আর্থার কোনান ডয়েল
শার্লক হোমস বলল, “অপরাধ-বিশেষজ্ঞের দিক থেকে যদি দেখো তা হলে তোমাকে মানতেই হবে যে, প্রোফেসর মরিয়ার্টি মারা যাবার পর থেকেই লন্ডন শহরের সব আকর্ষণই নষ্ট হয়ে গেছে।”
আমি বললাম, “শহরের যে হাজার হাজার লোক আইনটাইন মেনে ভদ্র ভাবে বাস করেন, তাঁরা তোমার কথায় সায় দেবেন বলে মনে হয় না।”
চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে উঠতে উঠতে হোমস মুচকি হেসে বলল, “ঠিক আছে, আমি আর স্বার্থপরের মতো কথা বলব না। সমাজের লাভ হয়েছে নিশ্চয়ই। একমাত্র বেকার-বিশেষজ্ঞ ছাড়া আর কারও ক্ষতি হয়নি। শুধু সেই হতভাগ্য বিশেষজ্ঞের আর কিছু করবার রইল না। যতদিন মরিয়ার্টি বেঁচে ছিল প্রতিদিন সকালবেলায় খবরের কাগজ হাতে নিলেই মনে হত একটা কোনও ঘটনা ঘটতে চলেছে। বেশিরভাগ সময়ই খুব সামান্য একটা ব্যাপার বুঝলে ওয়াটসন, অতি সাধারণ একটা ব্যাপার থেকেই আমি টের পেয়ে যেতাম যে, এর পেছনে সেই শয়তানি বুদ্ধি কাজ করছে। বিরাট একটা মাকড়সার জালের একটা সুতো অল্পমাত্র কেঁপে উঠলেই কুৎসিত মাকড়সার হদিস যেমন পাওয়া যায়, মরিয়ার্টির খবরটাও ঠিক তেমনই। সামান্য ছিঁচকে চুরি, ছোটখাটো হাঙ্গামা, ভীষণ মারামারি কোনওটার সঙ্গেই কোনওটার যোগ আছে বলে সাধারণ ভাবে মনে হবে না। তবে রহস্যের সূত্র যার হাতে আছে তার কাছে সব ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার। যে লোক বিজ্ঞানসম্মত ভাবে অপরাধতত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চায়, তার কাছে ক’দিন আগে পর্যন্ত লন্ডনই ছিল যাকে বলে স্বর্গ। এ ব্যাপারে লন্ডনের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজধানীর কোনও তুলনাই হয় না। আর এখন—”
তার কথা শেষ না করে হোমস নাচার ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। হোমসের ঠাট্টা-মশকরার ভাব দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না যে মরিয়ার্টির হাত থেকে লন্ডনবাসীদের উদ্ধার করে সে নিজেও কম খুশি হয়নি।
যে-সময়ের কথা বলছি, হোমস তার মাসকয়েক আগে লন্ডনে ফিরে এসেছে। হোমসের কথায় আমি আমার ডাক্তারি প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিয়ে আবার বেকার স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছি। ভারনার নামে এক ছোকরা ডাক্তার আমার কেনসিংটনের ছোট্ট প্র্যাকটিস বেশ মোটা দামেই কিনে নিয়েছিল। কোনও রকম দরাদরি না করে ওই ছোকরা এককথায় অত দাম দিতে রাজি হওয়ায় আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। পরে অবশ্য ভেতরের কথা টের পাই। ভারনার ছোকরা হোমসের কী রকম যেন আত্মীয়। আর ওই টাকাটা হোমসই ওকে জোগাড় করে দেয়।
হোমস যে-কথাটা একটু আগেই বলছিল সেটা কিন্তু ঠিক নয়। এই ক’মাস আমি যে বেকার হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলাম তা কিন্তু নয়। আমার ডায়েরির পাতা ওলটাতে গিয়ে নজরে পড়ল যে, ওই সময়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মুরিল্লোর কাগজপত্র সংক্রান্ত মামলার দায়িত্ব হোমসকে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়াও আর একটা ঘটনার তদন্তও হোমস এই সময়ে করেছিল। আর এই তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দু’জনেই অল্পের জন্যে বেঁচে যাই। রহস্যটা হল ওলন্দাজ জাহাজ ফ্রিজল্যান্ডকে নিয়ে। হোমসের স্বভাব এমনই যে, ও লোকজনের সঙ্গে বেশি মেশামেশি করা পছন্দ করে না। ওর স্বভাবে খানিকটা অহংকারও আছে। আর তাই ওর রহস্য অনুসন্ধানের সব কথা সাধারণ লোকে জানুক বা তা নিয়ে সবাই হইচই করুক এটা ও ভীষণ রকম অপছন্দ করে। তাই ও আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল যে, ও নিজে থেকে মত না-দেওয়া পর্যন্ত এ সব রহস্যভেদের কথা আমি লিখতে পারব না। কিছু দিন হল হোমস মত দিয়েছে।
হাসি-ঠাট্টার পালা শেষ করে হোমস তার নিজস্ব আরামকেদারায় বেশ করে এলিয়ে বসে তারিয়ে তারিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। এমন সময় সদর দরজার ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠল। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ কানে এল। মনে হল কেউ যেন দরজার পাল্লায় গুম গুম করে কিল মারছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা হট্টগোল আর সিঁড়িতে দুদ্দাড় শব্দ শুনতে পেলাম। কী হচ্ছে বুঝে ওঠবার আগেই এক যুবক ঘরে ঢুকল। যুবকের চোখে-মুখে একটা ভয়ের ভাব ফুটে উঠেছে। মাথার চুল উসকোখুসকো। জামাকাপড় আলুথালু। যুবক ঘরে পা দিয়েই আমাদের দু’জনের দিকে তাকাল। হঠাৎ ওর খেয়াল হল যে, এই ভাবে না বলে-কয়ে দুম করে ঘরে ঢুকে পড়ার জন্যে ওর আমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
যুবক বলল, “মিঃ হোমস, আপনারা আমার অপরাধ নেবেন না। আমার মাথার ঠিক নেই। মিঃ হোমস, আমিই হচ্ছি হতভাগ্য জন হেক্টর ম্যাকফারলেন।”
যুবকটি এমন ভাবে নিজের নাম বলল যে, তাতে মনে হয় ওর নাম শোনামাত্র আমরা ও কেন এসেছে তা বুঝে যাব। হোমসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে ওর অবস্থাও আমার মতো। যুবক যে কেন এসেছে তা ও টের পায়নি।
নিজের সিগারেট-কেসটা এগিয়ে দিয়ে হোমস বলল, “মিঃ ম্যাকফারলেন, আপনি একটা সিগারেট ধরান। আপনার শরীর-মনের যা অবস্থা দেখছি তাতে আমার বন্ধু ডঃ ওয়াটসন নিশ্চয়ই আপনাকে একটা ঘুমের ওষুধ দেবেন। গত কয়েক দিন যা গরম পড়েছে তার জন্যেই বোধহয় আপনার শরীরে জুত নেই। আপনি আগে এই চেয়ারে বসুন। একটু জিরিয়ে নিন। তারপর আপনার সব কথা—কী আপনার পরিচয়, কেনই বা আপনি আমাদের কাছে এসেছেন—আমাদের খুলে বলুন। আপনি আপনার নাম এমন ভাবে বললেন যে মনে হল, নাম শুনেই আমরা আপনাকে চিনতে পারব। কিন্তু বিশ্বাস করুন যে, আপনি অবিবাহিত, আইনজীবী, ফ্রি মেসন দলের সভ্য আর আপনার হাঁপানি আছে, এ ছাড়া আপনার সম্বন্ধে আমি আর কিছুই জানি না।”
শার্লক হোমসের কাজের ধারার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। হোমস যে কেন ওই কথাগুলো বলল তা বুঝতে পারলাম। ম্যাকফারলেনের জামাকাপড় অগোছালো, বগলে একতাড়া আদালতের কাগজ, ঘড়ির ব্যান্ডে ফ্রি মেসন দলের ব্যাজ লাগানো। ও বেশ জোরে জোরে দম নিচ্ছিল। হোমসের কথা শুনে আমাদের মক্কেল তো রীতিমতো হাঁ হয়ে গেল।
“মিঃ হোমস, আপনি যা যা বললেন আমি তাই। আর ঠিক এই মুহূর্তে আমি হচ্ছি লন্ডন শহরের সবচেয়ে দুর্ভাগা লোক। ভগবানের নাম নিয়ে বলছি মিঃ হোমস, আপনি আমাকে বাঁচান। আমার যা বলবার আছে তা আপনাকে সব বলবার আগে ওরা যদি আমাকে গ্রেফতার করতে আসে তো আপনি ওদের বাধা দেবেন। তা না হলে আসল কথা আমার আর বলা হবে না। আপনাকে সব কথা জানাবার পরে যদি পুলিশ আমাকে জেলে পুরে দেয় তো আমার কোনও আক্ষেপ থাকবে না। আমি জানব যে, জেলখানার বাইরে আপনি আমার হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।”
“আপনাকে গ্রেফতার করবে!” হোমস বলে উঠল। “এ তো খুবই আনন্দের—মানে গুরুতর কথা। কীসের জন্যে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করবে বলে মনে করছেন?”
“লোয়ার নরউডের জন ওলডেকারকে খুন করবার অভিযোগে।”
শার্লক হোমসের মুখ দেখে মনে হল যে, ম্যাকফারসনের জন্যে ওর দুঃখ হচ্ছে ঠিকই, তবে হঠাৎ একটা রহস্যের সন্ধান পেয়ে ও মনে মনে খুবই খুশি হয়ে উঠেছে।
“কী কাণ্ড!” হোমস বলল। “একটু আগেই চা খেতে খেতে আমি আমার বন্ধু ডঃ ওয়াটসনকে বলছিলাম যে, আজকাল খবরের কাগজে সে রকম গায়ে-কাঁটা-দেওয়া খবর বড় একটা থাকে না।”
আমাদের মক্কেল কাঁপা কাঁপা হাতে হোমসের কোলের ওপর থেকে ‘ডেলি টেলিগ্রাফ’ কাগজটা তুলে নিল।
“আপনি যদি কাগজটা পড়তেন তো আপনি একনজরে বুঝতে পারতেন যে, আমি কে আর কেনই বা আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার ধারণা হয়েছিল যে, আমার নাম আর আমার বিপদের কথা বোধহয় লোকের মুখে মুখে ফিরছে।” ম্যাকফারলেন কাগজের মাঝখানের পাতাটা বের করে কাগজটা মুড়ে রাখল। তারপর বলল, “খবরটা আমি আপনাদের পড়ে শোনাই। মিঃ হোমস, আপনি দয়া করে শুনুন। কাগজের হেডলাইন হচ্ছে: লোয়ার নরউডে রহস্যজনক ঘটনা। বিখ্যাত এক ঠিকাদার উধাও। খুন করা ও আগুন লাগানো হয়েছে বলে অনুমান। অপরাধীকে শনাক্ত করবার সূত্র পাওয়া গেছে। এই সূত্র ধরেই ওরা এগোচ্ছে আর আমি জানি যে শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকেই গ্রেফতার করবে। লন্ডন ব্রিজ স্টেশন থেকে পুলিশ আমাকে ধাওয়া করেছে। ওরা বোধহয় এখনও গ্রেফতার পরোয়ানাটা জোগাড় করতে পারেনি। সেটা পেলেই ওরা আমাকে ধরবে। এই কথা আমার মায়ের কাছে পৌঁছোলে তিনি যে কী আঘাত পাবেন তা বলতে পারি না। এই দারুণ আঘাত তিনি হয়তো সহ্যই করতেই পারবেন না।” ম্যাকফারলেন চেয়ারে বসে হাত কচলাতে লাগল।
আমি যুবকটিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। যেমন-তেমন নয়, এর বিরুদ্ধে একেবারে মানুষ খুন করার অভিযোগ। ম্যাকফারলেনের চেহারা বেশ ভাল। তবে আহামরি গোছের নয়। নীল চোখদুটো দেখলেই বোঝা যায় যে, ভয়ে একদম আধমরা হয়ে গেছে। দাড়ি-গোঁফ বেশ নিখুঁত ভাবে কামানো, পোশাক ভদ্রলোকের মতো। ওর কোটের পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বেরিয়ে ছিল। সেই কাগজগুলো দেখলেই ও কী কাজ করে যে-কেউ বুঝতে পারবে।
হোমস বলল, “আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। তাই চটপট সব কাজ সেরে ফেলতে হবে। ওয়াটসন, তুমি কি খবরের কাগজ থেকে খবরটা পড়ে শোনাবে?”
আমাদের মক্কেল মোটা হরফে ছাপা হেডলাইনগুলো আমাদের পড়ে শুনিয়ে ছিল। হেডলাইনের নীচে যে খবর ছাপা হয়েছিল সেটা আমি পড়তে লাগলাম:
গত রাত্রে বা আজ খুব ভোরে লোয়ার নরউডে যে দারুণ ঘটনা ঘটে গেছে তা দেখে মনে হয় এটি একটি পরিকল্পিত ক্রাইম। মিঃ জোনাস ওলডেকারকে ওই অঞ্চলের সকলে চেনে। দীর্ঘকাল ওখানে তিনি ঠিকাদারের কাজ করছেন। মিঃ ওলডেকার বিয়ে করেননি। বয়স বাহান্ন বছর। মিঃ ওলডেকার সিডেনহ্যামে ডিপ ডেন স্ট্রিটের শেষ বাড়ি ডিপ ডেন হাউসে থাকেন। ভদ্রলোক বেশ খামখেয়ালি স্বভাবের মানুষ, চুপচাপ থাকেন। কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না। কিছু দিন হল ঠিকাদারির কাজ তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। লোকে বলে ঠিকাদারি করে তিনি বেশ ভাল পয়সাই রোজগার করেছেন। মিঃ ওলডেকারের বাড়ির পেছনের উঠোনে ভাঙাচোরা বেশ কিছু কাঠের পাটা জড়ো করে রাখা আছে। গত রাত্রে বারোটা নাগাদ সেই কাঠের গাদায় আগুন লেগে যায়। আগুন লাগতেই লোকজন হইহই করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে দমকলে খবর দেওয়া হয়। দমকলের লোকরাও তক্ষুনি এসে পড়ে, কিন্তু শুকনো কাঠের গাদায় আগুন হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত দমকলের লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলে। তবে ততক্ষণে সব কাঠ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত পাড়ার লোকেরা ব্যাপারটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা বলেই মনে করেছিল। কিন্তু পরে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যা দেখে মনে হয় যে ব্যাপার রীতিমতো জটিল। প্রথমত আগুন লাগবার পর থেকে ঘটনাস্থলে বাড়ির মালিককে একবারও দেখা যায়নি। এতে সকলেই খুব আশ্চর্য হয়ে যায়। তখন মিঃ ওলডেকারের খোঁজ পড়ে যায়। মিঃ ওলডেকারকে পাওয়া যায়নি। তিনি একদম উধাও হয়ে গেছেন। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা যায় যে, তিনি রাত্রে ঘুমোতে যাননি। ঘরের মধ্যে একটা সিন্দুক ছিল। সিন্দুক খোলা। ঘরের মেঝেতে দরকারি কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে। ঘরের অবস্থা দেখে মনে হল, ঘরের মধ্যে বেশ জোর একচোট ধস্তাধস্তি হয়ে গেছে। ঘরের আসবাবপত্রে রক্তের ছিটে ছিটে দাগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঘরের মধ্যে একটা ওক কাঠের ছড়ি পাওয়া গেছে। ছড়িটার হাতলে রক্তের ছাপ লেগে আছে। খবরে জানা গেছে যে, ওই রাত্রে মিঃ ওলডেকারের সঙ্গে দেখা করতে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। খবরে আরও জানা গেছে যে, ওই লাঠিটি সেই ভদ্রলোকের। ভদ্রলোকের পরিচয়ও জানা গেছে। ভদ্রলোকের নাম জন হেক্টর ম্যাকফারলেন। লন্ডনে আইন ব্যবসা করেন। ৪২৬ নং গ্রেসাম বিলডিংয়ে গ্ৰেহাম আর ম্যাকফারলেন, কোম্পানির যে অফিস আছে তার ছোট অংশীদার এই ভদ্রলোক। পুলিশ বলছে, যে-তথ্য তাদের হাতে আছে তাতে এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য তাদের কাছে পরিষ্কার। যাই হোক না কেন, সব মিলিয়ে রহস্য যে-জমাট বেঁধে উঠেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সংযোজন: অসমর্থিত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে যে, পুলিশ মিঃ জোনাস ওলডেকারকে খুন করার অপরাধে মিঃ জন হেক্টর ম্যাকফারলেনকে গ্রেফতার করেছে। তবে মিঃ ম্যাকফারলেনের নামে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে এ কথা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে নরউডের রহস্য বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। মিঃ ওলডেকারের শোবার ঘরে ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া ছাড়াও জানা গেছে যে, তাঁর শোবার ঘরের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো খোলা ছিল। সেখান দিয়ে মনে হয় ভারী কোনও জিনিস টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জিনিসটা যে কাঠের গাদার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে-প্রমাণও পুলিশ পেয়েছে। ছাইয়ের সঙ্গে পুড়ে যাওয়া কিছু জিনিসও পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা সেই রাত্রে জঘন্য ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। ওলডেকারকে লাঠির আঘাতে খুন করে তার কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে খুনি মৃতদেহ টানতে টানতে কাঠের গাদার কাছে এনে হাজির করে। তারপর আগুন লাগিয়ে দেয়। তার মতলব ছিল যে, আগুনে মৃতদেহ পুড়ে গেলে খুনের ব্যাপারে কোনও প্রমাণ থাকবে না। এই খুনের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দক্ষ গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর লেস্ট্রেডের হাতে।
শার্লক হোমস চোখ বুজে হাতের আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনার কথা শুনল।
তারপর ধীরে-সুস্থে তার নিজস্ব ঢঙে বলল, “আপনার ব্যাপারটায় বেশ নতুনত্ব আছে। কিন্তু একটা কথা—আপনার বিরুদ্ধে যে-সব প্রমাণ রয়েছে সেগুলো খুবই গুরুতর। তা সত্ত্বেও পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করেনি কেন?”
“আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে ব্ল্যাকহিথের টরিংটন লজে থাকি। কাল রাত্রে জোনাস ওলডেকারের সঙ্গে কাজ সারতে অনেক দেরি হয়ে যায়। আমি নরউডেরই একটা হোটেলে রাত কাটাই। সেখান থেকে সকালের ট্রেনে লন্ডনে চলে আসি। আমি কোনও খবরই পাইনি। ট্রেনে খবরের কাগজে ঘটনাটি প্রথম পড়ি। আমি বুঝতে পারি যে, খুব বিপদে পড়ে গেছি। আমি যদি বাড়িতে থাকতাম কি আপিসে যেতাম তা হলে পুলিশ আমাকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলত। লন্ডন ব্রিজ স্টেশন থেকে একটা লোক আমার পিছু নিয়েছে। আমার ধারণা যে-কোনও মুহূর্তে—ওই যে দরজায় কে যেন ঘণ্টা বাজাল।”
দরজায় ঘণ্টা বাজার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িতে দুমদুম করে পা ফেলার শব্দ পেলাম। আর তার পরেই দরজার গোড়ায় লেস্ট্রেডের মুখ দেখতে পেলাম। লেস্ট্রেডের পেছনে দু’জন য়ুনিফর্ম পরা কনস্টেবল।
লেস্ট্রেড বলল, “মিঃ জন হেক্টর ম্যাকফারলেন।”
আমাদের মক্কেল উঠে দাঁড়ালেন। ভয়ে ওঁর মুখ একদম সাদা।
একটু থেমে লেস্ট্রেড বলল, “লোয়ার নরউডের বাসিন্দা মিঃ জোনাস ওলডেকারকে খুন করার অভিযোগে আমি আপনাকে গ্রেফতার করছি।”
ম্যাকফারলেন হতাশ ভাবে আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। বুঝলাম বেচারা খুবই মুষড়ে গেছে।
হোমস বলল, “দেখো লেস্ট্রেড, আধ ঘণ্টার এদিক-ওদিকে মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হবে না। লোয়ার নরউডে যে-ব্যাপার ঘটেছে ভদ্রলোক সেই বিষয়েই কথা বলতে আমাদের কাছে এসেছেন। আমার মনে হয়, ওঁর কথা শুনলে ব্যাপারটার ফয়সালা করা সহজ হবে।”
লেস্ট্রেড গম্ভীর ভাবে বলল, “ব্যাপারটার ফয়সালা করতে এমনিতেই বিশেষ কোনও কষ্ট করতে হবে না।”
“তা হতে পারে। তবে তোমার অনুমতি নিয়ে আমি ভদ্রলোকের কাছ থেকে সব কথা শুনতে চাই।”
লেস্ট্রেড বলল, “তাই হোক। আপনার কথা ঠেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি দু’-একটা মামলায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে খুব সাহায্য করেছেন। তাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। তবে হ্যাঁ একটা কথা। আমি কিন্তু হাজির থাকব। আর ইনি যা বলবেন তা কিন্তু ওঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হবে।”
আমাদের মক্কেল বলল, “আমি রাজি। আমি শুধু চাই যে আমার সব কথা আপনারা শুনুন আর আসল ব্যাপার যা হয়েছে তা বুঝুন।” লেস্ট্রেড নিজের হাতঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “আমি কিন্তু আধ ঘণ্টার বেশি সময় দিতে পারব না।”
ম্যাকফারলেন বলল, “গোড়াতেই একটা কথা আপনাদের কাছে পরিষ্কার করে বলা দরকার। আমি মিঃ জোনাস ওলডেকারের সম্বন্ধে কিছুই জানি না। ওঁর নাম আমার শোনা ছিল। বহু বছর আগে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে ওঁর পরিচয় ছিল। তারপর অবশ্য আর কোনও যোগাযোগ ছিল না। তাই কাল বিকেলে তিনটে নাগাদ উনি যখন হঠাৎ আমার অফিসে এসে হাজির হলেন, আমি তখন রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে তিনি যখন তাঁর আসার কারণটা আমাকে খুলে বললেন, তখন আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম। ওঁর হাতে একগাদা কাগজপত্র ছিল। সেই কাগজগুলোয় টুকরো টুকরো অনেক লেখা ছিল। ভদ্রলোক কাগজের তাড়া আমার টেবিলের ওপর রাখলেন। এই যে সেই কাগজ।
“উনি বললেন, ‘এই হল আমার খসড়া উইল। মিঃ ম্যাকফারলেন, আমি চাই যে আপনি আইন-মোতাবেক আমার উইলটা তৈরি করে দিন। আমি এখানে বসছি।’
“আমি উইল তৈরি করতে লেগে গেলাম। আপনারা নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারবেন যে, আমি কী সাংঘাতিক রকমের অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম যে, ভদ্রলোক তাঁর সম্পত্তির সামান্য কিছু অংশ বাদে সবই আমাকে দান করে দিচ্ছেন। ভদ্রলোকের ধরনধারণ সবই অদ্ভুত। ছোটখাটো চেহারা, চোখের পক্ষ্ম সব সাদা। লিখতে লিখতে দু’-একবার মাথা তুলতে নজর করলাম যে, ভদ্রলোক একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন হাসি হাসি মুখে। মনে হল তিনি যেন বেশ রসিয়ে রসিয়ে মজা উপভোগ করছেন। উইলটা পড়ে আমি এতই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম যে, ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। উনি আমাকে বললেন যে, উনি বিয়ে করেননি। নিজের বলতে ওঁর কেউ নেই। উনি অল্প বয়সে আমার বাবা-মাকে চিনতেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে উনি জানতে পেরেছেন যে, আমি খুব ভাল ছেলে। আমাকে যদি উনি ওঁর বিষয়আশয় দিয়ে যান তো তা আমি উড়িয়ে দেব না। ওঁর এই সব কথা শুনে আমি তো ঢোক গিলে তোতলাতে তোতলাতে আমার কৃতজ্ঞতা ওঁকে জানালাম। যাই হোক, উইল তৈরি হয়ে গেল। সই করা হল। সাক্ষী হলেন আমার অফিসের কেরানি। এই নীল কাগজটাই হল সেই দলিল আর এই সাদা কাগজগুলো মিঃ ওলডেকারের খসড়া। দলিলের কাজ শেষ হয়ে গেলে উনি আমাকে বললেন যে, এ-ছাড়া আরও কিছু কাগজপত্র ওঁর আছে। সেগুলো বেশির ভাগই জমির দলিল বা বন্ধকির দলিল। সেই কাগজগুলো আমার নাকি একবার ভাল করে দেখে বুঝে নেওয়া দরকার। উনি বার বার বলতে লাগলেন যে, যতক্ষণ না আমি কাগজগুলো সব দেখব, ততক্ষণ উনি শান্তি পাবেন না। সেই জন্য উনি আমাকে বিশেষ করে বললেন যে, আমি যেন অবশ্যই সেই রাত্রে নরউডে ওঁর বাড়িতে যাই। যাবার সময় আমাকে উইলটাও উনি নিয়ে যেতে বলেন। ‘তবে শোনো বাপু, সবকিছু যতক্ষণ না চুকেবুকে যাচ্ছে ততক্ষণ তোমার বাবা-মার কাছে এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য কোরো না। সব মিটে গেলে আমরা ওঁদের একদম অবাক করে দেব।’ এই কথাটা তিনি বার বার বলতে লাগলেন। শেষকালে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে, আমি সব ব্যাপারটা গোপন রাখব।
“মিঃ হোমস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, ঠিক সেই সময়ে ওই ভদ্রলোকের কথায় সায় না দিয়ে আমার কোনও উপায় ছিল না। উনি আমার এত উপকার করছেন আর আমি ওঁর এই সামান্য আবদারটুকু রাখব না? তাই আমি টেলিগ্রাম করে বাড়িতে খবর দিয়ে দিলাম যে, রাত্রে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। কত দেরি হবে বলতে পারি না। মিঃ ওলডেকার বলে ছিলেন যে, রাত্রি ন’টা নাগাদ আমি যেন তার বাড়ি যাই। কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ওঁর ন’টা বাজবে। আমরা একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। ওঁর বাড়ি খুঁজে পেতে আমার একটু অসুবিধে হয়েছিল। যখন ওঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম তখন সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। আমি দেখলাম—”
“এক মিনিট।” ম্যাকফারলেনকে বাধা দিয়ে হোমস বলল, “আপনাকে সদর দরজা খুলে দিয়েছিল কে?”
‘একজন মাঝবয়সি স্ত্রীলোক। আমার মনে হয় ওই স্ত্রীলোকটি ঘরসংসারের কাজকর্ম করে।”
“ওই স্ত্রীলোকটি বোদহয় আপনিই ম্যাকফারলেন কিনা জানতে চেয়েছিল?”
“আপনি ঠিক বলেছেন তো?”
“ঠিক আছে, আপনি বলুন।”
ম্যাকফারলেন কপালের ঘাম মুছে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল। স্ত্রীলোকটি আমাকে বসবার ঘরে নিয়ে গেল। সেই ঘরে টেবিলের ওপর খাবার সাজানো ছিল। সাদামাটা সব রান্না। খাওয়াদাওয়ার পর মিঃ ওলডেকার আমাকে তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে একটা সিন্দুক ছিল। উনি সিন্দুক খুলে একগাদা দলির বের করে আমাকে দেখাতে লাগলেন। কাগজপত্র দেখা যখন শেষ হল তখন এগারোটা অনেকক্ষণ বেজে গেছে। বারোটা বাজতে বেশি দেরি নেই। উনি বললেন যে, এত রাত্রে কাজের ওই স্ত্রীলোকটিকে জাগানো ঠিক হবে না। উনি আমাকে ওঁর ঘরের ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটা দেখিয়ে দিলেন। সেটা খোলাই ছিল।”
“ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পরদাটা কি ফেলা ছিল?” হোমস জানতে চাইল।
“সেটা পরিষ্কার মনে নেই। তবে মনে হয় যে, পরদা অর্ধেক ফেলা ছিল। হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে বটে। আমি যখন যাচ্ছিলাম উনি পরদাটা গুটিয়ে দিয়েছিলেন। আমি আমার লাঠিটা পাচ্ছিলাম না। উনি বললেন, “লাঠির জন্যে ব্যস্ত হোয়ো না; এখন আমাদের ঘন ঘন দেখাশোনা হবে। আমি তোমার লাঠি খুব যত্ন করে রেখে দেব। এর পরের বার যখন আসবে তখন ওটা নিয়ে নিয়ো, কেমন?” মিঃ ওলডেকারের কাছ থেকে আমি চলে এলাম। আমি যখন চলে আসি তখন ওলডেকার ওই ঘরেই ছিলেন। ওঁর সিন্দুক খোলা ছিল। আর ওঁর সব দলিল-দস্তাবেজ টেবিলের ওপর বান্ডিল করে করে গুছিয়ে রাখা ছিল। মিঃ ওলডেকারের কাছ থেকে যখন আমি বেরোলাম তখন ব্ল্যাকহিথ যাবার আর কোনও উপায় নেই। তাই আমি ‘অ্যানারলি আরমস’ হোটেলে রাতটা থেকে গেলাম। তারপর ট্রেনে খবরের কাগজ পড়বার আগে আমি এ ব্যাপারটার কিছুই জানতাম না।”
ম্যাকফারলেনের কথা শুনতে শুনতে লক্ষ করছিলাম যে লেস্ট্রেডের ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। এতক্ষণে ও প্রথম কথা বলল। “মিঃ হোমস, আপনি আর কিছু জানতে চান কি?”
“যতক্ষণ না ব্ল্যাকহিথ থেকে ঘুরে আসছি ততক্ষণ আমার কিছু জানবার নেই।”
লেস্ট্রেড বলল, “আপনি নরউডে যাবার কথা বলছেন নিশ্চয়ই।”
“হ্যাঁ, আমি নরউড়ে যাবার কথাই ভাবছিলাম।” হোমস মুচকি হেসে বলল। ওর মুখ দেখে কিছু বুঝবার উপায় নেই। লেস্ট্রেড মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে জানে যে, হোমসের অতি ক্ষুরধার বুদ্ধি, অনেক জটিল রহস্যের জাল অতি সহজেই ছিঁড়ে ফেলে খাঁটি কথাটা টের পেতে পারে যার হদিস করা তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। লক্ষ করলাম, লেস্ট্রেড হোমসের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে।
“মিঃ হোমস, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে,” লেস্ট্রেড বলল। তার পরেই ম্যাকফারলেনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মিঃ ম্যাকফারলেন, দরজার কাছে দু’জন সিপাই দাঁড়িয়ে আছে। নীচে একটা চার-চাকার গাড়ি আপনার জন্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।”
বেচারা ম্যাকফারলেন আমাদের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে গেল। লেস্ট্রেডের সঙ্গে যে-দু’জন ইন্সপেক্টর এসেছিল, তারা ম্যাকফারলেনকে নিয়ে চলে গেল। লেস্ট্রেড ঘরে থেকে গেল।
হোমস উইলের খসড়াটা তুলে নিল। তারপর প্রত্যেকটা পাতা খুব ভাল করে দেখতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ দেখবার পর কাগজগুলো লেস্ট্রেডের দিকে এগিয়ে দিয়ে হোমস বলল, “খসড়ার কাগজগুলো খুব ইন্টারেস্টিং। লেস্ট্রেড ভাল করে দেখো।”
লেস্ট্রেড অবাক হয়ে হোমসের দিকে তাকাল।
“আমি প্রথম পাতার প্রথম লাইনগুলো পড়তে পারছি। দ্বিতীয় পাতার মাঝের কয়েক লাইন পড়া যাচ্ছে। শেষ পাতার এই কয়েকটা লাইন তো দিব্যি ছাপার মতো পরিষ্কার লেখা। কিন্তু বাকি লেখাগুলো তো কিছুই পড়তে পারছি না। হাতের লেখাটা জায়গায় জায়গায় এত খারাপ যে, একটা অক্ষরও বোঝা যাচ্ছে না।”
হোমস বলল, “এর থেকে কিছু বুঝতে পারলে কি?”
“আপনি নিজে কিছু বুঝতে পেরেছেন কি?” লেস্ট্রেডের বলার ধরনে একটা ব্যঙ্গের ভাব ছিল, তা আমার কান এড়াল না।
“এই খসড়াটা করা হয়েছিল ট্রেনে বসে। গাড়িটা যখন স্টেশনে দাঁড়িয়েছে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যখন ট্রেনটা চলছিল তখন লেখাটা খারাপ হয়েছে। যখন ট্রেনটা পয়েন্টের, মানে যে-জায়গায় দুটো লাইন মিশেছে বা যেখান থেকে দুটো লাইন আলাদা হয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে গেছে তখন ঝাঁকুনি বেশি হওয়ায় হাতের লেখা এখন যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ হয়ে গেছে। তুমি যদি এই ব্যাপারে কোনও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলো তা হলে জানতে পারবে যে, এই খসড়া সাবার্বান লাইনে বসে লেখা হয়েছে। কেন না লন্ডন শহরের রেললাইনে যত পয়েন্ট আছে তত বেশি পয়েন্ট বোধহয় আর কোথাও নেই। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, এই খসড়াটা নরউড থেকে লন্ডনে আসার সময়টুকুর মধ্যেই করা হয়েছে, তা হলে বলা যায় যে, ভদ্রলোক এক্সপ্রেস ট্রেনে লন্ডনে এসেছিলেন। আর ট্রেনটা নরউড থেকে লন্ডনে আসবার মধ্যে একবার মাত্র থেমেছিল।”
হোমসের কথা শুনে লেস্ট্রেড হো হো করে হেসে উঠল। “হোমস, আপনি যখন কোনও একটা ব্যাপারে আপনার থিয়োরি—অর্থাৎ আপনার বিশেষ ভাবনার কথা খুলে বলেন তখন সত্যিই আমি কিছু বুঝতে পারি না।… এ ব্যাপারের সঙ্গে এ-সব কথার যোগাযোগ কী?”
“এইটে অন্তত জানা যাচ্ছে যে, এই ভদ্রলোক সত্যি কথাই বলেছেন। লন্ডনে আসবার পথেই জোনাস ওলডেকার তাঁর সম্পত্তির ‘উইল’-এর খসড়া তৈরি করেছিলেন। উইলের মতো দরকারি একটা কাগজ এই রকম দায়সারা ভাবে লেখাটা একটু অদ্ভুত নয় কি? এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, এই সম্পত্তি দেওয়ার ব্যাপারে ওলডেকার কোনও গুরুত্বই দেননি। এ রকম কাজ একটা তখনই করতে পারেন যখন তিনি জানেন যে, এই উইলটার কোনও দামই নেই।”
“ভাল কথা। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে ওলডেকার কি নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেননি?” লেস্ট্রেড বলল।
“ও। আপনার কি তাই মনে হয়েছে?”
“আপনি মনে করেন না?”
“তা হয়তো হতে পারে। তবে কেসটা আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়।”
“স্পষ্ট নয়? এই কেসটা যদি স্পষ্ট না হয় তবে এর চাইতে স্পষ্ট কেস আর কী হতে পারে? একজন অল্পবয়সি ছোকরা হঠাৎ জানতে পারল যে, একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক মারা গেলে প্রচুর সম্পত্তি তার হাতে আসবে। সে কী করল? এ ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গ সে কাউকে জানাল না। একটা ছুতো করে সে রাত্তিরবেলা সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে গোপনে দেখা করবার ব্যবস্থা করল। তারপর বাড়িতে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ছাড়া অন্য যে থাকে সে শুয়ে না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেলে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে তাঁরই ঘরে খুন করে কাঠের গাদায় আগুন লাগিয়ে লাশটা পুড়িয়ে ফেলে কাছাকাছি একটা হোটেলে গিয়ে রাত কাটিয়ে দিল। ঘরে আর লাঠির হাতলে রক্তের যে দাগ পাওয়া গেছে, তা খুবই অস্পষ্ট। ছোকরা হয়তো ভেবেছিল কোনও রকম রক্তারক্তি না করেই সে হয়তো বৃদ্ধকে সাবাড় করে ফেলতে পারবে। আর মৃতদেহটা যদি পুড়িয়ে ফেলতে পারা যায় তো কে আর তাকে সন্দেহ করবে? এ সব কি জলের মতো সোজা নয়, মিঃ হোমস?”
হোমস বলল, “দেখুন, লেস্ট্রেড, আমার মনে হচ্ছে সব ব্যাপারটা বড্ড বেশি রকম সোজা। আমি জানি যে, আপনি মোটেই কল্পনাপ্রবণ মানুষ নন। কিন্তু যদি আপনি ওই ছোকরার অবস্থায় পড়তেন তা হলে কল্পনা করে দেখুন আপনি কী করতেন। যে-দিন আপনাকে উইল করে সব সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হল, সেই রাত্রেই আপনি কি সম্পত্তির মালিককে খুন করতেন? দুটো ঘটনা পর পর ঘটলে যে-কোনও ভাবেই হোক পুলিশ আপনাকে সন্দেহ করত। তা ছাড়া আপনি কি লোক জানিয়ে খুন করতেন? বাড়ির কাজের লোক আপনাকে সদর দরজা খুলে দিয়েছে। আপনি যে বাড়িতে আছেন সে কথাও কাজের লোকটি জানে। এরকম অবস্থায় আপনি কি সেই বাড়ির মালিককে খুন করবেন? তার পরেরটাও ভাবুন। আপনি মৃতদেহটা গায়েব করবার সব রকম চেষ্টা করলেন, অথচ আপনার ছড়িটা ঘরের ভেতরে এমন ভাবে ফেলে গেলেন যাতে আপনাকে অত্যন্ত সহজেই খুনি বলে শনাক্ত করা যায়। লেস্ট্রেড, আমি স্বীকার করছি যে, ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, বরং খুবই ধোঁয়াটে।”
“ছড়িটার কথা যদি বলেন মিঃ হোমস, আমি বলব যে, অপরাধীরা উত্তেজনার ঝোঁকে এমন ভুল প্রায়ই করে ফেলে, যা সাধারণ কেউই করে না। আমার ধারণা যে, ওই ঘরে ফিরে যাবার মতো মনের জোর ছোকরার আর ছিল না। সে কথা থাক। আপনি কি অন্য কোনও ভাবে যা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা করতে পারেন?”
“একটা কেন? আমি এক্ষুনি আপনাকে আধ ডজন ব্যাখ্যা দিতে পারি,” হোমস বলল। “একটা ব্যাখ্যা আপনাকে আমি উপহার দিচ্ছি। এটা খুবই সঙ্গত ব্যাখ্যা। বৃদ্ধ লোকটি নিশ্চয়ই দামি কোনও জিনিস মিঃ ম্যাকফারলেনকে দেখাচ্ছিলেন। ঘরের পরদা তোলা ছিল। রাস্তা দিয়ে সেই সময়ে উটকো কোনও লোক যাচ্ছিল। হঠাৎ তার নজর পড়ল ঘরের ভেতরে। মিঃ ম্যাকফারলেন চলে গেলেন আর সঙ্গে সঙ্গে সেই উটকো লোকটা ঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই ছড়িটা সে দেখতে পেল। ছড়িটার এক ঘায়ে সে বৃদ্ধকে খতম করে তার মৃতদেহটা আগুনে পুড়িয়ে দিল।”
চুপ করে একটু ভেবে নিয়ে লেস্ট্রেড বলল, “কিন্তু সেই উটকো লোকটা মৃতদেহটা পোড়াতে যাবে কেন?”
“তা যদি বলেন তা ম্যাকফারলেনই বা কেন মৃতদেহটা পোড়াবে?”
“প্রমাণ লোপাট করবার জন্যে।”
“সম্ভবত উটকো লোকটাও মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয় যাতে খুনের ব্যাপারটা কারও চোখে না পড়ে।”
“কিন্তু উটকো লোকটা কিছু নিল না কেন?”
“বেশির ভাগই তো দলিল বা হ্যান্ডনোট। ওসব নিয়ে সে কী করবে?”
লেস্ট্রেড মাথা নাড়তে লাগল। তবে আমার মনে হল যে, হোমসের কথায় ও বেশ ভাবনায় পড়ে গেছে।
“ঠিক আছে মিঃ হোমস, আপনি আপনার সেই উটকো লোকটার খোঁজ করতে থাকুন। আমি ততক্ষণ আমার হাতের লোকটাকে ধরে থাকি। ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে কে ঠিক আর কে ভুল। তবে একটা কথা বিবেচনা করুন মিঃ হোমস। ওলডেকার খুন হলেন কিন্তু কোনও কাগজপত্র হারাল না, চুরি হল না। যে-লোকটাকে আমি গ্রেফতার করেছি সেই একমাত্র লোক যার দিক থেকে চুরি না-হওয়াটা সব চাইতে লাভজনক। কেন না এ সবকিছুরই মালিক তো সে নিজেই।”
লেস্ট্রেডের কথায় হোমস কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল।
“আমাদের হাতে যে-তথ্য আছে তাতে আপনার ধারণাটা যে মিথ্যে সে কথা আমি বলছি না। আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই যে, ঘটনাটাকে অন্য ভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। তবে আপনি যা বললেন সেই কথাটাই সত্যি। ভবিষ্যৎই বলে দেবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আচ্ছা, এখন আর আপনাকে আটকাব না। কোনও এক সময়ে আমি নরউডে গিয়ে হাজির হব। তখন জানতে পারব আপনার তদন্ত কেমন এগোচ্ছে।”
লেস্ট্রেড চলে গেল। হোমস বাইরে বেরোবার জন্যে তৈরি হতে লাগল। ওর চনমনে ভাব দেখে বুঝতে পারলাম, মনের মতো একটা কাজ পেয়ে ও বেজায় খুশি।
কোট পরতে পরতে হোমস বলল, “বুঝলে ওয়াটসন, আমার প্রথম গন্তব্যস্থান হল ব্ল্যাকহিথ।”
“সে কী! তুমি নরউডে যাবে না?”
“না। এই কেসটা যদি ভাল করে দেখো তো দেখবে যে, পর পর দুটো খুব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ভুল হচ্ছে কোথায় জানো? ওরা দ্বিতীয় ঘটনাটার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। দ্বিতীয় ঘটনাটা একটা অপরাধমূলক ঘটনা বলেই ওটার ওপর পুলিশের নজর পড়েছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই রহস্যের জট খুলতে গেলে আমাদের আগে প্রথম ঘটনাটার তাৎপর্য বুঝতে হবে। হঠাৎ এই ভাবে এ রকম একটা উদ্ভট উইল করার মানে কী? এমনও হতে পারে যে, প্রথম ঘটনাটা ঘটেছে বলেই দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল। না ওয়াটসন, এই তদন্তে ঠিক এই মুহূর্তে তোমার কিছু করবার নেই। কোনও বিপদের আশঙ্কাই নেই। থাকলে তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে আমি ঘর থেকে বার হতাম না। মনে হচ্ছে সন্ধে নাগাদ ফিরে এসে ম্যাকফারলেনের জন্যে কতটা কী করতে পারলাম তার একটা হিসেব দিতে পারব। বেচারা আমাদের ওপর বিশ্বাস করে বসে আছে।”
হোমস ফিরে এল অনেক দেরিতে। হোমসের দিকে তাকাতে আমি বুঝতে পারলাম যে, সে বেশ দমে গেছে। সকালে হোমসের চোখে-মুখে যে খুশির ভাব ছিল এখন সেটা আর নেই। বুঝলাম যে ওর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। হোমস ঘণ্টাখানেক বেহালা বাজাল। তারপর এক সময়ে বেহালা তুলে রেখে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
“ওয়াটসন, সবটাই ভুল হয়েছে। ব্যাপারটা আগাপাশতলা কিছুই ধরতে পারিনি। লেস্ট্রেডের কাছে আমি স্বীকার করিনি বটে, তবে মনে হচ্ছে যে, এই একবার বোধহয় লেস্ট্রেড ঠিক রাস্তায় এগিয়েছে। আমি ভুল করেছি। আমার বুদ্ধি এক কথা বলছে, কিন্তু আমার হাতে যা প্রমাণ রয়েছে তা অন্য কথা বলছে। ম্যাকফারলেন যে নির্দোষ সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহই নেই। অথচ এই কথাটা লোককে বোঝাবার মতো কোনও তথ্য আমার হাতে নেই। ব্রিটিশ জুরিরা যে রকম বুদ্ধিমান তাতে যে তারা লেস্ট্রেডের প্রমাণকে খারিজ করে আমার মতকে মেনে নেবে সে বিশ্বাস আমার নেই।”
“তুমি কি শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাকহিথে গিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। আমি ব্ল্যাকহিথে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রথমেই যে খবরটা পাই সেটা হল যে, ওলডেকার লোকটা ছিল পাজির পা-ঝাড়া। আমাদের মক্কেলের বাবা তাঁর ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িতে মক্কেলের মা ছিলেন। ছোটখাটো গোলগাল ভদ্রমহিলা। ওঁর নীল রঙের চোখদুটি ভারী সুন্দর। উনি খুব জোর গলায় বললেন যে, তাঁর ছেলে এ কাজ করতে পারে না। তবে ওলডেকার যে ওই ভাবে আগুনে পুড়ে মারা গেছে সে কথা শুনে ওঁর মনে কোনও কষ্ট হয়েছে বলে মনে হল না। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, খবরটা শুনে ভদ্রমহিলা মোটেই অবাক হলেন না। উলটে ওলডেকারের সম্বন্ধে তিনি এমন সব কথা বলতে লাগলেন যা পুলিশের কানে গেলে পুলিশের পক্ষে ম্যাকফারলেনকে দোষী প্রমাণ করার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। ম্যাকফারলেন যদি ওর মায়ের মুখ থেকে ওলডেকারের সম্পর্কে ওই সব মন্তব্য শুনে থাকে তো ওর পক্ষে ওলডেকারকে খুন করাটা খুবই স্বাভাবিক। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ওলডেকার মানুষ নয়। মানুষের শরীরে একটা শয়তান। যেমন ধূর্ত তেমনই পাজি। ছেলেবেলা থেকেই ওর নষ্টামির পরিচয় সবাই পেয়েছে।’
“এই কথা শুনে আমি ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি তা হলে ওকে ছেলেবেলা থেকেই চিনতেন?
‘“হ্যাঁ চিনতাম বই কী। ভাল করেই চিনতাম। সত্যি কথা বলতে কী ওর সঙ্গে একবার আমার বিয়ের কথা হয়েছিল। আমার ওপর ভগবানের অশেষ দয়া বলতে হবে যে, শেষ পর্যন্ত যার সঙ্গে আমার বিয়ে হল সে গরিব হলেও খুব ভাল মানুষ। ওর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেল কেন জানেন? যখন বিয়ের কথাবার্তা চলছে তখন একদিন আমি শুনলাম যে, একটা পাখির খাঁচার মধ্যে ও একটা বেড়াল ছেড়ে দিয়েছে। ওর এই নিষ্ঠুর কাজের কথা শুনেই আমি ঠিক করে ফেলি যে, ওই লোককে কিছুতেই বিয়ে করব না।’
“এরপর ভদ্রমহিলা আমাকে একটা ছবি দেখালেন। ছবিটা এক অল্পবয়সি ভদ্রমহিলার। ছবির ভদ্রমহিলার মুখ ধারালো ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে কাটা।”
‘“এটা আমার তখনকার একটা ছবি। আমার সঙ্গে বিয়ে হবে না জেনে আমার বিয়ের দিন উপহার হিসেবে ও ছবিটা এই ভাবে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়।’
“আমি বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত ওলডেকারের স্বভাব-চরিত্র বোধহয় বদলে গিয়েছিল। পুরনো দিনের রাগটাগ পড়ে গিয়েছিল। আর সেইজন্যে তাঁর সব সম্পত্তি তিনি আপনার ছেলেকে দিয়ে গেছেন।’
“ভদ্রমহিলা বেশ জোর গলায় আমাকে বললেন, ‘জোনাস ওলডেকার বেঁচে থাকুক বা না থাকুক ওর সম্পত্তির কানাকড়িও আমি বা আমার ছেলে ছুঁতে চাই না। মিঃ হোমস, আমাদের মাথার ওপর ভগবান আছেন। ওলডেকারের মতো পাজি লোককে তিনি অবশ্যই শাস্তি দেবেন আর আমার ছেলে যে সম্পূর্ণ নির্দোষ তাও তিনিই প্রমাণ করে দেবেন।”
“ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি অন্য দু’-চার জায়গায় একটু খোঁজখবর করতে লাগলাম। কিন্তু এমন কোনও খবরই পেলাম না যার দ্বারা আমাদের থিয়োরিটা প্রমাণ করতে পারা যায়। উলটে যে-সব খবর পেলাম তা সবই আমাদের মক্কেলের বিরুদ্ধে যায়। শেষকালে একরকম হাল ছেড়ে দিয়েই, বলতে পারো, আমি ওখান থেকে চলে গেলাম নরউডে।
“ডিপ ডেন হাউস হাল ফ্যাশানের কেতাদুরস্ত বড় বাড়ি। বাড়ির সামনে মস্ত লন। লনে গাছপালা আছে। বাড়ির ডান দিকে রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরে সেই কাঠের গুদাম। এই দেখো আমার নোটবইতে আমি বাড়িটার একটা কাজ-চলা-গোছের নকশা করে এনেছি। এই যে ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটা দেখছ এটাই ওলডেকারের ঘরের জানলা। এটা খোলা ছিল। তুমি বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই রাস্তা থেকে এই জানলাটা পরিষ্কার দেখা যায়। আজ সারা দিন ঘোরাঘুরি করে এইটুকুই যা ভাল খবর আমি জোগাড় করতে পেরেছি। লেস্ট্রেড ওখানে ছিল না। ওর একজন হেড কনস্টেবল সবকিছু দেখাশোনা করছে। ওদের হাবভাব দেখে আমার মনে হচ্ছিল ওরা যেন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। সারা সকাল ধরে ওরা ছাইয়ের গাদায় খোঁজাখুঁজি করে যা পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কতকগুলো বোতাম। বোতামগুলো আমি দেখেছি। বোতামগুলো পুড়ে গেছে। তবে ভাল করে দেখতে দেখলাম যে, বোতামের গায়ে লেখা রয়েছে হায়ামস। এই হায়ামসের দোকান থেকেই ওলডেকার তাঁর জামাকাপড় তৈরি করতেন। বলতে ভুলে গেছি, বোতামগুলো প্যান্টের। এরপর আমি লনটা পরীক্ষা করতে লাগলাম। পরীক্ষা করে নতুন কিছুই জানতে পারলাম না। যেখান দিয়ে একটা ভারী মোট বা কোনও মানুষকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে—সে জায়গাটা দেখলাম। এ পর্যন্ত যা সূত্র আমার চোখে পড়েছে তা কিন্তু লেস্ট্রেডের ধারণাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করে। এই অগাস্ট মাসের গরমে সারা দুপুর রোদে পুড়ে লনের প্রতি ইঞ্চি মাটি আমি চষে ফেললাম, কিন্তু কোনও লাভই হল না।
“এই পণ্ডশ্রমের পর আমি ওলডেকারের শোবার ঘরে গেলাম। ঘরের মধ্যে রক্তের ছিটে লেগে আছে। জল দিয়ে রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বটে, তবে দাগগুলো যে খুব হালের তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ছড়িটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছড়িটাতেও রক্তের দাগ আছে। ছড়িটা যে আমাদের মক্কেলের তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ছড়িটা যে ওর সে কথা ম্যাকফারলেন নিজেই স্বীকার করেছে। ঘরের মেঝের কার্পেটে দু’জন লোকের পায়ের দাগ আছে। তৃতীয় কোনও ব্যক্তির পায়ের ছাপ নেই। এটাও পুলিশের পক্ষে একটা খুব বড় প্রমাণ। বুঝলে ওয়াটসন, এই মামলায় পুলিশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর আমরা? যেখানে ছিলাম সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আলোর একটিমাত্র ক্ষীণ রেখা নজরে পড়ছে। তা শেষ পর্যন্ত সেটা আলো না আলেয়া কী দাঁড়াবে বলতে পারছি না। সিন্দুকের জিনিসপত্রগুলো আমি খুব খুঁটিয়ে দেখলাম। ওগুলো অবশ্য সিন্দুক থেকে বের করে টেবিলের ওপর বেশ ভাল করে গুছিয়ে রাখা ছিল। বেশির ভাগই সিলমোহর-করা খাম। দু’-একটা খাম মনে হয় পুলিশ খুলেছিল। খোলা খামের থেকে কাগজগুলো বের করে নিয়ে পড়লাম। পড়ে মনে হল যে, কাগজগুলো নেহাতই বাজে কাগজ। কোনও দামই নেই। মিঃ ওলডেকারের ব্যাঙ্কের পাশবইটা টেবিলে ছিল। পাশবইটা উলটেপালটে দেখলাম। ওলডেকার যে মোটামুটি সম্পন্ন লোক, তা মনে হল না। দেখেশুনে আমার মনে হল ওলডেকারের সব কাগজপত্র ওখানে নেই। কয়েকটা দলিলে হুন্ডির কথা লেখা ছিল। কিন্তু সে কাগজগুলো কই? এই খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটা যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি তবে লেস্ট্রেডের যুক্তিকে কাটান দেওয়া যাবে। যে-লোক অল্প দিনের মধ্যেই সবকিছুর মালিক হবে সে কি সেই জিনিস চুরি করতে যাবে?
“যাই হোক শেষ পর্যন্ত সব দিক দিয়ে তদন্ত করেও আমি যখন কোনও সূত্র পেলাম না তখন ঠিক করলাম যে, ওলডেকারের বাড়িতে যে-স্ত্রীলোকটি কাজ করত তার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। আমার কেমন মনে হল যে, ইচ্ছে করলে ও হয়তো কিছু নতুন খবর দিতে পারে। কিন্তু কথা কইতে গিয়ে দেখলাম মহিলা একেবারে কাঠের পুতুলের মতো। মহিলা স্বীকার করল যে, রাত্রি সাড়ে ন’টা নাগাদ ও মিঃ ম্যাকফারলেনকে সদর দরজা খুলে দিয়েছিল। ‘ওহ্ সদর দরজা খুলে দেবার আগে আমার হাতে কেন পক্ষাঘাত হল না!’ ও আমাকে বলল। তারপর সাড়ে দশটার সময় ও শুয়ে পড়ে। ওর ঘর বাড়ির একদম পেছন দিকে। তাই পরে যা ঘটেছে তার কিছুই ও টের পায়নি। ওর যত দূর মনে আছে তাতে মিঃ ম্যাকফারলেন, তাঁর টুপি ও ছড়ি হলঘরে রেখে গিয়েছিলেন। এরপর ‘আগুন’, ‘আগুন’ চিৎকার শুনে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ওর দৃঢ় বিশ্বাস যে, ওর মনিবকে কেউ খুন করেছে। মিঃ ওলডেকারের কি কোনও শত্রু ছিল? আমি জানতে চাইলাম। তার উত্তরে ও বলল, ‘সব মানুষেরই কোনও-না-কোনও শত্রু থাকে। তবে মিঃ ওলডেকার বাইরের লোকের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতেন না। ওঁর কাছে যারা আসত তারা কাজের জন্যেই আসত। বোতামগুলো দেখে ও চিনতে পারল। মিঃ ওলডেকার রাত্তিরবেলায় যে পোশাক পরেছিলেন তাতেই এই বোতামগুলো লাগানো ছিল। গত মাসখানেকের মধ্যে একছিটে বৃষ্টিও হয়নি। শুকনো কাঠ একেবারে জ্বালানি হয়েই ছিল। আগুন লাগতেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ও যখন কাঠগুদামের কাছে গিয়ে পৌঁছোয় তখন আগুন চার পাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। জ্বলন্ত আগুন থেকে মাংস পোড়ার গন্ধ বেরোচ্ছিল। শুধু এই মহিলাই নয়, ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরাও সেই উৎকট গন্ধ পেয়েছিল। মিঃ ওলডেকারের দলিলটলিল কি টাকাকড়ির কোনও খবর ও জানে না।
“এই হচ্ছে, ওয়াটসন, আমার আজকের সারা দিনের কাজের হিসেব। দেখছ তো কোথাও এতটুকু সুবিধে করতে পারিনি। সবই ব্যর্থ। কিন্তু তা হলেও,” হোমস শূন্যে হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “আমি নিশ্চিত ভাবে জানি যে, পুলিশের ধারণা ভুল। আমার শরীরের প্রতি কণা দিয়ে আমি বুঝতে পারছি যে, ম্যাকফারলেন ছোকরা সত্যিই নির্দোষ। ভেতরের সব কথা পুলিশ জানতে পারেনি। আর সে কথা ওই কাজের লোকটি জানে। ওর ধূর্ত চোখে আমি এমন একটা ভাব দেখেছি, যা একমাত্র অপরাধীর চোখেই দেখা যায়। যাই হোক, এই ব্যাপারে বেশি কথা বলে কোনও লাভ নেই। ভাগ্যদেবী যদি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দিকে মুখ তুলে না তাকান তো ওলডেকার নিখোঁজ হওয়ার রহস্যটা তোমার খাতায় আমার ব্যর্থতার কাহিনী হিসেবেই থাকবে। আর তার ফলে সাধারণ পাঠককে তোমার লেখাটি আর কষ্ট করে পড়তে হবে না।”
আমি বললাম, “কিন্তু ম্যাকফারলেনের চেহারা দেখে জুরিদের মন হয়তো একটু নরম হতেও পারে।”
“তুমি তো সাঙঘাতিক কথা বলছ ওয়াটসন। বার্ট স্টিভেন্সকে তোমার মনে আছে? ১৮৮৭ সালে লোকটা অনেকগুলো খুনের দায়ে ধরা পড়ে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল যাতে আমরা ওকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে পারি। ও রকম শান্ত, সৌম্য চেহারার লোককে দেখলে কি খুনি বলে মনে হয়?”
“সে কথা অবশ্য ঠিক।”
“না হে, না। অন্য কোনও ভাবে এই রহস্যের সমাধান না করতে পারলে আমাদের মক্কেলের বাঁচবার কোনও রাস্তাই নেই। ওর বিরুদ্ধে পুলিশ যে-সব অভিযোগ এনেছে সেগুলো কোনও ভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সব চেয়ে মুশকিল হচ্ছে যে, যে-সব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে তা সবই ছোকরার বিপক্ষে যাচ্ছে।…ভাল কথা, তোমাকে একটু আগে ওলডেকারের কাগজপত্তরের কথা বলছিলাম। ওই কাগজপত্তরের সঙ্গে ওলডেকারের ব্যাঙ্কের পাশবইটাও ছিল। ব্যাঙ্কের পাশবইয়ের পাতায় চোখ বোলাতে গিয়ে একটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে। আমার মনে হচ্ছে, যে, ওই সূত্রটা ধরে এগোলে আমরা হয়তো নতুন একটা পথের সন্ধান পেতে পারি। আর তা হলে ম্যাকফারলেন ছোকরাকে হয়তো বাঁচানো যেতে পারবে। ব্যাঙ্কের খাতায় দেখলাম গত বছর মিঃ কর্নেলিয়াস বলে একজনকে অনেক টাকা ওলডেকার দিয়েছেন। একবার নয়, খেপে খেপে চেক কেটে টাকা দেওয়া হয়েছে। আর তার ফলে ওলডেকারের জমানো টাকার বেশ মোটা অংশটাই খরচ হয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে, এই কর্নেলিয়াস লোকটি কে? তার সঙ্গে ওলডেকারের কী সম্পর্ক? কেন ওলডেকার তাকে অত টাকা দিয়েছিল? এমন হতে পারে যে, এই কর্নেলিয়াস শেয়ার বাজারে দালালি করে। কিন্তু ওলডেকার যে অনেক টাকার শেয়ার কিনেছিল তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্য কোনও ভাবে কর্নেলিয়াসের হদিস না পাওয়া যায় তো আমাকে ব্যাঙ্কের শরণাপন্ন হতে হবে। ব্যাঙ্ক হয়তো কোনও খবর দিতে পারবে। তবে এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে লেস্ট্রেডই জিতে যাবে। বেচারা ম্যাকফারলেনকে হয়তো ফাঁসিকাঠেই ঝুলতে হবে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তো জাঁকে ফেটে পড়বে।”
গত রাতে শার্লক হোমস দু’চোখের পাতা এক করেছিল কিনা জানি না। সকালবেলা আমি চায়ের টেবিলে এসে দেখি হোমসের চেহারা আরও শুকিয়ে গেছে। মুখ শুকনো। চোখ বসে গেছে। গভীর ভেতর থেকে চোখের তারাদুটো শুধু অস্বাভাবিক দীপ্তিতে ঝকঝক করছে। হোমস যে চেয়ারে বসে ছিল তার চারপাশে অসংখ্য সিগারেটের টুকরো ছড়ানো। সামনের টেবিলে খবরের কাগজগুলো রয়েছে, আর তার পাশেই একটা খোলা টেলিগ্রাম।
হোমস টেলিগ্রামটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “কী বুঝছ বলো দেখি ওয়াটসন?” দেখলাম টেলিগ্রামটা এসেছে নরউড থেকে। টেলিগ্রামটা পড়লাম।
“নতুন গুরুতর প্রমাণ হাতে এসেছে। ম্যাকফারলেন যে দোষী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। আমার মনে হয় এই তদন্ত নিয়ে আপনার আর না এগোনোই ভাল।— লেস্ট্রেড।”
টেলিগ্রামটা দেখে নিয়ে আমি বললাম, “ব্যাপার বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ। লেস্ট্রেড তার সাফল্যের খবরটা কায়দা করে জানিয়েছে।” হোমস হেসে বলল। “তবুও এখনই তদন্ত বন্ধ করে দেওয়াটা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যাই বলো না কেন, নতুন তথ্য হল ছুরি। এমনও হতে পারে যে, এই নতুন তথ্য হয়তো কেসটাকে নতুন দিকে ঘুরিয়ে দেবে। আর সেটা যে লেস্ট্রেডের পক্ষে তা কি জোর করে কেউ বলতে পারে! ওয়াটসন, চটপট খেয়ে নাও। চলো আমরা গিয়ে একবার দেখে আসি কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। আমার মনে হচ্ছে আজ তোমার সাহায্যের দরকার হবে।”
হোমস কিছুই খেল না। হোমসের এই এক অভ্যেস। তদন্তের সময় যখনই কোনও জটিল সমস্যা দেখা দেয়, হোমস তখন খাওয়াদাওয়া একদম ছেড়ে দেয়। এমনও হয়েছে যে, এই ভাবে উপোষ করতে করতে দু’-একবার অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে গেছে। ডাক্তার হিসেবে আমি ওকে বহু বার বলেছি যে, এতে শরীরের ক্ষতি হয়। আর হোমস বলে যে, যখন কোনও জটিল সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় তখন ও শরীরের একবিন্দু ক্ষমতাও বাজে খরচ করতে চায় না। হজম করতে গেলে নাকি অনেকটা শারীরিক ক্ষমতার বাজে খরচ হয়। সেই জন্যে ও যখন ব্রেকফাস্ট না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল, তখন আমি মোটেই আশ্চর্য হলাম না। নরউডে পৌঁছে ‘ডিপডেন হাউস’ খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। বাড়িটার চার পাশে তখনও কিছু কৌতুহলী লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। মফস্সলের বাগানবাড়ি যেমন হয় এ বাড়িটা সেই রকমের। গেটের কাছে লেস্ট্রেড দাঁড়িয়ে ছিল। সাফল্যের আনন্দে ওর চোখ-মুখ চকচক করছে।
“কী মিঃ হোমস, আপনি কি এবারেও আমাদের তদন্ত যে ভুল রাস্তায় এগিয়েছে তা প্রমাণ করতে পেরেছেন? আপনার সেই ‘উটকো’ লোকটির হদিস মিলল কি?”
হোমস বলল, “আমি এখন পর্যন্ত কোনও রকম সিদ্ধান্তেই পৌঁছোতে পারিনি।”
“কিন্তু আমরা ও কাজটা গত কালই করে ফেলেছিলাম। আর আজ প্রমাণ হয়ে গেছে যে, আমাদের সিদ্ধান্তই ঠিক। তা হলে এই রহস্যের সমাধানে আমরা আপনার চেয়ে খানিকটা এগিয়ে আছি, কী বলেন মিঃ হোমস?”
“আপনার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে সাঙঘাতিক রকমের কিছু-একটা ঘটেছে?”
হোমসের কথায় লেস্ট্রেড হো হো করে হেসে উঠল।
“দেখছি আর পাঁচজনের মতো আপনিও হার মেনে নিতে চান না। কিন্তু কী আর করা যাবে? প্রতি বারই যে আপনি জিতবেন আর অন্য লোক হারবে তা কি হয়? আপনি কী বলেন ডঃ ওয়াটসন? যাই হোক, এখন আপনারা যদি অনুগ্রহ করে এ দিকে আসেন তো আমি আপনাদের দেখিয়ে দেব যে, ম্যাকফারলেন ছোকরা ছাড়া অন্য কেউই এ কাজ করেনি।”
লেস্ট্রেড একটা বারান্দা দিয়ে আমাদের নিয়ে এল অন্ধকার একটা হলঘরে।
“খুন করে ম্যাকফারলেন ছোকরা তার টুপিটা নিতে নিশ্চয়ই এ দিকে এসেছিল,” লেস্ট্রেড বলল, “এবার এই দিকে দেখুন।” হঠাৎ বেশ নাটকীয় ভাবে লেস্ট্রেড ফস করে একটা দেশলাই জ্বালাল। দেশলাইয়ের আলোয় দেওয়ালের এক জায়গায় রক্তের দাগ নজরে পড়ল। দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি লেস্ট্রেড ওই দাগের কাছে নিয়ে গেল। দূর থেকে অল্প আলোয় যা দেখিনি সেটা দেখতে পেলাম। এ রক্তের দাগ নয়। একটা রক্তমাখা বুড়োআঙুলের ছাপ। বেশ পরিষ্কার ছাপ।
“মিঃ হোমস, ছাপটা আপনার ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভাল করে দেখুন।”
“হ্যাঁ। আমি দেখছি।”
“আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন যে, দুটো বুড়োআঙুলের ছাপ কখনও এক রকম হয় না।”
“হ্যাঁ, ওই রকম একটা কথা আমিও শুনেছি বটে।”
“তা হলে আপনি কি এই দেওয়ালের ছাপের সঙ্গে এই ছাপটা মিলিয়ে দেখবেন? এই ছাপটা ম্যাকফারলেনের বুড়োআঙুলের ছাপ। আমারই নির্দেশে আজ সকালে মোমের ওপর ম্যাকফারলেনের বুড়োআঙুলের এই ছাপ নেওয়া হয়েছে।”
লেস্ট্রেড ম্যাকফারলেনের বুড়োআঙুলের ছাপটা দেওয়ালের ছাপের পাশে রাখল। আমার কাছে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছিল না। কিন্তু খালি চোখে দেখেই আমার বুঝতে অসুবিধে হল না যে, এই ছাপদুটো একই আঙুলের। আমার মনে হল যে আমাদের মক্কেলকে বোধহয় আর বাঁচানো গেল না।
লেস্ট্রেড বলল, “এই এক প্রমাণেই সব শেষ।”
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে উঠলাম, “হ্যাঁ, সব শেষ।”
হোমস বলল, “হ্যাঁ, সব শেষ হয়ে গেল।”
হোমস যে ভাবে কথাটা বলল তাতে আমার মনে খটকা লাগল। আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর মুখের চেহারাটাই সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ওর চোখ-মুখ থেকে একটা চাপা খুশির ভাব ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। ওর চোখের তারাদুটো আকাশের তারার মতো ঝকঝক করছিল। আমার মনে হল হাসির দমকে ওর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাজার চেষ্টা করেও হোমস কিছুতেই হাসি চাপতে পারছে না।
শেষকালে হোমস আর পারল না। “উফ্…ওহো, কী কাণ্ড।…ওহ্, ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত এই রকম দাঁড়াবে তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? সত্যি, আমাদের চোখের দেখাটা যে কী মারাত্মক রকমের ভুল তা আজ বুঝে গেলাম। ওহ্, এই রকম সুন্দর, শান্ত একজন যুবক! এর থেকে একটা শিক্ষা পাওয়া গেল। সেটা হল যে আমাদের বিচারবুদ্ধির ওপর খুব আস্থা না রাখাই ভাল। লেস্ট্রেড এ সম্বন্ধে কী বলেন?”
“হ্যাঁ, মিঃ হোমস। আমাদের মধ্যে কারও কারও হামবড়া ভাবটা একটু বেশি,” লেস্ট্রেড একটু হেসে বলল। লোকটার মুরুব্বিয়ানা একেবারে অসহ্য। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে ওর কথার প্রতিবাদ করার কোনও উপায় নেই।
“সত্যি,” হোমস বলল, “একেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তা না হলে দেওয়ালের আংটা থেকে টুপিটা তুলে নিতে গিয়ে ও ছোকরা ওখানেই বা হাত দিতে যাবে কেন? আবার যদি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো তো দেখবে এই ছাপের ব্যাপারটায় অস্বাভাবিক কিছুই নেই। বরং ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক।”
হোমসকে দেখে আমার বুঝতে অসুবিধে হল না যে, মুখে না বললেও যে-কোনও কারণেই হোক ও ভেতরে ভেতরে খুবই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। “ভাল কথা। এই ছাপটা প্রথম কে দেখতে পেয়েছিল?” হোমস লেস্ট্রেডকে জিজ্ঞেস করল।
“মিসেস লেক্সিংটন বলে যে কাজের মেয়েটি আছে সে-ই দেখতে পায়। আর সঙ্গে সঙ্গে রাত্তিরে যে কনস্টেবল বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল তাকে ডেকে এনে ছাপটা দেখায়।”
“কনস্টেবলটি তখন কোথায় ছিল?”
“যে-ঘরে ওলডেকার খুন হয়েছেন সেই ঘরে পাহারা দিচ্ছিল। যাতে কেউ চুপি চুপি এসে কোনও কিছু নিয়ে পালাতে না পারে।”
“কিন্তু গত কাল পুলিশ যখন খোঁজাখুঁজি করেছে তখন এ দাগটা তাদের চোখ এড়িয়ে গেল কী করে?”
“হলটা খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা দরকার বলে বোধ হয়নি। আর তা ছাড়া দেখতেই তো পাচ্ছেন দাগটা দেওয়ালের এমন জায়গায় রয়েছে যে চট করে নজরে পড়ে না।”
“হ্যাঁ, সে কথাটা ঠিক বটে। আচ্ছা দাগটা যে গত কাল দেওয়ালে ছিল এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই তো?”
লেস্ট্রেড এমন ভাবে হোমসের দিকে তাকাল, তাতে মনে হয় ও ভাবছে হোমসের মাথার গোলমাল হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী হোমস এতক্ষণ যে রকম ভাবভঙ্গি করছিল আর তারপর এখন যা বলল তাতে আমি নিজেও রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম।”
লেস্ট্রেড বলল, “মিঃ হোমস, আপনি কি বলতে চাইছেন যে গভীর রাত্তিরে ম্যাকফারলেন জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোরদার করবার জন্যে দেওয়ালে ওই ছাপ দিয়ে গেছে।…আমি চাই যে, হাতের ছাপ সম্বন্ধে কোনও বিশেষজ্ঞ এসে বলুন এটা ম্যাকফারলেনের হাতের ছাপ কিনা।”
“এটা যে ম্যাকফারলেনের হাতের ছাপ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”
“ব্যাস। তবেই তো ব্যাপার চুকে গেল। মিঃ হোমস, আমি কাজের লোক। যখন আমার হাতে সূত্র এল আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম,” লেস্ট্রেড বলল, “আপনার আর কিছু বলার বা জানার থাকলে বসবার ঘরে আসবেন। আমি ওই ঘরে বসে আমার রিপোর্ট তৈরি করছি।”
হোমস এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। তবু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে, ভেতরে ভেতরে ও বোধহয় খুব মজা পাচ্ছে।
“ওয়াটসন, তোমার কি মনে হচ্ছে না যে ব্যাপারটা হয়তো একটু গোলমাল হয়ে গেল? তবে এরই মধ্যে এমন কিছু একটা ইঙ্গিত রয়েছে যেটা হয়তো শেষ পর্যন্ত আমাদের মক্কেলের পক্ষেই যাবে।”
হোমসের কথায় আমার খুব আনন্দ হল। বললাম, “এটা বেশ ভাল কথা। আমি তো ভেবেছিলাম যে, ছেলেটাকে বোধহয় কিছুতেই বাঁচানো যাবে না।”
“না, ওয়াটসন, অত খুশি হোয়ো না। তবে আমাদের বন্ধু লেস্ট্রেড যে প্রমাণের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে সেটার ভেতরেই গলদ রয়েছে।”
“তাই নাকি হোমস! গলদটা কী বলো তো?”
“গলদটা হচ্ছে এই যে, গত কাল আমি যখন হলঘর পরীক্ষা করি তখন ওই জায়গায় কোনও রক্তমাখা বুড়োআঙুলের ছাপ ছিল না। এসো না একটু রোদ পোহাতে পোহাতে বেড়িয়ে আসি।”
হোমসের সঙ্গে আমি বাগানের দিকে গেলাম। মনটা এখন বেশ হালকা লাগছে। তবে মাথাটা বেজায় রকম ঘুলিয়ে গেছে। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। হোমস বাইরে থেকে বাড়ির চারটে দিক বেশ ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। তারপর বাড়ির ভেতরে ঢুকল। এবার সে বাড়ির একতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। বাড়ির বেশির ভাগ ঘরই খালি। আসবাবপত্রও নেই। তবুও হোমস প্রত্যেকটি ঘর খুব ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল। তারপর যখন আমরা ওপরের তলায় বারান্দায় গিয়ে পৌঁছোলাম হোমস তখন আবার ফুর্তিতে চনমন করে উঠল। হঠাৎ তার এই ফুর্তির কোনও কারণই বুঝতে পারলাম না। এই তলার শোবার ঘরগুলোও ফাঁকা।
“ওয়াটসন, আমার মনে হচ্ছে যে, একদিক থেকে এই রহস্যটা সাঙঘাতিক রকমের নতুন। আমার অন্য কোনও তদন্তের সঙ্গে এর তুলনাই চলে না। যাই হোক, চলো লেস্ট্রেডকে ব্যাপারটা বলি। আজ সকালে লেস্ট্রেড আমাদের খুব ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে। আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তো এখন লেস্ট্রেডের ওপরে আমরা শোধ নিতে পারব। ঠিক, ঠিক, এই কায়দা করলেই হবে।”
আমরা যখন হলে এসে পৌঁছোলাম লেস্ট্রেড তখন লিখছিল।
“লেস্ট্রেড, আপনি কি এই রহস্যের সম্বন্ধে আপনার রিপোর্ট লিখছেন?” হোমস প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ, আমি রিপোর্টই লিখছি বটে।”
“কিন্তু এটা রাম না হতেই রামায়ণ হয়ে যাচ্ছে না কি? আমার মনে হচ্ছে যে, আপনি সব তথ্য-প্রমাণ এখনও জোগাড় করতে পারেননি।”
“মিঃ হোমস, আপনি কী বলতে চাইছেন?”
“আমি বলতে চাই যে, এক জন খুব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষাৎ আপনি পাননি।”
“আপনি তাকে হাজির করতে পারেন?”
“চেষ্টা করে দেখতে পারি, হোমস বলল।
“তবে তাই করুন!”
‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা অবশ্যই করব। এখানে আপনার সঙ্গে ক’জন কনস্টেবল আছে?”
“কাছাকাছির মধ্যে তিন জন আছে। আমি হাঁক দিলেই তারা শুনতে পাবে।”
হোমস বলল, “বাহ্, চমৎকার। তাদের সকলের স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খুব ভাল? তারা নিশ্চয়ই প্রয়োজনে খুব জোর চেঁচাতে পারবে?”
‘এদের স্বাস্থ্য যে খুবই ভাল সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। তবে এ ব্যাপারের সঙ্গে তাদের গলায় কী যোগ, তা বুঝতে পারছি না।”
“এ যোগাযোগটা না হয় আমিই আপনাকে পরে বুঝিয়ে দেব। এ ছাড়াও আরও দু’-একটা জিনিস আপনাকে দেখাব। এখন দয়া করে আপনার কনস্টেবলদের এখানে ডাকুন। তারপর আমি আমার কাজ শুরু করব।”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পুলিশ কনস্টেবলরা ঘরে এসে জড়ো হল।
হোমস তাদের বলল, “বাড়ির পেছন দিকে প্রচুর খড় গাদা করা রয়েছে। সেখান থেকে কয়েক আঁটি খড় নিয়ে এসো তো দেখি। যে-সাক্ষীর কথা বলছি তাকে খুঁজে পেতে হলে খড়ের দরকার হয়—ধন্যবাদ, এতেই হবে। ওয়াটসন, তোমার কাছে দেশলাই আছে তো। লেস্ট্রেড আমার সঙ্গে চলুন। আমরা এখন ওপরতলায় যাব।”
আমি তো আগেই বলেছি যে, ওপরতলায় একটা বেশ চওড়া বারান্দা আছে। বারান্দার এক দিকে তিনটে ঘর। ঘর-তিনটেই অবশ্য খালি। হোমস তাদের সকলকে বারান্দার এক কোণে এনে হাজির করল। কনস্টেবলরা হোমসের কাণ্ড দেখে ফিক ফিক করে হাসছিল। লক্ষ করলাম লেস্ট্রেড একদৃষ্টিতে হোমসের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে নানা রকম ভাব ফুটে উঠেছিল। হোমসের কথাবার্তা শুনে ওর মনে হচ্ছিল যে, হয়তো চমকপ্রদ ব্যাপার কিছু ঘটতে চলেছে। আবার খড় নিয়ে এসে হোমস যে-কাণ্ড করছিল তা দেখে ওর মুখে একটা বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছিল। হোমস আমাদের সামনে এমন ভাবে দাঁড়াল যে, অন্য কেউ দেখলে ভাবত যে, একজন জাদুকর যেন আমাদের খেলা দেখাতে যাচ্ছে।
“লেস্ট্রেড, আপনার একজন কনস্টেবলকে দু’বালতি জল আনতে বলুন। আচ্ছা, দেওয়াল থেকে সরিয়ে খড়গুলো এবার ভাল করে বিছিয়ে দাও। বাহ, ঠিক হয়েছে। এইবার শুরু করা যায়।”
লেস্ট্রেডের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছিল।
“মিঃ হোমস, আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করছেন কিনা। আপনি সত্যিই যদি কিছু জানেন তো ভাঁড়ামি না করে সে কথাটা বলে ফেলুন।”
“লেস্ট্রেড, বিশ্বাস করুন আমি যা করছি তার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে, একটু আগে আপনি আমার সম্বন্ধে বেশ কিছু মিঠেকড়া মন্তব্য করে ছিলেন। এখন পাশার দান উলটে গেছে। আমি যদি একটু নাটুকেপনা করেই থাকি, তাতে আপনার রাগ করা উচিত নয়। ওয়াটসন, ওই জানলাটা খুলে দিয়ে খড়ে আগুন লাগিয়ে দাও তো।”
আমি তাই করলাম। হাওয়ায় খড়ে দপ করে আগুন লেগে গেল। গলগল করে ধোঁয়া উঠতে লাগল।
“এইবার দেখা যাক লেস্ট্রেড আপনার সাক্ষীকে আমি হাজির করতে পারি কিনা। সকলে মিলে ‘আগুন, আগুন’ বলে চেঁচিয়ে উঠুন তো। নিন, এক দুই তিন—”
“আগুন।” আমরা সকলে চেঁচিয়ে উঠলাম।
“ধন্যবাদ। আর একবার।”
“আগুন, আগুন।”
“আর এক বার সকলে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে বলুন।”
“আগুন।”
আমার ধারণা আমাদের চিৎকার বোধহয় পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
আমাদের চিৎকার থামবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। বারান্দার একদম শেষ প্রান্তে যেখানটা এতক্ষণ নিরেট দেওয়াল বলে মনে হচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ একটা দরজা দমাস করে খুলে গেল। আর সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ছোটখাটো চেহারার একটা লোক।
“দারুণ হয়েছে।” হোমস একটুও আশ্চর্য হয়েছে বলে মনে হল না। “ওয়াটসন, এক বালতি জল খড়ের ওপর ঢেলে দাও। ঠিক আছে, এতেই হবে। ওহহা…লেস্ট্রেড, আসুন আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন আপনার সেই হারানো সাক্ষী মিঃ জোনাস ওলডেকার।”
লেস্ট্রেড অবাক হয়ে এই আকাশ-থেকে-পড়া আগন্তুকের দিকে তাকিয়েছিল। আর ওলডেকার নিজেও কম অবাক হয়নি। সে চোখ পিটপিট করে আমাদের সবাইকে দেখছিল। লোকটার মুখের দিকে তাকালেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ওর চোখের পাতার লোমগুলো সাদা। চোখের তারা বেড়ালের মতো কটা। মুখের মধ্যে লোভ, শয়তানি, মতলববাজি ফুটে বেরোচ্ছে।
“এ সব কী ব্যাপার”, লেস্ট্রেড এতক্ষণে মুখ খুলল। “আপনি এত দিন কী করছিলেন, আঁ?”
ওলডেকার বোকার মতো হাসল। তবে ও যে-ভাবে এক পা সরে গেল তাতে বুঝলাম যে, লেস্ট্রেডের কথার ধরন দেখে মনে মনে ভয় পেয়েছে।
“আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।”
“কোনও অন্যায় করেননি—বটে? আপনি যে কাণ্ড করেছেন তাতে আর একটু হলেই একজন নিরপরাধ লোকের ফাঁসি হয়ে যেত। এই ভদ্রলোক যদি না এসে পড়তেন তা হলে আপনার মতলব হাসিল হয়ে যেতেও পারত।”
লোকটা লেষ্ট্রেডের কথা শুনে কুঁই কুঁই করতে লাগল।
“না না, আপনি বিশ্বাস করুন ইন্সপেকটর, আমি একটু মজা করছিলাম।”
“ও, আপনি মজা করছিলেন? তবে আপনি নিজে যে খুব বেশি মজা পাবেন তা মনে হচ্ছে না। এই—এঁকে নিয়ে যাও। বাইরের ঘরে বসিয়ে রাখো, আমি একটু পরেই যাচ্ছি।”
ওলডেকারকে এক রকম টানতে টানতে কনস্টেবলরা নিয়ে গেল। ওরা চলে যাবার পর লেস্ট্রেড হোমসকে বলল, “আমি কনস্টেবলদের সামনে বলতে চাইনি, তবে ডঃ ওয়াটসনের সামনে স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, রহস্যের এ রকম অসামান্য সমাধান করতে আপনাকে আগে আর কখনও দেখিনি। অবশ্য কী ভাবে যে এই রহস্যের সমাধান আপনি করলেন তা আমি জানি না। আপনি যে একজন নিরপরাধ লোকের প্রাণ বাঁচালেন তাই নয়, আমাকে কেলেঙ্কারির হাত থেকে রক্ষা করলেন। এ সব কথা জানাজানি হয়ে গেলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হত।”
হোমস হেসে লেস্ট্রেডের পিঠ চাপড়ে দিল।
“না, না, লেস্ট্রেড, আপনার চাকরি নিয়ে টানাটানি হওয়া তো দূরের কথা, আপনার খাতির খুব বেড়ে যাবে। আপনি যে-রিপোর্টটা লিখছিলেন সেটা বদলে নিন, তা হলেই আপনার বড়কর্তারা বুঝবেন যে কী কৌশলে আপনি এই রহস্যের সমাধান করেছেন। আপনার বড়কর্তাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আপনার চোখে ধূলো দেওয়া সহজ নয়।”
“তা হলে আপনি কি বলছেন যে, আমার রিপোর্টে আপনার কথা কিছু লিখব না?”
হোমস বলল, “মোটেই নয়, মোটেই নয়। রহস্যের সমাধান করেই আমার আনন্দ।…তবে হ্যাঁ, দূর ভবিষ্যতে কোনও একদিন আমার একনিষ্ঠ জীবনীকার এই রহস্য সমাধানের ব্যাপারটা তার নিজের মতো করে হয়তো লিখবেন। এখন চলুন তো, ওই ছুঁচোটা যেখানে লুকিয়ে ছিল সেই জায়গাটা দেখে আসি।”
দেওয়ালের গায়ে লুকোনো দরজা দিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম। বারান্দাটার ছ’ফুট আন্দাজ পার্টিশন করা। বাইরে দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট গর্ত কাটা। সেই ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। সেখানে সামান্য কিছু আসবাবপত্র। কিছু খাবারদাবার। জল। খবরের কাগজ আর কিছু বই।”
আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
হোমস বলল, “কনট্রাক্টর হওয়ার এইটেই সুবিধে। কাউকে না জানিয়ে ও নিজেই নিজের গা-ঢাকা দেবার জায়গা ঠিক করে রেখেছিল। অবশ্য ঘরের কাজের মেয়েটি সবকিছুই জানে। লেস্ট্রেড, দেখবেন ও যেন আপনাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে না পারে।”
“আপনার পরামর্শমতো আমি এখনই মিসেস লেক্সিংটনকে আটকাবার জন্যে বলে দিচ্ছি। তার আগে আপনি বলুন তো কী করে এই ঘরটার কথা আপনি জানতে পারলেন।”
“গোড়া থেকেই আমার ধারণা হয়েছিল যে, বাড়ির মালিক ওলডেকার বাড়ির ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে আছে। বাড়িটা ভাল করে ঘুরে দেখতে দেখতে আমি লক্ষ করলাম যে, বাড়ির তিনতলার বারান্দাটা দোতলার বারান্দার চাইতে ছ’-ফুট কম লম্বা। আর তখনই আমি টের পেলাম যে, ওলডেকার বুড়ো কোথায় লুকিয়েছে। আমার মনে হল যে, বাড়িতে আগুন লেগেছে শুনলে ও নিশ্চয়ই ওর চোরাকুঠুরিতে লুকিয়ে বসে থাকতে পারবে না। আমরা অবশ্য সোজাসুজি দরজা ভেঙে ঢুকে ওকে ধরতে পারতাম কিন্তু আমার মনে হল যে, ও যদি নিজে থেকেই ধরা দেয় তো সেটা আরও ভাল হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা সকালবেলায় আপনি আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন, তারও একটা বেশ যোগ্য জবাব দেওয়া গেল—কী বলুন?
“হ্যাঁ, মিঃ হোমস, আমাকে আপনি যাকে বলে মুখের মতো জবাবই দিয়েছেন। কিন্তু লোকটা যে বাড়িতেই গা ঢাকা দিয়ে আছে সেটা আপনি বুঝলেন কী করে?”
“ওই বুড়োআঙুলের ছাপ। লেস্ট্রেড, আপনি আমাকে বলেছিলেন যে, ওই বুড়োআঙুলের ছাপ থেকেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। আপনি কথাটা ঠিকই বলেছিলেন। তবে সমাধানটা আপনি যে ভাবে ভেবেছিলেন সে ভাবে হল না। আমি জানতাম যে আগের দিন ওই দেওয়ালের ওই জায়গায় কোনও রকম ছাপই ছিল না। আপনি তো আমার সঙ্গে আগেও কাজ করেছেন। আপনি তো জানেন যে, এই ধরনের ছোটখাটো ব্যাপারও আমি খুব খুঁটিয়ে নজর করি। আমি হলঘরটা তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেছিলাম। কোনও দাগই আমার চোখে পড়েনি। আর তা হলে দাগটা পড়েছে রাত্তিরবেলায়।”
“কিন্তু ছাপটা ওখানে এল কী করে?”
“খুব সহজেই। ওই সব দলিলপত্রগুলো যখন সিলমোহর করা হচ্ছিল তখন ওলডেকার কায়দা করে ম্যাকফারলেন ছোকরার বুড়োআঙুলের একটা ছাঁচ তুলে নিয়েছিল। আমার মনে হয়, সিলমোহর করার কাজটা ওলডেকার ইচ্ছে করেই ম্যাকফারলেন ছোকরার ওপর দিয়েছিল। আর সব ব্যাপারটা এমন ঘরোয়া ভাবে হয়েছিল যে ম্যাকফারলেন ছোকরার হয়তো কথাটা মনেও নেই। ওই গোপন আস্তানায় বসে থাকতে থাকতে ওলডেকারের মাথায় ওই ছাঁচটা কাজে লাগাবার মতলব আসে। এই রকম একটা প্রমাণ যদি পুলিশের নজরে আনা যায় তবে ম্যাকফারলেনের বাঁচবার আর কোনও রাস্তা থাকবে না। এরপর ওই ছাঁচটা থেকে ওলডেকার আর একটা ছাঁচ তুলে নেয়। তারপর একটা পিন ফুটিয়ে রক্ত বের করে সেই রক্ত ছাঁচটায় লাগিয়ে সেটা দেওয়ালে মেরে দেয়। ওলডেকারের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলে ম্যাকফারলেনের হাতের ছাপ যে পড়ে যাবে তাতে আমার মনে কোনও সন্দেহই নেই।”
“চমৎকার! সত্যিই চমৎকার। এখন সব ব্যাপারাটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু এ রকম পেজোমি ও বুড়োটা করল কেন মিঃ হোমস?”
লেস্ট্রেডকে দেখে আমার খুব মজা লাগছিল। একটু আগেই ও বেশ মুরুব্বিয়ানা করছিল। এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছিল স্কুলের একটা ছেলে যেন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়া বুঝে নিচ্ছে।
“এটার ব্যাখ্যা খুব সোজা। ওলডেকার অত্যন্ত বদ প্রকৃতির লোক। অন্যের ক্ষতি করতে পারলেই ওর আনন্দ। জানেন বোধহয়, এক সময় ম্যাকফারলেনের মায়ের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা হয়েছিল। যে-কোনও কারণেই হোক সে বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়নি। আপনি জানেন না? মিঃ লেস্ট্রেড, আমি তো প্রথমেই আপনাকে ব্ল্যাকহিথে আর পরে নরউডে যেতে বলে ছিলাম। ওই বিয়ে না হওয়ার রাগ ওলডেকার মনে মনে পুষে রেখেছিল। সারা জীবন ধরে ও ভেবেছে কী ভাবে এর প্রতিশোধ নেওয়া যায়। কিন্তু হয় সে কোনও রাস্তা খুঁজে পায়নি, নয়তো কোনও সুযোগ সে পায়নি। কিন্তু গত বছর ওর জীবনে একটা বড় রকমের ধাক্কা লাগে। কেনাবেচার দালালি করতে গিয়ে ও বেশ মোটা টাকা জালিয়াতি করে। ও ঠিক করে যে, ওর পাওনাদারদের ঠকিয়ে ও সরে পড়বে। আর তাই করবার জন্যে ও মিঃ কর্নেলিয়াসের নামে মোটা টাকার চেক কাটে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কর্নেলিয়াস আর ওলডেকার একই ব্যক্তি। এই চেকগুলোর কোনও হদিস করবার সময় পাইনি। তবে খোঁজ করলে দেখা যাবে যে, কোনও ছোটখাটো শহরে কর্নেলিয়াসের অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়েছে। সেই শহরে সকলে ওলডেকারকে কর্নেলিয়াস নামেই চেনে। ওলডেকারের মতলব ছিল সব টাকাটা কর্নেলিয়াসের নামে চালান করে শেষকালে নিজে গা-ঢাকা দেবে।”
“হ্যাঁ, এটা খুবই সম্ভব বটে।”
“শেষকালে এক টিলে দুই পাখি মারবার মতলবটা ওর মাথায় খেলে যায়। যদি এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা যায় যাতে লোকের মনে হয় যে, ম্যাকফারলেনই তাকে খুন করেছে আর ম্যাকফারলেনকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারলে ম্যাকফারলেনের মায়ের ওপর পুরনো রাগের ঝালটাও মেটানো যায় আর কর্নেলিয়াস সেজে গা ঢাকা দেবারও সুবিধে হয়। শয়তানিবুদ্ধির একটা চরম দৃষ্টান্ত। ম্যাকফারলেনকে উইল করে সব সম্পত্তি দিয়ে দেওয়ার এই প্যাঁচটা একবারে অসাধারণ। এতে ম্যাকফারলেনের খুন করবার মোটিভটা বেশ জোরদার হয়ে উঠবে। আর সেই জন্যেই ও ম্যাকফারলনকে ওর সঙ্গে চুপি চুপি দেখা করতে বলেছিল। আর একই উদ্দেশ্যে ও ম্যাকফারলেনের লাঠিটা সরিয়ে ফেলেছিল। লাঠি, রক্তের দাগ, পোড়া বোতাম সবই বেশ এমন সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছিল যাতে ম্যাকফারলেন ছোকরার পক্ষে খালাস পাবার কোনও রাস্তাই না থাকে। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমার নিজেরই সন্দেহ ছিল ম্যাকফারলনকে বাঁচাতে পারব কিনা। ওলডেকার নিজের পাকা ঘুঁটিকে কাঁচিয়ে ফেলল। লোকটা থামতে জানে না। ও যে মতলব ভেঁজেছিল তাতেই ওর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত। কিন্তু ম্যাকফারলনকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার জন্যে ও অতি চালাকি করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনল। চলুন লেস্ট্রেড, আমরা এবার নীচে যাই। ওলডেকারকে দু’-একটা প্রশ্ন করবার আছে।”
শয়তানটা বাইরের ঘরে চেয়ারে বসেছিল। ওর দু’পাশে দু’জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।
“বিশ্বাস করুন ইন্সপেক্টর, আমি স্রেফ মজা করছিলাম। আমি আত্মগোপন করেছিলাম নিছক মজার জন্যে। আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। বিশ্বাস করুন, সত্যি সত্যি যদি ম্যাকফারলেনের বিচার হত তা হলে আমি সব কথা নিজের মুখে কবুল করতাম। এটা একদম ঠাট্টা-তামাশার ব্যাপার। কোনও বদ মতলব নেই।” এই কথাগুলোই ওলডেকার লেস্ট্রেডকে বার বার বলতে লাগল।
লেস্ট্রেড বলল, “এ সব কথা জুরিদের বলবেন। তারা যা করবার করবে। আমরা আপনাকে খুনের অভিযোগে যদি নাও করি খুন করার ষড়যন্ত্র করছিলেন, এই অভিযোগে গ্রেফতার করছি।”
হোমস বলল, “ইতিমধ্যে আপনার পাওনাদাররা যে কর্নেলিয়াসের ব্যাঙ্কের জামানত বাজেয়াপ্ত করে ফেলবে সে বিষয়ে কোনও ভুল নেই।”
হোমসের কথায় ওলডেকার বেশ চমকে গেল। তারপর হোমসের দিকে কটমট করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “যা করেছেন তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। হয়তো একদিন আমার ঋণ শোধের পালা আসবে।”
হোমস হেসে ফেলল। “কিন্তু এখন কিছু দিন তো আপনাকে অন্য ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে বলে আমার মনে হচ্ছে।…ভাল কথা, কাঠের গাদায় আপনার ট্রাউজার্সের সঙ্গে আর কী রেখেছিলেন? মরা কুকুর না খরগোশ? ওহ, আপনি বলবেন না? আপনি কিন্তু আমার সঙ্গে মোটেই ভাল ব্যবহার করলেন না। গোটাদুয়েক খরগোশই যথেষ্ট। ওয়াটসন, এ কাহিনী তুমি যদি লেখো তো খরগোশই লিখো।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন