গ্রিক দোভাষীর বিপদ

আর্থার কোনান ডয়েল

শার্লক হোমসের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। শুধু পরিচয় বললে ভুল বলা হবে। খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয়। কিন্তু এত দিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় সত্ত্বেও হোমস কখনও তার আত্মীয়স্বজনদের কথা বা তার ছেলেবেলার কথা আমাকে বলেনি। নিজের জীবনের সম্বন্ধে হোমসের এই ধরনের মনোভাব, এই উদাসীনতা আমাকে আশ্চর্য করে দিত। শেষকালে এমন হল যে, আমার ধারণা হয়ে গেল হোমস স্বয়ম্ভু। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি মানুষ। আত্মীয়স্বজন নেই, এমনকী নিজের অতীত জীবন বলেও কিছু নেই। এ এমন একজন লোক, যার বুদ্ধি আছে কিন্তু হৃদয় বলে কিছু নেই। এর অসামান্য ধীশক্তি, কিন্তু স্নেহ-মমতা-ভালবাসা খুবই কম। হোমস স্ত্রীলোকদের সব সময় এড়িয়ে চলত। নতুন করে কোনও লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পর্যন্ত করতে চাইত না। আর নিজের কথা কোনও সময়ে তুলতে চাইত না। এই সব দেখেশুনে আমার মনে হয়েছিল যে, ছেলেবেলাতেই হোমস বোধহয় অনাথ হয়ে পড়ে। নিকট আত্মীয় বলতে তার কেউ ছিল না। তাই যখন হঠাৎ একদিন হোমস তার দাদার কথা আমাকে বলল আমি তো একদম তাজ্জব বনে গেলাম।

গ্রীষ্মকাল। একদিন সন্ধেবেলায় আমরা দু’জন বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। গলফ ক্লাব নিয়ে কথা হতে হতে আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে গেল সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ আর খালি চোখে সূর্যের গতিপথের যে-হেরফের আমরা দেখি তা কেন হয়, এই সব কথা। তার থেকে আমরা কখন যে মানুষের ওপর তার বংশের প্রভাব বা কী ভাবে এক-পুরুষ দু’-পুরুষ বাদ দিয়ে বংশগত সাদৃশ্য দেখা দেয়, এই সব ব্যাপার নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছি তা আমাদের খেয়াল ছিল না। কথা হচ্ছিল মানুষের কোনও ক্ষমতা তার নিজের চেষ্টায় বেড়ে ওঠে, নাকি তার সবটাই আসে বংশসূত্রে।

আমি বললাম, “তোমার নিজের কথাটাই ভেবে দেখো না। তোমার নিজের কথা যেটুকু আমায় বলেছ তার থেকে বুঝেছি যে, তোমার এই যে-কোনও ঘটনাকে বিশ্লেষণ বা তার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা—এটা তো তুমি নিজে চেষ্টা করে, পরিশ্রম করে আয়ত্ত করেছ।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হোমস বলল, “খানিকটা অবশ্য তাই বটে। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন পাড়াগাঁয়ের অবস্থাপন্ন লোক। এসব লোকের স্বভাবচরিত্র যে রকম হয় এঁরাও সেই প্রকৃতির লোক ছিলেন। তা হলেও আমি যে এদিকে এসেছি সেটার পেছনেও বংশের কিছু প্রভাব আছে। আমার ঠাকুমা ছিলেন ফরাসি চিত্রকর ভেরনের নিজের বোন। রক্তের নিজের বোন। রক্তের মধ্যে যদি শিল্পকলার দিকে ঝোঁক থাকে তো তার ফলাফল যে কী হতে পারে তা বলা শিবেরও অসাধ্য।”

“কিন্তু তোমার মধ্যে যে বংশের ধারা কাজ করছে তাই বা তুমি জানলে কী করে?”

“তার কারণ হচ্ছে তুমি আমার যে-ক্ষমতার কথা বললে, সে ক্ষমতা আমার ভাই মাইক্রফটেরও আছে। আমার চেয়ে বেশিই আছে।”

এটা বাস্তবিক একটা খবর বটে। ইংল্যান্ডে এ রকম অসাধারণ লোক যদি আরও একজন থেকে থাকে তা হলে পুলিশ বা সাধারণ লোক কেউ তার সন্ধান জানবে না, এটা কী করে সম্ভব? তাই আমি একটু ঘুরিয়ে বললাম যে, এ কথাটা বলা বোধহয় বাড়াবাড়ি হচ্ছে। হোমস আমার কথায় হো হো করে হেসে উঠল।

“দেখো ওয়াটসন”, হোমস বলল, “যারা বিনয়কে সবচেয়ে বড় গুণ বলে মনে করে আমি তাদের দলে নেই। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে যে চলে, সে সবকিছুকেই ঠিক ঠিক ভাবে দেখে। যে-জিনিসটা যে রকম সেটাকে সেই ভাবেই দেখে। তাই নিজের ক্ষমতাকে সে বাড়িয়েও দেখে না, আবার কমিয়েও দেখে না। দুটোই তার কাছে ভুল বিচার বলে মনে হয়। তোমাকে যে আমি বললাম, মাইক্রফটের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমার চাইতে বেশি, তা কিন্তু আমি মোটেই বাড়িয়ে বলিনি। আমি সত্যি কথাই বলেছি।”

“তোমার ভাই কি তোমার চেয়ে বয়সে ছোট না বড়?”

“আমার চেয়ে সাত বছরের বড়।”

“কিন্তু তার নাম-ডাক শুনিনি তো।”

“ওর গণ্ডির মধ্যে ওর খুব নাম।”

“সে গণ্ডিটা কী?”

“ধরো ডাইয়োজিনেস ক্লাবে সবাই ওকে খুব খাতির করে।”

আমি এই ক্লাবের নাম-ধাম কিছুই শুনিনি। আমার মুখ দেখে আমার মনের কথা জানতে হোমসের কোনও অসুবিধেই হয়নি। হোমস পকেট থেকে ঘড়ি বের করল।

“লন্ডনে যত ক্লাব আছে তাদের মধ্যে ডাইয়োজিনেস ক্লাবই হচ্ছে সব চাইতে বেখাপ্পা ধরনের ক্লাব। আর মাইক্রফট হচ্ছে সবচেয়ে বেখাপ্পা রকমের লোক। প্রতি দিন পৌনে পাঁচটা থেকে আটটা বাজতে কুড়ি মিনিট পর্যন্ত ক্লাবে থাকে। এখন ছটা বাজে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে তো চলো একটু বেড়িয়ে আসি। বেড়াবার মতো সন্ধে আজকে। যদি রাজি থাকো তো বলো। দু’-দুটো নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচয় হবে।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা রিজেন্ট সার্কাসের দিকে পা চালালাম।

হোমস বলল, “ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ যে মাইক্রফটের এত প্রচণ্ড ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন সে ডিটেকটিভগিরি করে না। আসলে মাইক্রফটের ধাতে পোষায় না।”

“কিন্তু তুমি যেন বললে…”

“আমি বলেছিলাম, পর্যবেক্ষণ করার আর তার থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা ওর বেশি। তবে ঘরের মধ্যে আরামকেদারায় বসে বসেই যদি ডিটেকটিভের কাজের শুরু আর শেষ দুই-ই হত, তবে আমার দাদাটি সবচাইতে বড় ডিটেকটিভ হতে পারত। কিন্তু ওর নাম করবার বাসনা বা পরিশ্রম করার ক্ষমতা কোনওটাই নেই। এমনই ওর স্বভাব যে নড়াচড়া করা বা একটু কষ্ট করে কোথাও গিয়ে কোনও একটা সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল সেটা পর্যন্ত যাচাই করতে ওর কোনও উৎসাহ নেই। কষ্ট করে নিজের কোনও সিদ্ধান্তকে সত্য প্রমাণ করার চাইতে ও হাসিমুখে স্বীকার করে নেবে যে, ও যা বলেছে তা ভুল। অনেক বার অনেক কুটকচালে সমস্যা নিয়ে আমি মাইক্রফটের সঙ্গে দেখা করেছি। প্রতি বারই ও সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখেছি যে, ও যা বলেছে সেটাই ঠিক। কিন্তু সেই সমাধানকে কোর্টে দাঁড় করাবার জন্যে যে-সব পাথুরে প্রমাণ চাই তা জোগাড় করার মতো ক্ষমতা উৎসাহ বা ধৈর্য কোনওটাই ওর নেই।”

“ও। এটা তা হলে ওঁর পেশা নয়?”

“মোটেই নয়। আমার রুজিরোজগারের উপায়টা মাইক্রফটের কাছে নেহাতই একটা শখের ব্যাপার। ওর অঙ্কে খুব মাথা। ও গভর্নমেন্টের কোনও একটা দফতরের জমা-খরচের হিসেবটিসেব রাখে। পলমলের কাছে একটা বাসা নিয়ে আছে। প্রতি দিন সকালে হেঁটে হেঁটে হোয়াইট হলে যায় আর সন্ধে হলে আবার একই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসে। এ ছাড়া আর কোথাও যায় না। কোনও রকম পরিশ্রম করে না। ব্যায়ামট্যায়াম করাও ওর ধাতে নেই। আপিস আর বাড়ি ছাড়া ও নিয়মিত যায় ডাইয়োজিনেস ক্লাবে। ক্লাবটা আবার ওর বাড়ির ঠিক উলটো দিকে।”

“আমি কিন্তু এই ক্লাবের নাম কখনও শুনিনি।”

“এতে আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, লন্ডন শহরে এমন অনেক লোক আছে যারা লাজুক বলেই হোক বা মানুষের ওপর চটা বলেই হোক, কারও সঙ্গে মেলামেশা করা একদম পছন্দ করে না। কিন্তু তাই বলে তারা যে গদিআঁটা চেয়ারে বসে মাসিকপত্র বা খবরের কাগজ পড়তে ভালবাসে না, তা তো নয়। এই রকমের লোকেদের জন্যে এই ডাইয়োজিনেস ক্লাবের গোড়াপত্তন হয়। লন্ডন শহরের সবচাইতে অসামাজিক আর সবচাইতে কুনো লোকদের জন্যে এই ক্লাব। এদের নিয়ম হচ্ছে কোনও সভ্য অন্য সভ্য কী করছে না করছে সেদিকে নজর দিতে পারবে না। বাইরের লোকেদের বসবার যে-ঘর আছে সে ঘর ছাড়া অন্যত্র কথা বলা যাবে না। তিন বার আইন ভাঙলেই সভ্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। আমার দাদা হচ্ছে যাকে বলে ‘ফাউন্ডার মেম্বার’, যারা ক্লাব করেছে তাদের একজন। ওদের ক্লাবের পরিবেশটা আমার খুব ভাল লাগে।”

হাঁটতে হাঁটতে আমরা পলমল পৌঁছে গেলাম। আমরা সেন্ট জেমসের দিক থেকে আসছিলাম। কার্লটন থেকে একটু এগিয়ে একটা বাড়ির দরজার সামনে হোমস দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আমাকে সাবধান করে দিল আমি যেন চুপ করে থাকি। আমি ঘাড় নাড়লাম। হোমস দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম বিরাট আয়তনের একটা ঘর। সেই ঘরে বেশ কিছু লোক আলাদা আলাদা ভাবে বসে কাগজটাগজ পড়ছে। হোমস আমাকে একটা ছোট ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। ঘরটা পলমলের দিকে। রাস্তাঘাট সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমাকে বসিয়ে হোমস চলে গেল। একটু পরে ফিরে এল। তার সঙ্গে এক ভদ্রলোক। বুঝলাম ইনিই হোমসের দাদা।

মাইক্রফট হোমসের চেহারা শার্লকের চাইতে বড়সড় শক্তসমর্থ। শার্লকের তুলনায় মাইক্রফট বেশ নাদুসনুদুস। ওঁর মুখ খুবই বড়। তবু দেখলেই বোঝা যায় যে, শার্লকের মুখের সঙ্গে ওঁর মুখের বেশ মিল আছে। মাইক্রফটের চোখের চাউনিটা বড় অদ্ভুত। আমি বরাবর দেখছি যে, হোমস যখন খুব গভীর ভাবে চিন্তা করে তখন ওর চোখের চাউনিটা কেমন যেন হয়ে যায়। চোখের রং হয়ে যায় খুব হালকা ছাই ছাই। মাইক্রফটের চোখ দেখলাম স্বাভাবিক অবস্থাতেই ওই রকমের।

মাইক্রফট আমার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল।” আমার মনে হল যে, আমার হাতটা যেন সিলমাছের থাবার মধ্যে আটকে গেছে। “আপনি শার্লকের কথা লেখবার পর থেকে ওর নাম তো লোকের মুখে মুখে ফেরে… ভাল কথা, শার্লক, আমি গত সপ্তাহেই ভেবেছিলাম যে, তুমি ম্যানর হাউসের রহস্য নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে। আমার মনে হচ্ছিল যে, ব্যাপারটা বোধহয় তুমি ঠিক কবজা করতে পারছ না।”

হোমস হেসে বলল, “না, আমি ব্যাপারটার ফয়সালা করে ফেলেছি।”

“অ্যাডমস-ই করেছিল তো?”

“হ্যাঁ। অ্যাডমস-ই সবকিছুর মূলে।”

জানলার ধারে বসতে বসতে মাইক্রফট বললেন, “আমি অবশ্য গোড়া থেকেই জানতাম।” তারপর জানলা দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে তিনি বললেন, “যদি কেউ মানুষের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে জানতে চায় তো এই জায়গায় দাঁড়ালেই তার সব জানা হয়ে যাবে। কত বিচিত্র রকমের চরিত্র সব। …ওই যে লোকদুটি এ দিকে আসছে, ওদের দেখলেই আমার কথা সত্যি কিনা বুঝতে পারবে।”

“ওই বিলিয়ার্ডমার্কার আর ওর ওই সঙ্গীর কথা বলছ তো?”

“ঠিকই। ওই লোকটি সম্বন্ধে কী বলতে পারো?”

দু’জন লোক জানলার ঠিক উলটো দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের এক জনের ওয়েস্ট কোটের পকেটের কাছে খড়ির গুঁড়ো লেগেছিল। এ ছাড়া বিলিয়ার্ডের আর কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না। অন্য লোকটি একটু বেঁটে। রং ময়লা। মাথার টুপিটা পেছনের দিকে হেলানো।

লোকটির হাতে-বগলে বেশ কয়েকটা কাগজের মোড়ক।

শার্লক বলল, “আমার মনে হচ্ছে ভদ্রলোক সেনাবাহিনীতে ছিলেন।”

“হ্যাঁ। অল্প কিছু দিন হল চাকরি থেকে ছাড়া পেয়েছেন।” শার্লকের দাদা বললেন।

“ভদ্রলোক দেখছি কিছু দিন ভারতবর্ষে ছিলেন।”

“উনি নন-কমিশন্‌ড অফিসার।”

শার্লক বলল, “রয়্যাল আর্টলারিতে ছিলেন।”

“ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছেন।”

“কিন্তু ওঁর একটি সন্তান আছে।”

“একটি নয় হে, একের বেশি সন্তান আছে,” মাইক্রফট হেসে হেসে বললেন।

আমি হেসে বললাম, “এটা কি একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

হোমস বলল, “কেন, ভদ্রলোকের চেহারা, হাবভাব, তামাটে গায়ের রং এ সব থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ইনি অল্প দিন হল ভারতবর্ষ থেকে ফিরেছেন আর ইনি সাধারণ সৈন্য নন।”

“উনি যে খুব বেশি দিন চাকরি থেকে ছাড়া পাননি, তা বোঝা যায় ওঁর জুতোর দিকে তাকালে। উনি যে-জুতো পরেছেন ওর নাম হচ্ছে অ্যামুনিশন বুট,” মাইক্রফট বললেন।

“ওঁর হাঁটার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় যে উনি ক্যাভালরিতে ছিলেন না। কিন্তু লক্ষ করলে দেখবে টুপিটা উনি একটু হেলিয়ে পরেছেন। আর ওই ভাবে টুপি পরাই ওঁর অভ্যেস। তার ফলে কপালের একদিকটা রোদে ঝলসে গেছে বেশি। ওঁর চেহারাটি যে রকম গোলগাল, তাতে উনি মিলিটারির ইঞ্জিনিয়ারবাহিনীতে ছিলেন বলেও মনে হয় না। উনি গোলন্দাজবাহিনীতে ছিলেন।”

“তা ছাড়া আরও লক্ষ করবার বিষয় হল, ওঁর পোশাক। কালো পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, ওঁর কেউ আপনজন মারা গেছেন। দেখতেই পাচ্ছ উনি বাজার করে ফিরছেন। তার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন। দেখো, ছেলেদের জন্যেও উনি জিনিস কিনেছেন। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখবে, ওঁর পকেটে একটা ঝুমঝুমি। তাতেই বোঝা যায় যে, একটি ছেলে খুব ছোট। মনে হয় ছেলে হবার অল্প দিন পরেই ওঁর স্ত্রী মারা যান। আরও দেখো, ভদ্রলোকের হাতে একটা ছবির বই। তা হলে আরও একটি ছেলে আছে বলে মনে হয়।”

এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম যে, কেন শার্লক বলেছিল তার দাদা মাইক্রফটের খুঁটিয়ে দেখার ক্ষমতা, বুদ্ধি, বিশ্লেষণ করার শক্তি তার চাইতে বেশি। শার্লক আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। মাইক্রফট একটা কচ্ছপের খোলা দিয়ে তৈরি নস্যির ডিবে থেকে নস্যি বের করে বেশ বড় একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর পকেট থেকে একটা লাল রুমাল বের করে কোটের থেকে নস্যির গুঁড়ো ঝাড়তে লাগলেন।

একটু থেমে মাইক্রফট ফের শুরু করলেন, “তোমার পছন্দসই একটা সমস্যার খবর আমার কাছে আছে। সমস্যাটার মধ্যে বেশ নতুনত্ব আছে। সমস্যাটার সমাধান করার দায়িত্ব আমার ওপর দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দৌড়োদৌড়ি করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তাই সমস্যাটা খানিকটা ওপর ওপর দেখা ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারিনি। তবে এই সমস্যাটা থেকে অনেক ভাবনার খোরাক পেয়েছি। তুমি যদি ব্যাপারটার সম্বন্ধে কৌতূহলী হও…”

“মাইক্রফট, তুমি তো জানোই যে, সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমার ভাল লাগে।”

মাইক্রফট একটা কাগজে খসখস করে লিখেই ঘণ্টার দড়িটা ধরে টানলেন।

মাইক্রফট বললেন, “আমি মিঃ মেলাসকে আসবার জন্যে লিখলাম। মিঃ মেলাস আমার ফ্ল্যাটের ওপরতলায় থাকেন। আমার সঙ্গে মুখচেনা আছে। সেই সুবাদে উনি কথাটা আমাকে বলতে এসেছিলেন। মেলাস জাতিতে গ্রিক। অনেকগুলো ভাষা খুব ভাল ভাবে জানেন। উনি কোর্টে দোভাষীর কাজ করেন। এ ছাড়া যেসব ধনী বিদেশিরা বেড়াতে এসে নর্দাম্বারল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের হোটেলগুলোতে ওঠেন, তাদের গাইডেরও কাজ করেন। আমার মনে হয় ওঁর অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা তোমার ওঁর মুখ থেকেই শোনা উচিত।”

মিনিট পাঁচেক পরে এক বেঁটেখাটো মোটাসোটা ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের জলপাইরঙের গায়ের চামড়া আর কয়লার মতো কুচকুচে চুল দেখলেই বোঝা যায় যে, ওঁর দেশ দক্ষিণ দিকের কোনও অঞ্চলে। তবে ভদ্রলোকের ইংরেজি লেখাপড়া-জানা ইংরেজদের মতো। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি শার্লকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। শার্লক হোমস যে তাঁর সমস্যার কথা শুনতে চেয়েছে, একথা জেনেই ভদ্রলোকের চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করতে লাগল।

“আমার মনে হয় পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করছে না, মোটেই বিশ্বাস করছে না,” ভদ্রলোক খুব দুঃখিত ভাবে বললেন। “যে-হেতু এ রকম ব্যাপার ওরা এর আগে শোনেনি, তাই ওরা এ কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। কিন্তু যতক্ষণ না সেই স্টিকিং প্লাস্টার দিয়ে মুখ-বাঁধা লোকটির কোনও খবর পাচ্ছি, ততক্ষণ আমার মনে শান্তি হচ্ছে না।”

“আপনার সব কথা শোনবার জন্যে আমি অধীর হয়ে উঠছি,” শার্লক হোমস বলল।

মিঃ মেলাস বলতে লাগলেন, “আজকে হল বুধবার… তা হলে এটা হয়েছিল সোমবার রাত্রে। আজ থেকে ঠিক দু’দিন আগে সব ব্যাপারটা ঘটেছে। আমার এই প্রতিবেশী নিশ্চয়ই আপনাদের বলেছেন যে, আমি দোভাষীর কাজ করতে পারি। হয়তো বা সমস্ত য়ুরোপীয় ভাষাতেই কাজ চালাতে পারি। তবে যে-হেতু আমি গ্রিক, তাই গ্রিক ভাষার অনুবাদের কাজেই আমার ডাক পড়ে বেশি। বহু বছর ধরে লন্ডনে আমি হচ্ছি সবচেয়ে নামডাকওয়ালা গ্রিক দোভাষী। লন্ডনের সব হোটেলের মালিকই আমাকে চেনেন।

“আর তার ফলে আমার কাজের কোনও বাঁধাবরাদ্দ সময় নেই। যখন-তখন আমার ডাক পড়ে। কোনও বিদেশি হয়তো হঠাৎ এসে পড়েছেন কী অনেক দেরিতে এসে পৌঁছেছেন, কী হঠাৎ কোনও বিপদে পড়েছেন—ব্যাস, অমনি আমার ডাক এল। আর এ ধরনের ঘটনা দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে-কোনও সময়েই হতে পারে। সেইজন্যে সোমবার রাত্রে মিঃ ল্যাটিমার যখন আমার বাসায় এসে হাজির হলেন তখন আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। মিঃ ল্যাটিমারের বয়স কম। শৌখিন জামাকাপড়। উনি এসে বললেন যে, গাড়ি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। ল্যাটিমার বললেন যে, ওঁর ব্যবসার এক অংশীদার এসেছেন। ভদ্রলোক গ্রিক ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানেন না। সেইজন্যে একজন দোভাষীর খুব দরকার হয়ে পড়েছে। ল্যাটিমারের কথা থেকে বুঝলাম যে, কেনসিংটন থেকে একটু দূরেই ওঁর বাড়ি। মনে হল ভদ্রলোকের খুব তাড়া আছে। রাস্তায় পা দিতে-না-দিতেই উনি আমাকে প্রায় ঠেলে গাড়ির মধ্যে তুলে দিলেন।

“আমাকে তো ঠেলেঠুলে গাড়িতে তুলে দিলেন। গাড়িতে উঠে দেখলাম লন্ডন শহরে যে-ধরনের ভাড়াটে গাড়ি দেখতে পাওয়া যায় এটা সে রকম সাধারণ গাড়ি নয়। বেশ বড় আকারের গাড়ি। বড়লোকেরাই এ রকম গাড়িতে চড়ে। গাড়ির ভেতরের গদিটদি খুব আরামদায়ক, সুন্দর আর দামি, যদিও একটু পুরনো হয়ে গেছে। মিঃ ল্যাটিমার আমার উলটো দিকের সিটে বসলেন। আমাদের নিয়ে গাড়ি চেয়ারিং ক্রস পেরিয়ে শ্যাফ্‌ট্‌স বেরি অ্যাভিনিউয়ের দিকে চলল। আমরা যখন অক্সফোর্ড স্ট্রিটে পৌঁছোলাম তখন আমি বললাম যে আমরা কেনসিংটন যাব যদি তো এত ঘুরে যাচ্ছি কেন? কথাটা শেষ করেই আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

“ল্যাটিমার পকেট থেকে একটা ছোট লাঠি বের করল। লাঠিটার মাথায় একটা লোহার হাতল লাগানো। ল্যাটিমার লাঠিটা দোলাতে লাগল। বোধহয় কী ভাবে আঘাত করলে সবচেয়ে জোরে লাগবে সেটা পরখ করে নিল। তারপর কোনও কথা না বলে লাঠিটা নিজের পাশে রেখে দিল। লাঠিটা রেখে দিয়ে ল্যাটিমার যা করল তাতে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। গাড়ির জানলার কাঁচগুলো তুলে দিল। কাঁচগুলোয় পুরু করে কাগজ লাগানো। বাইরের কিছুই দেখা যায় না।

“ল্যাটিমার বলল, ‘আপনি বাইরের দৃশ্য আর দেখতে পাবেন না বলে আমার নিজের খারাপ লাগছে, মিঃ মেলাস। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা আপনি জেনে ফেলুন তা আমি চাই না। আপনি যদি রাস্তা চিনে চিনে পরে আবার ওখানে এসে হাজির হন তো আমার অসুবিধে হয়ে যেতে পারে।’

“মিঃ হোমস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, ল্যাটিমারের এ কথা শুনে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। একে তো ল্যাটিমারের বয়স আমার চাইতে কম। তার ওপর ওর স্বাস্থ্যও বেশ ভাল, বেশ ষণ্ডামার্কা চেহারা। আমার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র থাকলে আলাদা কথা ছিল। খালি হাতে তো আমি ওর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না।

“আমি থতমত খাওয়া ভাবটাকে যতদূর সম্ভব চেপে রেখে বললাম, ‘মিঃ ল্যাটিমার, আপনার ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আপনি যা করছেন তা শুধু অন্যায়ই নয়, বেআইনিও বটে।’ অবশ্য মিঃ হোমস কথাগুলো বলবার সময় আমার জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি তোতলাচ্ছিলাম।

“‘হ্যাঁ, কাজটা একটু খারাপই হচ্ছে বটে,’ ল্যাটিমার বলল, ‘কিন্তু এর জন্যে আপনাকে পুষিয়ে দেব। তবে একটা ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আজ রাত্তিরে এই নিয়ে আপনি যদি কোনও হইচই বা গণ্ডগোল করেন বা এমন কিছু করেন যাতে আমার স্বার্থে আঘাত লাগে তা হলে কিন্তু আপনার পক্ষে জিনিসটা ভাল হবে না। শুধু একটা কথা আপনাকে মনে রাখতে বলি। আপনি যে কোথায় রয়েছেন, সে কথা কিন্তু কেউ জানে না। আপনি এই গাড়িতেই থাকুন, আর আমার বাড়িতেই থাকুন, আপনি একদম আমার খপ্পরে পড়ে গেছেন।’

“ল্যাটিমার খুব ধীর ভাবে আস্তে আস্তে কথাগুলো বলল, তবে তার বলার ভেতরে এমন একটা চাপা নিষ্ঠুরতা ছিল যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি আর কোনও কথা না বলে চুপ করে বসে রইলাম। আর ভাবতে লাগলাম যে, কেন এ রকম ভাবে আমাকে আমার ঘর থেকে বার করে আনা হল। কিছুই বুঝতে পারলাম না। এটুকু বুঝলাম যে, বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই। এরপর যা যা ঘটবে তা চুপ করে দেখে যাওয়া ছাড়া আমার কিন্তু আর করার কিছু নেই।

“একটানা ঘণ্টা-দুয়েক গাড়ি চলল। কোথায় যে যাচ্ছি তার কোনও হদিস পেলাম না। শুধু গাড়ির চাকার আওয়াজ থেকে বুঝতে পারছিলাম যে, কখনও অ্যাসফল্ট বাঁধানো রাস্তা দিয়ে, আবার কখনও কখনও পাথর বসানো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। শুধুমাত্র গাড়ির চাকার আওয়াজের রকমফের ছাড়া আর এমন কোনও কিছুই টের পেলাম না, যার থেকে আমি কোথায় যাচ্ছি বা কোথায় রয়েছি তা বোঝা যায়। গাড়ির জানলার কাচ আগেই বলেছি, পুরু কাগজে ঢাকা দেওয়া। যেটা বলতে ভুলে গেছি সেটা হল যে, গাড়ির সামনের পেছনের কাঁচে নীল মোটা কাপড়ের পরদা আটকানো ছিল। আমরা পলমল থেকে যখন বার হই, তখন ঘড়ি দেখেছিলাম। সন্ধে সওয়া সাতটা। চলতে চলতে শেষকালে গাড়ি যখন থামল, তখন ঘড়িতে দেখলাম নটা বাজতে মোট দশ মিনিট বাকি। ল্যাটিমার গাড়ির দরজার কাচ নামাতেই একঝলক দেখে নিলাম। গাড়ি দাঁড়িয়েছে একটা নিচু খিলেন দেওয়া দরজার কাছে। খিলেনের মাথায় একটা আলো জ্বলছে। আমি গাড়ি থেকে নামামাত্র বাড়ির দরজা খুলে গেল। কী হচ্ছে বোঝবার আগেই আমাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। আমার যেটুকু মনে আছে তা হল বাড়ির সামনে মাঠ আর মাঠে বড় বড় গাছ। তবে সেটা ওই বাড়িরই হাতা, না বাড়িটা ওই রকম মাঠ আর বড় বড় ঝাড়ালো গাছের মধ্যে, তা আমি বলতে পারব না।

“বাড়ির মধ্যে একটা রঙিন গ্যাসবাতি খুব মিটমিট করে জ্বলছিল। সেই কম আলোতে আমি দেখলাম বেশ বড় আকারের একটা হলঘর। হলঘরের দেওয়ালে ছবি টাঙানো। সেই অল্প আলোতে যে লোকটি দরজা খুলে দিয়েছিল তাকে দেখলাম। মাঝবয়সি লোক। লম্বা নয়। কাঁধটা বেশ পুরুষ্টু। মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় অত্যন্ত নীচ, পাজি লোক। লোকটি আমার দিকে তাকাতে দেখলাম ওর চোখে চশমা।

“‘হ্যারল্ড, ইনিই কি মিঃ মেলাস?’ লোকটি জানতে চাইল।

“‘হ্যাঁ।’

“‘বাহ্, বাহ্। খুব ভাল। খুব ভাল। মিঃ মেলাস, আমাদের ওপর রাগ করবেন না। আপনাকে ছাড়া কিছুতেই আমাদের চলবে না। যদি আপনি আমাদের সঙ্গে সাধাসিধে ব্যবহার করেন তো আপনি ঠকবেন না। কিন্তু যদি কোনও রকম চালাকি করতে চান তো আপনার বিপদ হবে।’

“লোকটির কথাবার্তা তড়বড়ে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে আর খিলখিল করে হেসে ওঠে। কিন্তু এর রকমসকম দেখে আমার কেমন ভয় করতে লাগল। হ্যারল্ডকে দেখে বা তার ব্যবহারে আমার কিন্তু এ রকম ভয় হয়নি।

“আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার সঙ্গে আপনাদের কী দরকার?’

“‘আমাদের কাছে এক গ্রিক ভদ্রলোক বেড়াতে এসেছেন। তাঁকে কয়েকটা প্রশ্ন করে তার উত্তর জেনে নিয়ে আমাদের বলতে হবে। আমরা যা বলতে বলব তার চেয়ে একটি কথাও বেশি বলবেন না’, হাসতে হাসতে ভদ্রলোক শেষ করলেন, তা হলে কিন্তু আপনাকে পস্তাতে হবে। আপনার মনে হবে যে, এর চাইতে মানুষ হয়ে না-জন্মানোই ভাল ছিল।’

“কথা শেষ করেই ভদ্রলোক একটা দরজা খুলে আমাকে নিয়ে গেলেন আর একটা ঘরে। দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ঘরের মধ্যে একটা মাত্র আলো। কিন্তু সেই আলোটাও খুব মিটমিটে। এ ঘরটাও আকারে বিরাট। মেঝের কার্পেটে পা দিতেই পা যে রকম ডুবে যাচ্ছিল তাতেই টের পেলাম কার্পেট খুব দামি। চেয়ারগুলো দেখলাম ভেলভেটের গদি-মোড়া। মার্বেল পাথরের ম্যান্টেলপিস। ম্যান্টেলপিসের একধারে এক প্রস্থ জাপানি বর্ম। ঘরের সেই মিটমিটে আলোটার কাছেই একটা চেয়ার ছিল। বয়স্ক লোকটি আমাকে সেই চেয়ারে বসতে বললেন। হ্যারল্ড ছোকরা সে ঘরে ছিল না। হঠাৎ ঘরের অন্য দিকের দরজা দিয়ে সে ফিরে এল। তার সঙ্গে একটি লোক। লোকটির গায়ে একটা ঝলমলে ঢিলে ড্রেসিং গাউন। লোকটিকে সঙ্গে করে হ্যারল্ড আমার দিকে এগিয়ে এল। লোকটি যখন আলোর কাছাকাছি এল তখন তার চেহারা দেখে আমার শরীরে ভয়ের একটা শিহরন খেলে গেল। লোকটির চেহারা শুকিয়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় শরীর খুবই দুর্বল। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে ভদ্রলোকের চোখ। চোখদুটো সামান্য একটু বেরোনো। কিন্তু অদ্ভুত চকচকে। বোঝা যায় যে, ভদ্রলোকের শরীর ভেঙে গেছে বটে, মনের জোর কিন্তু একটুও কমেনি। ভদ্রলোকের মুখ দেখে আমার ভয় হয়েছিল। ভদ্রলোকের মুখের অনেক জায়গায় কোনাকুনি করে স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। তাঁর রোগা দুর্বল চেহারা দেখে আমার দুঃখ হয়েছিল। মুখের অবস্থা দেখে ভয় হল। একটা বড় কাপড়ের টুকরো দিয়ে ভদ্রলোকের মুখ বাঁধা।

“সেই লোকটিকে হ্যারল্ড একটা চেয়ারের কাছে নিয়ে আসতেই লোকটি ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। ‘হ্যারল্ড তোমার কাছে স্লেট আর খড়ি আছে তো,’ বয়স্ক লোকটি বলল। ‘ওর হাতদুটো খোলা আছে তো? ঠিক আছে, ওকে খড়িটা দাও। …আচ্ছা মিঃ মেলাস, আপনি এবার প্রশ্ন করতে শুরু করবেন। উনি উত্তরগুলো লিখে দেবেন।…প্রথমে ওঁকে জিজ্ঞেস করুন যে, উনি সেই কাগজগুলো সই করে দিতে রাজি আছেন কিনা।’

“লোকটির চোখদুটো জ্বলে উঠল।

“‘কখনও নয়।’ লোকটি গ্রিক ভাষায় স্লেটের উপর লিখলেন।

“ওদের কথায় আমি বললাম, ‘কোনও অবস্থাতেই কি সই করবেন না?’

“‘করতে পারি যদি আমার সামনে কোনও একজন গ্রিক পুরুতকে ডেকে ওই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়।’

“বয়স্ক লোকটা অদ্ভুত ভাবে খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসি শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

“‘তা হলে তোমার অবস্থাটা কী হবে জানো কি?’

“‘আমার যা হবার হোক, আমি ভয় পাই না।’

“আমাদের কথাবার্তা এই ভাবেই চলল। টুকরো টুকরো প্রশ্ন আর তার উত্তর। অর্ধেক বলা আর মাঝে লেখা। বার বারই ওরা আমাকে দিয়ে কোনও একটা কাগজে ওই ভদ্রলোক সই করবেন কিনা সেই কথাটা জানতে চাইছিল। বার বারই তিনি সেই একই রকম সাফ জবাব দিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি ওদের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে নিজের থেকে দু’-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আরম্ভ করলাম। প্রথমে খুবই সাধারণ কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। আমি বুঝতে চাইছিলাম যে, আমার সঙ্গীরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে কিনা। যখন জানলাম যে, ওরা আমার এই চালাকি ধরতে পারেনি, তখন ভেতরের ব্যাপারটা কী তা জানতে চেষ্টা করলাম। এরপর আমাদের কথাবার্তার ধরনটা দাঁড়াল এই রকম।

“‘এ রকম একগুঁয়েমি করে কোনও লাভ হবে না। আপনি কে?’

“‘আমি তোয়াক্কা করি না। আমি একজন বিদেশি, লন্ডনে এসে পড়েছি।’

“‘তা হলে তোমার অদৃষ্টে যা ঘটবে তার জন্য তুমি নিজেই দায়ী হবে। কত দিন আপনি এখানে এসেছেন?’

“‘তা হোকগে। তিন সপ্তাহ হল।’

“‘ও সম্পত্তি জীবনেও আর তোমার হবে না। আপনার কী হয়েছে?’

“ও সম্পত্তি শয়তানদের খপ্পরে যাবে না। ওরা আমাকে না খেতে দিয়ে আটকে রেখেছে।’

“‘সই করে দিলেই তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এ বাড়িটা কার?’

“‘আমি কক্ষনও সই করব না। আমি জানি না।’

“‘তুমি কিন্তু মেয়েটার ক্ষতি করছ। আপনার নাম কী?’

“‘ও ঠিক আছে। তা হলে ও নিজে আমাকে সে কথা বলুক। ক্রাটিদেস।

“‘যদি তুমি সই করো তবে ওকে দেখতে পাবে। আপনি কোথা থেকে আসছেন?’

“‘তা হলে ওকে আমি দেখতে চাই না। এথেন্স।’

মিঃ মেলাস একটু থেমে বললেন, “পাঁচ মিনিট সময় পেলে ওদের নাকের ডগা দিয়ে সব গোপন কথা টেনে বের করে ফেলতে পারতাম। আমি এর পরই যে-প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিলাম তাতেই ব্যাপার হয়তো অনেকটা খোলসা হয়ে যেত। কিন্তু যাকে বলে বিধি বাম। আমি প্রশ্নটা করতে যাচ্ছি, এমন সময় ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন এক ভদ্রমহিলা। ঘরের সেই মিটমিটে আলোয় যা দেখলাম, তাতে মনে হল যে, ভদ্রমহিলা সুন্দরী এবং বেশ লম্বা। ভদ্রমহিলার মাথা-ভরতি কালো চুল। গায়ে সাদা ঢিলে গাউন।

“ঘরে পা দিয়েই মহিলা বললেন, ‘হ্যারল্ড, আমি আর ওখানে থাকতে পারলাম না। ওহ্‌, ওখানটা কী সাংঘাতিক রকমের নির্জন…! এ কী! হা ভগবান, পল যে!’ ভদ্রমহিলার ইংরেজিটা ভাঙা ভাঙা। শেষের কথাগুলো অবশ্য ভদ্রমহিলা গ্রিক ভাষায় বলেছিলেন। ভদ্রমহিলার কথা শুনে সেই ধনী ভদ্রলোক তাঁর গায়ে যত জোর ছিল তা দিয়ে তাঁর মুখের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলেন। ‘সোফি, সোফি’, ভদ্রলোক কাতর ভাবে বললেন। ভদ্রমহিলা দৌড়ে গিয়ে সেই ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই হ্যারল্ড ছোকরা এসে ভদ্রমহিলাকে ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। আর হ্যারল্ডের সঙ্গী দুষ্ট প্রকৃতির লোকটা, যাকে পল বলে মহিলাটি ডেকে ছিলেন, তাঁকে ধরে ফেলল। না খেতে পেয়ে পল রীতিমতো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই লোকটার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে পারবে কেন? লোকটা পলকে টানতে টানতে অন্য দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে গেল। ঘরের ভেতরে তখন শুধু আমি একা। আমার মনে হল যে, এই সুযোগে একটু সুলুকসন্ধান করে কী কাণ্ড হচ্ছে তা দেখা যেতে পারে। বরাত ভাল বলতে হবে যে, আমি সত্যি সে রকম কোনও চেষ্টা করিনি। মাথা তুলতেই দেখি সেই বুড়োটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মিটিমিটি শয়তানি হাসি হাসছে।

“‘মিঃ মেলাস, আমাদের যা জানবার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, আমাদের খুবই গোপন কথা আপনাকে বিশ্বাস করে বলেছি। ব্যাপারটা শুধু গোপনীয়ই নয়, ব্যক্তিগতও বটে। আপনাকে বিরক্ত করতে হল এই জন্যে যে, আমাদের যে গ্রিক-জানা বন্ধুটি এই ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ায় তাঁকে এখান থেকে চলে যেতে হয়েছে। তাই তাঁর বদলে গ্রিক-জানা আর একজন লোকের সাহায্য আমাদের দরকার হয়ে পড়ে। আপনার কথা আমরা নানা জায়গায় শুনেছি।’

“লোকটার এ কথার আমি আর কী উত্তর দেব। তাই চুপ করেই রইলাম।

“লোকটা আমার কাছে সরে এসে বলল, ‘এই খামে পাঁচ সভ্‌রেন আছে। আমার মনে হয়, আপনার কাজের মজুরি হিসেবে এটা নেহাতই কম হয়নি।’ তারপর সেই রকম হাসতে হাসতে ভদ্রলোক আমার বুকে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বলল, ‘কিন্তু এসব কথা ঘুণাক্ষরে যদি কাউকে…কোনও লোককে আপনি বলেন তো আপনার অদৃষ্টে কষ্ট আছে। আর সে যে কী কষ্ট, তা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে। ভগবান আপনাকে রক্ষা করুন।’

“মিঃ হোমস, ওই লোকটার চেহারা যে সাংঘাতিক একটা কিছু তা কিন্তু নয়, তবুও ওর হাবভাব, হাসি দেখে আমার মনে যে কী দারুণ ভয় আর ঘেন্না হচ্ছিল তা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। লোকটা তখন আলোর কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বলে ওকে আমি ওই প্রথম ভাল করে দেখতে পেলাম। লোকটার চোখমুখে একটা ধূর্ত ভাব। গায়ের রং হলদেটে। মুখে দাড়িগোঁফ। কথা বললেই ওর ঠোঁট আর চোখের পাতা কাঁপে। সেন্ট ভিটাস অসুখ হলে যেমন হয় তেমনই। আমার মনে হল, কথায় কথায় ও যে ওই রকম হেসে ওঠে, তার কারণও বোধহয় কোনও স্মায়বিক দৌর্বল্য। কিন্তু যেটা দেখলে ভয় হয়, সেটা হল লোকটার চোখদুটো। ওর চোখের রং ঠিক ইস্পাতের মতো চকচকে। সেই চোখের দিকে তাকানো যায় না। চোখ থেকে একটা নিষ্ঠুর শয়তানি ভাব ঠিকরে বেরোচ্ছে।

“‘আপনি যদি এসব কথা কাউকে বলেন তো সে খবর আমরা পাবই,’ লোকটা বলল। ‘আমাদের এমন অনেক লোক আছে যাদের কাজই হচ্ছে খবর সংগ্রহ করা। যাক, আপনার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমার বন্ধু আপনাকে পৌঁছে দেবেন।’

“আমাকে আবার প্রায় গোরু তাড়ানোর মতো করে হলের ভেতর দিয়ে এনে গাড়িতে চাপিয়ে দিল। বাড়ির সামনের বাগানটা এক পলকের জন্যে দেখতে পেলাম। আমার ঘাড়ের কাছে হ্যারল্ড ল্যাটিমার। হ্যারল্ড আমাকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দিল। তারপর আমার সামনের সিটে বসল। গাড়ির সব জানলা বন্ধই ছিল। গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ি চলছে তো চলছেই। মনে হল, গাড়ি যেন আর থামবে না। গাড়ি যখন থামল তখন মাঝরাত্তির।

“‘মিঃ মেলাস, আপনাকে এখানেই নেমে যেতে হবে,’ হ্যারল্ড ল্যাটিমার বলল। আপনার বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে নামিয়ে দিতে হল বলে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। একটা কথা বলি। আপনি যদি এই গাড়িটা অনুসরণ করেন তবে আপনার ভীষণ বিপদ হবে।’

“কথাটা বলেই হ্যারল্ড ল্যাটিমার গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়ি থেকে আমি মাটিতে পা দিতে না দিতেই কোচোয়ান ঘোড়ার পিঠে সপাং করে চাবুক মারল। ঘোড়াটা জোরে ছুটতে শুরু করল। আর একটু হলে আমি পড়ে যেতাম। একটু ধাতস্থ হয়ে আমি আমার চারপাশটা দেখে নিলাম। আমাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছে সেটা একটা বিরাট মাঠ। মাঠের মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। আর বহু দূরে, মনে হল লোকালয় রয়েছে। দূরে লোকালয়ের দু’-একটা দোতলা বাড়ির ওপরতলায় আলো জ্বলছিল। মাঠের আর এক দিকে তাকাতে দেখি দূরে রেলওয়ে সিগন্যালের লাল আলো জ্বলছে।

“যে-গাড়িটা আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল, সেটা আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। গাড়িটা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। আমি সেই অন্ধকারে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, এ কোথায় আমি এসে পড়লাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম বলতে পারব না, হঠাৎ খেয়াল হল কেউ যেন অন্ধকারে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটি কাছে আসতে দেখলাম যে, সে একজন রেলের কুলি।

“আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ জায়গার নাম কী?’

“‘ওয়ান্ডস্‌ওয়ার্থ, কমন,’ লোকটি বলল।

“‘এখান থেকে লন্ডনে ফেরবার ট্রেন পাওয়া যাবে?’ আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম।

“‘যদি আপনি মাইলখানেক মতো হেঁটে ক্ল্যাপহ্যাম জংশনে পৌঁছোতে পারেন তবে লন্ডনের শেষ ট্রেনটা পেতেও পারেন।’

“মিঃ হোমস, এই ভাবে আমার সে রাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা শেষ হল। আমি কাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, কোথায় গিয়েছিলাম, কোনও কিছুই জানি না। আপনাকে যা বললাম তার চাইতে বেশি আর কিছুই জানতে পারিনি। তবে আমার মন বলছে যে, এর মধ্যে জঘন্য ধরনের কোনও ষড়যন্ত্র আছে। আর সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে যে, ওই গ্রিক ছোকরাটিকে সাহায্য করা দরকার। তাই পরের দিনই সক্কালে আমি মিঃ মাইক্রফট হোমসকে সব কথা বলি। পরে অবশ্য পুলিশকেও ব্যাপারটা জানাই।”

মিঃ মেলাস চুপ করলেন। মিঃ মেলাস যা বললেন তা তো গল্পের বইয়ে পড়া যায়। সত্যি সত্যি এসব হয় নাকি? আমরা তো শুনে একদম থ। শার্লক হোমসই কথা বলল। মাইক্রফটের দিকে তাকিয়ে শার্লক হোমস বলল, “তুমি কী করলে?”

টেবিলের ওপর একটা ‘ডেলি নিউজ’ পড়েছিল। কাগজটা মাইক্রফট তুলে নিলেন।

“এই বিজ্ঞাপনটাই সব কাগজেই বেরিয়েছিল। কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি,” বলে মাইক্রফট হোমস বিজ্ঞাপনটা পড়লেন, “পল ক্রাটিডেস নামে আথেন্সনিবাসী এক ভদ্রলোকের কোনও সন্ধান যদি কেউ দিতে পারেন তো তিনি উপযুক্ত পুরস্কার পাবেন। পল ক্রাটিডেস ইংরেজি জানেন না। সোফি নামের কোনও গ্রিক তরুণীর সম্পর্কে কোনও হদিস দিতে পারলেও উপযুক্ত পুরস্কার পাওয়া যাবে। এক্স ২৪৭৩।”

“তুমি কি গ্রিক সরকারি দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করোনি?”

“ওদের কাছে খবর নিয়েছিলাম। ওরা কিছু জানে না।”

“অ্যাথেন্সের পুলিশ দফতরে টেলিগ্রাম করলে কেমন হয়?”

মাইক্রফট হোমস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদের বাপঠাকুরদা সকলেই খুব পরিশ্রমী ছিলেন। শার্লক ওঁদের ধাত পেয়েছে। তারপর শার্লকের দিকে ফিরে বললেন, “শার্লক, এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি তদন্ত করো। যদি কোনও ফয়সালা করতে পারো তো আমাকে জানিয়ো।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে হোমস বলল, “তোমাকে তো জানাবই। মিঃ মেলাসকেও খবর দেব। …ইতিমধ্যে মিঃ মেলাস, আপনাকে একটা কথা বলি। আপনি কিন্তু খুব সাবধানে থাকবেন। এই বিজ্ঞাপন যদি ওদের চোখে পড়ে তো ওরা জানবে যে আপনি ওদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।”

বাড়ি ফেরার পথে হোমস একবার টেলিগ্রাফ অফিসে গেল। তারপর সেখান থেকে বেশ কয়েকটা টেলিগ্রাম পাঠাল।

হাঁটতে হাঁটতে হোমস বলল, “ওয়াটসন, সন্ধেটা বেশ ভাল ভাবেই কাটল বলতে হবে। আমার বেশ কয়েকটা ভাল কেসের খবর মাইক্রফটের কাছ থেকে পেয়েছি। যে-রহস্যের কথা এখন শুনলে তার অবশ্য একটা ব্যাখ্যাই হতে পারে। তবে ব্যাপারটার মধ্যে অনেক নতুনত্ব আছে।”

“তুমি রহস্যের সমাধান করতে পারবে মনে করছ?”

“দেখো ওয়াটসন, আমরা যে-সব কথা জানতে পেরেছি তার পরও যদি এই রহস্যের সমাধান না করতে পারি তো সেটাই খুব আশ্চর্যের কথা নয় কি? তুমি তো সব কথাই শুনেছ। হ্যারল্ড সম্বন্ধে তোমার কী মনে হচ্ছে বলো তো?”

“খানিকটা ধারণা হয়েছে বটে, তবে খুব পরিষ্কার কিছু নয়।”

“বলো শুনি।”

“আমার মনে হচ্ছে যে, ওই হ্যারল্ড ল্যাটিমার নামে ইংরেজ ছোকরাটা ওই গ্রিক মেয়েটিকে জোরজার করে আটকে রেখেছে।’

“কোথা থেকে ওকে এনেছে?”

“হয়তো অ্যাথেন্স থেকে।”

শার্লক হোমস মাথা নাড়ল, “ল্যাটিমার ছোকরা একবর্ণও গ্রিক জানে না। কিন্তু গ্রিক মেয়েটি মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারে। তার থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, মেয়েটি অন্তত কিছু দিন ইংল্যান্ডে এসেছে। আর ওই ছোকরা গ্রিসে যায়নি।”

“তা হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মেয়েটি হয়তো ইংল্যান্ডে বেড়াতে এসেছিল। কোনও ভাবে ল্যাটিমারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারপর ওই ছোকরা মেয়েটিকে ভুলিয়েভালিয়ে নিজের ডেরায় এনে বন্দি করে রাখে।”

“এ কথাটা যা বলছ তা খুবই সম্ভব।”

“এর মধ্যে ওই পল ক্রাটিডেস ইংল্যান্ডে এসে হাজির হল। আমার বিশ্বাস পল হল ওই মেয়েটির দাদা। ও বোধহয় বোনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই এসেছিল। তারপর ও বোকার মতো ওই ল্যাটিমার আর তার সঙ্গীর খপ্পরে পড়ে যায়। ওরা ওকেও বন্দি করে ফেলে। শুধু তাই নয়, ওর ওপর রীতিমতো অত্যাচার করতে শুরু করে। আমার মনে হচ্ছে যে, যে-কাগজে ও সই করাবার জন্যে ওরা ওদের ওপর অত্যাচার করছে, সেগুলো নিশ্চয়ই কোনও বিষয় সম্পত্তির মালিকানার কাগজ। হয়তো ওই সম্পত্তি সোফির। পল সোফির দাদা হিসেবে ওই সম্পত্তির দেখাশোনা করে। ল্যাটিমাররা চায় যে, পল এ সম্পত্তির ভার ওদেরই দিয়ে দিক। তাতে পল ছোকরা রাজি নয়। পলের সঙ্গে কথাবার্তা বলবার জন্যে একজন দোভাষীর দরকার। ওরা সেই কাজের জন্যে মিঃ মেলাসকে বেছে নেয়। এর আগে হয়তো অন্য কোনও লোকের সাহায্য ওরা নিয়ে থাকবে। পল যে ল্যাটিমারদের হাতে এ রকম কষ্ট পাচ্ছে তা সোফি জানত না। সেদিন নেহাতই ঘটনাচক্রে সে ব্যাপারটা জেনে ফেলে।”

“চমৎকার ওয়াটসন! চমৎকার! তুমি ঠিকই ধরেছ,” শার্লক হোমস বলল, “তা হলে দেখতেই পাচ্ছ যে, সব ক’টা তাসই আমাদের হাতে। যদি ওরা দুম করে কোনও খুনজখম না করে বসে তো ওদের ধরে ফেলতে আমাদের অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।”

“কিন্তু ওরা কোথায় কোন বাড়িতে আছে, তা তুমি জানবে কী করে?”

“দেখি, আমরা যা ভাবছি তাতে যদি কোনও ভুল না থাকে, আর ওই মেয়েটির নাম যদি সত্যি সত্যি সোফি ক্রাটিডেস হয়, তবে ওই মেয়েটির সন্ধান পেতে বিশেষ অসুবিধে হবে না। আর এই রহস্যের মোকাবিলায় মেয়েটিই আমাদের প্রধান সূত্র। কেন না, ওর ভাইকে তো কেউ চেনে না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, হ্যারল্ড ল্যাটিমারের সঙ্গে ওই মেয়েটির পরিচয় বেশ অনেক দিনের। অন্তত বেশ কয়েক সপ্তাহ তো হবেই। তা না হলে ওদের এই আলাপ-পরিচয়ের খবর ওর ভাই পাবে কী করে? আমার মনে হচ্ছে এই খবর পেয়েই ওই ভদ্রলোক গ্রিস থেকে চলে আসেন। যদি ওরা বরাবর একই জায়গায় থাকত তবে মাইক্রফটের বিজ্ঞাপনের একটা না-একটা উত্তর আসতই।”

এই রকম কথা বলতে বলতে আমরা এক সময়ে বেকার স্ট্রিট পৌঁছে গেলাম। হোমসই সিঁড়ি দিয়ে আগে আগে উঠছিল। ঘরের দরজা খুলেই হোমস বেশ চমকে গেল। হোমসের পিছন থেকে গলা বাড়িয়ে যা দেখলাম, তাতে আমি নিজেও রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ঘরের মাঝখানে একটা আরামকেদারায় বসে মাইক্রফট সিগারেট খাচ্ছেন।

“শার্লক ভেতরে এসো। আসুন ওয়াটসন,” আমাদের অবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে হেসে মাইক্রফট বললেন। “শালর্ক, তুমি ভাবো যে, এত নড়াচড়া করবার ক্ষমতা আমার নেই, তাই না? কিন্তু ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমার খুব আগ্রহ হয়েছে।”

“তুমি এখানে এলে কী করে?”

“আমি গাড়িতে এসেছি।”

“তা হলে নতুন কোনও খবর আছে বলে মনে হচ্ছে।”

“আমার বিজ্ঞাপনের উত্তরে একজন চিঠি লিখেছে।”

“আচ্ছা।”

“হ্যাঁ। তোমরা চলে যাবার একটু পরেই চিঠিটা এল।”

“চিঠিতে কী লিখছে?”

মাইক্রফট হোমস পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন।

“এই যে চিঠিটা,” মাইক্রফট বললেন, “চিঠিটা রয়্যাল ক্রিম কাগজে ‘জে’ কলম দিয়ে লেখা। যিনি লিখেছেন তিনি একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের স্বাস্থ্য ভাল নয়। ভদ্রলোক লিখছেন, ‘মহাশয়, আপনার আজকের তারিখের বিজ্ঞাপনের উত্তরে জানাই যে, যে-মহিলাটির কথা আপনি লিখেছেন তাঁকে আমি খুব ভাল ভাবেই চিনি। যদি আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেন তো ওঁর জীবনের দুঃখ-দুর্দশার কথা আমি আপনাকে বলতে পারি। এখন ওই ভদ্রমহিলা আছেন বেকেনহ্যামের দ্য মারটলসে। আপনার বিশ্বস্ত জে, ডাভেন পোর্ট।’

মাইক্রফট চিঠিটা মুড়ে রেখে বললেন, “চিঠিটা লেখা হয়েছে লোয়ার ব্রিক্সটন থেকে। শার্লক, এখন যদি আমরা ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই তা হলে কি কোনও খবরটবর পাওয়া যাবে বলে মনে করো?”

“দেখো মাইক্রফট, বোনের দুঃখের কথা শোনার চাইতে ওর ভাইয়ের জীবনের দাম অনেক বেশি। আমার মনে হয়, আমাদের এক্ষুনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর গ্রেগ্‌সনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোজা বেকেনহ্যাম যাওয়া উচিত। এ কথাটা ভুলে যাচ্ছ কেন যে, একজনকে তিলে তিলে মেরে ফেলবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের কাছে দামি।”

আমি বললাম, “তা হলে তো মিঃ মেলাসকে আমাদের সঙ্গে নেওয়া উচিত। আমাদের তো একজন দোভাষীর সাহায্য লাগবে।”

“ঠিক বলেছ,” শার্লক হোমস বলল, “ওয়াটসন, একটা গাড়ি ডাকতে বলে দাও। আমরা এক্ষুনি বেরোব।”

আমি লক্ষ করলাম যে, কথা বলতে বলতে হোমস টেবিলের প্রথম ড্রয়ার খুলে রিভলভার বের করে পকেটে পুরে নিল। আমি ব্যাপারটা দেখেছি দেখে হোমস বলল, “এটা সঙ্গে থাকা দরকার। যা শুনছি তাতে লোকগুলো অত্যন্ত সাংঘাতিক প্রকৃতির।”

আমরা যখন পলমলে মিঃ মেলাসের ঘরে গিয়ে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। একজন ভদ্রলোক তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি বেরিয়ে গেছেন।

মাইক্রফট হোমস বললেন, “কোথায় গেছেন বলতে পারেন?”

যে-মহিলাটি দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি বললেন, “তা তো আমি জানি না। শুধু দেখলাম যে, উনি গাড়ি চেপে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে চলে গেলেন।”

“ভদ্রলোক কি নিজের নাম বলেছিলেন?”

“না তো।”

“আচ্ছা, যিনি এসে ছিলেন তাঁকে কি দেখতে খুব সুন্দর? তাঁকে দেখে কি অল্পবয়সি বলে মনে হয়েছিল?”

“না, তিনি তো অল্পবয়সি নন। মাঝবয়সি। বেঁটে। ভদ্রলোকের চোখে চশমা আছে। কথাবার্তা খুব ভাল। মুখে হাসি লেগেই আছে। কথা বলবার সময়েও ভদ্রলোক হাসছিলেন।”

“ঠিক আছে। চলে এসো,” বলে শার্লক হোমস আমাদের প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলে এল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাবার সময় গাড়িতে হোমস বলল, “ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে গেছে। ওই লোকগুলো আবার মেলাসকে পাকড়েছে। সেদিন রাত্তিরেই ওরা টের পেয়ে গেছে যে, মিঃ মেলাস খুব ভিতু। ওঁর একফোঁটা সাহস নেই। সেদিন ওই ল্যাটিমার আর তার শাগরেদকে দেখেই মেলাস ভয় পেয়ে যায়। আর সেটা ওরা বুঝতে পেরে স্রেফ ভয় দেখিয়ে ওঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে। ওরা ওঁকে নিয়ে গেছে দোভাষীর কাজ করাবার জন্যেই। তবে কাজ হয়ে গেলে ওরা যে মেলাসকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শাস্তি দেবে এতে কোনও সন্দেহ নেই।”

আমরা ভেবেছিলাম যে, আমরা যদি ট্রেনে যাই তো গাড়িটা বেকেনহ্যামে পৌঁছোবার আগেই আমরা বেকেনহ্যামে পৌঁছে যাব। কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়ে ইন্সপেক্টর গ্রেগসনকে খুঁজে বের করতে দেরি হল। তারপর সার্চ ওয়ারেন্ট বের করতে আরও ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। কাগজপত্র নিয়ে গ্রেগসনকে সঙ্গে করে আমরা যখন লন্ডন ব্রিজে পৌঁছোলাম তখন পৌনে দশটা বাজে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে আমরা চার জন যখন বেকেনহ্যাম প্ল্যাটফর্মে নামলাম তখন সাড়ে দশটা বাজে। স্টেশন থেকে গাড়ি করে আধ-মাইলটাক যেতেই মারটলসে পৌঁছে গেলাম। বিরাট হাতাওয়ালা বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে বাড়িটা অনেক ভেতরে। বাড়িটাও বিরাট। আমরা বাড়ির কাছে এসে গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। তারপর আমরা বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম। বিরাট বাড়িটা অন্ধকার।

ইন্সপেক্টর গ্রেগসন বললেন, “সব জানলা তো দেখছি বন্ধ। মনে হচ্ছে বাড়িতে লোকজন নেই।”

হোমস বলল, “পাখি উড়ে গেছে। বাসা খালি।”

“এ কথা কেন বলছেন?”

“ঘণ্টাখানেক আগে প্রচুর মালপত্র বোঝাই একটা গাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে গেছে,” হোমস বলল। ইন্সপেক্টর হো হো করে হেসে উঠলেন, “আমি গেটের আলোয় গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পাচ্ছি বটে, তবে মালপত্তর নিয়ে যাওয়ার কোনও চিহ্ন দেখছি না তো!”

হোমস বলল, “একটু ভাল করে দেখলে দেখবেন দু’ ধরনের ছাপ রয়েছে। একটা দাগ বাইরে থেকে গাড়ি আসার, আর একটা গাড়িটি বেরিয়ে যাওয়ার। বাইরে যাওয়ার দাগটা বেশ গভীর ভাবে পড়েছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, গাড়িতে অনেক জিনিসপত্র চাপানো হয়েছিল।”

ইন্সপেক্টর নাচার ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “নাহ্‌, আপনার কথা ঠিক ধরতে পারলাম না। কিন্তু এ দরজা খোলা সহজ হবে না। যাক, আগে তো দেখি বাড়ির ভেতরে কেউ আছে কিনা?”

ইন্সপেক্টর কড়া ধরে জোরে নাড়া দিলেন, তারপর ‘বেল’ বাজালেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। হোমস কোথায় যেন গিয়েছিল। একটু পরেই ফিরে এল।

“আমি একটা জানলা খুলে ফেলেছি,” হোমস বলল।

হোমস যে রকম কায়দা করে জানলার ছিটকিনি খুলে ফেলেছে তা দেখে ইন্সপেক্টর গ্রেগসন বললেন, “ভাগ্যে আপনি পুলিশের হয়ে এ কাজ করলেন তাই রক্ষে, না হলে কিন্তু ফ্যাসাদ বাধত। যাক, অবস্থা বিবেচনা করে আমরা ওই জানলা দিয়েই ঢুকতে পারি। দরজা কেউ খুলে দেবে বলে মনে হচ্ছে না।”

আমরা সকলে একে একে সেই জানলা দিয়ে একটা বড় ঘরে ঢুকলাম। দেখে মনে হল এই ঘরের কথাই মেলাস আমাদের বলে ছিলেন। ইন্সপেক্টর তাঁর লণ্ঠনটা জ্বাললেন। লণ্ঠনের আলোয় ঘরটা দেখলাম। পরদা-টাঙানো জানলা, দুটো দরজা, একটা জাপানি বর্ম, মিঃ মেলাস যা যা বলে ছিলেন। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের ওপর দুটো কাঁচের গেলাস, একটা খালি ব্র্যান্ডির বোতল আর কিছু খাবারের গুঁড়ো ছড়ানো হয়েছে।

হঠাৎ শার্লক হোমস বলে উঠল, “ওটা কী?”

আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে লাগলাম। আমাদের মাথার ওপর থেকে খুব চাপা একটা গোঙানির শব্দ কানে আসছিল। হোমস দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হলের দিকে এগিয়ে গেল। হলে এসে আমরা বুঝতে পারলাম, শব্দটা ওপর তলা থেকেই আসছে। একটুও দেরি না করে হোমস সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে উঠে গেল। হোমসের পেছনে আমি আর ইন্সপেক্টর ছুটলাম। আমাদের পিছনে মাইক্রফট হোমস তাঁর মোটাসোটা চেহারা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব, আসছিলেন।

তিনতলায় তিনটে ঘর। মাঝের ঘরটা থেকেই আওয়াজটা আসছিল। কখনও এত আস্তে যে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। আবার এক এক সময় আওয়াজটা খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। একটা প্রচণ্ড কষ্ট যেন গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দরজাটার চাবি বন্ধ ছিল। তবে ভাগ্য ভাল যে, চাবিটা লকের মধ্যে লাগানো ছিল। হোমস চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলেই ঘরে ঢুকে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে নিজের গলা চেপে ধরে ছুটে বেরিয়ে এল, “ঘর কাঠকয়লার ধোঁয়ায় ভরে গেছে। …একটু অপেক্ষা করো। …ধোঁয়াটা বেরিয়ে যাক।”

ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে আমরা দেখলাম যে, ঘরের মাঝখানে একটা তামার তেপায়া বসানো। তেপায়ার ওপরে একটা আলো জ্বলছে। আলোর শিখাটা অদ্ভুত নীলচে ধরনের। সেই আলোয় ঘরের মাঝখানটা দেখা যাচ্ছে। ঘরের বাকিটা ছায়া আর অন্ধকার। একটা অদ্ভুত ভৌতিক পরিবেশ। বাইরে থেকে দেখে মনে হল যে, ঘরের এক কোণে দেওয়ালের ধারে ঘাড় গুঁজে দু’জন লোক পড়ে আছে। খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে বিষাক্ত ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল। কাশতে কাশতে আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। হোমস দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে। তার পরেই নেমে এসে ঘরের মধ্যে গিয়ে হোমস ঘরের সব জানলা হাট করে খুলে দিল আর তেপায়া সমেত সেই জ্বলন্ত আগুনটা জানলা দিয়ে বাগানে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে হোমস বলল, “আরও দু-এক মিনিট পরেই ঘরে ঢোকা যাবে। … মোমবাতি আছে নাকি? …আছে? কিন্তু ওই ঘর যে রকম গ্যাসে ভরতি হয়ে রয়েছে তাতে ওখানে দেশলাই জ্বালানো মোটেই নিরাপদ নয়। মাইক্রফট, তুমি দরজার কাছে মোমবাতিটা ধরো, আমরা ওদের ঘর থেকে বের করে আনব। নাও, ধরো বাতিটা।”

দৌড়ে গিয়ে আমরা সেই বিষের ধোঁয়ায় অসুস্থ লোক দু’জনকে কোনও রকমে টানতে টানতে বের করে আনলাম। দু’জনের ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। চোখ-মুখ বীভৎস রকমের ফুলে গেছে। সত্যি কথা বলতে কী, ওদের দু’জনের চোখ-মুখ এমনই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, দাড়ি ছাড়া মিঃ মেলাসকে চেনবার কোনও উপায়ই ছিল না। কয়েক ঘণ্টা আগে ডাইয়োজিনেস ক্লাবে যে গ্রিক দোভাষী ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে তিনি কি এই ভদ্রলোক? ভাবা যায় না যে, এত কম সময়ের মধ্যে মানুষের চোখ-মুখ এত সাংঘাতিক রকমের বদলে যেতে পারে। মিঃ মেলাসের হাত-পা শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তাঁর কপালের ঠিক নীচে চোখের ওপরে একটা কাটা দাগ। বোঝা যায় যে, কোনও কিছু দিয়ে ওঁকে জোরে মারা হয়েছিল। অপর ভদ্রলোকটির হাত-পা একই ভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার ওপর ভদ্রলোকের মুখে স্টিকিং প্লাস্টার কেটে কেটে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভদ্রলোক বেশ লম্বা। তবে শরীর খুবই খারাপ। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে গেছেন। আমরা যখন ভদ্রলোককে বের করে আনলাম তখন তাঁর কাতরানি থেমে গেছে। ভদ্রলোকের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারলাম যে, আমাদের আসতে দেরি হয়ে গেছে। কোনও ডাক্তারের কোনও ওষুধেই ওঁকে আর জাগিয়ে তোলা যাবে না। মিঃ মেলাস অবশ্য তখনও বেঁচে ছিলেন। খানিকক্ষণ অন্তর অন্তর আমোনিয়া আর ব্র্যান্ডি দিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওঁকে জাগিয়ে তোলা গেল। মিঃ মেলাস চোখ মেলে তাকালেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বুঝলাম, যে অন্ধকার উপত্যকায় আমাদের সবাইকে একদিন-না-একদিন যেতেই হবে, সেই উপত্যকার প্রায় মুখ থেকে মিঃ মেলাসকে ফিরিয়ে আনতে পারা গেছে।

সুস্থ হয়ে মিঃ মেলাস আমাদের যে-কাহিনী শোনালেন তা আমরা যে রকম ভেবেছিলাম তার সঙ্গে মোটামুটি মিলে গেল। মিঃ মেলাসের ঘরে ঢুকেই আগন্তুক পকেট থেকে রিভলভার বের করে। ওর হাতে রিভলভার দেখেই মিঃ মেলাস এত ভয় পেয়ে যান যে, তিনি কোনও রকম আপত্তি না করে ওর সঙ্গে গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এই দেখনহাসি শয়তানটা মিঃ মেলাসকে স্রেফ ভয় দেখিয়ে কী রকম বশ করে ফেলেছে তা ভাবতে পারা যায় না। ওই শয়তানটার কথা উঠলেই আমাদের এই অনেক ভাষা-জানা পণ্ডিতমশাইয়ের হাত-পা কাঁপতে শুরু করে, মুখ একদম সাদা হয়ে যায়। যাই হোক, মেলাসকে সঙ্গে নিয়ে ওই লোকটা সময় নষ্ট না করে সোজা বেকেনহ্যামে চলে আসে। বেকেনহ্যামে মিঃ মেলাসকে আবার দোভাষীর কাজ করতে হয়। মিঃ মেলাসের এবারের অভিজ্ঞতা আগের বারের অভিজ্ঞতার চেয়েও ভয়াবহ। দুই বদমায়েশ ইংরেজ সেই অসহায় গ্রিক ভদ্রলোকটিকে অনবরত শাসাচ্ছিল এই বলে যে, তাদের কথা না শুনলে ওরা ওঁকে খুন করে ফেলবে। ওরা যখন বুঝতে পারল যে, গ্রিক ভদ্রলোককে দিয়ে কোনও ভাবেই তাদের মতলব হাসিল হবে না, তখন ওরা ওঁকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। এরপরে ওরা মিঃ মেলাসকে নিয়ে পড়ল। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে উনি যে ওদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তার জন্যে ওঁকে ভর্ৎসনা করল। …তারপর উনি কিছু বোঝবার আগেই লাঠির ঘায়ে ওঁকে বেহুঁশ করে দিল। …তারপর কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না।

এই হল গ্রিক দোভাষীর আশ্চর্য অভিজ্ঞতার আসল রহস্য। মোটামুটি ভাবে রহস্যের সমাধান হলেও কিছু কিছু ব্যাপার কিন্তু অজানাই থেকে গেল। মাইক্রফট হোমসের দেওয়া বিজ্ঞাপনের উত্তরে যে-ভদ্রলোক চিঠি দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে যে-খবর পাওয়া গেল তা এই রকম:

সোফি বিরাট বড়লোকের মেয়ে। তিনি ইংল্যান্ডে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এসে ছিলেন। ইংল্যান্ডে এসে হ্যারল্ড ল্যাটিমার নামে এক ইংরেজ ছোকরার সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় হয়। যে-কোনও ভাবেই হোক সোফি ল্যাটিমারের খপ্পরে পড়ে যান। ল্যাটিমার ওঁকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে। এই ব্যাপারে সোফির বন্ধুরা খুব ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, সব কথা সোফির দাদাকে চিঠির মারফত জানিয়ে দিয়েই ওরা চুপ করে যায়। ওদের ধারণা হয় যে, ওদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। ওদের আর করবার কিছু নেই। সোফির দাদা চিঠি পেয়েই অ্যাথেন্স থেকে সোজা ইংল্যান্ডে চলে আসেন। কিন্তু উত্তেজনার বশে তিনি একটি কাঁচা কাজ করে ফেলেন। তিনি একা একাই হ্যারল্ড ল্যাটিমার আর তার সঙ্গীর, পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, ওই হাসিমুখো শয়তানটার নাম উইলিয়ম কেম্প, ঘাঁটিতে গিয়ে হাজির হন। এই উইলিয়ম কেম্প লোকটা ভয়ানক পাজি। হেন জঘন্য কাজ নেই যা ও করেনি। সোফির দাদা ওদের কাছে গেলে ওরা সহজেই ওকে বন্দি করে ফেলে। একে তো ভদ্রলোক বিদেশি, তার ওপর ইংরেজি জানেন না একটুও। তাই ভদ্রলোক যে ওদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবেন না, সেটা ওরা গোড়াতেই বুঝে গিয়েছিল। আর তাই তাঁদেরকে এক বাড়িতেই বন্দি করে রাখতে ওরা ভয় পায়নি। শুধু দাদার মুখে স্টিকিং প্লাস্টার লাগিয়ে রাখত, যাতে সোফি ওঁকে দেখতে পেলেও চিনতে না পারেন। তবে তাদের এ ধারণা যে কত মিথ্যে তা তো মিঃ মেলাসের কথা থেকেই জানতে পারা গেছে। ভাই-বোনের টান এমনই জিনিস। একনজর দেখেই সোফি তাঁর দাদাকে চিনতে পেরেছিলেন। সোফির নিজের অবস্থাও বিশেষ ভাল ছিল না। চব্বিশ ঘণ্টা বাড়ির ভেতরে বন্দি। বাড়িতে লোক বলতে দু’জন কাজের লোক। গাড়োয়ান আর তার স্ত্রী। ওরা দু’জনেই আবার ল্যাটিমার আর কেম্পের লোক। সোফির দাদাকে বন্দি করে রাখার উদ্দেশ্য হল জোর করে ওঁকে দিয়ে ওঁর আর সোফির সব সম্পত্তি ওদের নামে লিখিয়ে নেওয়া। শেষকালে ওরা যখন দেখল যে ওদের কীর্তিকাহিনী সব ফাঁস হয়ে গেছে, আর সোফির দাদা প্রাণ গেলেও সম্পত্তি ওদের হাতে লিখে দেবেন না, তখন ওরা সোফিকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর গোঁয়ারতুমির জন্যে সোফির দাদাকে এবং কথা দিয়ে কথা না রাখার জন্যে মিঃ মেলাসকে ওরা ভাল করে শাস্তি দিয়ে যায়।

বেশ কয়েক মাস পরে বুদাপেস্ট থেকে একটা ছোট্ট খবর ছাপা হয়েছিল। খবরটা আর কিছু নয়, শুধু এইটুকু: দু’জন ইংরেজ ছোকরা আর তাদের সঙ্গিনী এক মহিলা বুদাপেস্টে বেড়াবার সময় সাংঘাতিক রকমের দুর্ঘটনায় পড়ে। দু’জন লোকই ছুরির আঘাতে মারা যায়। হাঙ্গারির পুলিশের ধারণা, দু’জনের মধ্যে কোনও একটা সামান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়, তারপর মুখ থেকে ব্যাপারটা হাতে নেমে আসে। ছুরি খেয়ে পরস্পরের মৃত্যু ঘটে। আমি অবশ্য জানি হোমসের ধারণা ঠিক উলটো। হোমসের দৃঢ় ধারণা যে, যদি ওই গ্রিক মহিলাটির সঙ্গে কোনও দিন তার দেখা হয় তবেই সে জানতে পারবে যে, সোফি তার দাদার অকালমৃত্যুর ও তার নিজের কষ্টের প্রতিশোধ এইভাবে নিয়েছিল কিনা!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন