আর্থার কোনান ডয়েল
আমি আর আমার স্ত্রী সকালবেলায় বসে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের কাজের মেয়েটি একটা টেলিগ্রাম নিয়ে হাজির হল। টেলিগ্রাম করেছে শার্লক হোমস। সে লিখেছে:
“দু’-চার দিনের জন্যে আসতে পারবে ? বস্কোম্ব ভ্যালিতে যে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে সে ব্যাপারে তদন্ত করবার জন্যে ওই অঞ্চল থেকে ডাক এসেছে। যদি আসো তো খুশি হব। ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য আর আবহাওয়া খুব ভাল। প্যাডিংটন থেকে ১১-১৫ মিনিটের গাড়িতে যাব।”
আমার স্ত্রী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ভাবছ? যাবে নাকি?”
“কী করব বুঝতে পারছি না। হাতে এখন অনেকগুলো রুগি রয়েছে।”
“তুমি আনষ্ট্ৰাথারকে বলে যাও। সে তোমার রুগিদের চিকিৎসা করবে। তোমার শরীরটা ক’দিন দেখছি একটু শুকনো দেখাচ্ছে। দু’-চার দিন একটু বাইরে থেকে ঘুরে এলে তোমার পক্ষে ভালই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, শার্লক হোমসের তদন্তে তোমার এত আগ্রহ যখন, তখন তোমার যাওয়াই উচিত।”
“শার্লক হোমসের সঙ্গে থেকে আমার নিজেরও কম লাভ হয়নি,” আমি হেসে জবাব দিলাম। তারপর বললাম, “যেতে হলে কিন্তু এখনই গোছগাছ করতে হবে। হাতে আর মোটে আধঘণ্টা সময় আছে।”
মিলিটারি-ডাক্তার হিসেবে আমি কিছুদিন আফগানিস্থানে ছিলাম। সেই সময়ে আমাদের ক্যাম্পে থাকতে হত, আর হঠাৎ প্রায় বিনা নোটিসেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হত। এর ফলে আমার একটা ভাল শিক্ষা হয়েছিল। সেটা হল যে কোথাও যেতে টেতে হলে আমি খুব চট করে তৈরি হতে পারি। আর আমার মোটঘাটও হয় যৎসামান্য। তার ফলে আমি আধঘণ্টার অনেক আগেই আমার সুটকেস নিয়ে একটা ভাড়া-গাড়িতে চেপে প্যাডিংটনের দিকে রওনা হলাম। শার্লক হোমস প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছিল। শার্লক হোমস এমনিতেই রোগা আর লম্বা। তার ওপর মাথার ক্যাপ আর গায়ের লং কোটের জন্যে হোমসকে আরও লম্বা আর রোগা দেখাচ্ছিল।
আমাকে দেখে হোমস বলল, “যাক ওয়াটসন, তুমি এসেছ। খুব ভাল হয়েছে। সঙ্গে যদি এমন কেউ থাকে যার ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারি, তা হলে আমার কাজের সুবিধা হয়। স্থানীয় লোকেরা হয় কোনও কর্মের নয়, নয়তো তারা কোনও-না-কোনও পক্ষের লোক। তুমি গাড়িতে উঠে দুটো জানলার ধারের জায়গা রাখো। আমি টিকিট কেটে আনি।”
আমরা যে-কামরাটায় উঠলাম সেটাতে আর কোনও যাত্রী ছিল না। হোমস এক বান্ডিল খবরের কাগজ সঙ্গে করে এনেছিল। গাড়ি ছাড়তেই সে খবরের কাগজগুলো পড়তে লাগল। মাঝে মাঝে একটা কাগজে কী সব টুকে নিচ্ছিল, আবার কখনও কখনও গভীর ভাবে কী যেন চিন্তা করছিল। যখন আমরা রেডিংয়ে পৌঁছোলাম, হোমস খবরের কাগজগুলো তাড়া বেঁধে একপাশে সরিয়ে রাখল।
হোমস আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই কেসটার সম্বন্ধে তুমি কি কিছু জানো?”
“না, কিছুই জানি না। কয়েকদিন কাজের এমন চাপ পড়েছিল যে, খবরের কাগজই ভাল করে পড়তে পারিনি।
“লন্ডনের কাগজে এই ব্যাপারটার সম্বন্ধে বিশেষ কোনও খবর বেরোয়নি। এতক্ষণ ধরে সব কাগজগুলো পড়লাম, যাতে সবকিছু সম্বন্ধে আমার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়। যেটুকু জানতে পেরেছি তার থেকে বুঝেছি যে, এটা সেই ধরনের সহজ মামলা, যার ফয়সালা করা খুবই কঠিন কাজ।”
“এটা কি সোনার পাথরবাটি গোছের ব্যাপার হল না।”
“হতে পারে, তবে কথাটা ঠিক। কোনও কেস যদি খুব অভিনব বলে মনে হয় তো জানবে যে, সেই অভিনবত্বই একটা বড় সূত্র। যে-কেস যত বেশি সাদামাটা, যত বেশি সরল বলে মনে হবে জানবে সেই কেসে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া তত বেশি শক্ত। এই ব্যাপারটায় যে-লোকটি খুন হয়েছে তারই ছেলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে।”
“এটা তা হলে একটা খুনের তদন্ত,” আমি বললাম।
“হ্যাঁ, সেই রকমই অনুমান করা হচ্ছে। তবে যতক্ষণ না আমি নিজের চোখে সব দেখছি। ততক্ষণ এটা খুনের তদন্ত কিনা সে বিষয়ে আমি কোনও মতামত দেব না। তবে ইতিমধ্যে এই রহস্যজনক ব্যাপারটার সম্বন্ধে আমি যা জানতে পেরেছি তা তোমাকে সংক্ষেপে বলছি।
“হারফোর্ডশায়ারে রস-এর কাছে বস্কোম্ব ভ্যালি একটা বেশ বড় গ্রাম। মিঃ জন টার্নার নামে এক ভদ্রলোক ওই গ্রামের একজন রীতিমতো ধনী লোক। অনেক জমির মালিক। টার্নার কিছুদিন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন। সেখানে তিনি প্রচুর টাকাপয়সা উপার্জন করে কয়েক বছর হল ফিরে এসে ওই গাঁয়ে বাস করছেন। উনি ওঁর হেদারলির একটা গোলাবাড়ি মিঃ চার্লস ম্যাকার্থিকে ভাড়া দিয়েছেন। এই ম্যাকার্থিও অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন। অস্ট্রেলিয়াতে থাকতেই ওঁদের পরিচয় হয়। আর সেইজন্য ওঁরা পরস্পরের কাছাকাছি থাকতেন। দু’জনের মধ্যে টানারের অবস্থাই ভাল। ম্যাকার্থি যদিও টার্নারের ভাড়াটে তবুও ওঁরা বেশ সহজ ভাবেই মেলামেশা করতেন। ওঁদের দু’জনকে প্রায় একসঙ্গে দেখা যেত। ম্যাকার্থির একটি ছেলে। তার বয়স হবে বছর আঠারো। টার্নারের আবার একটি মেয়ে। তার বয়সও সতেরো-আঠারো হবে। দু’জনেরই স্ত্রী মারা গেছেন। টানার বা মাকার্থি কেউই প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেশামেশি করতেন না। তবে ম্যাকার্থি প্রায়ই তার ছেলেকে নিয়ে ঘোড়দৌড়ের মাঠে বা অন্য খেলাধুলোর আসরে যেতেন। ম্যাকার্থিদের কাজের লোক বলতে একটি চাকর আর একটি ঝি। টার্নারের লোকজন অনেক প্রায় জনা ছয়েক। টার্নার আর ম্যাকার্থির ঘরসংসার সম্বন্ধে আমি এইটুকুই যা জানতে পেরেছি। এবার আসল ঘটনার কথা বলি।
“জুন মাসের তেসরা, মানে গত সোমবার, বেলা তিনটে নাগাদ ম্যাকার্থি তাঁর হেদারলির বাড়ি থেকে বস্কোম্ব ঝিলের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বস্কোম্ব উপত্যকা দিয়ে যে-নদীটি বয়ে গেছে তারই জলে ওই ঝিলটির উৎপত্তি। ম্যাকার্থি সকালবেলায় তাঁর চাকরকে নিয়ে রস-এ গিয়েছিলেন। বলেছিলেন সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে হবে। তিনটের সময় তাঁর একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। সেই দেখা করতে যাওয়াই তাঁর শেষ যাওয়া। সেখান থেকে তিনি জীবিত অবস্থায় আর ফিরে আসেননি।
“হেদারলির বাড়ি থেকে বস্কোম্ব ঝিল খুব বেশি হলে সিকি মাইল। দু’জন লোক তাঁকে ওই পথে হেঁটে যেতে দেখেছে। এদের এক জন এক বুড়ি। তার পরিচয় জানি না। আর এক জন উইলিয়ম ক্রোডার। ক্রোডার টার্নারের পোশা জন্তু-জানোয়ারের দেখাশোনা করে। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এরা দু’জনেই বলেছে যে, ম্যাকার্থি একলাই মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া ক্রোডার বলেছে যে, ম্যাকার্থি যাবার একটু পরেই তার ছেলে জেমস ওই দিকে গেছে। জেমসের হাতে বন্দুক ছিল। ক্রোড়ার ভেবেছিল যে, জেমস তার বাবার সঙ্গে যাচ্ছে। তাই সমস্ত ঘটনাটা না-জানা অবধি এ ব্যাপার নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি। ক্রোডার ছাড়া অন্য লোকেও ম্যাকার্থিদের দেখেছিল। বস্কোম্ব ঝিলের চার দিকে প্রচুর গাছপালা। তবে ঝিলের ধারে ঘাস আর নলখাগড়ার ঝোপ আছে। বস্কোম্ব ভ্যালি এস্টেটের দেখাশোনা করবার ভার যে-লোকটির ওপর, তার বছর চোদ্দো বয়সের মেয়ে পেসেন্স মোরান ওদের দেখতে পায়। পেসেন্স ওই ঝিলের ধারে ফুল তুলতে গিয়েছিল। সে বলেছে, যখন সে ঝিলের কাছাকাছি আসে তখন দেখে যে জেমস আর তার বাবা নিজেদের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া করছে। তারা এত জোরে চিৎকার করছিল যে, পেসেন্সের মনে হয় এখনই হয়তো ওরা হাতাহাতি শুরু করবে। জেমস তো একবার এমন ঘুষি পাকাল যে, পেসেন্সের মনে হল সে হয়তো তার বাবাকে মেরেই বসবে। ভয়ে সে দৌড়ে সেখান থেকে বাড়ি চলে আসে আর তার মাকে এই সব কথা বলে। পেসেন্সের কথা শেষ হবার আগেই জেমস ছুটতে ছুটতে তাদের বাড়ি এসে তার বাবার কথা বলে। সে বলে তার বাবাকে সে মৃত অবস্থায় হ্রদের ধারে দেখতে পেয়েছে। পেসেন্সের বাবার সাহায্য তার খুব দরকার। জেমস যখন পেসেন্সদের বাড়িতে আসে তখন না ছিল তার বন্দুক, না ছিল তার টুপি। তার ডান হাতে আর জামার হাতায় রক্তের দাগ লেগে ছিল। জেমসের সঙ্গে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান যে, তার বাবার দেহ হ্রদের ধারে ঘাসের ওপর পড়ে আছে। কোনও ভারী কিছু দিয়ে বার বার আঘাত করে তার মাথাটা একদম থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। আঘাতের রকম দেখে মনে হয় যে, বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মারা হয়ে থাকতে পারে। বন্দুকটা মৃতদেহের কাছেই পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই সব দেখেশুনে পুলিশ জেমস ম্যাকার্থিকে গ্রেফতার করে। মঙ্গলবার করোনারের আদালতে তার বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ আনা হয়। আর তার পরের দিন বুধবার রসের জেলাশাসক জেমসের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করার আদেশ দেন। পুলিশ আর করোনারের কাছ থেকে ম্যাকার্থির খুনের সম্বন্ধে এইটুকু তথ্যই পাওয়া গেছে।”
আমি বললাম, “এ তো সাংঘাতিক ফ্যাসাদ দেখছি। চারপাশের ঘটনা, মানে যাকে আইনের ভাষায় সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বলে, দেখে মনে হচ্ছে যে হত্যাকারী কে তা বোঝা শক্ত নয়।”
“দেখো এই সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বা চারপাশের সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই মজার জিনিস। ওপর ওপর দেখলে মনে হয় যে, ব্যাপারটা এই রকমই হয়ে থাকবে। কিন্তু যদি একটু অন্য ভাবে দেখো তো সব ব্যাপারটাই উলটে যাবে। এটা ঠিকই যে, ব্যাপার দেখে মনে হয় যে ওই ছেলেটিই খুনি। ও যে খুন করেনি সে কথাটাও জোর করে বলা যাচ্ছে না। তবে ওই জায়গার অনেকেই মনে করছেন যে, ওর কোনও দোষ নেই। মিঃ টার্নারের মেয়ে মিস টার্নারও এই দলে আছেন। আর এই ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করবার জন্যে তিনি লেস্ট্রেডকে লাগিয়েছেন। লেস্ট্রেড এই কাজে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। ও আমার সাহায্য চেয়েছে। আর সেইজন্যে আমরা দুই মাঝবয়সি ভদ্রলোক আরাম করে কোথায় ব্রেকফাস্ট খাব তা নয়, ঊর্ধ্বশ্বাসে পশ্চিম দিকে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল স্পিডে ছুটছি।”
“কিন্তু দেখো হোমস, আমার মনে হচ্ছে যে, এই তদন্তে তুমি বোধহয় খুব সুবিধে করতে পারবে না। সমস্ত ব্যাপারটাই এত স্পষ্ট…”
আমাকে শেষ করতে না দিয়ে হোমস হেসে বলল, ‘দেখো এই খুব স্পষ্ট ব্যাপারগুলোই বড় গোলমেলে। তা ছাড়া আমরা এমন কোনও কিছু আবিষ্কার করতেও পারি যা লেস্ট্রেডের চোখ এড়িয়ে গেছে। তুমি তো ওয়াটসন আমাকে জানো। আমি অহংকার করি না। তবু আমি তোমাকে বলছি যে, আমি অবশ্যই এমন কোনও সূত্র পাব যার খোঁজ লেস্ট্রেড পায়নি বা সারা জীবনে পাবে না। আর সেই সূত্র থেকে এই কেসের ফয়সালা হবে। জেমস নির্দোষ কিনা তা প্রমাণ হয়ে যাবে। তোমাকে একটা ছোট্ট প্রমাণ দিই। তোমার শোবার ঘরের জানলাটা ঘরের ডান দিকে। আমি জোর গলায় বলতে পারি যে, এই সোজা জিনিসটা লেস্ট্রেডের চোখে পড়বে না।”
“কিন্তু সে কথা তুমি কী ভাবে জানলে?”
“তোমাকে তো আমি অনেক দিন ধরে জানি। তুমি মিলিটারিতে ছিলে। তুমি সব ব্যাপারেই খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমি জানি তুমি সকালে দাড়ি কামাও। আর এই সময়ে নিশ্চয়ই আলো জ্বেলে দাড়ি কামাবে না, সূর্যের আলোতেই কামাবে। অথচ দেখছি যে, তোমার ডান গালের দাড়ি যত নিখুঁত ভাবে কামানো হয়েছে বাঁ গালটা তত নিখুঁত হয়নি। গালের তলায়, চিবুকের নীচে সব জায়গায় কামানো হয়নি। এখন আলোটা যদি চার দিকে সমান ভাবে পড়ত তা হলে তুমি নিশ্চয়ই এ রকম ভাবে কামাতে না। এটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু এই হচ্ছে আমার কৌশল। আর এই ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আমার এই ধরনের কৌশল কাজেও লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া আরও দু’-একটা ছোটখাটো পয়েন্ট আছে। সেগুলো একটু খতিয়ে দেখা দরকার।”
“সেগুলো কী ?”
“যেমন ধরো, ওকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়নি। ওকে হেদারলির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় ঘটনার অনেক পরে। পুলিশ ইন্সপেক্টর তাকে যখন গ্রেফতার করে সে নাকি বলেছিল যে, এ কথা শুনে সে মোটেই আশ্চর্য হয়নি। এই নাকি তার পাওনা ছিল। করোনারের কোর্টে এ কথা শুনে জুরিদের মনে ওর দোষ সম্বন্ধে যেটুকু সন্দেহ ছিল সেটাও দূর হয়ে যায়।”
“ও তো নিজের মুখেই দোষ কবুল করেছে দেখছি।”
‘না। এই কথা বলার পরে ও বলে যে, এ ব্যাপারে ও সম্পূর্ণ নির্দোষ।”
“কিন্তু ঘটনা যা ঘটেছে তারপর এসব কথা শুনলে মনে সন্দেহটা আরও জোরদার হয়।”
হোমস বলল, “না, ঠিক উলটোটা। চারদিকের ঘেরা অন্ধকারের মধ্যে আমি ওইটুকুই যা আলোর চিকচিকিনি দেখতে পাচ্ছি। ও যত নির্দোষই হোক না কেন, ও নিশ্চয়ই এত আহাম্মক নয় যে, ও কী বিপদের মধ্যে পড়েছে সেটা বুঝবে না। পুলিশ যখন গ্রেফতার করতে আসে তখন যদি ও এমন ভাব করত যে, ও একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেছে বা ও খুব রাগারাগি করত তা হলেই সেটা সন্দেহের ব্যাপার হত। কেন না এই অবস্থায় তার অবাক হওয়া বা রাগ করা দুটোই অস্বাভাবিক হত। অথচ ও যদি সত্যি সত্যিই ধূর্ত হত তা হলে ও ঠিক ওই রকমই কিছু একটা করত। ও যে সবকিছু এত সহজ ভাবে নিয়েছে তার থেকেই মনে হচ্ছে যে, হয় ও সত্যি সত্যি নির্দোষ, নয়তো ও খুব দৃঢ় আর সংযত চরিত্রের লোক। আর এটা পাওনা বলাটাও ওর পক্ষে ঠিকই হয়েছে। একবার অবস্থাটা মনে মনে ভাবো। ও ওর বাবার মৃতদেহের কাছে দাড়িয়ে ছিল। সে দিনই বাবার সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথা কাটাকাটি হতে হতে ও এতই রেগে গিয়েছিল যে, সেই ছোট মেয়েটির কথা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ওরা এমন ভাব করেছিল যেন হাতাহাতি করতে যাচ্ছে। ওর কথার মধ্যে যে অনুশোচনা আর দুঃখের ভাব রয়েছে, তার থেকে আমার মনে হচ্ছে যে, ও খুনি নয়— সম্পূর্ণ নির্দোষ।”
আমি বললাম, “আমার মনে হচ্ছে না। এর চাইতে ঢের তুচ্ছ প্রমাণের ওপর নির্ভর করে আইনের বিচারে অনেকের ফাঁসি হয়েছে।”
“ঠিকই। তবে অনেক লোককে অন্যায় ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তা তো স্বীকার করবে।”
“তা ও নিজে এ সম্বন্ধে কী বলছে?”
“ও যে-কথা বলছে সেটা অবশ্য উৎসাহজনক কিছু না। তবে ও যা বলেছে তার মধ্যে ভাববার মতো দু’-একটা জিনিস আছে। এই কাগজগুলো পড়লেই তুমি তা জানতে পারবে।
হোমস একটু আগে যে-কাগজগুলো বান্ডিল করে রেখেছিল, তার ভেতর থেকে হারফোর্ডশায়ারের একটা খবরের কাগজ বের করে নিল। তারপর কাগজের ভাঁজ খুলে একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। খুনের ব্যাপারটা সম্বন্ধে ওই ছেলেটি যা বলেছে সেটা ছাপিয়ে দিয়েছে। আমি সিটে হেলান দিয়ে বসে ওই জায়গাটা খুব মন দিয়ে পড়তে লাগলাম। খবরের কাগজে লিখছে:
“এরপর নিহত ভদ্রলোকের একমাত্র সন্তান মিঃ জেমস ম্যাকার্থিকে ডাকা হয়। সাক্ষী দিতে গিয়ে ম্যাকার্থি বলে, ‘আমি তিন দিনের জন্যে ব্রিস্টলে গিয়েছিলাম। আমি ওই দিনই সকালে ফিরে আসি। আমি বাড়ি ফিরে বাবাকে দেখতে পাইনি। আমাদের কাজের মেয়েটির কাছ থেকে জানতে পারি যে, জন কব বলে আমাদের যে-সহিস আছে তাকে নিয়ে বাবা রস-এ কী কাজে গেছেন। একটু পরে আমাদের গাড়ির শব্দ শুনলাম। জানলা দিয়ে দেখলাম, গাড়ি থেকে নেমে বাবা গটগট করে বাগানের দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তবে উনি কোন দিকে যাচ্ছেন তা আমি জানতে পারিনি। একটু পরে আমি আমার বন্দুকটা নিয়ে বস্কোম্ব ঝিলের দিকে গেলাম। ওই ঝিলের ওপারে বুনো খরগোশ পাওয়া যায়। রাস্তায় উইলিয়াম ক্রোডারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। অবশ্য ও যা ভেবেছিল সেটা ঠিক নয়। আমি আমার বাবার পিছু পিছু যাইনি। বাবা যে আমার একটু আগেই ওই দিক দিয়ে গেছেন তাও আমি জানতাম না। আমি যখন ঝিলের কাছে পৌঁছে গেছি তখন আমার কানে এল ‘কুইই’। এই ডাকটা আমি আর বাবা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করি। এটা একটা আমাদের নিজেদের সিগন্যাল। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যে, বাবা ঝিলের ধারে দাড়িয়ে আছেন। মনে হল বাবা আমাকে সেখানে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছেন। একটু বিরক্ত ভাবে জানতে চাইলেন যে আমি সেখানে কী করছি। এরপর দু’-একটা কথার পরেই কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমার বাবা ভীষণ রাগী। আমি দেখলাম তিনি এত রেগে গেছেন, হয়তো একটা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবেন। তাই আমি সেখান থেকে চলে আসি। আমি দেড়শো গজ আন্দাজ গেছি, এমন সময় পেছন থেকে একটা আর্তনাদ কানে এল। আমি তখনই ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম যে মৃতপ্রায় অবস্থায় বাবা মাটিতে পড়ে রয়েছেন। তাঁর মাথায় ভীষণ চোট লেগেছে। আমি বন্দুকটা ফেলে দিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়লাম। আমি তাঁকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলাম। কিন্তু ততক্ষণে তিনি আর বেঁচে নেই। আমি কিছুক্ষণ তাঁর পাশে চুপচাপ বসে থেকে যে-লোকটি বস্কোম্ব ভ্যালি এস্টেটের তদারকি করে তার বাড়ির দিকে ছুটে যাই। আমি যখন চিৎকার শুনে ছুটে যাই, তখন কাউকে দেখতে পাইনি। বাবা একলাই পড়ে ছিলেন। আমার বাবার রাগী স্বভাবের জন্য কারও সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব ছিল না। তবে তার কোনও শত্রুও ছিল না। এ ব্যাপারে আমি আর কিছু জানি না।
করোনার: মারা যাবার আগে আপনার বাবা আপনাকে কোনও কথা বলেছিলেন কি?
সাক্ষী: উনি বিড়বিড় করে জড়িয়ে জড়িয়ে ‘র্যাট’ ‘র্যাট’ বলছিলেন।
করোনার: উনি কী বলতে চাইছিলেন আপনি বুঝতে পারেননি?
সাক্ষী: না। আমি ভেবেছিলাম যে উনি ভুল বকছেন।
করোনার: কী ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আপনার বাবার কথাকাটাকাটি শুরু হয়েছিল ?
সাক্ষী: সে ব্যাপার আমি এখানে বলতে পারব না।
করোনার: না, সে কথা আপনাকে বলতে হবে।
সাক্ষী: সে কথা আমি কিছুতেই বলব না। তা ছাড়া বাবার মৃত্যুর ব্যাপারের সঙ্গে সে কথার কোনও সম্পর্ক নেই।
করোনার: কোনও সম্পর্ক আছে কি নেই সেটা আদালতই ঠিক করবে। আর একটা কথা, আপনি যদি কথাটা এখন না বলেন তো ব্যাপারটা আদালতে বিচারের সময় আপনার বিপক্ষে যাবে।
সাক্ষী: তা হলেও আমি সে কথা বলব না।
করোনার: আপনি বলেছেন যে আপনি আর আপনার বাবা নিজেদের মধ্যে ‘কুইই’ ডাকটা ইশারা হিসেবে ব্যবহার করতেন।
সাক্ষী: হ্যাঁ।
করোনার: তা হলে এটা কী করে সম্ভব যে আপনি ব্রিস্টল থেকে ফিরেছেন কিনা জানার আগে, আপনাকে চোখে দেখবার আগেই উনি আপনাকে ওই ভাবে ডাকলেন?
সাক্ষী: (রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে) আমি জানি না।
জুরি: আপনার বাবার চিৎকারে আপনি যখন ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন আর দেখলেন যে আপনার বাবা সাংঘাতিক ভাবে আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন, তখন আপনার চোখে এমন কিছুই কি পড়েনি যার থেকে কোনও সন্দেহ করা যায় ?
সাক্ষী: জোর করে বলবার মতো কিছু আমার নজরে পড়েনি।
করোনার: আপনি কী বলতে চাইছেন ?
সাক্ষী: আমি যখন ছুটে ওখানে গিয়ে হাজির হলাম তখন বাবার কথা ছাড়া অন্য কোনও কথা ভাববার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। তবে আমার যেন মনে হচ্ছে যে আমি যখন ছুটে গেলাম আমার বাঁ দিকে মাটির ওপর ছাই ছাই রঙের কী যেন একটা পড়ে ছিল। সেটা একটা কোট বা চাদর জাতীয় কিছু হতে পারে। কিন্তু আমি যখন বাবার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালাম, তখন সেদিকে তাকাতে দেখলাম যে জিনিসটা নেই।
আপনি কি বলছেন যে আপনি যখন সাহায্য করবার জন্যে লোক ডাকতে গেলেন। তার আগেই সেটা অদৃশ্য হয়েছে?
হ্যাঁ। সেটা আর তখন ছিল না।
সেটা কী তাও আপনি সঠিক বলতে পারছেন না ?
না, তবে আমার ধারণা যে কিছু একটা ছিল।
সেটা আপনার বাবার কাছ থেকে কত দূরে পড়ে ছিল ?
বারো-চোদ্দো হাত দূরে হবে।
ঝোপ থেকে কত দূরে?
ওই রকম বারো-চোদ্দো হাত দুরেই হবে।
তা হলে আপনি যখন ওখানে ছিলেন তখনই আপনার বারো-চোদ্দো হাত দূর থেকে ওই জিনিসটি উধাও হয়ে গেল।
হ্যাঁ, তবে ওটা ছিল আমার পিছন দিকে।
সাক্ষীকে জেরা করা শেষ হল।”
খবরটা পড়া শেষ করে আমি বললাম, “করোনার ভদ্রলোক দেখছি ম্যাকার্থি ছোকরার সম্বন্ধে ভীষণ কড়া কথা বলেছেন। ম্যাকার্থির কথায় যে-সব গরমিল রয়েছে, সেগুলো বেশ জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। আর সত্যি কথাই তো ও স্বীকার করেছে যে, কুইই ডাকটা ওর আর ওর বাবার মধ্যে চালু ছিল। ওর বাবা কুইই হাঁক পাড়লেন, অথচ ওর বাবা জানতেন না যে ও ফিরে এসেছে, এটা কী রকম কথা হল! তারপর ও কেন বলছে না কী নিয়ে ওদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হল। তারপর ওর বাবার শেষ কথাগুলো…সব মিলিয়ে ওইই অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।”
আমার কথা শুনে হোমস খুক খুক করে হেসে উঠল। তারপর বেশ আরাম করে বসে বলল, “দেখো ওয়াটসন, তুমি আর ওই করোনার ভদ্রলোক যে-জিনিসগুলোর ওপর জোর দিচ্ছ সেগুলো কিন্তু জেমসকে নির্দোষ প্রমাণ করে। তোমরা যে ভাবে ব্যাপারটা দেখছ, তাতে মনে হচ্ছে ও একই সঙ্গে ভীষণ চালাক আর ভীষণ বোকা। ছোকরা এতই বোকা যে, ওর বাবার সঙ্গে ঝগড়া কী নিয়ে সে সম্বন্ধে একটা মনগড়া কারণ দেখাতে পারল না যা শুনে জুরিদের মন নরম হয়। আবার উলটো দিকে তোমরা বলতে চাইছ যে, ও এতই ধড়িবাজ যে ওই ‘র্যাট’ কথাটথা বলে সবাইকে ধোঁকা দিতে চাইছে। না হে, আমি কিন্তু ওই ছোকরা সত্যি কথা বলছে ধরে নিয়েই তদন্ত শুরু করব। তারপর দেখা যাবে কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। যাই হোক, আর কোনও কথা নয়। এবার আমি খানিকক্ষণ পেত্রার্কের বইটা পড়ব। আর মিনিট কুড়ি পর আমরা সুইনডন পৌঁছোব। সেখানে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নেব।”
বিকেল চারটে নাগাদ আমরা রস স্টেশনে এসে নামলাম। প্ল্যাটফর্মে আমাদের জন্যে যে রোগা ছটফটে ধূর্ত চেহারার লোকটি অপেক্ষা করছিল তাকে চিনতে আমার অসুবিধে হল না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর লেস্ট্রেড। লন্ডনের বাইরে এসেছে বলে লেস্ট্রেডের জামাকাপড়ও একটু অন্য রকম। লেস্ট্রেড আমাদের নিয়ে গেল হারফোর্ড আর্মস নামে একটি হোটেল। সেইখানে আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
আমরা বসে চা খাচ্ছিলাম। লেস্ট্রেড হোমসকে বলল, “আমি একটা গাড়ি ঠিক করেছি। আপনার যে রকম উৎসাহ তাতে খুনের জায়গাটা না দেখা পর্যন্ত আপনি যে ক্ষান্ত হবেন না, তা তো জানি।”
হোমস বলল, “আপনার দূরদৃষ্টি আর বিবেচনার প্রশংসা করতেই হয়। তবে এখন প্রশ্ন হল ব্যারোমিটারের চাপ কী রকম।”
লেস্ট্রেড হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“দেখি তো ব্যারোমিটারে কী বলছে। ঊনত্রিশ। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই, বাতাসও দিচ্ছে না। নাহ্, আজ আর গাড়িটার দরকার হচ্ছে না। তার চেয়ে বরং আমার কাছে বাক্স-ভরতি যে সিগারেটগুলো রয়েছে, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করা যাক। সাধারণত মফস্বলের হোটেলের আসবাবপত্র যে রকম হয়, তার চেয়ে এই হোটেলের আসবাবপত্র ঢের বেশি আরামদায়ক।”
লেস্ট্রেড একটু মুরুব্বিয়ানার হাসি হাসল। “খবরের কাগজে যে-সব খবর বেরিয়েছে, তার থেকেই মিঃ হোমস, আপনি বোধহয় তদন্তের মীমাংসা করে ফেলেছেন। ব্যাপারটা একদম জলের মতো সোজা। ব্যাপারটা নিয়ে যতই ভাবছি ততই সবটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তবে ওই রকম জেদি মহিলার কথা না মেনেও পারিনি। উনি আপনার কথা অনেক শুনেছেন। আপনার মতামত না শুনে ছাড়বেন না। আমি অবশ্য ওঁকে বার বারই বলেছি যে এ ব্যাপারে আমি যতদূর করবার করেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আপনিও করতে পারবেন না। …আরে ওই তো ওঁর গাড়ি এসে থামল বলে মনে হচ্ছে।”
লেস্ট্রেডের কথা শেষ হতে-না-হতে ঘরের ভেতরে হুড়মুড় করে ঢুকলেন এক অল্পবয়সি মহিলা। মহিলাকে দেখে মনে হল তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রয়েছেন। ঘরে ঢুকেই তিনি আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর শার্লক হোমসের দিকে এগিয়ে গেলেন।
“ও মিঃ শার্লক হোমস, আপনি আসায় আমার যে কী আনন্দ হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারব না। এই কথাটা বলতেই আমি ছুটতে ছুটতে আসছি। আমি জানি যে, জেমস এ কাজ করেনি। এটা আমি জানি। আর আমি চাই যে এ কথাটা ধরে নিয়েই আপনি কাজে হাত দিন। জেমস যে নির্দোষ সে কথা কিন্তু আপনি ভুলেও অবিশ্বাস করবেন না। আমি জেমসকে ছেলেবেলা থেকে জানি। ওর দোষ-গুণ সবই জানি। ওর স্বভাবটা এত নরম যে, ওর পক্ষে কোনও একটা পোকামাকড়কে মারাই শক্ত।”
হোমস বলল, “আমার মনে হচ্ছে যে ওঁকে আমি ছাড়িয়ে আনতে পারব। বিশ্বাস করুন মিস টার্নার, আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না।”
“আপনি তো সব তথ্য-প্রমাণের কথা কাগজে পড়েছেন। তার থেকে তো আপনি মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত করতে পেরেছেন। এই তথ্য-প্রমাণের মধ্যে আপনি কি কোনও গলদ দেখতে পাননি ? আপনার কি মনে হচ্ছে না যে, জেমসের কোনও দোষ নেই!”
“আমার ধারণা জেমস নিদোষ।”
“এবার কী হবে!” মিস টার্নার লেষ্ট্রেডের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনছেন তো মিঃ লেস্ট্রেড, মিঃ হোমস আমাকে আশা দিচ্ছেন।”
লেস্ট্রেড কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমার বন্ধু বোধহয় এ ব্যাপারে একটু বেশি তাড়াহুড়ো করে মনস্থির করে ফেলেছেন।”
“কিন্তু উনি ঠিক কথাই বলছেন। আমি জানি উনি ভুল করেননি। জেমস এ কাজ করতেই পারে না। আর ওর বাবার সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়েছিল তা যে ও করোনারকে কেন বলেনি তাও আমি জানি।”
“আপনি কী ভাবে জানলেন?” হোমস জানতে চাইল।
“বলছি। সব কথাই খুলে বলছি। জেমস আর আমি ছেলেবেলায় একসঙ্গে ভাই-বোনের মতো মানুষ হয়েছি। কিন্তু মিঃ ম্যাকার্থি এ বিষয়ে মোটেই খুশি ছিলেন না। তাঁর অন্য রকম ইচ্ছে ছিল।”
“এ ব্যাপারে আপনার বাবার মত কী?” হোমস প্রশ্ন করল।
“মিঃ ম্যাকার্থির সঙ্গে এ ব্যাপারে বাবার মতের মিল ছিল না।”
“একটা খুব জরুরি খবর দিলেন। কাল সকালে আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হতে পারে কি?”
ডাক্তারবাবু রাজি হবেন কিনা বলতে পারছি না।”
“ডাক্তারবাবু?”
“সে কী, আপনি শোনেননি? গত কয়েক বছর ধরে বাবার শরীর মোটেই ভাল যাচ্ছে না। আর এই ঘটনার পর একদম ভেঙে পড়েছেন। সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। ডঃ উইলোজ বলছেন যে, বাবার নার্ভগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। মিঃ ম্যাকার্থিই বোধহয় একমাত্র লোক যিনি বাবাকে বেশ সুস্থ-সবল দেখেছেন। ওঁদের পরিচয় হয় ভিক্টোরিয়ায়।”
“ওহো ভিক্টোরিয়ায় ! তাই নাকি! তাই নাকি!”
“হ্যাঁ। খনিতে।”
“ঠিক, ঠিক। ওখানকার সোনার খনিতে। সেখানেই বোধহয় আপনার বাবা ব্যবসায় উন্নতি করেন।”
“ঠিক তাই।”
“মিস টার্নার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি অনেক দরকারি খবর দিলেন।”
“মিঃ হোমস, আপনি যদি কিছু খবর পান তো আমাকে জানাবেন কিন্তু। আপনি নিশ্চয়ই জেলখানায় জেমসের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। আপনি যদি যান তো অবশ্যই মনে করে জেমসকে বলবেন, সে যে এই কাজ করেনি তা আমি জানি।”
“আমি নিশ্চয়ই এ কথা তাকে বলব মিস টার্নার।”
“এবার আমি বাড়ি যাব। বাবার শরীর খুবই খারাপ। আমি বাড়ির বাইরে থাকলে উনি খুব অস্থির হয়ে পড়েন। চলি। ভগবান আপনার ভাল করবেন।”
মিস টার্নার যেমন ঝড়ের মতো এসেছিলেন, তেমনই ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই একটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। লেস্ট্রেড বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন, “মিঃ হোমস, আপনার কাণ্ড দেখে সত্যিই লজ্জা বোধ করছি। কেন আপনি ওঁকে মিথ্যে আশা দিলেন। আপনি তো ভাল ভাবেই জানেন যে, এ মামলায় আর কিছুই করবার নেই। আমি অবশ্য কোমলহৃদয় নই, তবু আপনি যা করলেন সেটা আমার কাছে নিষ্ঠুরতা বলে মনে হচ্ছে।”
হোমস বলল, “জেমস ম্যাকার্থিকে কী ভাবে খালাস করা যাবে তা আমি বুঝে গেছি। ভাল কথা, আপনার কাছে জেমসের সঙ্গে দেখা করবার অনুমতিপত্র আছে কি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি আর আপনিই যেতে পারি।”
“তা হলে আজ রাত্রে বাইরে না-যাওয়ার সিদ্ধান্তটা বদলাতে হচ্ছে। এখন হারফোর্ড যাবার কোনও ট্রেন আছে কি? সে গাড়িতে গেলে জেমসের সঙ্গে দেখা হবে?”
“খুব, খুব।”
“তা হলে চলুন বেরিয়ে পড়ি। ওয়াটসন, তোমার হয়তো একলা একলা একটু খারাপ লাগবে। তবে আমি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই ফিরব।”
আমি ওদের স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। তারপর ঘরে ফিরে একটা রহস্য-উপন্যাস পড়তে লাগলাম। খানিকক্ষণ পরে বইটা ভীষণ জোলো মনে হল। জীবনে যে-সব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা হয়, তার কাছে গল্পের রহস্য কোথায় লাগে। আরও কিছুক্ষণ পরে আমার খেয়াল হল যে, আমার চোখদুটো বইয়ের পাতায় থাকলেও মনে মনে আমি ম্যাকার্থিকে খুন করার ব্যাপারটাই ভাবছি। বইটা রেখে দিলাম। যদি জেমসের কথা সত্যি হয়, তা হলে সে তার বাবার কাছ থেকে চলে আসবার পর আর বাবার চিৎকার শুনে ছুটে যাওয়ার মধ্যে ওই অল্প সময়টুকুতে এমন কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে থাকতে পারে? কী ভাবে জেমসের বাবার মৃত্যু হল ? কে তাকে খুন করল ? কী ভাবে করল? কেন করল ? হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ম্যাকার্থির মাথার ঠিক কোন জায়গায় কী রকম আঘাত লেগেছে সেটা আমার ডাক্তারি বিদ্যে দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে কি কোনও সূত্র পাওয়া যাবে?
সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের বেয়ারাকে ডেকে ওখানকার যে-সাপ্তাহিক কাগজে সব খবর বেরিয়েছিল, সেটা আনতে বললাম। কাগজ পড়লাম। পুলিশের ডাক্তার বলেছেন যে, খুব ভারী অথচ ভোঁতা কোনও কিছু দিয়ে মাথার পিছন দিকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করায় পাইরেটাল আর বাঁ দিকের অক্সিপেটাল হাড়দুটো চুরমার হয়ে গেছে। আমি মাথার পেছনে হাত দিয়ে জায়গাদুটো দেখে নিলাম। একটা জিনিস খুব পরিষ্কার। আঘাতটা করা হয়েছে পিছন থেকে। এটা জেমসের পক্ষে একটা প্রমাণ। কেন না যখন কথাকাটাকাটি চলছিল, তখন জেমস আর তার বাবা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য এটা খুব একটা অকাট্য প্রমাণও নয়। কেন না এমনও হতে পারে যে কথাকাটাকাটির মাঝখানে জেমসের বাবা উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। তবু আমার মনে হল যে, কথাটা হোমসকে বলা দরকার। তারপর ওই ব্যাটের ব্যাপারটাই বা কী? জেমসের বাবা কি ভুল বকছিলেন? কিন্তু মাথায় ওই ধরনের আঘাত লাগলে আহত ব্যক্তি কোনও মতেই ভুল বকবে না। তাই মনে হয় যে ওই র্যাট শব্দের মধ্যে দিয়ে ম্যাকার্থি নিশ্চয়ই কী ভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি? আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আরও একটা কথা আমার মনে পড়ল। জেমস যে-ছাই রঙের কাপড়টা ঘটনাস্থলে পড়ে থাকতে দেখেছিল, সেটাই বা কী? যদি এটা ধরে নিই যে, ওটা খুনিরই কোট বা ওভারকোট আর জেমস যখন তার বাবার মৃতদেহের পাশে বসেছিল, তখনই খুনি চুপিসারে এসে ওই জামাটা ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তা হলে মানতেই হবে যে খুনি যেমন সাহসী তেমনই ক্ষিপ্র। তবে কথা হচ্ছে, জেমসের এ কথাটা সত্যি কিনা। লেস্ট্রেডের কথা শুনে আমি মোটেই আশ্চর্য হইনি। সহজ বুদ্ধিতে ওদের কথাই ঠিক বলে মনে হয়। তবে শার্লক হোমসের ওপর আমার এতই আস্থা যে এ সব সত্ত্বেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হোমস জেমসকে ছাড়িয়ে আনতে পারবে।
হোমস যখন ফিরে এল তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। লেস্ট্রেড তার ডেরায় ফিরে গেছে। হোমস একলাই হোটেলে ফিরে এল।
একটা চেয়ারে বেশ আরাম করে হাত-পা মেলে বসে হোমস বলল, “আমরা ঘটনাস্থলে যাবার আগে যেন বৃষ্টি না হয়। মুশকিল হচ্ছে, ঘটনাস্থল ভাল করে দেখতে গেলে সুস্থ শরীর আর চাঙ্গা মন নিয়ে দেখতে হয়। সারা দিন ট্রেন জার্নি করে ওখানে আমি যেতে চাইনি।…আমার সঙ্গে জেমস ম্যাকার্থির দেখা হল।”
“ওর কাছ থেকে কী খবর পেলে ?”
“কিছুই নয়।”
“এমন কিছু বলতে পারল না যার থেকে ব্যাপারটার ফয়সালা হতে পারে।”
“নাহ্। আমার গোড়ায় ধারণা হয়েছিল যে কে খুন করেছে সেটা ও জানে। আর যে-কোনও কারণেই হোক খুনিকে ও বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু পরে দেখলাম না তা নয়। গোটা ব্যাপারটায় ও নিজেও খুবই আশ্চর্য হয়ে গেছে। জেমস ছোকরা এমনি যে খুব বুদ্ধিমান তা নয়, তবে ওর মনটা খুব ভাল।”
তারপর একটু থেমে হোমস বলল, “ম্যাকার্থিদের পয়সাকড়ি বিশেষ কিছু নেই। জেমসের বাবার মতলব ছিল মিস টার্নারের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেওয়ার। তা হলে আর টাকাপয়সার ভাবনা থাকবে না। কিন্তু জেমসের তাতে মন নেই। জেমস মিস টার্নারকে নিজের বোনের মতো ভালবাসে। এই নিয়ে কথাকাটাকাটি শুরু হয়। জেমস আকাশে দু’হাত তুলে ভগবানের নামে দিব্যি করে বলেছিল যে এ কথা সে মানতে পারবে না।”
“কিন্তু জেমস যদি খুন না করে থাকে তবে খুন করল কে?”
“তাই তো! কে করল খুন ? আমি দুটো ব্যাপার তোমাকে লক্ষ করতে বলছি। প্রথমত দেখো, নিহত ব্যক্তির কারও সঙ্গে দেখা করবার কথা ছিল। কিন্তু সে লোক তার ছেলে নয়। ছেলে যে ফিরে এসেছে তা সে জানতই না। তারপর সে একবার ‘কুইই’ বলে হক পেড়েছিল। কিন্তু তখনও সে জানত না যে, তার ছেলে ফিরে এসেছে। আচ্ছা…এবার অন্য কথা বলা যাক।”
হোমসের মনের আশা পূর্ণ করে সে রাতে বৃষ্টি হল না। সকালবেলা পরিষ্কার ঝকঝকে রোদ। আকাশে মেঘ নেই। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় লেস্ট্রেড গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হল। আমরা তার সঙ্গে বস্কোম্ব ঝিল আর হেদারলি ফার্মে যাব বলে বার হলাম।
যেতে যেতে লেস্ট্রেড বলল, “আজ সকালে একটা খারাপ খবর আছে। মিঃ টার্নারের শরীর খুবই খারাপ হয়েছে। বাঁচবেন কিনা সন্দেহ।”
“ভদ্রলোকের বয়স কত হবে?”
“পঁয়ষট্টির কাছাকাছি হবে। তবে বিদেশে থাকার সময়েই ওঁর শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। ইদানীং তো ওঁর স্বাস্থ্য একদম ভেঙে গেছে। তারপর এই ব্যাপারটায় উনি ভীষণ ‘শক’ পেয়েছেন। ওঁর সঙ্গে ম্যাকার্থির অনেক দিনের বন্ধুত্ব। দু’জনের মধ্যে এত ভাব যে উনি ম্যাকার্থিকে বিনা ভাড়ায় হেদারলি ফার্মে থাকতে দিয়েছেন।”
“তাই নাকি! তাই নাকি!” হোমস বলে উঠল।
“হ্যাঁ, শুধু তাই নয়। আরও অনেক ভাবে উনি ম্যাকার্থিদের সাহায্য করেছেন। এ সব কথা এখানকার সকলেই জানে।”
“বটে! লেস্ট্রেড, একটা জিনিস লক্ষ করুন। ম্যাকার্থির পয়সাকড়ি ছিল না। অনেক ব্যাপারেই তাঁকে টার্নারের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হত, তা সত্ত্বেও কেন তিনি তাঁর ছেলের সঙ্গে টানারের মেয়ের, যে কিনা একসময়ে এই বিরাট সম্পত্তির মালিক হবে, বিয়ের কথা বলতেন। সাধারণ ভাবে এটা একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না? এটা থেকে আপনি কিছু অনুমান করতে পারছেন?”
“অনুমান..সিদ্ধান্ত..” বেশ একটু মুরুব্বিয়ানার সুরে লেস্ট্রেড আমার দিকে চোখ টিপে বলল, “এ সবের চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে তথ্য, ফ্যাক্টস। ঘটনা আর তথ্যকে সামাল দিতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। অনুমান আর সিদ্ধান্ত কল্পনা করে নষ্ট করবার মতো সময় আমার নেই।”
হোমস খুব নিচু গলায় বলল, “আপনি ঠিক বলেছেন। ঘটনাগুলোর তাৎপর্য বোঝাই আপনার পক্ষে শক্ত।”
বেশ একটু রেগে গিয়ে লেস্ট্রেড বলল, “কিন্তু একটা ঘটনার তাৎপর্য আমি ঠিক বুঝেছি, যেটা আপনি এখনও ধরতে পারেননি।”
“সেটা কী?”
“সেটা হল এই যে, জেমস ম্যাকার্থি তার বাবাকে খুন করেছে। এ ছাড়া আর সবকিছুই মিথ্যে আকাশকুসুম কল্পনা করা।”
হোমস হেসে বলল, “কিছু না করার চাইতে কখনও কখনও কল্পনা করাও ভাল। যাকগে, আমাদের বাঁ দিকের ওই বাড়িটাই বোধহয় হেদারলি ফার্ম।”
“হ্যাঁ। ওইটেই হেদারলি ফার্ম বটে।”
বেশ বড় বাড়ি। দোতলা। দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় শ্যাওলার ছোপ ধরেছে। বাড়িটার জানলা-দরজা সব বন্ধ। চিমনি দিয়েও ধোঁয়া বেরোচ্ছে না। দেখলে মনে হয় যেন বাড়িটাও শোকের ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি। আমরা কলিংবেল বাজাতে একজন পরিচারিকা এসে দরজা খুলে দিল। হোমস তাকে ম্যাকার্থি খুন হওয়ার সময় যে জুতোটা পরেছিলেন সেটা, আর জেমস ম্যাকার্থির এক জোড়া জুতো আনতে বলল। অবশ্য জেমস সেই সময় যে-জুতোজোড়া পরে ছিল সেটা পাওয়া গেল না। তারপর হোমস একমনে জুতো পরীক্ষা করতে লাগল। সাত-আট রকম ভাবে জুতোগুলো মাপতে লাগল। যখন তার জুতো পরীক্ষা করা শেষ হল, তখন সে যে-রাস্তা ধরে ম্যাকার্থি বস্কো ঝিলের দিকে গিয়েছিলেন সেই পথ ধরে চলতে শুরু করল।
তদন্ত করবার সময়ে হোমস যখন কোনও সূত্রের সন্ধান পেয়ে যায় তখন তার মধ্যে একটা আশ্চর্য রকম পরিবর্তন দেখা যায়। যারা বেকার স্ট্রিটের চেয়ারে বসে থাকা প্রায় পি-পু-ফি-শু ধরনের লোকটিকে শার্লক হোমস বলে জানেন, তাঁরা এই হোমসকে চিনতেই পারবেন না। তার মুখটা উত্তেজনায় থমথমে আর লালচে হয়ে ওঠে। ভুরুদুটো টানা আর ছুঁচোলো হয়ে যায়। চোখদুটো এমন চকচক করে যে মনে হয় তার থেকে জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে পড়ে, ঠোঁটদুটো চেপে সে অসম্ভব ক্ষিপ্র ভাবে চলাফেরা করে। এই সময়ে সে এত গভীর ভাবে চিন্তা করে যে, কেউ কোনও কথা বললে হয় সেটা তার কানেই যায় না, নয়তো এমন বিরক্ত হয়ে খেকিয়ে ওঠে যে তা বলবার নয়।
কোনও কথা না বলে খুব দ্রুত পায়ে হোমস সেই পথে মাঠ পেরিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বস্কোম্ব ঝিলের দিকে এগিয়ে চলল। স্যাঁতসেঁতে জলা জায়গা। সেখানে মাটিতে অনেক লোকের পায়ের ছাপ পড়েছে। পায়ের ছাপ শুধু রাস্তাতেই নেই, আশপাশের ঘাসের ওপরেও অসংখ্য পায়ের দাগ। হোমস কোথাও কোথাও দৌড়ে যাচ্ছিল, আবার কখনও কখনও কোনও একটা জায়গায় এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। একবার তো হোমস মাঠের উলটো দিকে খানিক দূর চলে গিয়ে ঘুরে এল। লেস্ট্রেড আর আমি হোমসের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। লেস্ট্রেডকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে, হোমসের কাজকর্মকে মনে মনে সে খুবই তাচ্ছিল্য করছিল। তবে আমার ব্যাপারটা আলাদা। আমি সমস্ত কিছু খুব মন দিয়ে দেখে যাচ্ছিলাম। আমি জানি যে হোমস এখন যা করছে তার প্রত্যেকটির পিছনে একটি কার্যকারণ যোগ আছে।
বস্কোম্ব ঝিল হেদারলি ফার্ম আর মিঃ টানারের বাগানের মাঝখান বরাবর। ঝিলটা চওড়ায় প্রায় পঞ্চাশ গজ হবে। ঝিলের ওপারে বড় বড় গাছ। গাছের ওপর দিয়ে মিঃ টানারের বাড়ির লাল চুড়োটা দেখা যাচ্ছিল। ঝিলের জলে প্রচুর নলখাগড়া হয়েছে। হেদারলি ফার্মের দিকে খানিকটা জায়গা বেশ জঙ্গলের মতো। সেই জঙ্গলের আর ঝিলের মাঝখানে খানিকটা ঘাসে-ঢাকা জায়গা। যে-জায়গায় ম্যাকার্থির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল লেস্ট্রেড সে জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিল। জায়গাটায় এমন জলকাদা যে ম্যাকার্থি পড়ে যাওয়ায় সেখানে একটা ছাঁচের মতো হয়ে গিয়েছিল। হোমসের দিকে তাকাতে বুঝলাম যে এই জলকাদা, ঝোপজঙ্গল আর ঘাসের ভেতরে আমি যা দেখেছি তার চোখ তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু দেখেছে। হোমস শিকারি কুকুরের মতো একবার এখানে আর একবার ওখানে ছোটাছুটি করছিল।
“আপনি ঝিলে কী করতে নেমেছিলেন ?” হোমস লেস্ট্রেডকে জিজ্ঞেস করল।
“আমি একটা ডিঙিনৌকো নিয়ে দেখছিলাম যে-অস্ত্র দিয়ে ম্যাকার্থিকে খুন করা হয়েছে। সেটা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সে কথা আপনি কেমন করে—”
“আরে ছাড়ুন তো বাজে কথা। আপনার বাঁকা বাঁ পায়ের ছাপ সব জায়গায় পড়েছে। এ তো নেহাত অন্ধ ছাড়া কারও চোখ এড়িয়ে যাবার কথা নয়। কিন্তু ওই ষাঁড়ের দল এসে পড়বার আগে যদি আমি এখানে আসতে পারতাম কী ভালই না হত! এখানেই জেমস আর পেসেন্সের বাবা তার দলবল নিয়ে এসেছিল। এখানে ছ’-সাত জোড়া পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। এই জায়গাটায় দেখছি একই পায়ের ছাপ তিন বার পড়েছে।” জেমস পকেট থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে নিজের ওয়াটারপ্রুফটা পেতে মাটিতে শুয়ে পড়ল। তারপর নিজের মনেই কথা বলতে লাগল। “এগুলো হচ্ছে জেমসের পায়ের ছাপ। দু’বার সে হেঁটেছে। একবার জোরে ছুটেছে। চেটোর দাগটা গভীর হয়ে পড়েছে। গোড়ালির ছাপ নেই। বোঝা যাচ্ছে যে, ও সত্যি কথাই বলেছে। ওর বাবাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ও ছুটেছিল। এইখানে ওর বাবার পায়ের দাগ। ভদ্রলোক ওই জায়গাটায় পায়চারি করেছেন। এটা কী? এটা তো বন্দুকের কুঁদোটার ছাপ। বন্দুকটা এইখানে রেখে জেমস ওর বাবার সঙ্গে কথা বলছিল। এটা কী? তাই তো, তাই তো! এখানে এগুলো কী? পা টিপে টিপে কেউ গেছে। চৌকো ধরনের একটু অদ্ভুত আকারের জুতো। একবার এ দিকে এসেছে, তারপর ফিরে গেছে, আবার এসেছে। শেষ বার অবশ্য জামাটা নিতেই এসেছিল। কিন্তু সে এল কোন দিক থেকে?”
হোমস এদিক-ওদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল। কোথাও কোথাও সে পায়ের দাগ খুঁজে পাচ্ছিল না। আবার এক এক জায়গায় পায়ের দাগ বুঝতে পারছিল। এই ভাবে খুঁজতে খুঁজতে হোমস সেই ঝিলের পাশে ছোটখাটো জঙ্গলটার একধারে এসে পড়ল। সেখানে একটা বিরাট বিচগাছ। অত বড় গাছ আশেপাশে আর কোথাও নেই। হোমস সেই গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। তারপর মুখ দিয়ে একটা শব্দ করল। বুঝলাম কোনও কারণে সে খুব খুশি হয়েছে। বেশ কিছুটা সময় হোমস সেইখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একটা কাঠি দিয়ে সেইখানে পড়ে-থাকা শুকনো পাতা, ফুল, কাঠকুটো উলটেপালটে দেখতে লাগল। তারপর সেখান থেকে যত্ন করে, ধুলো বলেই আমার মনে হল, কী যেন একটা খামে পুরে ফেলল। এরপর ম্যাগনিফাইং লেন্স দিয়ে কেবল মাটিই নয়, গাছের ছালও ভাল করে দেখতে লাগল। গাছটার যত দূর পর্যন্ত দেখা যায় ততটাই হোমস দেখল। কাছেই একটা এবড়োখেবড়ো পাথরের চাঙড় পড়েছিল। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে হোমস সেটাকে তুলে নিল। তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যে সরু পায়ে-চলা পথটা চলে গেছে, সেটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় এসে পড়ল।
হোমস বলল, “ম্যাকার্থি খুনের তদন্তটা খুবই ইন্টারেস্টিং।” এখন হোমসের চেহারাটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। “ওই ছাই ছাই রঙের বাড়িটা বোধহয় পেসেন্সদের বাড়ি। আমি একবার পেসেন্সের সঙ্গে দেখা করব। তারপর একটা ছোট চিঠি লিখব। ব্যস, এই কাজটুকু সেরেই আমরা লাঞ্চ সারতে যাব। ওয়াটসন আর আপনি বরং ততক্ষণ গাড়িতে গিয়ে বসুন।”
মিনিট-দশেকের মধ্যেই হোমস ফিরে এল। তার হাতে তখনও সেই পাথরটা ধরা ছিল।
পাথরটা লেস্ট্রেডকে দেখিয়ে হোমস বলল, “লেস্ট্রেড, এই পাথরটা দিয়েই ম্যাকার্থিকে খুন করা হয়েছিল।”
“আমি তো কোনও দাগ দেখতে পাচ্ছি না।”
“কোনও দাগ তো নেই।”
“তা হলে কী করে জানলেন?”
“এই পাথরটার নীচে ঘাস গজিয়েছিল। এটা অল্পদিন হল ওইখানে রয়েছে। কিন্তু এটা যে কোথা থেকে আনা হয়েছিল, তা খুঁজে পেলাম না। ম্যাকার্থির মাথায় যে রকম আঘাত তা পাথরটার আকারের সঙ্গে মিলে যায়। এ ছাড়া আর কোনও অস্ত্র ওখানে নেই।”
“খুনির পরিচয়টা কী?”
“খুনি খুব লম্বা। ন্যাটা। তার ডান পা খোঁড়া। তার পায়ে শিকারিরা যে রকম পুরু সুকতলা-লাগানো জুতো পরে সেই রকম জুতো ছিল। তার গায়ে ছাই রঙের কোট ছিল। লোকটা সিগার খায়। সিগার-হোল্ডার ব্যবহার করে। তার পকেটে ভোঁতা পেনসিল-কাটা ছুরি ছিল। এ ছাড়া আরও কিছু কিছু কথা বলা যায়। তবে যে-কটা কথা বললাম, তাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে।”
লেস্ট্রেড হাসল। “আমি কিন্তু আপনার কথা মানতে পারছি না। এ সব অনুমান সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। তবে আমার সমস্যা হল এই যে, আমাকে মাথামাটা ব্রিটিশ জুরিদের বোঝাতে হবে।”
লেস্ট্রেড বলল বটে যে, হোমসের অনুমান আর সিদ্ধান্তের কথা ব্রিটিশ জুরিদের বোঝানো সম্ভব হবে না, কিন্তু হাসির ধরন দেখেই টের পেলাম, হোমসের সিদ্ধান্তে তার নিজেরই কিছুমাত্র বিশ্বাস নেই। হোমস বলল, “বেশ তো, আপনি আপনার মতো কাজ করুন, আর আমিও আমার মতো কাজ করে যাই। আজ বিকেলে আমি খুব ব্যস্ত থাকব। তারপর সন্ধের কোনও গাড়িতে লন্ডনে ফিরব।”
“সে কী! কাজ শেষ না করেই ফিরে যাবেন?”
“না। কাজ তো শেষ হয়ে গেছে।”
“কিন্তু সমস্যাটার কী হল?”
“তার তো সমাধান হয়ে গেছে।”
“খুনি কে?”
“যাঁর কথা একটু আগে বললাম।”
“কিন্তু তিনি কে?”
“এখানে এমন কিছু বেশি লোকের বসবাস নেই। তাকে খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে না।”
লেস্ট্রেড খানিকটা হাল ছেড়ে দেওয়া ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। “মিঃ হোমস, আমি কাজের লোক। এখন লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডান পা খোঁড়া ন্যাটা লোককে খুঁজে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকেরা আমাকে পাগল বলবে।”
“ঠিক আছে। আমি কিন্তু আপনাকে সব কথা বলেছি। এই যে আপনার বাসা এসে গেছে। চলি। যাবার আগে আমি আপনাকে জানিয়ে যাব।”
লেস্ট্রেডকে নামিয়ে দিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আমাদের লাঞ্চ তৈরি ছিল। হোমস চুপ করে বসে রইল। হোমসের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যে, কোনও কারণে সে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে।
খাওয়াদাওয়ার পর হোমস বলল, “ওয়াটসন, ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোসো। আমি একটা ছোটখাটো বক্তৃতা করব। তুমি সব শুনে বলো, কী করা উচিত। আমি তো বুঝতে পারছি না।”
“বেশ বলো।”
“তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে জেমস ম্যাকার্থির জবানবন্দীর দুটো কথা আমাদের দু’জনেরই খুব অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল। প্রথম হল, সে বলেছে যে তারা বাবা কুইই বলে ডেকে উঠেছিলেন। কিন্তু তার বাবা জানতেন না, সে ফিরে এসেছে। তারপর জেমসের বাবা র্যাট বলেছিলেন কেন? জেমসের বাবা কিন্তু আরও কিছু কথা বলেছিলেন। জেমস শুধু ওইটুকুই শুনতে পেয়েছিল। আমরা ধরে নিয়েছি যে, জেমস সত্যি কথাই বলেছে। তাই তার জবানবন্দী থেকে পাওয়া ওই দুটো সূত্রকে ধরেই আমাদের এগোতে হবে।”
“বেশ। তা হলে কুইই ডাকের কারণটা কী?”
“জেমসের বাবা জানতেন না যে সে ব্রিস্টল থেকে ফিরে এসেছে। আর তা যদি হয় তো কুইই করে ম্যাকার্থি তাঁর ছেলেকে ডাকেননি। তা হলে কাকে ডাকলেন। তিনি বলেছিলেন যে, বিকেলে তাঁর একজনের সঙ্গে দেখা করবার কথা আছে। যাঁর সঙ্গে তাঁর দেখা করবার কথা ছিল, তাঁকে ডাকবার জন্যেই তিনি কুইই বলেছিলেন। নিজেদের মধ্যে কুইই বলে ডাকাডাকি করাটা অস্ট্রেলিয়াতেই চলে। তাই এর থেকে এ কথাটা জোর করে বলা যায় যে, বস্কোম্ব ঝিলের ধারে ম্যাকার্থি যাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে ছিলেন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন।”
“তা হলে র্যাটের ব্যাপারটা কী?”
শার্লক হোমস পকেট থেকে একটা ভাঁজ-করা কাগজ বের করে সেটিকে টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখল। “এটা ভিক্টোরিয়া অঞ্চলের একটা ম্যাপ। আমি এটা ব্রিস্টল থেকে আনিয়েছি।” হোমস ম্যাপের একটা জায়গা হাত দিয়ে চেপে রেখে আমাকে বলল, “পড়ো!”
আমি পড়লাম, “আর্যাট।”
“এখন পড়ো তো।” হোমস হাতটা সরিয়ে নিল।
“বালার্যাট।”
“ঠিক। এই কথাটাই ম্যাকার্থি বলতে চেয়েছিলেন। জেমস শুধু শেষটুকু শুনতে পেয়েছিল। উনি ওঁর খুনির পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন। উনি বলতে চেয়েছিলেন যে, ওঁকে যে খুন করেছে তার বাড়ি বালার্যাট।”
“ওহ্। অদ্ভুত। আশ্চর্য! ভাবা যায় না।” আমি বলে উঠলাম।
“এটা তো জলের মতো সোজা ব্যাপার। তা হলে দেখছ যে আমি আমার তদন্তের বৃত্তটা ছোট করে এনেছি। তারপরে ওই ছাই রঙের জামার ব্যাপারটা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, জেমস সত্যি কথাই বলেছে। তা হলে এখন আমরা একজন লোকের পরিচয় পেলাম। ছাই রঙের কোট বা ওভারকোট-পরা একজন অস্ট্রেলীয়।”
“হ্যাঁ, ঠিক কথা,” আমি বললাম।
“আরও একটা কথা। সে লোকটি নিশ্চয়ই এই অঞ্চলের লোক। কেন না কোনও বাইরের লোক যে এই অঞ্চলের পথঘাট ভাল চেনে না তার পক্ষে বস্কোম্ব ঝিলে যাওয়া শক্ত।”
“নিশ্চয়ই।”
“তারপর আমাদের আজকের অভিযান। আমি অকুস্থল দেখে নিশ্চিত হলাম। আর মাথা-মোটা লেস্ট্রেডকে খুনির পরিচয় দিলাম।”
“কী দেখে তুমি নিশ্চিত হলে?”
“তুমি তো আমার রীতিনীতি জানো। তুচ্ছ জিনিসকে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেই কাজ হাসিল হয়।”
“লোকটা যে লম্বা তা নয় তুমি তার পায়ের ছাপের মধ্যেকার ফাঁকটা দেখে বুঝলে। তার পায়ের জুতোজোড়া যে সাধারণ জুতো নয়, জুতোর ছাপ দেখে বোঝা গেল। কিন্তু লোকটা যে খোঁড়া এটা তুমি জানলে কেমন করে?”
“তার বাঁ পায়ের দাগটা যত গভীর ভাবে বসে গেছে, ডান পায়ের ছাপটা তত গভীর হয়ে বসেনি। এর কারণ একটাই হতে পারে। সেটা হল লোকটি খোঁড়া।”
“বেশ। লোকটা যে ন্যাটা তা কী করে জানলে?”
“ওয়াটসন, করোনারের রিপোর্ট পড়ে তুমি ম্যাকার্থির আঘাত সম্বন্ধে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলে। আঘাত করা হয়েছিল পিছন থেকে। অথচ আঘাতটা মাথার বাঁ দিকে। এটা কী করে সম্ভব? এটা সম্ভব হতে পারে যদি সে খুনি ন্যাটা হয়। খুনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বাপ-ছেলের মধ্যে যে-সব কথাবার্তা হয়েছে সব শুনেছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে খুনি সিগার খেয়েছিল। তুমি জানো যে বিভিন্ন রকমের তামাকের ওপর আমি রিসার্চ করেছি। তার থেকে আমি টের পেলাম কোন দেশের তামাক দিয়ে সিগারেট তৈরি। তারপর ওই জায়গায় আর একটু খোঁজাখুঁজি করতেই একটা সিগারের টুকরো পেয়ে গেলাম। সিগারটা রটারডামে তৈরি।”
“সিগার হোলডারটা?”
“সিগারের পড়ে-থাকা টুকরোটায় দাঁত দিয়ে চেপে ধরার দাগ দেখতে পেলাম না। তাতেই বুঝলাম সিগার হোলডার ব্যবহার করা হয়েছে। সিগারের ধারটা কামড়ে ছেঁড়া হয়নি, ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে। কিন্তু কাটাটা বেশ পরিষ্কার নয়। তাতেই বুঝলাম পেনসিল কাটবার ভোঁতা ছুরি খুনির কাছে ছিল।”
“হোমস,” আমি বললাম, “তুমি তো খুনিকে একেবারে বেড়াজাল দিয়ে ঘিরে ফেলেছ। ওর আর পালাবার রাস্তা নেই। জেমস ছোকরাকে তুমি ফাঁসির দড়ি কেটে বের করে এনেছ। বুঝতে পেরেছি তুমি কার কথা বলতে চাইছ। খুনি হচ্ছে—”
“মিঃ জন টার্নার,” হোটেলের বেয়ারা আমাদের ঘরের দরজা খুলে বলল।
ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁর চেহারা তাকিয়ে দেখবার মতো। ভদ্রলোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। তবে মোটা মোটা আঙুল আর লম্বা লম্বা হাত পা দেখলে বোঝা যায় যে ভদ্রলোকের গায়ে এখনও বেশ জোর আছে। ভদ্রলোকের আর একটা দেখবার মতো জিনিস ওঁর চোখ-মুখের ভাব। ওঁর মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে বেশ শক্ত ধাতের মানুষ তিনি। ভদ্রলোকের মাথা-ভরতি উসকোখুসকো চুল, বড় বড় দাড়ি আর অসম্ভব মোটা ভুরু। এককথায় বেশ ভয়-পাওয়ানো জাঁদরেল চেহারা। তবে ডাক্তার হিসেবে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে, ভদ্রলোক খুব খারাপ আর কঠিন কোনও অসুখে ভুগছেন। ভদ্রলোকের মুখের রং ব্লটিং পেপারের মতো সাদা। শুধু ঠোঁটদুটো আর নাকের ডগাটা সামান্য নীল।
হোমস খুব নরম ভাবে বলল, “আপনি দয়া করে এই সোফাটায় বসুন।…আমার চিঠি ঠিক সময়ে পেয়েছিলেন তো?”
“হ্যাঁ। মোরান ঠিক সময়েই পৌঁছে দিয়েছে। আপনি লিখেছেন যে কেলেঙ্কারি এড়াবার জন্যে আমি যেন আপনার সঙ্গে হোটেলে এসে দেখা করি।”
“হ্যাঁ। আমার মনে হয়েছিল যে আমি আপনার বাড়িতে গেলে পাঁচজনে পাঁচকথা বলতে পারে।”
“কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান কেন!” ভদ্রলোক হোমসের মুখের দিকে এক পলকের জন্য তাকালেন। ভদ্রলোকের মুখ দেখে আমার মনে হল যে কেন হোমস তাঁকে এখানে ডেকে এনেছে তা তিনি জানেন।
“ব্যাপারটা নিহত চার্লস ম্যাকার্থিকে নিয়ে। আমি সব জেনে গেছি।”
ভদ্রলোক দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। তারপর এক সময়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন, “বিশ্বাস করুন, ভগবানের নামে দিব্যি করে বলছি, জেমসের কোনও ক্ষতি আমি করব না। আমি ঠিক করেছি জেমসের বিচার শুরু হলেই আদালতে গিয়ে সব কথা বলে দেব।”
হোমস গম্ভীর ভাবে বলল, “আপনার কথা শুনে সুখী হলাম।”
“আমি এখনই সব কথা বলতে পারতাম। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে বলতে পারিনি। আমাকে পুলিশে গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে গেলে ও বেচারা ভীষণ কষ্ট পাবে।”
“ব্যাপারটাকে অতদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবার কোনও দরকার নেই,” হোমস বলল।
“আপনি কী বললেন?”
“আমি তো সরকারি পুলিশ নই। আর জেমসকে বাঁচাবার জন্যে আপনার মেয়েই আমাকে এই খুনের তদন্ত করবার জন্যে ডেকে এনেছিলেন। যাই হোক জেমসকে তো বাঁচাতে হবেই।”
মিঃ টার্নার বললেন, “আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। বহুদিন ধরে আমি ডায়াবিটিসে ভুগছি। ডাক্তারদের মতে আর বড় জোর মাসখানেক আমার আয়ু। জেলখানায় নয়, নিজের বাড়িতে আমি শেষ নিশ্বাস ফেলতে চাই মিঃ হোমস।”
হোমস সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসল। একতাড়া কাগজ আর কলম টেনে নিয়ে বলল, “আপনি আমাকে সত্যি কথাটা বলুন। আমি শুধুমাত্র মূল ঘটনাটা লিখে নেব, তারপর আপনি সেটায় সই করবেন। আর ওয়াটসন সাক্ষী হিসেবে সই করবে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে নেহাত বাধ্য না হলে আপনার এই স্বীকারোক্তির কথা আর কাউকে জানাব না।”
“বেশ তবে তাই হোক। আমি কোর্টের শুনানির দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকব কিনা সন্দেহ। ব্যাপারটা খুলে বলছি। কাজটা ভেবে ঠিক করতে যত সময় লেগেছিল বলতে অবশ্য মোটেই সময় লাগবে না।
“আপনারা ম্যাকার্থিকে চিনতেন না। লোকটা আস্ত শয়তান। আমি বলছি। ভগবান যেন কখনও ও রকম লোকের খপ্পরে আপনাদের না ফেলেন। কুড়ি বছর ও আমার পিছনে লেগে আছে। আমার জীবন একবারে ছারখার করে দিয়েছে। কী ভাবে আমি ওর পাল্লায় পড়লাম সেই কথাটা আগে বলি।
“১৮৬০ সালের কথা। আমার তখন বয়স কম। রক্ত গরম। উৎসাহ খুব। সবকিছুতেই একটা ‘ঠিক আছে দেখা যাবে’ গোছের ভাব। এই সময় আরও অনেকের মতো পয়সা রোজগারের ধান্দায় আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু ভাগ্যদোষে আমি বদ সঙ্গে পড়ে গেলাম। তারপর যা হয়, সঙ্গদোষে আমিও অসৎ পথ ধরে ফেললাম। সৎ পথে পরিশ্রম করে পয়সা রোজগারের চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে রাহাজানি করতে লাগলাম। আমাদের দলে সবসুদ্ধ ছ’জন ছিল। আমাদের পয়সা উপায়ের রাস্তা ছিল গাড়ি আটকে টাকাপয়সা লুঠ করা। আমার নাম হয়েছিল বালার্যাটের ব্ল্যাক জন।
“একবার খবর পেলাম যে গাড়িতে করে বালার্যাট থেকে মেলবোর্নে সোনা চালান যাবে। আমরা সেই রাস্তার এক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। তারপর গাড়িটা আসতেই সেটাকে ঘিরে ফেললাম। গাড়িতে ছ’জন সৈন্য ছিল। আমাদের দলেও আমরা ছ’জন ছিলাম। খুব জোর লড়াই হল। আমরা ওদের চারজনকে খতম করে দিলাম। অবশ্য আমাদের দলেরও তিনজন মারা গেল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সোনা-ভরতি থলিগুলো হাতিয়ে নিয়ে আমরা সেখান থেকে চম্পট দিলাম। ওই গাড়িটা চালাচ্ছিল চার্লস ম্যাকার্থি। আমি ওর রগে পিস্তল ঠেকিয়ে ওকে আটকে রেখেছিলাম। পরে আমার অনেক বার মনে হয়েছে যে সেদিন ওকে দয়া করে না ছেড়ে দিয়ে গুলি করে শেষ করে দিলেই ভাল হত। যাই হোক অনেক সোনাদানা পেয়ে আমরা তো বড়লোক হয়ে গেলাম। তখন আমি ও দেশ ছেড়ে চলে এলাম। তবে এখনও ওখানকার লোকেরা ‘বালার্যাট’ দলের কথা ভুলে যায়নি। ইংল্যান্ডে ফিরে এসে জমিজমা ঘরবাড়ি কিনে এইখানে থিতু হয়ে বসলাম। কিছুদিন পরে আমার বিয়ে হল। আমার স্ত্রী অল্প বয়সে মারা যান। তখন আমার মেয়ে অ্যালিস খুব ছোট। বেশ ভালই ছিলাম, এমন সময় মাকার্থি কোথা থেকে এসে হাজির হল।
“একদিন ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে লন্ডন গেছি, হঠাৎ রিজেন্ট স্ট্রিটে ম্যাকার্থির সঙ্গে দেখা। আমাকে ঠিক চিনেছে। আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কানে কানে বলল, ‘জ্যাক, আমার আর আমার ছেলের ভরণপোষণের সব ভার তোমাকে নিতে হবে। যদি রাজি না হও তো দেখো মোড়ের কাছেই পুলিশ পাহারা রয়েছে। আর তুমি তো ভাল রকমই জানো যে, ইংল্যান্ডে ন্যায়বিচার তো পাওয়া যায়ই আর অপরাধীরও শাস্তি হয়।’
“সেই দিন থেকে ওরা আমার ঘাড়ে চেপে বসল। ওর হাত থেকে আমার রেহাই ছিল না। সব সময়ে আমার কাছে ঘুরঘুর করত। ওর যখনই যা দরকার তক্ষুনি সেই জিনিসটা ওকে জোগাড় করে দিতে হত। এরই মধ্যে অ্যালিস বড় হতে লাগল। ওর ছেলেও বড় হল। একদিন লোকটা আমার কাছে একটা প্রস্তাব করল। ওর কথা শুনে আমি তো হতবাক। বলে কী? ওর ছেলের সঙ্গে অ্যালিসের বিয়ে দিতে হবে। আমি জানি জেমস ছেলে ভাল। তবু এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি রাজি হলাম না। ও আমাকে শাসাতে লাগল। আমি ওকে যা পারে করতে বললাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল এ ব্যাপারে আরও আলোচনার জন্যে আমরা ঝিলের ধারে দেখা করব।
“সেখানে গিয়ে দেখি চার্লস আর জেমস নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। চার্লসের কথা শুনতে শুনতে রাগে আমার মাথা ঝনঝন করতে লাগল। শেষকালে এই শয়তানটার খপ্পরে অ্যালিস পড়বে? ওটার হাত থেকে অ্যালিসকে বাঁচাবার কোনও রাস্তাই কি নেই? আমার দিন তো ফুরিয়ে এসেছে। আমি মনকে শক্ত করলাম। বিশ্বাস করুন, ওকে মারবার সময় আমার এক ফোঁটা কষ্ট বা অনুশোচনা হয়নি। আমার মনে হল যে বিষাক্ত কীটকে মারলাম। মিঃ হোমস, যে-কাজ করেছি তার জন্যে আমার মনে কোনও দুঃখ নেই। প্রয়োজন হলে আমি ফের এই কাজ করব। এই হচ্ছে আমার কাহিনী।”
একটু চুপ করে থেকে হোমস গম্ভীর গলায় বলল, “আমি আপনার কাজের ভালমন্দ বিচার করতে চাই না। তবে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি এ রকম সমস্যায় আমাদের আর যেন পড়তে না হয়।”
মিঃ টার্নার বললেন, “সে কথা থাক। এখন আপনি কী করতে চান?”
“কিছুই না। শিগগির হয়তো আপনাকে আরও বড় আদালতের সামনে বিচারের জন্যে দাঁড়াতে হবে। সেখানেই আপনার বিচার হবে। আপনার এই স্বীকারোক্তি আমি আমার কাছে রেখে দেব। জেমসকে যদি আর কোনও উপায়ে বাঁচাতে না পারি তবেই আমি এটা আদালতে পেশ করব।”
“ঠিক আছে। তা হলে চলি। ভগবান আপনাদের মঙ্গল করুন।” মিঃ টার্নার প্রায় টলতে টলতে বেরিয়ে গেলেন।
শেষ অবধি অবশ্য হোমসকে টার্নারের গোপন কথা ফাঁস করতে হয়নি। সরকারি পক্ষের উকিল জেমসের বিরুদ্ধে যে-সব প্রমাণ দাখিল করেছিলেন তার ভেতর অনেক গলদ ছিল। অন্য লোকের চোখে সে গলদ ধরা না পড়লেও হোমসের চোখ এড়ায়নি। হোমস সেগুলো জেমসের উকিলকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর তাতেই জেমস বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। টার্নার অবশ্য এরপর আরও সাত-আট মাস বেঁচে ছিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন