খালি বাড়ি

আর্থার কোনান ডয়েল

১৮৯৪ সালের বসন্তকালের ঘটনা। সারা লন্ডন শহর তোলপাড়। বিশেষ করে ধনী, শৌখিন সমাজের লোকেদের মধ্যে সাঙঘাতিক উত্তেজনা। উত্তেজনা রোনাল্ড অ্যাডেয়ারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। আশ্চর্য রকম পরিস্থিতিতে রোনাল্ড অ্যাডেয়ার খুন হয়েছেন। কী ভাবে যে তাকে খুন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশি-তদন্তের সূত্র ধরে এ হত্যা-রহস্যের কিছু কিছু খবর সাধারণ লোক জেনে গেছেন। কিন্তু অনেক কথাই সাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। তার কারণ আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ ওই অ্যাডেয়ারের মৃত্যুর ব্যাপারেই যে-সব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিল, তাতেই অপরাধীর শাস্তি হয়েছিল। অন্য সব কথা আদালতে জানাবার দরকার হয়নি। এত দিন পরে, অন্তত দশ বছর তো হবেই, এই আশ্চর্য হত্যা-রহস্য উদঘাটনের পেছনে যে-গোপন তথ্য ছিল, সে সব কথা সাধারণ লোককে জানাবার অনুমতি মিলেছে! রোনাল্ড অ্যাডেয়ারকে যে ভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা সত্যিই খুব অদ্ভুত। কিন্তু এই হত্যার পর যে সব ঘটনা ঘটল, সেগুলো আমার কাছে আরও অনেক বেশি অদ্ভুত। আমার জীবনে অ্যাডভেঞ্চার বড় কম হয়নি। তবুও এ কথা ঠিক, এত আশ্চর্য, এমন স্তম্ভিত জীবনে আমি কখনওই হইনি। এত দিন বাদে আমি যখনই সেই ঘটনার কথা ভাবি, আমার মন আনন্দে আর বিস্ময়ে ভরে ওঠে। মনে হয় যা দেখেছি, তা যেন সত্যি নয়, স্বপ্ন। এখানে একটা কথা খুলে বলা দরকার। আমার অদ্ভুতকর্মা বন্ধুর কিছু কিছু কাহিনী আমি অনেককে শুনিয়েছি। এ সব ঘটনার কথা পড়তে তাদের ভাল লাগে, এ কথাও আমি শুনেছি। তাই আজ যে-ঘটনার কথা লিখছি, তা পড়ে পাঠকেরা দয়া করে আমার উপর রাগ করবেন না, বা আমাকে ভুল বুঝবেন না, এইটুকু শুধু অনুরোধ। আপনারা বিশ্বাস করুন, এত দিন আমি ইচ্ছে করে এ সব কথা গোপন রাখিনি। গোপন না রেখে আমার কোনও উপায় ছিল না। আমাকে কথা দিতে হয়েছিল যে, সে না-বলা পর্যন্ত এসব কথা আমি লিখব না। গত মাসের তেসরা তারিখে এই কাহিনী আপনাদের শোনাবার অনুমতি আমি পেয়েছি।

শার্লক হোমসের সঙ্গে অনেক দিন থাকবার ফলে, আর তার তদন্তের কাজে তাকে কিছু কিছু সাহায্য করার জন্য, ক্রাইম বা অপরাধমূলক ঘটনার সম্বন্ধে আমার নিজের মনেও একটা কৌতূহল জেগে উঠেছিল। তার ফলে শার্লক হোমস যখন আমার জীবন থেকে চিরবিদায় নিল, তখনও অপরাধমূলক ঘটনার ওপর আমার টান একটুও কমল না। কাগজে যে-সব অপরাধের কথা ছাপা হত, আমি সেগুলো খুব মন দিয়ে পড়তাম। আবার কখনওসখনও স্রেফ নিজের কৌতুহল মেটাবার জন্যে নিজেই একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করতাম। অবশ্য তাতে যে খুব একটা বড় রকমের কোনও ফল হত, তা নয়। তবে রোনাল্ড অ্যাডেয়ারের হত্যার ব্যাপারটা নিয়ে আমার মনে সত্যিই খুব কৌতূহল হয়েছিল। রোনাল্ড অ্যাডেয়ারের মৃত্যুর পর যে ইনকোয়েস্টের খবর কাগজে ছাপা হয়েছিল, তা পড়েছিলাম। মৃত্যুর সম্বন্ধে বলা হয়েছিল যে, এটা একটা ঠান্ডা মাথায় খুনের ঘটনা। তবে কে বা কারা খুন করেছে, তা অবশ্য ঠিক বলা যায়নি। অর্থাৎ খুনি বা খুনিদের পরিচয় জানা যায়নি। এই ঘটনার বিবরণ কাগজে পড়তে পড়তে হোমসের কথা আমার আরও বেশি করে মনে পড়তে লাগল। হোমসের মৃত্যুতে সাধারণ মানুষের কত ক্ষতিই না হয়েছে। আমার মনে হল, এই রোনাল্ড অ্যাডেয়ারের হত্যার ব্যাপারটা হোমসের নিশ্চয়ই একটা পছন্দসই ‘কেস’ হত। ব্যাপারটা রীতিমতো ঘোরালো। আজ যদি হোমস থাকত, তা হলে পুলিশ যে-কাজ করতে পারছে না। তা সহজেই হয়ে যেত। পুলিশের ত্রুটি দেখিয়ে দিয়ে হোমস যে কত বার অপরাধীকে ধরতে পুলিশকে সাহায্য করেছে, তা বোধহয় পাঠকরা এত দিনে জেনে গেছেন। কিন্তু এখন হাহুতাশ আর আক্ষেপ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। সারা দিন রুগি দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমার মাথায় এই খুনের ব্যাপারটা ঘুরতে লাগল। নানা দিক থেকে ভেবেও আমি এমন। কোনও সমাধান বের করতে পারলাম না, যা দিয়ে সব ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায় বা রহস্যের জট খুলতে পারা যায়। সকলেরই ঘটনাটা হয়তো জানা, তবুও আমি কাগজে পুলিশ কোর্টের যে-রিপোর্ট বেরিয়েছিল, সেটা সংক্ষেপে লিখছি।

মহামান্য রবার্ট অ্যাডেয়ার আর্ল অফ মেনাথ-এর মেজো ছেলে। যে-সময় এই ঘটনা ঘটে, তখন তিনি অস্ট্রেলিয়ার একটি রাজ্যের গভর্নর। অ্যাডেয়ারের মা চোখের ছানি কাটাবার জন্যে কিছু দিন আগেই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছেলে রোনাল্ড আর তাঁর মেয়ে হিলডা। ওঁরা তিন জন ৪২৭ নম্বর পার্ক লেনে থাকতেন। রোনাল্ড সৎসঙ্গে মেলামেশা করতেন। যতদূর জানা গেছে, ওঁর কোনও বাজে নেশা বা খারাপ অভ্যেস ছিল না। ওঁর কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল বলেও জানা যায়নি। রোনাল্ডের সঙ্গে কারস্টেয়ার্সের মিস এডিথ উলি-র বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্বন্ধ ভেঙে যায়। তবে এর জন্যে পাত্রীপক্ষের সঙ্গে ছেলের বাড়ির লোকের কোনও রকম মন কষাকষি বা রাগারাগি হয়নি। রোনাল্ড এমনিতে খুব শান্ত প্রকৃতির। তাঁর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও বেশি নয়। আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়েই তাঁর সময় কাটত। ধীর স্থির, বিচক্ষণ যুবক। অথচ এই রকম একটি নিরীহ-ভদ্র-শান্ত-সম্ভ্রান্ত যুবক ১৮৯৪ সালের ৩০ মার্চ তারিখে রাত্রি দশটা থেকে এগারোটা কুড়ির মধ্যে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়ে গেলেন।

রোনাল্ড অ্যাডেয়ারের জীবনে প্রধান শখ ছিল তাস খেলা। বন্ধুবান্ধব মহলে বাজি রেখে তিনি তাস খেলতেন। তবে বাজি ধরা হত সামান্যই। তাই বাজিতে হেরে গেলেও তাঁর কোনও ক্ষতি হত না। রোনাল্ড বলডুইন, ক্যাভেনডিস আর ব্যাগাটেল তিনটে ক্লাবেরই মেম্বার। পুলিশি-তদন্তে জানা গিয়েছিল যে, যে-দিন রাত্রে তিনি খুন হন, সেই দিন ডিনারের পর রোনাল্ড ব্যাগাটেল ক্লাবে অনেকক্ষণ তাস খেলে ছিলেন। ওঁর সঙ্গে আর যাঁরা তাস খেলে ছিলেন তাঁরা হলেন মিঃ মারে, সার জন হার্ডি এবং কর্নেল মোরান। তাঁদের কথা থেকে জানা গেল যে, তাঁরা হুইস্ট খেলছিলেন। আর সকলের হাতেই মোটামুটি সমান তাস ছিল। সেদিন রোনাল্ড খুব কম টাকাই বাজি হেরে ছিলেন। বড় জোর পাঁচ পাউন্ড। রোনাল্ডের অবস্থা বেশ ভাল। পাঁচ পাউন্ডের লোকসান ওঁর কাছে কিছুই নয়। তা ছাড়া রোনাল্ড খুব হিসেবি স্বভাবের লোক ছিলেন। তিনি রোজই তাস খেলতেন, জিততেন বেশি, হারতেন কম। পুলিশ অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, কয়েক সপ্তাহ আগে ক্যাপ্টেন মোরানকে জুটি নিয়ে রোনাল্ড প্রায় ৪২০ পাউন্ড জিতে ছিলেন। ওঁদের সঙ্গে খেলতে এসে গডফ্রে মিলনার আর লর্ড বালমোরাল গোহারান হেরে যান। পুলিশ তদন্তের সময় রোনাল্ড অ্যাডেয়ার সম্বন্ধে এইটুকু খবরই জোগাড় করতে পেরেছে।

খুনের দিন রোনাল্ড অ্যাডেয়ার রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর মা আর দিদি তাঁদেরই এক আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাড়ির কাজের মেয়েটি সাক্ষী দিতে গিয়ে বলেছে যে, রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে রোনাল্ড দোতলার সামনের দিকে যে-ঘরটা আছে, সেই ঘরে চলে যান। ঘরে ঢুকে তিনি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেন। ওই ঘরটা রোনাল্ড বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। ওই ঘরের ফায়ার প্লেসে মেয়েটি আগুন দিয়ে রেখেছিল। ঘরের ভেতরে খুব ধোঁয়া হচ্ছিল বলে কাজের মেয়েটিই ঘরের জানলাগুলো খুলে দেয়। এগারোটা কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের আগে ঘর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। এ সময়ে লেডি মেনাথ আর তাঁর মেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। শুতে যাবার আগে রোনাল্ডের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে লেডি মেনাথ ওই ঘরের দিকে যান। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় উনি দরজায় ধাক্কা দেন। কিন্তু ধাক্কাধাক্কি বা ডাকাডাকিতে ঘরের ভেতর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। তখন বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে লোক ডেকে এনে দরজা ভেঙে ফেলা হয়। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখা যায় যে, হতভাগ্য রোনাল্ডের মৃতদেহ টেবিলের কাছে পড়ে আছে। রিভলভারের গুলি লেগে তাঁর মাথা একদম থেঁতলে গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘরের মধ্যে কোনও অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়নি। সেই ঘরের টেবিলে দুটো দশ পাউন্ডের নোট ছাড়াও, নোট আর খুচরো মিলিয়ে আরও সতেরো পাউন্ড দশ শিলিং রাখা ছিল। পাউন্ড আর শিলিং থাক থাক করে রাখা। টেবিলের ওপরে একটা কাগজে রোনাল্ডের কয়েক জন বন্ধুর নাম, আর তাঁদের প্রত্যেকের নামের পাশেই একটা করে টাকার অঙ্ক লেখা। এঁরা প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও তাসের ক্লাবের মেম্বার। এই কাগজটা পরীক্ষা করে পুলিশের ধারণা হয় যে, মারা যাবার আগে রোনাল্ড হয়তো তাস খেলায় লাভ-লোকসানের হিসেবনিকেশ করছিলেন।

সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে দেখে পুলিশের দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, এই হত্যার ব্যাপারটা খুবই জটিল, গোলমেলে। প্রথমত, রোনাল্ড কেন যে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন তার কোনও রকম যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। প্রথমে মনে হয়েছিল যে, খুনি খুন করে ঘরের দরজা বন্ধ করে জানলা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জানলাটা জমি থেকে কম করে কুড়ি ফুট উঁচু। তার ওপর জানলার ঠিক তলায় ক্রকাস ফুলের ঝোপ। ক্রকাস ফুটে রয়েছে প্রচুর। সেই জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, ক্রকাস ঝোপের বা জমিতে এমন কোনও চিহ্ন নেই, যার থেকে বোঝা যেতে পারে যে, কুড়ি ফুট উঁচু থেকে কেউ সেখানে লাফ দিয়ে পড়েছিল। ফুলগাছের পরেই খানিকটা ঘাসের জমি। সেই জমিটার পরেই রাস্তা। সেই জমিটার ওপরও কোনও পায়ের ছাপটাপ কিছুই পাওয়া গেল না। সব দিক দেখে মনে হয় যে, রোনাল্ড নিজেই দরজা বন্ধ করে ছিলেন। কিন্তু তা হলে তিনি খুন হলেন কী করে? জানলা দিয়ে ঘরে কেউ ঢুকলে তার প্রমাণ বাইরে থেকে পাওয়া যেতই। তা ছাড়া জানলার ও পাশ থেকে যদি কেউ রিভলভার ছুড়েও থাকে, তো সেই রিভলভারের গুলিতে এ রকম প্রচণ্ড আঘাত লাগা সম্ভব বলে মনে হয় না। তা ছাড়া খুব পাকা হাত না হলে এত দূর থেকে রিভলভারে এ রকম নির্ভুল নিশানায় গুলি ছুড়তে কেউ পারবে না। তার ওপর পার্ক লেন দিয়ে সর্বদাই গাড়ি আর লোকজন যাতায়াত করে। রোনাল্ডের বাড়ির কাছেই একটা ভাড়াটে গাড়ির আড্ডা। সেখানে কেউই গুলির শব্দ শুনতে পায়নি। অথচ ঘরের মধ্যে রোনাল্ডের মৃতদেহ পড়েছিল। রিভলভারের গুলিতে যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। বিশেষ এক ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছে রোনাল্ডকে খুন করতে। একে বলে ‘সফট নোজড বুলেট’। দেহের মধ্যে প্রবেশ করেই বুলেটটা ফেটে যায়। ফলে সে লোক প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। অল্প কথায় এই হল পার্ক লেন হত্যা-রহস্য। রহস্যটা আরও জটিল হয়ে গেল এই জন্যে যে, রোনাল্ড যে কেন খুন হলেন সে কথাটা মোটেই বোঝা গেল না। অ্যাডেয়ারের সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আর যে-ঘরে তাঁকে খুন করা হয়েছিল, সেখান থেকে কোনও কিছু চুরি যায়নি।

ঘটনার বিবরণ কাগজে পড়বার পর সারা দিন এই কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। এই রহস্যের সমাধান বের করবার জন্যে আমি নানা ভাবে চিন্তা করতে লাগলাম। শার্লক হোমসের একটা কথা মনে পড়ল। হোমস বলত, রহস্য ভেদ করতে গেলে অনেক সূত্রের মধ্যে যে-সূত্র ধরে সব ব্যাপারটা সহজে ব্যাখ্যা করা যায়, সেটাই আসল সূত্র। স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে, আমি সে রকম কোনও সূত্র খুঁজে বের করতে পারলাম না। সন্ধে ছ’টা নাগাদ আমি পার্ক পেরিয়ে পার্ক লেনের যে-মুখটা অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকে শেষ হয়েছে সেই মোড়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। একদল বেকার লোক ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে হাঁ করে একটা জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের দেখেই রোনাল্ড অ্যাডেয়ারের বাড়ি চিনতে আমার কোনও অসুবিধে হল না। ওই ভিড়ের মধে কালো চশমা-পরা, রোগা-ঢ্যাঙা একটা লোক অ্যাডেয়ার হত্যা-রহস্য সম্বন্ধে তার নিজের ধারণার কথা বেশ জোর গলায় বলছিল। লোকটার বোলচাল শুনে আমার মনে হল যে, ও বোধহয় সাদা পোশাক-পরা কোনও পুলিশ কনস্টেবল হবে। আমিও ভিড়ের মধ্যে জুটে গিয়ে লোকটার কথা শুনতে লাগলাম। তবে ও যা বলল, তা আমার এতই আজগুবি বলে মনে হল যে, আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। জটলা থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি, এমন সময় এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। এ লোকটি আবার প্রতিবন্ধী। লোকটির হাতে কয়েকটি বই ছিল। আমার সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে বইগুলো রাস্তায় পড়ে গেল। আমি বইগুলো কুড়িয়ে তুলে দিতে গেলাম। তুলতে গিয়ে একটা বইয়ের মলাটের দিকে চোখ পড়ে গেল। বইটার নাম দেখলাম ‘দি অরিজিন অফ ট্রি ওয়রশিপ’। বইয়ের নাম দেখে আমার মনে হল যে লোকটি হয় সাঙঘাতিক রকমের পড়ুয়া, নয়তো বইয়ের ব্যবসা করে। তা না হলে এই ধরনের অদ্ভুত ব্যাপারের ওপর লেখা বই কেউ পড়ে নাকি? আমি না দেখে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চাইলাম। ভদ্রলোকটি আমার দিকে একনজর তাকিয়ে মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে তাড়াতাড়ি উলটো রাস্তায় চলে গেল। বুঝলাম, ওর যে-বইগুলো আমি ফেলে দিয়েছি, সে বইগুলো ওর চোখের মণি, প্রাণের থেকেও প্রিয়। আমি কী করব, না করব ভাবতে ভাবতেই সে লোকটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। লোকটির পিঠের কুঁজ আর সাদা দাড়ি ছাড়া আমি আর ভাল করে কিছু দেখতে পাইনি।

পার্ক লেনের ৪২৭ নম্বর বাড়িটা ভাল করে ঘুরে দেখেও আমি অ্যাডেয়ার হত্যা-রহস্যের কোনও সুরাহা করতে পারলাম না। বাড়িটা নিচু পাঁচিলের ওপর রেলিং দিয়ে ঘেরা। পাঁচিল আর রেলিং মিলিয়ে পাঁচ ফুটের বেশি হবে না। পাঁচিল টপকে কারও পক্ষে বাড়িতে ঢোকা মোটেই শক্ত নয়। কিন্তু দোতলার জানলার নাগাল বাইরে থেকে পাওয়া কোনও লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়। নর্দমার পাইপ নেই। এমন কোনও খাঁজখোঁজ নেই যা বেয়ে কেউ বাইরে থেকে জানলার কাছে যেতে পারে। অ্যাডেয়ারের বাড়ি দেখবার আগে সমস্যাটা যত জটিল মনে হয়েছিল, বাড়ি দেখবার আগে সমস্যাটা আরও বেশি জটিল মনে হল। কোনও হদিস করতে না পেরে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে সবেমাত্র বসবার ঘরে এসে বসেছি, এমন সময় কাজের মেয়েটি এসে খবর দিল যে, একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আগন্তুককে ভেতরে নিয়ে আসতে বললাম। ঘরে যে ঢুকল তাকে দেখে আমি। তো অবাক। সেই বয়স্ক প্রতিবন্ধী লোকটি। লোকটির দিকে তাকালাম। বয়সের দরুন চামড়া কুঁচকে গেছে। মাথার চুল-দাড়ি সব শন-পাকা। তবে তার চোখের চাউনি খুব জ্বলজ্বলে। লোকটির দু’বগলে অনেকগুলো বই। মনে হল, বইয়ের চাপে সে রীতিমতো বেঁকে গেছে।

“আপনি আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুবই আশ্চর্য হয়েছেন।” লোকটির গলার স্বর বেজায় কর্কশ।

আমাকে মানতেই হল, আমি অবাক হয়েছি।

“আমার মশাই বিবেক বলে একটা জিনিস আছে। যখন হঠাৎই দেখে ফেললাম যে, আপনি এই বাড়িতে ঢুকলেন তখনই আপনার পিছু পিছু নেংচাতে নেংচাতে এসে হাজির হলাম। আমি নিজেকেই বললাম যে, ভদ্রলোক যখন আমার সঙ্গে অত ভাল ব্যবহার করলেন তখন ওঁকে বলা দরকার, আমার হাবভাবটা গাঁইয়াদের মতো বটে তবে আমি ওঁকে অপমান করতে চাইনি। ভদ্রলোক যে আমার বইগুলো কুড়িয়ে দিয়ে উপকার করেছেন সেজন্য আমি সত্যি সত্যিই কৃতজ্ঞ।”

“আপনি সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছেন,” আমি বললাম। “কিন্তু আমার পরিচয়টা আপনি কী ভাবে পেলেন জানতে পারি কি?”

“যদি বেয়াদপি মনে না করেন তো বলি যে, আমি আপনার এখন পড়শি। চার্চ স্ট্রিটের মোড়ে নজর করলেই আপনি আমার ছোট্ট বইয়ের দোকানটি দেখতে পাবেন। আপনি যদি একদিন আমার বইয়ের দোকানে পা দেন, তো বড় খুশি হব। বইটই সংগ্রহ করার বাতিক আপনারও আছে নাকি? এই দেখুন না, আমার সঙ্গে ‘ব্রিটিশ বার্ডস’, ‘কাটুল্লুস’ আর ‘দ্য হোলি ওয়র’ রয়েছে। প্রত্যেকটা বইই অমূল্য। আর খানপাঁচেক বই হলেই আপনি আপনার ওই র‍্যাকের দ্বিতীয় থাকটা ভরতি করে নিতে পারেন। ওই জায়গাটা ফাঁকা থাকায় কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছে, তাই না?”

লোকটির কথা শুনে আমি ঘাড় ফিরিয়ে র‍্যাকটার দিকে তাকালাম। মুখ ফিরিয়ে দেখি, টেবিলের ওপাশে হাসি হাসি মুখে শার্লক হোমস দাঁড়িয়ে। আমি তো একদম হতবুদ্ধি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। কী কাণ্ড! তারপর জীবনের প্রথম আর শেষ বারের মতো আমি জ্ঞান হারালাম। আমার চোখের সামনে একটা ভারী কুয়াশার পরদা ঝুলছিল। সেই কুয়াশাটা কেটে গেলে টের পেলাম যে, আমার শার্টের কলারটা আলগা আর ঠোঁটে ব্র্যান্ডির স্বাদ। হোমস আমার চেয়ারের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে তারই ব্র্যান্ডির ফ্লাস্ক।

“ওয়াটসন,” সেই বহু দিনের চেনা গলা শুনলাম, “তোমার কাছে আমি সত্যিই মাফ চাইছি। তুমি যে এতটা বিহ্বল হয়ে পড়বে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।”

আমি হোমসের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম।

“হোমস,” আমি চিৎকার করে উঠলাম। “সত্যিই কি আমি তোমাকে দেখছি? তুমি কি সত্যি সত্যিই বেঁচে আছ? তুমি কি শেষ পর্যন্ত কোনও রকমে ওই জলপ্রপাতের গহ্বর থেকে উঠে আসতে পেরেছিলে?”

হোমস বলল, “এক মিনিট ধৈর্য ধরো। তুমি কি এখন সুস্থ বোধ করছ? এসব কথা আলোচনা করলে আবার তোমার শরীর খারাপ হবে না তো? আমার এই নাটুকেপনার জন্যে তোমার যে এত প্রচণ্ড ‘শক’ হবে তা বুঝতে পারিনি।”

আমি বললাম, “আমি ঠিক আছি। কিন্তু হোমস আমি কি সত্যি সত্যি ঠিক দেখছি। ওহ্, তুমি…তুমি… আমারই বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে আছ।” আবার আমি হোমসের হাতটা চেপে ধরলাম। সেই চেনা হাত। রোগা, মোটা মোটা হাড়। “যাক, তুমি অন্তত প্রেতাত্মা নও,” আমি খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললাম। “বন্ধু, তোমাকে ফিরে পেয়ে আমার যে কী আনন্দ হয়েছে, তা তোমাকে কী করে বোঝাব? বোসো, বোসো। তারপর আমাকে বলো কী করে সেই অতলস্পর্শী খাদ থেকে তুমি উঠে এলে।”

হোমস একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার সামনে বসল। তারপর তার নিজস্ব ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরাল। হোমস সেই পুরনো নোংরা ফ্ৰককোটটা পরেছিল। তবে সেই বইওলার ছদ্মবেশের সাদা চুলের রাশ তার বইগুলোর সঙ্গে আমার পড়বার টেবিলে খুলে রাখা ছিল। হোমসকে আগের চেয়ে অনেক রোগা দেখাচ্ছিল। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম যে, ওর মুখের রং প্রায় কাগজের মতো সাদা। বুঝতে পারলাম যে, ওর শরীর রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছে।

হোমস বলল, “শরীরটা বেশ ভাল করে এখন এলিয়ে দিতে পেরে আমি সত্যি সত্যি ভারী আরাম পাচ্ছি, ওয়াটসন। খুব লম্বা লোককে যদি বেশ কিছু দিন কয়েক ঘণ্টা ধরে বেঁটে লোক সেজে থেকে ঘোরাঘুরি করতে হয় তো তার চাইতে কষ্টকর আর কিছু নেই। কিন্তু এ সব কথার আগে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। আজ রাতে আমাদের এমন একটা অভিযানে যেতে হবে, যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আজ রাতের এই অভিযানে আমি তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। তাই মনে হয় যে, আজকের রাতের অ্যাডভেঞ্চার চুকেবুকে গেলে সব কথা তোমাকে খুলে বললে ভাল হবে।”

“না, সব কথা শুনতে আমার ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে। তুমি আমাকে এখনই বলো, আমি বললাম।

“তা হলে তুমি আজ রাতে আমার সঙ্গে যাচ্ছ?”

“নিশ্চয়ই। তুমি যখন যেখানে যেতে বলবে, আমি তখনই সেখানে যেতে তৈরি আছি।”

“এই তো সবই ঠিক আগেকার মতোই আছে দেখছি। তা হলে বেরোবার আগে কিন্তু আমাদের কিছু খেয়ে নিতে হবে। প্রথমে সেই খাদের কথা বলি। সত্যি বলছি, সেই খাদ থেকে উঠে আসতে আমার মোটেই কোনও কষ্ট হয়নি। তার কারণ হল যে, আমি মোটেই খাদের মধ্যে পড়ে যাইনি।”

“তুমি খাদের ভেতরে পড়ে যাওনি?”

“না, ওয়াটসন। আমি তলিয়ে যাইনি। তোমাকে যে চিঠিটা লিখেছিলাম সেটা কিন্তু খাঁটি। তাতে ছিটেমাত্র ভেজাল ছিল না। যখন দেখলাম যে, পালাবার রাস্তা আটকে প্রোফেসর মরিয়ার্টি দাঁড়িয়ে আছে, তখন আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, আমার বাঁচবার আর কোনও আশাই নেই। মরিয়ার্টির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, একটা চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত না করে সে ক্ষান্ত হবে না। তাই ওর সঙ্গে দু’-চার কথা কয়ে আমি তোমাকে চিঠি লেখার মত চাইলাম। মরিয়ার্টি রাজি হল। চিঠিটা লিখে আমি সেটা আমার সিগারেট-কেস চাপা দিয়ে রাখলাম। তার পাশে আমার লাঠিটা রেখে দিলাম। তারপর আমি প্রপাতের দিকে এগিয়ে গেলাম। মরিয়ার্টি আমার পিছনে পিছনে আসছিল। যখন প্রপাতের প্রায় কিনারায় এসে গেছি তখন আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। মরিয়ার্টি কোনও অস্ত্রটস্ত্র বের করল না। খালি হাতে আমার দিকে ছুটে এল। মরিয়ার্টি বুঝতে পেরেছিল যে, ওর কোনও নিস্তার নেই। আর যে-হেতু আমি ওর ধ্বংসের কারণ তাই ওর সব রাগ গিয়ে পড়েছিল আমার ওপর। ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হল, নিজে শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও শেষ করে দেওয়া। আর সেইজন্য ওই প্রপাতের কানায় ও আমাকে সবলে জাপটে ধরল। আমরা দু’জনে ওই ওখানে ঝাপটি করতে লাগলাম। এক সময়ে আমি জাপানি কুস্তি শিখেছিলাম। এই কুস্তির প্যাঁচ এর আগে আমাকে অনেক বার বাঁচিয়ে দিয়েছে। এবারেও অব্যর্থ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। আমি মরিয়ার্টির হাত ফসকে বেরিয়ে এলাম। আর সেই প্যাঁচের ধাক্কায় টাল সামলাতে পারল না মরিয়ার্টি। শূন্যে হাত পা ছুড়তে ছুড়তে একটা তীব্র চিৎকার করে মরিয়ার্টি পড়ে গেল। আমি ঝুঁকে পড়ে দেখলাম, আস্তে আস্তে মরিয়ার্টির দেহটা প্রপাতের তলায় তলিয়ে গেল।”

সিগারেটে টান দিতে দিতে হোমস যখন কথাগুলো বলছিল, তখন আমি সত্যিই যাকে বলে বাক্যহারা, তাই হয়ে গিয়েছিলাম।

“কিন্তু পায়ের ছাপ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আমি তো নিজের চোখে দেখেছিলাম যে, দু’সারি পায়ের দাগ প্রপাতের দিকে চলে গেছে। প্রপাতের দিক থেকে কোনও পায়ের ছাপ তো দেখতে পাইনি।”

“ব্যাপারটা কী হয়েছিল বলি। মরিয়ার্টির দেহটা যখন প্রপাতের তলায় মিলিয়ে গেল, আমি তখন বুঝতে পারলাম যে, ভাগ্যদেবী আমার সামনে একটা মস্ত বড় সুযোগ এনে দিয়েছেন। আমি জানতাম যে, মরিয়ার্টি ছাড়াও আরও অন্তত তিন জন লোক আছে, যারা সর্বদাই আমার মৃত্যু কামনা করছে। মরিয়ার্টি মারা গেছে, এই কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে ওই তিন জনের আমার ওপর রাগ আরও বেড়ে যাবে। ওরা তিন জনই খুব সাঙঘাতিক প্রকৃতির লোক। মরিয়ার্টি ওদের দলের নেতা। সুতরাং মরিয়ার্টির মৃত্যুর প্রতিশোধ ওরা যে ভাবেই হোক নেবে। কিন্তু মরিয়ার্টির সঙ্গে সঙ্গে আমিও মারা গেছি, এই কথাটা যদি প্রচার হয়ে যায় তা হলে ওরা নিশ্চিন্ত হবে। ওরা আর গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে না। বাইরে বেরিয়ে ওদের কাজকর্ম শুরু করবে। আর তা হলেই সুযোগমতো আমি ওদের এক-এক জনকে পাকড়ে ফেলতে পারব। ওদের পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমি আবার ইহলোকে ফিরে আসতে পারব।

“জানো ওয়াটসন, মরিয়ার্টির দেহ রাইখেনবাখ জলপ্রপাতের তলদেশ স্পর্শ করবার আগেই আমার মাথায় এত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল! মানুষের বুদ্ধি যে কত তাড়াতাড়ি চিন্তা করতে পারে, তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। যাই হোক, খানিক পরে আমি আমার পিছন দিকের যে-পাহাড় ছিল, তার গা’টা ভাল করে দেখতে লাগলাম। এই জায়গাটা সম্বন্ধে তুমি যে সুন্দর বিবরণ দিয়েছ, তা কয়েক মাস পরে আমার নজরে পড়েছিল। তবে একটা কথা তুমি ঠিক লেখোনি। তুমি লিখেছ, পাহাড়টা একদম খাড়া। সেটা অবশ্য ঠিক নয়, কোনও রকমে পা রাখার মতো কিছু কিছু খাঁজ আছে। আর তা ছাড়া একটু ওপরে উঠলে খুব সরু একটা তাকের মতো আছে। পাহাড়ের চূড়াটা এত উঁচু যে সেই চূড়ায় ওঠা একেবারেই অসম্ভব। আবার যে-রাস্তা দিয়ে এসেছি সেই রাস্তায় ফেরাও চলে না। সেখানে আর-এক জোড়া পায়ের দাগ পড়লে যে-জন্য আমি লুকিয়ে থাকতে চাইছি সেই উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। আমি হয়তো উলটো মুখ করে হাঁটতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে, একই দিকে তিন জোড়া পায়ের ছাপ দেখলেও লোকের মনে সন্দেহ হতে পারে যে, ব্যাপারটা সাজানো। সব দিক ভেবেচিন্তে মনে হল যে, পাহাড়ে চড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

“বিশ্বাস করো ওয়াটসন, পাহাড় চড়তে গিয়ে দেখি দারুণ কঠিন ব্যাপার। নীচ থেকে জলপ্রপাতের ক্রুদ্ধ গর্জন উঠে আসছিল। তুমি তো জানো যে, আমি খুব শক্ত ধাতের মানুষ। বিশ্বাস করো, পাহাড়ে চড়তে গিয়ে আমার বার বার মনে হচ্ছিল যে, জলপ্রপাতের শব্দকে ছাপিয়ে প্রোফেসর মরিয়ার্টির বুকফাটা আর্তনাদ আমার কানে আসছিল। একচুল ভুল হলেই আমি খতম। বেশ কয়েক বার আমি যেই একগোছা ঘাস ধরতে গেছি, অমনি সেই জায়গার ঘাস আমার হাতের মুঠোয় উপড়ে এসেছিল। পাহাড়ের ফাটলে বা খোঁদলে পা রাখতে গিয়ে পা-ও ফসকালাম বেশ ক’বার। এক বার তো আর একটু হলেই পা ফসকে যাচ্ছিল। ভাগ্য সেদিন খুব ভাল ছিল বলতে হবে। যাই হোক, কোনও রকমে আমি পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। এক সময় আমি সেই খাঁজের নাগাল পেলাম। খাড়াই পাহাড়ের মাঝখানে কয়েক ফুট চওড়া একটা সমতল জায়গা। জায়গাটা নরম শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। সেখানে এক জন লোক অনায়াসেই শুয়ে থাকতে পারে। আর মজাটা হচ্ছে এই যে, সেখান থেকে নীচে কী হচ্ছে পরিষ্কার দেখা গেলেও নীচে থেকে ওই জায়গাটা কেউই দেখতে পারে না। তুমি যখন আবার কয়েক জনকে নিয়ে জলপ্রপাতের কাছে ফিরে এলে তখন আমি বেশ আরামে ওইখানে শুয়ে শুয়ে তোমাদের কার্যকলাপ দেখছিলাম। তোমার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছিল। বিশেষ করে যখন দেখলাম যে, তোমার গোয়েন্দাগিরির ধারাটা একদম ভুল দিকে যাচ্ছে।

“তারপর শেষকালে যে-ভুল সিদ্ধান্তটি তোমরা করবে বলে আমি মনে মনে আশা করেছিলাম, তোমরা সেই ভুলটিই করলে আর দুঃখিত হয়ে হোটেলে ফিরে গেলে। তখন আমি একদম একলা হয়ে গেলাম। তোমরা চলেটলে গেলে ভাবলাম যে, সে দিনের মতো ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট বোধহয় চুকল। কিন্তু তার পরেই এমন একটা কাণ্ড ঘটল যে, বুঝলাম আমার ধারণা একদম ভুল। একটা প্রকাণ্ড পাথরের চাঙড় ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে এসে আমার পাশ দিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল জলপ্রপাতের তলায়। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে, এটা একটা নিছকই দুর্ঘটনা। কিন্তু ওপরের দিকে তাকাতেই একটা মাথা আমার চোখে পড়ল। আকাশে তখন অন্ধকারের ছোপ লেগেছে। সেই অন্ধকারের পেছনে আমি সেই মাথাটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা পাথরের চাঁই আমার প্রায় কান ঘেঁষে পড়ল যেখানে আমি বসে ছিলাম। ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। মরিয়ার্টি একলা আমার সঙ্গে মোকাবিলা করতে আসেনি। প্রোফেসরের সঙ্গে তার এক চেলা ছিল। চেলার যে-পরিচয়টুকু পেলাম তাতে বুঝতে ভুল হল না যে, চেলাটির প্রকৃতিও কম সাঙঘাতিক নয়। আরও বুঝলাম যে, মরিয়ার্টি যখন আমাকে আক্রমণ করে তখন সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। আমার অজ্ঞাতে ব্যাপার যা ঘটেছে তা সবই ও দেখতে পেয়েছে। তারপর ও ঘাপটি মেরে দেখেছে, আমি কী করি। আমাকে পাহাড়ের ওই জায়গাটায় আশ্রয় নিতে দেখে ও ওপর থেকে আমাকে টিপ করে পাথর ছুড়ে মরিয়ার্টি যে-কাজটা শেষ করতে পারেনি সেই কাজটা শেষ করতে চেয়েছে।”

একটু থেমে হোমস বলল, “বুঝলে ওয়াটসন, গোটা ব্যাপারটাই এক পলকে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আমি দেখলাম, সেই লোকটা পাহাড়ের ওপর থেকে গুড়ি মেরে দেখছে আমি কী করছি। ওর মতলব টের পেতে আমার ভুল হল না। ও আর-একটা পাথর ফেলবার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমি পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম। স্বাভাবিক অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় আমি ওই ভাবে কিছুতেই নামতে পারতাম না। ওই পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা শক্ত। নামাটা দেখলাম আরও অনেক বেশি শক্ত। কিন্তু তখন এই সব কথা ভাববার অবস্থা আমার ছিল না। আমি যখন খাঁজের প্রান্ত ধরে ঝুলছি, ঠিক তখনই একটা পাথর আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। আধাআধি যখন নেমে এসেছি, তখন আমার হাত ফসকাল। সে দিন আমার ওপর ভগবানের অসীম করুণা ছিল বলতে হবে। আমি জলপ্রপাতের দিকে না পড়ে রাস্তার ওপর পড়লাম। হাত-পা ছড়ে রক্ত পড়তে লাগল। জামাকাপড় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেল। কিন্তু সে সব গ্রাহ্য না করে সেই অন্ধকারে আমি পথ চলতে লাগলাম। আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে সেই রাতে দশ মাইল পাহাড়ি পথ হাঁটলাম। এক সপ্তাহ পরে আমি ফ্লোরেন্স পৌঁছে গেলাম। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। আমার যে কী হয়েছে তা কিন্তু কেউই জানতে পারেনি।

“শুধুমাত্র এক জন লোকই আসল কথাটা জানত। সে হল আমার দাদা মাইক্রফট। তোমাকে সেসব কথা জানাতে পারিনি বলে আমার নিজেরও কম কষ্ট হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করো ওয়াটসন, এ ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না। আমি চেয়েছিলাম যে, সবাই বিশ্বাস করুক, আমার মৃত্যু হয়েছে। আর এটা ঠিক যে, তুমি যে ভাবে রাইখেনবাখ ফলসের কথা লিখেছিলে, সে ভাবে কখনওই লিখতে পারতে না যদি তুমি জানতে যে, আমি বেঁচে আছি। তোমার লেখাটা খুবই আন্তরিক হয়েছিল। গত তিন বছরে অনেক বার আমার তোমাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু লিখতে বসে লিখিনি। ভয় হয়েছে, পাছে তুমি এমন কিছু কথা কাউকে বলে ফেলো বা এমন কিছু লিখে ফেলো যাতে সত্যি কথাটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। তা হলে আমার সব চেষ্টা একদম ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেই একই কারণে আজ সন্ধেবেলা যখন তুমি আমার বইপত্তর উলটে ফেলে দিলে, তখন আমি তোমাকে চেনা দিইনি। তখন আমার শত্রু আমার কাছেই ছিল। তোমার মুখের সামান্য ভাব-পরিবর্তনও তার নজর এড়াত না। আর তা হলেই আমার এই যে মিথ্যে পরিচয় সেটা ফাঁস হয়ে যেত। আর তাতে যা ক্ষতি হত, তা কিছুতেই পূরণ করা যেত না। মাইক্রফটকে সব কথা জানাতেই হয়েছিল টাকাপয়সার ব্যবস্থা করার জন্য। লন্ডনে যেসব ঘটনা ঘটছিল, তাতে আমি নিজেও খুব ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। পুলিশ যখন মরিয়ার্টির দলকে গ্রেফতার করতে চায় তখন শুধু যে মরিয়ার্টি একলাই পালাতে পেরেছিল তাই নয়, ওর দুজন শাগরেদও পালিয়েছিল। এই দু’জনই অত্যন্ত জঘন্য ধরনের ক্রিমিনাল। আমার পয়লা নম্বরের শত্রু। আর এই দু’জনেই বেশ বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরপর আমি তিব্বতে বছর-দুয়েক কাটিয়ে এলাম। সেই সময়ে লাসায় খুব আনন্দে ছিলাম। লামাদের যিনি প্রধান, তাঁর কাছেও কিছু দিন থেকে গেলাম। এই সময়ে তুমি নিশ্চয়ই নরওয়ের বাসিন্দা মিঃ সিগারসনের নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতার টুকরোটাকরা খবর কাগজে পড়ে থাকবে। কিন্তু এই সিগারসনই যে তোমার বন্ধু, এ চিন্তাটা তোমার মাথায় নিশ্চয়ই একবারও ঢোকেনি। তিব্বত থেকে আমি গেলাম পারস্যে। সুযোগমতো মক্কাটা ঘুরে নিলাম। মক্কা বেড়িয়ে গেলাম খার্তুম। খার্তুমের খলিফার সঙ্গে অনেক দরকারি কথা হল। খলিফার সঙ্গে আমার যে-কথা হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ আমি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের আপিসে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওখান থেকে আমি ফ্রান্সে ফিরে এলাম। ফ্রান্সে এসে আমি কয়লা থেকে যে-সব জিনিস উৎপন্ন হয়, তাদের রাসায়নিক গুণাগুণের ওপর রিসার্চ করছিলাম। আমি সে-সময়ে মনট্‌পেনিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলাম। কাজটা যখন আমার পছন্দমাফিক হল, তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খবর পেলাম যে, আমার শত্রুদের মধ্যে কেবল এক জনই বেঁচে আছে। আমি ঠিক করলাম, এইবার লন্ডন ফিরব। ঠিক এই রকম সময় পার্ক লেনের অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের খবরটা আমার চোখে পড়ল। ব্যাপারটা বেশ নতুন ধরনের তো বটেই তা ছাড়া আমার কেমন মনে হতে লাগল যে, এই রহস্যের সমাধানের সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের সুযোগও এসে গেছে, তাই কালবিলম্ব না করে লন্ডনে ফিরে এলাম। শার্লক হোমসের পরিচয়ে যখন বেকার স্ট্রিটে এসে হাজির হলাম, তখন মিসেস হাডসনের আনন্দ দেখবার মতো। তিনি পাগলের মতো নাচানাচি আর কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। মাইক্রফট ভাড়াটাড়া দিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটটা ঠিকঠাক করে রেখে দিয়েছিল। ফ্ল্যাটে এসে দেখলাম, আমার কাগজপত্র যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম, তেমনই আছে। তারপর শেষকালে আজ দুটোর সময় আমি আমার নিজের আরামচেয়ারে বেশ আরাম করে বসলাম। বসে বসে ভাবছিলাম, ষোলোকলা পূর্ণ হত যদি আমার বন্ধু ওয়াটসন তার আরামচেয়ারটা আমার চেয়ারের সামনে টেনে নিয়ে বসত।”

এপ্রিল মাসের এক সন্ধেবেলায় আমার বসার ঘরে আমি এই সব কথা শুনলাম। হোমস যদি নিজের মুখে এসব কথা না বলত, তা হলে আমি ওর একটি অক্ষরও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু হোমস আমার সামনেই বসে ছিল। হোমস খুব রোগা হয়ে গেছে বলে তাকে আরও লম্বা দেখাচ্ছে। তবে তার চোখের দৃষ্টি তেমনই উজ্জ্বল আর তীক্ষ। বুঝলাম যে, স্বপ্ন ও কল্পনা সত্য ছাড়িয়ে যেতে পারে। হোমসকে যে আবার দেখতে পাব তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনও দিন। আমার জীবনে যে শোকের আঘাত এসেছে, সে খবরও দেখলাম হোমস জানে। হোমস মুখে কিছু না বললেও আমার শোকে যে সে খুবই দুঃখ পেয়েছে, তা বুঝলাম ওর হাবভাব দেখে। হোমস বলল, “জানো ওয়াটসন, শোকদুঃখের একমাত্র ওষুধ কাজ। আজ রাত্তিরে আমাদের হাতে একটা কাজ আছে। যদি সেই কাজটা আমরা ঠিক ভাবে সারতে পারি, তা হলে জানব যে আমাদের মানুষ হয়ে জন্মানো সার্থক হল।”

কাজটা যে কী তা বলবার জন্যে আমি অনেক পীড়াপীড়ি করলাম। কিন্তু হোমস কোনও কথাই বলল না। “রাত শেষ হবার আগেই তুমি সবকিছু দেখবে, শুনবে। মনে রেখো, আমাদের দু’জনেরই তিন বছরের জমানো কথা বলবার আছে। সুতরাং সেই কথা মনে রেখে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকো। সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা নৈশ অভিযানে বেরোব।

আমাদের গন্তব্যস্থল একটা খালি বাড়ি।”

সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা যখন বার হলাম তখন আমার সেই সব পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। সেই রকম ভাড়া গাড়ির সিটে পাশাপাশি বসে আমরা যাচ্ছি। আমার পকেটে রিভলভার। বুকে একটা চাপা দুরুদুরু উত্তেজনা। হোমসের চোখেমুখে উত্তেজনার কোনও ছাপই নেই। একদম শান্ত। নির্বিকার। রাস্তার আলো এসে পড়ছিল মাঝে মাঝে, সেই আলোতে হোমসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তার কপাল কুঁচকে রয়েছে। হোমস সামনের দিকে তাকিয়ে আছে বটে, তবে কোনও কিছু যে তার নজরে পড়ছে তা মনে হল না। বুঝলাম যে, ও অত্যন্ত ভীষণ রকম চিন্তিত। লন্ডনের অপরাধ-জগতের গভীর জঙ্গলে কোন বন্যজন্তুটিকে শিকার করতে যে আমরা বেরিয়েছি, তা আমি নিজেও জানি না। তবে পাকা শিকারি হোমসকে ওই ভাবে বসে থাকতে দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না যে, আমাদের আজকের শিকার চুনোপুঁটি তো নয়ই, রীতিমতো রাঘববোয়াল। তবে হোমসের ঠোঁটের কোণে যে একটুকরো হাসি লেগে ছিল, তার থেকে বুঝতে পারলাম, আমাদের শিকারের বাঁচবার আজ আর কোনও আশা নেই। ঘায়েল সে আজ হবেই।

আমি ভেবেছিলাম আমরা বুঝি বেকার স্ট্রিটের দিকেই যাচ্ছি। কিন্তু ক্যাভেন্ডিস স্কোয়ারের মোড়ের কাছে আসতেই হোমস গাড়ি থামাতে বলল। লক্ষ করলাম, গাড়ি থেকে নেমেই হোমস ডান দিকে বাঁ দিকে খুব ভাল করে তাকিয়ে দেখল। তারপর প্রত্যেক মোড়ে পৌঁছেই হোমস চার দিক ভাল করে দেখে নিতে লাগল। বুঝলাম আমাদের কেউ অনুসরণ করছে কিনা দেখে নিচ্ছে। আমরা নানান রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। লন্ডন শহরের অলিগলি সম্বন্ধে হোমসের জ্ঞান অসাধারণ। আজ রাতে যে-সব গলি-আস্তাবলের পাশ দিয়ে আমাকে নিয়ে চলল, সেসব রাস্তায় আমি আগে কোনও দিন আসিনি। শেষকালে আমরা এসে পড়লাম একটা সরু রাস্তায়। রাস্তার দু’দিকেই খুব পুরনো পুরনো অন্ধকার বাড়ি। দেখলেই মনে হয় পোড়োবাড়ি। সেই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আমরা ম্যানচেস্টার স্ট্রিটে পড়লাম। সেখান থেকে গেলাম ব্ল্যান্ডফোর্ড স্ট্রিটে। সেখানে পৌঁছেই হোমস একছুটে একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়ল। গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটা কাঠের গেট দেখলাম। হোমস গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। একটা উঠোন। সেখানে কোনও জনপ্রাণী আছে বলে মনে হল না। হোমস কোনও দিকে না-তাকিয়ে সোজা এগিয়ে গেল। তারপর পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বাড়ির খিড়কি-দরজাটা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। হোমসের পিছু পিছু আমিও ঢুকলাম। হোমস দরজাটা বন্ধ করে দিল।

ভেতরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। বুঝতে পারলাম বাড়িতে কোনও লোকজন নেই। একদম খালি বাড়ি। মেঝেতে কার্পেট নেই। তাই পা ফেললেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হচ্ছিল। আমি হাত বাড়াতেই দেওয়ালে হাত লাগল। দেখলাম, দেওয়ালের কাগজ ফালি ফালি হয়ে ঝুলছে। হোমস তার সরু সরু আঙুল দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। হোমসের হাত কনকনে ঠান্ডা। হোমস আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। একটু যেতেই একটা বিরাট হলঘর। এই ঘরটা তত অন্ধকার নয়। হোমস ডান দিকে বেঁকল। আমরা আর-একটা ঘরে এলাম। এ ঘরটা চৌকো সাইজের। আকারেও বেশ বড়। ঘরের মাঝখানটা রাস্তার আলোয় আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। তবে ঘরের চার পাশে গাঢ় অন্ধকার। ঘরের ভেতরে বা কাছাকাছি কোনও আলো নেই। রাস্তার দিকে একটা জানলা। তবে বাইরে থেকে যেটুকু আলো জানলার ধুলো-পড়া কাচ ভেদ করে আসছিল, তাতে আমরা দু’জন দু’জনকে আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। হোমস আমার কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “আমরা কোথায় বুঝতে পারছ?”

আমি সেই অপরিষ্কার জানলার কাচের ভেতর দিয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এটা তো বেকার স্ট্রিট।”

“ঠিক বলেছ। আমরা ‘ক্যামডেন হাউসে’ এসেছি। এই বাড়িটা আমাদের ফ্ল্যাটের ঠিক উলটো দিকে।”

“কিন্তু আমরা এখানে এলাম কেন?”

“এখান থেকে আমাদের বাড়িটা খুব ভাল ভাবে দেখা যায়। ওয়াটসন, তুমি সাবধানে জানলার কাছে এগিয়ে এসো। দেখো বাইরে থেকে তোমাকে যেন কেউ দেখতে না পায়। আমার ফ্ল্যাটের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো। সেই ফ্ল্যাট, যেখান থেকে আমাদের অনেক রহস্য-অভিযানের শুরু হয়েছে, তার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো। দেখা যাক, তোমাকে আগেকার মতো অবাক করে দিতে পারি কিনা।”

আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। জানলা দিয়ে আমি বাইরে তাকাতেই ফ্ল্যাটের জানলাটা নজরে পড়ল। পরদাটা নামানো ছিল। ঘরের ভেতরে খুব জোরালো একটা আলো জ্বলছিল। ঘরের ভেতর চেয়ারে এক জন কেউ বসে ছিলেন। সেই লোকটির ছায়া জানলার পরদার ওপর পড়েছিল। ভুল হতেই পারে না আমার! ওই ভাবে মাথা হেলাবার ভঙ্গি, কাঁধের চৌকো আদল, বসবার ভঙ্গি সবই আমার চেনা। মুখটা সামান্য ফেরানো। জানলায় সেই মুখের পরিষ্কার সিল্যুট দেখা যাচ্ছে। আমি তো অবাক! অবিশ্বাস্য কাণ্ড। আমি জেগে আছি তো? আমি হোমসের দিকে তাকালাম। হোমস তখন হাসির দমকে দমকে অস্থির হয়ে পড়েছে।

হোমস বলল, “তারপর ওয়াটসন, কী বুঝলে?”

আমি বললাম, “দারুণ হয়েছে।”

হোমস বলল, “তা হলে স্বীকার করছ তো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভোঁতা হয়ে যাইনি, আর অনবরত কাজ করে গেলে নতুন নতুন কৌশল বের করবার জন্যে যে কল্পনাশক্তির দরকার তাও আমার নষ্ট হয়ে যায়নি।”

হোমসের বলার ধরনে বুঝলাম যে, সে খুবই খুশি হয়েছে। কাজ নিখুঁত ভাবে করতে পারলে একজন শিল্পীর যে রকম আনন্দ হয় এ আনন্দ সেই রকম। “ওই চেয়ারে-বসা। লোকটাকে অনেকটা আমার মতোই দেখতে, তাই না?”

“আমি তো হলফ করে বলতে পারি যে, হ্যাঁ, ওখানে তুমিই বসে আছ।” “এর সব কৃতিত্বটুকুই গ্রেনোবলের মঁসিয়ে অস্কার মুজিয়ে দাবি করতে পারেন। এই মূর্তিটা মোম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বাকি কাজটুকু আমি আজ বিকেলে বেকার স্ট্রিটে গিয়ে সেরে এসেছি।”

“কিন্তু এত কাণ্ড কেন?”

“কারণ আর কিছু নয়, আমি চাই কিছু লোক বিশ্বাস করুক যে ঠিক এই মূহুর্তে আমি শার্লক হোমস বেকার স্ট্রিটের ঘরে বসে আছি, আমি যে ওখানে নেই, সে কথাটা যেন ওরা কিছুতেই টের না পায়।

“তোমার ধারণা, বেকার স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের ওপরে কেউ নজর রেখেছে?”

“ধারণা নয়, আমি নিশ্চিত জানি সে কথা।”

“কিন্তু কারা?”

“আমার পুরনো শত্রুরা। যাদের নেতা রাইখেনবাখ হ্রদের জলের তলায় চির দিনের জন্যে তলিয়ে গেছে। ওয়াটসন, এ কথা ভুলো না, ওরা আগাগোড়াই জানে আমি সে দিন মরিনি। তাই ওরা ধরে নিয়েছিল, আজ হোক কাল তোক আবার আমি আমার বাড়িতে ফিরে আসব। তাই আমাদের ফ্ল্যাটে নজর রাখবার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা লোক লাগিয়ে রেখেছিল। আজ সকালে ওরা আমায় বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে।”

একটু চুপ করে থেকে আমি বললাম, “তুমি কী করে টের পেলে?”

হোমস বলল, “জানলা দিয়ে উঁকি মেরে রাস্তার দিকে তাকাতেই আমি ওদের পাহারাদারকে দেখতে পেলাম। যে-লোকটাকে ওরা কাজে লাগিয়েছে, তাকে আমি চিনি। ওর নাম পার্কার। লোকটা বোকা ধরনের। ও হচ্ছে নামকরা ফঁসুড়ে। লোকের গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করে। তবে ও তারের বাজনা খুব ভাল বাজাতে পারে। ওকে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা ওকে যে বহাল করেছে তাকে নিয়ে। সেই লোকটি প্রোফেসর মরিয়ার্টির ডান হাত। সে দিন ওই লোকটিই পাথরের চাঁই ফেলে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। লন্ডন শহরে ওর মতো ধূর্ত আর জঘন্য স্বভাবের দ্বিতীয় কোনও অপরাধী আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। ওয়াটসন, সেই লোকটিই আজ আমার পিছু নিয়েছে। কিন্তু একটা কথা ও জানে না। সেটা হল যে, আমরাই ওর পিছু নিয়েছি।”

হোমসের মতলব আমার কাছে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে এল। এই নির্জন খালি বাড়ির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে বসে আমরা, যারা হোমসকে তাড়া করছে, তাদের ওপর নজর রাখতে পারছি। মানে, যারা শিকারি হয়ে হোমসকে শিকার করতে চেয়েছে তারাই এখন শিকার আর হোমসই শিকারি হয়ে গেছে। বেকার স্ট্রিটের বাড়ির ওই ছায়ামূর্তি আসলে টোপ। অন্ধকারে আমরা দু’জনে চুপ করে দাঁড়িয়ে বেকার স্ট্রিট ধরে যে-সব লোক হেঁটে যাচ্ছিল, তাদের ওপর নজর রাখতে লাগলাম। হোমসের মুখে একটি কথা নেই। সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম যে, মনে মনে সে খুব অধীর হয়ে উঠেছে। পথচারীদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সে। সন্ধে থেকেই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে। এখন তো রীতিমতো ঝোড়ো হাওয়া বইছে। লোকজন ওভারকোট-মাফলার মুড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটছে। লোকজনদের দিকে তাকাতে তাকাতে আমার মনে হল যে, দু’-একটি লোক বোধহয় বেশ কয়েক বার একই ভাবে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। দুটি লোককে দেখে আমার তো রীতিমতো সন্দেহ হল। লোক দুটি ঝোড়ো হাওয়ার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য আমাদের ফ্ল্যাট থেকে একটু দূরে একটা বাড়ির দরজার কাছে জড়োসড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি হোমসকে ওই লোক দুটিকে ভাল করে দেখতে বললাম। হোমস আমার কথা তো শুনলই না, উলটে মুখ দিয়ে এমন একটা শব্দ করল যে, বুঝতে পারলাম সে খুব বিরক্ত হয়েছে। হোমস মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দেওয়ালে ঠুক ঠুক করে শব্দ করছিল আর মেঝেতে পা ঠুকছিল। বুঝতে পারলাম যে, হোমস মনে মনে অধৈর্য হয়ে পড়েছে। সে যে-মতলব ভেঁজেছিল সেটা ঠিকমতো না হওয়ায় সে ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির হয়ে পড়েছে। বারোটা বাজল। রাস্তায় লোকচলাচল কমে আসছে। হোমস ঘরের মধ্যে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল। বুঝলাম যে, ওর মনের উত্তেজনাকে দমাতে হোমসকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

আমি হোমসকে একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আমার চোখ গেল আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে। আমি একদম তাজ্জব। আমি হোমসের হাতটা আঁকড়ে ধরে ওকে জানলার দিকে দেখতে বললাম।

“ছায়াটা সরে গেছে!”

এখন আর মুখের প্রোফাইলটা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে মাথার পেছন দিকটা। তার মানে মাথাটা ঘুরে গেছে ঘরের দিকে।

দেখলাম তিন বছর অজ্ঞাতবাস করলেও হোমসের রাগ কমেনি। ওর কাজকর্মের হদিস করতে না পারলে ও এখনও আগের মতো চটে যায়।

হোমস বলল, “নিশ্চয়ই ছায়াটা সরে গেছে। তুমি কি ভাবো যে, আমি একটা আস্ত গাধা। একটা সাজানো পুতুলের টোপ ফেলে অতিশয় ধূর্ত একটি শয়তানকে ধরতে চেষ্টা করব। আমরা এই ঘরে ঘণ্টা-দুয়েক এসেছি, আর এই সময়ের মধ্যে মিসেস হাডসন পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর মূর্তিটাকে একটু একটু করে নড়িয়ে চড়িয়ে দিয়েছেন। উনি সামনের দিক থেকে মূর্তিটাকে নড়াচড়া করছেন বলে ওঁর ছায়া জানলার পরদায় পড়ছে না। আহ্!” হোমস খুব উত্তেজিত ভাবে দম নিল। ঝাপসা আলোয় দেখলাম, হোমস সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। ওর শরীর একদম শক্ত হয়ে গেছে। এই লোকদুটিকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওরা হয়তো অন্য কোনও ঘরের দরজায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। চার দিক চুপচাপ। অন্ধকার। শুধু আমাদের ফ্ল্যাটটায় আলো জ্বলছে। আর সেই আলো পড়েছে জানলার পরদায়। পরদার মাঝখানে একটি মূর্তির ছায়া। অন্ধকারে হোমসের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ হোমস আমাকে টেনে সরিয়ে ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার কোণে টেনে নিয়ে গেল। তারপর আমার মুখের ওপর তার আঙুলটা চেপে ধরল। হোমস আমাকে ধরে ছিল। টের পেলাম যে, ওর হাতটা কাপছে। হোমসকে এত বেশি উত্তেজিত হতে আগে কখনও দেখিনি। অথচ জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে চঞ্চল হবার মতো কোনও কিছুই আমি দেখতে পেলাম না।

একটু পরেই আমি বুঝতে পারলাম যে, কেন হোমস অত অস্থির হয়েছিল। হোমসের অনুভূতি যে আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রখর এই কথাটা ফের একবার বুঝতে পারলাম। আমার মনে হল, খুব সন্তর্পণে কেউ যেন আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে আসছে। শব্দটা বেকার স্ট্রিটের দিক থেকে আসেনি। আসছে আমরা যে-বাড়িতে এসে লুকিয়েছি, সেই বাড়িরই পেছন দিক থেকে। একটা দরজা খোলার শব্দ হল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সে শব্দও পেলাম। আর-একটু পরেই বাড়ির বারান্দায় ফের পায়ের শব্দ শুনলাম। চাপা আর সতর্ক। এমনিতে এই শব্দ কানে আসবার কথা নয়। তবে একে বাড়িটা পুরনো তার ওপর মেঝেয় কার্পেট নেই। তাই আগন্তুক যতই চেষ্টা করুক না কেন, তার পায়ের শব্দ খালি বাড়িতে বেশ ভাল ভাবেই শোনা যাচ্ছিল। হোমস দেওয়ালের সঙ্গে একদম সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল। আমিও তাই করলাম। হঠাৎ আমার খেয়াল হল যে, নিজের অজান্তেই আমি রিভলভারের বাঁটটা চেপে ধরেছি। অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করে দেখলাম, ঘরের দরজায় একটা গাঢ় ছায়া এসে দাঁড়াল। সেই ছায়ামূর্তি দরজার কাছে এক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে দাঁড়াল। তারপর সেই ছায়ামূর্তি খুব সাবধানে গুড়ি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকল। ওর হাবভাব অনেকটা হিংস্র বন্য জন্তুর মতো। মনে হয় শিকারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার জন্য তৈরি হয়েই আছে। ওর আর আমাদের মধ্যে দূরত্ব গজ-তিনেকের বেশি নয়। ও আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়লে আমি কী করব, তা ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে, আমরা যে ঘরে আছি, তা ও জানে না। আমাদের পাশ দিয়ে ও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল জানলার দিকে। তারপর খুব সাবধানে আস্তে আস্তে ও জানলার কাচটা ফুটখানেক ঠেলে তুলে দিল। তারপর ও খোলা জানলার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল, যাতে ওর মাথা জানলার ফ্রেমের আড়ালে থাকে। ধুলো-পড়া নোংরা কাচটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাস্তার আলো ওই ফাঁক দিয়ে এসে সোজাসুজি ওর মুখের ওপর পড়ছিল। মনে হল লোকটা এতই উত্তেজিত যে, বোধহয় এক্ষুনি বেসামাল হয়ে পড়বে। ওর চোখদুটো নীল আকাশের উজ্জ্বল তারার মতো চকচক করছিল। একটা চাপা উত্তেজনায় ওর সারা শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

লোকটির বেশ বয়স হয়েছে। খাড়া নাক। চওড়া কপাল। চুল উঠে যাবার দরুন কপাল আরও চওড়া দেখাচ্ছে। পুরু খোঁচা খোঁচা গোঁফ। লোকটার মাথায় একটা অপেরা-হ্যাঁট। সেটা আবার মাথার পিছন দিকে ঠেলা। খোলা ওভারকোটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম যে, লোকটা বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার সান্ধ্য পোশাক পরা। বেশ ভারী গম্ভীর মুখ। মুখের ওপর খুব স্পষ্ট বলিরেখা ফুটে উঠেছে। তাতে ওকে আরও ভীষণ দেখাচ্ছে। লোকটার হাতে একটা লাঠির মতো কিছু ছিল। সেটা মাটিতে নামিয়ে রাখতেই ঠং করে একটা ধাতব আওয়াজ হল। তারপর ওভারকোটের পকেট থেকে ও একটা বড়সড় ভারী জিনিস বের করল। এরপর মেঝেয় বসে লোকটা কী করছিল, তা দেখতে পেলাম না বটে তবে কিছুক্ষণ পরে হুড়কো বা ছিটকিনি ঠিকমতো লেগে গেলে যে রকম আওয়াজ হয়, সেই রকম একটা ঠক করে শব্দ হল। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটা গায়ের জোরে কোনও জিনিস চাড় দিয়ে তোলবার চেষ্টা করছে বলে মনে হল। অনেকক্ষণ একটা ঘড়ঘড় শব্দ হবার পর আবার একটা খট করে শব্দ হল। শব্দটা বেশ জোরেই হল।

লোকটা এতক্ষণে উঠে দাঁড়াল। ওর হাতের জিনিসটা এইবার দেখতে পেলাম। একটা বন্দুক। তবে বন্দুকের কুঁদোটা সাধারণ বন্দুকের কুঁদোর মতো নয়। একটু অদ্ভুত ধরনের। লোকটা বন্দুকের নলের পেছন দিকটা খুলে ফেলল। তারপর কোনও কিছু পুরে দিয়ে আবার কুঁদো আর নলটা ঠিক খাপে খাপে লাগিয়ে দিল। তারপর প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেল। জানলার কাছে গিয়ে লোকটা বন্দুকের নলটা খোলা জানলার ফ্রেমের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে রাখল। দেখলাম, ওর বিরাট গোঁফ বন্দুকের কুঁদোর সঙ্গে প্রায় ঠেকে গেছে। আর বাইরের দিকে তাকিয়ে লোকটা কোনও কিছু যেন খুঁজছিল। হঠাৎ ওর চোখদুটো জ্বলে উঠল। বন্দুকের কুঁদোটা বেশ জুত করে বাগিয়ে ধরে লোকটা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। লোকটা যে কাকে তাক করছে, দেখতে পেলাম। লোকটা মিনিট দুয়েক পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইল। তার পরই ওর আঙুল ট্রিগারের ওপর চেপে বসল। একটা আশ্চর্য রকমের হাওয়া-কাটা শব্দ হল। আর তার পরই ঝনঝন করে কাচভাঙার শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে হোমস বাঘের মতো সেই লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিত করে ফেলল। লোকটার গায়ের জোরও কম নয়। তক্ষুনি উঠেই দু’হাতে হোমসের গলা টিপে ধরল। আমি রিভলভারের বাঁট দিয়ে লোকটার মাথায় ঠক করে এক মোক্ষম ঘা লাগালাম। এক ঘা খেয়েই লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি লোকটাকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে রইলাম। হোমস পকেট থেকে একটা বাঁশি বের করে জোরে ফুঁ দিল। রাস্তায় পুলিশের ভারী জুতোর ছোটাছুটির শব্দ শুনতে পেলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দু’জন কনস্টেবল আর এক জন সাদা পোশাক পরা ডিটেকটিভ সদর দরজা ঠেলে বাড়িতে ঢুকে সোজা আমরা যে-ঘরে ছিলাম, সেই ঘরে এসে হাজির হল।

“কে, লেস্ট্রেড নাকি?” হোমস জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ মিঃ হোমস। ডিউটিটা আমি নিজেই নিয়েছিলাম। আপনি লন্ডনে ফিরে এসেছেন দেখে খুব ভাল লাগল।”

“দেখো লেস্ট্রেড, আমার মনে হচ্ছে যে, তলায় তলায় বেসরকারি ভাবে তোমাকে কিছু সাহায্য করা দরকার। এক বছরে তিন তিনটে খুন হল, অথচ একটারও খুনি ধরা পড়ল না। এটা তো ভাল কথা নয়। তবে হ্যাঁ, মোলসে রহস্যের কিনারা করতে গিয়ে তুমি সাধারণত যে রকম করো, তার তুলনায় বেশ ভালই করেছ, সে কথা মানতেই হয়।”

আমরা সকলেই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। দু’জন কনস্টেবলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের বন্দি ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছিল। গোলমাল শুনে দু’-চার জন লোক বাড়ির সামনের রাস্তায় জড়ো হয়েছিল। হোমস জানলার কাছে গিয়ে শার্সি বন্ধ করে দিয়ে জানলার ভারী পরদা টেনে দিল। লেস্ট্রেড সঙ্গে দুটো মোমবাতি এনেছিল। সে মোমবাতি দুটো জ্বালিয়ে দিল। কনস্টেবলরা ওদের ঢাকা দেওয়া লণ্ঠনগুলো জ্বালল। এতক্ষণে ধরা পড়া লোকটিকে বেশ ভাল করে দেখতে পেলাম।

লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। ওর মুখটা দেখলে প্রথমেই দুটো কথা মনে হয়। ওর গায়ে অসম্ভব ক্ষমতা আর ওর স্বভাব অত্যন্ত খারাপ। ওর মুখের ওপর দিকটা দেখলে দার্শনিকের চেহারা মনে পড়ে যায়। আর মুখের নীচের দিকটা দেখলে মনে হয় যে, লোকটা যেমন লোভী আর তেমনই নীচ প্রকৃতির। সুপথে বা কুপথে যাবার সব লক্ষণই ওর চেহারায় ফুটে উঠেছে। তবে ওর নীল প্রায়-বুজে-থাকা চোখের চাউনি আর মুখের বাঁকা হাসি দেখলে যে-কেউই বুঝতে পারবে, এর থেকে সহস্র হাত নয়, নিযুত হাত দূরে থাকা উচিত। লোকটা আমাদের দিকে এক বারও তাকায়নি। একদৃষ্টিতে ও শার্লক হোমসকে দেখছিল। ওর চাউনি দেখে বুঝলাম যে, শার্লক হোমসকে বাগে পেলে ও এক্ষুনি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ দেখে এটাও বুঝলাম যে, হোমসের হাতে ধরা পড়ে ও ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। ও কেবলই বিড়বিড় করে বলছিল, “শয়তান, ধূর্ত শয়তান।”

জামার কলার ঠিক করতে করতে হোমস বলল, “ওহ কর্নেল, সেই পুরনো যাত্রায় পালা শেষ হলে বন্ধুবান্ধবের যেমন মিলন হয়, আমাদের ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম হল, তাই না?—সেই রাইখেনবাখ জলপ্রপাতের ধারে আপনি যখন আমাকে তাক করে পাথর, চাঙড় গড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তারপর বোধহয় আমাদের আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, কী বলেন?”

কর্নেল ভূতে-পাওয়ার মতো একদৃষ্টিতে হোমসের দিকে তাকিয়ে রইল। “ঘোড়েল, ফিচেল, ঘুঘু, শয়তান,” ছাড়া আর কোনও কথা ওর মুখ দিয়ে বার হল না।

হোমস বলল, “এই যাঃ, আপনাদের সঙ্গে এঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। এঁর নাম কর্নেল সেবাস্টিয়ান মোরান। ইনি আমাদের রানির ভারতীয় সেনা বিভাগে ছিলেন। বন্যপ্রাণী শিকারে একেবারে সিদ্ধহস্ত। কত যে বাঘ মেরেছেন, তা বলা যায় না। তবে একটা কথা বলতে পারি, এঁর মতো এত বেশি বাঘ বোধহয় আর কেউ মারতে পারেননি।”

হোমসের কথার জবাবে কর্নেল কোনও কথাই বলল না। শুধু হোমসকে লক্ষ করতে লাগল। তবে ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর জ্বলজ্বলে চোখের হিংস্র ভাব দেখে আমার বাঘের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।

হোমস বলল, “কর্নেল, আপনার মতো একজন ঝানু শিকারি আমার এই অতি সাধারণ ফাঁদে যে কী করে পা দিলেন তা ভেবে আমি নিজেই আশ্চর্য হচ্ছি। এ তো আপনার জানা ফাঁদ। আপনি কি গাছের তলায় ছাগলছানা রেখে গাছের ওপর মাচা বেঁধে বাঘের জন্যে বসে থাকেননি? এই ফঁকা বাড়িটা হল আমার মাচা, আর আপনি হলেন সেই বাঘ। যখন আপনি বাঘ শিকারে যেতেন তখন একটা বন্দুক যদি ঠিকমতো কাজ না করে বা যদি একটার বেশি বাঘ এসে হাজির হয় তো, এই ভেবে আপনি নিশ্চয়ই সঙ্গে দু’-একটা বাড়তি বন্দুক নিয়ে যেতেন। এই এঁদের যে দেখছেন, এঁরা হচ্ছেন আমার সেই বাড়তি বন্দুক। ব্যাপারগুলো হুবহু মিলে যাচ্ছে।”

কর্নেল মোরান হোমসের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করল। কনস্টেবলরা ওকে টেনে ধরল। রাগে প্রতিহিংসায় ওর মুখটা তখন কদাকার দেখাচ্ছিল।

হোমস বলল, “স্বীকার করতে লজ্জা নেই, একটা ব্যাপারে আমি ঠকে গেছি। আপনি যে এই বাড়ির সামনের জানলাটা আপনার কাজের জন্যে বেছে নেবেন, এটা ভাবতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল যে, আপনি রাস্তা থেকেই কাজ সারবেন, তাই লেস্ট্রেডকে তার দলবল নিয়ে রাস্তায় নজর রাখতে বলেছিলাম। হিসেবের এই গরমিলটুকু ছাড়া আমি যা ভেবেছি, ঠিক তাই হয়েছে।”

কর্নেল লেস্ট্রেডের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আমাকে কোন অভিযোগে আপনি গ্রেফতার করছেন জানি না। তবে এই ভদ্রলোকের এই ধরনের ভাঁড়ামি সহ্য করতে আমি মোটেই রাজি নই। আমি যদি অপরাধী হই, তবে আইন অনুযায়ী আমার বিচার হোক।”

লেস্ট্রেড বললেন, “এটা খুবই যুক্তিযুক্ত কথা বটে। মিঃ হোমস আপনি আমাকে আর কিছু বলবেন, নাকি আমরা যাব!”

হোমস এক সময়ে মেঝে থেকে এয়ারগানটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। দেখলাম, সেটা ও খুব ভাল করে দেখছে।

একটু থেমে হোমস বলল, “এটা একটা অসাধারণ অস্ত্র,” তারপর বলল, “দারুণ জোরে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করবে, অথচ শব্দ হবে না একটুও। অন্ধ জার্মান কারিগর ফন হার্ডারকে আমি জানতাম। প্রোফেসর মরিয়ার্টি এই অস্ত্রটা ওকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিল। এটার কথা আমি অনেক দিন ধরে শুনছি, তবে আজই প্রথম জিনিসটা চাক্ষুষ করলাম। লেস্ট্রেড এই এয়ারগানটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করবে। আর কী ধরনের বুলেট এতে লাগে সেটাও দেখবে।”

“সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন, মিঃ হোমস,” বলে লেস্ট্রেড চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল, “আর কিছু বলতে চান নাকি?”

“হ্যাঁ, একটা কথা। কর্নেলের নামে কী অভিযোগ আনবে ভাবছ?”

“কেন?” লেস্ট্রেড রীতিমতো অবাক হয়ে হোমসের দিকে চাইল। “মিঃ শার্লক হোমসকে খুন করার চেষ্টার জন্যে কর্নেলকে অভিযুক্ত করা হবে।”

“না, লেস্ট্রেড। এ ব্যাপারটার সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াতে চাই না। আজকের এই আশ্চর্য উপায়ে গ্রেফতার করার সমস্ত কৃতিত্ব তোমার, শুধু তোমারই। হ্যাঁ লেস্ট্রেড, আমি তোমাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সত্যি, যে রকম বুদ্ধির প্যাঁচে আর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তুমি একে গ্রেফতার করলে, তার জন্য তোমাকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না।”

“গ্রেফতার করলাম? কাকে গ্রেফতার করলাম, মিঃ হোমস?”

“যাকে ধরবার জন্যে সমস্ত পুলিশবাহিনী হন্যে হয়ে ঘুরছে। সেই কর্নেল সেবাস্টিয়ান মোরান, যিনি অনারেবল রোনাল্ড অ্যাডেয়ারকে তাঁর ৪২৭ নম্বর পার্ক লেনের বাড়ির দোতলা ঘরে এয়ারগানের এক্সগ্যান্ডিং বুলেট দিয়ে খুন করেছিলেন গত মাসের ৩০ তারিখে। এই অভিযোগেই তুমি কর্নেলকে অভিযুক্ত কোরো।…এখন ওয়াটসন, যদি ভাঙা জানলা দিয়ে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে তোমার ঠান্ডা লাগবার ভয় না থাকে তো চলো সিগার খেতে খেতে একটু গল্পটল্প করা যাক।”

মাইক্রফট জেমস আর মিসেস হাডসনের চেষ্টায় আমাদের পুরনো বাসাটি আগের মতোই আছে। তবে ঘরে পা দিতেই প্রথমে যেটা নজরে পড়ে সেটা হল যে, ঘরদোর বড় বেশি সাজানো-গোছানো। কিন্তু আগেকার অগোছালো দিনের কিছু কিছু ছাপ ঘরের চার পাশে ছড়িয়ে রয়েছে। ঘরের যে-দিকটায় হোমস তার নানান ধরনের রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষা করত, সেই দিকের দেওয়ালেও কাচের একটা টেবিলে নানান রাসায়নিক দ্রব্যের ছাপছোপ লেগে রয়েছে। ঘরের এক পাশে বইয়ের র‍্যাকে বড় আকারের দুটো বিরাট বিরাট টুকরো খবরের খাতা। আমি জানি লন্ডনে এমন বহু লোক আছে যারা ওই খাতাদুটো নষ্ট হয়ে গেলে খুবই খুশি হবে। হোমসের বিচিত্র সব নকশাকরা বেহালার বাক্স, পাইপের তাক, এমনকী সেই পার্সিয়ান চটিটি যার মধ্যে হোমসের তামাকের থলি থাকে, সবকিছুই আমার নজরে পড়ল। ঘরের ভেতরে দু’জনকে দেখতে পেলাম। এক জন মিসেস হাডসন। আর এক জন নকল শার্লক হোমস। আজকের সন্ধের এই অ্যাডভেঞ্চারে এই অদ্ভুত মূর্তিটার পার্টও বড় কম নয়। মূর্তিটা শার্লক হোমসের একটা মোমের আবক্ষ প্রতিমূর্তি, খুব সুন্দর করে তৈরি। একটা নিচু টেবিলের ওপর ওই আবক্ষ মূর্তিটা রাখা। হোমসের একটা ড্রেসিং গাউন মূর্তিটার গায়ে চাপানো। তাতে সব ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক আর জীবন্ত হয়ে উঠেছে।”

“মিসেস হাডসন, আমি যেমন যেমন বলেছিলাম আপনি সেগুলো ঠিকমতো করেছিলেন তো?”

“হ্যাঁ। আপনার কথামতো আমি হামাগুড়ি দিয়ে ওটার কাছে গিয়েছিলাম।”

“চমৎকার। আপনি একদম নিখুঁত ভাবে সবকিছু করেছেন। বুলেটটা কোন দিকে গিয়েছিল, খেয়াল করেছিলেন কি?”

“হ্যাঁ। আপনার এই সুন্দর আবক্ষ মূর্তিটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। গুলিটা মূর্তির মাথা ভেদ করে দেওয়ালে গিয়ে লাগে। কার্পেটের ওপর গুলিটা পড়েছিল দেখে তুলে রেখেছি। এই যে সেই গুলিটা।”

হোমস বুলেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, “ওয়াটসন, তুমি জানো নিশ্চয়ই যে এ ধরনের বুলেটকে বলে সফট রিভলভার বুলেট। লোকটা সত্যিই প্রতিভাশালী। এয়ারগান থেকে এ ধরনের বুলেট ছোড়ার কথা কারও মাথাতেই আসবে না। ঠিক আছে মিসেস হাডসন, আপনি যা করেছেন তার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার ছুটি। আপনি এখন যেতে পারেন। আর ওয়াটসন, তুমি তোমার নিজের চেয়ারে গিয়ে বোসো। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। এই কেসটার বেশ ক’টা পয়েন্ট তোমার সঙ্গে আলোচনা করে নিতে চাই।”

হোমস গা থেকে সেই পুরনো তেল চিটচিটে ওভারকোটটা খুলে ফেলেছিল। এখন হোমসকে ঠিক আগের মতো দেখাচ্ছিল। হোমস মূর্তির গা থেকে ওর ধূসর রঙের ড্রেসিং গাউনটা তুলে গায়ে চাপিয়ে নিল।

“এ কথা মানতে হবে যে, বয়স হলেও আমাদের এই বৃদ্ধ শিকারির নার্ভ এখনও বেশ শক্ত আছে, আর চোখের দৃষ্টিও রীতিমতো প্রখর।” নিজের আবক্ষ মূর্তির প্রায় উড়ে-যাওয়া খুলিটার দিকে তাকিয়ে হোমস হাসতে হাসতে বলল।

“ঠিক খুলির পিছনে গিয়ে বুলেটটা লেগেছে। তারপর মস্তিষ্ক ছেঁদা করে বেরিয়েছে। ভারতবর্ষে ওর মতো অব্যর্থ লক্ষ আর দ্বিতীয় কোনও লোকের ছিল না। তুমি কি ওর নাম শুনেছিলে?”

“না, আমি ওর নাম শুনিনি।”

“সে কী! এত নাম! অবশ্য আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তুমি তো প্রোফেসর জেমস মরিয়ার্টির নামই শোনোনি। মরিয়ার্টির মতো এ রকম ধুরন্ধর শয়তান তো এই শতাব্দীতে জন্মায়নি। বইয়ের র‍্যাক থেকে জীবনীর যে নির্ঘণ্টটা আছে সেটা দাও তো।”

হোমস তার আরামচেয়ারে বসে আরাম করে হেলান দিয়ে সিগারের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তার জীবনীসংগ্রহের নির্ঘণ্টের পাতা ওলটাতে লাগল।

“এম’ দিয়ে শুরু নামের তালিকাটা বেশ জবরদস্ত। মরিয়ার্টির জীবনের সবকিছু লেখা আছে। শুধু মরিয়ার্টিকে নিয়েই একটা বই লেখা যায়। তারপর হচ্ছে মরগান। লোকটা বিষ দিয়ে লোক মারতে পয়লা নম্বরের ওস্তাদ। তারপর দেখছি মেরিডিউ। লোকটা এত জঘন্য প্রকৃতির যে, ওর নাম উচ্চারণ করতে প্রবৃত্তি হয় না। তারপর ম্যাথিউজ। লোকটা চেয়ারিং ক্রশ স্টেশনে আমার বাঁ দিকের শ্বদন্তটা উপড়ে ফেলেছিল। তারপর রয়েছে আমাদের আজকের সন্ধ্যার অতিথি।”

হোমস খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি পড়লাম: মোরান, সেবাস্টিয়ান, কর্নেল। এখন বেকার। আগে বাঙ্গালোর পাইওনিয়ারের প্রথম বিভাগে চাকরি করত। লন্ডনে আঠারোশো তিরিশ সালে জন্ম। বাবার নাম স্যার অগস্টস মোরান, সি বি। (ইনি কিছুকাল পারস্যদেশে ব্রিটিশ মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছিলেন) শিক্ষা চিনে ও অক্সফোর্ডে। জোওয়াকি যুদ্ধে ও আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়া চরসিয়ার, শেরপুর এবং কাবুলেও কাজ করেছেন। হেভি গেমস ইন ওয়েস্টার্ন হিমালয়াস (১৮৮১) এবং থ্রি মান্‌থ্‌স ইন দ্য জাঙ্গল (১৮৮৪) নামে দুটি বইয়ের লেখক। ঠিকানা কনডুইট স্ট্রিট। দি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, দ্য ট্যাংকারভিল, দ্য ব্যাগাটেল কার্ড ক্লাবের সভ্য।’

এরপর হোমসের হাতের গোটা গোটা অক্ষরে পরিষ্কার লেখা: ‘লন্ডন শহরের দু’ নম্বর সাঙঘাতিক লোক।’

হোমসকে খাতাখানা এগিয়ে দিয়ে আমি বললাম, “খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো! লোকটির. সম্বন্ধে যা লেখা, তাতে তো বেশ সম্ভ্রান্ত ও সাহসী সৈনিক বলেই মনে হয়।”

হোমস বলল, “সে কথা ঠিক বটে। অনেকদিন পর্যন্ত ও বেশ সহজ সরল লোক ছিল। তবে লোকটার ধাত খুব কড়া। ওর সম্বন্ধে একটা কথা এখনও ভারতবর্ষে চলে। সেটা হল যে, একবার ও একটা আহত নরখাদক বাঘকে নর্দমার ভেতরে তাড়া করেছিল। বুঝলে ওয়াটসন, অনেক গাছ দেখবে যেগুলো কিছু দূর পর্যন্ত খাড়া উঠে গেছে আর তার পরই গাছটা বেঁকেচুরে একটা কিম্ভূত রূপ ধরেছে। এই ব্যাপারটা মানুষের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়। আমার একটা থিয়োরি আছে। সেটা হল যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই তার বংশের আকৃতি আর ধারা প্রকাশ পায়। তবে কখনও কখনও হঠাৎ কোনও একজনের মধ্যে তার পূর্বপুরুষের একজনের চরিত্রের দোষগুণ, ভালমন্দ খুব বেশি ভাবে ফুটে ওঠে। অর্থাৎ সেই লোকটি হঠাৎ খুব বেশি রকমের ভাল বা খারাপ হয়ে উঠতে পারে। ফলে সেই লোকটি তার বংশের ভাল-মন্দের প্রতীক হয়ে ওঠে।”

আমি বললাম, “এটা একটু মাত্রাছাড়া কল্পনা হয়ে যাচ্ছে না।”

“যাকগে, এ ব্যাপারে আমি তোমার ওপর জোর জবরদস্তি করতে চাই না। তবে কারণ যাই হোক না কেন, কর্নেল মোরান ক্রমশ খারাপ হয়ে যেতে লাগল। শেষকালে অবস্থা এমন হয়ে উঠল যে, ওর পক্ষে ভারতবর্ষে বাস করাই দায় হল। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মোরান লন্ডনে ফিরে এল। কিছু দিনের মধ্যেই লন্ডন শহরের কুখ্যাত লোকেদের মধ্যে মোরান বেশ আসর জমিয়ে বসল। ক্রিমিনালদের মধ্যে ওর যখন বেশ নামডাক হয়েছে, তখনই মরিয়ার্টি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিছুদিনের মধ্যেই ও মরিয়ার্টির ডান হাত হয়ে ওঠে। মরিয়ার্টি ওকে প্রচুর টাকাপয়সা দিত। আর খুব দরকার না পড়লে মোরানকে কোনও কাজে লাগাত না। যে-সব কাজ খুব শক্ত, যে-সব কাজ সাধারণ খুনে-গুন্ডাদের দিয়ে হবার নয়, সেই ধরনের কাজের ফয়সালা করতেই মোরানের ডাক পড়ত। আঠারোশো সাতাত্তর সালের মিসেস স্টুয়ার্টের খুনের ব্যাপারটা তোমার মনে আছে কি? বুঝলে ওয়াটসন, আমি জোর গলায় বলতে পারি যে, ওটা মোরানেরই কাজ। তবে কোনও কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। মোরানকে ওরা এমন লুকিয়ে লুকিয়ে রাখত যে মরিয়ার্টির দল যখন ধরা পড়ল তখন মোরানের সঙ্গে মরিয়ার্টির কোনও যোগাযোগই আমরা প্রমাণ করতে পারলাম না। যে-দিন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে তোমার বাড়ি যাই, সে দিনের কথা তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই। সেদিন আমি এয়ারগানের ভয়ে ঘরের সব জানলা বন্ধ করে দিই সে কথাও তুমি ভোলেনি নিশ্চয়ই। সে দিন তোমার মনে হয়েছিল যে, আমি রজ্জুতে সর্পভ্রম করছি। কিন্তু আমি যা করে ছিলাম, তা ভেবেচিন্তেই করে ছিলাম। আমি এয়ারগানের খবর জানতে পেরেছিলাম। আর এয়ারগান যে ছুড়বে, তার নিশানা যে অব্যর্থ তাও আমি জানতাম। আমরা যখন সুইজারল্যান্ডে যাই তখন মরিয়ার্টির সঙ্গে মোরানও আমাদের ধাওয়া করেছিল। আর রাইখেনবাখ জলপ্রপাতে মরিয়ার্টির মৃত্যুর পর ও-ই যে আমাকে পাথর চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সে ব্যাপারে আমার মনে অন্তত কোনও সন্দেহই নেই।

“তারপর আমি যখন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রান্সে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আমি রোজ খবরের কাগজ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে ওর কার্যকলাপের দিকে নজর রাখতাম। যত দিন এই লোকটি লন্ডন শহরে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করবে তত দিন আমার বেঁচে থাকাটাই একটা সমস্যা হয়ে থাকবে। দুষ্টগ্রহের মতো ও আমাকে সব সময় তাড়া করে ফিরবে। আর চেষ্টা করতে করতে একদিন হয়তো ও আমাকে খতম করে দেবে। উলটো দিকে আমার সমস্যা হল, আমি কী করব? আমি তো আর ওকে মেরে ফেলতে পারি না। তাতে লাভের মধ্যে লাভ হবে এই যে, আমিই ফাঁসিকাঠে ঝুলব। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরবার করেও লাভ নেই। কারণ আমার কথা সব সত্যি হলেও সেগুলোকে অন্যের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলবার মতো কোনও প্রমাণ আমার হাতে নেই। সাধারণ ভাবে লোকের মনে হতে পারে যে, এ সবই আমার নিছক সন্দেহ। যাকে ফ্যাক্ট বলে তা তো নয়। তাই আমার দিক থেকে ঠিক তখনই করবার কিছুই ছিল না। গা-ঢাকা দিয়ে আমি শুধু অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি যেখানে যত অপরাধমূলক কাজ-কারবার হচ্ছে তার খবর জোগাড় করতে লাগলাম। আমি জানতাম যে, আজই হোক আর কালই হোক ধরে আমি ওকে ফেলবই। এই রকম যখন অবস্থা তখন রবার্ট অ্যাডেয়ার খুন হল। এতদিন ধরে যে-সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম, সে সুযোগ এল। আমি বুঝতে পারলাম যে এই খুন কর্নেল মোরান ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। মোরান অ্যাডেয়ারের সঙ্গে ক্লাবে তাস খেলেছিল। ওরা দু’জনে একই সঙ্গে ক্লাব থেকে বেরিয়েছিল। তারপর ও রবার্ট অ্যাডেয়ারকে অনুসরণ করে ওর বাড়ি পর্যন্ত এসেছিল। ও-ই খোলা জানলা দিয়ে গুলি ছুড়ে রবার্টকে খুন করে। ব্যাপারটা যে এই রকমই ঘটেছে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। ওই ঘরের মধ্যে যে-বুলেট পাওয়া গেছে, তার দ্বারাই কর্নেলকে ফঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আমি আর দেরি না করে লন্ডনে ফিরে এলাম। লন্ডনে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর লোকেরা আমাকে দেখে ফেলল। আর আমার আসবার খবরও মোরানকে জানিয়ে দিল। আমার হঠাৎ লন্ডনে ফিরে আসবার কারণ যে কী হতে পারে তা বুঝতে ওর ভুল হল না। আমি এইভাবে হঠাৎ ফিরে আসায় ও যে খুব ভয় পাবে তা আমি জানতাম। আর এ কথাও জানতাম যে, প্রথম সুযোগেই ও আমাকে খুন করার চেষ্টা করবে। আমাকে খুন করবার জন্যে যে ও ওই এয়ারগানটা ব্যবহার করবে তা-ও আমি জানতুম। তাই আমি ওর সুবিধের জন্যে একটা নিশানা রেখে এলাম আমার ঘরের জানলার কাছে। ইতিমধ্যে পুলিশকেও সব কথা জানিয়ে রাখলাম। ভাল কথা ওয়াটসন, আমাদের বাড়ির দরজার কাছে যাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে তুমি সন্দেহে করেছিলে তারা আসলে পুলিশের লোক। পুলিশকে রাস্তায় মোতায়েন করে আমি ঠিক করলাম যে, এই খালি বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সব লক্ষ করব। যে-কথাটা আমার একবারও খেয়াল হয়নি সেটা হল এই যে, মোরান তার কাজ হাসিল করবার জন্যে এইখানেই আসতে পারে। সব ব্যাপারটা হল যাকে বলে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।…ওয়াটসন, আর কিছু ব্যাখ্যা করে বলতে হবে কি?”

আমি বললাম, হ্যাঁ। একটা কথা বুঝলাম না। রবার্ট অ্যাডেয়ারকে মোরান খুন করল কেন? খুনের পেছনে উদ্দেশ্যটা কী?”

“দেখো ওয়াটসন, খুনের ‘মোটিভ’টা আন্দাজ করতে পেরেছি। তবে আন্দাজ করার ক্ষেত্রে অসাধারণ বুদ্ধিমান লোকেরও ভুল হতে পারে। তাই প্রত্যেকেরই এ সম্বন্ধে নিজের নিজের মত থাকতে পারে। আর এই সব ভিন্ন ভিন্ন মতের যে-কোনও একটা ঠিক হতে পারে। আমার মতটাই ঠিক আর তোমারটা ভুল এ কথা জোর করে বলা যাবে না।”

“তা তোমার মতটা কী শুনি।”

“জানা গেছে যে, অ্যাডেয়ার আর মোরান জুটি তাস খেলায় অনেক টাকার বাজি জিতেছিল। মোরান এই খেলার সময় জোচ্চুরি করত, সে কথা আমি জানতাম। আমার মনে হয় সে দিন খেলতে খেলতে মোরানের এই জোচ্চুরি অ্যাডেয়ার কোনও ভাবে টের পেয়ে যায়। খেলার পর দু’জনে যখন ক্লাব থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে আসে তখন অ্যাডেয়ার মোরানকে সরাসরি চেপে ধরে। হয়তো ওকে এই বলে ভয় দেখায় যে, মোরান যদি তাস খেলা আর ক্লাবের সদস্যপদ ছেড়ে না দেয় তো অ্যাডেয়ার এই জালজোচ্চুরির কথা ফাঁস করে দেবে। অ্যাডেয়ার আসলে অত্যন্ত শিক্ষিত সজ্জন ভদ্র যুবক। ওর পক্ষে কোনও বয়স্ক লোককে পাঁচজনের সামনে খোলাখুলি ভাবে চোর বদনাম দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়। তাই এই নিয়ে ও কোনও রকম হইচই করতে চায়নি। অ্যাডেয়ারের কথা শুনে মোরানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাস খেলা বন্ধ হলে ওর সমূহ বিপদ। তাসে লোক ঠকিয়ে পয়সা উপায় করেই এখন ওর দিন চলে। তাই প্রাণের দায়ে ও অ্যাডেয়ারকে খুন করতে বাধ্য হয়। যে-সময় অ্যাডেয়ারকে মোরান খুন করে সেই সময়ে অ্যাডেয়ার যারা খেলায় হেরেছে তাদের তার নিজের ভাগের টাকাটা ফিরিয়ে দেবার জন্যে হিসেব করছিল। পাছে সেই সময় তার মা-বোন এসে পড়ে আর তাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে লোকের নামের তালিকা আর টাকাপয়সা নিয়ে কী করছে তাই অ্যাডেয়ার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল।—কী হে, কথাটা মনে ধরল?”

“তুমি যা বললে তাই হয়েছে বলে মনে হয়।”

“আমার কথা সত্যি কি মিথ্যে তা বিচারের সময় জানা যাবে। যাই হোক মোরান আর আমাদের বিরক্ত করবে না। ইতিমধ্যে ফন হারডারের এই অদ্ভুত এয়ারগান স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিউজিয়মে শোভা পাবে। আর মিঃ শার্লক হোমসও লন্ডন শহরের এই বিচিত্র জনসমারোহের মধ্যে দু’-একটা ছোটখাটো সমস্যার সমাধান বেশ নিশ্চিন্ত ভাবে করতে পারবে।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন