নৌবাহিনীর চুক্তি গায়েব

আর্থার কোনান ডয়েল

আমার বিয়ের ঠিক পরের জুলাই মাসটার কথা আমি কখনও ভুলব না। এই এক মাসের মধ্যে হোমস তিন তিনটে সাংঘাতিক জটিল রকমের রহস্যের দারুণ সমাধান করে ফেলেছিল। আর তিনটে রহস্যের তদন্তের সময়েই আমি হোমসের সঙ্গে ছিলাম। শুধু যে হোমসের সঙ্গে ছিলাম তাই নয়, হোমসের কাজের ধারা খুব কাছ থেকে ভাল করে দেখবার সুযোগও পেয়েছিলাম। এই তিনটে কেসের কথাই আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। প্রথম কেসটা ‘দ্বিতীয় দাগের রহস্য’ বলে লেখা আছে। আর দ্বিতীয়টা নৌবাহিনীর একটা গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিকে ঘিরে যে-রহস্যের বেড়াজাল গড়ে উঠেছিল তার কথা। আর শেষের ব্যাপারটার শিরোনামে লেখা আছে ‘অবসন্ন দলপতির সমস্যা’।

প্রথম ঘটনাটার কথা আমার পক্ষে কোনও দিন লেখা সম্ভব হবে কিনা জানি না। সারা ইংল্যান্ডে এমন একটিও সম্ভ্রান্ত পরিবার নেই যার কেউ-না-কেউ, কোনও-না-কোনও ভাবে এই রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। সত্যি কথা বলতে কী, সমাজের যাঁরা গণ্যমান্য ব্যক্তি, যাঁরা সমাজের মাথা, তাঁরা সকলেই এই মামলায় ফেঁসে গেছেন। তাই এই রহস্যটা যে কী, আর কী ভাবে হোমস এটার সমাধান করেছিল, সে কথা খুলে বলা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। তবে একটা কথা ঠিক, এই তদন্তে হাত দেবার আগে হোমস বহু রহস্যের সমাধান করেছে। এগুলোর মধ্যে কোনও কোনওটার রহস্য রীতিমতো জটিল। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান করে দিয়ে হোমস সক্কলকে যে রকম তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, তা সত্যি ভাবা যায় না। হোমসের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি, চুলচেরা বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সকলকে তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিল। এই রহস্য সমাধানের সময় যারা হোমসের কাছাকাছি ছিল, তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছে যে, হোমসের তুলনা নেই।

প্যারিস পুলিশের বড়কর্তা মঁসিয় দুবক আর ডানজিগের ক্রাইম-বিশেষজ্ঞ ফ্রিটস ফন ভালটবাউমের সঙ্গে এই রহস্য নিয়ে হোমসের অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছিল। সে কথাবার্তার আক্ষরিক অনুলিপি আমার কাছে আছে। হোমস সব ব্যাপারটা ওঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। হোমসের কথা শুনে ওঁরা তো থ। এই রহস্যের সমাধান করতে দুবক আর ভালটবাউম দু’জনেই প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, ওঁরা আসল কথাটা ধরতেই পারেননি। যে-জিনিসটাকে রহস্যের জট বলে ওঁরা ভেবে ছিলেন সেটা একটা সামান্য জিনিস। বাজে জিনিসকে আসল জিনিস মনে করে ওঁরা শুধু শুধু সময় আর শ্রম নষ্ট করেছেন। এই শতাব্দী পেরিয়ে যখন আগামী শতাব্দী আসবে তখন হয়তো এ কাহিনী সাধারণের কাছে পেশ করা যাবে। ইতিমধ্যে আমি আমার ডায়েরির দু’নম্বর কেসটার কথা বরং আপনাদের শুনিয়ে দিই। এই কেসটার কথা শুনে মনে হয়েছিল এটাও হয়তো শেষ পর্যন্ত এমন রহস্য হয়ে উঠবে যার সঙ্গে আমাদের দেশের ভাল মন্দের প্রশ্ন জড়িয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা হয়নি। তবে রহস্যটা খুবই জমজমাট হয়ে উঠেছিল। একদিক থেকে দেখলে এ রকম রহস্যের তদন্তের ভার হোমসের হাতে এর আগে কখনও আসেনি।

স্কুলে পড়বার সময় আমার একটি বন্ধু ছিল। তার নাম পার্সি ফেলপ্‌স। সে ছিল আমার প্রাণের বন্ধু। পার্সি আমার বয়সি ছিল, তবে পড়ত দু’ক্লাস ওপরে। লেখাপড়ায় অসাধারণ ভাল ছেলে। পরীক্ষায় সব সময়ে ভাল রেজাল্ট করে প্রাইজ পেত। স্কুলের শেষ পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করে সে স্কলারশিপ পেয়ে কেম্‌ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেল। পার্সি যে লেখাপড়াতেই ভাল ছিল তাই নয়, ও খুব ভাল বংশের ছেলে। ওর অনেক আত্মীয় খুব বড় বড় চাকরি করতেন। যখন ও স্কুলে পড়ত তখনই আমরা জানতাম যে ওর মামা লর্ড হোলডহার্স্ট কনজারভেটিভ দলের একজন প্রধান নেতা। এই সব কথা ছেলেদের মধ্যে জানাজানি হওয়ায় ওর পক্ষে ফল ভাল হয়নি। অনেকেই ওকে মনে মনে হিংসে করত। আর সেই জন্যে খেলার মাঠে সুযোগ পেলেই ওকে অনেকে হেনস্থা করত। কিন্তু যখন ও লেখাপড়ার পালা সাঙ্গ করল তখন ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াল। একে তো পার্সি অসাধারণ ভাল ছাত্র তার ওপর ওর সামাজিক প্রতিপত্তিও খুব। আর তার ফলে ও সহজেই ফরেন আপিসে ভাল চাকরি পেয়ে গেল। এরপর ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমে আসতে লাগল। শেষকালে ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন পার্সির একটা চিঠি পেলাম। সব কথা মনে পড়ে গেল। পার্সি লিখেছে:

ব্রায়ারব্রে, ওকিং

প্রিয় ওয়াটসন,

আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি ‘ব্যাঙাচি’ ফেলপ্‌সকে ভুলে যাওনি। তুমি যখন থার্ড ফর্মে পড়তে আমি তখন ফিফথ ফর্মে পড়তাম। হয়তো তুমি এ কথাও শুনেছ যে, আমার মামার চেষ্টায় আমি ফরেন আপিসে একটা ভাল চাকরি পাই। আমাকে যে-পদ দেওয়া হয় সেটা খুবই উঁচু আর দায়িত্বপূর্ণ পদ। এই কাজ আমি ভাল ভাবেই করে আসছিলাম। হঠাৎ এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে যে, যার ফলে আমার চাকরিজীবন একেবারে শেষ হয়ে যেতে বসেছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমার জীবনে কলঙ্কের ছাপ পড়তে চলেছে।

এই ঘটনার সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে লেখার প্রয়োজন নেই। যদি তুমি আমার অনুরোধ রাখো তো সব কথাই আমাকে তখন খুলে বলতে হবে। আমি টানা ন’সপ্তাহ ব্রেন ফিভারে ভুগলাম। এখন সবে একটু সেরে উঠেছি। তবে এখনও খুবই দুর্বল। তুমি কি তোমার বন্ধু মিঃ হোমসকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারো? এই ব্যাপারটা নিয়ে মিঃ হোমসের সঙ্গে কথা বলে আমি তাঁর মতামত শুনতে চাই। আমার আপিসের কর্তারা অবশ্য আমাকে বার বার বলছেন যে, এই ব্যাপারে আর কিছুই করবার নেই। তবু তুমি মিঃ হোমসকে বুঝিয়ে বলে এখানে নিয়ে আসবার চেষ্টা কোরো। বুঝতেই পারছ যে, আমার মনের অবস্থা ভাল নয়। যতক্ষণ না এই সন্দেহ আর সংশয়ের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি, ততক্ষণ আমার শান্তি নেই। এক একটা মিনিটকে মনে হয় যেন এক একটা ঘণ্টা। মিঃ হোমসকে বুঝিয়ে বোলো যে তাঁকে আগে খবর না দেবার কারণ, তাঁকে খবর দেবার মতো অবস্থা আমার ছিল না। হঠাৎ একটা অকল্পনীয় আঘাতে আমার মাথার ঠিক ছিল না। এর পরেই আমি অসুখে পড়ি। মিঃ হোমসের ক্ষমতার ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। এখন একটু সুস্থ হয়েছি, তাই লিখছি। তবে ওই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে চাই না। ভয় হয় পাছে আবার অসুখে পড়ে যাই। আমি এখনও শরীরে বল পাইনি। তাই নিজের হাতে চিঠি লিখতে পারলাম না। অন্যকে দিয়ে লেখাতে হল।

ইতি

তোমার পুরনো স্কুলের বন্ধু

পার্সি ফেলপ্‌স।

চিঠি পড়ে আমার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। পার্সি এ ভাবে বার বার হোমসকে ওর কাছে নিয়ে যাবার জন্যে কাতর ভাবে অনুরোধ করেছে তা জেনে আমার কষ্ট হল। পার্সির জন্যে আমার এতই দুঃখ হল যে, আমি ঠিক করলাম যেমন ভাবেই হোক হোমসকে নিয়ে যাব। তবে আমি জানতাম যে, আমাকে বিশেষ চেষ্টা করতে হবে না। হোমস রহস্যের জট খুলতে এতই ভালবাসে যে, এ কাজে তার ডাক পড়লে সে সাড়া না দিয়ে পারে না। মক্কেলরা যতখানি আগ্রহ নিয়ে হোমসের কাছে আসে হোমসও ঠিক ততখানি আগ্রহ নিয়ে মক্কেলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সব কথা শুনে আমার স্ত্রী বললেন যে, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুবই জরুরি। এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা উচিত হবে না। তাই আমি তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম।

হোমস ড্রেসিং গাউন গায়ে দিয়ে একটা টেবিলের কাছে বসে কেমিস্ট্রির কী একটা পরীক্ষা করছিল। একটা বুনসেন বার্নার নীল হয়ে জ্বলছিল। বার্নারের ওপরে একটা অদ্ভুত আকৃতির কাচের পাত্র। পাত্রটার ভেতরে জলীয় কোনও পদার্থ টগবগ করে ফুটছিল। কাচের পাত্রটার সঙ্গে একটা নল লাগানো। সেই নলটা গিয়ে পড়েছে একটা দু’লিটার মগের পাত্রে। নল থেকে বাষ্প বেরিয়ে এসে ফোঁটা ফোঁটা করে দ্বিতীয় পাত্রে পড়ছিল। আমি ঘরে ঢুকলাম। হোমস আমাকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হল না। বুঝলাম হোমস খুব জরুরি কোনও পরীক্ষায় ব্যস্ত। আমি কোনও কথা না বলে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হোমস কাচের একটা সরু নল দিয়ে একবার এই পাত্রটা থেকে আর একবার ওই পাত্র থেকে নানান রাসায়নিক পদার্থ তুলে নিয়ে মেশাচ্ছিল। শেষকালে হোমস একটা টেস্টটিউব নিয়ে এল। টেস্টটিউবে কী যেন একটা সলিউশন। হোমসের ডান হাতে একটা লিটমাস পেপারের টুকরো।

“ওয়াটসন, তুমি এমন একটা সময়ে এসে পড়লে যখন কিনা সত্যি সত্যিই জীবনমরণ সমস্যা। এই কাগজটার রং যদি নীল থাকে তো কোনও বিপদ নেই। কিন্তু কাগজটার রং যদি লাল হয়ে যায় তো তবে একজন লোকের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে,” হোমস বলল। কথাটা শেষ করেই হোমস কাগজটা সেই তরল সলিউশনে ডুবিয়ে দিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা রক্তের মতো লাল হয়ে গেল। হোমস বলে উঠল, “এই রকমটাই যে হবে তা বুঝতে পেরেছিলাম। ওয়াটসন, এক মিনিট অপেক্ষা করো হাতের কাজটা সেরে ফেলি। ওই পার্সিয়ান চটিটার মধ্যে তুমি তামাকের থলিটা পাবে।” হোমস তার লেখার টেবিলে উঠে গিয়ে খসখস করে কয়েকটা টেলিগ্রাম লিখে ফেলল। তারপর আমাদের ফাইফরমাশ খাটার ছেলেটিকে ডেকে সেগুলি তক্ষুনি পাঠাবার ব্যবস্থা করল। ছেলেটি চলে গেল। আমি যে-চেয়ারটায় বসেছিলাম হোমস সেটার উলটো দিকের চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে হোমস বলল, “একটা খুব সাধারণ খুনের ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছে তোমার কাছে এর চাইতে ভাল খবর আছে। ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই কোনও রহস্যের আগাম খবর নিয়ে এসেছ। বলো, বন্ধু, কী তোমার খবর।’

আমি পার্সি ফেলপ্‌সের চিঠিটা হোমসকে এগিয়ে দিলাম। হোমস খুব মন দিয়ে চিঠিটা পড়ল।

“চিঠিটার থেকে বিশেষ কিছু খবর পাওয়া গেল না।” হোমস চিঠিটা মুড়ে আমাকে ফেরত দিয়ে দিল।

“হ্যাঁ। ব্যাপারটা যে কী তা বোঝা যাচ্ছে না।”

“তবে হাতের লেখাটা অবশ্য খুব ইন্টারেস্টিং।”

“কিন্তু লেখাটা তো পার্সির নয়।”

“ঠিক কথা। এটা মহিলার হাতের লেখা।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম, “আমার তো মনে হচ্ছে এটা কোনও পুরুষমানুষের হাতের লেখা।”

“না, এটি যে মহিলার হাতের লেখা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর এই মহিলা অত্যন্ত অসাধারণ চরিত্রের মহিলা। দেখো ওয়াটসন, তদন্ত শুরু করবার আগেই আমাদের হাতে একটা বড় সূত্র এসে গেল। আমরা জানতে পারলাম যে, তোমার বন্ধুর সঙ্গে এমন এক মহিলার যোগাযোগ আছে, যিনি ভালই হোন বা খারাপ হোন, অসাধারণ মহিলা। যাঁর চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব দুই-ই অসাধারণ। এই ব্যাপারটার সম্বন্ধে আমার কৌতূহল হচ্ছে। ওয়াটসন, তুমি যদি তৈরি থাকো তো আমরা এক্ষুনি ওকিংয়ের দিকে এগিয়ে পড়তে পারি। তোমার অসুস্থ কূটনীতিক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হবে, আর ওই অসাধারণ মহিলা, যাঁকে দিয়ে তোমার বন্ধু তাঁর চিঠি লেখান, তাঁকেও দেখা হবে।”

আমাদের ভাগ্য ভাল বলতে হবে। ওয়াটারলু স্টেশনে এসে পৌঁছোনো মাত্র আমরা ওকিং যাবার ট্রেন পেয়ে গেলাম। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে ওকিং পৌঁছে গেলাম। ওকিংয়ে যে-দিকেই চাও কেবল হেদার আর ফার গাছ। ফেলপ্‌স যে-বাড়িতে আছে, ব্রায়ারব্রে, সেটাকে একটা ছোটখাটো প্রাসাদ বললেও ভুল বলা হয় না। বিরাট হাতাওয়ালা বাড়ি। বাড়িটা অবশ্য স্টেশনের কাছেই। মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। ব্রায়ারব্রেতে পৌঁছে আমরা আমাদের ‘কার্ড’ পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের একটা সুন্দর করে সাজানো বসবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা সেই ঘরে গিয়ে বসতে-না-বসতেই একজন বেশ শক্ত-সমর্থ চেহারার ভদ্রলোক ঘরে এলেন। ভদ্রলোক আমাদের বেশ আদর-আপ্যায়ন করতে লাগলেন। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল ওঁর বয়স তিরিশের বেশি, তবে চল্লিশের কম। গালদুটো বেশ টকটকে লাল। আর ভদ্রলোকের চোখদুটো দেখলেই মনে হয় যে, সব সময়েই তিনি বেশ ফুর্তিতে আছেন। ভদ্রলোককে দেখেই আমার গোলগাল-মোটাসোটা দুষ্টু ছেলের ছবি মনে পড়ে গেল।

ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “আপনারা আসাতে যে কী ভাল হল তা আর কী বলব! পার্সি সকাল থেকে খোঁজ নিচ্ছে আপনারা এলেন কিনা। বেচারা! খড়কুটোটা ধরেই এখন বাঁচতে চাইছে। পার্সির বাবা-মা আমাকে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পাঠিয়ে দিলেন। সমস্ত ব্যাপারটাই ওদের কাছে এত দুঃখের যে, সে বলে বোঝাতে পারব না।”

হোমস বলল, “দেখুন, ব্যাপারটার সম্বন্ধে আমরা কিছুই প্রায় জানি না। তবে দেখছি যে আপনি এদের কোনও আত্মীয়টাত্মিয় নন।”

হোমসের কথায় ভদ্রলোকটি বেশ চমকে গেলেন। তারপর মাথা নিচু করে হাসতে লাগলেন।

“ও আপনারা আমার ‘লকেটে’ জে এইচ ছাপটা দেখেছেন। প্রথমে সত্যি সত্যি মনে হয়েছিল আপনি একটা দারুণ ভেলকি দেখালেন। আমার নাম জোসেফ হ্যাবিসন। আমার বোন অ্যানির সঙ্গে পার্সির বিয়ে হবে তো! বলতে পারেন সেই বিয়ের সুবাদে আমি ওর আত্মীয় হব। আমার বোন অ্যানিকে পার্সির ঘরে দেখতে পাবেন। গত দু’মাস নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে দিন-রাত ও পার্সির সেবা-শুশ্রূষা করেছে। চলুন, আমরা বরং পার্সির ঘরেই যাই। আপনাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে ও একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে।”

ড্রয়িংরুম থেকে আমাদের যে-ঘরে নিয়ে যাওয়া হল সেটা ওই তলাতেই। এটাও বেশ বড় ঘর। ঘরের খানিকটা বসবার ঘরের মতো করে সাজানো আর বাকিটা শোবার ঘরের মতো। ঘরের প্রত্যেক কোণে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। খোলা জানলার কাছে একটা ইজিচেয়ারে এক যুবক শুয়ে ছিল। শক্ত অসুখে ভুগে যে সে খুবই কাহিল হয়ে পড়েছে, এ কথা বলে দিতে হয় না। খোলা জানলা দিয়ে বাতাস আসছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল নানা রকমের ফুলের মিষ্টি সুবাস। যে-ইজিচেয়ারে যুবকটি বসেছিল তার কাছেই একটু নিচু টুলে এক অল্পবয়সি মহিলা বসে ছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই মহিলাটি উঠে দাঁড়ালেন।

“পার্সি, আমি কি বেরিয়ে যাব?” মহিলা বললেন।

পার্সি কোনও কথা না বলে হাত তুলে তাকে যেতে বারণ করল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে বলল, “কেমন আছ ওয়াটসন? …তোমার ওই বিরাট গোঁফের জন্যে আমি তো তোমাকে চিনতেই পারতাম না। অবশ্য আমার শরীরের যে-হাল হয়েছে তাতে তুমিও আমাকে বোধহয় চিনতে পারতে না। …ইনি নিশ্চয় তোমার স্বনামধন্য বিখ্যাত বন্ধু মিঃ শার্লক হোমস?”

আমি দু’-চার কথায় হোমসের সঙ্গে ফেলপ্‌সের পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর আমরা দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। সেই হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর বোন টুলটা সরিয়ে নিয়ে পার্সির চেয়ারের কাছে বসলেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে খুব সুন্দর। প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে সেটা হল, মহিলা খুব লম্বা নন। আর হয়তো বা একটু মোটা। তবে ওঁর গায়ের রং জলপাইয়ের মতো। চোখদুটি বেশ টানা টানা, কালো। অনেকটা ইটালিয়ানদের মতো। মাথা-ভরতি ঘন কালো চুল। ওঁর পাশে বসেছিল বলেই পার্সিকে আরও দুর্বল, আরও রোগা দেখাচ্ছিল।

সোফার ওপর একটু নড়েচড়ে বসে পার্সি বলল, “আমি বাজে কথায় সময় নষ্ট করতে চাই না। কোনও রকম ভূমিকা না করে আমি সোজাসুজি আসল কথায় আসি। …মিঃ হোমস, সুখী মানুষ বললে যা বোঝায় আমি তাই ছিলাম। অল্প বয়সে জীবনে উন্নতি করেছি, লোকে যা চায় সবই আমি পেয়েছিলাম। হঠাৎ আমার বিয়ের ঠিক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আর তার জন্যে আমার জীবনের সবকিছু একেবারে ভেঙে যাবার জোগাড়।

“ওয়াটসন হয়তো আপনাকে বলেছে যে, আমি ফরেন আপিসে কাজ করতাম। লর্ড হোল্ডহার্স্ট আমার মামা! নিজের চেষ্টায় আর মামার জোরে অল্প দিনের মধ্যেই আমি বেশ দায়িত্বপূর্ণ পদ পেয়ে গেলাম। আপনি জানেন যে, এই সরকারের আমলে আমার মামা বিদেশ দফতরের মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি মন্ত্রী হয়ে আমাকে অনেক গোপনীয় কাজের ভার দেন। এর প্রত্যেকটাই আমি খুব ভাল ভাবে করেছি। এই কাজগুলো করতে পারায় আমার মামার মনে হয় যে, আমি রীতিমতো কাজের লোক হয়ে উঠেছি। আমার দক্ষতা ও যোগ্যতা দুইই আছে।

“মাস আড়াই আগে, সঠিক তারিখটা আমার মনে আছে, ২৩ মে, আমার মামা আমাকে তাঁর প্রাইভেট চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। আমার কাজকর্মের খুব প্রশংসা করে বললেন যে, তিনি আমাকে আর একটা বিশেষ গোপন কাজের ভার দিতে চান।

“তাঁর নিজের দেরাজ থেকে একটা ছাই রঙের কাগজ বের করে মামা বললেন, ‘এটা ইংল্যান্ড আর ইটালির মধ্যে একটা গোপন চুক্তির দলিল। দুঃখের ব্যাপার এই যে, খবরের কাগজওলারা কোনও রকমে ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে। এখন আমাদের দেখতে হবে যে, নতুন কোনও খবর যেন কাগজে বার না হয়। ফরাসি আর রুশ সরকার এই চুক্তির আসল কথাটা জানবার জন্যে প্রচুর টাকা খরচ করতে রাজি। এই চুক্তিটা সদাসর্বদা আমার নিজের দেরাজে থাকবার কথা। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী, এই চুক্তির একটা নকলের বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছে। তোমার নিজস্ব কোনও দেরাজ আছে?’

“আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আছে।’

“‘তা হলে এই চুক্তিপত্রটা নিয়ে যাও। তোমার দেরাজে চাবি দিয়ে রাখোগে। আমি নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি যে, আর সকলে চলে গেলেও তোমাকে আপিসে থাকতে দেবে। সকলে কাজ করে চলে গেলে তুমি তোমার সুবিধেমতো এটার নকল করে ফেলবে। আসল কথাটা কেউ জানতে পারবে না, বা তুমি কী কপি করছ তাও দেখতে পাবে না। তোমার নকল করা হয়ে গেলে আসল আর নকল দুটো চুক্তিই তোমার দেরাজে চাবি-তালা দিয়ে চলে যাবে। কাল সকালে আপিসে এসেই ও দুটো আমাকে দিয়ে দেবে।’

“আমি কাগজটা নিয়ে নিলাম আর…”

পার্সিকে বাধা দিয়ে হোমস বলল, “এক মিনিট। এই যে কথাবার্তা হচ্ছিল তখন কি ঘরে আপনারা দু’জনই ছিলেন?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আর কে থাকবে?”

“ঘরটা আকারে কি খুব বড়?”

“ঘরটা লম্বায় তিরিশ ফুট। চওড়াতেও তিরিশ ফুট।”

“আপনারা কি ঘরের মাঝখানে ছিলেন?”

“হ্যাঁ, প্রায় মাঝখানেই ছিলাম।”

“আপনারা খুব নিচু গলায় কথা বলছিলেন তো?”

“আমার মামা এত আস্তে আস্তে কথা বলেন যে, ওঁর কথা একটু দূর থেকে পরিষ্কার শোনা যায় না। আর আমি সারাক্ষণ চুপ করেই ছিলাম।”

“ধন্যবাদ। আপনি বলতে শুরু করুন,” হোমস বলল, তারপর সে চোখ বুজে বসে রইল।

“মামা যে রকমটি বলে দিয়েছিলেন, আমি সেই রকমই করলাম। সকলের চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার এক সহকর্মী আমার সঙ্গে একই ঘরে বসে। ওর নাম চার্লস গোরো। চার্লসের কিছু বকেয়া কাজ ছিল। ও সেই কাজগুলো সেরে ফেলছিল। ওর দেরি আছে দেখে আমি রাতের খাওয়াটা বাইরে থেকে সেরে আসতে গেলাম। আমি খাওয়াদাওয়া সেরে আপিসে ফিরে এসে দেখলাম যে, গোরো চলে গেছে। আমি কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে চাইছিলাম। আমি জানতাম যোসেফ লন্ডনে এসেছে। যোসেফ হচ্ছে মিঃ হ্যারিসন যার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় একটু আগেই হয়েছে। যোসেফ সেই দিনই ওকিং ফিরবে, এগারোটার ট্রেনে। আমি চাইছিলাম কাজটা সেরে ওর সঙ্গে একই গাড়িতে ফিরতে।

“চুক্তির বয়ানটা যখন পড়লাম তখন বুঝতে পারলাম যে মামা একটি কথাও বাড়িয়ে বলেননি। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ নথি। চুক্তির ভেতরের কথাটা ফাঁস না করে এটুকু বলতে পারি যে, ত্রিপাক্ষিক যে-বোঝাপড়া হচ্ছে তার সম্বন্ধে ইংল্যান্ড কী ভাবছে সেটাই এর মোদ্দা কথা। আর, একটা কথা হচ্ছে যে, যদি ফরাসি নৌবাহিনী ইটালির নৌবাহিনীর চাইতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ফরাসি নৌবাহিনীর প্রতিপত্তি বেড়ে গেলে, ইংল্যান্ড কী করবে? চুক্তির বেশির ভাগটাই নৌবাহিনীর বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় ভরতি। চুক্তির শেষে দু’পক্ষের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সই আছে। সবটা একবার পড়ে নিয়ে আমি দলিলটা নকল করতে বসে গেলাম।

“চুক্তিটা খুব বড়। ফরাসিতে লেখা। ছাব্বিশটা অনুচ্ছেদ আছে। আমি যতটা তাড়াতাড়ি পারি নকল করতে লাগলাম। ঘড়িতে যখন ন’টা বাজল তখন আমার মাত্র ন’টা অনুচ্ছেদ কপি করা হয়েছে। বুঝতে পারলাম যে, এগারোটার ট্রেন ধরা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। কেমন একটা ঝিমুনির ভাব আসছিল। সারাদিন বড় খাটাখাটনি গেছে। তার ওপর খাওয়াটাও বোধহয় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হল এক কাপ গরম কফি খেলে শরীর-মন দুই-ই তরতাজা হয়ে উঠবে। রাত্তিরে একজন কেয়ারটেকার আপিসের নীচের তলায় একটা ঘরে থাকে। ওর একটা স্পিরিট ল্যাম্প আছে। কেউ যদি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে তো তার দরকারমতো ওই কেয়ারটেকার স্পিরিট ল্যাম্প ধরিয়ে চা কিংবা কফি করে দেয়। আমি ঘণ্টা বাজিয়ে কেয়ারটেকারকে ডাকলাম।

“ঘণ্টা শুনে যে ঘরে ঢুকল তাকে দেখে তো আমি অবাক। একজন মহিলা! দেখতে যেমন মোটাসোটা, তেমনই রুক্ষ মুখচোখের ভাব। মহিলাটি অ্যাপ্রন পরেছিল। সে বলল, যে, সে কেয়ারটেকারের স্ত্রী। সে অফিসের ঘরগুলো সাফটাফ করে। আমি তাকে এক কাপ কফি করে আনতে বললাম।

“আমি আরও দুটো অনুচ্ছেদ কোনও রকমে লিখলাম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। হাত যেন চলতে চাইছে না। যা পড়ছি তার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ঘুম ছাড়াবার জন্যে আমি ঘরের ভেতর পায়চারি করতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ আগে কফি আনতে বলেছি। এতক্ষণেও কফি এল না দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এত দেরি হচ্ছে কেন? দরজা খুলে, ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। আমি যে-ঘরে কাজ করছিলাম সেখান থেকে টানা বারান্দা চলে গেছে। বারান্দায় আলো জ্বলছে। তবে মোটেই জোরালো আলো নয়। ঘর থেকে বাইরে যাবার ওই একটাই রাস্তা। টানা বারান্দাটা সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত চলে গেছে। কেয়ারটেকারের ঘর নীচের তলায়, সিঁড়ির পাশে। তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলে, তিনতলা আর একতলার মাঝামাঝি ছোট একটা ল্যান্ডিং। ল্যান্ডিং থেকে একটা বারান্দা সমকোণে বেরিয়ে গেছে। সেই বারান্দার একদম শেষে একটা ছোট সিঁড়ি আছে। বেয়ারা বা দরোয়ানরা এই সিঁড়ি দিয়ে বাইরে যায়। আর যে-সমস্ত কেরানিরা চার্লস স্ট্রিটের দিক থেকে আসেন তাঁরাও পথ সংক্ষেপ করবার জন্যে ওই সিঁড়িটা দিয়ে যাতায়াত করেন।

“আপনার বোঝার সুবিধের জন্য আমি একটা নকশা মতো করে রেখেছি।”

ফেলপ্‌সের হাত থেকে নকশাটা নিয়ে হোমস বলল, “ভালই করেছেন। তবে আপনার কথা থেকে আমি ছবিটা বুঝে গেছি।”

“এইবার যে-কথাটা বলছি সেটা কিন্তু আপনি খুব মন দিয়ে শুনুন। আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচের হল ঘরে নেমে গেলাম। দেখলাম কেয়ারটেকার তার খুপরিতে বসে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, স্পিরিট ল্যাম্পটা জ্বলছে। ল্যাম্পের ওপরে কেটলিতে জল ফুটছে, আর মাঝে মাঝে গরম জল কেটলির নল দিয়ে মেঝেতে পড়ছে। কেটলি থেকে এত জল মেঝেয় পড়ছে দেখে বুঝতে পারলাম জলটা অনেকক্ষণ ফুটে যাচ্ছে। আমি কেয়ারটেকারের কাঁধে হাত দিয়ে ওকে জাগাতে যাব এমন সময় ওর মাথার কাছে একটা ঘণ্টা টং করে বেজে উঠল। ঘণ্টার শব্দে চমকে গিয়ে কেয়ারটেকার ধড়মড় করে জেগে উঠল।

“আমাকে দেখে ভীষণ রকম আশ্চর্য হয়ে কেয়ারটেকার বলল, ‘মিঃ ফেলপ্‌স! আপনি?’

“‘আমি দেখতে এসেছিলাম যে, আমার কফিটা তৈরি হয়েছে কিনা।’

“‘আমি কেটলিটা স্পিরিট ল্যাম্পে চড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ তারপর ও বোকার মতো একবার আমার মুখের দিকে আর একবার ওর মাথার ওপরের ঘণ্টাটার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি লক্ষ করলাম ওর মুখের ভাবটা কেমন আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে।

“‘আপনি যদি স্যার এখানে ছিলেন তা হলে ঘণ্টাটা বাজাল কে?’ কেয়ারটেকার ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

“‘ঘণ্টা’? আমি বললাম। ‘এটা কীসের ঘণ্টা?’

“‘এটা স্যার আপনি যে-ঘরে কাজ করছিলেন, সেই ঘরের ঘণ্টা।’

“কেয়ারটেকারের কথা শুনে আমার মনে হল, একটা কনকনে ঠান্ডা হাত যেন আমার হৃৎপিণ্ডটা পিষে ফেলছে। যে-যরে আমি ওই একান্ত গোপনীয় অমূল্য দলিলটা ফেলে এসেছি, সে ঘরে তা হলে আর কেউ রয়েছে! আমি পাগলের মতো লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি টপকে বারান্দা পার হয়ে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম। বারান্দায় কেউ নেই। ঘরের ভেতরেও কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি নীচে যাবার আগে সব যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে। শুধু যে-ডেস্কে বসে আমি কাজ করছিলাম, সেই ডেস্কের ওপরে আমার দায়িত্বে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাগজটা রাখা ছিল, সেইটেই নেই। আমি যে-নকলটা করছিলাম সেটা রয়েছে। নেই, আসল চুক্তিটা নেই।”

হোমস চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। তারপর নিজের হাতদুটো জোরে ঘষতে ঘষতে বলল “এরপর আপনি কী করলেন?’

আমি বুঝলাম যে, ফেলপ্‌সের এই রহস্যে হোমস খুব মজে গেছে।

“আমি তক্ষুনি অনুমান করলাম যে, চোর নিশ্চয় ওই পাশের দরজা দিয়ে এসেছে। যদি চোর সদর দরজা দিয়ে আসত তা হলে তাকে আমি দেখতে পেতামই। ল্যান্ডিং থেকে ওই বারান্দাটা একদম রাইট অ্যাঙ্গেলে বা সমকোণে। সে কথা তো আপনাকে আগেই বলেছি।”

হোমস বলল, “আচ্ছা আপনি যে-ঘরে বসে এই দলিলটার কপি করছিলেন সেখানে কেউ লুকিয়ে ছিল না তো? কিংবা ধরুন বারান্দায়ও তো কেউ ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারত। বারান্দার আলো তো ছিল খুব কমজোরি।”

“না, তা একেবারেই অসম্ভব। ওই ঘরে বা বারান্দায় একটা ইঁদুর পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারে না। লুকোবার কোনও জায়গাই নেই।”

“ঠিক আছে। তারপর কী হল বলুন।”

“কেয়ারটেকার আমার চোখ-মুখের অবস্থা দেখেই বুঝেছিল যে, সাংঘাতির ধরনের কিছু একটা ঘটে গেছে। তাই আমার পেছন পেছন ও দৌড়োতে দৌড়োতে নেমে এল। আমরা চার্লস স্ট্রিটের দিকে যে-গেটটা আছে সেই দিকে ছুটলাম। দরজাটা বন্ধ ছিল বটে, তবে তালা লাগানো ছিল না। এক ধাক্কায় দরজা খুলে আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে যে, যখন আমরা চার্লস স্ট্রিটে পা দিলাম ঠিক তখনই কাছের কোনও একটা ঘড়িতে ঢং-ঢং করে তিন বার ঘণ্টা বাজল। তখন ঠিক পৌনে দশটা।” হোমস শার্টের কবজিতে লিখতে লিখতে বলল, “এটা একটা খুব দামি খবর।”

“চার দিক বেশ অন্ধকার হয়েছিল। একে আকাশে মেঘ করেছিল তার ওপর আবার ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। চার্লস স্ট্রিটে লোকজন নেই। গোটা রাস্তাটা খাঁ-খাঁ করছে। অথচ একটু দূরেই হোয়াইট হলে গাড়ি আর লোক যাতায়াতের শেষ নেই। আমরা খালি মাথায় ফুটপাত ধরে ছুটতে লাগলাম। বেশ খানিকটা দূরে এক জন পুলিশ কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল।

“আমি হাঁপাতে হাঁপাতে সেই কনস্টেবলকে বললাম, এখনই একটা চুরি হয়ে গেছে। ফরেন আপিস থেকে একটা অত্যন্ত দামি সরকারি কাগজ চুরি হয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে কাউকে যেতে দেখেছ কি’?”

“কনস্টেবল বলল, “আমি এখানে প্রায় মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে আছি। এই সময়ের মধ্যে এক জনই এই দিক দিয়ে গেছে। শালমুড়ি-দেওয়া মোটাসোটা এক বুড়ি।’

“কেয়ারটেকার বলল, ‘ওহ্‌! ওই বুড়ি আমার স্ত্রী। ওকে ছাড়া আর কাউকে যেতে দেখেননি?’

“‘নাহ্‌। আর কাউকে দেখিনি?’

“কেয়ারটেকার আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলল, তা হলে চোরটা নিশ্চয়ই ওই রাস্তা দিয়ে পালিয়েছে।’

“কিন্তু কেয়ারটেকারের কথায় আমার মন সায় দিল না। তা ছাড়া ও যে ভাবে আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল তাতে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল।

“আমি কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই বুড়ি কোন দিকে গেল?’

“‘আমি স্যার, সেটা ঠিক বলতে পারব না। আমি বুড়িকে যেতে দেখেছি। কোন দিকে গেছে তা তো লক্ষ করিনি। কেন না বুড়িকে দেখে আমার কোনও রকম সন্দেহ হয়নি। তবে মনে হয়েছিল যে, ওর বিশেষ তাড়া আছে।’

“‘কতক্ষণ আগে ওকে যেতে দেখেছ, কনস্টেবল?’

“‘এই তো। দু’-চার মিনিটও বোধহয় হয়নি।’

“‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে হবে?’

“‘পাঁচ মিনিটের বেশি কিছুতেই হবে না।’

“কেয়ারটেকার অস্থির ভাবে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘স্যার, আপনি অকারণ সময় নষ্ট করছেন। এখন প্রতিটি মিনিটই আমাদের কাছে খুব দামি। …আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমার স্ত্রী এ সমস্ত ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও জানে না। চলুন আমরা ওই দিকে যাই। আর আপনি যদি না যান তো আমিই যাচ্ছি।’

“আমার কথা শোনবার জন্যে অপেক্ষা না করেই কেয়ারটেকার উলটো দিকে পা চালাল। কিন্তু আমি ছুটে গিয়ে ওকে ধরে ফেললাম।

“আমি বললাম, ‘তুমি থাকো কোথায়?’

“‘ব্রিকস্টনে। আমার ঠিকানা ১৬ নং আইভি লেন। তবে মিঃ ফেলপ্‌স, মনগড়া একটা সন্দেহের পেছনে মিছিমিছি সময় নষ্ট করবেন না। তার চেয়ে চলুন আমরা বরং ওই দিকে যাই। ওখানে হয়তো কোনও খবর পাওয়া যেতেও পারে।’

“আমার মনে হল কেয়ারটেকারের কথা শুনলে কোনও ক্ষতি নেই। কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দু’জন হোয়াইট হলের দিকে গেলাম। রাস্তায় অবিরাম গাড়িঘোড়ার যাতায়াত। দু’দিকের ফুটপাত ধরে লোকের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির জন্যে সকলেরই বাড়ি ফেরার তাড়া খুব বেশি। ওখানে এমন কাউকে পাওয়া গেল না, যার কাছ থেকে আমাদের দরকারি খবর পাওয়া যেতে পারে।

“বাধ্য হয়ে আমরা আপিসে ফিরে এলাম। সিঁড়ি আর বারান্দা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। কিন্তু কোথায় কী? সিঁড়ির মুখ থেকে যে-টানা বারান্দাটা চলে গেছে সেটায় এক রকমের তেলতেলে লিনোলিয়ম পাতা। এই লিনোলিয়মের ওপর সহজেই জুতোর ছাপ পড়ে যায়। আমরা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিনোলিয়মটা দেখলাম। কিন্তু কোনও পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম না।”

“সে দিন কি সন্ধে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল?” হোমস জানতে চাইল।

“হ্যাঁ, সাতটা থেকে বৃষ্টি যে নেমেছিল তা তখনও থামেনি।”

“তা যদি হয় তো ন’টার সময়ে কেয়ারটেকারের স্ত্রী যখন আপনার ঘরে এসেছিল, তার পায়ের ছাপ মেঝেতে পড়ল না কেন?”

“কথাটা বলে আপনি ভালই করলেন। এটা আমার তখনই মনে হয়েছিল। এই ধরনের কাজের মেয়েরা রাস্তার জুতো কেয়ারটেকারের আপিসে খুলে ফেলে। তারপর ওরা চটি পরে কাজ করে।”

“এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। যদিও সন্ধে থেকে একটানা বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছিল, তা হলেও ঘরে বা বারান্দায় জলকাদার চিহ্নমাত্র ছিল না। ঘটনাগুলো পর পর যা ঘটেছে তাতে গোটা ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমার খুবই কৌতুহল হচ্ছে। তা এরপর আপনি কী করলেন?”

পার্সি ফেলপ্‌স একটু থেমে বললেন, “ঘরের মধ্যে কোনও গুপ্ত পথ বা লুকোনো দরজা নেই। রাস্তা থেকে ঘরের জানলা প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু। রাস্তার দিকে দুটো জানলা। দুটোই ভেতরের দিক থেকে শক্ত করে ছিটকিনি দেওয়া। মেঝে কার্পেট দিয়ে মোড়া। সুতরাং মেঝের কোনও অংশে লুকনো কোনও আসা-যাওয়ার পথও নেই। ঘরের ছাত আর দেওয়াল সাধারণ হোয়াইট ওয়াশ করা। আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি, যে আমার টেবিল থেকে ওই দলিল চুরি করেছে, সে দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকেছিল।”

“আচ্ছা আপনারা ফায়ার প্লেসটা দেখেছিলেন?”

“আমাদের আপিসে সেকেলে ফায়ার প্লেস আর নেই। সব ঘরেই স্টোভ। ঘণ্টা বাজাবার দড়িটা একটা তার থেকে ঝোলানো। যে-ডেস্কে বসে আমি কাজ করি ঘণ্টাটা’র দড়িটা তার ডান দিকে ঝোলানো থাকে। ঘন্টাটা যেই বাজাক না কেন, তাকে আমার ডেস্কের কাছে আসতে হয়েছিল। কিন্তু যে অপরাধী, সে খামোকা ঘণ্টা বাজাতে যাবে কেন? এটাই আমার কাছে সব চাইতে জটিল রহস্য বলে মনে হয়েছে।”

“তা যা বলেছেন। বেশ রহস্যজনক ব্যাপারই বটে। এরপর আপনারা কী করলেন? আপনারা নিশ্চয়ই ঘরটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে ছিলেন যদি কোথাও কোনও রকম হদিস পাওয়া যায়! একটা সিগারেটের টুকরো কি একটা দস্তানা বা চুলের কাঁটা, এই রকমই নেহাত তুচ্ছ ধরনের কোনও সূত্র খুঁজে পাবার চেষ্টা করেননি?”

“না, সে রকম কোনও কিছুই আমরা পাইনি।”

“কোনও রকম গন্ধও পাননি?”

“গন্ধের ব্যাপারটা অবশ্য আমাদের মনে হয়নি।”

“এই ধরনের রহস্যের তদন্তে সিগারেট কি পাইপের তামাকের বিশেষ গন্ধও আমাদের পক্ষে খুব দামি সূত্র হতে পারত।”

“আমি মিঃ হোমস, সিগারেট-টিগারেট খাই না। সুতরাং ঘরে যদি তামাকের গন্ধ থাকত নিশ্চয়ই তা আমার নাকে লাগত। কোনও রকম সুত্রই সেখানে আমরা খুঁজে পাইনি। একমাত্র ঘটনা যা তা হল যে, কেয়ারটেকারের স্ত্রী, ওর নাম মিসেস ট্যাঙি, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আপিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মিসেস ট্যাঙি যে কেন এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেল, সে ব্যাপারে ওর স্বামী মানে আমাদের কেয়ারটেকার কিছু বলতে পারেনি। কেয়ারটেকারকে যখন এই প্রশ্ন করা হয় তখন ও আমতা আমতা করে বলল যে, ওই সময়েই নাকি মিসেস ট্যাঙি বাড়ি ফেরে। কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম, কেয়ারটেকারের স্ত্রী-ই যদি ওই দলিলটা চুরি করে থাকে তবে সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে পাকড়াও করা উচিত। দলিলটা যাতে ওই মহিলা পাচার করতে না পারে।”

“খবরটা ইতিমধ্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পৌঁছে গিয়েছিল। ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ মিঃ ফরবস অকুস্থলে এসে পড়েছিলেন। তিনি এসেই কাজে নেমে পড়লেন। আমরা একটা গাড়ি ধরে আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের কাছে মিসেস ট্যাঙির যে-ঠিকানা ছিল, সেখানে পৌঁছে গেলাম। অল্পবয়সি একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। পরে জেনেছিলাম যে ওই মেয়েটি মিসেস ট্যাঙির বড় মেয়ে। না, ওর মা তখনও বাড়ি ফেরেনি। মেয়েটি আমাদের বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।

“মিনিট দশেক পরে দরজায় ঠক ঠক করে টোকা পড়ল। আর ঠিক তখনই আমরা বিরাট এক ভুল করলাম। আর তার জন্যে আমিই দায়ী। আমরা নিজেরা উঠে গিয়ে দরজা না খুলে ওই মেয়েটাকেই দরজা খুলতে দিলাম। আমরা শুনলাম যে, মেয়েটা ওর মাকে বলছে ‘বাইরের ঘরে দু’জন ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে বসে আছেন।’ তার পরেই শুনতে পেলাম সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে কারা যেন নেমে যাচ্ছে। ফরবস এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সেটা রান্নাঘর বলে মনে হল। বুড়ি আমাদের আগেই রান্নাঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। বুড়ি আমাদের দিকে তেড়ে আসার মতো করে এগিয়ে এল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যে, আমাদের ভস্মই করে ফেলবে বুঝি। আমাকে চিনতে পেরে বুড়ি খুব অবাক হয়ে গেল।

“‘মিঃ ফেলপ্‌স কী ব্যাপার?’

“ডিটেকটিভ ফরবস বললেন, ‘কাকে ভেবে তুমি পালাবার চেষ্টা করছিলে বলো তো?’

“‘আমি ভেবেছিলাম যে কোনও দালাল বুঝি। সম্প্রতি ক’টা দালাল বড় জ্বালাতন করছে।’

“ফরবস বললেন, ‘এটা কি বিশ্বাস করবার মতো একটা কথা হল? আমরা খবর পেয়েছি যে ফরেন আপিস থেকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাগজ তুমি সরিয়ে ফেলেছ। কাগজটা চালান করে দেবার জন্যে তুমি এখানে এসেছ। তোমাকে আমাদের সঙ্গে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড যেতে হবে। তোমাকে তল্লাশি করে দেখা হবে।’

“বুড়ি তো কিছুতেই আমাদের সঙ্গে আসবে না। সে যত রকম ভাবে পারল আপত্তি করতে লাগল। একটা গাড়ি ডেকে আমরা তিন জন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দিকে চললাম। যাবার আগে আমরা ঘরদোর ভাল করে দেখে নিলাম। কোথাও সেই দলিলটা পাওয়া গেল না। রান্নাঘরটা খুব ভাল করে দেখেছিলাম। সেখানেও নেই। রান্নাঘরে উনুন খোঁচাখুঁচি করে কোনও পোড়া কাগজের টুকরো বা ছাই পাওয়া গেল না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পোঁছে আমরা ওই বুড়িকে মেয়ে পুলিশদের জিম্মায় দিয়ে দিলাম। আমার সমস্ত শরীর তখন উত্তেজনায় থরথর করছে। মনের মধ্যে কী হয় কী হয় ভাব। সময় যেন আর কাটতে চাইছে না। খানিকক্ষণ পরে মেয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর জানালেন যে, বুড়িকে তল্লাশি করে কোনও কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।

“এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম, আমি কী বিপদেই না পড়েছি! এতক্ষণ আমি দৌড়োদৌড়ি করেছি। শারীরিক পরিশ্রম করার জন্যে মানসিক চিন্তাটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। বুড়িই যে কাগজটা চুরি করেছে এবং ওর কাছ থেকেই যে ওটা উদ্ধার করা যাবে, এ ব্যাপারে আমার মনে কোনও রকম সন্দেহ ছিল না। তাই যদি ওর কাছ থেকে কাগজটা না পাওয়া যায় তা হলে কী হবে, এ চিন্তাটা আমার মাথায় এক বারও আসেনি। কিন্তু এখন তো আর কিছু করবার নেই! স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চত্বরে দাঁড়িয়ে আমি আমার নিজের অবস্থাটা টের পেলাম। আমার সমূহ বিপদ। ওয়াটসন হয়তো আপনাকে বলেছে যে স্কুলে পড়বার সময় আমি খুব ভিতু ছিলাম। এটা আমার স্বভাব। আমার মামার কথা মনে পড়ল। মামার সঙ্গে যাঁরা মন্ত্রিসভায় কাজ করেন তাঁদের কথা মনে পড়ে গেল। বুঝতে পারলাম, কী বিরাট অপমানের বোঝা মামার মাথায় আমি চাপিয়ে দিয়েছি। শুধু মামার নয়, আমার সঙ্গে যাদের আত্মীয়তা আছে, যাদের পরিচয় আছে, তাদের প্রত্যেকের ওপরই আমি অপমানের বিরাট বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এতে আমার নিজের তো কোনও দোষ নেই। সব ঘটনাটাই একটা নিছক দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি যেখানে চাকরি করি সেখানে এ ধরনের দুর্ঘটনাকে কেউ ক্ষমা করে না। এটা আমার গাফিলতি বলেই মনে করা হবে। আমি একদম শেষ হয়ে গেলাম! লজ্জা আর অপমানের বোঝা বয়ে আমাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে! ওখানে যে আমি কী কাণ্ড করেছিলাম মনে নেই। নিশ্চয়ই চিৎকার চেঁচামেচি করে ছোটখাটো নাটক করে ফেলেছিলাম। আবছা যা মনে পড়ে তা হল, আমার চার পাশে অনেক অফিসার এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জন আমার সঙ্গে ওয়াটারলু স্টেশন পর্যন্ত এলেন। তিনি আমাকে ওকিংয়ের ট্রেনে চাপিয়ে দিলেন। কথা ছিল যে, তিনি ওকিং পর্যন্ত আমার সঙ্গে যাবেন। ওয়াটারলু স্টেশনে ডঃ ফেরিয়ারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ডঃ ফেরিয়ার আমার বাড়ির খুব কাছেই থাকেন। উনিও ওই ট্রেনে ফিরছিলেন। ডঃ ফেরিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভালই হয়। স্টেশনেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। বাড়িতে যখন এলাম তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না।

“অত রাত্রে ডঃ ফেরিয়ার যখন আমাকে নিয়ে এসে বাড়ির লোকজনকে ডেকে তুললেন, তখন বাড়ির লোকেরা অবাক হয়ে গেলেন। আমাকে দেখে তাঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। আমার মধ্যে পুরোদস্তুর পাগলামি প্রকাশ পাচ্ছে। অ্যানি আর আমার মা তো আমাকে দেখে একদম ভেঙে পড়লেন। ডঃ ফেরিয়ার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকের কাছে কী হয়েছে তা শুনে ছিলেন। তিনি সে কথা সকলকে বললেন। সেই কথা শুনে তো সকলের মনমেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। আমার অবস্থা দেখে সকলেই বুঝতে পারলেন যে, আমার অসুখ চট করে সারবে না। এই ঘরটায় যোসেফ শুয়েছিল। ওকে সেই রাতেই অন্য ঘরে চালান করে দেওয়া হল। আর এই ঘরটায় আমাকে রাখা হয়। এই ঘরে ন’সপ্তাহ আমি অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে ছিলাম। আমার ব্রেন ফিভার হয়েছিল। মিস হ্যারিসনের সেবা আর ডঃ ফেরিয়ারের চিকিৎসার গুণে আমি সেরে উঠে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। সারা দিন ধরে মিস হ্যারিসন আমার শুশ্রূষা করেছেন। আর রাতের জন্যে একজন নার্স রাখা হয়েছিল। কেন না পাগলামির ঝোঁকে আমি যে-কোনও কাজই করে ফেলতে পারতাম। আস্তে আস্তে আমি সেরে উঠলাম। পাগলামিটাও সেরে গেল। তিন-চার দিন হল আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমি সব কথা ঠিক ঠিক ভাবতেও পারছি এবং যা ঘটেছে সব মনে করতেও পারছি। এক এক বার অবশ্য মনে হচ্ছে যে, অসুখটা না সারলেই বোধহয় ভাল ছিল। সেরে উঠেই আমি ফরবসকে টেলিগ্রাম করলাম। কেন না এই চুরির ব্যাপারে তদন্ত করবার ভার পড়েছে ওঁর ওপর। আমার টেলিগ্রাম পেয়েই ফরবস চলে এলেন। উনি বললেন যে, সব রকম ভাবেই চোরকে ধরার এবং চোরাই মাল উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তবে এমন কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি যেটা দিয়ে এ ব্যাপারটার ফয়সালা করা সম্ভব হতে পারে। কেয়ারটেকার আর তার স্ত্রী-কে সব রকম ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও হদিসই পাওয়া যায়নি। এরপর পুলিশ গোরোকে সন্দেহ করে। আপনাদের মনে আছে বোধহয়, সেই রাত্রে গোরো অনেকক্ষণ আপিসে ছিল বকেয়া কাজ শেষ করে ফেলবার জন্যে। গোরোকে পুলিশের সন্দেহ করবার কারণ দুটো। এক নম্বর হল যে, সে দিন ও অনেক রাত পর্যন্ত আপিসে ছিল। আর দু’ নম্বর কারণ হল, ওর ফরাসি নাম। কিন্তু এ কথাটা ভুললে চলবে না, আমি চুক্তিটা নকল করতে শুরু করি গোরো চলে যাবার পরে, আগে নয়। তা ছাড়া গোরোর মধ্যে হিউগেনট বংশের রক্ত আছে বটে, তবে ও মনেপ্রাণে খাঁটি ইংরেজ। সুতরাং এই চুরির সঙ্গে গোরোর কোনও সম্পর্ক নেই। পুলিশও গোরোকে সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেল না। ব্যাপারটা ওইখানে ধামাচাপা পড়ে গেল। মিঃ হোমস, আপনিই আমার শেষ ভরসা। আপনি যদি এ রহস্যের সমাধান করতে না পারেন তো, আমার চাকরিই শুধু নয়, মানসম্মান সবই যাবে।”

অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে ফেলপ্‌স বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ও কেদারায় এলিয়ে পড়ল। মিস হ্যারিসন তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ওকে গেলাসে করে কোনও ওষুধ এনে দিলেন। হোমস তার চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে এমন ভাবে বসে ছিল যে, যাঁরা ওর স্বভাবচরিত্র জানেন না তাঁরা মনে করবেন ও বোধহয় ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আমি জানি যে ওর বাইরের এই গা-ছাড়া ভাবটা একটা খোলস। ও মনে মনে ভীষণ ভাবে সক্রিয়। এই ব্যাপারটা নিয়ে ও এখন গভীর ভাবে চিন্তা করছে।

বেশ খানিকক্ষণ পরে হোমস মুখ খুলল। “মিঃ ফেলপ্‌স, আপনি সব কথাই বেশ পরিষ্কার করে খুলে বলেছেন। আমার জিজ্ঞেস করবার বিশেষ কিছুই নেই। একটা মাত্র কথাই আমার জানবার আছে। সেটা কিন্তু খুব জরুরি কথা। আপনার ওপর যে এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে কথা কি আপনি কাউকে বলে ছিলেন?”

“কাউকে নয়।”

“এমনকী এই মিস হ্যারিসনকেও নয়?”

“না। কাজটার দায়িত্ব যখন আমাকে দেওয়া হয়, আর যখন আমি কাজটা শুরু করি, তার মাঝখানে আমি তো ওকিংয়ে আসিনি।”

“আপনার কোনও আত্মীয় বা বন্ধু আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আপনার আপিসে যায়নি?”

“কেউ যায়নি!”

“আপনার সঙ্গে দেখা করতে পরিচিত কেউ কখনও আপনার আপিসে যাননি?”

“হ্যাঁ। অনেকেই গেছে। তারা আমার আপিস চেনে। কোথায় আমি বসি তা জানে।”

“অবশ্য এ কথাটা আপনি যদি কাউকেই না বলে থাকেন তো, এসব প্রশ্ন করার কোনও মানে হয় না।”

“না, আমি কাউকেই বলিনি।”

“আচ্ছা, আপনাদের কেয়ারটেকারটির সম্বন্ধে আপনি কিছু বলতে পারেন?”

“না। ওর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। শুনেছি যে ও সেনাবাহিনীতে কাজ করত। রিটায়ার করার পর আমাদের আপিসে বহাল হয়েছে।”

“কোন রেজিমেন্টে ছিল জানেন কি?”

“হ্যাঁ। শুনেছি কোলড স্ট্রিম গার্ডসে ছিল।”

“ঠিক আছে। ফরবসের কাছ থেকে ওর হাড়হদ্দ সব জানা যাবে। আমাদের সরকারি পুলিশ খবরাখবর জোগাড় করতে পারে খুব ভাল। যেটা পারে না সেটা হল ওই খবরের থেকে খাঁটি কথাটা বের করে নিতে। …ওহ্, গোলাপের সত্যি তুলনা নেই। এর কাছে কিছুই লাগে না,” শার্লক হোমস বলল।

কথাটা শেষ করেই হোমস চেয়ার থেকে উঠে পড়ে খোলা জানলার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর জানলায় রাখা গোলাপফুলের হেলে পড়া ডাঁটিগুলোকে সাবধানে, আলতো করে তুলে ধরে তাদের সবুজ আর লাল রঙের অপূর্ব বাহারের দিকে তাকিয়ে রইল। হোমসের কাণ্ড দেখে আমি তো থ। ওর স্বভাবের এ দিকটা আমার একদমই অজানা। গাছপালা বা প্রকৃতির শোভা রসিয়ে উপভোগ করতে আমি অন্তত হোমসকে দেখিনি কোনও দিন।

বেশ কিছুক্ষণ গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকবার পর, জানলায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হোমস বলল, “ধর্মের ব্যাপারে যুক্তির ব্যবহার যত খাটে অন্য কোথাও বোধহয় এত খাটে না। ধর্মকে যুক্তির ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায়। অন্ততপক্ষে যে-লোক নির্ভুল ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে, তার পক্ষে এটা মোটেই কঠিন কাজ নয়। ঈশ্বরই বলুন আর যাই বলুন তাঁর যে ভালত্ব সেটা সবচাইতে বেশি ফুটে উঠেছে ফুলের সৌন্দর্যে। ফুলের দিকে তাকালে আমাদের মনে ভরসা হয়। মনে হয়, যিনি বিধাতা তিনি করুণাময়, আনন্দময়। পৃথিবীতে আর যা কিছু আছে সে সবই আমাদের প্রয়োজনের জন্যে। পৃথিবীর সব জিনিসই দরকারি। কোনওটা আমাদের খাবার জন্যে চাই। কোনওটা আমাদের চাহিদা মেটাবার জন্যে চাই। আবার কোনওটা চাই আমাদের শক্তি আর ক্ষমতার আস্ফালনের জন্যে। কিন্তু এই গোলাপফুল? এটা হচ্ছে উপরি পাওনা। এটা কোনও চাহিদা মেটাবার সামগ্রী নয়। এর যে সুগন্ধ সেটা আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় নয় ঠিকই, কিন্তু এই সুগন্ধ আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। যাঁর নিজের মধ্যে ভালত্ব আছে তিনি পারেন পাওনার ওপরে উপরি দিতে। তাই বলছি ফুলের দিকে তাকালে অনেক আশার আলো দেখতে পাওয়া যায়।”

হোমস যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন পার্সি ফেলপ্‌স আর মিস হ্যারিসন ওর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তবে ওদের চোখ-মুখের ভাব দেখে আমার বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ওরা মনে মনে রীতিমতো হতাশ হয়েছে। হয়তো বা একটু অবাকও হয়েছে। গোলাপফুলের দিকে তাকিয়ে হোমস এতই বিভোর হয়ে গেছে যে, আশপাশের কোনও কিছুর সম্বন্ধেই তার আর হুঁশ নেই। হোমসের এই ঘোরের ভাবটা হয়তো আরও চলত যদি না মিস হ্যারিসন বাধা দিতেন।

মিস হ্যারিসন বললেন, “মিঃ হোমস, আপনি কি মনে করেন যে, এই রহস্যের সমাধান আপনি করতে পারবেন?” মিস হ্যারিসন যে ভাবে কথাগুলো বললেন তাতে বুঝলাম, উনি হোমসের ব্যবহারে বেশ বিরক্ত হয়েছেন।

“ও, রহস্যের কথাটা!” মুহূর্তের মধ্যে চটকা ভেঙে হোমস আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। যে-চেয়ারে বসেছিল সেই চেয়ারটায় বসে পড়ে হোমস বলল, “সমস্যাটা যে খুবই জটিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবব। আর যদি কোনও কথা আমার মনে হয় তো আপনাদের তা জানাব।”

“আপনি কি কোনও সূত্র পেয়েছেন?”

“আপনাদের কথা থেকে আমি সাতটা সূত্র পেয়েছি। তবে এর মধ্যে কোন কোনটা দরকারি সেটা এক্ষুনি বলতে পারব না। প্রত্যেক সূত্রকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”

“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?”

“আমি নিজেকেই সন্দেহ করি।”

“কী বললেন?”

“যখন কোনও ব্যাপারে আমি তড়িঘড়ি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই!”

“তা হলে লন্ডনে ফিরে গিয়ে আপনার সূত্রগুলোকে খতিয়ে বিচার করুনগে।”

হোমস বলল, “ওয়াটসন, এখানে কিছু করার নেই। মিঃ ফেলপ্‌স আমি আপনাকে মিথ্যে আশা দিতে চাই না। ব্যাপারটা সত্যিই খুব ঘোরালো।”

পার্সি ফেলপ্‌স কাতর ভাবে বলল, “আপনার কাছ থেকে কোনও খবর না পাওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাব না।”

“আমি কালকে আবার হয়তো এই ট্রেনেই একবার আসব। তবে আপনি কোনও কিছুই আশা করবেন না। হয়তো আমি আপনার জন্যে কোনও ভাল খবরই আনতে পারব না।”

“ভগবান আপনার ভাল করুন। আপনি যে আবার আসবেন বলেছেন তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।” ফেলপ্‌স কথাগুলো এমন ভাবে বলল যে, বুঝলাম এ তার মনের কথা, মুখের কথা নয়। “এই ব্যাপারটার সম্বন্ধে কিছু করা হচ্ছে জানলে মন আর শরীরে বল পাই। …ভাল কথা, আমি লর্ড হোলডহার্স্টের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি।”

“তাই নাকি? উনি কী লিখেছেন?”

“চিঠিতে অবশ্য কড়া কথা কিছু লেখেননি। বোধহয় আমার মারাত্মক অসুখের কথা ভেবেই উনি চিঠিতে শক্ত কথা লেখেননি। তবে চিঠির ভাষা একটু কড়া। উনি লিখেছেন, ব্যাপারটা খুবই জরুরি। যতক্ষণ না আমি একদম সেরে উঠছি, আর আমার এই গাফিলতির জন্যে যে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটেছে তার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারছি, ততক্ষণ আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও আলোচনা হবে না। এর মানে তত দিন পর্যন্ত আমার চাকরিটা যাবে না।”

হোমস বলল, “ওঁদের দিক থেকে ওঁরা অবশ্য ঠিকই করেছেন। …চলো ওয়াটসন, যাওয়া যাক। লন্ডনে আমাদের বিস্তর কাজ পড়ে আছে।”

মিঃ যোসেফ হ্যারিসন গাড়ি করে আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমরা পোর্টস মাউথ থেকে আসা ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেন গড়গড়িয়ে লন্ডনের দিকে ছুটল। সারা পথটাই হোমস মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। ক্ল্যাপহ্যাম জংশন ছাড়াবার পর হোমস মুখ খুলল। “বুঝলে ওয়াটসন, এই লাইনে লন্ডনে ফিরলে মনটা আপনাআপনি খুশিতে ভরে যায়। দেখছ রেললাইনগুলো কত উঁচু দিয়ে গেছে। গাড়ির কামরা থেকে বাড়ির ছাত ছাড়িয়ে চোখের নজর চলে যায় বহু দূর।”

আমি ভাবলাম হোমস বুঝি ঠাট্টা করছে। কেন না চার পাশের দৃশ্য বলতে যা কিছু তা সবই অতি সাধারণ। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে হোমস তার কথাটা খুলে বলল। “ওই দূরে ছাড়া ছাড়া ওই বড় বড় বাড়িগুলোর দিকে দেখো। ওগুলো যেন চারপাশের বিস্তৃত সমুদ্রের মধ্যে কতকগুলো ইটের তৈরি দ্বীপ।”

“বোর্ডিং-স্কুলগুলোর কথা বলছ?”

“ওইগুলো স্কুল নয়, বাতিঘর। আমাদের ভবিষ্যতের আশা। এক একটা ক্যাপসুল, যার প্রত্যেকটার মধ্যে বেশ কয়েকশো করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা রয়েছে। এদের মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের ইংল্যান্ড। আমরা যা দেখছি তার চাইতে ঢের ভাল, মনে ও শরীরে ঢের সুস্থ ইংল্যান্ড। …ভাল কথা, ফেলপ্‌স লোকটি নেশাটেশা করে নাকি?”

“আমার মনে হয় না।”

“আমারও ধারণা তাই। তবে কী না এ ধরনের ব্যাপারে সব দিকটাই ভেবে রাখতে হয়। তোমার বন্ধু বেচারা গভীর গাড্ডায় পড়ে গেছে। তাকে ওই গাড্ডা থেকে টেনে ওপরে তোলা যাবে কিনা সন্দেহ। …মিস হ্যারিসনের সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা?”

“বেশ শক্ত ধাতের মহিলা বলেই তো মনে হল।”

“হ্যাঁ। ওর স্বভাবটিও বেশ ভাল বলে মনে হয়। তা না হলে বুঝব যে, আমার লোক চেনবার ক্ষমতা নেই। ওরা দুই ভাইবোন। ওদের বাবা নর্দাম্বারল্যান্ডের কাছাকাছি থাকেন। গত বছর কোথাও বেড়াতে গিয়ে ফেলপ্‌সের সঙ্গে ওদের আলাপ-পরিচয় হয়। তারপর ওদের বিয়ের কথাবার্তা হয়। ফেলপ্‌সের মায়ের কথায় মিস হ্যারিসন আর তাঁর ভাই এখানে বেড়াতে আসেন। আর ওই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। ফেলপ্‌সের সেবা করবার জন্যে মিস হ্যারিসনকে থেকে যেতে হল। আর সেই সুযোগে ওঁর ভাই যোসেফও জমিয়ে বসে গেলেন। খাচ্ছেনদাচ্ছেন আর তোফা আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তুমি দেখতেই পাচ্ছ যে, আমি আমার রহস্য অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দিয়েছি। তবে আজকের দিনটা কেবল খোঁজখবর করতে করতেই কেটে যাবে।”

আমি বললাম, “আমার প্র্যাকটিস—”

হোমস রীতিমতো মুখিয়ে উঠে বলল, “আমার এই রহস্যের মামলার চাইতে তোমার হাতে যে-কাজ রয়েছে, তা যদি বেশি ইন্টারেস্টিং হয় তো…”

হোমসকে শেষ করতে না দিয়ে আমি বললাম, “আমি বলতে চাইছিলাম যে এখন আমার হাতে সাংঘাতিক রকমের অসুস্থ রোগী নেই। তাই আমি দু’-এক দিন ডাক্তারি বন্ধ রাখতে পারি। …বছরের এই সময়টা আমাদের মন্দাই যায় বলতে পারো।”

খুশি হয়ে হোমস বলল, “চমৎকার! তা হলে আমরা দু’জনে মিলে এই রহস্যের জট খুলতে লেগে যাই। আমার মনে হয় আমাদের গোড়াতেই ফরবসের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। ফরবসের কাছ থেকে আমরা সব তথ্যই পেয়ে যাব। যতক্ষণ না সব তথ্য আমাদের হাতে আসছে, ততক্ষণ মামলাটা ঠিকমতো সাজাতে পারা যাবে না।”

“তুমি একটা সূত্র পেয়েছ বললে যে?”

“সত্যি কথা বলতে কী, একটা নয় অনেকগুলো সূত্র পেয়েছি। এখন খোঁজখবর করে জানতে হবে কোন সূত্রটা কাজে লাগবে, আর কোনটা লাগবে না। যে-সব অপরাধমূলক ঘটনার পিছনে কোনও উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না, সেই রহস্য ভেদ করা খুব শক্ত ব্যাপার। কিন্তু এই নথি চুরির ব্যাপারটা তো মোটেই উদ্দেশ্যহীন নয়! এই চুরি করে কার লাভ? অনেক লোকেরই লাভ হতে পারে। প্রথম কথা, ফরাসি রাষ্ট্রদূতের লাভ হবে। রুশ রাষ্ট্রদূতেরও লাভ হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যে নথিটা হাতিয়েছে সে যে-কোনও দেশের কাছেই এটা চড়া দামে বিক্রি করতে পারবে। তার ওপর লর্ড হোলডহার্স্টকেও বাদ দেওয়া যায় না!”

“লর্ড হোলডহার্স্ট!”

“দেখো ওয়াটসন, যে-কোনও কারণেই হোক অবস্থা হয়তো এমনই হয়েছিল যে, লর্ড হোলডহার্স্ট হয়তো চাইছিলেন ওই নথিটা কোনও ভাবে খোয়া যাক। রাজনীতির খেলায় সবই সম্ভব।”

“তা বলে লর্ড হোলডহার্স্টের মতো লোক এ কাজ করবেন? আজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে দলের লাোকেরাও তাঁর সম্বন্ধে কোনও খারাপ কথা বলেনি।”

“মানছি। কিন্তু এটাও হতে পারে। আর এটা যে হতে পারে সে কথাটা আমাদের ভুললে চলবে না। সবকিছুই হতে পারে এটা ধরে নিয়ে আমরা এগোব। যাই হোক, আজই আমরা এই মানী লোকটির সঙ্গে দেখা করব। দেখা যাক, লর্ড হোলডহার্স্ট আমাদের কোনও খবর দিতে পারেন কিনা! আমি অবশ্য ইতিমধ্যেই খোঁজখবর নেবার কাজ শুরু করে দিয়েছি।”

“এর মধ্যেই?”

“হ্যাঁ। ওকিং স্টেশন থেকে আমি লন্ডনের প্রত্যেকটি সান্ধ্য পত্রিকার আপিসে জরুরি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছি। একটা বিজ্ঞাপন প্রত্যেক কাগজের বিকেলের সংস্করণে ছাপা হবে।”

হোমস তার নোটবুক থেকে ছেঁড়া একটা পাতা আমার দিকে এগিয়ে দিল। ওই কাগজে পেনসিলে এই বিজ্ঞাপনটা লেখা:

“দশ পাউন্ড পুরস্কার। ২৩ মে তারিখে রাত পৌনে দশটা নাগাদ যে গাড়ির কোচোয়ান চার্লস স্ট্রিটে ফরেন আপিসের দরজায় বা ফরেন অফিসের কাছাকাছি কোনও সওয়ারিকে নামিয়ে দিয়েছে তার জন্যে নগদ দশ পাউন্ড পুরস্কার। যোগাযোগ করার ঠিকানা ২২১বি, বেকার স্ট্রিট।”

“তোমার কি বিশ্বাস যে, চোর গাড়ি করে এসেছিল?”

“যদি গাড়ি করে না এসে থাকে, তা হলেও ক্ষতি নেই। তবে মিঃ ফেলপ্‌সের কথা যদি ঠিক হয় যে, ওই ঘরের ভেতরে বা বারান্দায় লুকিয়ে থাকবার কোনও জায়গা নেই, তা হলে চোর অবশ্যই বাইরে থেকে এসেছিল। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, সে দিন সন্ধে থেকে বেশ জোর বৃষ্টি হয়েছিল অথচ ঘরের লিনোলিয়মের ওপর কোনও রকম ভিজে ছাপ পাওয়া যায়নি! ছাপ অবশ্যই নজরে পড়া উচিত ছিল। কেন না চুরি যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফেলপ্‌স আর কেয়ারটেকার ঘরে এসেছিল এবং ঘরের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করেছিল। এটাও যদি সত্যি হয় তা হলে চোর অবশ্যই গাড়ি করে এসেছিল। ওয়াটসন, আমি বলছি যে, চোর গাড়ি চেপে এসেছিল।”

“হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে।”

“এই একটা সূত্রের কথা আমি বলেছিলাম। এর থেকে আমরা হয়তো খানিকটা হদিস পেতে পারি। তারপর ধরো, ওই ঘণ্টা বেজে ওঠার ব্যাপারটা। এই রহস্যের সমাধানে ওই ঘণ্টাটার একটা বড় ভূমিকা আছে বলে আমার মনে হয়। ওই ঘণ্টাটা হঠাৎ বেজে উঠল কেন? চোর কি বাহাদুরি করে ঘণ্টাটা বাজিয়েছে? নাকি চোরের সঙ্গে এমন কেউ ছিল যে, এই চুরিটা বন্ধ করতে চেয়েছিল! নাকি হঠাৎই ঘণ্টাটা বাজানো হয়েছিল, সবটাই একটা অ্যাকসিডেন্ট! নাকি এটা একটা…?”

হোমস যেমন হঠাৎই কথা বলতে শুরু করেছিল তেমনি হঠাৎই চুপ করে গেল। গদিতে হেলান দিয়ে বসে হোমস গভীর ভাবে কী যেন ভাবতে লাগল। হোমসের হাবভাব সবই আমার জানা। বুঝতে পারলাম যে, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ নতুন কোনও ভাবনা ওর মনে দেখা দিয়েছে।

আমরা যখন ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে পৌঁছোলাম, তখন তিনটে বেজে কুড়ি হয়ে গেছে। স্টেশনেই কোনও রকমে চটপট নাকে-মুখে আমরা কিছু গুঁজে নিলাম। তার পরেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দিকে ছুটলাম। হোমস আগেই ফরবসকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল। ফরবস জানত যে, আমরা আসছি। ও তৈরি হয়েই ছিল। ছোটখাটো মানুষটি। দেখলেই শিয়ালের কথা মনে পড়ে। চোখ-মুখ বেশ ধারালো। তবে মুখ-চোখের ভাবটা এমনই যে, দেখলে যেচে আলাপ করতে ইচ্ছে হয় না। ফরবস আমাদের সঙ্গে বেশ খোলামেলা ভাবে মিশতে পারছিল না। কেমন যেন কাঠ কাঠ। আমরা কেন এসেছি শুনে ফরবস তো শামুকের মতো গুটিয়ে গেল।

“মিঃ হোমস, আপনার কাজকর্মের খবর আমি কিছু কিছু শুনেছি,” ফরবস বেশ রাগ রাগ গলায় বলল। “পুলিশের কাছ থেকে সব কথা জেনে নিয়ে আপনি রহস্যের সমাধান করে ফেলেন। আর পুলিশের বদনাম হয়। লোকে ভাবে পুলিশ কিছুই করতে পারে না।”

হোমস বলল, “সত্যি কথা বলতে গেলে ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক উলটো। আমি শেষ যে তিপ্পান্নটি রহস্য ভেদ করেছি তার মাত্র চারটে কেসে আমার নাম ছিল। উনপঞ্চাশটা রহস্যের সমাধান করার বাহাদুরি পুলিশের লোকই পেয়েছে। এ কথাটা তুমি জানো না বলে তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। তোমার বয়স কম। অভিজ্ঞতাও কম। কিন্তু যদি তুমি তোমার এই নতুন চাকরিতে উন্নতি করতে চাও তো আমার সঙ্গে থেকো। আমার সঙ্গে আড়াআড়ি কোরো না।”

হোমসের কথা শুনে ফরবস একটু যেন নরম হল। “আপনি যদি আমাকে দু’-একটা ‘টিপস’ দিয়ে দেন তো খুব ভাল হয়। আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি যে, এখন পর্যন্ত এই রহস্যের মাথামুন্ডু কিছুই ধরতে পারিনি।”

“তো তুমি অনুসন্ধানের ব্যাপারে কতদূর কী করেছ?”

“কেয়ারটেকার ট্যাঙিকে আমাদের লোক নজরে রেখেছে। ট্যাঙি গার্ডস থেকে অবসর নিয়েছে। ওর কাজের রেকর্ড খুব ভাল। ওর স্বভাবচরিত্রও বেশ ভাল। ওর সম্বন্ধে কোনও খারাপ কথা আমরা শুনিনি। তবে ওর স্ত্রী মোটেই সুবিধের নয়। দুষ্টু প্রকৃতির। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই নথি চুরির ব্যাপারে মিসেস ট্যাঙি অনেক কথাই জানে। ভাঙছে না।

“তুমি কি ওর পেছনে কোনও লোককে লাগিয়েছ?”

“হ্যাঁ, একজন মেয়ে পুলিশকে ওর ওপরে নজর রাখতে বলেছি। মিসেস ট্যাঙি নেশাটেশা করেন। উনি যখন নেশা করে বেসামাল অবস্থায় ছিলেন, তখন আমাদের ওই মেয়ে পুলিশটি ওঁর কাছে গিয়ে ভাব জমায়। কিন্তু কোনও কথাই বের করতে পারেনি।”

“আমি শুনছিলাম যে ট্যাঙিদের বাড়িতে পাওনাদারের যাতায়াত শুরু হয়েছিল।”

“ঠিকই শুনেছেন। ওদের টাকা বাকি পড়েছিল। ওরা টাকা মিটিয়ে দিয়েছে।”

“টাকাটা ওরা কোথা থেকে পেল?”

“টাকার সম্বন্ধে কোনও গোলমাল নেই। মিঃ ট্যাঙির পেনশনের টাকা পাওনা ছিল। ওদের হাতে যে হঠাৎ অনেক টাকা এসে গেছে এ রকম কোনও প্রমাণ নেই।”

“মিঃ ফেলপ্‌স যখন কফি আনতে বলবার জন্যে ঘণ্টা বাজিয়ে ছিলেন তখন ওর স্বামী না এসে ও এসেছিল। কিন্তু ও কেন এসেছিল? এ ব্যাপারে ও কী বলে?”

“ও যা বলছে তা হল এই যে, ওর স্বামী তখন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। স্বামীর কাজ একটু হালকা করে দেবার জন্যে ও এসেছিল।”

“এ কথাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে। কেন না এর একটু পরেই মিঃ ফেলপ্‌স গিয়ে দেখেন যে, কেয়ারটেকার নিজের চেয়ারে বসে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তা হলে ওদের সন্দেহ করবার কোনও কারণ নেই। একমাত্র যেটা চিন্তার কথা সেটা হল, ওই স্ত্রীলোকটি একটু গোলমেলে ধরনের মানুষ। আচ্ছা, সেই রাত্রে মিসেস ট্যাঙি অত তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল কেন এ কথা কি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে? ওর ওই পালানোর ভঙ্গি দেখেই কনস্টেবল ওকে সন্দেহ করেছিল।”

“সে দিন ওর বাড়ি ফিরতে অন্য দিনের থেকে দেরি হয়েছিল। তাই ও তাড়াতাড়ি করছিল।”

“তুমি আর মিঃ ফেলপ্‌স ও চলে যাবার অন্তত কুড়ি মিনিট পরে ওকে ধাওয়া করেছিলে। ওর যদি সত্যিই বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল তা হলে তোমরা ওর আগেই ওর বাড়িতে পৌঁছে গেলে কী করে? এ নিয়ে তুমি কি মিসেস ট্যাঙিকে প্রশ্ন করেছিলে?”

“হ্যাঁ। ও বলছে যে, ও বাসে গিয়েছিল আর আমরা গাড়িতে। তাই আমরা আগে আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম।”

“বেশ তা না হয় হল। কিন্তু বাড়ি পৌঁছেই ও সাততাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে ছুটেছিল কেন?”

“পাওনাদারদের দেবার জন্যে আলাদা করে রেখে দেওয়া টাকাটা নাকি ওই রান্নাঘরে ছিল।”

“ওর দেখছি সব প্রশ্নের জবাবই তৈরি আছে। ফরেন আপিস থেকে বেরোবার পরে চার্লস স্ট্রিটে ওর সঙ্গে কি কোনও লোকের দেখা হয়েছিল? কোনও লোককে কি ও ওই জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল?”

“না। পুলিশ কনস্টেবল ছাড়া সে দিন সে সময় ওই জায়গায় ও আর কাউকেই দেখতে পায়নি।”

হোমস বলল, “বেশ। তুমি তো দেখছি মিসেস ট্যাঙিকে খুব ভালমতেই জেরা করেছ। এ ছাড়া আর কী করেছ?”

“গোরো বলে যে-কেরানিটি সে দিন ওই ঘরে অনেক রাত অবধি ছিল তাকে গত ন’সপ্তাহ ধরে আমরা ছায়ার মতো অনুসরণ করেছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ও যে এই ব্যাপারটার সঙ্গে যুক্ত তা মনে করবার মতো কোনও কিছুই জানা যায়নি।

“এ ছাড়া আর কিছু?”

“নাহ্। আমাদের হাতে তো কোনও সূত্রই নেই যেটাকে ধরে এগোতে পারি। কোনও সাক্ষী, কোনও প্রমাণ, কিছুই নেই।”

“আচ্ছা আর একটা কথা। ঘরের ঘণ্টাটা বেজে উঠল কেন? কে বাজাল? কেন বাজাল? এ নিয়ে তুমি কিছু ভেবেছ কি?”

“আপনার কাছে অকপটে স্বীকার করছি যে, ওই ঘণ্টা বাজার কোনও রকম ব্যাখ্যাই আমি করতে পারছি না। যে-ই ঘণ্টাটা বাজিয়ে থাকুক, সে খুব সাংঘাতিক লোক। ওই ভাবে ঘণ্টা বাজিয়ে লোককে জানান দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।”

“এটা খুবই অদ্ভুত কাণ্ড বটে। ঠিক আছে, আজ উঠি। তুমি যে সব কথা আমাকে খুলে বললে এর জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার আসামির যদি হদিস করতে পারি তো অবশ্যই তোমাকে জানাব। চলো ওয়াটসন, এখন যাওয়া যাক।”

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আমি হোমসকে বললাম, “এখন যাবে কোথায়?”

হোমস বলল, “এখন আমরা ক্যাবিনেট মন্ত্রী, যিনি ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে সাধারণ লোকের ধারণা, সেই লর্ড হোলডহার্স্টের সঙ্গে দেখা করতে যাব।”

আমাদের বরাত ভাল বলতে হবে। লর্ড হোলডহার্স্ট তখনও ডাউনিং স্ট্রিটে তাঁর আপিসে ছিলেন। হোমস তার নামের কার্ড পাঠিয়ে দিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ডাক পড়ল। আমাদের দেখেই লর্ড হোলডহার্স্ট এগিয়ে এলেন। আমি শুনেছিলাম যে, লর্ড হোলডহার্স্টের ব্যবহার নাকি অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত। সেই পুরনো দিনের খাঁটি ইংরেজি ভদ্রতা, যা এখন প্রায় উঠে যেতে বসেছে, তার পরিচয় লর্ড হোলডহার্স্টের আচারব্যবহারে পাওয়া যায়। কথাটা দেখলাম অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। লর্ড আমাদের ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা দুটো চেয়ারে বসতে দিলেন। সাজানো-গোছানো ঘর। লর্ড হোলডহার্স্টের চেহারাটি নজরে পড়ার মতো। রোগা, লম্বা। মুখ-চোখ চোখা চোখা। মুখ দেখলে মনে হয়, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। রগের দু’পাশের কোঁকড়া চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। লর্ড হোলডহার্স্টকে দেখে সেই প্রাচীন যুগের অভিজাত বংশের লোকেদের কথা মনে পড়ে যায়, যাঁরা স্বভাবে ও প্রকৃতিতে সত্যিই বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

হোলর্ডহার্স্ট সামান্য হেসে বললেন, “মিঃ হোমস, আপনার নাম আমি অনেক শুনেছি। আর আপনি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, তাও বুঝতে পারছি। আপনার নজরে পড়বার মতো একটা ঘটনাই তো এই দফতরে ঘটেছে। আপনি কার হয়ে এই ব্যাপারে তদন্ত করছেন বলতে কোনও আপত্তি আছে কি?”

হোমস বলল, “আমি পার্সি ফেলপ্‌সের পক্ষে তদন্ত শুরু করেছি।”

“ও। আমার ভাগনে। বেচারা! আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, ওর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা থাকার জন্যেই, ওর হয়ে কোনও কথা বলা বা ওকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাওয়া আমার পক্ষে কত শক্ত। আমার ভাবতে খারাপ লাগছে, এই ব্যাপারটার জন্যে ওর চাকরির ভবিষ্যৎ বোধহয় নষ্ট হয়ে গেল।”

“কিন্তু সেই চুক্তিপত্র বা নথিটা যদি ফেরত পাওয়া যায়?”

“তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। ওর কোনও ভয় থাকবে না।”

হোমস বলল, “লর্ড হোলডহার্স্ট, আপনার কাছে আমার দু’-একটা কথা জানবার ছিল।”

“আপনাকে আমার এক্তিয়ারের মধ্যে যা আছে তা বলতে আমার কোনও আপত্তি নেই।”

“এই ঘরেই কি আপনি আপনার ভাগনেকে ডেকে ওই চুক্তিটা নকল করবার কথা বলে ছিলেন?”

“হ্যাঁ, এই ঘরেই বলেছিলাম।”

“আপনাদের কথাবার্তা কেউ আড়ি পেতে শুনতে পায়নি তো?”

“না। তার কোনও সুযোগই নেই।”

“ওই চুক্তিটা যে নকল করতে দিচ্ছেন বা নকল করাবার কথা ভাবছেন, এ কথা কি আপনি কাউকে বলে ছিলেন?”

“নাহ্, এ কথা কাউকেই বলিনি।”

“আপনি কি নিশ্চিত ভাবে এ কথা বলতে পারেন?”

“অবশ্যই।”

“হুম। আপনি বলছেন যে, চুক্তিটা নকল করাবার কথা আপনি কাউকেই বলেননি। মিঃ ফেলপ্‌স বলছেন যে, তিনিও এ কথা কাউকে বলেননি। আপনারা দু’জন ছাড়া এ কথা কেউই জানত না। তা হলে চোরের ওই সময়ে ওই ঘরে যাওয়াটা একেবারেই যাকে বলে কাকতালীয় ঘটনা। সুযোগ পেয়েই চোর চুক্তিটা চুরি করে নিয়ে পালায়।”

লর্ড হোলডহার্স্ট হেসে বললেন, “এ ব্যাপার তো আমার এক্তিয়ারের বাইরে। তাই আমি কিছুই বলতে পারব না।”

হোমস খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তাপর বলল, “আর একটা কথা আপনার কাছে জানা দরকার। আমি যতদূর শুনেছি তাতে আপনি বলে ছিলেন যে, এ চুক্তির কথা যদি কোনও ভাবে ফাঁস হয়ে যায়, তো সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে।”

মুহূর্তের জন্যে লর্ড হোলডহার্স্টের মুখটা ভীষণ গম্ভীর হয়ে উঠল। খুব আস্তে আস্তে তিনি বললেন, “খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটবে!”

“সে রকম কিছু ঘটেছে কি?”

“এখনও পর্যন্ত নয়।”

“ধরুন, চুক্তির নকলটা যদি ফরাসি বা রুশ রাষ্ট্রদূতের হাতে গিয়ে পড়ত তা হলে সে খবর আপনার কানে আসত কি?”

মুখটা অত্যন্ত গম্ভীর করে লর্ড হোলডহার্স্ট বললেন, “আমার কানে তো কথাটা আসা উচিত।”

“প্রায় দশ সপ্তাহ হয়ে গেল চুক্তির নকলটা চুরি গেছে। এখনও পর্যন্ত কোনও তরফ থেকেই ওই চুক্তির ব্যাপারে কোনও কথা শোনা যায়নি। সুতরাং এ কথাটা অনুমান করা যায় যে, ওই নকল চুক্তিটা শত্রুপক্ষের হাতে বা কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে পড়েনি,” হোমস বলল।

হোলডহার্স্ট খানিকটা হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “মিঃ হোমস, যে-লোকই এই চুক্তির নকলটা চুরি করে থাকুক না কেন, সে নিশ্চয়ই এটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘরের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখবে বলে চুরি করেনি।”

“হয়তো সে আরও বেশি দাম পাবে বলে আশা করছে।”

“যদি সে বেশি দাম পাবার জন্যে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করে তা হলে শেষ পর্যন্ত একটি পয়সাও পাবে না। আর কয়েকমাস পরে এই চুক্তির কথা প্রকাশ করা হবে সরকারি ভাবে।”

“এটা একটা খুব দামি খবর বটে,” হোমস বলল। “এটাও হতে পারে যে, চোর হয়তো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

হোমসের দিকে তাকিয়ে লর্ড হোলডহার্স্ট বললেন, “ব্রেন ফিভার জাতীয় অসুখ?”

হোমস একটুও না ঘাবড়ে বলল, “আমি তো সে কথা বলিনি। আচ্ছা লর্ড হোলডহার্স্ট, আপনার অনেক সময় নষ্ট করে গেলাম, আমরা এখন উঠব। বিদায়।”

আমাদের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু মাথা ঝুঁকিয়ে লর্ড হোলডহার্স্ট বললেন, “আমি চাই যে, এই রহস্যের সমাধান আপনি করুন। চোর যে-ই হোক না কেন, সে যেন ধরা পড়ে।”

আমরা উঠে পড়লাম। হোয়াইট হল থেকে বেরিয়ে এসে হোমস বলল, “চমৎকার লোক। কিন্তু নিজের পজিশন ঠিক রাখবার জন্যে ভদ্রলোককে দারুণ ভাবে লড়ে যেতে হচ্ছে। ভদ্রলোকের পয়সাকড়ির টানাটানি চলেছে, কিন্তু খরচাপত্তর প্রচুর। তুমি দেখেছিলে নিশ্চয়ই যে, ওর জুতোর তলায় সুকতলা লাগানো। ওয়াটসন, তোমাকে আর আটকাব না। তোমার হাতে যে কাজগুলো আছে সেগুলো তুমি সেরে ফেলো। যতক্ষণ না গাড়ির কোনও উত্তর আসছে ততক্ষণ আজ আর কিছু করবার নেই। কিন্তু কাল সকালে তুমি যদি আসতে পারো তো বড় ভাল হয়। কাল একবার ওকিং যাব। আজ যে-ট্রেনে গিয়েছিলাম সেই ট্রেনেই যাব।”

হোমসের কথামতো আমি পরের দিন ওর কাছে গেলাম। আমরা ওকিং যাবার জন্যে ট্রেন ধরলাম। হোমসের বিজ্ঞাপনের কোনও উত্তর আসেনি। এই মামলার ফয়সালার নতুন কোনও সংবাদও পাওয়া যায়নি। হোমস ইচ্ছে করলেই তার মুখের চেহারাটা রেড ইন্ডিয়ানদের মতো করতে পারে। কোনও রকম বিকার নেই। একদম ভাবলেশহীন। হোমসের মুখ দেখে আমি ধরতে পারলাম না যে, চুক্তি চুরির মামলায় অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে হোমস খুশি না দুঃখিত। সারা রাস্তা হোমস বেরতিলঁ পদ্ধতিতে মাপের সুবিধে নিয়ে কথা বলতে লাগল। এই ফরাসি পণ্ডিতের সম্বন্ধে হোমস ভীষণ ভাল ভাল কথা বলতে লাগল।

আমরা যখন পার্সি ফেলপ্‌সের সঙ্গে দেখা করলাম, তখনও মিস হ্যারিসন ওর কাছেই ছিলেন। তবে আজকে পার্সিকে অনেক চাঙ্গা দেখাচ্ছিল। আমরা ঘরে ঢুকতেই ফেলপ্‌স নিজেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করল।

“কোনও খবর আছে নাকি?” ফেলপ্‌স উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আমি আপনাকে যে রকম বলেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে। আমি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলতে পারছি না। আমি ইন্সপেক্টর ফরবসের সঙ্গে দেখা করেছি। আপনার মামার সঙ্গেও দেখা করে কথাবার্তা বলেছি। আমি ছোটখাটো দু’-একটা খবর জোগাড় করবার জন্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছি। এই খবরগুলো পেলেই আমি আপনাকে এই তদন্তের ফলাফল সম্বন্ধে কথা দিতে পারব।”

“তা হলে আপনি হাল ছেড়ে দেননি?”

“মোটেই নয়।”

“যে-কথা আপনি শোনালেন তার জন্যে ভগবান আপনার অবশ্যই ভাল করবেন,” মিস হ্যারিসন বললেন।

“যদি আমরা আমাদের সাহস আর ধৈর্য বজায় রাখতে পারি তা হলে যা সত্যি তা বেরিয়ে পড়বেই,” হোমস বলল।

ফেলপ্‌স তার সোফায় বসে পড়ে বলল, “আপনি আমাদের যা শোনালেন তার চাইতে কিছু বেশি খবর আমরাই বোধহয় আপনাদের শোনাতে পারি।”

“আপনি আমাকে আরও কিছু বলতে পারবেন বলেই আমার ধারণা ছিল।”

“গতকাল রাত্রে এখানে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাটা সাংঘাতিক হতে পারত।”

লক্ষ করলাম কথাগুলো বলতে বলতে ফেলপ্‌সের মুখ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর হঠাৎই তার চোখ-মুখের ভাব এমন হয়ে গেল যে, মনে হল ফেলপ্‌স খুব ভয় পেয়ে গেছে। “জানেন মিঃ হোমস, আমার কেমন ধারণা হচ্ছে যে, আমি বোধহয় নিজের অজান্তেই কোনও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হয়ে উঠছি। আর যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তারা আমার মান-সম্মানই নষ্ট করতে চায় না, আমাকে প্রাণেও মারতে চায়!”

হোমস বলল, “আহ-হা।”

“আপনি হয়তো আমার কথাটা বিশ্বাস করবেন না তবু আমি খুব জোর গলায় বলছি যে, আমার কোনও শত্রু নেই। কিন্তু কাল রাত্তিরের ঘটনার কথা চিন্তা করে আমার যা মনে হয়েছে তাই আপনাকে বললাম।”

“ব্যাপারটা খুলে বলুন।”

“বহু দিন পরে কালই আমি রাত্তিরে একা শুয়ে ছিলাম। এত দিন পর্যন্ত আমার ঘরে রাত্তিরবেলায় একজন নার্স থাকতেন। কালকে শরীরটা বেশ ভাল লাগছিল। তাই রাত্তিরের নার্সকে ছুটি দিয়েছিলাম। ঘরে অবশ্য একটা কমজোরি আলো জ্বলছিল। রাত দুটো নাগাদ আমার ঘুম ভেঙে গেল। একটা চাপা শব্দ শুনলাম। শরীর অসুস্থ বলে ঘুমটা আমার এখন বেশ পাতলাই। ইঁদুর কাঠ কাটলে যে রকম শব্দ হয়, ওই শব্দটাও ঠিক তেমনই। ঘরের বাইরে ইঁদুরে কাঠ কাটছে মনে করে আমি শুয়ে শুয়ে সেই শব্দ শুনতে লাগলাম। আস্তে আস্তে শব্দটা বেশ জোরে হতে লাগল। তারপর হঠাৎ এক সময় জানলার কাছে বেশ জোরেই একটা খট করে শব্দ হল। রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে আমি বিছানার ওপরে উঠে বসলাম। শব্দটা কেন হচ্ছে আর কোথা থেকে হচ্ছে তা বুঝতে আমার ভুল হল না। ওই শব্দটা আর কিছু নয়, কেউ জানলার শার্সির ফাঁক দিয়ে ধারালো কোনও কিছু ঢোকাবার চেষ্টা করছিল। খট করে শব্দটা হল জানলার ছিটকিনি থেকে। ছিটকিনিটা খুলে গেল।

“এরপর মিনিট-দশেক সব চুপচাপ। আর কোনও শব্দ নেই। আমার মনে হল লোকটা বোধহয় ওই শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেছে কিনা সেটা বুঝতে চেষ্টা করছে। তারও বেশ খানিকক্ষণ পর একটা কিচকিচ শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর দেখলাম আস্তে আস্তে জানলাটা খুলে যাচ্ছে। অসুখের জন্যে আমার মনটাও বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে জানলাটা খুলে দিলাম। জানলার নীচে একটা লোক গুঁড়ি মেরে বসে ছিল। জানলাটা খোলবার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা পালিয়ে গেল। আমি তাকে একনজর দেখতে পেয়েছিলাম। লোকটা একটা অদ্ভুত ধরনের ঢিলে জামা পরে ছিল। আর তার মুখের দিকটা ঢাকা ছিল। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। লোকটার হাতে একটা অস্ত্র ছিল। আমার মনে হল জিনিসটা একটা লম্বা ছুরি। লোকটা যখন দৌড়ে পালাচ্ছিল, তখন ছুরিটা চকচক করছিল।”

“খুবই অদ্ভুত ব্যাপার বটে,” হোমস বলল। “তারপর কী হল?”

“আমার যদি শরীরে কুলোত তো আমি ওই লোকটার পেছন পেছন ছুটতাম। কিন্তু তা পারলাম না। তাই আমি ঘণ্টা বাজিয়ে বাড়ির লোকজনদের ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘণ্টাটা রান্নাঘরে বাজে। বাড়ির কাজের লোকেরা ওপর তলায় থাকে। তাই ঘণ্টা বাজিয়ে তাদের ঘুম ভাঙানো শক্ত। আমি তাই চেঁচাতে লাগলাম। আমার চেঁচামেচি শুনে যোসেফ এল। তারপর যোসেফ আর সকলকে জাগাল। যোসেফ আমাদের কোচোয়ানকে নিয়ে বাগানে গেল। আমার ঘরের জানলার ধারে ফুলগাছের ঝাড়ের কাছে অস্পষ্ট কিছু পায়ের ছাপ ওরা দেখেছে। তবে ক’দিন বৃষ্টি না হওয়ায় জমি বেশ শুকনো। তাই ঘাসের ওপর কোনও পায়ের ছাপটাপ পাওয়া যায়নি। তবে বড় রাস্তা বরাবর আমাদের বাগানের কাঠের বেড়ার একটা জায়গা সামান্য ভেঙে গেছে। মনে হয়, কেউ লাফাতে গিয়ে ওখানকার কাঠের পাটাটা ভেঙেছে। এখানকার পুলিশকে এসব কথা আমি এখনও বলিনি। আমার মনে হয়েছিল যে, এসব কথা আপনাকে না জানিয়ে, আপনার পরামর্শ না শুনে কাউকে বলা বোধহয় ঠিক হবে না।”

পার্সির এই অভিজ্ঞতার কথা শুনে হোমস ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে ঘরের মধ্যে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগল। বুঝতে পারলাম যে, সে কোনও ভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছে না।

পার্সিকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কালকের রাতের ঘটনায় সে বেশ ভয় পেয়ে গেছে। তবুও জোর করে হাসবার চেষ্টা করে বলল, “দুর্ভাগ্য কখনও একা আসে না।”

হোমস বলল, “হ্যাঁ, আপনার সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে বটে। আপনি কি আমার সঙ্গে বাগানে গিয়ে একটু বেড়িয়ে আসতে পারবেন?”

“খুব পারব। রোদ্দুরে বেড়িয়ে এলে আমার খুব ভাল লাগবে। যোসেফও আমাদের সঙ্গে আসবে।”

মিস হ্যারিসন বললেন, “আমিও যাব।”

হোমস আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল, “না, তা হবে না। আমি চাই যে, আপনি যেখানে আছেন ঠিক সেইখানটিতেই বসে থাকুন।

হোমসের কথায় মিস হ্যারিসন চটে গেছেন বোঝা গেল। ওঁর ভাই যোসেফ অবশ্য আমাদের সঙ্গে এল। আমরা চার জনে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা লন পেরিয়ে পার্সি যে-ঘরে থাকে, সেই ঘরের জানলার কাছে গেলাম। পার্সি যেরকম বলেছিল ফুল গাছের কাছে কয়েকটা দাগ রয়েছে তা এত অস্পষ্ট আর জ্যাবড়ামতো যে, তার থেকে কিছুই বোঝা যায় না। হোমস একবার হাঁটু গেড়ে বসে দাগগুলো দেখে নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর হতাশ ভাবে কাঁধ নাচাল।

হোমস বলল, “নাহ, এই দাগ থেকে কেউ কিছু বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না। চলুন, চার পাশটা ঘুরে আসি। বোঝবার চেষ্টা করা যাক, কেন চোর এই ঘরটাতে চুরি করতে এসেছিল। আমার তো মনে হচ্ছে যে, চোরের বাড়ির ভেতরে ঢোকবার পক্ষে খাবার ঘরটাই ভাল ছিল। ও ঘরের জানলাগুলোও বেশ বড় বড় আর ওখানে চট করে কারও নজরে পড়বার ভয় নেই। তার চেয়ে বড় কথা, ও ঘরে চুরি করবার মতো জিনিস অনেক আছে।”

যোসেফ হ্যারিসন বলল, “ও ঘরটা রাস্তা থেকে দেখা যায় বলে বোধহয় চোর ও ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেনি।”

“ও! তা অবশ্য হতে পারে। এখানে তো একটা দরজা রয়েছে দেখছি। চোরটা তো এ দরজা দিয়েও ভেতরে ঢোকবার চেষ্টা করতে পারত,” হোমস বলল, “এ দরজাটা কীসের জন্যে?”

“এটা লোকজন আর ফেরিওয়ালাদের যাবার রাস্তা। রাত্তিরবেলা দরজাটা তালা দেওয়া থাকে।”

“এ রকম চোর আসার ঘটনা কি আপনাদের বাড়িতে আগে ঘটেছে?”

“না, কখনও নয়,” পার্সি বলল।

“আপনাদের বাড়িতে বাসন বা অন্য কিছু সোনা-রুপোর জিনিষ আছে, যা চোরে চুরি করতে আসতে পারে?”

‘নাহ্‌। দামি কোনও কিছুই বাড়িতে রাখা হয় না।”

হোমস পকেটে হাত পুরে বাড়িটার চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। লক্ষ করলাম হোমসের কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব। হোমসের স্বভাব তো এ রকম নয়। আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম।

যোসেফ হ্যারিসনের দিকে ফিরে হোমস বলল, “ভাল কথা, যে-জায়গায় বেড়া টপকে চোর বাগানে ঢুকেছিল, সে জায়গাটা নাকি আপনি দেখতে পেয়েছেন? চলুন তো সেখানটা দেখে আসি।”

যোসেফ হ্যারিসন আমাদের যেখানে নিয়ে গেলেন, সেখানে বেড়ার ওপর দিকের একটা কাঠের পাটা সামান্য ভেঙে গেছে। ভাঙা পাটা থেকে একটা টুকরো ঝুলছিল। হোমস সেই টুকরোটা ভেঙে নিয়ে ভাল করে দেখল।

“আপনি বলছেন এটা কাল রাত্তিরে ভেঙেছে? আমার কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে এটা কিছু দিন আগেই ভেঙেছে।”

“তা হয়তো হতে পারে।”

“বেড়ার বাইরের দিকে কারও লাফিয়ে পড়ার কোনও চিহ্ন আছে কি? আমার মনে হয় বাইরের দিকে সে রকম কিছু পাওয়া যাবে না। চলুন, আমরা আপনার শোবার ঘরে ফিরে গিয়ে কথাবার্তা বলি”, হোমস বলল।

পার্সি ফেলপ্‌স খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিল। তার পাশেই ছিল যোসেফ হ্যারিসন। মাঝে মাঝে হ্যারিসন পার্সিকে প্রায় ধরে ধরে নিয়ে আসছিল। হোমস বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটছিল। লন পার হয়ে আমরা যখন ফেলপ্‌সের ঘরের জানলার কাছে এলাম তখন পার্সি আর যোসেফ অনেক পিছনে পড়ে গেছে।

ঘরে পা দিয়েই হোমস খুব গম্ভীর ভাবে মিস হ্যারিসনকে বলল, “মিস হ্যারিসন, আপনি যেখানে আছেন আজ সমস্ত দিন সেখানেই থাকবেন। কোনও অবস্থাতেই আপনি এখান থেকে নড়বেন না। এটা কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন।”

হোমসের কথায় মিস হ্যারিসন খুবই অবাক হয়ে গেলেন। মুখে অবশ্য বললেন, “আপনি যা বলবেন তাই হবে।”

“আপনি যখন রাত্তিরে শুতে যাবেন, তখন মনে করে ঘরটা বাইরে থেকে চাবি দিয়ে যাবেন। আর চাবিটা আপনার কাছে রেখে দেবেন। আমাকে কথা দিন যে, এ কাজটি আপনি করবেন।”

“কিন্তু পার্সি?”

“উনি আমাদের সঙ্গে লন্ডনে যাবেন।”

“আর আমি এখানে থাকব?”

“এ সমস্তই মিঃ ফেলপ্‌সের ভালর জন্যে। আপনি এখানে থেকেই তার অনেক বেশি উপকার করতে পারবেন। আপনি কোনও রকম আপত্তি করবেন না। আমার কথা শুনুন।”

হোমসের কথায় রাজি হয়ে মিস হ্যারিসন মাথা নাড়লেন আর তক্ষুনি পার্সি আর যোসেফ হ্যারিসন ঘরে ঢুকল।

“আরে অ্যানি, তুমি ঘরের মধ্যে মুখ গোমড়া করে বসে কী করছ,” জোসেফ বলল। “বাইরে থেকে বেড়িয়ে এসো।”

“না, যোসেফ আমার মাথা ধরেছে। তা ছাড়া এই ঘরটা বেশ ঠান্ডা আর আরামদায়ক।” পার্সি ফেলপ্‌স বলল, “এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন মিঃ হোমস?”

“দেখুন এই ছোট ব্যাপারটার সমাধান করতে গিয়ে আমরা যেন মূল সমস্যার কথাটা ভুলে না যাই। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে লন্ডনে আসেন তো আসল সমস্যার সমাধান করবার সুবিধে হবে।”

“এক্ষুনি যেতে বলছেন?”

“না, আপনি যখন তৈরি হতে পারবেন তখনই যাওয়া যাবে। ধরুন, ঘণ্টাখানেক পরে যদি বার হই।”

“আমি আপনার তদন্তের কাজে লাগতে পারব, সে কথা ভেবেই আমার শরীর সেরে গেছে।”

“আপনি লন্ডনে এলে আমার কাজের খুব সুবিধে হবে।”

“আপনি বোধহয় চান যে, আজ রাতটা আমি লন্ডনেই থাকি।”

“হ্যাঁ। আমি সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম।”

“তা হলে কাল রাত্তিরে যে-মহাপ্রভু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, আজও তিনি যদি আসেন তো দেখবেন, পাখি উড়ে গেছে। মিঃ হোমস, আমরা নিজেদের আপনার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আপনি শুধু বলে দিন আমাদের কী করতে হবে। আমাকে দেখাশোনা করবার জন্যে যোসেফও আমাদের সঙ্গে যাবে তো?”

“না, না, তার কোনও দরকার হবে না। আপনি তো জানেন যে, আমার বন্ধু ওয়াটসন একজন ডাক্তার। ওয়াটসনই আপনার দেখাশোনা করবে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমরা দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সেরে নেব। তারপর তিন জনে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ব।”

হোমস যা বলল সেই রকমই হল। হোমসের কথামতো মিস হ্যারিসন ওই ঘরেই বসে রইলেন। হোমস যে কেন এ কাজটা করল তা বুঝতে পারলাম না। হোমস কি চায় যে পার্সি মিস হ্যারিসনের থেকে দূরে থাকুক? শরীরটা একটু সেরে ওঠায় আর লন্ডনে গিয়ে তদন্তের কাজে অংশ নিতে পারবে বলে পার্সি মনে মনে এত খুশি হয়ে পড়েছিল যে, ও আমাদের সঙ্গে খাবার ঘরে খেতে এল। তবে হোমস এর পরে যা করল তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা তো স্টেশনে এলাম। আমি আর ফেলপ্‌স গাড়িতে ওঠবার পর কিছুই যেন হয়নি এমন একটা ভাব করে হোমস বলল যে, সে ওকিংয়ে থাকছে। আমাদের সঙ্গে লন্ডনে ফিরছে না।”

“ছোটখাটো দু’-একটা জিনিস জানবার আছে। সেগুলো না জেনে এখান থেকে যেতে পারছি না। আপনি এখানে না থাকলেই আমার কাজের সুবিধে হবে। ওয়াটসন, লন্ডনে পৌঁছেই তোমরা সোজা বেকার স্ট্রিটে চলে যাবে। আর আমি না-ফেরা পর্যন্ত বাড়িতেই থাকবে। তোমরা তো ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়েছ। তাই তোমাদের কথা বলার বিষয়ের কোনও ঘাটতি হবে না। আমাদের গেস্টরুমে মিঃ ফেলপ্‌সের শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ো। আমি কাল সকালেই পৌঁছে যাব। এখান থেকে একটা ট্রেন আছে, সেটা আটটার সময় ওয়াটারলু পৌঁছে যায়। আমি ওই ট্রেনে যাব।”

বেশ একটু দুঃখিত ভাবে পার্সি বলল, “তা হলে লন্ডনে আমাদের তদন্ত করবার কী হবে?”

“সেটা আগামী কালও করা যেতে পারে। ঠিক এই মুহূর্তে আমার নিজের এখানে থাকাটাই বেশি দরকার বলে মনে হচ্ছে।”

গাড়ি ছেড়ে দিল। ফেলপ্‌স গাড়ির কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, “তা হলে আপনি একটু ‘ব্রায়ার ব্রে’তে খবর দিয়ে দেবেন যে, আমি কাল রাত্তিরে ফিরব।”

হোমস হাত নাড়তে নাড়তে হেসে বলল, “আমি ‘ব্রায়ার ব্রে’র দিকে যেতে পারব বলে মনে হয় না।”

সারা রাস্তা আমি আর ফেলপ্‌স হোমসের মতলবটা কী তা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারলাম না। এমন কী ঘটল যার জন্যে হোমস আমাদের লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ওখানে থেকে গেল?

“আমার মনে হচ্ছে যে কাল রাত্তিরে যে চোর এসেছিল সেই ব্যাপারে কোনও নতুন সূত্র বোধহয় উনি পেয়েছেন। কাল রাত্তিরের ঘটনাটা সত্যিই ছিঁচকে চোরের কাণ্ড কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে।”

“তোমার কি মনে হয় এটা ছিঁচকে চুরি নয়?”

“তুমি হয়তো মনে করতে পারো যে, অসুখে ভুগে আমার শরীর আর মনের জোর কমে গেছে। বিশ্বাস করো ওয়াটসন, আমার যেন মনে হচ্ছে আমাকে ঘিরে একটা রাজনৈতিক চক্রান্ত গড়ে উঠেছে। কেউ বা কারা যেন আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। তবে কেন যে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে তা আমার মাথায় ঢুকছে না। হয়তো তোমার মনে হবে আমি বড় বড় কথা বলছি, তা কিন্তু নয়। ভেবে দেখো, ওই ঘরে চোর আসবে কেন? ও ঘরে তো কোনও দামি জিনিস নেই। আর যদি ছিঁচকে চোরই হবে তো সে ও রকম একটা বড়সড় ছুরিই বা আনবে কেন?”

“তুমি বলছ ওটা ছুরিই, সিঁধ কাটার যন্ত্র নয়?”

“না, না। ওটা ছুরি। ছুরির লম্বা ফলাটা চকচক করছিল।”

“কিন্তু তোমাকে কেউ মেরে ফেলতেই বা চাইবে কেন?”

“হ্যাঁ, সেটাই তো প্রশ্ন।”

“হোমসের মতও যদি তাই হয় তো ও এখানে থেকে গিয়ে ভালই করেছে। যদি হোমস ওই লোকটাকে ধরতে পারে, তবে তোমার ওই নৌবাহিনী-নথি চুরি যাওয়ার রহস্যটার সমাধানও হয়ে যেতে পারে। তোমার দু’জন শত্রু আছে বলে মনে হয় না।”

“কিন্তু মিঃ হোমস যে বললেন, উনি ‘ব্রায়ার ব্রে’তে যাবেন না।”

আমি বললাম, “হোমসকে আমি অনেক দিন দেখছি। কারণ ছাড়া কোনও কাজ ও করে না।”

এরপর আমরা অন্য বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। কিন্তু আমার পক্ষে ব্যাপারটা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠল। ভারী অসুখে ভুগে ফেলপ্‌স খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর তার স্বভাবও খুব খিটখিটে হয়ে গেছে। আমি তাকে ভারতবর্ষের কথা, আফগানিস্থানে আমার অভিজ্ঞতার কথা বললাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ফেলপ্‌স কেবলই তার নিজের কথা বলতে লাগল। সে বার বারই নিজের মনে বলতে লাগল, ‘নকল করা নথিটা কি আর পাওয়া যাবে?” আর আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, “আচ্ছা, মিঃ হোমস এখন কী করছেন? উনি ওখানে কেন থেকে গেলেন?… আচ্ছা, লর্ড হোলডহার্স্ট এই চুরির ব্যাপারে কী করছেন বলো তো?…কাল সকালে মিঃ হোমস কী খবর আনবেন বলে তোমার মনে হয় ওয়াটসন?” যত রাত বাড়তে লাগল ফেলপ্‌সের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হল।

ফেলপ্‌স বলল, “তোমার কি মিঃ হোমসের ওপর পুরোপুরি ভরসা আছে?”

“ওকে আমি অনেক আশ্চর্য কাজ করতে দেখেছি।”

“কিন্তু এ রকম জটিল কোনও রহস্যের সমাধান কি উনি করেছেন?”

“অবশ্য। হোমস খুব তুচ্ছ সূত্র থেকে অনেক কঠিন কঠিন রহস্যের সুরাহা করে দিয়েছে।”

“কিন্তু এই রহস্যের ওপরে যে দেশের অনেক ভাল-মন্দ নির্ভর করছে।”

“তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু জানি যে ইউরোপের তিনটি নামী রাজবংশের খুব গোপন ব্যাপারে তদন্ত করার দায়িত্ব হোমসকে দেওয়া হয়েছিল।”

“ওয়াটসন, তুমি মিঃ হোমসকে জানো। কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওঁর কথাবার্তা, চালচলন সবই কেমন যেন রহস্যময়। তোমার কি মনে হয় এ ব্যাপারে ফয়সালা উনি করতে পারবেন? ওঁর সঙ্গে কথাটথা বলে তোমার কী মনে হল?

“হোমস কিছুই বলেনি।”

“তা হলে তো গতিক সুবিধের নয় বলে মনে হচ্ছে।”

“ঠিক তার উলটো। হোমস যখন কোনও রহস্যের হদিস না পায়, তখন সে কথা ও খোলাখুলি ভাবে বলে। কিন্তু যখন কোনও একটা বিশেষ সূত্র ধরে ও এগোয়, অথচ সে সূত্রটা ঠিক না বেঠিক সে ব্যাপারে ওর তখন নিজের মনেই সন্দেহ থেকে যায়, তখন ও একদম চুপ করে থাকে। তখন ওর কাছ থেকে একটি কথাও বের করা যায় না। দেখো পার্সি, হোমস কোনও সূত্র পেয়েছে কি পায়নি, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে এখন কোনও লাভ নেই। এতে মিছিমিছি আমাদের মাথাই গরম হবে অথচ কোনও ফল হবে না। বরং এখন শুয়ে পড়া যাক। তাতে তোমার শরীর আর মনের দুয়েরই উপকার হবে। কাল সকালে যা হবার তা হবে।”

অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তো পার্সিকে শুতে পাঠালাম। কিন্তু ওর মনের যে রকম চঞ্চল অবস্থা তাতে ওর ঘুম হবে বলে আমার মনে হল না। শুতে গিয়ে দেখলাম আমার অবস্থাও পার্সির মতো। প্রায় মাঝ রাত্তির পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরতে লাগল। কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। কী ভাবে এই অদ্ভুত সমস্যার সমাধান হবে? নানা রকম সমাধানের কথা মাথায় আসতে লাগল। কিন্তু প্রত্যেকটা সমাধানই ভীষণ রকম অসম্ভব বলে মনে হল। হোমস কেন ওকিংয়ে থেকে গেল? কেন ও মিস হ্যারিসনকে ফেলপ্‌স যে-ঘরে ছিল সে ঘরে সারা দিন থাকতে বলল? কেন ও ‘ব্রায়ার ব্রে’-র লোকেদের জানাতে চায় না যে ও ওকিংয়ে রয়েছে? হাজার মাথা ঘামিয়েও এ সব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পেলাম না। তারপর কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।

যখন ঘুম ভাঙল তখন সাতটা বেজে গেছে। উঠে আমি প্রথমেই ফেলপ্‌সের ঘরে গেলাম। পার্সির চেহারা দেখে বুঝলাম যে, ও সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করেনি। আমাকে দেখেই পার্সি বলল, “মিঃ হোমস ফিরেছেন?”

আমি বললাম, “হোমস যখন আসবে বলেছে ঠিক তখনই আসবে। তার আগেও আসবে না, পরেও না।”

আমার কথা ফলে গেল। ঠিক আটটার সময় আমাদের দরজার কাছে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে শার্লস হোমস নামল। ওপরের ঘরে জানলা থেকে আমরা দেখলাম হোমসের বাঁ হাতটা ভাল রকম ব্যান্ডেজ করা। হোমসের মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। হোমস বাড়ির মধ্যে ঢুকল বটে, তবে ওপরে উঠে এল বেশ খানিকক্ষণ পরে।

পার্সি বলল, ‘মিঃ হোমসকে দেখে মনে হচ্ছে উনি যেন সুবিধে করতে পারেননি।”

পার্সির কথা আমাকে স্বীকার করে নিতেই হল। আমি বললাম, “হয়তো ওই ব্যাপারের মূল সূত্র লন্ডন শহরেই পাওয়া যাবে।”

ফেলপ্‌সের মুখ দিয়ে একটা কাতর শব্দ বার হল।

“কেন আমার মনে হয়েছিল বলতে পারব না, তবে আমি বড্ড আশা করেছিলাম যে, মিঃ হোমস ফিরে এলে কোনও একটা খবর আমি পাবই। কিন্তু কালকে তো ওঁর হাতে কোনও ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল না। কী ব্যাপার হল তা হলে?”

হোমস ঘরে ঢুকতে আমি বললাম, “হোমস, তুমি আঘাত পেলে কী করে?”

“ও কিছু নয়। সামান্য ছড়ে গেছে।”

আমাকে এই কথা বলেই হোমস পার্সির দিকে ফিরে বলল, “আমি যে-সব শক্ত কেস করেছি আপনার এই নথি চুরির মামলাটা সেগুলোর প্রায় সব কটাকেই টেক্কা দিয়েছে।”

“আমার মনে হয়েছিল যে, এ ব্যাপারে আপনি বিশেষ সুবিধে করতে পারবেন না।”

“এটা একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা বটে।”

“তোমার হাতের ওই ব্যান্ডেজটা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে,” আমি বললাম, “কী হয়েছিল আমাদের বলো।”

“বন্ধু হে, চা-টা খাবার পরে বলব। ভেবে দেখো, আজ সকালে আমি তিরিশ মাইল সারের খোলা হাওয়া খেয়েছি। …আচ্ছা, আমার সেই বিজ্ঞাপনের কোনও উত্তর আসেনি? …কী আর করা যাবে। সব সময় সবকিছু ঠিকঠাক চলবে বলে আশা করা যায় না।”

টেবিল সাজানো হয়ে আছে। আমরা বসে আছি। চা আসতে দেরি হচ্ছে কেন খবর নিতে যাব ভাবছি, এমন সময় মিসেস হাডসন ঘরে ঢুকলেন। মিসেস হাডসন চা আর কফির পট রেখে চলে গেলেন। একটু পরেই তিনি কতকগুলো ঢাকা-দেওয়া পাত্র নিয়ে এলেন। আমরা চেয়ার এগিয়ে নিলাম। হোমসের খুব জোর খিদে পেয়েছে দেখলাম। আমার খিদের চেয়ে ওর কী হয়েছে জানার কৌতূহলটাই বেশি। পার্সি মুখ কালো করে চুপচাপ বসে আছে।

মশলা-মুরগির পাত্রটার দিকে তাকিয়ে হোমস বলল, “মিসেস হাডসন দেখছি খিদে বুঝে খাবার করেছেন। উনি হয়তো অনেক রকম রাঁধতে জানেন না, তবে সকালবেলায় উত্তম জলখাবার কী করে তৈরি করতে হয়, সেটা উনি জানেন। …ওয়াটসন, তোমার কাছে ওটা কী রয়েছে?”

“ডিম দেওয়া হ্যাম,” আমি বললাম।

“বাহ্। মিঃ ফেলপ্‌স আপনি মুরগি, হ্যাম নিন! নাকি যেটা পছন্দ সেটাই নেবেন?”

“ধন্যবাদ। আমার মোটেই খিদে পায়নি;” ফেলপ্‌স বলল।

“তাই কি হয়! ওই তো আপনার কাছে যে-পাত্রটা রয়েছে ওটাতে কী আছে দেখুন না।”

“না, দেখুন, আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“আপনি যখন খাবেন না তখন…”, একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে হোমস বলল, “তা হলে ওই পাত্রটায় যা আছে তা একটু আমাকে তুলে দিন তো!”

ফেলপ্‌স ঢাকাটা খুলেই চিৎকার করে উঠল। দেখলাম, ও বড় বড় চোখ করে পাত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখ একদম সাদা। দেখলাম, পাত্রটার মধ্যে গোল করে গোটানো একটা নীলচে ছাই রঙের কাগজ। ফেলপ্‌স কাগজটা তুলে নিল। মনে হল কাগজের মোড়কটা বোধহয় ও গিলে খাবে। তারপর কাগজটা দু’হাতে চেপে ধরে ফেলপ্‌স সারা ঘরের মধ্যে নেচে বেড়াতে লাগল। আনন্দের চোটে ও মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ বার করতে লাগল। শেষকালে আনন্দের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ফেলপ্‌স একটা চেয়ারে বসে পড়ল। ওর ভাবগতিক দেখে আমাদের মনে হল যে, ও বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমরা তাড়াতাড়ি ওকে জোর করে খানিকটা গরম কফি খাইয়ে দিলাম।

ফেলপ্‌সের পিঠ চাপড়ে দিয়ে হোমস বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। হঠাৎ ওই ভাবে কাগজটা আপনার সামনে আনাটা আমার অন্যায় হয়েছে। কিন্তু ওয়াটসন জানে, আমি সুযোগ পেলেই নাটকীয় ব্যাপার করে ফেলি। এটা আমার স্বভাবের দোষ বলতে পারেন।”

ফেলপ্‌স হোমসের দুটো হাত জড়িয়ে ধরল, “ভগবান আপনার ভাল করবেন। আপনি আমার মান-ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছেন।”

হোমস বলল, “আমার নিজেরই মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হচ্ছিল। বিশ্বাস করুন, আপিসের কোনও কাজের দায়িত্ব নিয়ে সে কাজ ভাল ভাবে করতে না পারলে আপনার যেমন খারাপ লাগে, আমারও ঠিক তেমনই খারাপ লাগে কোনও রহস্যের সমাধানে হাত দেবার পর সে রহস্য সমাধান করতে না পারলে।”

ফেলপ্‌স কাগজটা তার কোটের ভেতরের পকেটে পুরে রাখল।

“আপনার খাওয়ায় বাধা দিতে আমার খুব খারাপ লাগছে, অথচ কোথায় আর কী করে ওই কাগজটা আপনি পেলেন, সে কথাটা জানতেও ইচ্ছে করছে খুব।”

হোমস এক কাপ কফি আর ডিম দেওয়া হ্যাম খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। তারপর নিজের আরামকেদারাটিতে জুত করে বসে পাইপ ধরিয়ে বলল, “আগে বলি কী করলাম, কী করে করলাম সে কথাটা পরে বলব। …আপনাদের ট্রেন ছেড়ে দেবার পর স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সারের প্রাকৃতিক দৃশ্য চমৎকার। আমি হাঁটতে হাঁটতে গেলাম রিপলি বলে ছোট্ট একটা গ্রামে। গ্রামের সরাইখানায় চা খেয়ে নিলাম। তারপর আমার ফ্লাস্কে চা ভরতি করে নিলাম আর কিছু স্যান্ডউইচ কিনে নিলাম। সন্ধে পর্যন্ত আমি রিপলিতে থেকে গেলাম। যখন অন্ধকার হয়ে গেল তখন ওকিংয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ‘ব্রায়ার ব্রে’র কাছে যখন এসে পড়লাম তখন সূর্য ডুবে গেছে।

“যতক্ষণ না বুঝলাম যে, চার দিক বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে, ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, সুবিধের মধ্যে হচ্ছে যে, ওই রাস্তায় লোক চলাচল বেশি নেই। তারপর আমি বেড়া টপকে আপনাদের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।”

ফেলপ্‌স বলে উঠল, “কিন্তু বাগানের দিকের গেটটা খোলা ছিল নিশ্চয়ই!”

“হ্যাঁ, তা ছিল। তবে এই রকম পাঁচিল কি বেড়া টপকে বাড়ির ভেতর ঢোকাটাই আমার বেশি পছন্দ। বাগানের যেখানটায় তিনটে ফার গাছ আছে আমি সেখানটায় বেড়া টপকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওই জায়গাটা বেশ ঢাকামতন। বাড়ি থেকে কেউ আমাকে চট করে দেখতে পাবে না। আমি ঝোপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে রইলাম। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। আমার ট্রাউজার্সের হাঁটুর অবস্থা দেখলেই বুঝবেন, আমি কী করেছি। যাই হোক, এই ভাবে হামাগুড়ি দিয়ে আমি আপনার ঘরের জানলার কাছাকাছি যে রডোডেনড্রন গাছের ঝোপ আছে, সেখানে পৌঁছে গেলাম। ওখানে হাঁটু মুড়ে বসে রইলাম কী হয় দেখবার জন্য।

“আপনার ঘরের পরদা তোলা ছিল। আমি দেখলাম, মিস হ্যারিসন চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। সওয়া দশটার সময় তিনি জানলা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে চলে গেলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করবার আওয়াজ পেলাম। মনে হল যেন দরজাটা বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দিলেন।”

“চাবি!” ফেলপ্‌স বলে উঠল।

“হ্যাঁ, আমি মিস হ্যারিসনকে বিশেষ করে বলে দিয়েছিলাম যে, আপনার ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে চাবি বন্ধ করে চাবিটা যেন উনি নিজের কাছে রাখেন। উনি আমার প্রত্যেকটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, উনি এই রকম সাহায্য না করলে আপনি ওই কাগজটা পকেটে পুরতে পারতেন না। আলো নিভে গেল। উনি চলে গেলেন। আমি রডোডেনড্রন ঝোপে বসে রইলাম।

“চমৎকার আবহাওয়া ছিল। কিন্তু ওই ভাবে বসে থাকাটা ভয়ানক ক্লান্তিকর। তবে ওই ভাবে বসে থাকার মধ্যেও একটা উত্তেজনা আছে। শিকারিরা যখন মাচায় বসে থাকে, কিংবা মাছ ধরার জন্যে যখন কেউ ছিপ ফেলে পুকুরপাড়ে বসে থাকে, তখন সে যে ধরনের উত্তেজনা বোধ করে, এটাও সেই রকমের। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। ওয়াটসন, সেই বুটিদার ফেট্টির রহস্যের সমাধানের জন্যে আমাদের যতক্ষণ বসে থাকতে হয়েছিল এবারেও প্রায় ততক্ষণই বসে থাকতে হল। ওকিং চার্চের ঘড়িটা পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর বাজছিল। কিন্তু বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হচ্ছিল যে, চার্চের ঘড়িটা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। বসে থাকতে থাকতে দুটো বেজে গেল। হঠাৎ খুব সন্তর্পণে ছিটকিনি খোলবার শব্দ হল। তারপর চাবি খোলবার শব্দ হল। তার পরেই লোকজনদের যাতায়াতের দরজাটা খুলে গেল। দরজা খুলে যে-লোকটি বাগানে এসে দাঁড়াল চাঁদের আলোয়, তাকে চিনতে আমার ভুল হল না। যোসেফ হ্যারিসন।

“যোসেফ।” ফেলপ্‌স চিৎকার করে উঠল।

“যোসেফের মাথায় টুপি ছিল না। তবে ওর গায়ে একটা ঝোলা জামা ছিল। দরকার হলেই যাতে মুখটা ঢেকে ফেলতে পারে। ও পা টিপে টিপে দেওয়ালের পাশ দিয়ে এগিয়ে এল। তারপর জামার ভেতর থেকে একটা বেশ লম্বা ফলাওলা ছুরি বের করে ও জানলার ছিটকিনিটা খুলে ফেলল। তারপর জানলার পাল্লা খুলে ও ঘরে ঢুকে গেল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে ঘরের ভেতরটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। তাই ঘরের ভিতর ও কী করছিল সবই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। ঘরে ঢুকে ও ম্যান্টেলপিসে রাখা দুটো মোমবাতিই জ্বেলে দিল। তারপর ও ঘরের দরজার কাছের এক কোণে নিচু হয়ে মেঝের কার্পেটটা তুলে ফেলল। তারপর ওইখানে একটু টানতেই একটা চৌকো কাঠ খুলে গেল। এক ঘর থেকে আর এক ঘরে গ্যাসের পাইপ নিয়ে যাবার জন্যে ওই রকম একটা ফাঁক মিস্ত্রিরা রেখে দেয়। পরে দেখলাম যে, ওখানে গ্যাস পাইপের একটা টি-জয়েন্ট লাগানো আছে। সেইখান থেকে আপনাদের রান্নাঘরের গ্যাস পাইপ চলে গেছে। এই গোপন জায়গা থেকে যোসেফ গোল করে রাখা কাগজটা বের করে আনল। তারপর কাঠের টুকরোটা আবার ঠিকমতো বসিয়ে কার্পেটটা পেতে দিয়ে যোসেফ মোমবাতি দুটো নিভিয়ে দিল। কাজ শেষ করে জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই যোসেফ আমার হাতে ধরা পড়ে গেল।

“তবে মিস্টার যোসেফের প্রকৃতি আমি যা ভেবেছিলাম তার চাইতে ঢের বেশি হিংস্র। ও ছুরি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এল। ওকে বারদুয়েক মাটিতে চিত করে ফেলে দিয়ে আপনার এই কাগজখানা নিয়ে নিলাম। সেই সময়ে ওর ছুরিতে আমার আঙুলের গাঁটের কাছে কেটে যায়। তবে ওকে কাবু করতে আমার বিশেষ অসুবিধে হয়নি। কাগজটা কেড়ে নিয়ে আমি ওকে পালাতে দিলাম। পালাবার আগে ও এক বার আমার দিকে একনজর তাকিয়ে ছিল। সেই চাউনি দেখে বুঝেছিলাম যে, পারলে ও আমাকে খুন করে ফেলে। আমি আজ সকালে ফরবসকে সব কথা টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছি। আমার টেলিগ্রাম পেয়েই যদি ফরবস চটপট কাজে নেমে পড়ে তবে হয়তো ওকে ধরতে পারবে। তবে আমার ধারণা ফরবস গিয়ে দেখবে যে, পাখি উড়ে গেছে। অবশ্য তাতে ভালই হবে। সরকার অনেক ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে যাবে। আমার ধারণা লর্ড হোলডহার্স্ট আর মিঃ পার্সি ফেলপ্‌সের কেউই চাইবেন না যে, এই নথি চুরির ব্যাপারটা কোর্ট-কাছারি অবধি যাক।’

ভীষণ রকম অবাক হয়ে আমাদের মক্কেল বলল, “হায় ঈশ্বর! আপনি কী বলছেন! এই দশ সপ্তাহ ধরে আমি যখন শরীর আর মনের যন্ত্রণায় ছটফট করেছি তখন ওই কাগজখানা আমি যে-ঘরে বন্দি ছিলাম সেই ঘরেই রাখা ছিল?”

“হ্যাঁ, তাই বটে।”

“কী সাংঘাতিক! যোসেফ এই রকম শয়তান!”

“হুঁ। যোসেফকে দেখে যে রকম মনে হয় উনি মোটেই সে রকম নন। অত্যন্ত জঘন্য ধরনের লোক। ওর কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি তার থেকে বুঝেছি, ফাটকা খেলতে গিয়ে ও প্রচুর লোকসান করেছে। এখন যে-কোনও ভাবেই হোক, পয়সা রোজগার করাটাই ওর লক্ষ। যোসেফ অত্যন্ত স্বার্থপর। তাই যখন ঘটনাচক্রে ওই নথিটা ওর নজরে পড়ল তখন ও আপনার বা ওর বোনের ভাল-মন্দের কথাটা ভাবেনি।”

“ফেলপ্‌স চেয়ারে এলিয়ে পড়ে বলল, “আপনার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। আমার মাথা ঘুরছে।”

হোমস তার স্বভাব অনুযায়ী বক্তৃতায় ঢঙে বলল, “আমাদের এই রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে প্রথম যে অসুবিধেটা হয়েছে সেটা হল, সূত্রের বাড়াবাড়ি। আর তার ফলে আসল সূত্রটা অদরকারি সূত্রের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। আমাদের প্রথম কাজ ছিল যে-সব ঘটনা আমরা শুনেছিলাম তার থেকে আসল ঘটনাগুলো বেছে নিয়ে সেগুলোকে পর পর সাজিয়ে নেওয়া। আর সেই কাজ করতে পারলেই কী ভাবে এই আশ্চর্য চুরি সম্ভব হয়েছে তা জানতে পারা যাবে। আমি আপনার কথা শুনে যোসেফকে সন্দেহ করেছিলাম। আপনি বলে ছিলেন যে, আপনার যোসেফের সঙ্গে ফিরে যাবার কথা ছিল। তার থেকে আমার মনে হল হয়তো স্টেশনে যাবার পথে যোসেফ আপনাকে ডাকতে এসেছিল। কেন না আপনি বলে ছিলেন আপনার আত্মীয়-বন্ধু অনেকেই আপনার আপিস চেনেন। তারপর যখন শুনলাম যে, যে-দিন আপনি প্রথম একলা শুয়ে ছিলেন সেই রাত্তিরেই ওই ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ ঢোকবার চেষ্টা করছিল, তখন আমার মনে আর কোনও সন্দেহই রইল না। আপনি বলে ছিলেন যে, ওই ঘরে যোসেফ থাকতেন। আপনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলে যোসেফকে মাঝ রাতে ওই ঘর থেকে এক রকম বিনা নোটিসে বের করে দেওয়া হয়। তা হলে ওই ঘরে কিছু লুকিয়ে রাখলে তা রেখেছেন ওই যোসেফ। আর যে-রাত্তিরে নার্সকে ছুটি দিয়ে আপনি একাই শুলেন, সেই রাত্তিরেই ঘরে কেউ ঢুকতে চেষ্টা করল। এর থেকে বুঝলাম যে, যে-ই ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করুক না কেন সে বাড়ির ভেতরের সব খবরই রাখে। আর তখন আমার মনে যে-সন্দেহটা দানা বাঁধছিল সেটাই সত্যি মনে হল।”

“ওহ্, আমি একদম আস্ত কানা।”

“এই রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে আমি ঘটনাগুলোকে যেভাবে সাজিয়ে ছিলাম তা হল মোটামুটি এই রকম: যোসেফ হ্যারিসন চার্চ স্ট্রিটের দিকের দরজা দিয়ে আপনার আপিসে ঢোকে। আপনার আপিস ওর ভালমতোই চেনা। ও সোজা আপনার ঘরে যায়। কিন্তু তার আগেই আপনি কফি আসতে দেরি হচ্ছে কেন দেখতে গিয়েছিলেন। ঘরে কাউকে না দেখতে পেয়ে যোসেফ ঘণ্টা বাজায়। আর তখনই আপনার টেবিলের ওপর রাখা দলিলটা ওর নজরে পড়ে। নথিটা দেখেই ও বুঝতে পারে যে, কী অসাধারণ মূল্যবান জিনিস ওর হাতে এসেছে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে নথিটি পকেটে পুরে ও আপনার আপিসঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আপনার মনে আছে বোধহয়, আপনার সঙ্গে দু’-একটা কথা বলবার পরে কেয়ারটেকার ঘণ্টা বাজার কথা আপনাকে বলে। ওই অল্প সময়ের মধ্যেই যোসেফ নথিটি নিয়ে সরে পড়ে।

“আপনার আপিস থেকে বেরিয়ে যোসেফ প্রথম যে-ট্রেনটি পায় সেই ট্রেনেই ওকিংয়ে চলে আসে। তারপর ধীরেসুস্থে ওই নথিটি পরীক্ষা করে বুঝতে পারে যে, ওটার কী দাম। ও ওটাকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। ওর মতলব ছিল দু’-এক দিন পরে ওটা ফরেন রাষ্ট্রদূতের আপিসে গিয়ে বেচে দেবে। কিন্তু ওই দিনই আপনি অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি গেলেন আর ওকে ঘর থেকে বের করে ওর ঘরেই আপনি থাকতে লাগলেন। তারপর থেকে ওই ঘরে সব সময়েই লোক। সুতরাং যোসেফ কিছুতেই জিনিসটা সরাতে পারল না। তখন ওর মনের অবস্থা যে কী রকম তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। শেষকালে একটা সুযোগ এল, যে-দিন নার্সকে ছুটি দিয়ে আপনি একা ঘরে শুলেন। কিন্তু আপনি জেগে ছিলেন বলে সে রাতেও কাজ হাসিল হল না। আপনার মনে আছে ওই দিন আপনি শোবার আগে দুধ খাননি?”

হ্যাঁ, মনে আছে।”

“আমার দৃঢ় ধারণা আপনার দুধে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। যোসেফের ধারণা ছিল যে, আপনি গভীর ভাবে ঘুমোবেন। আমি জানতাম, যোসেফ আবার ওই ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করবে। আপনি ঘর থেকে চলে যাওয়ায় ও সেই সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু আমি মিস হ্যারিসনকে সারা দিন ওই ঘরে বসিয়ে রাখলাম। তাতে ও আমাদের আড়ালে জিনিসটা সরাতে পারল না। তারপর এমন ভাবে আমরা চলে গেলাম যে, ওর বিশ্বাস হল পথ পরিষ্কার। আর ইতিমধ্যে আমি ফিরে এসে বাগানের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বসে রইলাম। আমি গোড়া থেকেই জানতাম, আপনার হারানিধি ওই ঘরেই আছে। কিন্তু ঘরের আসবাবপত্র ওলটপালট করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম যে কাগজটা ওই বের করে দিক। …আর কিছু জানতে চান?”

আমি বললাম, “আচ্ছা, যোসেফ তো বাড়ির ভেতর দিয়ে পার্সির ঘরে যেতে পারত। তা না করে ও বাগানের দিকের জানলা দিয়ে ঢুকতে গেল কেন?

“মিঃ ফেলপ্‌সের ঘরে আসতে হলে ওকে সাতটা শোবার ঘর পেরিয়ে আসতে হত। বাগান দিয়ে ঢোকা, বার হওয়া অনেক সোজা। আর কিছু?”

ফেলপ্‌স বলল, “ছুরিটা বোধহয় যোসেফ জানলা খোলবার জন্যেই এনেছিল, আমাকে খুনটুন করার মতলব নিশ্চয়ই ওর ছিল না!”

“হতে পারে, হোমস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তবে যোসেফ হ্যারিসনকে আমি বিশ্বাস করি না।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন