বৌদ্ধদের মাতৃসাধনা

পৃথ্বীরাজ সেন

নিঃসন্দেহে তাঁকে আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় বলতে পারি। তাঁর আলোর পতাকা হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ বহন করে চলেছেন। আজও পৃথিবীর বহু দেশ তাঁর পদানত, কিন্তু এজন্য তাঁকে কোনও তরবারি ব্যবহার করতে হয়নি। এ হল এক দর্শনের দিগ্বিজয়, যে মানুষটির মধ্যে ছিল স্নিগ্ধ হাসির অপার মৌলিক প্রজ্ঞা আর আশ্চর্য দর্শন, তিনি হলেন গৌতম বুদ্ধ।

একসময় ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ এই ধর্মে নিশ্চিত শান্তি এবং পরম নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আচারসর্বস্ব প্রাতিষ্ঠানিক অন্তঃসার— শূন্যতার বিরুদ্ধে গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন একা, এক অহিংস পুরুষ হয়ে। পরবর্তীকালে আবার যখন ভারতবর্ষের বুকে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য এবং প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনও আমরা গৌতম বুদ্ধের মতবাদকে একেবারে অস্বীকার বা নস্যাৎ করতে পারিনি। তাই দেখা যায়, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখা—প্রশাখায় তাঁর উজ্জ্বল অথচ নীরব উপস্থিতি। যে শঙ্করাচার্যকে আমরা হিন্দুধর্ম পুনঃপ্রবর্তনের যুগপুরুষ বলে থাকি, তিনিও কিন্তু বৌদ্ধধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত এবং প্রচলিত মতবাদে গৌতম বুদ্ধের সুস্পষ্ট উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ভারতের জাতীয় মহাকাব্য মহাভারত পাঠ করলেও মনে হয় আমরা বুঝি গৌতম বুদ্ধের মতবাদের বিভিন্ন প্রক্ষিপ্ত অংশের দেখা পেয়েছি। যুদ্ধে পরান্মুখ অর্জুনকে আমরা তো মহামতি অশোকের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাই মনে হয়, ভারতীয় শাস্ত্রকাররা নিরুপায় হয়ে বুদ্ধের শরণে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নাহলে হিন্দুধর্মের এই গৌরবময় পুনরুত্থান কখনও ঘটত না।

যে গৌতম বুদ্ধ জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, বৈরাগ্যের আনন্দ যে কী অসীম হতে পারে, তা বুঝিয়েছিলেন। নির্লিপ্তি কখন যে মনোজগতে আনতে পারে আনন্দের প্লাবন, তা উপলব্ধি করিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বুদ্ধদেবের সেই মতবাদে নানাধরনের ব্যাভিচার ও অবক্ষয় এসে বাসা বাঁধে। ভাবতে অবাক লাগে, যে বুদ্ধ অহিংস মতবাদের প্রতীক, তাঁর উত্তরপুরুষেরা কীভাবে তন্ত্রসাধনায় এত পারদর্শী হয়ে উঠলেন। গৌতম বুদ্ধ নানা কারণে প্রথমদিকে তাঁর সঙ্ঘে মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি দেননি। পরবর্তীকালে তাঁর মাতা প্রজাপতি গৌতমীর একান্ত অনুরোধে তিনি এই নিষেধ তুলে নিয়েছিলেন। এর ফল হয়েছিল মারাত্মক। একাধিক আশ্রমে ঘটে গেল নিষিদ্ধ যৌনতার ঘটনা। জানি না গৌতম বুদ্ধ এসব ঘটনা শুনে কতখানি মর্মাহত হয়েছিলেন।

তাঁর মহাপ্রয়াণের পর বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে ব্যাভিচার এবং কলঙ্ক গড়ে ওঠে। দিকে দিকে শুরু হয় বৌদ্ধধর্মের নতুন বিশ্লেষণ। তন্ত্রচর্চার সাথে এই ধর্ম কোনও কোনও ক্ষেত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর এর ফলে বৌদ্ধসাধকেরা নতুন পন্থার পথিক হয়ে মাতৃসাধনায় মগ্ন হলেন। এই পর্যায়ে আমরা দেখাব, কীভাবে একদা অবিভক্ত বঙ্গদেশের উত্তরাঞ্চলে বৌদ্ধতান্ত্রিক মতে মাতৃসাধনার আয়োজন হয়েছিল। আজ হয়তো এই ধারাটি ঈষৎ ক্ষীণ হয়ে গেছে, কিন্তু আজও আমরা গ্রামবাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে এই মতে বিশ্বাসী কিছু মানুষকে পেয়ে থাকি। তাঁরা সমাজ সভ্যতা থেকে দূরে বসে নিভৃত নিরালায় বৌদ্ধতন্ত্রাচর্চায় মগ্ন আছেন। তাঁদের এই গূঢ় তন্ত্ররহস্যের কথা জানা খুব একটা সহজ নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে তবেই এই প্রতিবেদনটি লিখিত হয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের রূপান্তরণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম পরবর্তীকালে দুটি পৃথক দলীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি হীনযান, অপরটি মহাযান। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে মহাযান ধর্ম প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষক নাগার্জুন, অনঙ্গ, বসুবন্ধু, অশ্বঘোষ, শান্তিদেব প্রভৃতি বিশিষ্ট দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে মাধ্যমিক এবং যোগাচার—এই দুটি মত প্রচলিত ছিল। এইসব দার্শনিকগণের প্রচারিত এবং সিদ্ধাচার্যদের আচরিত ধর্মের প্রভাবে মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে মন্ত্রযান, বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযানের উৎপত্তি হয়।

মাধ্যমিকরা শূন্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তাঁরা বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের উপাসনাকে স্বীকার করেছিলেন। যোগাচাররা যোগাত্মা ও পরমাত্মার মিলন স্বীকার করে অনাত্মবাদী মহাযানদের মধ্যে আত্মবাদ প্রচার করলেন। অষ্টম এবং নবম শতকে মহাযান বৌদ্ধধর্মে নতুনভাবে তান্ত্রিক ধ্যানকল্পনার স্পর্শ লাগল। দশম শতক থেকে বৌদ্ধধর্মের গুহ্য সাধনতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একাংশ পূজাচারে মন দিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে কিন্তু মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে নির্বাণপ্রাপ্তির একমাত্র পথ ছিল জ্ঞাননিষ্ঠ ইন্দ্রিয় সংযম এবং সন্ন্যাসবৈরাগ্য।

আমরা সকলেই জানি কিসা গৌতমীর অনুরোধে এবং প্রিয় শিষ্য আনন্দের সদিচ্ছায় বুদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীদের লক্ষ্য ছিল নিবৃত্তি। পরবর্তীকালে বৌদ্ধবিহার এবং সংঘারামে হাজার হাজার ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা আশ্রয় লাভ করতে থাকলেন। তাঁদের পারস্পরিক সংযোগে একটির পর একটি ব্যাভিচারের ঘটনা ঘটে চলল। তখন ভগবান বুদ্ধ সংঘে ব্যাভিচার নিরোধের জন্য বেশ কয়েকটি নিয়মনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। তখন বিনয়পিটক সৃষ্টি হয়। জ্ঞানতপস্বী জিতেন্দ্রিয় ভিক্ষুরা কামিনী কাঞ্চন বা প্রকৃতিমার্গের বিরোধী ছিলেন। কেউ কেউ আবার স্ত্রীজাতির সংসর্গের জন্য কল্পসাধনার মাধ্যমে নিবৃত্তি বা মোক্ষলাভের উপায় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন। এর ফলে একাধিক মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হল। শূন্যবাদ এবং যোগাচারবাদের গভীর দার্শনিক তত্ত্ব এবং সাধনমার্গের বিচিত্র স্তর বোঝার ক্ষমতা সাধারণ মানুষদের ছিল না। তাদের কাছে মন্ত্র, জাদুশক্তি, মণ্ডল, ধারণী এবং বীজ অনেক সহজ হল। আর এইভাবে এক শ্রেণীর বৌদ্ধ আচার্য নতুন ধর্মপথের পথিক হলেন। দেখা গেল পঞ্চপুরুষ এবং পঞ্চশক্তির উপাসনা। মন্ত্রযান সম্প্রদায় স্বয়ম্ভু বা আদি বুদ্ধ এবং তাঁর প্রজ্ঞাবাদ ধর্ম থেকে সম্ভূত বৈরোচন আক্ষাভ্য, রত্নসম্ভব, অমিতাভ এবং অমোঘ সিদ্ধি নামে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধের কল্পনা করলেন। বৈরোচনী, লোচন, মামুখি, পাণ্ডুরা এবং তারা হলেন পঞ্চমশক্তি। এই পঞ্চবুদ্ধ এবং পঞ্চশক্তির মিলনে পঞ্চপুত্রের জন্ম হল—সমন্তভদ্র, বজ্রপাণি, রত্নপাণি, পদ্মপাণি এবং বিশ্বপাণি। এঁদের উপাসকদের বলা হল বোধিসত্ত্বযান।

আবার মন্ত্রযানে বিশ্বাসী কিছু বৌদ্ধ তান্ত্রিকতার প্রতি অতিমাত্রায় আকর্ষিত হলেন। তাঁরা প্রবৃত্তিমার্গী নবসম্প্রদায় সৃষ্টি করলেন। এর ফলে বজ্রসত্ত্ব নামে ষষ্ঠ ধ্যানী বুদ্ধ আবির্ভূত হলেন। তাঁর নারীশক্তিকে বলা হল বজ্রধাতেশ্বরী। নতুন একটি মার্গদর্শন প্রতিষ্ঠিত হল। মহাযান সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় স্তরটি হল বজ্রযান। বজ্রযান পদ্ধতির সঙ্গে হিন্দু তান্ত্রিক পদ্ধতির অনেক সাদৃশ্য বিদ্যমান। বজ্রযানীরা মনে করে থাকেন, নির্বাণের পর তিনটি অবস্থা হয়। শূন্য, বিজ্ঞান এবং মহাসুখ। শূন্যত্বের সৃষ্টিকর্তা হলেন নাগার্জুন। তিনি বলেছেন, দুঃখ, কর্মফল, সবই শূন্য। বজ্রযানীরা মনে করেন নিরাত্মা হল নির্বিকল্প জ্ঞান। জীবের আত্মা নির্বাণপ্রাপ্ত হলে নিরাত্মাতে বিলীন হয়। এখানে নিরাত্মাকে এক শক্তিশালী দেবী হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। বোধিচিত্ত যখন নিরাত্মাতে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন, তখন মহাসুখের উৎপত্তি হয়।

বজ্রযানের সর্বোচ্চ দেবতা হলেন বজ্রসত্ত্ব। তিনি বজ্র স্বভাবের অধিকারী। তাঁর প্রভাবে বোধিচিত্ত স্থির ভাব প্রতিপন্ন করে। বজ্রযানে মৈথুন যোগের ওপর বিশেষ গুরত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মৈথুনের ফলে চিত্তের যে চরম আনন্দভাব জাগে, তাই হল বোধিচিত্ত।

বোধিচিত্তের আনন্দ চার ধরনের—আনন্দ, মহানন্দ, সহজানন্দ এবং বিরমানন্দ। আলিঙ্গন, চুম্বন, স্তনমর্দন প্রভৃতি সাহায্যে বজ্রপদ্ধ সংযোগে যে আনন্দ অনুভূত হয়, তাই হল আনন্দ। তারপর আমরা ধীরে ধীরে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হন। যখন পদ্মান্তর্গত বজ্রের চালনের মাধ্যমে মনিমুল বোধিচিত্ত প্রাপ্তি হয়, তখন তাকে বলে পরমানন্দ। আবার মনিমুল থেকে পদ্মদ্বয়ের অন্তর্গত রাগ—বিরাগের অতিরিক্ত শূন্য স্বভাবোস্থিত মন, মনেই অন্তর্নিবিষ্ট হয়। দেহ সৎ সুখে মূর্চ্ছাপন্ন হয়। তখন এমন এক নিস্তরঙ্গ আনন্দ অনুভূত হয়, যাকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। একেই বলে সহজানন্দ।

এই সময় এক বিকল্প অনুভব লাভ করা হয়, তাকে বিরমানন্দ বলে। বজ্রযানীরা বলে থাকেন, ইন্দ্রিয় দমন করতে হলে আগে সেগুলিকে জাগ্রত করতে হবে। আর এই জাগরণের উপায় হল মিথুন। মিথুনজাত আনন্দকে অর্থাৎ বোধিচিত্তকে মন্ত্রশক্তির সাহায্যে স্থায়ী করা সম্ভব হয়। এই অবস্থায় ইন্দ্রশক্তি দমিত হয়। সাধক তাঁর দীর্ঘকালীন সাধনার মাধ্যমে মন্ত্র বা ধ্যানের অবস্থানে পৌঁছে যান। আর তখনই বিভিন্ন দেবদেবীকে আমরা আমাদের রূপকল্পনার মধ্যে দেখে থাকি। মৈথুন অবস্থায় আমাদের মনের ভেতর যে অনুভূতি জাগ্রত হয়। তার মাধ্যমেই সাধক চোখের সামনে দেবদেবীদের প্রত্যক্ষ করেন। এক—এক দেবদেবী এক—এক স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে এক—একটি মণ্ডল সৃষ্টি করেন। এই মণ্ডলে নিঃশব্দে ধ্যানরত অবস্থাতেই বোধিচিত্ত বজ্রের মতো কঠিন হয়।

এই সাধনার মূলে আছে মন্ত্র, মুদ্রা এবং মণ্ডল। এগুলিকে ঠিকমতো পালন করলে আমরা প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করতে পারি। চরম সত্য এবং জ্ঞান লাভ করতে পারি।

বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকেরা মন্ত্রকে শব্দবীজ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। শব্দবীজের সাহায্যে একজন তন্ত্রসাধক দেবদেবীর মূর্তি পরিগ্রহ করেন। আর এইভাবে দেবদেবী সমাবেশ মণ্ডলের সৃষ্টি করেন। মণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে থাকেন অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। তারপর মুদ্রার মাধ্যমে দেবতাদের আহ্বান করা হয়। এই সাধনায় পঞ্চস্কন্ধের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি না হলে পুনর্জন্ম, সংসার, দুঃখ, মায়া—মমতা প্রভৃতি থেকে মুক্তি লাভ করা যায় না। পঞ্চস্কন্ধের মূল শক্তি হল কুল। কুলকে সহজে অতিক্রম করা যায় না। বজ্র, পদ্ম, কর্ম, তথাগত এবং রত্ন—এই পাঁচটিকে পঞ্চকুল নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি কুলে একটি করে নারী শক্তি আছে, যথাক্রমে জেম্বি, নটী, রজকী, ব্রাহ্মণী এবং চণ্ডালি। তাদের একত্রে আমরা পঞ্চবুদ্ধি শক্তি বলে থাকি। এই পাঁচটি বুদ্ধিশক্তিকে আবার পঞ্চ নামে চিহ্নিত করা হয়—বৈরোচন, অক্ষোভ্য, রত্নসম্ভব, অমিতাভ এবং অমোঘসিদ্ধি।

এইভাবে বৌদ্ধ—তান্ত্রিকরা মাতৃসাধনায় মগ্ন হলেন। বৌদ্ধগোষ্ঠীর দীপঙ্কর এবং শ্রাবক নাম্নী সাধকরাই এক্ষেত্রে বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা জনসাধারণের কাছে একটি নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন যে, স্বয়ং ভগবান বজ্রসত্ত্ব হলেন পরম পৌরুষের প্রতীক। তিনি তাঁর শক্তির সাথে মিলিত হয়ে সহজানন্দ লাভ করেছিলেন। গৌড়বঙ্গে এই সময় বজ্রযান বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছিল। যখন ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে, তখন গৌড়বঙ্গ ছিল তার শেষ আশ্রয়স্থল। গৌড়বঙ্গে বৌদ্ধ সাধকেরা ইন্দ্রিয় চরিতার্থস্বরূপ সহজ সরল ধর্মের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেন। সুখবিলাসী জনসাধারণের মধ্যে কেউ কেউ এই ধর্মের প্রতি অপরিমাপ্য ভালোবাসা পোষণ করছিলেন। কিন্তু বজ্রযানের সাধন পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত গুহ্য। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। এছাড়া কোনও গুরু ছাড়া কেউ এই ধর্মের গূঢ় বিষয়গুলি ব্যক্ত করতে পারতেন না। গুরুর প্রত্যক্ষ উপদেশ বা নির্দেশ ব্যতীত এই ধর্মে সাধন করা ছিল নীতিবিরুদ্ধ এবং শাস্ত্রবিরোধিতা।

বৌদ্ধসিদ্ধাচার্যগণ তখন একটি সহজ সরল ধর্মমত প্রচারের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতা অনুভব করলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, এইভাবে গুরু—শিষ্যকেন্দ্রিক গুহ্য ধর্মমত জনসাধারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না। তাই বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম থেকে বৌদ্ধ সহজযানের উদ্ভব হল। সহজযানীরা যেমন একদিকে ব্রত, উপবাস, পূজাপাঠ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণে যোগ দিতেন, অন্যদিকে আবার নর—নারীর সার্থক যৌন মিলনকে পরমার্থসূচক আনন্দের দ্যোতক হিসাবে গ্রহণ করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, পাল রাজাদের রাজত্বকালে বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম বিশেষ প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল। এটাই হল ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ। পৃথিবীর যে কোনও দেশের ধর্মান্দোলন এবং ধার্মিক ভাবনার বিস্তৃতি ও প্রসারের ওপর আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাব যে ধর্ম স্থানীয় রাজা বা নৃপতির আনুকূল্য লাভ করেছে, সেই ধর্ম গ্রহণ করতে প্রজারা বাধ্য হয়েছেন। এর অন্তরালে তাৎক্ষণিক লাভের আশা এবং অর্থনৈতিক নিশ্চিন্ততার বিষয়টি লুকিয়ে আছে। বঙ্গদেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তাই দেখা গেল, পালরাজাদের আমলে অবিভক্ত বঙ্গদেশের সর্বত্র বৌদ্ধতন্ত্র শাস্ত্রের জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে। মহাযানী বৌদ্ধদের মতে, আমাদের সাধনার মূল উদ্দেশ্য হল বোধিচিত্ত উৎপাদন। এজন্য স্থূল জগৎ থেকে ফিরে সম্ভোগকায়ে এবং সেখান থেকে ধর্মকায়ে ফিরে যেতে হবে। এছাড়া সহজিয়া বৌদ্ধরা চতুর্থ কায়—এর সন্ধান দিয়েছিলেন। একে সহজকায় বলা হচ্ছে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের শরীরের ভেতর এই চারটি কায় অবস্থিত। আর শরীরের ভেতর যে অশরীর সত্তা বিদ্যমান, তিনি হলেন স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ।

বোধিচিত্তের মধ্যে আবার দুটি রূপ আছে; এক, সংবৃত রূপ, এবং অন্যটি পারমার্থিক রূপ। বোধিচিত্তকে আমরা দেহের বীর্যস্বরূপ পরম ধাতু বলে থাকি। চঞ্চল নিম্নগতিতে সে বিশ্বসৃষ্টির প্রবাহকে নির্মাণ করে। আবার ঊর্ধ্বগতিতে সে হয় পরমানন্দের কারণ। তখন তার হাতে হাত রেখে আমরা চিরমুক্তির পথ অন্বেষণ করতে পারি। এই পরমানন্দকেই বলা হয়েছে মহাসুখ। আর এই মহাসুখের জন্য নারী—পুরুষের মিলন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তা না হলে আমরা মহাসুখকে অনুভব করতে পারব না।

খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গদেশে এই জাতীয় বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কারণ তখন পালরাজারা এই ধর্মকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। পাল রাজবংশের অবলুপ্তির পর বঙ্গদেশে এলেন সেনবংশের রাজারা। তাঁরা ছিলেন শৈব বা বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁরা বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করতেন না। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে বৌদ্ধধর্মের অধঃপতন শুরু হল। বখতিয়ার খিলজী যখন বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন তখন বৌদ্ধধর্ম একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। যাঁরা শেষ পর্যন্ত মুসলমান আক্রমণকারীদের হাত থেকে প্রাণরক্ষা করতে পেরেছিলেন, তাঁরা নেপাল, তিব্বত, ভুটান প্রভৃতি অঞ্চলে চলে গেলেন। আবার কেউ কেউ হিন্দুধর্মের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। শক্তিসাধনা এবং সহজ—ভজনকে আমরা বজ্রযানের রূপান্তরণ সংস্করণ বলতে পারি। যাঁরা সহজভজনে ব্রত ছিলেন, তাঁরা যে হঠাৎ গৌড়বঙ্গের সাধারণ মানুষের মন থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, এমন কষ্টকল্পনা করা কখনও উচিত নয়। তাই দেখা গেল তখনও বৌদ্ধসাধনা অন্যভাবে বঙ্গদেশে প্রচলিত হয়েছে। মহাযানীদের অনেক দেবী শিবের সঙ্গে যুক্ত হলেন, অথবা শৈবমণ্ডলে এসে পড়লেন। মহাযানীরা তারা, হারীতী, বাগেশ্বরী প্রভৃতি দেবীকে পুজো করতেন। তাঁরা শিবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চণ্ডী, মনসা, শীতলা বা সরস্বতী হিসাবে দেখা দিলেন। রামাই পণ্ডিত যে ধর্মপূজা বিধানের কথা বলেছিলেন সেখানে বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে বুদ্ধের নাম করা হয়েছে। অনেকে আবার জগন্নাথকে এনে বুদ্ধের স্থান দখল করার চেষ্টা করলেন।

তাই আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, সহজভজনের ধারা অন্তঃসলিলা হয়ে বঙ্গদেশের ধর্ম—চিন্তনকে প্রভাবিত করল। এর পাশাপাশি বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে এল সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম। অনেকে বলে থাকে, বৌদ্ধসহজিয়ারাই ধীরে ধীরে বৈষ্ণবসমাজে অনুপ্রবিষ্ট হন। তাঁরা বৈষ্ণবসহজিয়া নাম গ্রহণ করেন। আর নিজেদের মধ্যে এক গূঢ় সাধন ভজন প্রচার ও প্রসারে ব্রতী হন।

বৈষ্ণবসমাজে প্রবেশ করার পর বৌদ্ধ ন্যাড়া—নেড়ীরা বৈষ্ণবসহজিয়া নামে একটি উপ—সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিলেন। চতুর্দশ শতকের কবি বড়ু চণ্ডীদাস হলেন এই মতের উদ্ভাবক। সপ্তদশ—অষ্টাদশ শতকে বাংলাদেশে বৌদ্ধসহজিয়াদের অনুকরণে এই মত যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। এই মতাবলম্বীরা নিজেদের সহজ পথের পথিক বলে গণ্য করতেন। তাঁরা বললেন যে প্রেমসাধনার মাধ্যমে আমরা অনাস্বাদিত আনন্দ লাভ করতে পারি। আর এর জন্যই মানুষকে বারবার সাধক হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে হয়। বৈষ্ণবসহজিয়া প্রেম বৌদ্ধসহজিয়া থেকে উদ্ভূত। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে রাধাকৃষ্ণের প্রেম আবার নব আঙ্গিকে উদ্ভাসিত হল।

সহজিয়ারা বলে থাকেন যে, রাধাকৃষ্ণ শুধুমাত্র বৃন্দাবনের গোপ—গোপিনীদের দশচক্র আস্বাদন করিয়েছিলেন তা নয়, তাঁরা মানব—মানবীর মধ্যে দিয়ে নিত্য তাঁদের লীলা প্রকাশ করেন। হিন্দু এবং বৌদ্ধ তন্ত্রমতে, প্রত্যেক পুরুষ স্বরূপে শিববিগ্রহ এবং নারী শক্তিবিগ্রহসম বিদ্যমান। আবার সহজিয়া মতে পুরুষ হলেন কৃষ্ণ, আর নারী হলেন রাধা। বৈষ্ণব সিদ্ধাচার্যরা বলে থাকেন হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার অংশ। সাধনা সিদ্ধিতে শ্রীকৃষ্ণের ষোড়শ কলারূপিণী হ্লাদিনী শক্তি রাধাতে পরিণত হন। কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর অপরোক্ষভাবে মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

এই ধর্মের সাধনা যাঁরা করেছিলেন তাঁরা তন্ত্রমতে আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকেন। তাঁরা বলতে থাকেন যে, আমাদের শরীরের মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না নামে তিনটি প্রধান নাড়ী আছে। তার মধ্যে ইড়া হল অমৃতবহা নাড়ী। পিঙ্গলা বিষবহা নাড়ী। একজন তন্ত্রসাধক দীর্ঘদিন ধরে পরম নিষ্ঠা ভরে ব্রহ্মচর্য পালন করেন এবং ঊর্ধ্বরেতা হওয়ার সাধনা করেন। যদি কোনওভাবে আমরা সেই অবস্থায় পৌঁছোতে পারি তাহলে ইড়া ও পিঙ্গলার মুখদ্বয় সংযোজিত হবে। তখন মূলাধারে সুপ্ত কুণ্ডলিনীর জাগরণ ঘটবে। এই অবস্থায় শক্তি তার বহু ঈপ্সিত চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত করবে। শক্তি জাগরিত হলে সুষুম্না নাড়ী দুয়ার উন্মুক্ত হবে। তার মাধ্যমে শক্তি ঊর্ধ্বে উত্থিত হবে, সহস্রারে শিবের সঙ্গে মিলিত হবে। শিব ও শক্তির মিলনে তখন সাধক—সাধিকা এমন আনন্দ লাভ করবেন যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

আবার বৈষ্ণব সহজিয়ারা বলে থাকেন যে, এই নাড়ীত্রয়ের সম্মিলনের মাধ্যমে আমরা সর্বত্র প্রেমকে উপলব্ধি করতে পারি। এর ফলে জগৎ প্রপঞ্চের উৎপত্তি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হবে। তাঁরা এইভাবে রাধা—কৃষ্ণের মিলনকে অন্য এক আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলে থাকেন যে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম পৃথিবীর সমস্ত নর—নারীর প্রেমের অংশমাত্র। তাঁদের মতে, স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব স্ত্রী—শক্তি সহকারে সহজ সাধনা করেছিলেন। আবার বৌদ্ধসহজিয়াপন্থীরা এই বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন, ভগবান বুদ্ধ স্ত্রী গোপার সঙ্গে সহজ সাধনা অভ্যাস করেছিলেন।

বৈষ্ণবসহজিয়াপন্থীদের সঙ্গে বৌদ্ধসহজিয়াপন্থীদের উল্লেখযোগ্য সাদৃশতা পরিলক্ষিত হয়। বৈষ্ণবসহজিয়ারা বলে থাকেন যে, তাঁদের চন্দ্র আছে চারটি—নখচন্দ্র, মুখচন্দ্র, গণ্ডচন্দ্র ও গুপ্তচন্দ্র। আর বিভিন্ন পদ্ম আছে আমাদের শরীরে, যেমন নাভিপদ্ম, উরুপদ্ম, আঁখিপদ্ম ইত্যাদি। দেহের অভ্যন্তরস্থ সরোবরগুলির কল্পনায় বৌদ্ধতান্ত্রিক চক্রকল্পনার মিল আছে। কিন্তু নামে ও স্বরূপে তা স্বতন্ত্র। বৈষ্ণবসজিয়ারা একে অক্ষয় সরোবর, প্রেম সরোবর ও কাম সরোবর বলে থাকেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে তাঁরা বৌদ্ধধর্মের দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

সহজযানী গুরুরা মনে করেন, প্রত্যেক শিষ্যের মধ্যে একটি আলাদা আধ্যাত্মিক প্রবণতা লুকিয়ে আছে। এইভাবে তাঁরা পাঁচটি কুলের নামকরণ করেছেন—ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী। পাঁচটি কুল হল প্রজ্ঞা বা শক্তির পাঁচটি দিক। এই বিষয়টি বৌদ্ধধর্মের বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বুকে যে বৈষ্ণব সহজিয়াপন্থীদের জন্ম হয়, তাঁরা বৌদ্ধধর্মকে অন্য কোনও পরিপ্রেক্ষিতের মাধ্যমে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, নর—নারীর প্রেমের মধ্যে এক অপার্থিব আনন্দ লুকিয়ে আছে। সহজিয়া অনুসারে বলা হয়, নর—নারী দৈহিক রূপের মধ্যে তাঁদের স্বরূপ বা সহজ রূপ নিহিত। রাধা এবং কৃষ্ণলীলাকে আমরা দেহী মিথুনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করতে পারি। তাই বৌদ্ধসহজিয়াপন্থীরা নারী—পুরুষের মিলনে আপত্তি করেননি। কারণ তাঁরা জেনেছেন যে, যখন নর—নারী সব কিছু ভুলে পরস্পর মিলিত হয়, তখন কাম প্রেমে পরিণত হয়।

বাঙালি বৌদ্ধ মাতৃসাধনার সাথে প্রেমসাধনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার মিলন অথবা হর—গৌরীর মিলন সুখের মধ্যে আমরা ষেই সাধনার দুটি দিককে পরিষ্কার বুঝতে পারি। সাধক—সাধিকারা নিজেদের মধ্যে কৃষ্ণসত্তা বা রাধাসত্তা আরোপ করেন। তাঁরা যৌন—যৌগিক সাধন পথে অগ্রসর হয়ে অনির্বচনীয় প্রেম উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন।

প্রসঙ্গত আমরা বৌদ্ধধর্মে অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে গৃহীতা দুই মাতৃদেবীর কথা বলব। তাঁরা হলেন যথাক্রমে তারা এবং স্থিরচক্রমঞ্জুশ্রী।

দেবী তারা হলেন মহাযানী বৌদ্ধদের কাছে ‘নারী বোধিসত্ত্ব’ এবং বজ্রযানীদের কাছে ‘নারী বুদ্ধ’। তাঁকে আমরা মুক্তির দেবীর হিসাবে কল্পনা করেছি। তিনি যে কোনও কর্মে সাফল্য আনতে পারেন। মানুষ তার জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে যে সমস্ত কৃতিত্বের অধিকারী হয়, দেবী তারা সেই সকল ক্ষেত্রে মানুষকে সাহায্য করে থাকেন। তিব্বতে তিনি হলেন ‘জেতসুনদলমা’, জাপানে ‘তরনি বোসাতসু’ আর চিনে তাঁর নাম ‘তুত্তলুত্ত’। এই শব্দগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারব যে, একসময় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এক বৃহৎ ভূখণ্ডে দেবী তারা অন্যতম পূজিতা দেবী হিসাবে আরাধ্যা ছিলেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে এই দেবী তারা কিন্তু এক তান্ত্রিক ধ্যানমূর্তি। বজ্রযানী বৌদ্ধদের তিব্বতী শাখা এই দেবীর উপাসনা করে থাকেন। তাঁরা বলে থাকেন নিয়ম—নিষ্ঠা সহকারে দেবী তারার উপাসনা করলে সহমর্মিতা এবং শূন্যতার মতো নানা ধরনের মানসিক অন্তর্গুণের অধিকারী হওয়া যায়।

বোধিসত্ত্বরা বুদ্ধের বিভিন্ন গুণের প্রজ্ঞা উপমা হিসাবে একাধিক দেবীকে কল্পনা করেছেন। তারা তাঁদের অন্যতমা।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে উৎখননের ফলে তারাদেবীর কিছু কিছু মূর্তি পাওয়া গেছে। যেমন তাঁর একটি দারুমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে অধুনা মুম্বাইয়ের কাছে কানহেরি ৩১ নং গুহার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে। এই মূর্তিটি সম্ভবত পূর্ব ভারত থেকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর সার্বিক গঠন সৌকর্ষ দেখে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখানে পালযুগের ভাস্কর্যশৈলীর ছাপ আছে। মূর্তিটির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারি না।

এছাড়া বঙ্গদেশেও তারাদেবীর দুটি—একটি ভগ্নপ্রায় মূর্তি পাওয়া গেছে। আমরা বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্রানুসারে জানতে পেরেছি যে, তারা দেবী কমলাসনের ওপর পদ্মাসনা হয়ে ধ্যানমগ্না। তাঁর আয়ত চক্ষুদ্বয় অর্ধ—নিমীলিত। তাঁর দৃষ্টি নাসাগ্রে নিবদ্ধ। দেবী সকচ্ছ—পদ্ধতিতে খাটো ধুতি পরিহিতা। এবং তাঁর কাপড়ের দুই প্রান্ত পিছন দিকে বাঁধা। সে যুগের উচ্চবর্গীয় শিল্প—ভাবনার নান্দনিক দর্শনানুসারে তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ নগ্ন, শুধু স্তনযুগলকে ঢেকে রাখার জন্য গলায় কিছু হারের আভাস দেওয়া হয়েছে। দেবীর মাথায় রয়েছে কারুকার্যখচিত লম্বা চোঙের মতো একটি মুকুট। কানে গোলাকার বড়ো বড়ো কুণ্ডল বা দুল।

এই তারা মূর্তিটিকে যদি আমরা অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সাথে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে বলব এর মধ্যে এক ধরনের শরীরী—উষ্ণতা ও আধ্যাত্মিক আনন্দের বিরল সংমিশ্রণ ঘটে গেছে। এই জাতীয় মূর্তি দেখে বিখ্যাত মূর্তিবিশারদেরা মন্তব্য করেছেন যে, এমন মূর্তি শুধুমাত্র দৈহিক তৃপ্তিলাভের জন্য পূজিতা হন না, এর অন্তরালে থাকে সাধক—সাধিকার আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা।

রামপাল থেকে আমরা স্থিরচক্র মঞ্জুশ্রীর মূর্তি আবিষ্কার করেছি। সংস্কৃত ‘মঞ্জুশ্রী’ কথাটির বাংলা অর্থ হল ‘মার্জিত দীপ্তি’। বৌদ্ধদের মহাযানপন্থীরা বলে থাকেন, ইনি হলেন বোধিসত্ত্বের ষোলোটি রূপের মধ্যে দ্বিতীয় অর্থাৎ মৈত্রেয়র পরে এনার অবস্থান। তিনি ঐশ্বরিক জ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার বৌদ্ধধর্মের গুহ্য সাধকেরা এঁকে ধ্যান মূর্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। কখনও কখনও তাঁকে ‘মঞ্জুঘোষ’ অর্থাৎ ‘মার্জিত কণ্ঠস্বরের অধিকারিণী’ নামে ডাকা হতো। তাই মনে করা হয়ে থাকে যে, ইনি হলেন সঙ্গীত—সাধিকা। মানুষের মধ্যে যেসব সৃজনশীল গুণাবলী রয়ে গেছে, তিনি সেই সব গুণে প্রকাশিতা।

অবলোকিতেশ্বরের পরে মঞ্জুশ্রী হলেন বৌদ্ধ দেবদেবীদের মধ্যে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে আমরা হিন্দুদের দেবী সরস্বতীর সাথে তুলনা করতে পারি। কারণ তিনি হলেন বিদ্যার দেবতা। তাঁর এক হাতে অশিক্ষা দূর করবার জন্য তরবারি এবং অন্য হাতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য পুস্তক সংযুক্ত হয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই দেবীর তরবারি হল অন্ধকারকে ছিন্ন করার অস্ত্র। এই অন্ধকার অজ্ঞানতার অন্ধকার। তাঁর অন্য হাতে বরদামুদ্রা প্রকাশিত হয়। এই দেবীর গায়ের রং সাদা। তাঁর পরিধেয় বস্ত্রের রং মৌমাছির মতো হলুদ। একটি পদ্মফুলের ওপর রাখা চাদের ওপর তিনি আসীনা। তাঁর মধ্যে আছে এমন এক আবেগময় প্রেমের আচ্ছাদন, যা সহজে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি চিরক নামের এক ধরনের ওড়নায় তাঁর মুখ আচ্ছাদিত করেছেন। তাঁর অঙ্গে শোভা পাচ্ছে রাজকীয় অলঙ্কারসমূহ। সাধনা অনুযায়ী, এই দেবীর সাথে সুন্দরী প্রজ্ঞার থাকার কথা। তবে এই বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

এই দারুবিগ্রহের মধ্যে আছে কোমলতা এবং উজ্জ্বল কামুক ভাব। কোনও কোনও অঞ্চলে প্রাপ্ত মঞ্জুশ্রী মূর্তিতে দেবীর চক্ষুদুটিকে অর্ধ—নিমীলিত অবস্থায় দেখা যায়। তিনি ধ্যানমগ্না। তাঁর ডানহাতে ছোট্ট একটি তরবারি। হালকাভাবে ধরা আছে। তাঁর পরনে খাটো সকচ্ছ ধুতি। দীর্ঘ চিরক গায়ের ওপর আলগাভাবে জড়ানো। কাপড়ের প্রান্তগুলো কটিবন্ধ থেকে কুঁচি করে দু’পাশে ঝোলানো। দেবীর মাথায় লম্বা চোঙাকৃতি মুকুট দেখতে পাওয়া যায়। কানে কুণ্ডল, গলায় মোটা হারের গাছি, হাতে চুড়ি, বাহুতে বাজুবন্ধ।

এই মূর্তিটিকে অনেকে আবার পুরুষমূর্তি হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু এই মূর্তির ঊর্ধ্বাংশ দেখলে বুঝতে পারা যায়, ইনি হলেন দেবী প্রতিমা। এই দেবী প্রতিমার মধ্যে আছে কাঙ্ক্ষিত নমনীয়তা এবং ঐশ্বরিক কামুকতা।

কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁকে আবার অন্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে তিনি এক পূর্ণযৌবনা মহিলা হিসাবেই গৃহীতা।

ভাবতে ভালো লাগে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের হিংসাত্মক পুনরুজ্জীবনের পরেও বাংলার সাধারণ মানুষের মনের গোপন গভীর অন্তঃপুরে বৌদ্ধ ধর্মসাধনা স্থান করে নিতে পেরেছিল। আজও যখন কোথাও মনসাপুজোর ঢাক বেজে ওঠে, ধর্মঠাকুরের নামে আমরা জয়ধ্বনি করি, তখন মনে পড়ে যায়, গৌতম বুদ্ধের সেই করুণা ঘন মহামূর্তির কথা। শুধুমাত্র প্রেম এবং ভালোবাসা দিয়ে যিনি একদা বিশ্বজয় করেছিলেন। আর এভাবেই বোধহয় আজও অবিভক্ত বঙ্গের আকাশে—বাতাসে তাঁর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত হয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আচারে—আচরণে তিনি সুস্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। কোনও শত্রু বহু চেষ্টা করেও বৌদ্ধধর্মের বিষয়গুলিকে বাংলার হৃদয় থেকে সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত করতে সমর্থ হবেন না। এটাই হল গৌতম বুদ্ধের সবথেকে বড়ো সাফল্য।

অধ্যায় ১১ / ১১

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন