পৃথ্বীরাজ সেন
বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে সমস্ত ধর্মের আধ্যাত্মিক অন্বেষণে মাতৃশক্তি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ভাবতে ভালো লাগে, যে মায়ের গর্ভে সন্তানের জন্ম, যে জননী অনেক পরিশ্রম, দুঃখ—কষ্ট স্বীকার করে সন্তানকে বড় করে তোলেন আমরা কিন্তু তাঁদের সদাসর্বদা স্মরণে রেখেছি। ভারতের প্রাচীন মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা সভ্যতাতে অসংখ্য মৃন্ময়ী মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু ভারত নয়, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, ফ্রান্স, কাসপেসিয়ান সভ্যতা, এশিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, সাইপ্রাস, গ্রিস, বলকান উপদ্বীপ এবং ঈজিপ্টেও এই জাতীয় মৃন্ময়ী মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে মাতৃকা মূর্তির পুজো যেমন প্রাচীন ও সর্বব্যাপী, পৃথিবীর অন্যত্র বোধহয় তেমনটি দেখা যায় না।
এই প্রসঙ্গে আমরা স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের লেখা ‘তন্ত্রতত্ত্ব প্রবেশিকা’ গ্রন্থটির কথা বলব। ওই মহান প্রবন্ধকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাতৃপূজার একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, বিশ্বের প্রায় সমস্ত মানব সভ্যতায় মাতৃপূজার প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে এক এক দেশে নারীশক্তি এবং মাতৃপূজাকে এক একভাবে বিশ্লেষিত করা হয়েছে। প্রাচীন মানব সভ্যতায় তার উপস্থিতি তাই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রাচীন মেক্সিকোতে মাতৃদেবী ছিলেন চন্দ্র দেবী, তিনি পৃথিবীকে আলোকদান করেন। আর কোনও কোনও প্রাচীন মেক্সিকো পুঁথিতে তাঁকে পৃথিবীর সাথে একাত্ম করে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মাতৃদেবী এবং পৃথ্বিদেবীর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই।
জার্মানদের নেপথাস দেবীও ছিলেন পৃথ্বীমাতা। তিনি সমস্ত পৃথিবীকে রক্ষা করছেন বিপদ এবং বিপর্যয়ের হাত থেকে। প্রাচীন গ্রীক মাতৃদেবী রথী ছিলেন পৃথিবীর দেবী। রোমান দেবী সিঞ্চিলিকে আমরা বসুন্ধরার দ্যোতক হিসেবে কল্পনা করেছি। অর্থাৎ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে বসুন্ধরার সঙ্গে মাতৃশক্তির একাত্মতা সূচিত হয়েছে। এর কারণ কি? মনে হয় মাতা যেমন সর্বংসহা, তিনি যেমন তাঁর সন্তান—সন্ততিদের জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারেন, বসুন্ধরার মধ্যেও সেই জাতীয় গুণাবলীও বিদ্যমান।
সৌরজগতের সমস্ত গ্রহের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের স্পন্দন আছে। তাই আমরা সদাসর্বদা আমাদের পৃথ্বীমাতার কাছে আমাদের অপরিমাপ্য ঋণ স্বীকার করি।
‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থের লেখক শশীভূষণ দাশগুপ্ত এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর প্রাচীন মাতৃপূজার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী বহু দেশে প্রাচীনকালে মাতৃদেবী ও তার পূজার প্রচলন ছিল। গ্রিসে রুহি দেবী, এশিয়া মাইনরে সিবিলি, ঈজিপ্টে ইস্থার, আইসিস প্রভৃতি প্রাচীন মাতৃদেবীর উল্লেখ করা যেতে পারে। ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপে একসময় সিংহবাহিনী পার্বতী বা পর্বতবাসিনী দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল তার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ভূমধ্যসাগরের এই সকল অঞ্চলে বহু খননের ফলে বহু প্রাচীন নারীমূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই নারীমূর্তির প্রাধান্য মাতৃপূজার জনপ্রিয়তার চিহ্ণ।
তাঁর এই মন্তব্যের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল গ্রিস দেবীর মাতৃদেবী পর্বতবাসিনী। আবার আমাদের শাস্ত্রে মাতৃদেবীকে পার্বতী বা গিরিরাজের কন্যা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এর কারণ কি? সমাজবিদরা বলে থাকেন, পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকেন। যে—কোনও সময়ে তাঁরা দুর্বৃত্ত পুরুষের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারেন। এই গুণটি—ই বোধহয় সেকালের মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল।
এবার আমরা ভারতবর্ষের ওপর আলোকপাত করব। ভারতবর্ষেও যে মাতৃদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানেও মাতাকে পৃথিবীর দ্যোতক হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ভারতবর্ষে যখন অনার্য সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল তখন মাতৃদেবীকে শস্য এবং প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। নৃতত্ত্ববিদেরা গবেষণা করে এই তথ্য আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষ মাতৃ উপাসক ছিলেন। মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠীর মানুষও মাতৃ উপাসনা করতে ভালোবাসতেন। অনার্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বারাই যে ভারতবর্ষে মাতৃপূজার সূচনা হয়েছে, সেটি হলো এক ঐতিহাসিক সত্য। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটে। একটি জাতির আঞ্চলিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে অন্য একটি জাতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন ও মিশ্রণ ঘটে যায়। এর ফলে মাতৃপূজা আরও বিচিত্রতর হয়ে ওঠে। অবশ্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাতৃপূজার প্রচলন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে আর্যসমাজ পুরষকেন্দ্রিক হওয়াতে তখন পুরুষ দেবতার প্রচলন ছিল অনেক বেশি। সে—যুগে ইন্দ্র, সূর্য, মরুৎ, দৌ, বরুণ এবং অগ্নি পূজা পেতেন। তা সত্ত্বেও বৈদিক সাহিত্যে মাতৃদেবীকে কল্পনা করা হয়েছে এবং তাঁর প্রশস্তিসূচক বেশ কিছু সুক্তও রচিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে বলা হয়েছে যে মাতা হলেন পৃথিবীর মতোই প্রাণদায়িনী, অন্নদায়িনী এবং স্তনদায়িনী। ঋকবেদেও পৃথিবীমাতার বন্দনা—স্তোত্র দেখতে পাওয়া যায়। এই ঋকবেদে পৃথিবীকে সন্তানবৎসলা রূপে কল্পনা করে পূজা করা হয়েছে।
ঋকবেদে নারীশক্তিকে পৃথিবীর মতো মহতী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। অথর্ববেদে তাঁকে বিকশিতা এক মহীমময়ী রমণী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথর্ববেদে আমরা এমন কিছু শ্লোক পেয়ে থাকি যেখানে নারীকে পৃথিবীর মতো সন্তানবৎসলা রূপে তুলে ধরা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পৃথিবী এবং নারীর সাযুজ্য কল্পনা করা হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণে বারে বারে রমণীকে পৃথিবীর সমতুল্যা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে পৃথিবীর দেবী হলেন জগদ্ধাত্রী। মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ডী এবং পৃথিবীর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শনে আমরা মায়াতত্ত্ব এবং প্রকৃতিতত্ত্বের গূঢ় আলোচনা দেখেছি। এই তত্ত্ব অনুসারে বসুন্ধরা ও নারীর মধ্যে ঐক্য বিদ্যমান। উপনিষদেগুলিতেও মাতৃকাশক্তির কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। একাধিক উপনিষদে আমরা কালী, করালি, উমা, হৈমবতী, ভদ্রকালি প্রভৃতি শক্তির নাম পেয়েছি।
এবার আমরা ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার আর এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব তন্ত্রশাস্ত্রের কথা বলব। তন্ত্রশাস্ত্রে মাতৃকাশক্তিকে বারবার উপাসনা করা হয়েছে। তন্ত্র হল আমাদের দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার এমন একটি শাখা যেখানে আর্য এবং আর্যেতর ভাবধারার সংমিশ্রণ ঘটে গেছে। তন্ত্রের মধ্যে মন্ত্রের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। একাক্ষরী বীজমন্ত্রের বারবার উচ্চারণের মাধ্যমে তান্ত্রিক সাধক এক অসামান্য শক্তি অর্জন করেন। এই একাক্ষরী বীজমন্ত্রগুলির মধ্যে প্রথমে প্রণব বা ওঁ মন্ত্রের কথা বলতে হয়। এটি বৈদিক মন্ত্র এ—বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। অন্য মন্ত্রগুলি বৈদিক বলে মনে হয় না। এই তালিকাতে আছে ত্রিং, ওইং ইত্যাদি।
তন্ত্রে আচার—বিচারের ওপর অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত আচার নারীশক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তন্ত্রের মধ্যে ধ্যান, স্তব, স্তুতি, যজ্ঞ, হোম প্রভৃতি ক্রিয়া সম্পাদনের নানা পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। প্রতিটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নারীশক্তি জড়িত আছে।
এক সময়ে বৌদ্ধধর্ম ভারতে তন্ত্রশাস্ত্রের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্মে তন্ত্রসাধনার নানা ব্যাখ্যা প্রযুক্ত হয়েছে। এই ব্যাখ্যাগুলি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে সেখানেও নারীশক্তিকে অসামান্য শক্তির প্রতিভূ স্বরূপ ধরা হয়েছে।
একদা অবিভক্ত বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু এই বৌদ্ধধর্ম গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত ধর্ম নয়, এই ধর্মের মধ্যে তন্ত্রসাধনা এবং তন্ত্রশাস্ত্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে বাংলাদেশের শক্তিসাধনা এবং মাতৃপূজা একটি নতুন ধারা অবলম্বন করে। এই ধারাটির ভেতর অনেক নব্য মতবাদ চলে এসেছিল। এর অন্তরালে ছিল বৌদ্ধ ধর্মাশ্রিত তন্ত্রের প্রভাব। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত অবিভক্ত বঙ্গদেশে মহাযান বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া বজ্রযান ও সহজযান তন্ত্র ঘেঁষা ভাবধারা বৌদ্ধধর্মে পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে যেসব হিন্দুতন্ত্র প্রচলিত আছে তাদের উদ্ভবের সময়সীমা খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক থেকে খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই হিন্দুতন্ত্র সংক্রান্ত সাধনাতেও নারীজাতিকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, রমণী হল সকল ধর্মের আধার। হিন্দুরা বারবার নারীশক্তির সাধনা করে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, সন্তান কখনও তাঁর জননীকে ভুলে যেতে পারেন না।
মাতৃকা উপাসনার বিভিন্ন ধারা আমাদের আধ্যাত্মিক শাস্ত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছে। মঙ্গলকাব্য, শিবায়ন, কালিকামঙ্গল, অনুবাদিত রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতির মাধ্যমে একদিকে যেমন শক্তিগীতি ও শাক্ত পদাবলীর জয়যাত্রা সূচিত হয়েছে, অন্যদিকে আগমনি এবং বিজয়ার গান শোনা গেছে। এই দুই জাতীয় রচনা আমাদের মাতৃ সাধনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত এবং গৌরবান্বিত করে তুলেছে।
তন্ত্রসাধনার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
এক সময় কাশ্মীর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত এক বিস্তৃত ভূখণ্ড ছিল তান্ত্রিক সাধনার কেন্দ্রভূমি। তবে বিশিষ্ট পণ্ডিতবর্গ বিশ্বাস করেন যে, ভারত নয়, চীন হল তন্ত্রের আদি উৎসভূমি। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের আগে ভারতবর্ষে কোনও তান্ত্রিক ছিলেন বলে জানা যায় না। চীনা পরিব্রাজক অন্যান্য সাধকদের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তান্ত্রিকদের কথা বলেননি। এমনকি দ্বাদশ শতকের আগে বাংলাদেশে তন্ত্র সম্বন্ধীয় কোনও গ্রন্থ রচিত হয়নি। তাই পণ্ডিতরা ও ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতকে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তন্ত্রসাধনা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কাশ্মীর থেকে শুরু করে ভূটান, নেপাল, সিকিম, বাংলাদেশ, অসম পর্যন্ত অঞ্চলে তন্ত্রসাধনার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছিল। এর কারণ কি? এর অন্তরালে আছে একটি ঐতিহাসিক সত্য। একসময় ভারতবর্ষের অনেক রাজণ্যবর্গ বৌদ্ধধর্মকে রাজকীয় ধর্ম হিসাবে স্বীকার করেছিলেন। যেহেতু তখন ভারতবর্ষের রাজতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল তাই ওইসব রাজ্যের প্রজারা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে আবার ভারতের বিশাল ভূখণ্ডে শৈবধর্মের অভ্যুত্থান সূচিত হয়। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। এই প্রভাবকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বৌদ্ধ সাধকেরা তাঁদের উপাস্য ধর্মতত্ত্বের সাথে হিন্দু দেবদেবীর সদৃশতা আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেক হিন্দু সাধক তন্ত্রসাধন পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা প্রেমের ঠাকুর শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের নাম বলতে পারি। তখন তাঁর সমসাময়িক পণ্ডিত রঘুনন্দন তন্ত্রকে প্রামাণ্য বলে মনে করতেন। আবার চৈতন্যের সময়েই নবদ্বীপের বিশিষ্ট পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তন্ত্রসার লিখেছিলেন। এই গ্রন্থটিকে আমরা তন্ত্রশাস্ত্রের মহাভারত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছি।
তন্ত্র মতে শিব এবং শক্তি দুইয়ের প্রভাব অপরিসীম। শিব নিষ্ক্রিয় এবং শক্তি গতিময়ী। শিব ও শক্তি সংযুক্ত না হলে কোনও পূজা বা আরতি শেষ পর্যন্ত অর্থ পায় না। অন্বয় শক্তির এই দুটি রূপ মিথুন রূপে এক হয়ে থাকেন। সাধকের কাম্যবস্তু হল শিব এবং শক্তির মধ্যে মিলিত অবস্থান উত্থাপন করা। আবার বলা যেতে পারে যে, প্রবৃত্তি হল শক্তি এবং নিবৃত্তি হল শিব। কিভাবে শক্তি ও শিবের কাঙ্ক্ষিত মিলন ঘটানো সম্ভব, তন্ত্রশাস্ত্রে তার বিবিধ পদ্ধতির কথা আলোচিত হয়েছে।
তন্ত্রসাধনার গতিপ্রকৃতি জানতে হলে বিভিন্ন তান্ত্রিক শব্দের সাথে পরিচিতি অর্জন করতে হবে। আমরা একে একে তন্ত্রসাধনার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত শব্দ, আচার, অষ্টপাশ, ভাবত্রয়, পঞ্চ ম—কার, ইন্দ্রধ্বনি শক্তি, কুণ্ডলিনী যোগ ও তার ক্রিয়া—প্রকৃতি বিষয়ে আলোচনা করব। এর পাশাপাশি আমরা ষটচক্রের রহস্য তন্ময়তা জানতে চেষ্টা করব। নাড়ী, বায়ু, সহস্রার, পদ্ম প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কেও আলোকপাত করা হবে।
তন্ত্রী বা তনত্রি শব্দ থেকে তন্ত্র শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ হচ্ছে উৎপাদন বা জ্ঞান। তন্ত্র শব্দের অন্তে ‘ত্র’ ত্রাণ বা মুক্তির নির্দেশ দেয়। তন্ত্রশাস্ত্র বলতে কি বোঝায়? পণ্ডিত শশীভূষণ দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছেন—যাহা তত্ত্ব ও মন্ত্রের সমন্বয়ে ত্রাণ সাধিত করে তাহাই তন্ত্র নামে পরিচিত। আবার ইংরাজি ভাষায় বলা হয়েছে—The regular order of ceremonies and rights and systems frame work ritual হল তন্ত্র। তন্ত্র শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল পন্থা, মতবাদ বা বিধি।
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর The Cultural Heritage of India গ্রন্থে তন্ত্র শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত এবং ব্যবহারিক অর্থ নিরূপণ করেছেন এইভাবে— “The word ‘tantra’ which is sometimes derived from the root ‘tan’, to spread, means a system, a method, a discipline. It is a system of acts on the physical, vital and mental planes by which centre of being can render itself an apparatus efficient for the purpose of encompassing the two ford end of abhyudaya (progress of uplift) (অভ্যুদয়) and nihsreyasa (নিঃশ্রেয়স) (the supreme good).
ভারতীয় সাধনার ক্ষেত্রে অবশ্য তন্ত্র শব্দটিকে এই অর্থে গ্রহণ করা হয়নি। এখানে তন্ত্র শব্দটিকে একটু রহস্যাবৃত করে তোলা হয়েছে। যেহেতু তান্ত্রিক সাধনা একটি দুরূহ সাধন পদ্ধতি, তাই তন্ত্র শব্দটির সঙ্গে ওই রহস্যজনক উপাসনা পদ্ধতিটির এককত্ব নিরূপিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, বাঙালি শাক্তপদীদের অনেকেই ছিলেন তন্ত্রোপাসক। তাঁরা নানাভাবে তন্ত্রসাধনা করেছেন। কখনও সেই সাধনার মধ্যে সাধনশক্তির বহিঃপ্রকাশ চিহ্নিত হয়েছে। কখনও বা সেখানে দেখা গেছে ভক্তের আকুতি। এই কটি কথা মনে রেখে আমরা এবার তন্ত্রসাধনার সাথে যুক্ত বিষয়গুলির ওপর আলোকপাত করব।
তন্ত্রসাধনার সপ্ত আচার
প্রথমেই আমরা সপ্ত আচারের কথা বলব। তন্ত্রে যে সপ্ত আচারের কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল যথাক্রমে—বেদাচার, বৈষ্ণব আচার, শৈবাচার, দক্ষিণাচার, বামাচার, সিদ্ধান্তাচার এবং কুলাচার। এছাড়া আছে সময়াচার। যাঁরা সময়াচারী তাঁরা বাহ্য পূজা অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা অন্তরের ভক্তি ও বিনম্র প্রণামের দ্বারাই তন্ত্রোপাসনা করে থাকেন।
যে সাতটি তন্ত্রাচারের কথা বলা হল তার মধ্যে বেদাচার হল সাধারণ। বেদাচার পুরাণ, স্মৃতি প্রভৃতি বিধিকে মেনে চলে। দক্ষিণাচার বেদাচারের মতোই শাস্ত্রবিধিকে অনুসরণ করে। সময়াচার হল একটি পবিত্র আচার। আবার বীরাচারে গুরু, মন্ত্র, দেবতা, বর্ণ ও ধ্যান এই পাঁচটি তন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়। বামাচারী সাধকেরা পঞ্চ ম—কারের সাধনা করে থাকেন। বামাচার এবং বীরাচারকে আমরা পিচ্ছিল এবং বিপজ্জনক পথ বলে থাকি। বামাচার, সিদ্ধান্তাচার এবং কৌলাচারে যথেষ্ট পরিমাণে মদ্য, মৎস্য, মাংস প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়।
সপ্তআচার অনুসারে গুরুই হলেন আসল শক্তি। গুরু যদি তাঁর শিষ্য বা সাধককে ঠিক পথে পরিচালিত করেন তাহলে সাধক কখনও লক্ষ্যচ্যুত হবেন না। কিন্তু সঠিক গুরু পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। এছাড়া সঠিক গুরুর কাছে গিয়ে তন্ত্র শিখতে হলে সাধক বা শিক্ষার্থীকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। এই পরিশ্রমে কিছু ভুল—ত্রুটি দেখা দিলে ওই সাধক আর তার সাধনায় সফল হবেন না।
তন্ত্রসাধনার ভাবত্রয়
তন্ত্রের সাথে তিনটি ভাব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত—(১) পশুভাব, (২) বীরভাব এবং (৩) দিব্যভাব। যে সমস্ত মানুষের মধ্যে তমোগুণের আধিক্য তাঁরা পশুভাবে আবিষ্ট হবেন। যাঁদের মধ্যে রজোগুণ আছে তারা বীরভাব গ্রহণ করবেন এবং যাঁর মধ্যে সত্ত্বগুণ আছে তাঁর জন্য আছে দিব্যভাব।
পশুভাবে, পশু অর্থে জীবকে বোঝানো হয়েছে। তন্ত্রমতে যে সকল জীব জৈব প্রবৃত্তিকে অতিক্রম করতে পারে না। তারাই শেষ পর্যন্ত পশু অবস্থায় থেকে যায়। যে আচারে অনুকল্পের বিধানে পঞ্চ ম—কার তত্ত্বের সাধনা করা হয় তাকে পশুভাবের উপাসনা বলে। এই ভাবের মধ্যে আছে বৈদিক, বৈষ্ণব, শৈব ও দক্ষিণ আচার।
বীরভাবে, বীর শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ শক্তিশালী ব্যক্তি নয়, যিনি জৈবিক প্রকৃতির তাড়নাকে প্রতিহত করতে পারেন, তিনিই হলেন বীর। এই জাতীয় সাধনার মধ্যে আছে বামাচার ও সিদ্ধান্ত আচার।
দিব্যভাবকে পরম শক্তিভাব বলা হয়। এই ভাবকল্পে সাধক সঠিক দিব্যজ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর দেহ হয় পবিত্র এবং হৃদয় হয় নির্মল। তাঁর দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং তিনি তৃতীয় নয়নের অধিকারী হন। এই ভাবের অন্তর্গত হল কৌলাচার।
তন্ত্রের পঞ্চ ম—কার
পঞ্চ ম—কার বলতে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুনকে বোঝায়। এখানে প্রত্যেকটি শব্দের বাহ্যিক এবং অন্তর্নিহিত অর্থ আছে।
পঞ্চতত্ত্বের প্রথমটি হল মদ্য। যে অমৃতধারা ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত হয় এবং যা পালন করলে মানুষের মন অনাস্বাদি আনন্দে পরিপ্লাবিত হয়, সেই তরলকে বলা হয় মদ্য।
মা শব্দে রসনাকে বোঝানো হয়েছে। বাক্য হল রসনার অংশ। যে ব্যক্তি সর্বদা বাক্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ মৌনী অবস্থায় থাকেন, তিনিই হলেন মৎস্যসাধক। এখানে দুটি মৎস্যের কথা বলা হয়েছে। এরা হল ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ির দ্যোতক। আবার শ্বাস ও প্রশ্বাসকে দুটি মৎস্য বল হয়। যিনি উপযুক্ত প্রাণায়ামের দ্বারা শ্বাস ও প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন তিনিই হলেন আদর্শ মৎস্যসাধক।
আমরা জানি আত্মার অবস্থান শিরস্থিত সহস্রদল পদ্মে শোভিত কর্ণিকার মধ্যে। ইনি তেজে কোটি সূর্যের অনুরূপ আবার কমনীয়তায় কোটি চন্দ্রের সমান। যিনি এই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধিতে সমর্থ হয়েছেন, তিনিই হলেন মুদ্রা সাধক।
মূলাধারে কুণ্ডলিনী শক্তির অবস্থান। আর পরম শিব আছেন কর্ণিকার কেন্দ্রস্থ বিন্দুতে। আমরা যে জটিল এবং ধারাবাহিক পদ্ধতির মাধ্যমে কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে পরম শিবকে সংযুক্ত করতে পারি, তাকেই মৈথুন বলে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন