আর্থার কোনান ডয়েল
আমার বন্ধু শার্লক হোমসের কাজকর্মের টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে আমি সেই ঘটনাগুলোই বেছে নিয়েছি, যেগুলোর ফয়সালা সে করতে পেরেছে। অবশ্য এর একটা বড় কারণ হল যে, শার্লক হোমস যে-সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, সে সমস্যার সমাধান আর কেউই করতে পারেনি। সে সমস্যা চিরকালের জন্যে সমস্যাই রয়ে গেছে। এই ঘটনাগুলোর কোনও কোনওটা আমি তার কাছে শুনেছি, আর অনেকগুলোর সমাধানের সময় আমি তার সঙ্গে থেকেছি। তবে যেটা বরাবর লক্ষ করেছি সেটা হল, যখন শার্লক হোমস কোনও রহস্যের মোকাবিলা করতে পারছে না, তখন তার দক্ষতা, ক্ষমতা আর জেদ যেন দশ গুণ বেড়ে যায়। আবার দু’-একবার এমনও হয়েছে যে, শার্লক হোমস ভুল পথে এগিয়েও রহস্যের মোকাবিলা করে ফেলেছে। আমার ডায়েরিতে এই ধরনের গোটা-ছয়েক ঘটনার কথা লেখা আছে। তার মধ্যে দুটো ঘটনা খুবই ইন্টারেস্টিং। সেই দুটো ঘটনার একটা ঘটনা আজ লিখব বলে ঠিক করেছি।
স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য ব্যায়ামট্যায়াম করা শার্লক হোমসের ধাতে নেই। অথচ তার গায়ে জোর সাংঘাতিক। শুধু গায়ের জোরই নয়, বক্সিংয়েও তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কী জানি কেন, মুগুর ডাম্বেল ভাঁজা বা ডনবৈঠক দেওয়ার ব্যাপারটাকে হোমস সময় আর ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মনে করে। তাই নেহাত তদন্তের ব্যাপার ছাড়া ঘর থেকে বেরোত না। আর যখন কোনও তদন্তের কাজে হাত দিত, তখন সে দিনরাত নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করত। তখন তাকে ক্লান্ত হয়ে জিরোতে দেখিনি কখনও। কী করে যে হোমস নিজেকে এমন ‘ফিট’ রাখে, সেটা সত্যি একটা আশ্চর্যের কথা। অবশ্য একটা কারণ এই হতে পারে যে, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে হোমস খুব সাবধানী। সে খায় খুব সামান্য। আর খায়ও সাদাসাপটা। আর একটা কারণ হতে পারে যে ধূমপান ছাড়া তার অন্য কোনও নেশা নেই।
শীত শেষ হয়ে বসন্ত আসি আসি করছে। হোমস খুব খোশমেজাজে ছিল। আমাকে টেনে নিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। আমরা পার্কে ঢুকলাম। সবে গাছে গাছে কচিপাতা বেরোতে শুরু করেছে। প্রায় দু’ ঘণ্টা আমরা চুপচাপ সেখানে বেড়াতে লাগলাম। তারপর আমরা যখন বেকার স্ট্রিটে ফিরে এলাম, তখন পাঁচটা বেজে গেছে।
আমরা ফিরে আসতেই আমাদের কাজের লোকটি বলল, “একজন ভদ্রলোক আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।”
হোমস আমার দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল, “বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল!” হোমস আমাকে কথা শুনিয়ে দিল। তারপর ছেলেটাকে বলল, “সে ভদ্রলোক কি চলে গেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কি তাঁকে ঘরে বসতে বলোনি?”
“বলেছিলাম। তিনি ঘরে বসেও ছিলেন।”
“তিনি কতক্ষণ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন?”
“তা প্রায় আধঘণ্টা তো হবেই। তবে ভদ্রলোক খুব ছটফট করছিলেন। আমি তো বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম যে, ভদ্রলোক একবার বসছেন, একবার দাঁড়াচ্ছেন, একবার পায়চারি করছেন। তারপর এক সময় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উনি বললেন, ‘ভদ্রলোক ঘরে ফিরবেন না নাকি?’ ঠিক এই কথাগুলোই উনি বলেছিলেন। আমি বললাম, ‘আপনি আর একটু বসুন। উনি এক্ষুনি এসে পড়বেন।’ তখন ভদ্রলোক বললেন, ‘তা হলে আমি বরং বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। ঘরের মধ্যে আমার হাঁফ ধরছে।’ আমার কথায় কান না দিয়ে ভদ্রলোক তড়বড় করে নেমে গেলেন।”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হোমস কাজের ছেলেটিকে বলল, “না, তোমার কোনও দোষ নেই”, তারপর আমাকে বলল, “খুব বিরক্ত লাগছে। বুঝলে ওয়াটসন, মাথা খাটাবার মতো কোনও বিষয়ই আমার হাতে নেই। ভদ্রলোক যে রকম উত্তেজিত আর অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন, তার থেকে মনে হচ্ছে যে, তাঁর আমার কাছে আসবার কারণটা বেশ জরুরি।…আরে আরে, টেবিলের ওপর ওই পাইপটা তো তোমার নয়। নিশ্চয়ই সেই ভদ্রলোকই এই পাইপটা ফেলে গেছেন। দেখি তো। বেশ পুরনো ব্রায়ার পাইপ। বাজারে এগুলোকে বলে অ্যাম্বার। এ ধরনের খাঁটি অ্যাম্বার লন্ডন শহরে খুব বেশি আছে বলে আমার মনে হয় না। লোকে বলে খাঁটি অ্যাম্বারের মধ্যে একটা দাগ থাকে। নকল দাগ দিয়ে জাল অ্যাম্বার তৈরি করাটা একটা বড় ব্যবসা। যে-কোনও কারণেই হোক ভদ্রলোক মনে মনে এতই বিচলিত হয়ে পড়েছেন যে, তাঁর এই প্রিয় পাইপটা এখানে ফেলে গেছেন।”
আমি বললাম, “পাইপটা যে ভদ্রলোকের প্রিয়, একথাটা তুমি জানলে কেমন করে?”
“দেখো ওয়াটসন, এই পাইপটার দাম হবে বড়জোর সাড়ে সাত শিলিং। আচ্ছা এইবার দেখো, পাইপটাকে দু’বার মেরামত করা হয়েছে। একবার নলটা সারানো হয়েছে, আর একবার মুন্ডিটা সারানো হয়েছে। দু’জায়গাতেই রুপোর পাত মেরে দেওয়া হয়েছে। এই এক-একটা রুপোর পাতের দাম পাইপটার দামের চাইতে বেশি। ভদ্রলোক এত খরচ করে দু-দু’বার পাইপটা কখনও সারাতেন না, যদি এটার ওপর তাঁর বিশেষ টান না থাকত। এর চাইতে ঢের কম পয়সায় তিনি একটা নতুন পাইপ কিনে নিতে পারতেন।”
লক্ষ করলাম, হোমস পাইপটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে। তাই আমি বললাম, “এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারো!”
হোমস পাইপটা তুলে ধরল। তারপর মেডিকেল কলেজে অধ্যাপকমশাইরা যেমন একটা হাড়ের টুকরোর ওপর আঙুল দিয়ে দাগ টানতে টানতে বক্তৃতা দেন, সেই রকম ভাবে বলতে লাগল, “পাইপ থেকে একটি মানুষ সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারা যায়। ঘড়ি আর জুতোর ফিতের পরে পাইপই হচ্ছে একমাত্র জিনিস, যেটাকে খুঁটিয়ে দেখলে সেই মানুষটির স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে প্রায় সব কথাই জানা যায়। কিন্তু এই পাইপটায় সে রকম কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়ছে না। এই পাইপের মালিকের স্বাস্থ্য বেশ ভাল। ভদ্রলোক ন্যাটা। তাঁর দাঁত খুব ভাল। স্বভাব অগোছালো। অবস্থা ভাল, হিসেব করে চলতে হয় না।”
হোমস কথাগুলো তরতর করে বলে গেল। তারপর আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি বুঝতে পারলাম, সে জানতে চাইছে যে, কোন তথ্যের ওপর নির্ভর করে সে এই কথাগুলো বলেছে তা আমি বুঝতে পেরেছি কিনা।
“লোকটি সাড়ে সাত শিলিং দামের পাইপ ব্যবহার করছে বলে তুমি ধরে নিচ্ছ যে, তার অবস্থা ভাল,” আমি বললাম।
পাইপটা থেকে ঠুকে ঠুকে তামাক হাতের চেটোয় বের করে হোমস বলল, “এই তামাকের নাম গ্রোভনার মিক্সচার। এক আউন্সের দাম আট পেন্স। এর অর্ধেক দামে ভাল ভাল তামাক পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও যখন উনি এই তামাকই ব্যবহার করেন, তখন বোঝা যাচ্ছে যে, ওঁর পয়সার টানাটানি নেই।”
“কিন্তু আর সব কথা তুমি জানলে কী ভাবে?”
“গ্যাস থেকে পাইপ ধরানো ভদ্রলোকের অভ্যেস। দেখো, পাইপের মুন্ডির পাশটা পুড়ে গেছে। দেশলাই দিয়ে পাইপ ধরালে এ ভাবে পুড়ত না। দেশলাইটা লোকে তামাকের ওপরে ধরে, পাইপের ধারে নয়। ধারটা পুড়তে পারে আগুনের ওপর ধরলে। তারপর দেখো, পাইপের ডানদিকটাই বেশি পুড়েছে। এর কারণ হচ্ছে, ভদ্রলোক ন্যাটা। তুমি যদি তোমার পাইপটা ওই ভাবে ধরাও তো দেখবে, বাঁ দিকটা পুড়বে। কেন না তুমি ন্যাটা নও। এক-আধ বার তোমার ডান দিকটা পুড়তে পারে। তবে বেশি পুড়বে বাঁ দিকটা। তারপর দেখো, অ্যাম্বারের ওপর ভদ্রলোকের সঁতের দাগ বসে গেছে। পাইপকে এই ভাবে কামড়ে ধরতে পারে সেই লোকই যার গায়ে বেশ তাগত আছে, আর যার দাঁতও বেশ মজবুত। তবে আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তো ওই বোধহয় সিঁড়িতে ভদ্রলোকের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর, তা হলে পাইপ নয়, পাইপের মালিককেই আমরা দেখতে পাব।”
হোমসের কথা শেষ হতে-না-হতেই এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোক বেশ লম্বা। বয়স কম। তাঁর জামাকাপড় দামি, তবে সাধাসিধে। তার বাঁ হাতে একটা তামাটে রঙের ফেল্ট হ্যাট। আমার মনে হয়েছিল ভদ্রলোকের বয়েস তিরিশের কমই হবে। পরে জানতে পেরেছিলাম যে, ভদ্রলোকের বয়স তিরিশের ঢের বেশি।
ঘরে পা দিয়েই ভদ্রলোক বেশ লজ্জিত ভাবে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি না-বলে-কয়েই ঘরে ঢুকে পড়েছি। আমার উচিত ছিল দরজায় টোকা দিয়ে আপনাদের জানিয়ে ঘরে ঢোকা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার মাথার ঠিক নেই। আর তাই আমি এ রকম অসভ্যের মতো ঢুকে পড়েছি।” তারপর ভদ্রলোক কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চেয়ারে বসে পড়লেন। লিখছি বটে বসলেন, তবে আমার মনে হল তিনি যেন চেয়ারের ওপর ধপ করে পড়ে গেলেন।
হোমস তার স্বভাবসুলভ সহজ ভঙ্গিতে বলল, “বুঝতে পারছি আপনি দু’-এক রাত জেগেই কাটিয়েছেন। রাত্তিরে ঘুম না হলে আমাদের শরীরে যত ধকল হয় তা বেশি খাটাখাটনি করলে বা হইহুল্লোড় করে মাতামাতি করলেও হয় না। বলুন তো, আমি কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।”
“আমি আপনার পরামর্শ চাই। কী যে করব কিছুই ঠিক করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার বোধহয় সব শেষ হয়ে গেল।”
“আপনি কি চান যে, আমি একজন গোয়েন্দা হিসেবেই আপনাকে পরামর্শ দিই?”
“না, না, তা নয়। একজন বিবেচক মানুষ হিসেবে আপনার মত জানতে চাইছি। কী করব আমি। আপনি আমাকে বলে দিন আমার কী করা উচিত। ঠিক পথের হদিস পাব বলেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।”
ভদ্রলোকের কথা বলার ধরনটা লক্ষ করছিলাম। খানিকক্ষণ কথা বলেই তিনি চুপ করে যাচ্ছিলেন। আবার দু’-একটা কথা বলে ফের চুপ করছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, খুব দুঃখের সঙ্গেই তিনি কথাগুলো বলছিলেন। আর কথাগুলো বলতে তাঁর মোটেই ইচ্ছে করছিল না।
ভদ্রলোক বলছিলেন, “ব্যাপারটা মানে খুবই ইয়ে আর কি। ঘরের কথা বাইরে কে বলতে চায় বলুন? দেখুন না, আপনাদের সঙ্গে আমার আজই পরিচয় হল। আপনাদের কাছে বাড়ির লোকের কাণ্ডকারখানা বলাটা আমার পক্ষে কতখানি দুঃখের।…কিন্তু আমি যে আর পারছি না। আমি আমার ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। আমাকে কারও পরামর্শ নিতেই হবে।”
ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে হোমস বলল, “মিঃ গ্রান্ট মনরো…”
ভদ্রলোক তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন, “আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?”
হোমস মুচকি হেসে বলল, “আপনি যদি নিজের নামধাম গোপন রেখে কোনও কাজ করতে চান তো টুপির পট্টিতে নিজের নাম লিখে রাখবেন না। আর নয় তো এমন ভাবে বসে কথা বলবেন যে, যার সঙ্গে কথা বলছেন, সে যেন আপনার চাঁদি ছাড়া আর মাথার অন্য কোনও দিক দেখতে না পায়। সে কথা থাক। আমি আপনাকে যা বলছিলাম তা হল এই যে, এই ঘরে অনেক লোক এসে তাদের মনের দুঃখের কথা আমাদের বলেছে। ভগবানের দয়ায় তাদের অনেকের মনের কষ্ট আমরা দূর করতে পেরেছি। আমি আশা করি, আপনার মনের কষ্টও আমরা দূর করতে পারব। আর সেইজন্য আমি আপনাকে বলছি যে, আর কথা না বাড়িয়ে আপনার সমস্যার সবকিছু আমাকে খুলে বলুন। সব কথা কিন্তু আমার জানা দরকার।”
আমাদের মক্কেল বেশ কিছুক্ষণ দু’হাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে রইলেন। ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে আমার মনে হল যে, ইনি খুবই মুখচোরা ধরনের লোক, আড়ালে আড়ালে থাকতেই ভালবাসেন। নিজের কথা কাউকে বলতে চান না। এখন বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে বলে মুশকিলে পড়েছেন। এই ভাবে বেশ খানিকক্ষণ বসে থেকে এক সময় তিনি বলতে লাগলেন, “ব্যাপারটা হচ্ছে এই। বছর তিনেক আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী বেশ সুখে স্বচ্ছন্দেই ছিলাম। আমাদের মধ্যে কোনও ব্যাপারে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। হঠাৎ গত সোমবার থেকে আমার স্ত্রী, এফির কী যে হয়েছে বলতে পারি না, একদম বদলে গেছেন। তাঁর হাবভাব, আচার-আচরণ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এ যেন একজন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। আর কেন যে তিনি হঠাৎ এ রকম পালটে গেলেন তা আমি কিছুতেই ধরতে পারছি না।
“তবে একটা কথা গোড়াতেই আপনাকে পরিষ্কার করে বলা ভাল। এফি অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, স্নেহপ্রবণ, সুশীল প্রকৃতির মেয়ে। তাঁর মতো স্বভাবচরিত্রের মেয়ে আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। সবচেয়ে বড় কথা যে, তাঁর শারীরিক বা মানসিক কোনও অসুখই নেই। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস…”
ভদ্রলোক হয়তো আরও কিছু বলতেন, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শার্লক হোমস বলল, “আপনার বিশ্বাসের কথা পরে শুনব। আগে ফ্যাক্টস, মানে যা যা ঘটেছে, সেগুলো আমাকে বলুন।”
“আচ্ছা, তা হলে আগে এফির কথাই আপনাকে বলি। এফির সঙ্গে আমার যখন আলাপ হয়, তখন তাঁর নাম ছিল মিসেস একি হেব্রোন। খুব অল্প বয়সে আমেরিকান আইনজীবী মিঃ হেব্রোনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। তিনি আমেরিকায় ওকালতি করতেন। পসারও ছিল খুব। আটলান্টা শহরে ওঁরা থাকতেন। ওঁদের একটি ছেলেও হয়েছিল। হঠাৎ আটলান্টা শহরে ‘ইয়েলো ফিভার’ দেখা দেয়। আর অল্প দিনের মধ্যেই সেটা মহামারীর আকার নেয়। ইয়েলো ফিভারে মিঃ হেব্রোন আর ছেলেটি মারা যায়। আমি তাঁদের সরকারি ডেথ সার্টিফিকেট দেখেছি। এই ঘটনার পর এফির আর আমেরিকায় মন টেঁকেনি। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। মিডলসেক্সের পিনারে এফির এক বুড়ি পিসি থাকেন। তিনি বিয়ে করেননি। এফি তাঁর কাছে চলে আসেন। আগেই বলেছি, মিঃ হেব্রোনের বেশ ভাল পসারই ছিল। তাই তিনি এফির জন্যে ভাল রকম টাকাপয়সারই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। সাড়ে চার হাজার পাউন্ড এফির নামে এমন ব্যবস্থা করা আছে যে, তার থেকে কম পক্ষে শতকরা সাত পাউন্ড সুদ তিনি পাবেনই। এফির সঙ্গে আমার আলাপ হয় পিনারে। তার বেশ কিছুদিন আগে তিনি আমেরিকা থেকে চলে এসেছেন। তখন তাঁর বয়স পঁচিশ বছর।
“আমি একজন ব্যবসাদার। আমার আয় মোটামুটি সাত-আটশো পাউন্ড। আমাদের অবস্থা বেশ ভালই। আমরা নরবেরিতে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছি। শহরের খুব কাছে হলেও নরবেরি অঞ্চলটা বেশ পাড়াগাঁ পাড়াগাঁ। আমাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা ছোট হোটেল আর দুটো বাড়ি আছে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় মাঠ। মাঠের উলটো দিকে একটা বাড়ি। এ ছাড়া আমাদের বাড়ির কাছে আর কোনও বাড়ি নেই। লোকালয় বলতে আর যা তা আমাদের বাড়ি থেকে স্টেশনে যাবার অর্ধেক পথে। কাজের জন্যে আমাকে প্রায়ই লন্ডনে যেতে হয়। তবে গরমকালে কাজের চাপটা সাধারণত কম থাকে। তাই আমরা সেই সময়ে বেশ স্ফুর্তিতেই ঘরে দিন কাটাই।
“একটা কথা আপনাদের বলা দরকার। আমাদের যখন বিয়ে হয়, তখন আমার স্ত্রী তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেন। আমি অনেক আপত্তি করেছিলাম। কেন না আমার ভয় ছিল যে, ব্যবসায় লোকসান হলে ব্যাপারটা আমার পক্ষে খুব খারাপ হবে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। শেষকালে তাঁর কথামতোই ব্যবস্থা হল। যাক সে কথা। আজ থেকে মাস-দেড়েক আগে একদিন এফি আমার কাছে এসে বললেন, ‘তুমি যখন আমার টাকা নিতে রাজি হয়েছিলে তখন বলেছিলে যে, আমার দরকার পড়লে আমি তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারব।’
‘“নিশ্চয়ই। এ তো তোমারই টাকা,’ আমি জবাব দিলাম।
‘“বেশ। তা হলে আমাকে একশো পাউন্ড দাও।’
“এফির কথায় আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম যে, তিনি বোধহয় কোনও নতুন জামাকাপড় কিনবেন।
‘“এত টাকার কী দরকার হল,’ আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
“একটু রসিকতা করে এফি বললেন, ‘তখন তুমি বলেছিলে যে, তুমি আমার ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে গেলে কৈফিয়ত দিতে হয় বুঝি?’
‘“তুমি যদি জিনিসটা এ ভাবে দেখো, তা হলে কোনও কথা বলা চলে না। টাকাটা তুমি পাবে।’
‘“হ্যাঁ, টাকাটা আমার চাই।’
‘“কী জন্যে টাকাটা তোমার চাই, তা তুমি আমাকে বলবে না?’
‘“পরে বলব। তবে এখন বলা যাবে না।’
‘“ঠিক আছে।’
“আমি আর কিছু না বলে এফিকে একটা একশো পাউন্ডের চেক লিখে দিলাম। ব্যাপারটা আমি এক সময় একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। এর পরের ঘটনার সঙ্গে এ ব্যাপারটার হয়তো কোনও যোগ নেই। তবে আমার মনে হল সবকিছু আপনাকে খুলে বলাই ভাল।”
মিঃ গ্রান্ট একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আবার শুরু করলেন তাঁর কাহিনী, “আমি আপনাদের আগেই বলেছি যে, আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা বাড়ি আছে। আমাদের বাড়ি আর সেই বাড়িটার মাঝখানে একটা মাঠ। তবে ওই বাড়িটায় যেতে গেলে রাস্তা দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর একটা ছোট গলি দিয়ে বেঁকে যেতে হয়। তার পরেই খানিকটা বাগানের মতো আছে। সেখানে পায়চারি করতে আমার খুব ভাল লাগে। গত আট মাস ধরে বাড়িটা খালিই পড়ে আছে। যাতায়াতের পথে আমি মাঝে মাঝে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের মনেই ভাবি, আহা, কী সুন্দর বাড়িটা!”
হোমস বলল, “তারপর?”
“গত সোমবার সন্ধেবেলা আমি ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলাম। দেখলাম, একটা খালি ভ্যানগাড়ি ওই বাড়িটার দিক থেকে আসছে। ভাল করে নজর করতে দেখতে পেলাম বাড়িটার দরজার কাছে কার্পেট আর নানান জিনিস নামানো রয়েছে। বুঝলাম, বাড়িটায় এবার লোক আসছে। আমি বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, যারা আসছে তারা কেমন ধরনের লোক কে জানে! দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হল দোতলার জানলা থেকে কেউ যেন আমাকে দেখছে।
“সেই মুখটা ঠিক কী রকম তা আমি বলতে পারব না। তবে সেই মুখের দিকে তাকাতেই আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। তাই সেই মুখটা আমি খুব ভাল করে দেখতে পাইনি। তবে যা দেখেছিলাম, তাতে আমার মনে হল এ কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মুখ নয়। এ কোনও অমানুষিক মুখ। আরও ভাল করে দেখবার জন্যে আমি একটু এগিয়ে গেলাম। কিন্তু আমি এগিয়ে যেতেই মুখটা জানলা থেকে সরে গেল। সরে গেল বললে ভুল হবে। আমার মনে হল, কে যেন ছোঁ মেরে মুখটাকে উপড়ে নিয়ে গেল। আমি প্রায় পাঁচ মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম যে, ব্যাপারটা কী হতে পারে। সে মুখটা কোনও ছেলের না মেয়ের তাও বুঝতে পারিনি। যেটা আমাকে আশ্চর্য করেছিল, সেটা হল, সেই মুখের রং। মুখটা বীভৎস রকমের হলদে। ব্যাপারটা এমন ভাবিয়ে তুলল যে, আমি ঠিক করলাম বাড়িতে কারা এসেছে সে খবরটা আমাকে নিতেই হবে। আমি সোজা এগিয়ে গিয়ে দরজার বেল টিপলাম। বেল টিপতেই এক বিরাট লম্বা-চওড়া মহিলা এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ দেখলেই ভয় হয়।
“খুব কড়া ভাবে তিনি আমাকে বললেন, ‘কী চাই?’ কথা বলার ধরন দেখে বুঝলাম ভদ্রমহিলার বাড়ি ইংল্যান্ডের উত্তর দিকে।
“আমি আমার বাড়িটা দেখিয়ে বললাম, “ওই দেখছেন আমার বাড়ি। আপনারা তো আমাদেরই পাড়াতে এলেন। দেখলাম কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। তাই এলাম যদি আপনাদের কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারি।’
“’তাই নাকি? বেশ, দরকার হলে আপনাকে খবর দেব,’ বলেই সেই মহিলা আমার মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এই রকম ভাবে অপমানিত হয়ে আমার মনখারাপ হয়ে গেল। আমি বাড়ি ফিরে গেলাম। যদিও এই ঘটনাটা আমি মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছিলাম, তবুও সারা সন্ধে বার বার সেই অস্বাভাবিক মুখ আর ভদ্রমহিলার দুর্ব্যবহারের কথা মনে পড়ছিল। আমি ঠিক করলাম, এসব কথা আমার স্ত্রীকে বলব না। তার এক নম্বর কারণ হচ্ছে যে, তিনি একটু ভিতু প্রকৃতির মহিলা, আর দু’নম্বর কারণ হচ্ছে, সেই মহিলার দুর্ব্যবহারের কথা বলে পড়শিদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণাটা আগে থেকেই খারাপ করে দেওয়া ঠিক নয়। যাই হোক, ঘুমোতে যাবার আগে আমি আমার স্ত্রীকে ওই বাড়িতে লোক আসবার কথা বললাম। আমার স্ত্রী অবশ্য কথাটা কানে নিলেন না।
“এমনিতে আমার ঘুম খুব গাঢ়। আমার এই ঘুমের জন্যে আত্মীয়রা আমাকে ঠাট্টা করে খুব। বলে যে, কোনও কিছুতেই নাকি আমার ঘুম ভাঙে না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা সন্ধেবেলার সেই বিচ্ছিরি ব্যাপারটার জন্যে হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, সে রাতে ঘুমটা মোটেই বেশ গভীর হচ্ছিল না। আধো ঘুম আর আধো তন্দ্রার মধ্যে আমার মনে হল ঘরের মধ্যে কী যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুমচোখ দেখলাম, আমার স্ত্রী বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আমি জড়িয়ে জড়িয়ে তাঁকে বোধহয় এত রাত্রে বাইরে যেতে বারণ করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মুখের ওপর মোমবাতির আলো পড়ায় আমার তন্দ্রা তো ছুটে গেলই, মুখ দিয়েও কোনও কথা বেরোল না। তাঁর মুখের ভাব একদম পালটে গেছে। এ রকম চেহারা তো আমি কোনও দিন দেখিনি। তাঁর মুখের রং একেবারে সাদা। তিনি রীতিমতো হাঁফাচ্ছেন। জামাকাপড় পরতে পরতে তিনি প্রায়ই খাটের দিকে আড়চোখে দেখে নিচ্ছিলেন, আমি ঘুমোচ্ছি কিনা। তারপর আমি ঘুমিয়ে আছি মনে করে পা টিপে টিপে ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম খট করে সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলাম। আমি চিমটি কেটে দেখে নিলাম যে, সত্যি সত্যি জেগে আছি না স্বপ্ন দেখছি। বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করে দেখলাম। রাত তিনটে। এত রাত্রে আমার স্ত্রী রাস্তায় বের হলেন কেন? আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
“আমি বিছানায় বসে বসে যতই চিন্তা করতে লাগলাম, ততই সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। আমি কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারলাম না। এমনি করে প্রায় মিনিট-কুড়ি কেটে গেল। হঠাৎ টের পেলাম, প্রায় নিঃশব্দে ঘরের দরজাটা খুলে গেল।
“আমার স্ত্রী ঘরে পা দিতেই আমি বললাম, ‘এত রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে এফি?’
“আমার কথা শুনে ভয়ানক চমকে গিয়ে এফি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। এফির কান্নায় আমি আরও হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী এমনিতেও হাসিখুশি স্ফূর্তিবাজ। আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম যখন দেখলাম যে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে এফি শুয়ে পড়লেন।
“একটু পরে খানিকটা জোর করে হাসতে হাসতে আমার স্ত্রী বললেন, ‘ও তুমি জেগে আছ? আমার ধারণা ছিল যে রাত্তিরে কোনও কিছুতেই তোমার ঘুম ভাঙে না।’
“আমি বেশ গম্ভীর গলায় বললাম, ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’
“তুমি খুব অবাক হয়ে গেছ দেখছি। অবশ্য অবাক হবারই কথা। সত্যি এর আগে এ রকম কখনও হয়নি। আমার কী রকম দম বন্ধ হয়ে আসছিল, হাঁফ ধরছিল। মনে হল বাইরের খোলা বাতাসে না ঘুরে এলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। তাই আমি বাইরের রাস্তায় দু’-চার মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন ঠিক হয়ে গেছি।’
“আমি লক্ষ করলাম এতক্ষণ এফি একবারও আমার মুখের দিকে তাকাননি। আর তাঁর গলার স্বরও কেমন অন্য রকম শোনাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম যে, এফি বাজে কথা বলছেন। তাই তাঁর কথার কোনও উত্তর দিলাম না। তবে ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কেন এফি বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন এই চিন্তাতেই আমার আর বাকি রাতটুকু ঘুম হল না।
“পরের দিন আমার লন্ডনে যাবার দরকার। কিন্তু একে সারা রাত ঘুম হয়নি, আর তার ওপর মাথার মধ্যে ওই চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল বলে আমি সকালবেলায় চুপচাপ বসে ছিলাম। এফিও কোনও কথা না বলে নিজের কাজ করতে লাগলেন। ঘরে বসে ভাল লাগছিল না। তাই ব্রেকফাস্ট সেরে একটু হাঁটতে বেরোলাম।
“হাঁটতে হাঁটতে ক্রিস্টাল প্যালেস অবধি চলে গেলাম। ঘণ্টাখানেক মাঠে মাঠে ঘুরে যখন নরবেরিতে এলাম, তখন একটা বেজেছে। ওই বাড়িটা আমার ফেরার পথে পড়ল। বাড়িটার সামনে এসে আমি একটু দাঁড়ালাম। ভাবলাম, সেই অস্বাভাবিক মুখের দেখা আর একবার যদি পাই। হঠাৎ দেখলাম, আমার স্ত্রী ওই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলেন। মিঃ হোমস, আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, তাঁকে এখানে দেখে আমি কী রকম আশ্চর্য হয়েছিলাম।
“আমাকে ওখানে দেখে আমার স্ত্রীও কম আশ্চর্য হননি। তিনি আমাকে দেখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি দেখলাম তাঁর হাত-পা কাঁপছে।
“আমাকে তিনি বললেন, ‘আমি এঁদের কোনও দরকারটরকার আছে কিনা জানতে এসেছিলাম। তুমি ও ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ?’
‘“ও, তা হলে তুমি কাল রাত্রে এখানেই এসেছিলে?’ আমি বললাম।
“আমার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি কী বলছ!’
“আমি ঠিকই বলছি, তুমি এখানেই এসেছিলে। এরা কারা, যাদের সঙ্গে অত রাত্রে তুমি চুপি চুপি দেখা করতে এসেছিলে।’
‘“আমি এখানে আগে কখনও আসিনি।’
“জেনেশুনে তুমি মিথ্যে কথা বলছ কেন? তোমার বলা থেকেই আমি বুঝতে পারছি যে, তুমি সত্যি কথা বলছ না। কেন ব্যাপারটা আমার কাছে চেপে যাচ্ছ? তুমি তো আগে এ রকম ছিলে না।’ আমি একটু রাগ করেই বললাম। তারপর বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি বাড়ির ভেতরে গিয়ে ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত করব।’
“আমার স্ত্রী অত্যন্ত উতলা হয়ে পড়লেন, ‘না, না। ভগবানের দোহাই এমন কাজ কোরো না।’ তাঁর কথা না শুনে আমি সেই বাড়ির সদর দরজার দিকে পা বাড়াতেই তিনি আমাকে হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন। ‘আমার কথা শোনো। ও রকম কোরো না। পরে এক সময় আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলব। কিন্তু আমার কথা না শুনে যদি এখনই তুমি ও বাড়িতে যাও তা হলে ভাল তো হবেই না, ফল উলটো হবে।’
“আমি আমার স্ত্রীর কথায় কান না দিয়ে তাঁকে একরকম জোর করে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। আমার স্ত্রী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
‘“আমাকে বিশ্বাস করো, তুমি ঠকবে না। এইবারের মতো আমাকে বিশ্বাস করো, তোমার ভাল হবে। যদি তুমি আমার কথা শুনে এখান থেকে এখনই চলে আসো তো তুমি ঠকবে না। আর আমার কথা না শুনে জোর করে যদি বাড়ির মধ্যে যাও তো তুমিই পরে পস্তাবে।’
“আমার স্ত্রীর বলার ধরনে এমন একটা কিছু ছিল যে, আমি কী করব ঠিক করতে পারছিলাম না। শেষকালে বললাম, ‘ঠিক আছে। একটি শর্তে আমি তোমার কথা মানতে পারি। সেটা হল এই ব্যাপারের এখানেই ইতি করতে হবে। তোমার আর এখানে আসা চলবে না। এটা করতে তুমি যদি রাজি থাকো, তবে আমি এ সম্বন্ধে আর কোনও কথা জানতে চাইব না।’
“আমার স্ত্রী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি জানতুম তুমি আমার কথা শুনবে। ঠিক আছে, তুমি যা বলছ তাই হবে। এখন এখান থেকে চলো তো।’ আমার স্ত্রী আমার হাত ধরে টানতে টানতে আমাকে সেখান থেকে নিয়ে এলেন। সেখান থেকে চলে আসবার সময়ে আমি পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, সেই অদ্ভুত ধরনের মুখটা দোতলার জানলার বন্ধ শার্সির ভেতর দিয়ে আমাদের লক্ষ করছে। আমার মাথাটা ঘুরে গেল। ওই মুখটা কার? তার সঙ্গে আমার স্ত্রীর যোগটাই বা কী? ওই অশিষ্ট মহিলার সঙ্গে আমার স্ত্রীর কী সম্পর্ক তা আমার মাথায় ঢুকল না কোনওমতেই। অদ্ভুত একটা ধাঁধা। যে ধাঁধার সমাধান করতে পারব কি পারব না কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অথচ এ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে আমার মনে শান্তি হবে না।
“এর পরের দুটো দিন বেশ ভালই গেল। আমি আর আমার স্ত্রী দু’জনেই বাড়িতে বসে গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিনে টের পেলাম যে, আমার স্ত্রী কথার খেলাপ করেছেন।
“সে দিন আমাকে ব্যবসার খাতিরে লন্ডনে যেতে হয়েছিল। আমি সাধারণত লন্ডন থেকে ৩টে ৩৬-এর ট্রেনে বাড়ি ফিরি। সে দিন কাজ সকাল সকাল শেষ হয়েছিল বলে ২টো ৪০-এর গাড়িতে ফিরে এলাম। আমি দরজার বেল টিপতে আমাদের কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিল। লক্ষ করলাম যে, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসায় সে বেশ ঘাবড়ে গেছে।
‘“তোমার বউদিদি কোথায় গেছেন?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘“বউদিদি একটু বেড়াতে বেরোলেন।’
“আমার তখনই খটকা লাগল। নিশ্চিত হবার জন্যে আমি আর কথা না বাড়িয়ে দোতলায় চলে গেলাম। দোতলার ঘরের জানলার কাছে দাঁড়াতেই দেখলাম যে, কাজের মেয়েটি মাঠের মধ্যে দিয়ে ওই বাড়িটার দিকে ছুটছে। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমার স্ত্রী ওই বাড়িতে গেছেন। আর কাজের মেয়েটিকে বলে গেছেন যে, আমি ফিরে এলে সে যেন তাঁকে খবর দিয়ে আসে। রাগে আমার রক্ত টগবগ করতে লাগল। আমি দৌড়ে নীচে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। আমি ঠিক করে ফেললাম যে, এ ব্যাপারের হেস্তনেস্ত আজই করে ফেলব। যেতে যেতে দেখলাম আমার স্ত্রী ও কাজের মেয়েটি মাঠ দিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে। আমি ওদের দিকে লক্ষ না করে সোজা চলে গেলাম। ওই বাড়িতে কী আছে তা আমাকে জানতেই হবে। আমি দরজায় টোকা না দিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
“বাড়ির ভেতরে সব চুপচাপ। একতলায় কারও সাড়াশব্দ পেলাম না। শুধু রান্নাঘরে চায়ের কেতলিতে জল ফুটছিল। আর একটা কালো বেড়াল কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়েছিল। সেই অভব্য মহিলাকেও দেখতে পেলাম না। তখন অন্য ঘরগুলো দেখলাম। কেউ কোথাও নেই। দোতলায় উঠে গেলাম। সেখানেও ভোঁ-ভাঁ। বাড়িটায় তো কেউ নেই। ঘরগুলো কেমন ফাঁকা ফাঁকা। শুধু দোতলার যে ঘরটার জানলায় সেই অদ্ভুত মুখের দেখা পেয়েছিলাম, সেই ঘরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঘরের আসবাবপত্রও বেশ ভাল। ঘরে ঢুকতেই যা দেখলাম তাতে আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম। ঘরের ম্যান্টলপিসের ওপরে আমার স্ত্রীর একটা ছবি। ছবিটা আমারই কথায় মাস তিনেক আগে তুলেছিলেন। আমি যখন নিশ্চিত হলাম যে, বাড়িটাতে কেউ নেই তখন আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিন্তু আমার সমস্যার সমাধান তো হলই না, উলটে সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যেতে লাগল।
“আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আমি বাড়িতে পা দিতেই আমার স্ত্রী আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
‘“আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। এবারের মতো তুমি আমাকে মাফ করো।’
‘“তা হলে আমাকে সব কথা খুলে বলো।’
‘“আমার স্ত্রী কেঁদে বললেন, ‘তা হয় না।’
‘“যতক্ষণ না তুমি আমাকে বলছ ওই বাড়িতে কারা থাকে, আর কেনই বা ওদের তুমি তোমার ছবি দিয়েছ, ততক্ষণ তোমার কোনও কথা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
“তারপর আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। এটা কালকের কথা। সেই থেকে আমি ব্যাপারটা নিয়ে কেবলই ভেবেছি। হঠাৎ আজ সকালে আমার মনে হল, আপনি হয়তো একটা হদিস দিতে পারেন। আমি কোনও কিছু গোপন না করে সব কথা আপনাকে বলেছি। আপনার আর যদি কিছু জানবার থাকে তো আমাকে বলুন, আর এ রহস্যের একটা মীমাংসা করে দিন।”
হোমস আর আমি একটি কথাও না বলে মিঃ গ্রান্ট মনরোর অবাক করে দেওয়া অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম। হোমস আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মিঃ গ্রান্ট মনরোকে জিজ্ঞেস করলে, “যে-মুখ আপনি জানলার শার্সির ওধারে দেখে ছিলেন, সেটা কোনও পুরুষ না মহিলার মুখ, তা বুঝতে পেরেছিলেন কি?”
না। প্রত্যেক বারেই এত দূর থেকে দেখেছি যে, সেটা ছেলের কি মেয়ের মুখ তা জোর করে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“তবে সেই মুখটা দেখে আপনার খুবই খারাপ লেগেছিল?”
“সে কথা ঠিক। সেই মুখের রং খুবই অস্বাভাবিক। আর মুখের মধ্যে অদ্ভুত একটা কঠিন ভাব। আমি কাছাকাছি আসতেই এক ঝাঁকুনি দিয়ে মুখটা সরে গেছে প্রতিবার।”
“আপনার স্ত্রী কত দিন আগে আপনার কাছে টাকা চেয়েছিলেন?”
“তা প্রায় মাস-দুয়েক আগে তো বটেই।”
“আপনি কি মিঃ হেব্রোনের কোনও ফোটো দেখেছেন?”
“না। মিঃ হেব্রোন মারা যাবার কিছু দিন পরেই আটলান্টায় ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড হয়। তাতে ওদের অনেক জিনিসপত্র পুড়ে যায়।”
“আশ্চর্য! অথচ ওদের ডেথ সার্টিফিকেটটা ওঁর কাছে রয়ে গেছে! আপনি সেই ডেথ সার্টিফিকেট তো দেখেছেন?”
“হ্যাঁ। ওটা একটা ডুপ্লিকেট।”
“আচ্ছা, আপনার স্ত্রীর আমেরিকান কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের সঙ্গে আপনার কখনও দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কি?”
“না।”
“আপনার স্ত্রী কি কখনও আমেরিকায় বেড়াতে যেতে চেয়েছেন?”
“না।”
“আমেরিকা থেকে ওঁর কি চিঠিপত্র আসে?”
‘না। অন্তত আমার চোখে কখনও পড়েনি।”
“ঠিক আছে। আমাকে একটু ভাববার সময় দিন। যদি ওরা বাড়ি ছেড়ে একদম চলে গিয়ে থাকে তো মুশকিল। তবে এমনও হতে পারে যে, আপনি আসছেন টের পেয়ে ওরা কাছাকাছি কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে ছিল। তা যদি হয় তো ওরা আবার ফিরে আসবে। তা হলে ব্যাপারটার ফয়সালা সহজেই হতে পারে। যাই হোক, এখন আপনি নরবেরিতে ফিরে যান। যদি দেখেন যে, ওরা ফিরে এসেছে, তো আপনি আমাকে টেলিগ্রাম করে খবর দিয়ে দেবেন। আপনার টেলিগ্রাম পেলেই আমি পৌঁছে যাব। তবে আপনি নিজে থেকে কিছু করতে যাবেন না।
“যদি বাড়িটা খালিই থাকে?”
“তা হলে কাল আমি নরবেরি যাব। সেখানে পৌঁছে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে। ওই কথাই তা হলে রইল। একটা কথা, মিছিমিছি মনখারাপ করবেন না।”
মিঃ গ্রান্ট মনরোকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে হোমস বলল, “বেশ গোলমেলে ব্যাপার, বুঝলে ওয়াটসন। তুমি কী বুঝলে বলো তো?”
“খুবই ঘোরালো ব্যাপার।”
“হ্যাঁ! আমার ধারণা ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা আদায় করার চেষ্টা করছে কেউ।”
“কিন্তু কে সেই লোক?”
“মনে হয় দোতলার সাজানো ঘরটিতে যে বসে থাকে, সে-ই যত নষ্টের মূল। বিশ্বাস করো ওয়াটসন, ওই অস্বাভাবিক মুখের মধ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। এই মামলা আমি কিছুতেই হাতছাড়া করব না।”
“তুমি কি কোনও সিদ্ধান্ত করেছ?”
“হ্যাঁ, মোটামুটি সিদ্ধান্ত একটা করেছি বই কী। আমার ধারণা ভুল হলেই আমি আশ্চর্য হব। আমার মনে হয়, মিঃ হেব্রোন ওই ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে!”
“কেন তুমি এ কথা বলছ?”
“এ ছাড়া মিসেস গ্রান্টের এই অদ্ভুত ব্যবহারের কোনও রকম ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি যা অনুমান করেছি, সেটা মোটামুটি এই রকম। এই মিঃ হেব্রোন লোকটি খুব সুবিধের নয়। হয় এর স্বভাবচরিত্র খুব খারাপ, নয় এর কোনও জটিল অসুখ ছিল। বিয়ের সময় ভদ্রমহিলা এসব খবর জানতেন না। পরে জানতে পারেন। আর জানতে পেরে ভদ্রমহিলা এ দেশে পালিয়ে আসেন। বছর তিনেক হেব্রোনের কোনও খবর না পেয়ে তিনি নিশ্চিত হন যে, হেব্রোন আর বেঁচে নেই। পরিচিত কারও সাহায্যে তিনি একটা ডেথ সার্টিফিকেটও জোগাড় করেন। পরে মিঃ গ্রান্টের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ইতিমধ্যে ওই লোকটা কোনও ভাবে জানতে পারে যে, ভদ্রমহিলা এখানে এসেছেন এবং গ্রান্টের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। ওই লোকটিই ইতিমধ্যে আর একটা দুষ্টু মেয়েকে বিয়ে করেছে, হয় ওই লোকটি না হয় সেই মেয়েটি মিসেস মনরোকে সব কথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখায়। মিসেস মনরো একশো পাউন্ড দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেন। এই জন্যেই তিনি স্বামীর কাছে ওই টাকাটা চেয়েছিলেন। কিন্তু টাকা পেয়ে ওই লোকটা আরও টাকা আদায়ের জন্যে এ দেশে আসে। তাই তাঁর স্বামী যখন তাঁকে বললেন যে তাঁদের বাড়ির কাছের খালি বাড়িটা ভাড়া হয়েছে। তখনই তিনি ব্যাপারটা আঁচ করেন। তারপর গ্রান্ট না ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেন। তারপর তিনি ওদের কাছে গিয়ে কাতর ভাবে বলেন যে, তাঁর ওপর তারা যেন অত্যাচার না করে তাঁকে সুখে-শান্তিতে থাকতে দেয়। মিসেস গ্রান্টের কথায় ওরা নিশ্চয়ই কান দেয়নি। তাই তিনি ফের সকালবেলায় ওই বাড়িতে যান। সেই সময় মিঃ মনরো তাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেন। দিন-দুই পরে ভদ্রমহিলা আবার ওই বাড়িতে যান। সেই সময়েই বোধহয় উনিই কোনও কারণে ওঁর ছবি সঙ্গে করে নিয়ে যান। মিসেস গ্রান্ট যখন ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন সেই সময়ে কাজের মেয়েটি এসে খবর দেয় যে, মিঃ গ্রান্ট আসছেন। তখন মিসেস গ্রান্টের কথায় ওই লোকটা আর সেই বদ মহিলা বাড়ির পেছনে যে ফারগাছের জঙ্গলটা আছে, যেটার কথা গ্রান্ট আমাদের বলেছেন, সেখানে গিয়ে গা-ঢাকা দেয়। আর সেই কারণে মিঃ গ্রান্ট মনরো বাড়ির মধ্যে গিয়ে দেখেন চিড়িয়া ভেগেছে। খাঁচা খালি। অবশ্য আজ সন্ধেবেলায় গিয়েও মিঃ গ্রান্ট যদি দেখেন বাড়িটা খালি তা হলে আমি সত্যিই খুব অবাক হব।”
“কিন্তু এ সবই তোমার অনুমান।”
“তা ঠিক। তবে এই অনুমানই ঠিক। কেন না আমরা এখনও পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি তা সবই এই অনুমানের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। যদি এরপর এমন কোনও তথ্য আমরা জানতে পারি যেটা এই অনুমানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তখন গোটা ব্যাপারটা নতুন করে ভাবব। এখন নরবেরি থেকে খবর না-আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করবার নেই।”
আমাদের অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বিকেলে চা খাচ্ছি, এমন সময় গ্রান্টের টেলিগ্রাম এল। “বাড়িতে এখনও লোকজন আছে। জানলায় মুখটা ফের দেখা গেছে। সাতটার ট্রেনে আসুন। স্টেশনে থাকব। আপনারা না আসা পর্যন্ত কিছু করব না।”
আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। মিঃ গ্রান্ট মনরো প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলেন। প্ল্যাটফর্মের আলোতে দেখলাম মিঃ গ্রান্ট ভীষণ উত্তেজিত।
হোমসের হাত চেপে ধরে মিঃ গ্রান্ট বললেন, “ওরা এখনও বাড়ির মধ্যে আছে। আসবার সময় দেখলাম, আলো জ্বলছে। যাই হোক, এ ব্যাপারের ফয়সালা আজ এবং এখনই করবই।”
হাঁটতে হাঁটতে হোমস বলল, “কী করবেন ভাবছেন?”
“আমি জোর করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখব বাড়িতে কারা রয়েছে। আমি চাই যে আপনারা দু’জনে সাক্ষী হিসেবে আমার সঙ্গে থাকবেন।”
“আপনার স্ত্রী কিন্তু এ রকম কিছু করতে আপনাকে বহু বার বারণ করেছেন। তা সত্ত্বেও আপনি এ কাজ করবেন?”
“হ্যাঁ, আমি মনস্থির করে ফেলেছি।”
“হয়তো আপনি ঠিকই করছেন। সন্দেহের মধ্যে থাকার চাইতে যা সত্যি তা জেনে যাওয়াই ভাল। তবে কাজটা ঘোরতর বেআইনি হচ্ছে। অবশ্য এ ছাড়া উপায়ই বা কী?
মেঘ করে চার দিক অন্ধকার হয়ে ছিল। এখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে একটা গলিতে ঢুকলাম। মিঃ গ্রান্ট উত্তেজিত ভাবে হনহন করে এগিয়ে চলেছিলেন, আমরা তাঁর পিছনে আসছিলাম।
“ওই যে, ওই দিকে আলো দেখতে পাচ্ছেন, ওটাই আমার বাড়ি। আর এটাই হচ্ছে সেই বাড়ি, যেখানে আমরা যাচ্ছি,” মিঃ মনরো চুপি চুপি বললেন।
আমরা একটা মোড় ঘুরলাম। আর একদম বাড়িটার সদর দরজার কাছে এসে পড়লাম। অন্ধকার বাগানে প্রায় বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে একফালি আলো এসে পড়েছিল। বোঝা গেল দরজা খোলাই রয়েছে। দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছিল। আমরা দোতলার ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখতে পেলাম একটা ছায়ামূর্তি জানলার শার্সির সামনে থেকে সরে গেল।
“ওই যে, ওই যে সেই লোকটা। আপনারা স্বচক্ষে দেখলেন যে, বাড়িতে লোক রয়েছে। চলুন, এইবার ভেতরে যাওয়া যাক। আপনারা আমার পিছনে আসুন,” বললেন মিঃ গ্রান্ট।
আমরা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ অন্ধকার থেকে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। আমি ভদ্রমহিলাকে ভাল দেখতে পাইনি। শুধু দেখলাম, তিনি দু’হাত জড়ো করে অনুনয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
“ভগবানের দোহাই, এমন কাজ কোরো না। আমার মনে হয়েছিল যে, আজ সন্ধেবেলায় তুমি হয়তো আবার এখানে ফিরে আসবে। আমার কথা শোনো, এতে তোমার ভালই হবে। আমাকে বিশ্বাস করলে তুমি ঠকবে না।”
মিঃ গ্রান্ট মনরো বেশ কঠিন ভাবে বললেন, “তোমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করেছি। আর নয়। আমার সামনে থেকে সরে যাও। আমি আমার এই বন্ধুদের নিয়ে এ ব্যাপারের একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আজ আর এক্ষুনি করে ফেলব।”
ভদ্রমহিলাকে পাশ কাটিয়ে মিঃ মনরো বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গে আমরাও ঢুকলাম। দরজা খুলে মিঃ মনরো বাড়ির ভেতরে পা দিতেই এক মহিলা কোথা থেকে ছুটে এসে তাঁকে আটকাতে গেলেন। মহিলার বেশ বয়স হয়েছে। গ্রান্ট মনরো তাঁকে জোর করে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। আমরাও তাঁকে অনুসরণ করলাম। গ্রান্ট মনরো কোনও কথা না বলে একদৌড়ে দোতলায় গিয়ে যে-ঘরটায় আলো জ্বলছিল সোজা সেই ঘরটার দিকে গেলেন। মিঃ মনরোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ও ঘরে ঢুকলাম।
বেশ সুন্দর করে সাজানো-গোছানো ঘর। একটা টেবিলের ওপর দুটো বড় মোমবাতি জ্বলছিল। আর দুটো মোমবাতি জ্বলছিল ম্যান্টেলপিসের ওপরে। ঘরের এক কোণে একটি বাচ্চা মেয়ে ডেস্কের ওপর ঝুঁকে পড়ে কী যেন করছিল। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তবে দেখলাম যে, সে একটা লাল রঙের ফ্রক আর হাত-ভরতি দস্তানা পরে আছে। মেয়েটি আমাদের দিকে মুখ ফেরাতেই আমি দারুণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। অদ্ভুত বীভৎস একটা হলদে মুখ। সে মুখের মধ্যে কোনও রকম প্রাণের ছাপ বা ভাব নেই। পর মুহূর্তেই রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। হাসতে হাসতে হোমস মেয়েটির কানের পাশে হাত দিয়ে সামান্য একটু চাপ দিতেই একটা মুখোশ খসে পড়ল। আর অমনি দেখতে পেলাম আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি নিগ্রো মেয়ে। সেও খুব মজা পেয়েছে। তার মুখে হাসি আর ধরছে না। কালো মুখে সাদা দাঁত খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমিও না হেসে পারলাম না। শুধু মিঃ গ্রান্ট স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
“মাই গড, এর মানে কী?” খানিকক্ষণ পরে গ্রান্টই প্রথম কথা বললেন।
আর ঠিক তখনই সেই ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন, “আমিই বুঝিয়ে বলছি। আমার স্বামী আটলান্টায় আগুনে পুড়ে মারা যান। আমাদের শিশুসন্তানটি বেঁচেছিল।”
“তোমার সন্তান!”
গলায় ঝোলানো একটা লকেট দেখিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “এটা আমি কোনও দিন খুলিনি।”
মিঃ মনরো বলে উঠলেন, “আমার ধারণা ওটা খোলা যায় না।”
ভদ্রমহিলা একটা স্প্রিংয়ে অল্প চাপ দিতেই লকেটটা খুলে গেল। লকেটের ভিতরে একটা ছবি। নিগ্রো ভদ্রলোকের ছবি। ভদ্রলোকের মুখটি ভারী সুন্দর।
ভদ্রমহিলা বললেন, “ইনিই জন হেব্রোন। এঁর মতো উদার, এত বড় মানুষ আমি কমই দেখেছি। মুশকিল হল কী, আমাদের মেয়েকে আমার মতো দেখতে হল না। হল তার বাবার মতো দেখতে।
“আমি যখন আমেরিকা থেকে চলে আসি, তখন একে সঙ্গে আনিনি। ছোটবেলায় এর স্বাস্থ্য মোটেই ভাল ছিল না। আমার মনে হয়েছিল যে, ইংল্যান্ডের আবহাওয়া এর বোধহয় সহ্য হবে না। আটলান্টায় আমাদের কাজের মেয়েটি খুবই বিশ্বাসী ছিল। আমি তার জিম্মায় এই মেয়েকে রেখে আসি। তোমার সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হল, তখন এর কথাটা বলব বলব করেও বলা হয়নি। তবে ভেবো না যে, আমার মেয়ের সঙ্গে আমি সম্পর্ক চুকিয়ে দিতাম। এক সময়ে তোমাকে আমি সব কথাই খুলে বলতাম। এই রকম করে চলছিল। বছর তিনেক ওকে ছেড়ে থেকে একদিন ওকে দেখবার জন্যে আমার ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল। আমি ঠিক করলাম যে, ওকে এখানে নিয়ে আসব। আমি একশো পাউন্ড পাঠিয়ে দিলাম। আমি আমাদের কাছাকাছি খালি বাড়িটার কথাও জানিয়ে দিই। আমি ওই কাজের মেয়েটিকে লিখে দিয়েছিলাম যে, একে যেন বাড়ির বাইরে না বের করে। পাড়ায় নিগ্রো মেয়ে এসেছে, এ কথাটা জানাজানি হবে। এখন মনে হচ্ছে যে, সবকিছু চেপে না গিয়ে তোমাকে খুলে বললেই বোধহয় ভাল হত।
“যাই হোক, তুমিই আমাকে খবর দিলে যে, ও বাড়িতে লোক এসেছে। সকাল হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারলাম না। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ মনে করে আমি চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। তুমি অবশ্য পরের দিন সেই রাত্রের ব্যাপারটা জানবার জন্যে কোনও রকম জোরাজুরি বা জেদাজেদি করোনি। দিন-তিনেক পরে তুমি যে-দিন ওই বাড়িতে ঢুকলে তখন মেয়েটা আর নার্স কোনও রকমে পিছনে ফারগাছের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। যাই হোক, আজ তুমি সব কথা শুনলে। এখন বলো, আমার মেয়ের আর আমার কী হবে?”
মিনিটখানেক চুপ করে থেকে গ্রান্ট মনরো যা বললেন তা শুনে আমার কান জুড়িয়ে গেল। ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে গ্রান্ট বললেন, “চলো, বাড়ি যাওয়া যাক। তুমি আমাকে যতটা বদ লোক বলে মনে করো, আমি ততটা বদ লোক নই।”
ওঁরা তিন জনে বাড়ির রাস্তা ধরলেন। হোমস আর আমি ওদের পিছু পিছু আসছিলাম। বড় রাস্তায় এসে হোমস আমার কানে কানে বলল, “এখানে আমাদের আর কোনও কাজ নেই। চলো, লন্ডনে ফিরে যাই।”
এরপর হোমস এই কেসটা নিয়ে আর একটি কথাও বলল না। শুধু শুতে যাবার আগে বলল, “ওয়াটসন, এর পরে কোনও রহস্যের মীমাংসার সময় তোমার যদি মনে হয় আমি একটু সবজান্তাগিরি করছি বা তদন্ত করবার সময় যতটা মনোযোগ দেওয়া উচিত, ততটা দিচ্ছি না, তা হলে আমার কানে কানে ‘নরবেরি’ কথাটা উচ্চারণ কোরো।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন