ওষ্ঠবক্র রহস্য

আর্থার কোনান ডয়েল

ওষ্ঠবক্র রহস্য

সেন্ট জর্জেস-এর থিওলজিকাল কলেজের পরলোকগত অধ্যক্ষ ডক্টর অব ডিভিনিটি এলিয়াস হুইটনির ভাই ইসা হুইটনির আফিম খাওয়ার অভ্যেস ছিল। আফিম খেলে আশ্চর্য অনুভূতি হয়, ছাত্রজীবনে এই কথা পড়ে তিনি শখ করে আফিম ধরেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝলেন যে, এই অভ্যেস ধরা সোজা, কিন্তু ছাড়া ভীষণ শক্ত। আমার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয়, তখন তাঁর শরীর একদম ভেঙে গেছে। তোবড়ানো গাল, ঘোলাটে দৃষ্টি। দু’ চোখের পাতা যেন সব সময়েই বন্ধ হয়ে আসছে। চেয়ারে বসে থাকা এই ভগ্নস্বাস্থ্য লোকটিকে দেখলে আমার কষ্ট হয়।

১৮৬৯ সালের জুন মাসের এক রাত্তিরে আমার সদর দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। বেশ রাত হয়েছে। বসে বসে হাই উঠছিল, ভাবছিলাম এবার শুতে যাব। ঘণ্টা শুনে আমি চেয়ারে সিধে হয়ে বসলাম। আমার স্ত্রী সেলাই করছিলেন। সেলাইটা রেখে হাল-ছেড়ে-দেওয়া ভাবে আমার দিকে তাকালেন।

“এ নিশ্চয়ই কোনও রুগি। তোমাকে নির্ঘাত এই রাত্রে বেরোতে হবে।”

আড়মোড়া ভেঙে আমি বললাম, “আর পারা যায় না। সমস্ত দিন প্রচুর খাটাখাটনি করে আমি একটু আগে ফিরেছি।”

আমরা দরজা খোলার আওয়াজ শুনলাম। দু’-চারটে কথাও অস্পষ্ট ভাবে শোনা গেল। তার পরেই আমাদের ঘরের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকলেন কালো ওড়নায় মুখ ঢাকা কালো জামাকাপড় পরা এক ভদ্রমহিলা।

“এত রাতে এসে তোমাদের জ্বালাতন করছি বলে ক্ষমা কোরো।” এইটুকু বলেই ভদ্রমহিলা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ছুটে এসে আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। “আমার বড় বিপদ। আমাকে সাহায্য করতেই হবে,” কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন।

“কী কাণ্ড!” ভদ্রমহিলার মুখের ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে আমার স্ত্রী বললেন, “আরে কেট হুইটনি যে! তুমি তো আমাকে দারুণ ঘাবড়ে দিয়েছিলে। তুমি যখন ঘরে ঢুকলে আমি তোমায় চিনতেই পারিনি।”

“কী করব বুঝতে না পেরে আমি সোজা তোমার কাছে চলে এলাম।”

বরাবর দেখছি যে, যখনই কোনও ভদ্রমহিলা কোনও গোলমালে পড়েন তখনই তিনি আমার স্ত্রীর কাছে ছুটে আসেন, আলোর কাছে পতঙ্গ যেমন ছুটে আসে।

আমার স্ত্রী বললেন, “খুব ভাল করেছ। আগে এক গেলাস জল না চা না কফি খাবে বলো। তার পরে ধীরেসুস্থে সব কথা বলবে।” তারপর আমাকে দেখিয়ে বললেন, “ওঁকে কি এখান থেকে যেতে বলব?”

“না, না, ডাক্তারবাবুকেই আমার দরকার। ব্যাপারটা আমার স্বামী ইসাকে নিয়ে। গত দু’দিন ধরে সে ঘরে ফেরেনি। তার জন্যে আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

এর আগেও কেট হুইটনি তার স্বামী ইসা হুইটনির কথা আমাদের কাছে দু’-চার বার বলেছে। আমাকে বলেছে আমি ডাক্তার বলে আর আমার স্ত্রীকে বলেছে তার ছেলেবেলার বন্ধু হিসেবে। তার কথা শুনে আমরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলাম। ইসা কোথায় গেছে তা কি কেট জানে ? আমরা কি চেষ্টা করলে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারি ?

কেটের কথা শুনে মনে হল যে, ইসাকে ফিরিয়ে আনবার জন্যেই এত রাত্রে সে আমাদের কাছে ছুটে এসেছে। কেট জানতে পেরেছে যে, বেশ কিছুদিন হল ইসা লন্ডনের পূর্বাঞ্চলে একটি আফিমখোরদের আড্ডার সন্ধান পায়। প্রথম প্রথম সে ওই আড্ডায় যেত কিছুক্ষণের জন্যে। সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসত। এবারে আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার পাত্তা নেই। কেটের দৃঢ় বিশ্বাস যে, আপার সোয়ানডাম লেনের ‘দি বার অব গোল্ড’-এ গেলে ইসাকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে কী করতে পারে? কী করে সে একলা ওই দুর্দান্ত পাড়ায় গিয়ে তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে আনবে?

এই অবস্থায় কী করা উচিত? আমার পক্ষে কি কেটের সঙ্গে দি বার অব গোল্ডে যাওয়া সম্ভব? কেটেরই বা যাবার দরকার কী? আমি তো ইসার ডাক্তার। আমি একলা গিয়েই তো তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে নিয়ে আসতে পারি। এইসব কথাবার্তার পর ঠিক হল যে, আমি এখনই ইসার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ছি। আর যদি ওই ঠিকানায় সে সত্যিই থাকে তবে তাকে আমি ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই আমি একটা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আপার সোয়ানডাম লেনের দিকে চললাম। প্রথমে বেশ নির্বিঘ্নেই গেলাম। কিন্তু মুশকিল হল পরে। আপার সোয়ানডাম লেন একটা কুখ্যাত গলি। রাস্তাটা টানা চলে গেছে লন্ডন ব্রিজের পুবদিকে নদীর উত্তর তীর ধরে মাল তোলা-নামানোর ঘাটগুলোর সমান্তরাল। একটা সস্তার তৈরি জামাকাপড়ের দোকান আর সস্তার চায়ের কেবিনের মাঝখান দিয়ে একটা সিঁড়ি কয়েক ধাপ নেমে গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা অন্ধকার গুহার মুখ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমি বুঝতে পারলাম যে, ওইটেই আফিমখোরদের আড্ডা। আমার ভাড়াগাড়ির কোচোয়ানকে সেইখানে অপেক্ষা করতে বলে আমি সাবধানে সেই প্রায়-অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। ওপর থেকে একটা লন্ঠনের আলো এসে পড়ছিল। সেই আলোয় কোনও রকমে ঠাহর করে আমি তো দি বার অব গোল্ডের দরজাটা খুঁজে পেলাম। ঢুকে দেখলাম যে, ঘরের ভেতরের বাতাসটা যেমন ভারী তেমনই কটু গন্ধ আর ধোঁয়ায় ভরা।

সেই ধোঁয়ায় ভরতি আলো-আঁধারি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম যে, বহু লোক সেই ঘরের মধ্যে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে-বসে বা আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মরা ছাগলের মতো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এদের মধ্যে বেশিরভাগ লোকই চুপচাপ বসে ছিল, খুব অল্প কয়েকজন নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল।

আমি ঘরে পা দিতে-না-দিতেই একজন মালয় দেশীয় লোক এসে আমাকে ‘আসুন, আসুন’ বলে অভ্যর্থনা করল। আমি তাকে বললাম যে, আমি খদ্দের হয়ে এখানে আসিনি। ইসা হুইটনি বলে আমার এক বন্ধু এখানে এসেছে, তার সঙ্গে কথা বলতে আমি এসেছি।

আমার ডান দিকে কে যেন নড়ে উঠল, আর তার পরেই একটা চিৎকার। আধো-অন্ধকারের মধ্যে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম যে, ইসা হুইটনি আমার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখে কেমন যেন একটা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি; তাঁর পোশাক অত্যন্ত ময়লা আর সমস্ত শরীরে যেন কালির ছোপ পড়ে গেছে।

“হা অদৃষ্ট! ওয়াটসন যে! কী ব্যাপার!” তাকে দেখে আমার করুণা হল। তার শরীরে যেন ক্ষমতা নেই। হাত-পা দুর্বল। “ওয়াটসন, কটা বাজে বলুন তো?”

“প্রায় এগারোটা।”

“তার মানে?”

“আজ জুন মাসের ১৯ তারিখ। শুক্রবার। সময় রাত্রি এগারোটা।”

“সে কী! আমি তো ভেবেছি আজ বুধবার। আজ তো বুধবারই। শুধু শুধু আপনি আমাকে নিয়ে রসিকতা করছেন কেন?” এই বলে সে বেঞ্চে এলিয়ে বসে পড়ল।

“শুনুন। আজ শুক্রবার। গত দু’দিন যাবৎ আপনার কোনও খবর না পেয়ে আপনার স্ত্রী ভাবনায়-চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন। আপনার নিজের স্বভাবের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া উচিত।” আমি কিছুটা কঠিন ভাবে বললাম।

“বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি সত্যিই অনুতপ্ত। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ডাঃ ওয়াটসন, আপনি বোধহয় একটু ভুল করছেন। আমি তো অল্প কিছুক্ষণ আগে এখানে এসেছি। যাই হোক, আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব। সত্যি, কেটের ওপর খুব অন্যায় করে ফেলেছি।… আমাকে একটু উঠতে সাহায্য করবেন কি? আপনার সঙ্গে কি গাড়ি আছে?”

“হ্যাঁ, আমার গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে?”

“তা হলে আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমি ওই গাড়িটা নিয়েই বাড়ি চলে যাই। আর একটা কথা, আপনি যদি একবার ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বলেন যে, আমার শরীরটা খুব দুর্বল বোধ হচ্ছে বলে আমি ম্যানেজারের কাছে গেলাম না, তা হলে বড় ভাল হয়।”

ইসা হুইটনিকে অপেক্ষা করতে বলে আমি সেই অন্ধকার ধোঁয়ায় ভরতি ঘরের মধ্যে দিয়ে ম্যানেজারের খোঁজে চললাম। যখন আমি একটা বেঞ্চিতে বসা একটা লম্বা লোকের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন কে যেন পিছন থেকে আমার কোট ধরে টেনে চাপা গলায় বলল, “আমার সামনে দিয়ে চলে যাবার পর পেছন দিকে তাকিয়ো।” আমার শুনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি। আমি পাশে তাকালাম। আমার পাশেই একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি চুপচাপ বসে ছিলেন। তাঁর কোনও বাহ্যজ্ঞান আছে বলে আমার মনে হল না। আমি দু’ পা এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। সেই মুহূর্তে জানি না কী অসীম চেষ্টায় আমি চিৎকার করে ওঠা থেকে নিজেকে সংযত করলাম। সেই বৃদ্ধ লোকটি আমার দিকে তাঁর মাথাটা এমন ভাবে সামান্য ঘুরিয়েছেন যাতে তাঁর মুখটা একমাত্র আমিই দেখতে পাই। তাঁর চোখমুখের বার্ধক্যের ছাপটা সরে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে শার্লক হোমস। হোমস আমাকে ইঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে আসতে বলল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখে সেই বৃদ্ধের ভাবটা ফিরে এল।

আমি ফিসফিস করে বললাম, “হোমস, তুমি এখানে কী করছ?”

“চুপ। আরও আস্তে কথা বলো। আমার কান খুব পরিষ্কার। তুমি যদি তোমার ওই জবুথবু বন্ধুটিকে বিদায় করতে পারো তো ভাল হয়। তোমাকে আমার বিশেষ দরকার।”

“আমি বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।”

“তা হলে ওঁকে ওই গাড়িতে করে এখনই বাড়ি পাঠিয়ে দাও। আর কোচোয়ানের হাতে তোমার স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়ে দাও যে, আজ রাত্রে তুমি আমার বাসায় থাকবে। তুমি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি।”

শার্লক হোমসের কথায় সব সময়েই এমন একটা সিরিয়াস ভাব থাকে যে, সে কিছু বললে তার কথার প্রতিবাদ করা যায় না। আর তা ছাড়া আমার মনে হল যে, হুইটনিকে এখান থেকে বের করে বাড়ির দিকে পাঠালেই আমার দায়িত্ব শেষ। সব চাইতে বড় কথা শার্লক হোমসের তদন্তের সঙ্গী হবার সুযোগ কোনও অবস্থাতেই আমি হাতছাড়া করতে চাই না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি হুইটনিকে ঘোড়ারগাড়িতে চাপিয়ে কোচোয়ানকে তার বাড়িতে নামিয়ে এই চিঠিটা আমার স্ত্রীকে দিয়ে দিতে বললাম। অল্প কিছুক্ষণ পরে অত্যন্ত অশক্ত এক বৃদ্ধ দি বার অব গোল্ড থেকে বেরিয়ে এল। আমি সেই বৃদ্ধের ছদ্মবেশধারী শার্লক হোমসের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলাম। প্রায় আধ মাইলটাক রাস্তা হোমস সেই বৃদ্ধের মতো কোনও রকমে টলতে টলতে পথ হাঁটতে লাগল আর ঘন ঘন পিছন ফিরে দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ এক সময় সে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

“ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছিলে যে আফিম ধরেছি।”

“সত্যি কথা বলতে কী, তোমাকে ওই ভাবে ওখানে দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হয়েছি।”

“তা যদি বলো তো তোমাকে ওখানে দেখে আমিও কম আশ্চর্য হইনি।”

“আমি গিয়েছিলাম আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের খোঁজে।”

“আর আমি গিয়েছিলাম আমার এক শত্রুর খোঁজে।”

“শত্রুর খোঁজে?” আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম।

“হ্যাঁ। আমার জাতশত্রু, বলতে পারো স্বাভাবিক শিকার। সংক্ষেপে তোমায় বলি। এখন আমি বেশ একটা জটিল তদন্তে জড়িয়ে পড়েছি। আমি আশা করেছিলাম যে, এই আড্ডাখানায় নিয়মিত যে-সব লোক আসে, তাদের কথাবার্তা থেকে এ ব্যাপারের কোনও একটা সূত্র হয়তো বা পেয়ে যাব। ওখানে যদি আমার আসল পরিচয় জানাজানি হয়ে যেত তা হলে আমাকে আর জীবন্ত অবস্থায় কখনও খুঁজে পাওয়া যেত না। এর আগে দু’-এক বার এই আড্ডায় এসে আমি কাজ হাসিল করে গেছি। এই আড্ডাখানার মালিক গুন্ডাসর্দার ম্যানেজার বলেছে, আমাকে পেলে একবার দেখে নেবে। এই বাড়িটার একটা খিড়কি দরজা আছে পলঘাটের কাছে। সেখান দিয়ে রাত্রের অন্ধকারে কত কী যে নদীতে চালান গেছে তা অনুমান করা শক্ত নয়।”

“কী বলছ? নিশ্চয়ই গোটা গোটা মৃতদেহ চালান হয়নি।”

“হাঁ, ওয়াটসন, মৃতদেহই পাচার হয়েছে। যত মৃতদেহ পাচার হয়েছে তার প্রত্যেকটির জন্যে যদি হাজার পাউন্ড করে পেতাম, তা হলে এত দিনে আমরা বহু কোটিপতি হতে পারতাম। এ রকম জঘন্য মৃত্যুকূপ টেমসের ধারে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই। আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার সেই যে জীবন্ত অবস্থায় এখানে ঢুকেছে, সে আর জীবন্ত অবস্থায় এখান থেকে বেরোয়নি। কিন্তু আমাদের গাড়িটার তো এখানেই থাকবার কথা।”

আমি কিছু বলবার আগেই হোমস মুখের মধ্যে দুটো আঙুল পুরে দিয়ে খুব জোরে শিস দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লোকজনের কথাবার্তা আর গাড়িঘোড়ার শব্দকে ছাপিয়ে আর একটা শিস শোনা গেল। আর তার পরেই ঘোড়ার ক্ষুরের খপ্‌খপ্‌ আর গাড়ির চাকার ঘর্ঘর শব্দ শোনা গেল। অন্ধকারের মধ্যে জোরালো দুটো আলো জ্বালিয়ে বেশ বড় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল।

“কী ওয়াটসন, এখন আমার সঙ্গে যাবে তো?”

“আমি যদি তোমার কোনও কাজে লাগি তো অবশ্যই যাব।”

“বিশ্বস্ত সহকারীর প্রয়োজন সর্বদাই। তা ছাড়া সে আবার যদি জীবনীলেখক হয় তো তাকে বাদ দেবার প্রশ্নই ওঠে না। আমার এখনকার আস্তানা সেডার্সে। একটা ডবল বেড রুম।”

“সেডার্স?”

“হ্যাঁ। ওটা মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের বাড়ি। এই তদন্ত শুরু করবার পর থেকে আমি ওখানেই আছি।”

“কিন্তু বাড়িটা কোথায়?”

“কেন্ট লিয়ের কাছে। আমাদের এখান থেকে পাক্কা সাত মাইল যেতে হবে।”

“আমি কিন্তু এখনও যে তিমিরে সেই তিমিরেই।”

“তাই তো বটে। ব্যস্ত হয়ো না, যেতে যেতে আমি তোমাকে সব কথা বলব। আগে উঠে পড়ো তো। জন, এই হাফ ক্রাউনটা রাখো। আজ রাত্তিরে তোমাকে আর আমার দরকার নেই। কাল সকাল এগারোটার সময় আমার সঙ্গে দেখা কোরো। ঠিক আছে।”

হোমস পাকা কোচোয়ানের মতো চাবুক মারতেই ঘোড়াটা ছুটতে লাগল। প্রায় অন্ধকার জনহীন সব গলি দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটল। তারপর আমরা একটা অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। তারপর একটা ব্রিজ পার হলাম। চকিতের জন্যে ব্রিজের নীচের কালো জল আমার চোখে পড়ল। আমরা বেশ কয়েক মাইল চলে এসেছি। আকাশে মেঘ রয়েছে। তার মাঝখানে কখনও কখনও একটা-দুটো তারা একবার দেখা দিয়েই ফের মিলিয়ে যাচ্ছে। শার্লক হোমস রাস্তার দিকে মাথা নিচু করে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বুঝলাম যে, সে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। এখন কথা বললে যে ভাবে তার চিন্তাকে সাজাচ্ছে তাতে বাধা পড়বে। এতটা পথ যে এলাম বিটের কনস্টেবল ছাড়া আর কিন্তু অন্য কোনও পথচারীকে দেখতে পেলাম না। আমাদের দু’ পাশে কখনও বিরাট প্রান্তর আর মাঠ। এই ভাবে বেশ কিছু রাস্তা পেরিয়ে যাবার পর আবার একটা দুটো করে ঘরবাড়ি চোখে পড়তে লাগল। আমার মনে হল যে, আমরা একটা লোকালয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি।

হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে হোমস বলল, “ওয়াটসন, তোমার এই চুপ করে থাকবার ক্ষমতার সত্যি তুলনা হয় না। এই গুণের জন্যেই তুমি সঙ্গী হিসেবে অদ্বিতীয়। বিশ্বাস করো, এমন একজন সঙ্গীই আমার চাই, যার কাছে আমি আমার মনের সমস্ত কথা খুলে বলতে পারি। এই মুহূর্তে আমার মাথার মধ্যে যে চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা আর যা-ই হোক খুব আনন্দের নয়।

“আমরা গিয়ে পৌঁছোনো মাত্রই যে ভদ্রমহিলা আমাদের দরজা খুলে দিতে আসবেন তাঁকে যে কী বলব তা আমার মাথায় আসছে না।”

“লি-এ পৌঁছোবার আগেই তোমাকে ব্যাপারটা মোটামুটি একটা বিবরণ দিতে পারব বলে আশা করি। ব্যাপারটা এমনিতে খুবই সহজ বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, এমন কোনও সূত্র পাচ্ছি না যেটাকে ধরে এগোতে পারি। বলতে পারি যে এটা হচ্ছে একটা যেন জটপাকানো সুতো। অনেকগুলো মুখ আছে, কিন্তু মূলটা পাচ্ছি না। এখন আমি তোমাকে সব ব্যাপারটা বলছি। এমন হতে পারে যে, যদিও আমি অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না, তুমি হয়তো কোনও আলোর ফুলকি দেখতে পাবে।”

“তা হলে বলো।”

“বেশ কয়েক বছর আগে, সঠিক তারিখটা হল মে, ১৮৮৪—লি-তে এক ভদ্রলোক বাস করতে আসেন। তাঁর নাম নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার। হাবভাব দেখে মনে হত তিনি একজন বেশ বড়লোক। তিনি একটা বড় হাতাওয়ালা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে বাস করতে লাগলেন। বেশ বড়লোকি চালেই তিনি থাকতেন। আস্তে আস্তে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হতে লাগল। ১৮৮৭ সালে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর মেয়েকে তিনি বিয়ে করেন। ভদ্রলোক কোনও চাকরি করতেন না। তবে অনেক কোম্পানিতে তাঁর টাকা লগ্নি করা ছিল। সাধারণত তিনি সকালের ট্রেনে লন্ডন যেতেন আর ফিরে আসতেন ক্যানন স্ট্রিট স্টেশন থেকে ৫টা ১৪ মিনিটের ট্রেন ধরে। মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের বয়স এখন সাঁইত্রিশ। শান্ত, সুবোধ ভদ্রলোক। দুটি সন্তান নিয়ে বেশ সুখে থাকতেন। আর পাড়াপড়শিরা তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। আমি খোঁজখবর করে যতদূর জানতে পারি যে, বাজারে তাঁর দেনা হচ্ছে ৮৮ পাউন্ড ১০ শিলিং। কিন্তু ক্যাপিটাল অ্যান্ড কাউন্টিজ ব্যাঙ্কে তাঁর জমা আছে ২২০ পাউন্ড। সুতরাং এ কথা মনে করবার কোনও কারণ নেই যে, তাঁর মনে টাকাপয়সা সংক্রান্ত কোনও দুশ্চিন্তা ছিল।

“গত সোমবার মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার অন্য দিনের চেয়ে একটু সকাল সকালই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন। যাবার আগে বলে যান যে, শহরে তাঁর দুটো জরুরি কাজ আছে, আর ফেরবার পথে তিনি তাঁর ছেলের জন্যে একবাক্স খেলনা কিনে আনবেন। এখন হয়েছে কী, সেই দিনই মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার বেরিয়ে যাবার পর তাঁর স্ত্রী লন্ডন থেকে একটা টেলিগ্রাম পান। টেলিগ্রামটা এসেছিল অ্যাবারডিন শিপিং কোম্পানির অফিস থেকে। টেলিগ্রামে জানানো হয়েছে যে তাঁর বিদেশ থেকে একটা মূল্যবান জিনিস আসবার কথা ছিল। সেটা এসে গেছে। তোমার জানা আছে কিনা জানি না, অ্যাবারডিন শিপিং কোম্পানির অফিস হচ্ছে ফ্রেসনো স্ট্রিটে। ফ্রেসনো স্ট্রিটটা আবার বেরিয়েছে আপার সোয়ানডাম লেন থেকে, যেখানে তোমার সঙ্গে আমার আজ রাত্রে দেখা হল। মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে লন্ডনে যান। সেখান থেকে তাঁর জিনিসটি সংগ্রহ করে তিনি ঠিক চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিটে আপার সোয়ানডাম লেন ধরে হাঁটছিলেন স্টেশনে ফেরবার জন্যে। এতক্ষণ যা বললাম তুমি সব কথা বুঝেছ তো?”

“হ্যাঁ। সব বুঝেছি।”

“তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে, গত সোমবার অত্যন্ত গরম পড়েছিল। মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার একটা গাড়ি ধরবেন বলে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বেশ দুলকি চালে রাস্তা হাঁটছিলেন। সোয়ানডাম লেন ধরে হাঁটবার সময় হঠাৎ একটা চাপা আর্তনাদ তাঁর কানে আসে। সেই শব্দটা যে দিক থেকে এসেছিল সেই দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই তিনি একটা দোতলা বাড়ির জানলায় যে-দৃশ্য দেখলেন তাতে তিনি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দোতলার সেই জানলাটা সম্পূর্ণ খোলা ছিল। তিনি দেখলেন তাঁর স্বামী জানলা দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মনে হল তিনি যেন তাঁকে হাত নেড়ে ডাকলেন। আগেই বলেছি যে, জানলাটা একদম খোলা ছিল। তাই তাঁর দেখতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার তাঁর স্বামীর মুখটা পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন যে, সে সময়ে তাঁর স্বামীর চোখমুখ উত্তেজনায় থমথম করছিল। তাঁর স্বামী তাঁকে খুব উত্তেজিত ভাবে হাত নেড়ে ইশারা করেন। কিন্তু তাঁর পরেই মিসেস সেন্ট ক্লেয়ারের মনে হয় কেউ যেন খুব জোর করে পিছন দিকে তাঁকে টেনে নিয়ে গেল। আর একটা জিনিস লক্ষ করে মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার খুব আশ্চর্য হন। সেটা হল, যদিও তিনি যে কালো কোট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সেটা তাঁর গায়ে ছিল বটে, কিন্তু তাঁর জামার কলার বা নেকটাই কোনওটাই ছিল না।

“তাঁর স্বামীর কোনও বিপদ হয়েছে বুঝে তিনি ওই বাড়ির দিকে ছুটলেন। কোন বাড়িটার কথা বলছি বুঝতে পারছ তো? যেখানে আমার সঙ্গে তোমার আজ দেখা হল। বাড়ির দরজায় ওই পাজি ম্যানেজার দাঁড়িয়েছিল। সে আর তার সাকরেদ ডেনমার্কের গুন্ডাটা তো তাঁকে দরজার গোড়ায় আটকে দিল। তারপর তাঁকে প্রায় এক রকম জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে দিল। রাগে ভয়ে প্রায় পাগলের মতো হয়ে তিনি যখন রাস্তা দিয়ে দৌড়োচ্ছিলেন তখন ফ্রেসনো স্ট্রিটে একজন সার্জেন্ট আর কয়েকজন কনস্টেবল আসছিল। তাঁর কথা শুনে সার্জেন্ট তাঁর দলকে নিয়ে ওই আড্ডায় এসে হাজির হল। ওই আড্ডার মালিকের কোনও ওজর আপত্তি না শুনে যে-ঘরে মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার তাঁর স্বামীকে দেখেছিলেন, সার্জেন্ট সেই ঘরে গেল। সেখানে মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের টিকিটি পর্যন্ত দেখা গেল না। সে ঘরে কেন, সেই গোটা দোতলায় মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সত্যি কথা বলতে কী, একটি অত্যন্ত কুৎসিতদর্শন এক বিকলাঙ্গ ছাড়া সেখানে দ্বিতীয় কোনও প্রাণীকে দেখতে পাওয়া গেল না। ম্যানেজার আর সেই বিকলাঙ্গ লোকটি দু’জনেই খুব জোর গলায় শপথ করে বলল যে, সামনের ঘরে দুপুর থেকে কেউ আসেনি বা ছিল না। তাদের জোরালো আপত্তি শুনে সার্জেন্টও একটু দমে গেল। তার মনে সন্দেহ হতে লাগল যে, হয়তো মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার ভুল দেখেছেন। এমন সময় মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার চিৎকার করে ঘরের টেবিল থেকে একটা কাগজে মোড়া প্যাকেট তুলে নিলেন। কাগজের মোড়কটা খুলতে ছেলেদের খেলবার বিল্ডিং ব্লকের একটা বাক্স বেরিয়ে পড়ল। তোমার বোধহয় মনে আছে যে, সেইদিন মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাঁর ছেলেকে ওই রকম একটা বিল্ডিং ব্লক কিনে দেবেন বলেছিলেন।

“এই জিনিসটা পাবার পরে সেই বিকলাঙ্গ লোকটা এমন এলোমেলো কথা বলতে লাগল যে সার্জেন্টের মনে হল ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো। দোতলার ঘরগুলো ভাল ভাবে পরীক্ষা করে দেখা হল। বোঝা গেল খুব জঘন্য ধরনের একটা অপরাধ ঘটেছে। সামনের দিকে ঘরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো। দেখলেই বোঝা যায় যে, এটাকে বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পরে একটা ছোট শোবার ঘর। শোবার ঘরের পেছনে নদীর ঘাট। শোবার ঘরের জানলা আর নদীর ঘাটের মধ্যে একফালি জমি। জোয়ারের সময় অবশ্য সেটা জলের তলায় যায়। শোবার ঘরের জানলাটা খুব বড়। তলা দিয়ে ঠেলে খুলতে হয়। জানলার ফ্রেম খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, সেখানে রক্তের ছিটে লেগে আছে। শোবার ঘরের কাঠের মেঝেতেও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দেখা গেল। তারপর আরও খুঁটিয়ে তল্লাশি করতে বসবার ঘরে একটা পরদার আড়ালে মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারের কোটটি ছাড়া আর সব পোশাকই জড়ো করে রাখা আছে দেখা গেল। বোঝা গেল মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার ওই জানলা দিয়েই লাফিয়ে পড়েছেন। রক্তের দাগ দেখে মনে হল বেশ কিছুটা ধস্তাধস্তি করেই তাঁকে জানলা দিয়ে গলতে হয়েছে। তবে এটাও বোঝা গেল যে, এত চেষ্টা করেও মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার শেষরক্ষা করতে পারেননি। কেন না নদীতে সে সময় প্রচণ্ড জোয়ার ছিল। সে রকম অবস্থায় নদীতে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে নিজেকে বাঁচানো কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

“এখন এই অপরাধের সঙ্গে যে দু’জন একেবারে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত তাদের একজন হল ম্যানেজার। আর ম্যানেজারের পূর্ব ইতিহাস পুলিশের সবই জানা। তবে মিসেস সেন্ট ক্লেয়ারের কথা অনুযায়ী তিনি তাঁর স্বামীকে দেখবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ও বাড়ির দরজার গোড়ায় ম্যানেজারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সুতরাং মূল অপরাধের সঙ্গে তাঁর যোগ থাকা সম্ভব নয়। এটা বলা যেতে পারে যে, অপরাধ নিজে না করলেও সে অপরাধমূলক ঘটনাটা ঘটতে সাহায্য করেছে। ম্যানেজার নিজের পক্ষ সমর্থন করে বলল যে, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ, এ ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গ সে জানে না। আর তার দোতলার ভাড়াটে হিউ বুনের কার্যকলাপ সম্বন্ধেও সে কিছু জানে না। বস্তুত অন্যের কথায় তার নাক গলাবার প্রয়োজন বা অধিকার নেই। মিঃ হিউ বুন কিন্তু মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারের জামাকাপড় ওই ভাবে ওখানে পড়ে থাকার কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যাও দিতে পারলেন না।

“এই তো গেল ম্যানেজারের কথা। ওই যে বীভৎস বিকলাঙ্গর কথা বলেছি ওর নামই হিউ বুন। সব দিক বিচার করে দেখলে হিউ বুনই একমাত্র লোক যে মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারকে সবশেষে দেখেছে। এই লোকটাকে লন্ডন শহরের সব লোক চেনে। ও রকম ভীষণদর্শন মুখ আর লন্ডন শহরে বোধহয় দুটি নেই। ও লোকটা জাতভিখিরি। তবে পুলিশের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে ও সাধারণত দেশলাই নিয়ে বসে থাকে। ও কোথায় বসে জানো? থ্রেডনিডন স্ট্রিট দিয়ে কিছু দূর গেলে বাঁ হাতে দেখবে একটা বাড়ির দেওয়ালের কোণে ও আসনপিঁড়ি হয়ে রোজ বসে থাকে। ওর কোলের ওপর কয়েকটা দেশলাইয়ের বাক্স ছড়ানো থাকে। এমনিতে ওকে দেখলে খুব কষ্ট হয়। তার ফলে ওই রাস্তা দিয়ে যত লোক যায় তারা সকলে ওকে কিছু-না-কিছু পয়সা দিয়ে যায়। তাই ওর আয় খুব ভালই হয়। আমি নিজে ওকে বহু বার দেখেছি। অল্প সময়ের মধ্যে ও যে রকম রোজগার করে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। ওর চেহারাটাই এমন যে ওকে লক্ষ না করে কেউ চলে যেতে পারে না। মাথা-ভরতি লাল চুল। শীর্ণ মুখে একটা গভীর কাটা দাগ। যেটার জন্যে ওর গালের চামড়াটা টেনে গিয়ে ওপরের ঠোঁটটা উলটে গেছে। ওর চোখদুটো কিন্তু আশ্চর্য রকম তীক্ষ আর কালো। সব মিলিয়ে আর পাঁচটা ভিখিরির চাইতে ওকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে মনে হয়। ওর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল ও খুব চটপট উপযুক্ত জবাব দিতে পারে। ওকে যদি কেউ কিছু বাঁকা কথা বলে তো ও সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের মতো উত্তর দিয়ে দেয়। এখন এই লোকটিই আমাদের নিরুদ্দিষ্ট মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছে।”

আমি বললাম, “কিন্তু ও তো বিকলাঙ্গ! একজন বিকলাঙ্গের পক্ষে একজন সুস্থ সবল মাঝবয়সি লোককে খালি হাতে মেরে ফেলা কি সম্ভব?”।

“বিকলাঙ্গ মানে ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, পা দুটো কমজোরি। তা ছাড়া ও এমনিতে বেশ স্বাস্থ্যবান। তুমি তো ডাক্তার। সুতরাং ওয়াটসন, এ কথা তো তুমি জানো যে, দেহের কোনও অঙ্গ দুর্বল বা অপুষ্ট হলে অন্য অঙ্গ খুবই পুষ্ট হয়।”

“হুঁ, তা বটে। যাকগে, তুমি তোমার কাহিনী শেষ করো।”

“মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার তো জানলায় রক্তের দাগ দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তাই তাঁকে তক্ষুনি পুলিশের গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল। আর তা ছাড়া ওই ব্যাপারের তদন্তে তিনি কী সাহায্যই বা পুলিশকে করতে পারতেন। ওই তদন্তের ভার দেওয়া হল ইন্সপেক্টর বার্টনকে। তিনি তো ঘটনাস্থল যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন, কিন্তু কোনও রকম উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পেলেন না। অবশ্য ইন্সপেক্টর বার্টন একটা ভুল করেছিলেন। তাঁর উচিত ছিল গোড়াতেই হিউ বুনকে গ্রেফতার করা। অবশ্য সে ভুলটা তিনি পরে শুধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু যে সময়টুকু সে পেয়েছিল তাতে হয়তো সে ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সূত্র লোপ করে থাকতে পারে। তবে বুনকে তো গ্রেফতার করা হল, কিন্তু তাঁর কাছে এমন কিছু পাওয়া গেল না, যাতে ওকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যায়। অবশ্য ওর জামার আস্তিনে রক্তের ছিটে লেগেছিল। সে বলে যে, তার আঙুল কেটে যায় আর সেই রক্তের দাগ তার জামায় লেগেছিল। আর মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার হইচই শুরু করবার কিছুক্ষণ আগে সে জানলার কাছে গিয়েছিল, তখন হয়তো তার আঙুল ঘষে গিয়ে জানলার ফ্রেমে রক্ত লেগে থাকতে পারে। সে খুব জোর দিয়েই বলল যে, মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারকে সে কখনও দেখেনি। আর কী করে যে মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের জামাকাপড় ওখানে গেল সেটা ও নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার সম্বন্ধে ওর ধারণা যে, উনি ভুল দেখেছেন। যাই হোক, ওর আপত্তি সত্ত্বেও তো ওকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হল। ইন্সপেক্টর অবশ্য ওখানে থেকে গেলেন। ভাবলেন জোয়ারের জল সরে গেলে যদি কোনও সূত্র পাওয়া যায়।

“সূত্র অবশ্য পাওয়া গেল। তবে যা আশা করা গিয়েছিল তা নয়। দেখা গেল কাদায় মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের কোটটা আটকে রয়েছে। তবে মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার অথবা তাঁর দেহের কোনও চিহ্ন নেই। মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের কোটের পকেটে কী পাওয়া গেছে অনুমান করতে পারো?”

আমি বললাম, “না, অনুমান করতে পারছি না।”

‘না, তুমি আন্দাজ করতে পারবে না। কোটের সবকটা পকেট খুচরোয় ভরতি—পেনি, হাফপেনি। তাঁর পকেটে চারশো একুশটা পেনি আর দুশো সত্তরটি হাফপেনি। এবার বুঝতে পারছ যে, খুচরো পয়সার ওজনের জন্যে ওই কোটটা জোয়ারের জলে ভেসে যায়নি। কিন্তু মৃতদেহের ব্যাপারটা আলাদা। মনে হয়, কাদায়, নুড়িতে কোটটা গেঁথে গিয়েছিল, কিন্তু জলের প্রচণ্ড টানে দেহটা ভেসে যায়।”

“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি যেন বলেছিলে যে, মিঃ সেন্ট ক্লেয়ারের সব পোশাক ঘরে পুঁটুলি-করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তা হলে কি মৃতদেহের পরনে শুধু একটা কোটই ছিল।” আমি প্রশ্ন করলাম।

হোমস বলল, “না, হে, তা নয়। তবে ব্যাপারটা এই ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, এই বুন লোকটা নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারকে জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে দেয়। সে কী করবে? তার প্রথমেই মনে হবে যে, ওই জামাকাপড়গুলোর জন্যেই সে হয়তো ধরা পড়বে। প্রথমেই সে কোটটা ছুড়ে ফেলতে গেল। ফেলবার আগের মুহূর্তে তাঁর মনে হল যে, কোটটা তো ডুববে না। জলে ভাসবে। অথচ তার হাতে সময় বেশি নেই। নীচে ম্যানেজারের সঙ্গে মিসেস সেন্ট ক্লেয়ারের কথা কাটাকাটি চলছে। হয়তো ম্যানেজারের কোনও সাকরেদ এসে তাকে পুলিশ আসার খবর দিয়ে গেছে। একদম সময় নেই, যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। তখন কী করবে ভেবে সে দৌড়ে গেল তার লুকোনো ভাঁড়ারে। যতগুলো সম্ভব খুচরো পকেটগুলোয় পুরে সে কোটটা ছুড়ে ফেলে দিল। অন্য জামাগুলো নিয়েও সে একই কাজ করত, কিন্তু ততক্ষণে সে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। কোনও রকমে সে জানলাটা বন্ধ করতে পারল লোকজন উঠে আসবার আগেই।”

“এটা হয়তো হলেও হতে পারে।”

“যাই হোক, যতক্ষণ না এর চেয়ে আরও ভাল কোনও হাইপোথিসিস করা যাচ্ছে ততক্ষণ এই পথেই আমাদের এগোতে হবে। এদিকে বুনকে তো গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু থানায় গিয়ে দেখা গেল যে, কোনও অপরাধকর্ম সে আগে করেছে এমন কোনও তথ্য নেই। একথা ঠিকই যে, ভিক্ষে করাই তার পেশা, কিন্তু এমনিতে সে বেশ শান্তশিষ্ট প্রকৃতির লোক। এই তো হচ্ছে ব্যাপার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার ওখানে কী করছিল। ওখানে তার শেষ পর্যন্ত কী হল, সে কোথায় গেল, আর হিউ বুন এই সমস্ত ঘটনার সঙ্গে কী ভাবে জড়িত। এই সব প্রশ্নের কোনওটারই উত্তরের সামান্যতম ইঙ্গিত আমার জানা নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আমার এই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এর আগে আমার হাতে এমন ‘কেস’ একটিও আসেনি যেটা প্রথমে খুবই সরল বলে মনে হলেও শেষকালে অসম্ভব রকমের জটিল রূপ নিয়েছে।”

শার্লক হোমস যখন তার অদ্ভুত কেসের কথা আমাকে শোনাচ্ছিল, তখন আমরা শহর ছাড়িয়ে পল্লি অঞ্চলে এসে পড়েছি। এইমাত্র আমরা দুটো ছোট গ্রামের পাশ দিয়ে এসেছি। এখন কিছু দূরে বেশ কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম, আমরা কোনও বড় জায়গার কাছাকাছি চলে এসেছি।

হোমস বলল, “আমরা এখন লি-র কাছে এসে পড়েছি। এইটুকু পথ আসতে আমরা তিনটে কাউন্টির মধ্যে দিয়ে এসেছি। প্রথমে মিডলসেক্স, তারপর সারের কোণ ঘেঁষে, আর সবশেষে কেন্ট। ওই গাছগুলোর মধ্য দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছ ? ওইটে হল সেডার্স। ওখানে একটা জানলার ধারে বসে মিসেস সেন্ট ফ্লেয়ার উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের ঘোড়ার খুরের শব্দ ওঁর কানে গেছে।”

“কিন্তু এই তদন্তটা তুমি বেকার স্ট্রিটের বাড়ি থেকে করছ না কেন?” আমি হোমসকে জিজ্ঞেস করলাম।

“তার কারণ, বেশ কিছু অনুসন্ধান এখান থেকেই করতে হবে। মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার আমাকে দুটো ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। আর আমার বন্ধু ও সহকারী হিসেবে তিনি যে তোমার আসাতে খুবই খুশি হবেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি বলছি তোমার আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি হবে না। বুঝলে ওয়াটসন, তাঁর সামনাসামনি হতে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে, বিশেষত তাঁর স্বামীর কোনও খবরই যখন আমি আনতে পারছি না। এই আমরা এসে পড়েছি।”

আমরা একটা বড় ভিলা-ধরনের বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাড়িটা একটা প্রকাণ্ড বড় বাগানের মাঝখানে। আমাদের গাড়ি থামতেই একজন সহিস ছুটে এল। আমি হোমসের পেছনে পেছনে নুড়িঢালা পথ দিয়ে বাড়িটার সদর দরজার দিকে এগোলাম। আমরা সদর দরজার কাছে আসতেই দরজা খুলে দিলেন ছোটখাটো চেহারার এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা।

“কী, কী হল?” তিনি ব্যগ্র ভাবে প্রশ্ন করলেন। তার পরই দুটি লোককে আসতে দেখে তাঁর মুখ থেকে একটা আনন্দের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল। কিন্তু পরক্ষণেই আমার সঙ্গীর হতাশ ভাবে মাথা নাড়া দেখে ভদ্রমহিলা ফের মুষড়ে পড়লেন।

“কোনও সুসংবাদই নেই।”

“না।” হোমস উত্তর দিল।

“কোনও খারাপ খবর আছে কি?”

“না, তাও নেই।”

“ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। আসুন, ভিতরে আসুন। সারাদিন বিস্তর খাটাখাটনি করে আপনি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।”

“ইনি আমার বন্ধু ওয়াটসন। আমার অনেক তদন্তে ইনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আজ হঠাৎ সৌভাগ্যক্রমে এঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। ইনি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন।”

আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করে তিনি বললেন, “আপনি আসাতে আমার সত্যিই খুব আনন্দ হয়েছে। আশা করি এখানে থাকতে আপনার কষ্ট হবে না। যদি কিছু অসুবিধে হয় তো আমার অবস্থার কথা ভেবে আপনি সেটুকু ক্ষমা করবেন।”

আমি তাঁকে বললাম, “সে ব্যাপারে আপনার বিচলিত হবার কোনও প্রয়োজন নেই। আপনার যদি কোনও উপকারে আসতে পারি, তা হলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।”

তারপর ভদ্রমহিলা আমাদের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরের সব আলো জ্বলছে। টেবিলের ওপর রাত্রের খাবার সাজানো রয়েছে।

ভদ্রমহিলা শার্লক হোমসকে লক্ষ করে বললেন, “দেখুন মিঃ হোমস, আমি আপনাকে একটা কথা খোলাখুলি জিজ্ঞেস করতে চাই। আশা করি আপনি আমাকে তাঁর সোজাসুজি উত্তর দেবেন।”

“নিশ্চয়ই দেব।”

“আপনি আমার কথা ভাববেন না। আমার মন খুব শক্ত। আমি সহজে বিচলিত হই না। আমি আপনার নিজের মত শুনতে চাই। ভয় পাবেন না। আমি চিৎকার চেঁচামেচি করব না বা অজ্ঞান হয়ে পড়ব না।”

“কোন ব্যাপারে আপনি আমার মত জানতে চান?”

“আপনি কি সত্যি সত্যি মনে করেন যে, মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার বেঁচে আছেন?”

আমার মনে হল প্রশ্নটা শুনে শার্লক হোমস একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। “বলুন মিঃ হোমস। চুপ করে থাকবেন না।”

“সত্য কথা বলতে কী, তিনি বেঁচে আছেন বলে আমার মনে হয় না।”

“আপনার বিশ্বাস তিনি মারা গেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“তিনি কি খুন হয়েছেন?”

“তা জানি না। তবে তাই হওয়া সম্ভব।”

“কবে তিনি খুন হয়েছেন বলে আপনার ধারণা ?”

“সোমবার।”

“তা হলে মিঃ হোমস, আপনি কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন যে, কী করে তাঁর লেখা চিঠি আজকে আমি পেলাম?”

শার্লক হোমস চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। মনে হল তার শরীর দিয়ে যেন প্রচণ্ড একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে গেল।

“কী বললেন?” শার্লক হোমস চেঁচিয়ে উঠল।

“হ্যাঁ, আজকেই চিঠি পেয়েছি।” ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে একটা খাম তুলে ধরলেন।

“আমি কি চিঠিটা দেখতে পারি।”

“নিশ্চয়ই।”

ভদ্রমহিলার হাত থেকে চিঠিটা এক রকম খপ করে কেড়ে নিয়ে হোমস খামটা টেবিলের ওপর রাখল। তারপর আলোটা সরিয়ে এনে খামটা খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। আমি আমার চেয়ার থেকে উঠে এসে তার পেছনে দাঁড়ালাম। সস্তার মোটা পুরু খাম। খামের ওপর গ্রেভ্‌স এন্ড পোস্ট আপিসের ছাপ। আজকেরই তারিখ। তবে এখন বোধহয় কালকের তারিখ বলা উচিত, কেন না রাত বারোটা অনেকক্ষণ আগে বেজে গেছে।

“অপরিষ্কার কাঁচা হাতের লেখা,” হোমস বলল। “এটা নিশ্চয়ই আপনার স্বামীর হাতের লেখা নয়।”

“না। কিন্তু ভেতরের চিঠিটা তাঁর হাতের লেখা।”

“আমি বলতে পারি খামের ওপর ঠিকানাটা যে লিখেছে, তাকে খোঁজখবর করে ঠিকানা জেনে লিখতে হয়েছে।”

“সেটা আপনি কী করে বলছেন?”

“দেখুন নামটা কালো কালিতে লেখা। কিন্তু ঠিকানার বাকি অংশটা একটু ছাই রঙের। তার কারণ হচ্ছে নামটা লেখবার পর কালিটা আপনা-আপনি শুকিয়ে গেছে, কিন্তু ঠিকানার কালিটা ব্লটিং দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদি ঠিকানা আর নাম একসঙ্গে লেখা হত তা হলে কালির রঙে এই তফাত হত না। খামের ওপর নামটা লেখবার পর, বেশ কিছুক্ষণ পর, সে ঠিকানাটা লিখেছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, ঠিকানাটা তার জানা নেই। যাই হোক এটা একটা খুব সামান্য ব্যাপার। তবে এই সামান্য ব্যাপারগুলো কখনও কখনও ভীষণ রকম জরুরি হয়ে ওঠে। এবার চিঠিটা দেখা যাক। চিঠিটার সঙ্গে আর একটা কী ছিল দেখছি।”

“হ্যাঁ, তাঁর শিলমোহর করবার আংটিটা ছিল।”

“আপনি নিশ্চিত যে এটা তাঁরই হাতের লেখা।”

“হ্যাঁ, ওঁর এক ধরনের লেখা।”

“এক ধরনের লেখা, মানে?”

“উনি যখন তাড়াতাড়ি লেখেন তখন ওঁর লেখাটা এই রকম হয়ে যায়। এটা ওঁর সাধারণ হাতের লেখার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে আমি জোর করে বলছি, এ হাতের লেখা ওঁরই।”

চিঠিটা এই রকম:

“কল্যাণীয়াসু,

ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানে একটা খুব বড় রকমের ভুল হয়েছে। ঠিকঠাক করতে কিছু সময় নেবে। ধৈর্য ধরো। ইতি নেভিল।”

“চিঠিটা একটা অক্‌টেভো আকারের বইয়ের পুস্তানিতে পেনসিল দিয়ে লেখা। কাগজে কোনও জলছাপ নেই। চিঠিটা আজকেই গ্রেভ্‌স এন্ড থেকে ফেলা হয়েছে। যে ফেলেছে তার বুড়োআঙুলে ময়লা লেগেছিল। খামটা থুতু দিয়ে আটকানো হয়েছে। যে জুড়েছে সে তামাকপাতা চিবোয়।… আর এ চিঠি যে আপনার স্বামীর লেখা সে বিষয়ে আপনার মনে কোনও সন্দেহই নেই?”

“না। এ চিঠি তাঁরই লেখা।”

“আর চিঠিটা আজই গ্রেভ্‌স এন্ডে ফেলা হয়েছে। মিসেস ক্লেয়ার, মেঘ কাটতে শুরু করেছে, তবে বিপদ যে একদম কেটে গেছে তা বলব না।”

“কিন্তু, মিঃ হোমস, তিনি তো নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন?”

“হ্যাঁ, যদি না অবশ্য আমাদের ভুল দিকে চালাবার জন্যে এই চিঠিটা কেউ জাল করিয়ে থাকে। আংটিটা অবশ্য কিছু প্রমাণ করে না। ওটা তিনি নিজেও দিয়ে থাকতে পারেন অথবা কেউ জোর করে কেড়ে নিয়েও থাকতে পারে।”

“না, না। এটা নিশ্চয়ই তাঁরই হাতের লেখা।”

“ভাল কথা। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে এটা সোমবারেই লেখা হয়েছিল, কিন্তু ফেলা হয়েছে আজকে।”

“তা অবশ্য হতেও পারে।”

“তা যদি হয় তবে এই ক’দিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটাই সম্ভব।”

“না, মিঃ হোমস, আপনি একথা বলবেন না। আমার মন বলছে তিনি সুস্থ আছেন।”

“আমি অনেক দেখেছি মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার। আমি জানি মানুষের মন অনেক সময় এমন অনেক সত্য জানতে পারে যা বিচার আর বুদ্ধির বিশ্লেষণে ধরা পড়ে না। আর এই চিঠিটা অবশ্য আপনার মনে হওয়ার পক্ষে মস্ত বড় একটা প্রমাণ। কিন্তু যদি আপনার স্বামী সুস্থ থাকেন, তবে কেন তিনি এ রকম ভাবে আপনাদের থেকে আলাদা থাকছেন ?”

“অনেক ভেবেও আমি এর কোনও সদুত্তর পাচ্ছি না মিঃ হোমস।”

“আচ্ছা, সোমবার দিন এখান থেকে যাবার আগে তিনি কি এমন কথা বলেছিলেন যে, তাঁর ফিরতে দিন কয়েক দেরি হবে।”

“না।”

“আচ্ছা, সোয়ানডাম লেনে তাঁকে দেখে আপনি কি আশ্চর্য হয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম।”

“ঘরের জানলাটি খোলা ছিল ?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, তিনি কি আপনাকে দেখতে পেয়ে ডেকেছিলেন?”

“হ্যাঁ, তাই আমার মনে হয়েছিল।”

“আমি শুনেছি যে তিনি গলা থেকে একটা অর্থহীন শব্দ করেছিলেন মাত্র।”

“হ্যাঁ।”

“আপনার মনে হয়েছিল তিনি সাহায্যের জন্যে ডেকেছিলেন?”

“হ্যাঁ। তিনি হাত নাড়ছিলেন।”

“কিন্তু এও তো হতে পারে যে, তিনি হঠাৎ ওই জায়গায় আপনাকে দেখে এতই আশ্চর্য হয়েছিলেন যে, তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে আওয়াজ করেছিলেন, আর ওই বিস্ময়ের ঘোরেই তিনি হাত তুলেছিলেন।”

“এটা সম্ভব।”

“আপনার মনে হয়েছিল তাঁকে পেছন থেকে ধরে কেউ যেন টেনে সরিয়ে নিল?”

“হ্যাঁ, এমন ভাবে হঠাৎ তিনি ওইখান থেকে সরে গেলেন যে, আমার সেই রকমই মনে হয়েছিল।”

“তিনি হয়তো পেছনদিকে সরে গিয়েছিলেন। আচ্ছা, ওই ঘরে আপনি আর কাউকে দেখেননি?”

“না, তবে ওই বিচ্ছিরি দেখতে লোকটা নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে ওই ঘরের মধ্যে ছিল আর ম্যানেজার ছিল সিঁড়ির গোড়ায়।”

“ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, আপনার স্বামী কি সাধারণ পোশাকই পরেছিলেন।”

“হ্যাঁ, কিন্তু তাঁর টাই বা জামার কলার ছিল না। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, আমি তাঁর খালি গলা দেখেছিলুম।”

“আচ্ছা, তিনি কি আগে কখনও সোয়ানডাম লেনের কথা আপনাকে বলেছিলেন?”

“না।”

“আচ্ছা, তিনি কি আফিমসেবী ছিলেন?”

“না।”

“ঠিক আছে, মিসেস সেন্ট ক্লেয়ার। এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর জানার খুব প্রয়োজন ছিল। এখন আমরা রাত্রের খাওয়া সেরে বিশ্রামের আয়োজন করব। কাল সারা দিনটাই খুব ব্যস্ততার মধ্যে হয়তো কাটবে।”

বিরাট একটা সাজানো গোছানো ঘর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের মধ্যে দুটো শোবার খাট। আজকের নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের পর আমি খুব ক্লান্তি অনুভব করছিলাম, তাই কালবিলম্ব না করে শুয়ে পড়লাম। শার্লক হোমস এমনই লোক যে, যখন তার মনের মধ্যে কোনও সমাধান-না-করা রহস্যের খবর আসে তখন সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কখনও এক সপ্তাহেরও বেশি সময় বিশ্রাম না করে থাকতে পারে। তখন সে প্রতি মুহূর্তে ওই ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে থাকে, যতক্ষণ না সে একটা সমাধানের সূত্র খুঁজে পায় অথবা সে স্থিরনিশ্চিত হয় যে, তার হাতে যে-সব সূত্র আছে তা সমস্যার সমাধানের জন্যে যথেষ্ট নয়। আমি বুঝতে পারলাম যে, হোমস সারা রাত্রি বসে বসেই কাটিয়ে দেবে। কোট আর ওয়েস্টকোটটা খুলে রেখে সে একটা ঘন নীল রঙের ড্রেসিংগাউন গায়ে চাপিয়ে নিল। তারপর বালিশ আর কুশনগুলো এক জায়গায় জড়ো করে একটা সিংহাসনের মতো করে নিয়ে তার ওপর পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে পড়ল। সামনে একটা ছোট টেবিলে তার পাইপ, তামাক আর দেশলাই সাজানো। ঘরের অস্পষ্ট আলোয় আমি দেখলাম হোমস একটা পুরনো ব্রায়ার পাইপে তামাক পুরে আগুন ধরিয়ে টানছে। আর নীল ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাতাসে ভাসছে। তার চোখ খোলা। আমার মনে হল যে, সে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বটে কিন্তু কিছুই তার চোখে পড়ছে না। আমি এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। … হঠাৎ একটা চিৎকারে যখন আমার ঘুম ভাঙল দেখলাম হোমস তখনও ঠিক একই ভাবে বসে আছে। সূর্যের আলো এসে ঘরে পড়েছে। তবে সারা ঘর ধোঁয়ায় ভরতি। টেবিলের দিকে তাকালাম। আগের রাতের তামাকের বান্ডিলের একটা টুকরোও নেই।

“কী ওয়াটসন, ঘুম ভাঙল?” হোমস প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ।”

“সকালবেলায় ঘোরাঘুরি করতে রাজি আছ কি?”

“নিশ্চয়ই?”

“তা হলে চটপট তৈরি হয়ে নাও। যদিও এ বাড়ির কেউই এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি, তবে সহিসরা কোথায় থাকে আমার তা জানা আছে। গাড়ি জোগাড় করতে কিছু অসুবিধা হবে না।”

লক্ষ করলাম, হোমস কথা বলতে বলতে বেশ মুচকি মুচকি হাসছে। তার চোখও খুশিতে চকচক করছে। এ যেন কাল রাত্তিরের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গম্ভীর লোকটি নয়, অন্য আর কেউ। জামা পরতে পরতে ঘড়ি দেখলাম। চারটে বেজে পঁচিশ। তাই বাড়ির লোকরা যে এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমি তৈরি হবার আগেই হোমস এসে খবর দিল গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে।

জুতো পরতে পরতে হোমস বলল, “আমি আমার একটা থিয়োরি পরীক্ষা করে দেখতে চাই। বুঝলে ওয়াটসন, এই মুহূর্তে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত ইউরোপের মধ্যে সব চাইতে বোকা আহাম্মক লোকটা। আমাকে এখন এখান থেকে চেয়ারিং ক্রস পর্যন্ত লাথি মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া উচিত। তবে হ্যাঁ, রহস্যের চাবিকাঠি এখন আমি পেয়ে গেছি।”

“কোথায় সেই চাবিকাঠি?”

“বাথরুমে,” হোমস উত্তর দিল। “না, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করছি না। এইমাত্র চাবিকাঠিটি সেখান থেকে নিয়ে এসে আমার গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগে রেখেছি। এখন পরীক্ষা করে দেখতে হবে ওই কাঠিতে তালা খোলে কি না।”

আমরা নীচে নেমে এলাম। বাইরে ভোরের সূর্যের আলোয় সবকিছু ঝলমল করছে। সদ্য ঘুম-থেকে-ওঠা একজন অল্পবয়সি সহিস আমাদের জন্যে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। দেখলাম যে, হোমসের তাড়ার চোটে বেচারা ভাল করে জামাটা পর্যন্ত পরতে পারেনি। আমরা লাফিয়ে গাড়িতে উঠে সোজা লন্ডনের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। রাস্তার দু’ধারের বাড়িগুলো এখনও ঘুমে নিঝুম। মাঝে মাঝে দু’একটা সবজি-ভরতি গাড়ি লন্ডনের দিকে চলেছে।

ঘোড়াটাকে জোরে ছুটিয়ে হোমস বলল, “অনেকগুলো দিক দিয়ে এই কেসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে আমি কিছু ধরতেই পারিনি। দিনেরবেলায় ছুঁচোর যেমন অবস্থা। তবে কী জানো, ওই যে কথায় বলে একদম না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভাল।”

শহরে পৌঁছে দেখলাম যে, যারা ওরই মধ্যে একটু ভোর ভোর ওঠে, তারা ঘুম-চোখে জানলা দিয়ে আমাদের এই দুরন্ত গতিতে ছুটে যাওয়া দেখছে। ওয়াটারলু ব্রিজ স্ট্রিট ধরে নদী পার হয়ে আমরা ওয়েলিংটন স্ট্রিট ধরে চললাম। তারপর গেলাম বো স্ট্রিটে। শার্লক হোমসকে পুলিশের লোকরা খুব ভাল ভাবেই চেনে। আমাদের গাড়ি বো স্ট্রিট থানায় ঢুকতেই একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে ঘোড়ার লাগামটা ধরল।

“এখন ডিউটিতে কে আছে?” হোমস কনস্টেবলটিকে জিজ্ঞেস করল।

“ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট, স্যার।”

“এই যে ব্র্যাডষ্ট্রিট, কেমন আছেন?” একজন লম্বা-চওড়া চেহারার পুলিশ ইন্সপেক্টর আপিসবাড়ির পাথরের মেঝেয় জুতোয় খটাখট শব্দ করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। “আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।”

“নিশ্চয়ই, মিঃ হোমস। চলুন আমার আপিসঘরে যাই।”

আপিসঘরটা ছোট। ব্র্যাডস্ট্রিটের টেবিলের ওপরে একটা বিরাট আকারের লেজার খাতা বসানো। ঘরের দেওয়ালে টেলিফোন লাগানো। আমাদের বসতে বলে ব্র্যাডস্ট্রিট তার নিজের চেয়ারে বসল।

“বলুন, মিঃ হোমস, আপনার জন্যে কী করতে পারি ?”

“আমি হিউ বুন, মানে সেই ভিখিরি যাকে মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারের অন্তর্ধানের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তার সম্বন্ধে কথা বলতে এসেছি।”

“ও হ্যাঁ, তাকে ধরা হয়েছে। আরও তদন্তের জন্যে তাকে কয়েদে রাখা হয়েছে।”

“হ্যাঁ, সে কথা আমি শুনেছি। ভাল কথা, সে কি এখানে আছে?”

“হ্যাঁ। সেলে আছে।”

“সে কি এমনিতে চুপচাপ থাকে?”

“হ্যাঁ। তবে চুপচাপ থাকলে কী হবে, লোকটা ভয়ানক নোংরা।”

“নোংরা?”

“হ্যাঁ মিঃ হোমস। ওর মুখের চেহারা দেখলে আপনার মনে হবে যেন চায়ের দোকানের কেটলির তলা—এমন কালো! অনেক চেষ্টা করেও ওকে পরিষ্কার করতে পারিনি। যাক, ওর কেসের ফয়সালা হয়ে গেলে জেলখানায় ওকে জোর করে চান করিয়ে দেব। আপনি যদি ওকে দেখেন তো বলবেন যে, এখনই চান করে পরিষ্কার হওয়াটাই ওর সবচাইতে বেশি দরকার।”

“আমি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

“আপনি দেখা করবেন? কোনও অসুবিধে নেই। এদিকে আসুন…ব্যাগটা কি এখানেই রেখে যাবেন?”

“না, ব্যাগটা নিয়ে যাব।”

“বেশ। এদিকে আসুন।”

ব্র্যাডস্ট্রিট আমাদের একটা বারান্দা দিয়ে নিয়ে গেল। তারপর একটা গরাদ লাগানো দরজার চাবি খুলে একটা সিঁড়ি দিয়ে নামল। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে আবার একটা চুনকাম করা বারান্দা। বারান্দার দু’দিকে সারি সারি দরজা।

ইন্সপেক্টর বলল, “ডানদিকের তিন নম্বর খুপরিতে আছে। এই যে এসে গেছি।” তারপর দরজার ওপরের দিকে একটা গর্ত দিয়ে দেখে নিয়ে বলল, “ও এখন ঘুমোচ্ছে। এখানে সরে আসুন, তা হলে দেখতে পাবেন।”

আমরা দু’জনে গর্ত দিয়ে দেখলাম। কয়েদি আমাদের দিকে মুখ করে গভীর ভাবে ঘুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে নিশ্বাস পড়ছে। গড়ন মাঝারি। জামাকাপড় খুব ময়লা। কোটের যে জায়গাটা ছিঁড়ে গেছে সেখান থেকে তাঁর রঙিন জামা দেখা যাচ্ছে। ইন্সপেক্টর যা বলেছিল, তার চেহারা-পোশাক সবই খুব নোংরা। তার চোখের কোণ থেকে গাল পর্যন্ত একটা গভীর ক্ষতের দাগ। গালের মাংস কুঁচকে যাওয়ায় তার ওপরের ঠোঁটটা অনেকখানি উলটে গেছে। তার ফলে সামনের তিনটে দাঁত সব সময়েই বেরিয়ে থাকে। দেখলে মনে হয় যেন কামড়াতে আসছে। তার মুখের কুশ্রীতা প্রথম দর্শনেই চোখে পড়ে। তার মাথা-ভরতি লাল চুল কপালে এসে পড়েছে।

“ওকে দেখে কী মনে হচ্ছে?” ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ, ভাল করে চান করাটা ওর অবশ্যই দরকার। আমারও মনে হয়েছিল যে, ওকে হয়তো চান করাতে হতে পারে। তাই আমি জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছি।” হোমস আমাদের তার গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুলে দেখাল। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে, ব্যাগের মধ্যে একটা স্পঞ্জের টুকরো।

ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট হাসি চাপতে না পেরে বলল, “আপনি তো ভারী মজার লোক দেখছি, মিঃ হোমস।”

“এখন আপনি যদি দয়া করে চুপি চুপি ঘরের দরজাটা খুলে দেন তো আমরা ওকে ভদ্রস্থ করে তুলতে পারি।”

“তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। সত্যি কথা বলতে কী, ওর এই রকম দশা দেখলে লোকে বো স্ট্রিট পুলিশ থানার কাজের নিন্দে করবে।”

ইন্সপেক্টর তার চাবি দিয়ে তালা খুললে আমরা পা টিপে টিপে ঘরে গেলাম। কয়েদি ঘুমের ঘোরেই একবার পাশ ফিরে উঁ-আঁ করেই ঘুমিয়ে পড়ল।

হোমস ঘরের ভেতরে রাখা জলের জায়গা থেকে স্পঞ্জটা ভিজিয়ে নিল। তারপর কেউ কিছু বোঝবার আগে কয়েদির মুখে স্পঞ্জটা বার-দুই ঘষে দিল।

“আসুন,” হোমস বলল, “আপনাদের সঙ্গে কেন্ট কাউন্টির লি অঞ্চলের বাসিন্দা মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারের পরিচয় করিয়ে দিই।”

আমার জীবনে এ রকম দৃশ্য আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। গাছের ছাল ছাড়িয়ে দিলে যেমন হয়, লোকটির মুখ হুবহু সেই রকম দেখাচ্ছিল। তার মুখের তামাটে ধরনের নোংরা ছাপটা বেমালুম মিলিয়ে গেছে। গালের সেই বীভৎস কাটা দাগটা, যেটার জন্যে তার ওপরের ঠোঁটটা পর্যন্ত বেঁকে গিয়েছিল, সেটাও অদৃশ্য হয়েছে। অল্প জোরে টানতেই তার মাথার নকল লাল চুলের ‘উইগ’টা খুলে গেল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, বিছানায় বসে আছেন সুশ্রী এক ভদ্রলোক। তাঁকে খুব বিমর্ষ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ভদ্রলোকটিও ব্যাপার দেখে কম হকচকিয়ে যাননি। তিনি দু’হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে কী ঘটল তাই বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। আমি আরও লক্ষ করলাম যে, তাঁর মাথার চুল ঘন কালো।

“আরেব্বাস, কী কাণ্ড। এ যে দেখছি সেই নিখোঁজ-হওয়া ভদ্রলোক। আমি তার ছবি দেখেছি।” ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট চেঁচিয়ে উঠলেন।

ভদ্রলোক যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি ধরা পড়ে গেছেন, তখন খানিকটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, “বেশ তো। আমাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে জানতে পারি কি?”

“মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারকে লোপাট করে দেবার… নাহ্,” ইন্সপেক্টর হেসে ফেলে বললেন, “আপনার বিরুদ্ধে সে অভিযোগ আনা যাবে না। সত্যি কথা বলতে কী, আমি সাতাশ বছর পুলিশে চাকরি করছি, আজকের অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না।”

ভদ্রলোক বললেন, “যদি আমিই নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার হই তা হলে বোঝা গেল যে, কোনও রকম অপরাধকৰ্ম ঘটেনি, আর আমাকে অন্যায় ভাবে আটকে রাখা হয়েছে।”

“না, কোনও অপরাধ হয়নি, তবে মস্ত বড় একটা ভুল হয়েছে। আপনার উচিত ছিল আপনার স্ত্রীকে সব কথা খুলে বলা,” হোমস বলল।

“আমি আমার স্ত্রীর কাছে গোপন করতে চাইনি। ব্যাপারটা আমার ছেলেমেয়ের কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। আমি চাইনি যে, তারা তাদের বাবার কোনও কাজের লজ্জা পাক। এখন তো সব জানাজানি হয়ে যাবে! কী লজ্জা! হে ভগবান!”

বুঝতে পারলাম যে দুঃখে, লজ্জায় ভদ্রলোক একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। শার্লক হোমস বিছানায় তার পাশে বসে পরম বন্ধুর মতো তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “দেখুন মিঃ সেন্ট ক্লেয়ার, ব্যাপারটা যদি কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় তা হলে অবশ্য জানাজানি হবেই। কিন্তু আপনি যদি সব কথা খোলাখুলি ভাবে পুলিশকে বলেন এবং তারা যদি বুঝতে পারে যে, আপনি সত্যি কথা বলেছেন এবং আপনার বিরুদ্ধে কোনও রকম অপকর্মের অভিযোগ দাঁড় করানো যাবে না, তা হলে বোধহয় ব্যাপারটা গোপন রাখা শক্ত হবে না। আপনি যা বলবেন ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট সেসব কথা লিখে নিয়ে তাঁর ওপরওয়ালার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আর ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত যাবে না।”

“ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। আমি জেলে বন্দি থাকতে, এমনকী, ফাঁসিকাঠে ঝুলতেও রাজি আছি, কিন্তু এই সব কথা ফাঁস হলে আমার ছেলেমেয়ের জীবনে যে কলঙ্কের দাগ লাগবে তা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। …ঠিক আছে আপনাদের কাছে আমি আমার সব কথা বলব। আমার বাবা চেস্টারফিল্ডে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমি সেখানে পড়াশোনা করেছি। লেখাপড়ায় আমি বেশ ভাল ছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে আমি একটা থিয়েটারের দলে যোগ দিই। এরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাটক করত। আমি এদের সঙ্গে অনেক ঘুরেছি। শেষকালে আমি লন্ডনে এসে একটি সান্ধ্য দৈনিকপত্রের আপিসে রিপোর্টারের চাকরি নিই। আমাদের পত্রিকার সম্পাদক শহরের ভিখিরিদের ওপর একটা বিস্তারিত ‘ফিচার’ ছাপবার কথা বলেন। আমি কাজটার দায়িত্ব নিলাম। সেই হল আমার কাহিনীর সূত্রপাত। আমি ভাবলাম যে, আমি যদি ভিখিরি সেজে ভিক্ষে করি তা হলে হয়তো সঠিক খবর জোগাড় করতে পারব। আমি আগে অভিনয় করতাম। আমার পক্ষে ‘মেকআপ’ নেওয়া খুবই সোজা। আর তা ছাড়া গ্রিনরুমের কাজটায় আমার হাতও ছিল বেশ ভাল। আমি এমন ‘মেকআপ’ নিলাম, যাতে চট করে লোকের নজরে পড়ে আর লোকের মনে করুণা হয়। গালে একটা কাটা দাগ করে ওপরের ঠোঁটটা রং করা স্টিকিং প্লাস্টার দিয়ে আটকে দিলাম। শহরের সবচেয়ে ভিড়ের রাস্তায় কয়েকটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে বসে গেলাম। ঘণ্টা সাতেক বসে থাকার পর আমি বাড়ি ফিরে অবাক হয়ে দেখলাম যে, আমি ছাব্বিশ শিলিং চার পেনি উপায় করেছি।

“আমি আমার লেখাটা তৈরি করে দিয়ে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। ইতিমধ্যে হয়েছে কী কোনও একটা ব্যাপারে আমার এক বন্ধুর হয়ে আমি জামিন দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন কোর্ট থেকে আমার ওপর নির্দেশ এল পঁচিশ পাউন্ড জমা দেবার জন্যে। আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। এক্ষুনি পঁচিশ পাউন্ড পাই কোথায়? ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এল। আমি অনেক বলেকয়ে পনেরো দিন সময় নিলাম। আর আপিস থেকেও দিন পনেরো ছুটি নিলাম। তারপর ছদ্মবেশ ধরে শহরে ভিক্ষে করতে শুরু করলাম। দশ দিনেই টাকাটা উঠে গেল। আমি পাওনাদারকে শোধ করলাম।

“এর পরই আসল গণ্ডগোলটা বাধল। খবরের কাগজের আপিসে ঘন্টার পর ঘণ্টা ঘাড় গুঁজে কাজ করে আমি সপ্তাহের শেষে পেতাম মাত্র দু’পাউন্ড। অখচ মুখে একটু রংচং মেখে আর রাস্তায় টুপি পেতে চুপচাপ বসে থেকে আমি এক দিনেই দু’পাউন্ড রোজগার করতে পারি। আমার মনের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলতে লাগল। একদিকে আত্মসম্মান, আর একদিকে সহজে পয়সা উপায়। শেষ পর্যন্ত লোভেরই জয় হল। আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। দিনের পর দিন ওই একই জায়গায় বসে ভিক্ষে করতে লাগলাম। আমার আয় খুব ভাল হত। একজন লোকই আমার আসল পরিচয় জানত। সে হল ওই আফিম-আড্ডার ম্যানেজার। সোয়ানডাম লেনে তার ঘর থেকে আমি সকালবেলায় ভিখিরি আর সন্ধেবেলা ভদ্রলোক সেজে বেরিয়ে আসতাম। এই ম্যানেজারকে আমি নিয়মিত ভাল টাকা দিতাম। তাই জানতাম যে আমার গোপন কথা ফাঁস হবার কোনও ভয় নেই।

“অল্প দিনের মধ্যে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেললাম। না, আমি একথা মোটেই বলছি না যে, লন্ডন শহরের সব ভিখিরিই বছরে সাত-আটশো পাউন্ড রোজগার করে। তবে আমার আয় অবশ্য সাতশো পাউন্ডের ঢের বেশি। তার কারণ হল আমার মেকআপের কেরামতি আর দ্বিতীয় কারণ আমার লোকের মুখের ওপর ঝটপট জবাব দেবার ক্ষমতা। সত্যি কথা বলতে কী লোকের কথার জবাব দিতে দিতে আমার উত্তরগুলোও বেশ চোখা আর লাগসই হয়ে উঠছিল। অল্প দিনের মধ্যেই শহরের অনেক লোক আমাকে চিনে গেল। যেদিন আমার সবচেয়ে কম আয় হত সেদিন দু’পাউন্ড পেতাম।

“পয়সা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার নানা রকম ইচ্ছে হতে লাগল। আমি লি অঞ্চলে একটা বড় বাড়ি ভাড়া করলাম। বিয়ে করলাম। ছেলেমেয়ে হল। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল। কিন্তু আমার রোজগারের আসল পথটা যে কী, তা কেউই জানত না। আমার স্ত্রী জানেন যে, শহরে আমার ব্যবসা আছে, তবে ব্যবসাটা কীসের সেটা জানেন না।

“গত সোমবার কাজ সেরে আমি যখন আমার ওই আস্তানায় জামাকাপড় বদলে ভদ্রলোক সাজছিলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম যে, আমার স্ত্রী রাস্তা থেকে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। ওখানে ওই সময়ে তাঁকে দেখে আমি এতই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠি। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে একছুটে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে সব কথা বলি যে, সে যেন যে-কোনও উপায়ে আমার স্ত্রীকে নীচে আটকে রাখে। তারপর আমি আমার ঘরে চলে এসে শুনতে পেলাম যে, তিনি নীচে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছেন। অবশ্য আমি জানতাম যে, খুব সহজে তিনি ওপরে উঠে আসতে পারবেন না। এরই মধ্যে আমি আবার ভদ্রলোকের সাজ ছেড়ে ভিখিরির পোশাক পরে নিই। আমার ছদ্মবেশ এত নিখুঁত যে, আমার স্ত্রী-ও আমাকে দেখে চিনতে পারেননি। কিন্তু তখন আমার মনে হল যে, আমার ঘরে তল্লাশি হতে পারে। তা হলে তো ধরা পড়ে যাব। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে আমি জোর করে নদীর দিকে জানলাটা খুলতে গেলাম। সকালবেলায় বাড়িতেই আমার হাত কেটে গিয়েছিল, তখন ঘষটানিতে আবার রক্ত পড়তে আরম্ভ করল। তখন আমি আমার কোটের পকেটে খুচরো ভরতি করে টেম্‌সে ছুড়ে দিলাম। অন্য জামাকাপড়গুলোও সেই ভাবেই ফেলে দিতাম, কিন্তু তার আগেই পুলিশ এসে পড়ল। কিন্তু এরই মধ্যে আমার এই ভেবে মজা লাগল যে, আমার ছদ্মবেশ তো ধরা পড়লই না, উলটে আমাকেই নেভিল সেন্ট ক্লেয়ারের খুনি বলে গ্রেফতার করা হল।

“এর বেশি আমার আর কিছু বলবার নেই। আমি আমার ছদ্মবেশেই থাকতে চেয়েছিলাম বলেই মুখটুখ না ধুয়ে এমনি নোংরা সেজে থেকেছি। আমি জানতাম যে, আমার স্ত্রী খুবই চিন্তা করবেন। তাই আমি তাঁর নামে একটা চিঠি লিখে ম্যানেজারকে দিই ফেলে দেবার জন্যে।”

হোমস বলল, “সে চিঠি তিনি পেয়েছেন কালকে মাত্র।”

“ওহ, তা হলে এ ক’টা দিন তার খুব মনের কষ্ট আর উদ্বেগ গেছে।”

ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট বলল, “পুলিশ ওই ম্যানেজারকে নজরে রেখেছিল, সেই জন্যেই ও তাড়াতাড়ি চিঠি ফেলতে পারেনি। হয়তো সে কোনও জাহাজি লোককে ওই চিঠিটা ফেলতে দিয়েছিল, আর সে ঠিক সময়মতো ফেলেনি।”

শার্লক হোমস সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তাই হবে। আচ্ছা, মিঃ নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার, ভিক্ষে করবার জন্যে আপনার কোনও জরিমানা হয়নি ?”

“হবে না কেন? তবে আমার রোজগারের তুলনায় সে জরিমানা কিছুই নয়।”

ব্র্যাডস্ট্রিট বলল, “সব ব্যাপারটা আমরা গোপন রাখতে পারি, যদি হিউ বুন চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়।”

নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার বললেন, “সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন। আমি ভগবানের নামে দিব্যি করে বলছি যে, হিউ বুন আর কোনও দিনই ফিরে আসবে না।”

“তা হলে ঠিক আছে। সমস্যাটার সমাধান করে দেবার জন্যে মিঃ হোমস, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে কী ভাবে সমাধান করলেন জানতে পারলে সুখী হতাম।”

হোমস বলল, “পাঁচটা বালিশে ঠেস দিয়ে সারা রাত্রি জেগে বসে আর এক আউন্স কড়া তামাক সেবন করে এই সমস্যার সমাধান করেছি।” তারপর আমাকে বলল, “চলো ওয়াটসন, বেকার স্ট্রিটে গিয়ে জলযোগ করা যাক।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন