শাক্তপদাবলীর দেবী

পৃথ্বীরাজ সেন

শাক্তপদাবলীতে দুই ধরনের দেবীর অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়েছে। একদিকে তিনি আমাদের আদরিণী কন্যা উমা, অন্যদিকে কালোরূপিণী শ্যামা। উমাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত শাক্তপদাবলী রচিত হয়েছে তাদের আগমনী ও বিজয়ার গান বলা হয়। আর শ্যামাকে কেন্দ্র করে রচিত শাক্তপদাবলীকে বলে শ্যামা সঙ্গীত।

দুর্গা আমাদের কাছে নানারূপে আবির্ভূতা হয়ে থাকেন। কখনও তিনি উমা, কখনও পার্বতী, আবার কখনও তিনি দক্ষকন্যা সতী। তাঁকে চণ্ডিকা নামেও ডাকা হয়। পুরাণ তন্ত্রাদিতে এই দেবীর বিভিন্ন নামকরণের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এই দেবী কালে কালান্তরে নানাভাবে বিবর্তিত হয়েছেন। তাঁর সাথে সংযুক্ত কেন্দ্রীয় শক্তিটিও বারেবারে বিবর্তিত হয়েছে। আবার এই দেবীর শক্তির সাথে কালিকাশক্তির সাদৃশতা পরিলক্ষিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে যদিও দুর্গোৎসব হিন্দু বাঙালির সব থেকে বড় অনুষ্ঠান, কিন্তু বাংলাদেশে শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে কালী বা কালিকাই প্রধান।

কবির ভাষায় দেবী দুর্গা নানাভাবে প্রতিভাত হয়েছেন। কখনও বলা হয়েছে যে তিনি অতসী কুসুম বর্ণাভাযুক্ত। দীপ্তিতে মঙ্গলময়ী মাতৃমূর্তিতে বিরাজমানা। আবার কখনও তাঁকে স্নেহের হেমকান্তিতে প্রস্ফুটিতা স্নেহের দুলালি আদরিণী কন্যা হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। শব্দের এই সংযোজন এবং বিশেষণের সার্থক ব্যবহারই প্রমাণ করে যে দেবী দুর্গার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক কতখানি আন্তরিক এবং আত্মিক। প্রত্যেক হিন্দু বাঙালি দুর্গাদেবীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং সম্মান করে থাকেন। যে কোনও কাজে যাবার আগে তাঁর নাম স্মরণ করা হয়। শুধু কি তাই? দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে আমরা যে বিশাল সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধার্মিক আনন্দোৎসবের আয়োজন করে থাকি, বিশ্বে তার তুলনা বিরল।

‘উমা’ শব্দটি কোন ভাষার কোন ভাণ্ডার থেকে সংগৃহীত হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের এখনও শেষ হয়নি। এটি সম্ভবত সংস্কৃত শব্দ নয় কেননা এর কোনও প্রকৃতি, প্রত্যয় নির্দেশিত হয়নি।

এই প্রসঙ্গে আমরা বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের কথা বলব। তিনি তাঁর ‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেছেন—অভিধানে ইহার স্পষ্ট কোনও প্রকৃতি প্রত্যয় নির্দেশ করা হয় নাই।

তবে এই বক্তব্যটি কি যথাযথ? গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং গোপিকামোহন ভট্টাচার্যের সংকলিত A Trilingual Dictionary—তে স্পষ্ট লেখা আছে—উমা স্ত্রী (pg 4)— উ + মা — প + প্য।

উমা শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে পার্বতী, গৌরী, দুর্গা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি হিমালয় ও মেনকার কন্যা, কৃতি, শান্তি, কান্তি এবং অতসী পুষ্প।

অনেকে আবার ‘উমা’ এই শব্দের একটি অন্য প্রকৃতি বা অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন। ‘উ’ শব্দের অর্থ শিব, ‘মা’ শব্দের অর্থ শ্রী। যেহেতু উমা শিবের স্ত্রী তাই তাঁকে শিবের শ্রী বলা হচ্ছে। ‘মা’ শব্দের অর্থ যিনি মননকারী। আবার যিনি শিবকে পতিরূপে পাবার জন্য ধ্যান করেছেন তিনি হলেন উমা। ‘মা’ শব্দের পরিমাপ করার অর্থ অনুভূত হতে পারে। শিবের যিনি পরিমাপক অর্থাৎ যার মধ্যে দিয়ে অপরিমেয় শিব সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মগ্ন হন তিনি হলেন উমা। উমা হলেন শিবের শক্তিরূপিণী সত্তা।

এখানে এক চমকপ্রদ তত্ত্ব উল্লেখ করা যেতে পারে। তাহলো, উমা নামটি হিমালয় কন্যার কোনও নাম না, মূলত তিনি পার্বতী বা গিরিজা নামেই খ্যাতা ছিলেন। এই নামটি পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে। এই সংযোজনের কারণ কি? প্রসঙ্গত আমরা ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের কথা বলব। ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘উমা’ কথাটির যে সকল ব্যুৎপত্তি দেওয়া হইয়াছে তাহার কোনোটাই সর্বজনগ্রাহ্য নহে। কিন্তু আমরা দেখিতে পাই ‘মাতৃ’ শব্দের ব্যবলনীয় প্রতিশব্দ হইতেছে ‘উমু’ বা উম্ম। এক্কাডিয় বা অ্যাকাডিয়ান প্রতিশব্দ উম্ম। দ্রাবিড়ীয় প্রতিশব্দ হচ্ছে উমা। এই শব্দগুলি পরস্পরের সাথে মিলে গেছে এবং ভারতীয় উমা শব্দটির সাথে মিলিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে তিনি আরও মন্তব্য করেছেন—প্রাচীন পার্বতী দেবী দুর্গা বা চণ্ডীর সঙ্গে যেভাবে সংযুক্ত হয়েছেন উমা কিন্তু সেভাবে হননি।

আমরা জানি উমা কন্যা হিসাবেই সমধিক প্রতিষ্ঠিত। বৈদিক যুগের একেবারে শেষদিকে আমরা দুর্গা, ভবানী, ভদ্রকালি প্রভৃতি নামগুলি পেয়েছি। তখন তিনি ছিলেন এক অপ্রধানা দেবী। আবার পার্বতী—উমা ধারায় ধারাবাহিকতায় এসেছে অম্বিকা, ভবানী, ভদ্রকালি প্রভৃতি নাম।

দেবীপূজার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে পার্বতী—উমা ধারাটি প্রাচীনতম। দক্ষ কন্যা সতী উমার পূর্ববর্তিনী। মহাকবি কালীদাস তাঁর কুমারসম্ভব কাব্যে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এখানে আর একটি চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরা যেতে পারে, তা হল যে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের গল্প শুনে আমরা শিহরিত হই সেই কাহিনি কিন্তু বৈদিক সাহিত্য কিংবা রামায়ণ—মহাভারতে নেই। এটি হল পুরাণ সঞ্জাত কাহিনি।

প্রচলিত কাহিনি থেকে জানা যায় যে দক্ষযজ্ঞে শিবের নামে নানা ধরনের ভর্ৎসনা উচ্চারিত হতে থাকে। দক্ষ এইভাবে তার জামাতাকে নিন্দা করায় সতী সেখানে আর স্থির থাকতে পারেননি। তিনি দেহত্যাগ করেন। এই খবর শিবের কাছে পৌঁছে গেলে তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি সতীর মৃতদেহ নিয়ে মহাপ্রলয়ের ছন্দে নেচে ওঠেন। তখন প্রজাপালক এবং পৃথিবী রক্ষক বিষ্ণু এগিয়ে এসে তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ কর্তন করতে থাকেন। এইভাবে ভারতে এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে একান্নটি সতীপীঠ উৎপন্ন হয়। যেখানে যেখানে সতীর মৃতদেহের অংশ প্রোথিত হয়েছে যেখানেই তাঁকে স্মরণ করে একটি পীঠ গড়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মহাভাগবত পুরাণ, মহানির্বাণতন্ত্র, বৃহধর্মপুরাণ এবং কালিকাপুরাণেও এই জাতীয় কাহিনি উল্লিখিত হয়েছে।

পার্বতী কিন্তু উমা বা দুর্গার তুলনায় পশ্চাদবর্তিনী দেবী। তৈত্তিরীয় উপনিষদের মাধ্যমে আমরা প্রথম দুর্গা শব্দটির সাথে পরিচিত হই। যেহেতু তিনি আমাদের সমস্ত দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তাই তাঁকে দুর্গা বলা হয়েছে। ‘দুর্গা’ এই শব্দটির নানা অর্থ আছে। এই প্রসঙ্গে শব্দকল্পদ্রুম কি বলেছে আমরা একবার তা জেনে নেব।

”দুর্গোদৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি
শোকে দুঃখে নরকে যমদণ্ডে চ জন্মনি।।
মহাভয়েহতিরোগে চাপ্যা শব্দো হন্তৃবাচকঃ।
এতান হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরকীর্তিতাঃ।”

‘দূর্গা’ শব্দের বাচ্য দুর্গ নাম দৈর্ঘ্য। দৈত্য, মহা বিঘ্ন, কর্ম, শোক, দুঃখ, যম, দণ্ড, মহাভয় ইত্যাদি। এর সাথে ‘আ’ শব্দটি যুক্ত হয়ে বলা হয়েছে যিনি এই সকলকে হনন করেন তিনিই হলেন দেবী দুর্গা।

আবার কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, যে দেবী বিপক্ষ সৈন্যদলের হাত থেকে রক্ষা করেন তিনিই হলেন দুর্গা। দেবীপুরাণের পাতায় এমন ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়—

”ত্বং হি দুর্গে মহাতীর্থে দুর্গে দুর্গপরাক্রমে।
সকলো নিষ্কলশ্চৈব কলাতীত নমোহস্তুতে।।”

ভাগবতেও বলা হয়েছে—

”নগরে হয় ত্বয়া মাতঃ স্থাতব্যং মম সর্বদা।
দুর্গা দেবীতি নাম্নাবৈত্বং শক্তিরিহ সংস্থিতা।।”

কবে থেকে আমরা দুর্গার সাধনায় মগ্ন হয়েছি? মহাকাব্য মহাভারত থেকে আমরা দেখতে পাই যে সেখানে যুধিষ্ঠির বিরাটপর্বে দুর্গাকে প্রণাম জানিয়েছেন স্তবের মাধ্যমে। ভীষ্মপর্বে অর্জুন দুর্গার কাছ থেকে সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু এই গল্পগুলি আদি মহাভারতের পাতায় ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। অনেকে বলে থাকেন মহাভারতের যুগে দেবী দুর্গা এতখানি প্রচার এবং প্রসার পাননি। পরবর্তীকালের লেখকরা মহাভারতের সঙ্গে এই গল্পগুলি প্রক্ষিপ্তভাবে সংযোজন করেছেন। তাই মহাভারতে দুর্গা বন্দনা আছে বলে কোনও সর্বজনসম্মত অভিমত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

দুর্গা দুর্গতিনাশিনী এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তিনি অসুর বিনাশ করেছেন, কিন্তু সেই অর্থে তাঁকে দুর্গরক্ষাকারিণী হিসাবে দেখা যায়নি। আবার দুর্গা শস্ত্রধারিণী ও অসুরমর্দিনী। উমার ক্ষেত্রে এইসব বিশেষণগুলি প্রযুক্ত হয়নি। উমা প্রথমে কন্যা রূপে এবং পরবর্তীকালে মাতৃরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন। উমার মধ্যে দেবীত্বের থেকে মানবীত্বের প্রকাশ বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। অনেকে মনে করে থাকেন যে দুর্গা এবং চণ্ডী হলেন অসুবিনাশিনী। কালীর মধ্যেও এক রণোন্মাদিনী রূপ দেখতে পাওয়া যায়। অথচ উমার মধ্যে যে রূপটি পরিস্ফুটিত হয়েছে সেটি শান্ত, স্নিগ্ধ রূপ। মানবমনের বিভিন্ন ভাবনার দ্যোতক বা প্রতীক হিসাবেই এইসব দেবীর কল্পনা করা হয়েছে বলে অনুমান করা যেতে পারে।

এই প্রসঙ্গে আমরা চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবীর কথা আলাদাভাবে বলব। দেবী চণ্ডী এখনও আমাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় আরাধ্যা এক দেবী শক্তি। মার্কণ্ডেয় পুরাণকে অবলম্বন করেই তাঁর প্রতিষ্ঠা। চণ্ডীর মহিমা প্রচারিত হয়েছে মহিষাসুর এবং শুম্ভ—নিশুম্ভ অসুর বধে। চণ্ডী গ্রন্থে দেবী কোথাও শিবরে সঙ্গে সম্পর্কিত নন। তাই আমরা বলতে পারি যে চণ্ডী এবং দুর্গা অভিন্না নন অথচ উমা—চণ্ডীকে আমরা দুর্গার আর একটি রূপ হিসেবে কল্পনা করে থাকি।

ভারতীয় শক্তিসাধনাতে তিনটি ধারা পাশাপাশি বহমান। প্রথম ধারায় দেবী শিবকে আশ্রয় করে প্রস্ফুটিত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধারায় শিব এবং শক্তির সমপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয় ধারায় ত্রিভুবনব্যাপিনী অদ্বিতীয় এক মহাশক্তি উপস্থিত আছেন যিনি দেবী হিসেবে খ্যাতা।

পার্বতী বা সতী, দুর্গা অথবা চণ্ডী শেষ পর্যন্ত এক ধনাত্মক মহাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। কাল থেকে কালান্তরে তাঁর যাত্রাপথ আরও প্রশস্ত হয়েছে। তিনি আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মন অধিকার করতে পেরেছেন। এর পাশাপাশি আর একটি ধারাও বহমান আছে। তা হল দেবী কালিকাধারা। মুণ্ডক উপনিষদে আমরা কালী শব্দটি দেখেছি। কালীকে বলা হয়েছে যজ্ঞ, অগ্নি, শব্দ, জুহ্ব বা একটি জিহ্বা—কালী—করালি, মন জবা চ / সুললিতা বা চ সুধুম্রবর্ণা / স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চ দেবী / বিলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বা।।

মহাভারতেও কালীর উল্লেখ আছে। বিশেষ করে সৌপ্তিক পর্বে আমরা রক্ত নয়না এক শক্তিকে দেখেছি। তিনি সংহারের প্রতীক। তিনি অনায়াসে শত্রু দমন করেন। তিনি কৃষ্ণবর্ণা। তিনি শোণিত লোলুপা। তিনি হলেন রক্ত চামুণ্ডা। এই কালিকা, চামুণ্ডা এবং কালী শেষ পর্যন্ত এক হয়ে গেছেন। কেন এমন ঘটনা ঘটেছে? মানুষ বোধহয় শত্রুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য এমন এক শক্তিশালী নারীকে প্রার্থনা করেছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত কালিকার আবির্ভাব। এই প্রসঙ্গে আমরা ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের লেখা ওই বিখ্যাত গ্রন্থটির সাহায্য নেব। সেখানে এই রূপান্তরণের কথা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—ইন্দ্রাদি দেবগণ শুম্ভ—নিশুম্ভ বধের জন্য হিমালয়ে স্থিতা দেবীর নিকটে উপস্থিত হইলে দেবী শরীর কোষ হইতে নিঃসৃতা হইয়াছিলেন। সেইজন্য সেই দেবী কৌশিকী নামে লোকে পরিগণিতা হইলেন। কৌশিকী দেবী এইরূপে দেহ হইতে বহির্গতা হইয়া গেলে পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হইয়া গেলেন। এইজন্য তিনি হিমাচল বাসিনী কালিকা নামে সমাজখ্যাতা হইলেন।

অর্থাৎ এই অংশটি পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি যে আপাতদৃষ্টিতে দুর্গা ও কালীর মধ্যে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান হলেও তাঁরা একে অন্যের সাথে অভিন্নতা প্রমাণ করেছেন। কালিকা শক্তি এবং দুর্গা শক্তির মধ্যে কোনও মূলগত পার্থক্য নেই।

আবার অনেকে বলে থাকেন যে, অত্যধিক রাগের ফলে অম্বিকার মুখমণ্ডল মসীবর্ণ ধারণ করেছিল। তখন আমরা যে রূপটি দেখতে পাই সে রূপ হল দেবী কালিকার রূপ। দেবী কালী বিচিত্র নরকঙ্কালধারিণী, নরমালা বিভূষণা, করালদ্রংস্ট্রা, ভীষণরূপিণী।

তান্ত্রিক সাধকের চোখে কালিকা মূর্তি নানাভাবে প্রতিভাত হয়েছে। পুরাণ, উপপুরাণ এবং বিভিন্ন তন্ত্রে কালী রূপের যে বিবর্তন আছে সেখানে সব থেকে উল্লেখযোগ্য রূপ হল কালী। তিনি শিবের ওপর অবস্থিতা। তাঁর এক পদ শিবের বুকে ন্যস্ত। তন্ত্রসাধকরা কালীর এই মূর্তিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। সাংখ্যের নির্গুণ পুরুষ এবং ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি তত্ত্ব, এছাড়া তন্ত্রের বিপরীত তত্ত্ব সম্পর্কেও আমাদের জানা আছে। শিবের পরাজয়ে বলরূপিণী শক্তিদেবীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অবশ্য প্রাচীন বর্ণনাতে দেবী কালিকা কিন্তু শিবারূঢ়া ছিলেন না, তিনি ছিলেন শবারূঢ়া। অসুর নিধন করে অসুরদের শব শাসন করার জন্যই তিনি এমন মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। দক্ষিণাকালীর প্রচলিত ধ্যানেও এই কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। পরবর্তীকালে শিব কেন শবের স্থান দখল করলেন? দার্শনিক চিন্তায় বিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবেই এমন ঘটনা ঘটে গেছে। রামপ্রসাদের গানে বলা হয়েছে—

শিব না মায়ের পদতলে।
 ওটা লোক মিথ্যা বলে।।
মায়ের পাদস্পর্শে দানব দেহ।
 শিবরূপ হয় রণ স্থলে।।

অর্থাৎ মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ শিবরূপত্ব প্রাপ্ত করেছে। শক্তিতত্ত্বের প্রাধান্যে শক্তির চরম লগ্ন অসুরের শবই শিবে রূপান্তরিত হয়েছে। বিভিন্ন তন্ত্রে এই রূপান্তরের নানা ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে—তিনি মহাকাল, তিনি সর্বপ্রাণীকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলিয়াই মহাকাল, দেবী আবার এই মহাকালকেই কলন বা গ্রাস করেন, এই নিমিত্তেই তিনি আদ্যাপরম কালিকা। কালকে গ্রাস করেন বলিয়াই দেবী কালী। তিনি সকলের আদি, সকলের কালস্বরূপা এবং আদিভূতা (বাংলার তন্ত্রসাধনা : শশীভূষণ দাশগুপ্ত)।

কালীতন্ত্রে আমরা কালিকার এই মূর্তির ব্যাখ্যা পেয়ে থাকি। কালীতন্ত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালাভূষিতা, বামদিকের অধো হস্তে মুণ্ড, আর ঊর্ধ্ব হস্তে খড়্গ, দক্ষিণের অধো আর ঊর্ধ্ব হস্তে বর ও অভয়মুদ্রা।

দেবী মহামেঘের বর্ণের মতে শ্যামবর্ণা তাই তাঁকে শ্যামা বলা হয় এবং দিগম্বরী, যাঁর কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা হইতে ক্ষরিত রুধির ধারা দ্বারা দেবীর দেহচর্চিত, আর দুইটি শব শিশু তাঁর কর্ণভূষণ। তিনি ঘোর দ্রংস্ট্রা, করাললাস্যা, পীনোন্নত পয়োধারা, শব সমূহের দ্বারা নির্মিত কঞ্চিপরিহিতা হইয়া দেবী হাস্যমুখী, ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় হইতে গলিত রক্তধারা দ্বারা বিস্ফুরিতা, তিনি ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী, শ্মশান—গুহাবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের দীপ্তি সম তাঁর ত্রিনেত্র, তিনি তীক্ষ্ন দন্তা, তাঁহার কেশদাম দক্ষিণব্যাপী আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়পরি অবস্থিতা, তিনি চতুর্দিকে ঘোর রক্তবর্ণ শিবাকোলের দ্বারা সমন্বিতা।

মহানির্বাণতন্ত্রে কালীর এই রূপের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আমাদের অবাক করে দেয়। আমরা বুঝতে পারি কবিরা কতখানি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। পার্বতীদেবী মহেশ্বরকে প্রশ্ন করছেন—

মহৎ যোনিস্বরূপা আদিশক্তিরূপিণী মহাদ্যুতি সম্পন্না সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভূতা যিনি মহাকালী, তাঁর শক্তি নিরূপণ করা কিভাবে সম্ভব?

এই প্রশ্নের উত্তরে সদাশিব জবাব দিচ্ছেন—

হে প্রিয়ে, পূর্বেই কথিত হইয়াছে, উপাসকগণের কার্যের নিমিত্ত পুনঃক্রিয়া অনুসারে যে রূপ প্রকল্পিত হইয়া থাকে শ্বেতপীতাদি বর্ণ যেমন কৃষ্ণে বিলীন হয়, হে শৈলজে, সর্বভূতসমূহ তেমনই কালীতে প্রবেশ করে। এই জন্যই যোগীগণের হিতের জন্য তিনি নির্গুণা, নিরাকার, কালশক্তির বর্ণ কৃষ্ণ বলিয়া নিরূপিত হইয়াছেন। অমৃত তত্ত্বের হেতুই এই নিত্যা কালো রূপা অভয়, কল্যাণরূপিণী ললাটে চন্দ্রচিহ্ন নিরূপিত হইয়াছেন। নিত্যকালী শশী, সূর্য, অগ্নির দ্বারা এই কালোকৃত জগৎসম দর্শন করেন বলিয়া তাঁহার তিনটি নাম কল্পিত হইয়াছে। সর্বপ্রাণীকে গ্রাস করেন বলিয়া এবং কালযজ্ঞের দ্বারা চর্বন করেন বলিয়া তাহাদের রক্তসমূহ এই দেবীর শরীর—বমন রূপে বলা হইয়াছে। সময়ে সময়ে জীবের বিপদ হইতে রক্ষণে এবং স্ব—স্ব কার্যে প্রেরণই দেবীর বর ও অভয় বলিয়া উদ্ভাসিত। রজোঃগুণসমন্বিত বিল্বসমূহতে তিনি ব্যাপ্ত করিয়া অবস্থান করেন, এইজন্যই তিনি ভদ্রে, তিনি রক্তপদ্মাসনাস্থিতা বলিয়া কথিত হন। মোহময়ী সুরা পান করিয়া সেই সর্বদেবী কালসম্ভূত ক্রীড়ামগ্ন সৃষ্টিকে দর্শন করেন। এইভাবে অল্পবুদ্ধি ভক্তগণের হিতের জন্য গুণানুসারে দেবীর বিবিধ রূপ কল্পিত হইয়া থাকে।

তাহলে এই হল দেবী কালিকার মূর্তির দার্শনিক এবং আভিধানিক ব্যাখ্যা। এবার আমরা দেখব যে কিভাবে অবিভক্ত বঙ্গদেশে দেবী দুর্গা দেবী কালিকায় রূপান্তরিত হলেন। বাঙালি সাধক এবং তান্ত্রিকরা কেন পরম শ্রদ্ধা ভরে দেবী কালিকার পুজো করতে শুরু করলেন।

ব্রহ্মযান গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর উক্তি আছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, বঙ্গদেশে দেবী কালিকারূপে পূজিতা। বাংলাদেশে দুর্গাপুজো কালীপুজোর থেকে প্রাচীনতর, কিন্তু সাধকগণ কালের সাধনায় দেবী কালিকাকেই গ্রহণ করে থাকেন। খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে যে ধারার জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল, আজও তা ধারাবাহিভাবে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেক শক্তিসাধনার কেন্দ্রে এক কালীপ্রতিমা বিদ্যমান।

বঙ্গদেশে কোন সময় থেকে দুর্গাপূজার সূত্রপাত তা নিয়ে পণ্ডিতেরা আজও এক বিতর্ক করে থাকেন। এই বিষয় নিয়ে নানা ধরনের গল্পগাঁথা প্রচলিত আছে। এই গল্পগুলির ঐতিহাসিক সত্যতা কতখানি তা নিরূপণ করা সম্ভব না। যুগে যুগে কালে কালক্রমে বিবর্তিত হতে হতে এই গল্পগুলি আমাদের হৃদয়ে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ, পঞ্চদশ, ষোড়শ শতকে দুর্গা বিষয়ক যে বিভিন্ন পুঁথি লেখা হয়েছিল তার ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। এই পুঁথিগুলির অধিকাংশ বিষয় দেবীপুরাণ, দেবীভাগবত, কালিকাপুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয়। এই প্রসঙ্গে আমরা স্বামী জগদীশ্বরানন্দের বিখ্যাত গ্রন্থ শ্রীশ্রীচণ্ডীর কথা উল্লেখ করব। এই মহান গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বিভিন্ন দুর্গাপূজার উল্লেখ করেছেন। যেমন, রঘুনন্দনের নাম আছে, তাঁর লেখা তিথিতত্ত্ব গ্রন্থে রঘুনন্দনকে নিয়ে দুর্গোৎসব প্রকরণ নামে একটি অধ্যায় সংযোজিত করেন। ওই অধ্যায়টি পাঠ করলে আমরা দুর্গাপূজার বিভিন্ন উপকরণ এবং বিভিন্ন মন্ত্রসমূহকে জানতে পারি।

বাচস্পতি মিশ্র লিখেছেন বাসন্তীপূজা প্রকরণ। বিদ্যাপতির লেখা বিদ্যাভক্তিতরঙ্গিণী এবং জীমূতবাহনের লেখা হিন্দু উৎসব নির্ণয় প্রভৃতি গ্রন্থেও দেবী দুর্গার পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি বিস্তৃত ভাবে আলোচিত হয়েছে। এইসব গ্রন্থগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে দ্বাদশ, ত্রয়োদশ শতক থেকে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে ধরনের দুর্গাপূজা দেখে থাকি তার আবির্ভাব ঘটে ষোড়শ শতাব্দীতে। অনেকে বলে থাকেন রাজা কংসনারায়ণ সেকালে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে দুর্গাপূজা করেছিলেন।

এবার বাংলাদেশে কালিপূজার ইতিহাস এবং বিবর্তনের ওপর আলোকপাত করা যাক।

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তন্ত্রসাধনায় কালীপূজার বিধান দিয়েছেন। কৃষ্ণানন্দ ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর মানুষ। তাঁর গ্রন্থে কালীপূজা ছাড়া তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা প্রভৃতি মহাবিদ্যাস্থাপন রীতি বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে। আমরা এখন যে দীপালি উৎসবের দিনে কালীপূজা করে থাকি তার উল্লেখ আছে ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কাশীনাথের লেখা কালিকা তন্ত্র গ্রন্থে। কার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই পূজার উদ্ভব হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই সম্ভবত প্রথম কালীপূজার প্রবর্তন করেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে এই পূজা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে দুর্গাপূজা যেমন সাধারণ গৃহস্থ মনকে আলোড়িত ও আপ্লুত করে, কালীপূজা সেরকম করে কি? কালীপূজা সাধকদের দ্বারাই বিশেষভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি আর একটি কথাও বলা উচিত, তা হল যদিও দুর্গোৎসব বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব, কিন্তু দেবী দুর্গাকে নিত্যদিন মনে রাখি কি? নিত্য দুর্গাপূজার প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় না অথচ নিত্য কালীপূজা প্রচলন আছে। দুর্গার থেকেও কালীর প্রাধান্য যথেষ্ট বেশি। আসলে দুর্গাপূজা শস্য—সম্পদ শক্তি রূপিণী মায়ের আগমনী উৎসব, আবার বিজয়া নামেই একটি বিষণ্ণ মুহূর্তের সঙ্গেও সংযুক্ত। যেহেতু দুর্গাপূজা বছরে মাত্র পাঁচদিন অনুষ্ঠিত হয় তাই বাঙালি এই পাঁচদিন এই মহা উৎসবে যুক্ত থাকেন। আর দেবী কালিকা আমাদের কুলুঙ্গিতে নিত্য বিরাজমানা থাকেন। তাই তাঁকে নিত্য পুজো করতে হয়।

এই প্রসঙ্গে আমরা আবার বিশিষ্ট প্রবন্ধকার এবং লেখক ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের প্রবন্ধের সাহায্য গ্রহণ করব। তাঁর ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য গ্রন্থে পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে যে—’বাংলাদেশে দুর্গাপূজার ইতিহাস ও প্রকৃতি বিচার করিলে বোঝা যাইবে যে এই ব্যাপক সম্বাৎসরিক উৎসবের সহিত মধ্যযুগের ক্ষত্রিয় সামন্ততন্ত্র এবং পরবর্তীকালে জমিদারী—তালুকদারী তন্ত্রের যোগ রহিয়াছে। কিছুদিন পূর্বে পর্যন্ত শহরাঞ্চলে ধনী জমিদারের গৃহে দুর্গাপূজা প্রচলিত ছিল। গ্রামাঞ্চলেও মহাসমারোহে বাৎসরিক দুর্গাপূজা জমিদার তালুকদারগণের এক প্রধান মর্যাদা বলিয়া পরিগণিত হইত। দোল—দুর্গোৎসবের অনুষ্ঠান ক্রিয়া মতো বনিয়াদি পরিবারের অবশ্য করণীয় অনুষ্ঠান ছিল।’

বিভিন্ন পুরাণ এবং উপপুরাণে আমরা দেবী কালিকার যে বর্ণনা পেয়েছি তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তাঁকে পার্বতী—উমা—দুর্গার সাথে অভিন্ন করে দেখানো হয়েছে। আবার কোনও কোনও গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে দেবী কালী হলেন মূল দেবী। উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী বা পার্বতী তাঁর থেকেই প্রসূতা। দেবীপুরাণে কালী বা কালিকাকে মূল দেবী রূপে অভিহিত করা হয়েছে। সৌরপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, কর্তাপুরাণ এবং শিবপুরাণে এই বিষয়টিকে নানা গল্প এবং আখ্যায়িকার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষ কন্যা সতী পতি নিন্দার জন্য দেহত্যাগ করেছিলেন। তিনিই আবার শিব লাভের জন্য হিমালয়ে মেনকা কন্যা রূপে কালীদেহে তপস্যা করেছিলেন। কঠোর তপস্যা দ্বারাই কালী তপ্ত কাঞ্চনাভ গৌরীদেহ লাভ করেন। কালিকাপুরাণে এই ঘটনাটিকে অন্যভাবে এবং অন্য ধারায় বিবৃত করা হয়েছে। আমরা যদি এই রহস্য সম্পর্কে জানতে কর্তাপুরাণকে গ্রহণ করে থাকি তাহলে সেখানেও দেখব একই ধরনের কাহিনি অন্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

পদ্মাপুরাণে আবার এই কাহিনিটি অন্যমাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। এই পুরাণের সৃষ্টি খণ্ডে দেখা যায় শিব এবং পার্বতী পারস্পরিক কঠোর কথপোকথনে নিমগ্ন আছেন। শিব পার্বতীর চন্দন তরু সমতুল্য দেহকে কালভুজঙ্গিনী রূপে বর্ণনা করছেন। একথা শুনে পার্বতী অত্যন্ত কুপিতা হন। পরবর্তীকালে তিনি কৃষ্ণাত্বক ত্যাগ করেন। পদ্মাপুরাণ মতে এই কৃষ্ণবর্ণ দেবীই হলেন কৌশিকী। কৃষ্ণবর্ণ ত্বক পরিত্যাগ করে তিনি হলেন গৌরী। কালিকাপুরাণে কালীর মূল দেবীত্বের কথা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। তনুত্যাগ করে তিনি হিমালয়ের গৃহে পুনঃজন্ম গ্রহণ করেন। এই গিরিনন্দিনী কালী নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। নারদও এই কথা হিমালয়কে জানিয়েছিলেন। তপস্যার দ্বারা শিব সন্তুষ্ট হলে কালী কন্যা সুবর্ণ আভাসম্পন্না হয়ে স্বর্ণগৌরী, বিদ্যুৎগৌরী এবং গৌরী নামে খ্যাতা হন।

দেবীভাগবতের পঞ্চম খণ্ডের ত্রয়োত্রিংশ অধ্যায়ে চণ্ডীর বর্ণনানুসারে বলা হয়েছে যে দেবীর দেহ থেকে কৌশিকী দেবী নির্গতা হয়েছিলেন। তখন দেবী কৃষ্ণরূপা হয়ে কীর্তিতা হন। এই কালিকা মসীবর্ণা, মহাঘোরা এবং দৈত্যগণের ভয়বর্ধিনী। আমাদের বাংলাদেশে মহানির্বাণতন্ত্র গ্রন্থটি যথেষ্ট প্রসিদ্ধি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সেই গ্রন্থে দেবী কালিকা রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় ধরে নানা পুরাণ, উপপুরাণ ও মহাপুরাণে দেবী কালিকার রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। কালিকাই যে হিমালয় কন্যা, বাংলার আধ্যাত্মিক সাহিত্যও তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণেও দেখা গেছে যে দেবী অম্বিকা হলেন দেবী কালিকা। এইভাবে বাঙালির মনন ও মানসিকতায়, আধ্যাত্মিক চিন্তা ও দার্শনিক অভিযাত্রায় দেবী কালিকা ও দেবী দুর্গা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। এটি বোধহয় বাঙালির দার্শনিক অভিজ্ঞানের একটি বৈশিষ্ট্য।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন