে পারো?’
‘“খুব পারি।’
‘“এখানে আর কোনও এলমগাছ নেই?’
‘“না, বুড়ো এলমগাছ আর নেই। তবে অনেক বিচি-গাছ আছে?’
‘“এলমগাছটা যেখানে ছিল সেখানটা একবার দেখা দরকার।’
“আমরা গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। রেজিনাল্ড বাড়ির কাছে গাড়ি না থামিয়ে বাগানের একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল। সেখানে খানিকটা জায়গা জুড়ে পুড়ে যাবার মতো কালো একটা দাগ। এই জায়গাটা বাড়ি আর সেই বিরাট ওক গাছটার মাঝামাঝি। আমি খুশি হলাম। তদন্ত বেশ ভাল ভাবেই এগোচ্ছে।
“রেজিনাল্ডকে বললাম, ‘গাছটা কত উঁচু ছিল সেটা বোধহয় জানা যাবে না?’
‘“হ্যাঁ। এক্ষুনি বলতে পারি। গাছটা ৬৪ ফুট লম্বা ছিল।’
“আমি সত্যিই খুব অবাক হয়ে গেলাম। রেজিনাল্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কী করে জানলে?’
‘“আমার মাস্টারমশাই আমাকে যখনই ট্রিগোনোমেট্রি শেখাতেন তিনি সব সময়েই উচ্চতা মানে কোনও জিনিস কত উঁচু এবং সেটা কী করে মাপতে হয় তাই শেখাতেন। আমি তাই খুব অল্প বয়সে এ অঞ্চলের যত গাছ আছে সেগুলো কত উঁচু তা কষে বের করেছিলাম। আমাদের বাড়িটাও কতখানি উঁচু তাও অঙ্ক কষে বের করেছিলাম।’
“রেজিনাল্ডের কথায় মনে হল যে, আমার ভাগ্য ভাল। যত তাড়াতাড়ি দরকারি সূত্র পাব মনে করেছিলাম তার চাইতে ঢের তাড়াতাড়ি অনেক বেশি সূত্র পেয়ে গেলাম।
‘“আচ্ছা রেজিনাল্ড, তোমাদের নায়েব ব্রান্টন কি কখনও এ রকম প্রশ্ন তোমায় করেছিল?’
“আমার কথা শুনে রেজিনাল্ড খুব আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘তুমি জানতে চাইলে বলে কথাটা মনে পড়ল। মাসকয়েক আগে ব্রান্টন এলমগাছটা কত উঁচু ছিল, জানতে চেয়েছিল। তার সঙ্গে আস্তাবলের সহিসের মধ্যে এ ব্যাপারে জোর তর্ক হয়েছিল।’
একটুক্ষণ থেমে শার্লক হোমস শুরু করল, “ওয়াটসন, কথাটা শুনে আমি খুব খুশি হলাম। বুঝলাম, আমি ঠিক পথেই চলেছি। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য হেলে পড়েছে। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সূর্য গাছটার সবচেয়ে উঁচু ডালটার ওপরে চলে আসবে। তখনই মাসগ্রেভদের আচারের একটা শর্ত পূরণ হবে। আর এলমগাছের ছায়া নিশ্চয়ই উলটো দিকের সীমানা বোঝাচ্ছে না। না হলে এলমগাছের গুঁড়িটাকে নিশানা হিসেবে নেওয়া হত। এখন দেখতে হবে সূর্য যখন ওকগাছের ওপরে থাকে, তখন এলমগাছের ছায়া কোথায় পড়ত।”
“হোমস,” আমি বললাম, “এ কাজটা তো সোজা নয়। গাছটাই যখন নেই, তখন তার ছায়া কোথায় পড়বে সেটা জানা যাবে কী করে?”
“ব্রান্টন যখন সেটা বের করতে পেরেছিল তখন আমি সেটা বের করতে পারব, এ বিশ্বাস আমার ছিল। আর তা ছাড়া কাজটা তো কিছু শক্ত নয়। রেজিনাল্ডের সঙ্গে ওদের বাড়িতে পৌঁছে ওর বসবার ঘরে বসে আমি প্রথমেই একটা কাঠের টুকরো জোগাড় করে সেটাকে ছুলে এই গোঁজটা তৈরি করলাম। তারপর গোঁজটার সঙ্গে এই লম্বা সুতোটা বাঁধলাম। শেষকালে এই সুতোটায় ঠিক এক গজ অন্তর অন্তর একটা করে গিঁট দিতে লাগলাম। রেজিনাল্ড একটা ছিপ নিয়ে এল। সেটা ছ’ফুট লম্বা। ছিপটিপ নিয়ে আমি আর রেজিনাল্ড এলমগাছের গুঁড়িটার কাছে গেলাম। সূর্য তখন ওকগাছের মাথায়। আমি ছিপের একটা দিক দড়ি দিয়ে বেঁধে খাড়া দাঁড় করিয়ে দিলাম। ছায়া কোন দিকে পড়ছে দেখলাম। তারপর ছায়ার দৈর্ঘ্য মাপলাম। ন’ফুট।
“এর পরের হিসেবটা সোজা। ছ’ফুট লম্বা ছিপের ছায়া যদি ন’ফুট লম্বা হয়, তবে চৌষট্টি ফুট লম্বা গাছের ছায়া হবে ছিয়ানব্বুই ফুট। আর ছিপের ছায়া যে-দিকে পড়েছে গাছের ছায়াও সেই দিকেই পড়বে। আমি গুঁড়ির কাছ থেকে যে-দিকে ছায়া পড়েছে, সে দিকে ছিয়ানব্বুই ফুট মেপে নিলাম। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়লাম। সেইখানে জমিতে একটা কাঠের গোঁজ পুঁতে দিলাম। ওয়াটসন, যখন দেখলাম, যে-জায়গায় আমি গোঁজ পুঁতেছি তার দু’ইঞ্চি পরিমাণ দূরে একটা ছোট মতন গর্ত তখন আমার মনের অবস্থা যে কী হল, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। বুঝলাম, এই গর্তটা ব্রান্টন ছায়ার দৈর্ঘ্য মাপতে গিয়ে করেছে। বুঝলাম আমি ঠিক পথেই চলেছি।
“এই জায়গা থেকে আমি পা গুনে গুনে এগোতে লাগলাম। প্রথমে পকেট থেকে কম্পাস বের করে চারটে দিক ঠিক করে নিলাম। তারপর দশ দশ করে কুড়ি পা হাঁটলাম। যেখানে পৌঁছোলাম, সেটা মূল বাড়ির দেওয়ালের সমান্তরাল একটা জায়গা। সেখানে একটা গোঁজ পুঁতে দিলাম। তারপর পুবদিকে পাঁচ পা করে এবং দক্ষিণ দিকে দু’পা করে গেলাম। পুরনো বাড়ির দরজাটার কাছে পৌঁছে গেলাম। পশ্চিম দিকে দু’পা যেতে হবে। তার মানে পাথর-বাঁধানো সড়কে দু’পা যেতে হবে। এ কাগজে এই জায়গার কথা লেখা আছে।
“ওয়াটসন, জীবনে এত হতাশ আমি কখনও হইনি। একবার মনে হল যে, আমি বোধহয় হিসেবে কোনও ভুল করে ফেলেছি। সে জায়গাটা পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। আমি দেখলাম, এই বছরের পর বছর মানুষের পায়ে পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া ছাই ছাই রঙের পাথরগুলো সিমেন্ট দিয়ে জমাট করে বসানো। পাথরগুলো ক্ষয়ে গেছে কিন্তু আলগা হয়নি। এই পাথরগুলোর ওপর কেউ কোনও কারচুপি করেছে বলেও মনে হল না। ব্রান্টন এখানে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি করেনি। আমি সারা জায়গাটা ঠুকে ঠুকে দেখলাম। বেজায় শক্ত। কোথাও কোনও ফাটাফুটো আছে বলে মনে হল না। রেজিনাল্ড এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। সব চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে পকেট থেকে কাগজটা বের করল। তারপর যে-হিসেব করেছি সেটা মিলিয়ে দেখতে লাগল।
“রেজিনাল্ড চিৎকার করে উঠল, ‘আর নীচে। হোমস, তুমি ‘আর নীচে’ কথাটা বাদ দিয়ে গেছ।’
“আমি ভেবেছিলাম যে, আমাদের বোধহয় খুঁড়তে হবে। এখন বুঝলাম, ভুল ভেবেছিলাম। আমি বললাম, ‘এর নীচে কি কোনও চোরকুঠুরি আছে?’
‘“হ্যাঁ। খুব পুরনো একটা ঘর আছে। বাড়িটা যখন হয়েছিল ঘরটা তখনই করানো হয়েছিল বলে শুনেছি। এর ঠিক তলায় ঘরটা আছে। দরজা দিয়ে যেতে হবে।’
“আমরা একটা ঘোরানো পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলাম। দরজার কাছে একটা কাঠের পিপের ওপর একটা লণ্ঠন বসানো ছিল। রেজিনাল্ড পকেট থেকে দেশলাই বের করে লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে নিল। বুঝতে পারলাম যে, ঠিক জায়গায় এসে গেছি। আর আমরাই যে শেষ পর্যন্ত ঠিক জায়গায় এসেছি তাই নয়, আমরা আসবার অল্প কিছু দিন আগেই কে বা কারা এখানে এসেছিল।
“ঘরটা আস্ত একটা কাঠের গুদাম। ঘর ভরতি ডাঁই করা বিভিন্ন আকারের চেলাকাঠ। তবে ঘরে পা দিতেই প্রথমে যেটা আমার নজরে পড়ল সেটা হল, ঘরের মাঝখানে কাঠটাট সরিয়ে বেশ পরিষ্কার করা হয়েছে। এই জায়গায় পাথরের মেঝেয় একটা লোহার আংটা লাগানো। মরচে-ধরা আংটাটা ঠিক মাঝখানে আটকানো। আংটার সঙ্গে একটা বেশ পুরু ডোরাকাটা মাফলার জড়ানো।
‘“আরে, আরে,’ রেজিনাল্ড চিৎকার করে বলল, ‘এটা যে ব্রান্টনের মাফলার বলে মনে হচ্ছে। এই রকম একটা মাফলার ওকে গলায় জড়াতে দেখেছি। শয়তানটা এখানে কী করছিল?’
“আমার কথায় রেজিনাল্ড দু’জন পুলিশকে ডেকে আনাল। পুলিশ যখন এসে হাজির হল তখন আমি ওই মাফলারটা টেনে পাথরটা সরাবার চেষ্টা করলাম। অনেক চেষ্টা করে সামান্য একটু নড়াতে পারলাম মাত্র। তারপর একজন পুলিশের সাহায্য নিয়ে পাথরটা সরালাম। তলায় একটা অন্ধকার গর্ত। আমরা গর্তের পাশে বসে নীচে কী আছে দেখতে চেষ্টা করলাম। রেজিনাল্ড তার লণ্ঠনটা গর্তের ভেতর দিয়ে ঝুলিয়ে দিল।
“একটা চার ফুট সাইজের ঘর। ঘরটা প্রায় সাত ফুট উঁচু। লণ্ঠনের আলোয় আমরা সবই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। ঘরের এক পাশে একটা কাঠের বাক্স। বাক্সটার গায়ে পেতলের চাকতি লাগানো। বাক্সের ডালাটা খোলা। ডালায় একটা পুরনো ধরনের চাবি লাগানো। বাক্সটার চার পাশে পুরু ধুলো। বাক্সটার ভেতরে-বাইরে ঘুণ ধরে গেছে। বাক্সর মধ্যে রয়েছে ধাতু দিয়ে তৈরি গোল গোল চাকতি। ওপর থেকে আমার মনে হল, সেগুলো টাকা হওয়াই সম্ভব। বাক্সটায় এ ছাড়া আর কিছু নেই।
“কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাক্সটার দিকে আমাদের নজর ছিল না। খোলা বাক্সটার সামনে বসে-থাকা মানুষটার দিকে আমরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। লোকটি উবু হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে তার হাতদুটো দু’পাশে ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল। এই ভাবে বসে থাকার দরুন তার শরীরের সব রক্ত মুখে উঠে এসেছিল। আর তার ফলে তার মুখের চেহারা এমন কদাকার হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। যাই হোক মৃতদেহ যখন ওপরে তোলা হল তখন জামাকাপড়, উচ্চতা আর চুলের রং দেখে রেজিনাল্ড ব্রান্টনকে চিনতে পারল। ব্রান্টন-রহস্যের একটা সমাধান হল। কিন্তু আর একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল। ব্রান্টনের এমন দশা হল কী ভাবে? ব্রান্টন মারা গেছে বেশ কয়েক দিন আগে। কিন্তু সে মারা পড়ল কী ভাবে? তার শরীরে কোনও আঘাতের দাগ নেই।
“ওয়াটসন, সত্যি কথা বলতে কী, এই রহস্য সমাধানে আমি খুব যে একটা সফল হতে পেরেছি, তা নয়। আমি মনে করেছিলাম যে, মাসগ্রেভদের ওই কাগজে যে-জায়গার কথা লেখা আছে সেখানে পৌঁছোতে পারলেই ওই কাগজের সমস্যাও সমাধান করতে পারব। জায়গাটা তো বের করতে পারলাম, কিন্তু সমস্যার সমাধান হল কই? ব্রান্টনের হদিস পাওয়া গেল বটে। কিন্তু ব্রান্টন কী করে মারা গেল, তা জানতে পারলাম না। ব্রান্টনের এই পরিণামের সঙ্গে র্যাচেলের পালানোর সম্পর্কটাই বা কী? আমি একটা পিপের ওপরে বসে বসে ভাবতে লাগলাম।
“ওয়াটসন, তুমি তো আমার কাজের ধারা জানো। আমি নিজেকে ব্রান্টনের জায়গায় কল্পনা করলাম। ভাবতে চেষ্টা করলাম, আমি হলে কী করতাম। কাজটা এমনিতে সহজ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে কাজটা সোজা হয়ে গিয়েছিল, কেন না ব্রান্টন অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। ব্রান্টন বুঝতে পেরেছিল যে, জিনিসটা খুবই দামি। সে জায়গাটাও খুঁজে পেয়েছিল। পাথরটা যে রকম ভারী তাতে সেটা একলা তার পক্ষে সরানো অসম্ভব। তখন সে কী করল? বাইরে থেকে অত রাতে কাউকে ডেকে আনা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বড় কথা, চট করে বাইরের কোনও লোককে এ রকম ব্যাপারে বিশ্বাস করাও শক্ত। তা ছাড়া অত রাতে দরজা খুলে কাউকে ঢোকালে ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে। সব দিক থেকে সুবিধের হয়, যদি সে বাড়ির ভেতরের কোনও লোকের সাহায্য পায়। কে সেই লোক? র্যাচেলের সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়েছিল। আমার মনে হল, ব্রান্টন র্যাচেলকেই ডেকে এনেছিল। ওরা দু’জনে পাথরটা সরায়।
“আমার ধারণা আমি এতক্ষণ ধরে যা যা কল্পনা করেছি, বাস্তবে তাই ঘটেছে। তবে পাথরটা বেজায় ভারী। আমি আর সাসেক্সের এক পুলিশ দু’জনে মিলে সেটা সরাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেছি। সুতরাং এক জন পুরুষ আর এক জন স্ত্রীলোকের পক্ষে এই পাথরটা সরানো সহজ কথা নয়। তা হলে ওরা কী করল? আমি হলে এই অবস্থায় কী করতাম? আমি উঠে পড়ে ঘরে ছড়ানো চেলাকাঠগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলাম। যা খুঁজছিলাম পেয়ে গেলাম। কতকগুলো থেঁতলে-যাওয়া কাঠ পেলাম। মনে হল, কাঠগুলোর ওপরে খুব ভারী কোনও জিনিস চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। বুঝলাম, ওরা পাথরটা একটু করে তুলেছে আর কাঠের গোঁজ দিয়েছে। এই ভাবে গোঁজ দিতে দিতে মোটামুটি এমন একটা ফাঁক হয়েছিল যেটার মধ্যে দিয়ে একজন গলে যেতে পারে। এ পর্যন্ত আমার যুক্তিতে কোনও ফাঁক নেই।
“কিন্তু এরপর সে দিন মাঝ রাতে কী ঘটেছিল? কী ঘটে থাকতে পারে? ব্রান্টন ফাঁক দিয়ে নেমে যায়। র্যাচেল ওপরে দাঁড়িয়েছিল। ব্রান্টন বাক্স খুলে বাক্সের মধ্যে যা কিছু ছিল তা তুলে দেয়। কিন্তু তারপর? তারপর কী হল? পাথরটা কি কোনও কারণে আপনিই বন্ধ হয়ে যায়? তারপর কী হল? গোঁজগুলো কি নড়ে গিয়েছিল? নাকি র্যাচেল ইচ্ছে করে পাথরটা ফেলে দেয়। ব্রান্টন তাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। সেই অপমানের শোধ কি এই ভাবে র্যাচেল নেয়? এই কারণেই কি তার পরের দিন র্যাচেল ওই রকম পাগলামি করেছিল? তা নয় হল। কিন্তু বাক্সের মধ্যে কী ছিল? সেই জিনিসগুলো নিয়ে র্যাচেল শেষ পর্যন্ত কী করল? নিশ্চয়ই প্রথম সুযোগেই সে জিনিসগুলো পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিল।
“প্রায় মিনিট কুড়ি আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। রেজিনাল্ড গর্তের মধ্যে লণ্ঠনের আলো ফেলতে ফেলতে বলল, ‘ওগুলো সব প্রথম চার্লসের সময়ের টাকা। হোমস, আমরা আমাদের ওই আচার কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার সময়টা ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।
“রেজিনাল্ডের কথা শুনেই কাগজে লেখা প্রশ্নোত্তরের প্রথম দুটো প্রশ্ন আর উত্তর আমার মনে পড়ে গেল। আমি বললাম, ‘প্রথম চার্লসের আরও কিছু জিনিস পাওয়া যেতে পারে। পুকুর থেকে যে-থলিটা পেয়েছিলে সেটার মধ্যে যে-জিনিসগুলো ছিল সেগুলো একবার দেখব।’
“আমরা রেজিনাল্ডের পড়ার ঘরে ফিরে এলাম। রেজিনাল্ড থলিটা নিয়ে এসে জিনিসগুলো বের করল। বুঝলাম, কেন ও ওই জিনিসগুলোর মূল্য বুঝতে পারেনি। ময়লা পড়ে জিনিসগুলো একদম কালো হয়ে গেছে। আমি একটা পাথরের নুড়ি তুলে আমার কোটের হাতায় ঘষলাম। খানিক ঘষতেই নুড়িটা ঝকঝক করে উঠল। ধাতুর তৈরি জিনিসটা দুটো চাকার মতো ছিল। এটাকে বাঁকিয়ে ফেলা হয়েছে।
“রেজিনাল্ডকে বললাম, ‘দেখো প্রথম চার্লসের মৃত্যুর পরেও রাজবংশের লোকেরা কিছুদিন ইংল্যান্ডেই ছিল। পরে তারা যখন পালিয়ে যায় তারা বেশ কিছু দামি জিনিসপত্র এ দেশেই রেখে যায়। ভেবেছিল, যখন ফিরে আসবে, তখন সেই জিনিসগুলো আবার ফিরে পাবে।’
“রেজিনাল্ড বলল, ‘আমাদের এক পূর্বপুরুষ স্যার রালফ মাসগ্রেভ দ্বিতীয় চার্লসের ডান হাত ছিলেন।’
‘“তাই নাকি! এতক্ষণ যে ফাঁকটা ভরাতে পারছিলাম না, তোমার কথায় সেটা ভরে গেল। তোমাকে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি। তুমি যে-জিনিস পেয়েছ তা সত্যি সত্যিই অমূল্য।’
“রেজিনাল্ড খুব অবাক হয়ে বলল, ‘কী জিনিস?’
‘“ইংল্যান্ডের রাজমুকুট।’
‘“রাজমুকুট!’
‘“হ্যাঁ। ভেবে দেখো এই কাগজে কী লেখা ছিল। ‘এটা কার ছিল?’ ‘তার, যে চলে গেছে।’ অর্থাৎ প্রথম চার্লসের হত্যার কথা। তারপরে লেখা আছে, ‘এটা কে পাবে?’ ‘যে পরে আসবে।’ এখানে দ্বিতীয় চার্লসের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় চার্লস যে ইংল্যান্ডে ফিরে আসবেন এবং রাজা হবেন, তা তারা নিশ্চিত ভাবে জানত। তাই এই বাঁকাচোরা জিনিসটাই যে স্টুয়ার্টবংশের রাজাদের মাথায় শোভা পেত, তাতে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।”
‘“কিন্তু এটা পুকুরে গেল কী করে?’
“সমস্ত ব্যাপারটা আমি যে ভাবে ভেবেছি, রেজিনাল্ডকে খুলে বললাম। আমার বলা যখন শেষ হল, তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হয়ে গেছে।
“রেজিনাল্ড বললে, আর-একটা কথা। দ্বিতীয় চার্লস যখন ফিরে এলেন, তখন মুকুটটা তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হল না কেন?’
‘“এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারব না। তবে মনে হয় যে, তোমার বংশের কোনও একজন বোধহয় হঠাৎ মারা যান, তাই ও প্রশ্নোত্তরের ঠিক মানেটা তিনি বলে যেতে পারেননি।’
“ওয়াটসন, এই হচ্ছে মাসগ্রেভদের বংশের অদ্ভুত আচরণের আসল কথা। মুকুটটা হারলস্টোনে গেলে দেখতে পাবে। রেজিনাল্ড ওটা রেখে দিয়েছে। অবশ্য তার জন্যে ওকে পয়সাও কম খরচ করতে হয়নি। ভাল কথা, র্যাচেলের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। মনে হয়, সে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন