আর্থার কোনান ডয়েল
শীতকালের রাত্তির। ঘরের চুল্লিতে গনগন করে আগুন জ্বলছে। আমরা দু’জন চুল্লির দু’ধারে দুটো চেয়ারে আরাম করে বসেছিলাম।
হোমস বলল, “আমার কাছে কিছু কাগজপত্র আছে। আমার মনে হয় সেগুলো তোমার দেখা দরকার। গ্লোরিয়া স্কটের নাম শুনেছ তো? এই কাগজে গ্লোরিয়া স্কটের অদ্ভুত কাণ্ডর হদিশ আছে। আর এই চিঠিটা পড়েই জাস্টিস অভ দি পিস ট্রেভর এমন ভয় পান যে, তিনি সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুখেই তার মৃত্যু হয়।”
হোমস একটা ড্রয়ার খুলে তার থেকে একটা নলের মতো কী বের করল। নলটার রং চটে গেছে, গায়ে দড়ি বাঁধা। হোমস দড়িটা খুলে নলটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। সেটা একটা গাঢ় স্লেট রঙের পাকানো কাগজ। তাতে কয়েক লাইনের ছোট্ট একটা লেখা।
লেখাটা এই রকম:
The supply of game for London is going steadily up. Headkeeper Hudson, we believe, has been now told to receive all orders for fly paper and for preservation of your hen pheasants life.
আমি দু’-তিন বার পড়েও লেখাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হোমসের দিকে তাকাতে দেখি সে খুকখুক করে হাসছে। “তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে, বেশ ঘাবড়ে গেছ।” হোমস বলল।
“এই লেখাটা পড়ে ভয় পাবার কী কারণ থাকতে পারে, তা তো বুঝছি না। আমার তো এটা উন্মাদের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে।”
“ঠিকই বলেছ। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, একজন সুস্থ সবল প্রাপ্তবয়স্ক ভদ্রলোক এইটি পড়েই এমন ভাবে মূর্ছা যান, যেন কেউ পিছন থেকে তাঁর মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে ঘা মেরেছে।”
আমি বললাম, “তোমার কথা শুনে আমার কৌতুহল বেড়ে যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারটা আমার বিশেষ করে জানা দরকার, এ কথাটা কেন বললে তা বুঝতে পারলাম না।”
“বললাম এই জন্যে যে, এই সমস্যার সমাধান করতে আমার প্রথম ডাক পড়েছিল। বলতে পারো, এইটেই আমার প্রথম গোয়েন্দাগিরি।”
আমি এর আগে বহু বার আমার বন্ধু শার্লক হোমসের কাছে জানতে চেয়েছি, কেন কবে এবং কী ভাবে সে গোয়েন্দাগিরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিল। হোমস কখনওই ঠিকমতো উত্তর দেয়নি। বুঝলাম, যে-কোনও কারণেই হোক, আজ হোমস খুব খোশমেজাজে আছে। হোমস তার প্রিয় আরামচেয়ারে জুত করে বসে কাগজপত্রগুলো তার কোলের উপর রাখল। তারপর পাইপটা ধরিয়ে চুপ করে পাইপ টানতে টানতে কাগজগুলো ওলটাতে লাগল।
“আমি বোধহয় ভিক্টর ট্রেভরের কথা তোমাকে কখনও বলিনি,” হোমস আমাকে জিজ্ঞেস করল। তারপর আমি উত্তর দেবার আগেই বলতে লাগল, “কলেজে দু’বছর পড়ার সময় একমাত্র তার সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। ওয়াটসন, আমি কখনওই খুব মিশুকে ধরনের ছিলাম না। বেশির ভাগ সময়েই নিজের ঘরে বসে আমার নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতির কী ভাবে আরও উন্নতি করা যায়, তাই নিয়ে চিন্তা করতাম। সেই জন্যে আমার সঙ্গে যারা পড়ত, তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়নি। তলোয়ার খেলা আর বক্সিং ছাড়া অন্য কোনও খেলাধুলোয় আমার ঝোঁক ছিল না। তা ছাড়া, আমি একেবারে আলাদা বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতাম। সেই কারণেও আমার সহপাঠীদের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। সহপাঠীদের মধ্যে একমাত্র ট্রেভরকেই আমি চিনতাম। তার সঙ্গে আলাপও হয়। অদ্ভুত ভাবে। একদিন আমি যখন চ্যাপেলের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন ট্রেভরের বুলটেরিয়ারটা আমার গোড়ালিতে কামড়ে দেয়।
“কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবার পক্ষে এটা মোটেই ভাল উপায় নয়। তবে আমার বেলায় এটা যাকে বলে বেশ কাজের হয়েছিল। আমাকে পাক্কা দশটি দিন ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল। ট্রেভর রোজ আমার খবর নিতে আসত। গোড়ায় গোড়ায় সে দু’-এক মিনিট কথাবার্তা বলেই চলে যেত। তারপরে আস্তে আস্তে সে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করত। কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্ব বেশ গভীর হয়ে উঠল। ট্রেভর বেশ মিশুকে ফুর্তিবাজ ছটফটে ছেলে। সত্যি কথা বলতে কী, ওর স্বভাব ঠিক আমার উলটো। তবে কিছু ব্যাপারে আমাদের মধ্যে মিল ছিল। আমাদের বন্ধুত্বের ভিত আরও পাকা হল, যখন জানতে পারলাম যে, ওরও কোনও বন্ধু নেই। শেষকালে একদিন ট্রেভর আমাকে তাদের দেশের বাড়িতে নেমন্তন্ন করল। ওর বাবা নরফোকের ডনিথ্রপে বাড়ি করেছিলেন। আমি রাজি হলাম। ঠিক হল যে, গ্রীষ্মের লম্বা ছুটিতে আমি এক মাস ওখানে কাটিয়ে আসব।
“মিঃ ট্রেভর বেশ পয়সাওয়ালা আর প্রভাবশালী লোক। তিনি একজন জে.পি.। তার জমিজমাও অনেক। ব্রডস জেলার ল্যাংমেআর শহরের উত্তরে ডনিথ্রপ একটা ছোট্ট গ্রাম। উনি যে-বাড়িটায় থাকেন, সেটা বেশ পুরনো ধরনের। খোলামেলা বাড়ি। বাড়িটার কড়িবরগাগুলো সব ওক কাঠের। বড় রাস্তা থেকে বাড়ির দরজায় যাবার পথটার দু’ধারে লেবুগাছের সারি। বাড়িটার কাছে একটা বিল। সেখানে প্রচুর বুনোহাঁস আর মাছ। যত খুশি শিকার করো। আর সবচেয়ে যেটা আমার ভাল লেগেছিল, সেটা হল, বাড়ির বিরাট লাইব্রেরিটা। এই লাইব্রেরিটা মিঃ ট্রেভর বাড়ির মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। ওদের যে রাঁধুনি, সে রান্নাবান্না ভালই করত। তাই খুঁত-ধরা বাতিক না থাকলে যে-কোনও লোকের পক্ষেই ওই বাড়িতে মাসখানেক থাকাটা খুবই আনন্দের।
“মিঃ ট্রেভর বিপত্নীক। আমার বন্ধু তার একমাত্র সন্তান। ওঁর একটি মেয়ে ছিল। সে বার্মিংহামে বেড়াতে গিয়ে ডিপথিরিয়া হয়ে মারা যায়। মিঃ ট্রেভরকে দেখেই আমার খুব কৌতুহল হয়েছিল। ভদ্রলোক বেশি লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু খুব বুদ্ধিমান। আর তার স্বাস্থ্যটিও ছিল খুব ভাল। তিনি ভাল বইটই বিশেষ পড়েননি। তবে শুধু ঘুরেছেন প্রচুর, দেখেছেন অনেক কিছু। আর সেই দেখা-শোনার অভিজ্ঞতা তিনি মনেই রাখেননি, তার থেকে শিখেছেন অনেক অনেক জিনিস। বেশ গাঁট্টাগোট্টা গড়ন। মাথা-ভরতি কাঁচাপাকা চুল। মুখের রং পোড়া তামাটে। দেখলে বোঝা যায়, অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে। চোখের তারাগুলি নীল। তাঁর দৃষ্টি এত ঝকঝকে যে, চোখের দিকে তাকাতে ভয় করে। কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশীরা তো বটেই, ওই অঞ্চলের সব লোক একবাক্যে স্বীকার করে যে, ওঁর মতো ভালমানুষ হয় না। সকলকেই উনি সাহায্য করেন। জাস্টিস অভ দি পিস হিসেবে যতটা কড়া হওয়া উচিত, তাও তিনি হতে পারতেন না।
“আমি ডনিথ্রপে যাবার কয়েক দিন পরে রাত্তিরের খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা কফি খেতে খেতে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার বন্ধু আমার বিচার-বিশ্লেষণ, সব দেখবার ক্ষমতা, কী ভাবে আমি আমার এই ক্ষমতাকে একটা পদ্ধতি হিসেবে গড়ে তুলেছি, সেই সব কথা সাতকাহন করে বলতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কী, এইটেই যে আমার জীবনে পেশা আর নেশা হয়ে যাবে, তা আমি তখন জানতাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, মিঃ ট্রেভর তার ছেলের কথায় বিশেষ কান দিচ্ছেন না। তিনি ভাবছিলেন যে, আমার বন্ধু তিলকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে তাল করে তুলছে।
“মিঃ ট্রেভর মজা করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘হোমস, আমাকে দেখে তুমি কী অনুমান করতে পারছ বলো তো শুনি।’
“আমি বললাম, ‘না, খুব বেশি কিছু বলতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তবে গত বছর থেকে আপনি খুব ভয়ে ভয়ে আছেন। আপনার ধারণা হয়েছে, কে বা কারা আপনাকে মেরে ফেলতে পারে।’
“বিশ্বাস করো ওয়াটসন, আমার কথায় ভদ্রলোকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছ।’ তারপর তার ছেলের দিকে ফিরে বললেন, ‘ভিক্টর, জানো, গত বছর আমরা যে চোরাগোপ্তা শিকারির দলটাকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম, তারা আমাদের ছোরা মারবে বলে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকী, সার এডোয়ার্ড হবিকে ওরা একদিন আক্রমণ করেছিল। তারপর থেকে আমি সব সময়ে হুঁশিয়ার হয়ে থাকি। কিন্তু এ কথা তুমি জানলে কী করে হোমস?”
“আমি বললাম, ‘আপনার ছড়িটা খুব সুন্দর। লাঠিটার গায়ের লেখা থেকে দেখতে পাচ্ছি এটা এক বছরও কেনা হয়নি। অথচ দেখছি হাতলটা কুরে গর্ত করে নিয়ে তাতে লোহা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। তার ফলে এটা লাঠিকে লাঠি, আবার হাতিয়ারকে হাতিয়ার। তার থেকে সিদ্ধান্ত করলাম, আপনার ওপরে হামলা হতে পারে আশঙ্কা করেই এই ব্যবস্থা আপনি নিয়েছেন।’
“‘এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারো?’ তিনি হেসে বললেন।
“‘অল্প বয়সে আপনি খুব বক্সিং করতেন।’
“‘আবার ঠিক বলেছ। এটা কী ভাবে জানলে? আমার নাক কি একটু বেঁকা?’
“‘না,’ আমি বললাম, ‘নাক নয়, আপনার কানদুটো সামান্য চ্যাপটা আর পুরু। যারা বক্সিং লড়ে তাদের এই রকমই হয়।’
“‘আর কিছু?’
“‘আপনার গায়ের চামড়া যেরকম খসখসে আর পুরু, তার থেকে মনে হয় আপনি এক সময়ে খুব খোঁড়াখুঁড়ি করতেন।’
“‘হ্যাঁ। সোনার খনিতে কাজ করেই আমি দু’ পয়সা উপার্জন করেছি।’
“‘আপনি নিউজিল্যান্ডে ছিলেন?’
“‘ঠিক বলেছ।’
“আপনি জাপানও ঘুরে এসেছেন?’
“‘হ্যাঁ। তাও ঠিক।’
“‘এক সময়ে আপনার এমন একজনের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল, যার নামের আদ্যক্ষর হচ্ছে জে. এ.। আর এখন আপনি তার কথা একদম ভুলে যেতে চান।’
“‘আমার কথা শুনে মিঃ ট্রেভর চেয়ার থেকে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের ভাব। তার পরই তিনি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।
“ওয়াটসন, হঠাৎ এই কাণ্ড ঘটায় আমি আর আমার বন্ধু দুজনেই বেশ ঘাবড়ে গেলাম। যাই হোক, তাঁর এই ভাবটা বেশিক্ষণ রইল না। আমরা তার জামাটামা আলগা করে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিতেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
“খানিকটা জোর করে হাসবার চেষ্টা করে মিঃ ট্রেভর বললেন, ‘তোমাদের বোধহয় ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম। আমার চেহারাটা বড়সড় হলেও আমার হার্টের অবস্থা ভাল নয়। একটু উত্তেজনা হলেই এই রকম অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমি জানি না কী ভাবে তুমি এই কথাগুলো বললে। তবে এ কথা জোর গলায় বলতে পারি যে, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের যে-সব গোয়েন্দার কথা বা উপন্যাসের যে-সব কাল্পনিক গোয়েন্দার কথা আমরা পড়েছি, তোমার তুলনায় তারা একেবারে শিশু। এইটেই তোমার পথ। আমি জীবনে অনেক দেখেছি শুনেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা বলছি।’
“ওঁর এই কথা, বিশেষ করে আমার বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতির এতই প্রশংসা উনি করতে লাগলেন যে, সেই তখনই আমার প্রথম মনে হল, আমার এই নিছক খামখেয়ালি নেশাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। বিশ্বাস করো ওয়াটসন, আমি যে কোনও দিন গোয়েন্দাগিরি করব এটা আমার মাথায় এর আগে আসেনি। তবে ঠিক সেই মুহূর্তে এসব কথা ভাবার সময় ছিল না। আমি মিঃ ট্রেভরকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।
“আমি বিব্রত হয়ে বললাম, ‘আশা করি আমার কথায় আপনি মনে কোনও কষ্ট পাননি।’
“না। তবে তুমি আমার মনের একটা দুর্বল জায়গায় ঘা দিয়েছ। আচ্ছা, সত্যি কথা বলো তো। এ কথা তুমি জানলে কেমন করে আর এ ছাড়া আরও কী তুমি জানো?’ মিঃ ট্রেভর যদিও হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন, তবু তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝলাম যে, ভদ্রলোক বেশ ভয় পেয়েছেন।
“আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা খুবই সোজা। সে দিন মাছ ধরার সময় আপনি যখন মাছটাকে জল থেকে টেনে নৌকোর ওপর তুললেন, তখন আপনার জামার আস্তিন গুটোনো ছিল। তখনই আমি আপনার কনুইয়ের ভাজের কাছে উলকিটা লক্ষ করি, আর জে. এ. হরফ দুটোও পড়তে পারি। হরফদুটো পড়া যায় বটে, তবে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ওটাকে মুছে ফেলবার জন্যেও খুব চেষ্টা করা হয়েছে। তা হলে বোঝা যায় যে, জে. এ. একসময়ে আপনার খুবই আপনজন ছিল। পরে অবশ্য যে-কোনও কারণেই হোক, আপনি এই লোকটিকে ভুলে যেতে চেয়েছেন।’
“স্বস্তির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মিঃ ট্রেভর বললেন, ‘নাহ্ স্বীকার করতেই হবে যে, তোমার দেখবার চোখ আছে। তুমি যা বলেছ, তা সত্যি কথাই বটে! তবে সেসব কথা এখন আলোচনা করতে চাই না। সব ভূতের চেয়ে আমাদের ভালবাসার লোকেদের ভূতেরাই বেশি গোলমেলে। চলো, একটু বিলিয়ার্ড-রুমে গিয়ে বিশ্রাম করা যাক।’
“সে দিনের ঘটনার পর থেকে আমার মনে হতে লাগল যে, মিঃ ট্রেভর আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন। অবশ্য তাঁর কথাবার্তা বা হাবভাব আগেকার মতো ছিল। আমার বন্ধুর চোখেও এ ব্যাপারটা ধরা পড়েছিল। একদিন সে আমাকে বলল, “তুমি তো বাবাকে বেজায় ঘাবড়ে দিয়েছ। তুমি যে কী জানো আর কী জানো না, সেটাই উনি বুঝতে পারছেন না।’ মিঃ ট্রেভর তার মনের ভাব অবশ্যই প্রকাশ করতে চাননি। কিন্তু তিনি ভিতরে ভিতরে এতই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তার মনোভাব কিছুতেই গোপন করতে পারতেন না। শেষকালে আমার মনে হল, ওখানে থাকা আমার পক্ষে আর ঠিক হবে না। যে দিন আমি চলে আসব ঠিক করলাম, সেই দিনই, আমি চলে আসবার আগে, এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটার তাৎপর্য বোঝা গিয়েছিল অনেক দিন বাদে।
“আমরা তিন জন রোদ্দুরে আরাম করে লনে বসে কথাবার্তা বলছিলাম। এমন সময় কাজের মেয়েটি এসে বলল যে, একজন লোক মিঃ ট্রেভরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
“মিঃ ট্রেভর বললেন, ‘কী নাম?’
“‘নাম বলেনি।’
“‘তা হলে কী দরকার?’
“‘সে বলছে যে, আপনি তাকে চেনেন। আপনার সঙ্গে তার এক মিনিটের দরকার।
“‘ঠিক আছে। তাকে এখানেই নিয়ে এসো।’
“একটু পরেই একটি লোক এসে হাজির হল। লোকটার চেহারাটা অদ্ভুত সিড়িঙ্গে মতন। হাবভাব দেখলে মনে হয় যেন মাটির সঙ্গে সিঁটিয়ে রয়েছে। হাঁটার ধরনটা একটু থপথপে। লোকটা শস্তার কোট আর মোটা কাপড়ের ট্রাউজার্স পরেছিল। কোটের বোতাম খোলা। তার লাল কালো ডোরাকাটা শার্টটা চোখে পড়বার মতো। লোকটার পাতলা লম্বাটে মুখে একটা ধুর্ত ভাব। লোকটার মুখে হাসি লেগেই আছে। ঠোঁটের ফাক দিয়ে তার হলদে ছোপ-ধরা ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছিল। লোকটার ফাটা ফাটা হাতদুটো মুঠোর মতো করা, ঠিক জাহাজের নাবিক বা খালাসিদের যেমন হয়। লোকটা যখন লন পার হয়ে আমাদের কাছে চলে এসেছে, তখন মিঃ ট্রেভরের গলা থেকে একটা অদ্ভুত ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে এল। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে তিনি এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই যখন মিঃ ট্রেভর ফিরে এলেন, টের পেলাম তাঁর গা দিয়ে ব্র্যান্ডির গন্ধ বেরোচ্ছে।
“মিঃ ট্রেভর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলুন আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?’
“লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে ঘোলাটে, বসে-যাওয়া চোখে মিঃ ট্রেভরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখের হাসি কিন্তু লেগেই ছিল।”
“‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’ সে বলল।
“মিঃ ট্রেভর বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আরে, এ যে হাডসন দেখছি।’
“হ্যাঁ, সার, আমি হাডসনই বটে। ওহ্, প্রায় তিরিশ বছরেরও পরে আপনার সঙ্গে দেখা হল। দেখুন, আপনি নিজের বাড়িতে বসে আছেন আর আমি জাহাজে জাহাজে ঘুরে কোনও রকমে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছি।”
“‘সে কী কথা! তুমি নিশ্চয়ই জানবে যে, আমি আমার পুরনো বন্ধুদের কথা ভুলি না।’ মিঃ ট্রেভর চেয়ার ছেড়ে উঠে খালাসিটার কাছে গিয়ে চুপিসারে কী যেন বললেন। তারপর চেঁচিয়ে বললেন, ‘তুমি রান্নাঘরে যাও। আগে কিছু খাও। মনে হয় তোমার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’
“কপালে হাত ঠেকিয়ে লোকটা বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। দু’বছর একটা মাত্র আট-নট যেতে পারে এ রকম জাহাজে ঘুরে আমি সবেমাত্র ছুটি পেয়েছি। জাহাজটায় আবার খালাসিও ছিল কম। যা খাটুনি এই দুটো বছর গেছে! আমি জানতাম যে, আপনার কাছে কিংবা মিঃ বেডসের কাছে আশ্রয় পাবই।’
“মিঃ ট্রেভর বললেন, ‘মিঃ বেডস কোথায় থাকেন তুমি জানো?’
“লোকটা একটা শয়তানি হাসি হেসে বলল, ‘বিশ্বাস করুন সার, আমার পরিচিত লোকেরা কে কোথায় থাকেন সবই জানি।’ তারপর সে হোঁচট খেতে খেতে কাজের মেয়েটির সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
“মিঃ ট্রেভর আমাদের বললেন, যখন তিনি পয়সা রোজগারের ধান্দায় সমুদ্রে ভেসে পড়েছিলেন, এই লোকটি তাদের জাহাজে ছিল। তখনই এর সঙ্গে তার পরিচয়। একটু পরে মিঃ ট্রেভর বাড়ির ভিতরে গেলেন। আমরা বসে রইলাম। ঘণ্টাখানেক পরে আমরা বাড়িতে ফিরে এসে দেখি, মিঃ ট্রেভর বসবার ঘরে একটা সোফাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সমস্ত ঘটনাটা আমার মনে একটা গভীর ছাপ রেখে গেল। যাই হোক, এই ঘটনার পরের দিনই আমি ডনিথ্রপ থেকে চলে এলাম। আমি থাকলে মিঃ ট্রেভর আরও অস্বস্তি বোধ করতেন,”
হোমস খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফের শুরু করল তার কথা। “এটা হচ্ছে ছুটির একেবারে গোড়ার দিকের কথা। আমি লন্ডনে ফিরে এলাম। লন্ডনে ফিরে পরের সাত সপ্তাহ আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনো করতে লাগলাম। অর্গানিক কেমিস্ট্রির কতকগুলো জিনিস আমার ভাল করে শেখবার দরকার হয়েছিল। ছুটি শেষ হয়ে কলেজ খোলবার সময় হয়েছে। শরৎকাল আসি আসি করছে। এমন সময় ডনিথ্রপ থেকে আমার বন্ধুর একটা জরুরি টেলিগ্রাম এল। সে লিখেছে যে, আমার পরামর্শের ও সাহায্যের তার বিশেষ প্রয়োজন। আমি যেন টেলিগ্রাম পাওয়ামাত্রই ডনিথ্রপে যাই। বুঝতেই পারছ, এই টেলিগ্রাম পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি সব কাজ ফেলে ডনিথ্রপের দিকে পাড়ি দিলাম।
“আমার বন্ধু আমার জন্যে স্টেশনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখেই আমি বুঝতে পারলাম যে, গত দু’ মাসে তার ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে গেছে। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। মুখে-চোখে গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। তার ওপর সেই প্রাণখোলা হাসি চঞ্চল স্বভাব যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে।
“আমাকে দেখে আমার বন্ধু বলল, ‘বাবা বোধহয় আর বাঁচবেন না।’
“‘সে কী কথা! কী হয়েছে, কী?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“‘অ্যাপোপ্লেক্সি। তাঁর স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। আজ তার অবস্থা খুবই খারাপ। বাড়ি ফিরে তাকে দেখতে পাব কিনা জানি না।’
“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে, হঠাৎ এমন কথা শুনে আমি রীতিমতো বিচলিত হয়ে পড়লাম।
“আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে এই অসুখ হল?”
“‘হ্যাঁ, সেইটেই তো কথা। গাড়িতে ওঠো। যেতে যেতে সব কথা বলব। তুমি চলে যাবার আগের দিন সন্ধেবেলায় যে-লোকটা এসে হাজির হয়েছিল, তার কথা তোমার মনে আছে কি?’
“‘খুব মনে আছে।’
“‘সেদিন কাকে আমাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম জানো?’
“‘না, জানি না।’
“আমার বন্ধু উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘ওই লোকটা হচ্ছে শয়তান।’
“আমি আমার বন্ধুর মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
“‘হ্যাঁ, লোকটা আস্ত শয়তান। ও আসবার পর থেকে আমাদের বাড়িতে শান্তি নেই। সেই সন্ধের পর থেকে বাবার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এখন তো তাঁর শরীর একদম ভেঙে গেছে। তাঁর হার্টের অবস্থা খুবই খারাপ। এ সবই হয়েছে ওই শয়তান হাডসনের জন্যে।’
“‘ওর এমন কী ক্ষমতা?’
“আমার বন্ধু বলল, ‘সেইটে জানবার জন্যে আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। আমার বাবা সহজ সরল স্বভাবের লোক। কী ভাবে তিনি ওই পাজি নচ্ছার লোকটার খপ্পরে পড়লেন, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। যাক, তুমি এসে গেছ। এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি। তোমার বিচার-বিবেচনার ওপর আমার ষোলোআনা আস্থা আছে। আমি জানি তুমি আমাকে ঠিক পরামর্শ দেবে।’
“আমাদের গাড়ি সোজা রাস্তা ধরে ছুটে চলল। দু’পাশে মাঠ। সূর্যের পড়ন্ত আলোয় চার দিক ঝকমক করছে। দূর থেকে আমার বন্ধুদের বাড়ির চিমনি আর পতাকা ওড়াবার দণ্ডটা দেখা যাচ্ছিল।
“বন্ধু বলল, ‘আমার বাবা প্রথমে ওই লোকটাকে বাগান দেখাশোনা করবার ভার দিলেন। সেটা ওর তেমন মনঃপূত হল না। তখন ওকে ‘বাটলার’ করে দেওয়া হল। আর যাবে কোথা! গোটা বাড়িতে তাণ্ডব চলতে লাগল। যা ইচ্ছে তাই করতে লাগল। বাড়ির কাজের লোকেরা চটে গেল। লোকটা নেশা করে। তারপর সকলকে গালাগালি করে। ওরা হয়তো চাকরি ছেড়ে চলেই যেত। বাবা ওদের মাইনে বাড়িয়ে দিলেন। লোকটা যখন খুশি বাবার সবচেয়ে ভাল বন্দুকটা নিয়ে নৌকোয় চেপে শিকার করতে যেত। বলার প্রয়োজন মনে তো করতই না, উলটে এমন একটা অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাত যে, এক এক সময় আমার মনে হত, ওর মাথাটা ফাটিয়ে দিই। আমি ওকে ভাল রকম উত্তমমধ্যম দিয়ে দিতাম, যদি ও আমার সমবয়সি বা আমার চাইতে ছোট হত। বিশ্বাস করো হোমস, নিজেকে সামলে রাখা আমার পক্ষে খুবই শক্ত হত। তবুও নিজেকে সংযত রেখেছি। এখন মনে হচ্ছে, তখন যদি ভালমানুষি করে চুপচাপ না থাকতাম, তা হলেই বোধহয় ভাল হত।’
“একটুক্ষণ চুপ করে রইল বন্ধুটি। তারপর বলল, ‘যাই হোক, অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। হাডসন ছুঁচোটার দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বাড়তেই লাগল। একদিন হল কী, আমার সামনে ও লোকটা বাবার কথার এমন অসভ্যের মতো জবাব দিল যে, আমি ওর ঘাড় ধরে ওকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাগে ওর মুখটা কদাকার হয়ে গিয়েছিল। ওর চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সাপের চোখ। তারপরে বাবার সঙ্গে ও লোকটার কী কথাবার্তা হয়েছিল জানি না। তবে পরদিন বাবা আমাকে বললেন যে, আমি যেন আমার ব্যবহারের জন্যে হাডসনের কাছে ক্ষমা চাই। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, আমি রাজি হলাম না। উলটে আমি বাবার কাছে জানতে চাইলাম যে, এই ধরনের একটা পাজি লোককে এ ভাবে আশকারা তিনি কেন দিচ্ছেন।
“‘বাবা বললেন, “অনেক কথা বলা সোজা। কিন্তু তুমি তো আমার অবস্থা জানো না। ভিক্টর, একদিন তুমি সব কথাই জানতে পারবে। যাই ঘটুক না কেন, সব কথা তুমি যাতে জানতে পারো, সে ব্যবস্থা আমি করে যাব। তুমি নিশ্চয়ই তোমার বাবার সম্বন্ধে খারাপ কিছু ধারণা করবে না বলেই বিশ্বাস করি।” আমি বুঝতে পারলাম যে, বাবা খুবই বিচলিত হয়েছেন। এরপর তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। তারপর সারা দিন ঘর থেকে আর বেরোলেন না। বাবা কী করছেন উঁকি মেরে দেখতে গেলাম। দেখলাম তিনি খুব মন দিয়ে কী সব লিখছেন।
“‘সেই দিন সন্ধেবেলায় আমাদের মুক্তি হল বলে মনে হল। হাডসন বলল যে, সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। খাওয়াদাওয়ার পর আমরা খাবার ঘরেই চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ হাডসন এসে হাজির। সে জড়ানো জড়ানো ভাবে বলল যে, সে চলে যাবে।
“‘হাডসন বলল, “নরফোকে অনেক দিন হল। ভাবছি কিছু দিন হ্যামশায়ারে মিঃ বেডসের কাছে থাকব। অবশ্য আমি হাজির হলে তিনি যে আপনার চাইতে খুশি হবেন, তা মনে করি না।”
“বাবা বললন, “তুমি নিশ্চয়ই মনের মধ্যে রাগ নিয়ে এখান থেকে যাচ্ছ না, হাডসন।” বাবা কথাগুলো এমন অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন যে, আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
“‘আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা কর্কশ ভাবে বলল, “আমার কাছে এখনও ক্ষমা চাওয়া হয়নি।”
“‘বাবা বললেন, “ভিক্টর, তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, হাডসনের সঙ্গে তুমি খুবই দুর্ব্যবহার করেছ।”
“‘আমি বললাম, “না। বরঞ্চ আমি মনে করি যে, আপনি একে অকারণে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছেন।”
“‘আমার কথা শুনে লোকটা বলল, “ও তাই নাকি, তাই নাকি? খুব ভাল। শেষ পর্যন্ত বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল।”
“‘লোকটা এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এর আধ ঘণ্টা পরে লোকটা আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল। ও চলে যাওয়ায় বাবা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন। রাতের পর রাত আমি শুনতে পেতাম তিনি ঘরের ভেতরে পায়চারি করছেন। এই রকম করে দিন কাটতে লাগল। আস্তে আস্তে বাবার সেই অস্থির ভাবটা কেটে গেল। তিনি আবার আগের মতোই হাসিখুশি ফুর্তিবাজ হয়ে উঠছিলেন। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত হল।’
“আমি আমার বন্ধুকে থামিয়ে বললাম, ‘কী হল?’
“‘একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। গতকাল সন্ধের ডাকে বাবার একটা চিঠি এল। চিঠিটায় ফোর্ডিংব্রিজ পোস্টাপিসের ছাপ মারা। বাবা চিঠিটা পড়লেন। তারপর দু’হাত দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে ধরে ঘরের মধ্যে পাগলের মতো বৃত্তাকারে দৌড়োতে লাগলেন। আমি যখন তাকে ধরে জোর করে সোফায় বসিয়ে দিলাম, তখন তাঁর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, মুখটা সামান্য বেঁকে গেছে। বুঝলাম যে, বাবার স্ট্রোক হয়েছে। খবর দেওয়ামাত্রই ডঃ ফর্ডহ্যাম এসে হাজির হলেন। আমরা দু’জনে ধরাধরি করে বাবাকে শুইয়ে দিলাম। ততক্ষণে তাঁর পক্ষাঘাত হয়ে গেছে। তারপর থেকে তার আর জ্ঞান ফেরেনি। বাবা বাঁচবেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।’
“‘ভিক্টর, তোমার কথা শুনে তো ভয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চিঠিটায় এমন কী মারাত্মক কথা ছিল যা পড়েই উনি এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে বাঁচবেন কিনা সন্দেহ?’
“‘কিছুই না। আর রহস্যটা তো সেইখানেই। চিঠিটায় যা লেখা আছে তার না আছে মাথা না আছে মুন্ডু। একদম বাজে।…হে ভগবান, এই ভয়টাই আমি করেছিলাম।’
“আমরা ভিক্টরের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। ভিক্টরের কথায় বাড়িটার দিকে তাকাতে দেখলাম বাড়ির সব জানলার পরদা ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে সদর দরজার দিকে গেলাম। দুঃখে আমার বন্ধুর চোখ-মুখ কুঁচকে গিয়েছিল। আমরা দরজার কাছে যেতেই কালো পোশাক-পরা এক ভদ্রলোক বাড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলেন।
“বন্ধুটি বলল, ‘ডাক্তারবাবু কখন…?’
“ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তুমি যাবার একটু পরেই।’
“‘বাবার জ্ঞান ফিরেছিল কি?’
“একটু থেমে ডাক্তারবাবু বললেন, হ্যাঁ। মারা যাবার ঠিক আগে।’
“‘আমাকে কি খুঁজেছিলেন?’
“বলে গেছেন কাগজপত্র সব জাপানি-আলমারির পিছনের দেরাজে আছে।’
“যে-ঘরে তার বাবার মৃতদেহ ছিল ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার বন্ধু সে ঘরে গেল। আমি বাইরের ঘরে বসে সব কথা মনে মনে ভাবতে লাগলাম। আমার মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা দানা বেঁধে উঠছিল। এই ট্রেভরের অতীত জীবনে কী গোপন কথা আছে? কেনই বা তিনি নিজেকে এই ভাবে একটা খারাপ লোকের হাতের পুতুল করে ফেলেছিলেন? কেন তাঁর হাতে ঘষে উঠিয়ে দেওয়া উলকির কথা বলতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন? ফোর্ডিংব্রিজ থেকে একটা সামান্য চিঠি আসাতেই বা কেন এমন সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, তাতেই তিনি মারা গেলেন?
“আর ঠিক তক্ষুনি আমার মনে পড়ল যে, ফোর্ডিংহ্যাম হ্যাম্পশায়ারে। আর মিঃ বেডস, যাঁকে ব্ল্যাকমেল করবার জন্যে হাডসন লোকটা তার কাছে গেছে, হ্যাম্পশায়ারেই থাকেন। চিঠিটা তা হলে হয় হাডসনের কাছ থেকে এসেছে, না-হয় মিঃ বেডসের কাছ থেকে এসেছে। যদি হাডসনের কাছ থেকে এসে থাকে, তা হলে চিঠির বয়ান নিশ্চয়ই এই রকম, সে মিঃ ট্রেভরের কেলেঙ্কারির কথা বলে দিয়েছে। আর মিঃ বেডস যদি চিঠিটা লিখে থাকেন, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই পুরনো বন্ধুকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, ভিতরের কথা শিগগিরই ফাঁস হয়ে যাবে। এ পর্যন্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোনও জটিলতা নেই। কিন্তু সমস্যা হল এই যে, চিঠিটা কি সত্যি সত্যিই তুচ্ছ? মনে হয় চিঠিটার আসল মানে ভিক্টর ধরতে পারেনি। চিঠিটা নিশ্চয়ই সাংকেতিক ভাষায় লেখা। চিঠিটা পড়ে যা মনে হবে সেটা কিছু নয়। চিঠিটার একটা অন্য মানে আছে। যারা সাংকেতিক সূত্র জানে তারাই ধরতে পারবে। চিঠিটা দেখা বিশেষ দরকার। চিঠিটায় যদি কোনও সাংকেতিক বার্তা থাকে তো আমি নিশ্চয়ই সেটা ধরতে পারব। প্রায় এক ঘণ্টা আমি সেই ঘরে বসে ছিলাম। টের পাইনি অন্ধকার হয়ে গেছে। টের পেলাম যখন কাজের মেয়েটি এসে ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন। তার পরেই ভিক্টর ঘরে ঢুকল। ভিক্টরকে দেখে বুঝতে পারলাম সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। তবে লক্ষ করলাম তার হাবভাব বেশ সংযত। এই যে কাগজগুলো দেখছ, এগুলো তার হাতে ছিল। সে টেবিলের উলটো দিকে বসে টেবিলের আলোটা একধারে সরিয়ে আমার হাতে এই যে চিঠিটা দেখছ, সেটা এগিয়ে দিল। এক টুকরো স্লেট রঙের কাগজের ওপর লেখা:
The supply of game for London is going steadily up. Headkeeper Hudson, we believe, has been now told to receive all orders for fly paper and for preservation of your hen pheasant’s life.
“আমি যখন প্রথম লেখাটা পড়ি তখন তোমার মতোই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমি খুব মন দিয়ে লেখাটা বার বার পড়লাম। যা অনুমান করেছিলাম, ঠিক তাই। এর ভিতরে একটা লুকোনো অর্থ আছে। নাকি ‘fly paper’ ‘hen pheasant’ বিশেষ কোনও অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে? তা যদি হয়, তবে এই চিঠির অর্থ বের করা শক্ত হবে। তবে এ ব্যাখ্যাটা মানতে পারছিলাম না। চিঠিটায় হাডসনের উল্লেখ থাকায় বুঝতে পারছিলাম যে, এটা হয় তার কাছ থেকে নয়তো মিঃ বেডসের কাছ থেকে এসেছে। তখন আমি চিঠিটা শেষ থেকে পড়তে শুরু করলাম। তা হলে দাঁড়ায় Life pheasant’s hen. এটা বিশেষ সুবিধেজনক বলে মনে হল না। তখন আমি শব্দগুলোকে এপাশে-ওপাশে বসিয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়। আর প্রায় তক্ষুনি ধাঁধাটার সমাধান হয়ে গেল। খুব ছোট একটা সাবধানবাণী। আর এইটে পেয়েই ট্রেভর স্রেফ ভয় পেয়েই মারা গেলেন। প্রথম শব্দটা আর তার পরের প্রত্যেক তৃতীয় শব্দটা নিতে হবে। চিঠিটার আসল মানে হচ্ছে:
The game is up. Hudson has told. Fly for your life. মানে ‘খেল খতম। হাডসন সব ফাঁস করে দিয়েছে। বাঁচতে চাও তো পালাও।
“আমার কথা শুনে ভিক্টর মাথা নিচু করে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘হোমস, তুমি হয়তো ঠিকই বলছ! এ তো খুবই লজ্জার কথা। কিন্তু ‘headkeeper’ আর ‘hen pheasnts’-এর মানে কী?’
“‘মূল চিঠিটার সঙ্গে এই শব্দগুলোর কোনও যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে এই শব্দগুলো থেকে চিঠিটা কে পাঠিয়েছিল তা হয়তো বোঝা যেতে পারে। প্রথমে দেখো, চিঠিটা কী ভাবে শুরু হচ্ছে: The…game…is…এরপর চিঠিটায় মাঝে মাঝে কিছু ভুয়া শব্দ বসাতে হয়েছে। যে এই চিঠি লিখেছে সে প্রথমে যে-শব্দটা মাথায় এসেছে সেটাই লিখে দিয়েছে। এখন এই চিঠিটাতে এমন অনেক কথা আছে, যেগুলো সাধারণত শিকারিরাই ব্যবহার করে। তার থেকে মনে হচ্ছে যে, চিঠির লেখক হয় একজন ঝানু শিকারি, নয়তো হাঁস-মুরগির ব্যবসা করেন। মিঃ বেডসের সম্বন্ধে তুমি কিছু জানো কি?’
“ভিক্টর বলল, ‘তুমি বলায় মনে পড়ল যে, প্রত্যেক বছর শীত পড়বার আগে মিঃ বেডস বাবাকে তাঁর ওখানে শিকার করতে যেতে বলতেন।’
“‘তা হলে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি এ চিঠি মিঃ বেডসই লিখেছেন,’ আমি বললাম, ‘এখন জানতে হবে যে, হাডসন কী এমন গোপন কথা জানত যার জন্যে এ রকম ধনী-মানী দু’জন লোক তাকে এত ভয় করতেন!’
“‘হোমস, নিশ্চয়ই কোনও অন্যায় কাজ।…যাই হোক, তোমার কাছে আমি কিছুই লুকোব না। বিপদ আসছে বুঝেই আমার বাবা তার জীবনের সব কথা লিখে রেখে গেছেন। ডাক্তারবাবুর কথামতো জাপানি ক্যাবিনেটে এই কাগজগুলো আমি পেয়েছি। এ কাগজগুলো তুমি আমাকে পড়ে শোনাও আমার নিজের পড়বার সাহসও নেই, শক্তিও নেই।’
“ওয়াটসন, এই সেই কাগজ, যা সেই রাতে ভিক্টর আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। আমি সে দিন যেমন ভিক্টরকে পড়ে শুনিয়েছিলাম, তোমাকেও তেমনই আজ পড়ে শোনাচ্ছি। খামের ওপর কী লেখা আছে জানো? ফালমাথ থেকে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর থেকে নভেম্বরের ৬ তারিখে ১৫°২০′ উত্তর অক্ষাংশ ও ২৫°১৪′ পশ্চিম দ্রাঘিমার মধ্যে গ্লোরিয়া স্কট জাহাজের যাত্রা ও ডুবে যাওয়ার সব ঘটনা লেখা আছে। আসল লেখাটা একটা চিঠির আকারে:
“পরম কল্যাণীয়েষু,
আমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে। আজ যদি আমার অতীত জীবনের কোনও ঘটনার জন্যে আমি অপমানিত হই বা আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হই তো আমার কিছুই এসে যাবে না। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগছে ভেবে, আমার জন্যে তুমি হয়তো পাঁচজনের চোখে ছোট হয়ে যাবে। তুমি আমাকে এত ভালবাসো, এত শ্রদ্ধা করো! যদি দৈবদুর্বিপাকে সেই ঘটনা ঘটেই যায়, আমার একান্ত অনুরোধ, তুমি এই লেখাটি পোড়ো। তা হলে আমার কথা তুমি আমার মুখ থেকেই শুনতে পাবে। আর যদি ভগবানের অসীম অনুগ্রহে সে রকম কিছু না ঘটে এবং আমার মৃত্যুর পরে এই কাগজপত্র তোমার হাতে পড়ে, তবে তোমাকে আমার একান্ত অনুরোধ, খামসুদ্ধু আগুনে ফেলে দিয়ো। এ চিঠি পড়বার দরকার নেই। এ নিয়ে কিছু ভাববারও তোমার দরকার নেই।
যদি এই চিঠি তোমাকে পড়তেই হয়, তবে বিশ্বাস কোরো এ চিঠির প্রতিটি কথাই সত্যি। আর আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে।
আমার নাম ট্রেভর নয়। ছেলেবেলায় আমার নাম ছিল জেমস আর্মিটেজ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে, তোমার কলেজের বন্ধু যখন আমাকে এমন কতকগুলো কথা বলেছিল, যাতে মনে হয়েছিল সে আমার সব কথা জানে, তখন কেন আমি ভয় পেয়েছিলাম। জেমস আর্মিটেজ নামে আমি লন্ডনের ব্যাঙ্কে কাজ করতাম। বেআইনি কাজ করবার জন্যে আমাকে দেশ থেকে বার করে দেওয়া হয়। না, না, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। ব্যাঙ্কের টাকা থেকে আমি একজনকে কিছু ধার দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বার্ষিক হিসেবের আগে টাকাটা জমা করে দিতে পারব। তা হলে ধরা পড়বার ভয় থাকবে না। কিন্তু আমার অদৃষ্ট খারাপ। যিনি নিয়েছিলেন তিনি টাকাটা ফেরত দিলেন না। আর সেই বছরেই যে-সময় বার্ষিক হিসেব হবার কথা, তার আগেই হিসেব হয়ে গেল। হিসেব মিলল না। চুরির দায়ে ধরা পড়ে গেলাম। বিচারে আমার শাস্তি হল। লঘু পাপে গুরু দণ্ড। এতটা শাস্তি নাও হতে পারত। তবে তখনকার জজসাহেবরা ভীষণ কড়া ছিলেন। যাই হোক, যে দিন আমি তেইশ বছরে পা দিলাম, সেই দিনই অপরাধী হিসেবে আমাকে জাহাজে করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হল। আমরা সবসুদ্ধ সাঁইত্রিশ জন দাগি আসামি গ্লোরিয়া স্কট জাহাজে চেপে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমালাম।
সেটা ১৮৫৫ সালের কথা। তখন ক্রিমিয়ান যুদ্ধ দারুণ ভাবে চলছে। বড় বড় জাহাজ সবই যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্লোরিয়া স্কট একটা ৫০০ টনের জাহাজ। এটা চিন থেকে চা আমদানির কাজে লাগানো হত। আমরা সাঁইত্রিশ জন ছাড়া জাহাজে ছিল ক্যাপ্টেন, তিন জন মেট, এক জন ডাক্তার, এক জন পাদরি, চার জন রক্ষী, ছাব্বিশ জন খালাসি আর আঠারো জন সৈন্য। ফালমাথ থেকে আমরা যে-দিন যাত্রা করলাম, জাহাজে প্রায় একশো জন লোক।
যে-সব জাহাজে বন্দি চালান করা হয়, সেগুলোয় বন্দিদের রাখবার ঘরগুলো বেশ মজবুত ওক কাঠ দিয়ে তৈরি। কিন্তু এই জাহাজের ঘরগুলো ছিল পাতলা অপোক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি। আমার পাশের ঘরের লোকটিকে জাহাজঘাটায় দেখেই আমার ভাল লেগেছিল। লোকটির বয়স কম। পরিষ্কার দাড়িগোঁফ কামানো মুখ। চোয়ালদুটো চৌকো। বিরাট লম্বা, সাড়ে ছ’ফুটের ওপর হবে। মাথা সোজা করে যখন হাঁটে, তখন আপনিই তার দিকে নজর চলে যায়। আশেপাশের কয়েদিদের গোমড়া মুখের মাঝখানে ওকে দেখলে আমার খুব ভাল লাগে। ওর চলায়ফেরায় ‘একটা কিছু করতেই হবে’ গোছের দৃঢ়তা প্রকাশ পেত। ওকে আমার পাশের ঘরে পেয়ে ভারী আনন্দ হল। পরের দিন রাতে আরও আনন্দ হল, যখন ও ওর ঘরের কাঠের দেওয়ালের ওপাশ থেকে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘কী নাম তোমার হে? এখানে জুটলে কী করে?’ আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে, ও কাঠের দেওয়ালে একটা ফুটো করেছে। আমি ওকে আমার সব কথা বললাম। তারপর ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমার নাম জ্যাক পেন্ডারগাস্ট। ভগবানের নাম নিয়ে বলছি, একদিন তুমি আমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করবে,’ ও বলল।
জ্যাক পেন্ডারগাস্ট নামটা শুনেই আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। ব্যাপারটা নিয়ে সারা দেশে সাঙ্ঘাতিক হইচই পড়ে গিয়েছিল। আমি ধরা পড়বার আগে এ কাণ্ডটা ঘটে। জ্যাক খুব বড় বংশের ছেলে। নানান বিষয়ে ওর খুব দক্ষতা আছে। তবে ওর স্বভাব মোটেই ভাল নয়। অত্যন্ত বদমেজাজি। বিরাট জালিয়াতির ফাঁদ পেতে ও লন্ডনের সব নামকরা ব্যবসাদারদের ঠকিয়ে প্রচুর টাকা কামিয়ে ছিল।
‘আঃ-হাঃ! আমার মামলার কথাটা মনে পড়েছে?’ বেশ গর্ব করে জ্যাক বলল।
‘খুব পরিষ্কার মনে আছে।’
‘তা হলে একটা রহস্যের কথা তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই?’
‘কোন রহস্যের কথা বলছ?’
‘আমি প্রায় পঁচিশ লক্ষ পাউন্ড হাতিয়ে ছিলাম বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, বটে তো?’
‘হ্যাঁ, সেই রকমই শুনেছিলাম।’
‘কিন্তু সে টাকাটার হদিস পাওয়া যায়নি।’
‘না।’
জ্যাক আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে সে টাকাটা গেল কোথায়?’
আমি বললাম, ‘আমি কী করে জানব?’
জ্যাক বলল, ‘আমার মুঠোয় লুকোনো আছে। ভগবানের দিব্যি বলছি, তোমার মাথায় যত চুল আছে তার চাইতে অনেক বেশি টাকা আমার কাছে আছে। বাপু হে, তোমার হাতে যদি টাকাটা থাকে আর সে টাকাটা খাটাবার মতো বুদ্ধি থাকে তো তুমি যা চাও তাই করতে পারো। তোমার কি মনে হয় যে-লোক যা ইচ্ছে তাই করবার ক্ষমতা রাখে, সে এই ইঁদুর আর মাছি-ভরতি পুরনো মাল-বওয়া জাহাজের নোংরা অন্ধকার কাঠের কেবিনে চুপচাপ বসে থেকে সময় কাটাবে? না মশাই। এ শর্মা নিজের ব্যবস্থা নিজেই করবে। আর তার বন্ধুদের ব্যবস্থাও করবে। তুমি আমার কথার ওপর বাজি ধরতে পারো। তুমি যদি একে ধরে থাকো, তবে তুমি বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করে বলতে পারো যে, সে তোমাকে টেনে তুলবেই।
পেন্ডারগাস্টের কথাবার্তার ধরনধারণই এই রকম। গোড়াতে আমি তার কথায় কান দিইনি। ভাবতাম এ সব কথার কথা। কিছু দিন পরে তার যখন মনে হল যে, আমাকে বিশ্বাস করা যায়, তখন আমাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিয়ে সে বলল যে, জাহাজটা দখল করবার একটা মতলব ভেঁজেছে। জাহাজে ওঠবার আগেই একদল কয়েদি এই ফন্দিটা করেছিল। বলাই বাহুল্য, পেন্ডারগাস্ট হচ্ছে দলের পাণ্ডা। আর সবকিছুর পিছনে রয়েছে তার টাকা।
‘আমার একজন শাগরেদ ছিল। খুব বিশ্বাসী লোক। আমরা দু’জনে যাকে বলে হরিহর আত্মা। টাকাটা তার কাছেই ছিল। আমার সেই শাগরেদটি এখন কোথায় বলো তো? বলতে পারলে না তো? সে হচ্ছে এই জাহাজের পাদরি। সে পাদরির পোশাক পরে ধর্মপুস্তকটুস্তক নিয়ে জাহাজে চেপেছে। তার বাক্সপ্যাঁটরার তলায় এত টাকা আছে, যা দিয়ে এই জাহাজ মায় ক্যাপ্টেন, মেট, খালাসিসমেত কিনে ফেলা যাবে। অবশ্য এই জাহাজের খালাসিদের দেহ মন সবই সে জয় করে ফেলেছে। দু’জন প্রহরী আর একজন মেট, তার নাম মার্শার, সেও পাদরির দলে ভিড়ে গেছে। দরকার হলে সে জাহাজের ক্যাপ্টেনকেও টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারে।
‘তা আমাদের কী করতে হবে?’ আমি জানতে চাইলাম।
সে বলল, ‘কী করবে ভাবছ? আমরা ওই সৈন্যদের লাল রঙের জামাগুলো আরও টকটকে লাল করে দেব।’
‘কিন্তু ওদের কাছে বন্দুক আছে।’
‘বাপু হে, আমাদেরও অস্ত্র আছে বই কী। আমাদের প্রত্যেকের কাছে একটা করে পিস্তল থাকবে। আর তা সত্ত্বেও যদি আমরা জাহাজটা দখল করতে না পারি, তা হলে আমরা শিশু। তুমি তোমার বাঁ পাশের ঘরে যে আছে তার সঙ্গে কথা বলে দেখো, তাকে বিশ্বাস করা যাবে কিনা।’
আমি জ্যাক পেন্ডারগাস্টের কথামতো কাজ করলাম। আমার বাঁ পাশের ঘরের লোকটির অবস্থা আমারই মতো। বয়সও বেশি নয়। নকল নথিপত্র চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তার নাম ছিল ইভান্স। পরে অবশ্য সেও নাম বদলে নেয়। এখন দক্ষিণ ইংল্যান্ডে বাস করে। বেশ প্রতিপত্তিশালী লোক। সে আমাদের দলে যোগ দিল। অল্প দিনের মধ্যে দু’জন ছাড়া সবাই আমাদের সঙ্গে জুটে গেল। যে-দু’জন যোগ দিলে না তাদের একজন এতই দুর্বল স্বভাবের যে, তাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে বলে মনে হল না। আর-একজনের খুব সাঙ্ঘাতিক ধরনের জন্ডিস হয়েছিল। গোড়া থেকেই এমন ছিল, আমাদের পক্ষে জাহাজটার দখল নেওয়া মোটেই শক্ত ছিল না। জাহাজের খালাসিগুলো ছিল একদম চোরগুন্ডা। এই জাহাজের জন্যে তাদের বিশেষ ভাবে বাছাই করা হয়েছিল। সেই জাল পাদরি কাগজপত্রে-ভরতি কালো ব্যাগ নিয়ে আমাদের কুঠুরিতে প্রায়ই আসতেন। তিনি এত ঘন ঘন আসতেন যে, তিন দিনের মধ্যেই আমাদের প্রত্যেকের কাছে পিস্তল, কুড়িটা কার্তুজ, আধসের মতো বারুদ আর একটা করে উকো পৌছে গেল। জাহাজের দু’জন রক্ষী আর এক জন মেট তো পেন্ডারগাস্টের হাতের লোক। ক্যাপ্টেন, আর দু’জন মেট, দু’জন রক্ষী, লেফটেন্যান্ট মার্টিন তার আঠারো জন সৈন্য আর জাহাজের ডাক্তারবাবু এঁরাই আমাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই আমাদের ভয়ের কিছুই ছিল না। তবু আমরা আটঘাঁট বেঁধে ধীরেসুস্থে রাতের অন্ধকারে কাজ হাসিল করব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা এক দিন অদ্ভুত ভাবেই ঘটে গেল।
ফালমাথ থেকে যাত্রা করবার সপ্তাহ-তিনেক পরে একদিন সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবু একজন অসুস্থ কয়েদিকে দেখতে তার কুঠুরিতে গেলেন। সেই রুগিকে বিছানায় শুইয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে ডাক্তারবাবুর হাতে পিস্তলটা ঠেকে যায়। ডাক্তারবাবু যদি বুদ্ধিমানের মতো চুপচাপ থাকতেন, তা হলে হয়তো আমরা সবাই ধরা পড়ে যেতাম। কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসলেন। সেই কয়েদি যখন বুঝতে পারল যে ডাক্তারবাবু কেন চেঁচিয়ে উঠছেন তখন সে ডাক্তারবাবুকে মুখ বন্ধ করে বিছানায় শুইয়ে বেঁধে দিল। তারপর সে দরজাগুলো খুলে দিতেই আমরা সকলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলাম। যে-দু’জন সৈন্য পাহারায় ছিল তাদের একজন কী হয়েছে দেখতে আসছিল, তাকে আমরা সকলে হুড়মুড় করে মেরে ফেললাম। জাহাজের বড় ঘরটায় জনাকয়েক সৈন্য বসেছিল। তাদের বন্দুকে বোধহয় গুলি ভরতি করা ছিল না। তারা কিছু করবার আগেই আমরা আবার তাদের খতম করে দিলাম। তখন আমরা ক্যাপ্টেনের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। যখন আমরা দরজা ঠেলে ক্যাপ্টেনের ঘরে ঢুকতে যাব, তখনই ঘরের ভিতর থেকে বিকট একটা আওয়াজ শোনা গেল। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম যে, ক্যাপ্টেনের টেবিলে আটলান্টিক মহাসাগরের একটা ম্যাপ বিছানো রয়েছে, আর সেই ম্যাপের ওপর ক্যাপ্টেন ঘাড় লটকে পড়ে আছে। আর টেবিলের এক দিকে পাদরিসাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তার পিস্তলের নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাকি দু’জন মেটকে খালাসিরা বন্দি করে ফেলেছিল। সুতরাং সবকিছুই আমাদের হিসেবমতো হয়ে গেল।
আমরা জাহাজের বড় ঘরে গিয়ে জড় হলাম। যে যেখানে পারলাম বসে পড়ে হইচই করে কথা বলতে লাগলাম। ওই ঘরের খাবার আলমারিতে যত ভাল ভাল খাবার আর পানীয় ছিল সেসব আলমারি ভেঙে যত না খেলাম তার চেয়ে বেশি চারপাশে ছড়িয়ে দিলাম। মুক্তি পেয়ে আমাদের সকলেরই খুব আনন্দ হয়েছিল। ঘরের চার দিকে অনেক আলমারি ছিল। উইলসন, যে এত দিন পাদরি সেজে ছিল, একটা আলমারির চাবি ভেঙে ফেলল। আলমারি ভরতি নানা রকমের ভাল ভাল খাবার জিনিস ছিল। আমরা সেগুলো বের করে এনে খেতে লাগলাম। আমাদের ফুর্তি যখন জমে উঠেছে, বাতাস তখন হঠাৎ বন্দুকের শব্দে বারুদের গন্ধে আর ধোঁয়ায় ভরে ছিল। ধোঁয়া কমে এলে দেখলাম ঘরের ভিতর একটা ঝড় বয়ে গেছে। উইলসন আর তার সঙ্গে আট জন বন্দি মেঝেতে পড়ে ছটফট করছে। ঘরের মধ্যে রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে আমি তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হল অন্য সকলেই ভয় পেয়েছিল। আমরা আবার হয়তো ধরাই পড়ে যেতাম, যদি না পেন্ডারগাস্ট আমাদের সঙ্গে থাকত। সে সিংহের মতো গর্জন করে আমাদের যে-ক’জন বেঁচে ছিল তাদের নিয়ে দরজার দিকে তেড়ে গেল। ঘরের স্কাইলাইটা ফাঁক করে লেফটেন্যান্ট আর সৈন্যরা গুলি চালিয়ে ছিল। আমরা যখন তাদের দিকে এগিয়েও গেলাম তখন ওরা বন্দুকে গুলি পুরতে ব্যস্ত ছিল। ওরা আমাদের সঙ্গে জোর লড়াই করল। কিন্তু আমরা মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে ওদের শেষ করে দিলাম। জাহাজটাকে তখন একটা কসাইখানা বলে মনে হচ্ছিল। পেন্ডারগাস্টকে তখন আস্ত শয়তানের মতো দেখাচ্ছিল। সে জীবিতই হোক আর মৃতই হোক, এক একটা সৈন্যকে ছোট ছেলের মতো দু’হাতে ধরে সমুদ্রে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিল। যখন মারামারি কাটাকাটি শেষ হল, তখন আমাদের শত্রুপক্ষের বিশেষ কেউ আর বেঁচে ছিল না। বেঁচে ছিলেন শুধু জাহাজের ডাক্তার, একজন প্রহরী আর দু’জন মেট।
এদের নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধল। আমরা একদল বললাম যে, আমরা আমাদের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। আর মিছিমিছি খুনখারাপি করার দরকার কী? যুদ্ধ যখন চলছে তখন মারতে পারা যায়। কিন্তু শুধু শুধু কি নিরীহ লোককে ঠান্ডা মাথায় খুন করা যায়? আমরা আট জন, পাঁচ জন কয়েদি আর তিন জন খালাসি, বললাম আর কোনও খুনোখুনিতে আমরা রাজি নই। কিন্তু পেন্ডারগাস্ট আর তার চেলারা আমাদের কথায় সায় দিল না। পেন্ডারগাস্ট বলল, ‘আমাদের বাঁচবার একমাত্র রাস্তা হল এদের সকলকে খুন করা। কেন না এদের মধ্যে এক জনও যদি বেঁচে থাকে, আর পরে আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় তো আমাদের নির্ঘাত ফাঁসি হবে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথাকাটাকাটি হল। পেন্ডারগাস্ট তো এমন রেগে গেল যে, মনে হল সে বুঝি আমাদের মেরেই ফেলবে। শেষ পর্যন্ত পেন্ডারগাস্ট বলল যে, আমরা ইচ্ছে করলে একটা নৌকো নিয়ে জাহাজ ছেড়ে চলে যেতে পারি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের প্রত্যেককে একপ্রস্থ করে নাবিকদের পোশাক, এক জালা খাবার জল, একটা কম্পাস আর কিছু খাবারদাবার দিয়ে দিল। পেন্ডারগাস্ট একটা ম্যাপ দেখিয়ে বলল যে, আমরা যেন নিজেদের ডুবে-যাওয়া জাহাজের নাবিক বলে পরিচয় দিই। আমরা তখন পনেরো ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং পঁচিশ ডিগ্রি দক্ষিণ দ্রাঘিমায় ছিলাম।
এইবার আমার কাহিনীর সবচাইতে চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলব। আমাদের নামিয়ে দিয়েই জাহাজটা পুবমুখে ভেসে চলল। জাহাজটা আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল। আমাদের ডিঙিনৌকো সমুদ্রের ওপর ভাসতে ভাসতে জলের টানে এগিয়ে চলল। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের মধ্যে আমি আর ইভান্স ছাড়া সকলেই একদম গোমূর্খ। এখন সমস্যা হল, আমরা কোন দিকে যাব। কেপ দ্য ভের্দ আমাদের পাঁচশো মাইল উত্তরে, আর আফ্রিকা প্রায় সাতশো মাইল পুবে। উত্তর আর পুব, দু’দিক থেকেই বাতাস বইছিল। উত্তরে বাতাসে ভর করে আমরা সিয়েরা লিওনের দিকে যাওয়াই ভাল মনে করলাম। আমরা সেই মতো নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের জাহাজটার দিকে নজর পড়াতে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। জাহাজটা থেকে ভসভস করে চাপ চাপ ধোঁয়া বেরোচ্ছে। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। আমাদের কানে তালা লেগে গেল। সেই জায়গায় ধোঁয়া যখন কমে গেল, তখন ‘গ্লোরিয়া স্কট’ জাহাজের চিহ্নটুকুও আর নেই।
সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আমরা যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে পৌঁছোবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছোতে আমাদের প্রায় একঘণ্টা সময় লেগে গেল। জাহাজটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কাঠের টুকরোগুলো সেখানকার উত্তাল ঢেউয়ের দোলায় উঠছে আর পড়ছে। মনে হল, আমরা অনেক দেরিতে এসেছি। জাহাজের এক জনকেও বোধহয় বাঁচানো যাবে না। আমরা চার দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে নৌকোর মুখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছি, এমন সময় একটা আর্ত চিৎকার কানে এল। যে-দিক থেকে আওয়াজটা এসেছিল, সে দিকে ভাল করে নজর করতে লক্ষ করলাম, কাঠের একটা তক্তার ওপর এক জন লোক শুয়ে আছে। আমরা তাকে উদ্ধার করলাম। সেই লোকটাই হাডসন। লোকটার হাত-পা পুড়ে গিয়ে ছিল।
পরে হাডসনের কাছে আমরা যা জানতে পেরেছিলাম তা হল যে, আমরা চলে আসবার পর পেন্ডারগাস্ট ঠিক করে বাকি পাঁচ জনকেও মেরে ফেলবে। দু’জন প্রহরী আর এক জন মেটকে গুলি করে মেরে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর পেন্ডারগাস্ট জাহাজের ডাক্তারকে নিজের হাতে খুন করে। বাকি থাকে শুধু জাহাজের প্রথম মেট। লোকটির গায়ে ছিল যেমন ক্ষমতা, মনে ছিল তেমনই সাহস। কী ভাবে সে জানি না, তার হাতের বাঁধন আলগা করে ফেলেছিল। পেন্ডারগাস্টকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে তাকে পাশ কাটিয়ে জাহাজের নীচের তলার একটা ঘরে লুকিয়ে পড়ে। কয়েদিরা তাকে যে-ঘরে খুঁজে পায় সে ঘরে জালা-ভরতি বারুদ ছিল। কয়েদিদের আসতে দেখেই সে একটা জালার মুখ ফুটো করে চিৎকার করে বলল, এ ঘরে ঢুকলেই সব উড়িয়ে দেব। তার হাতে একটা দেশলাই ধরা ছিল। শেষকালে অবশ্য মেটই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল না কারও হাত থেকে ফসকে বেরিয়ে যাওয়া বন্দুকের গুলিতে বারুদের স্কুপে আগুন লেগে গিয়েছিল, তা হাডসন অবশ্য বলতে পারল না। যাই হোক না কেন, গ্লোরিয়া স্কটের সে দিন সেইখানে সলিলসমাধি হল।
পরের দিন ‘হটসপার’ জাহাজ আমাদের দেখতে পেয়ে তুলে নেয় ও সিডনিতে নামিয়ে দেয়। সেখানে আমি আর ইভান্স দু’জনেই নাম বদলে ফেলি। নতুন দেশে নতুন পরিচয়ে আমরা নতুন ভাবে জীবন শুরু করি।
এর পরের কথা বিশেষ বলবার নেই। পরিশ্রম করে প্রচুর টাকাপয়সা উপার্জন করে আমি দেশে ফিরে আসি। পঁচিশ বছর নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে দেবার পর হঠাৎ যে-দিন দুষ্টগ্রহের মতো হাডসন, যাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম, এসে হাজির হল, সে দিন থেকে আমার জীবনের সব সুখ নষ্ট হয়ে গেল। আমি চেষ্টা করেছিলাম ওকে সন্তুষ্ট রাখতে। এখন তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে, কেন ওর সব অত্যাচার আমি মুখ বুজে সহ্য করতাম।
যাই হোক, একদিন ও চলে গেল। মুখে কিছু না বললও আমি ওর হাবভাব দেখে বুঝেছিলাম যে, ও আমার সর্বনাশ করবে।
এরপর আঁকাবাঁকা হরফে লেখা: এইমাত্র বেডসের চিঠি পেলাম। হাডসন সব কথা ফাঁস করে দিয়েছে। ভগবান আমার অপরাধ যেন মার্জনা করেন।”
“বুঝলে ওয়াটসন, এই কাহিনী সে দিন ভিক্টরকে পড়ে শুনিয়েছিলাম আর আজকে তোমাকে পড়ে শোনালাম। ভিক্টর মনে খুবই ব্যথা পেয়েছিল। কিছু দিন পরে ও দেশ ছেড়ে চলে যায়। পরে খবর পেয়েছি তরাই অঞ্চলে চায়ের বাগান করে ও এখন বেশ ভালই আছে। হাডসন আর বেডসের কিন্তু কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। দু’জনেই একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। পুলিশের কাছে কোনও ডায়েরি করা হয়নি। তার থেকে মনে হয় বেডস হাডসনের শাসানিতে ভয় পেয়ে যায়। হাডসনকে বেডসের বাড়ির কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। পুলিশের ধারণা হাডসন বেডসকে খুন করে পালিয়েছে। আমার ধারণা, হাডসন সব কথা ফাঁস করে দিয়েছে মনে করে বেডস-ই হাডসনকে হত্যা করে টাকাপয়সা যা ছিল তা নিয়ে গা ঢাকা দেয়।
“ডাক্তার, এই হচ্ছে ঘটনা। যদি তোমার ইচ্ছে হয় তো কাগজপত্রগুলো তোমার কাছে রেখে দিতে পারো।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন