পৃথ্বীরাজ সেন
দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গ এবং তৎসন্নিহিত অঞ্চলে মাতৃসাধনার একটি নিজস্ব ধারা প্রবাহিত ছিল। এই অঞ্চলের মাতৃসাধকেরা প্রধানত তন্ত্রসাধনার আশ্রয় নিয়ে স্থল—জল—অন্তরীক্ষের দেবীর উদ্দেশে তাঁদের ভক্তিবিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এর পাশাপাশি তাঁরা মাতৃশক্তির স্বরূপ উদঘাটনে ছিলেন আত্মনিবেদিত। এইসব গূঢ় এবং গুহ্য পদ্ধতি বংশপরম্পরাক্রমে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। আর এর ফলে পূর্ব ভারতের এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে মাতৃসাধনার একটি স্বতন্ত্র প্রতীতি গড়ে ওঠে। একসময় যার বিস্তৃতি ছিল অবিভক্ত বঙ্গদেশের প্রান্তসীমা থেকে সুদূর প্রাগজ্যোতিষপুর পর্যন্ত। আজও এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সাধন কেন্দ্র আছে। তবে মাতৃসাধনার সেই ধারণাটি এখন বোধহয় বেশ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।
যুগে—যুগান্তরে বাংলার মাতৃসাধকেরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মাতৃশক্তিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের সকলের স্বীয় স্বীয় সাধন বৈশিষ্ট্য ছিল। কেউ শারীরিক ক্লেশকে স্বীকার করেছেন হাসিমুখে। কেউ আবার দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন ধ্যানমগ্ন। তাঁদের মধ্যে অনেকে শ্মশানে কাটিয়েছেন বিনিদ্রিত রাত। শবাসনে বসে ঈশ্বরানুভূতির চেষ্টা করেছেন। আবার অনেকে গার্হস্থ্য জীবনযাপন করার পাশাপাশি মাকে ভালোবেসেছেন নিজের জননী করে। কেউ আবার ভক্তজনকে দীক্ষিত করেন মহামন্ত্রে। অনেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে প্রতিটি প্রহর অতিবাহিত করেছেন। এইভাবে মাতৃসাধকেরা ভিন্ন ভিন্ন পথের পথিক হয়ে বাংলার মাতৃসাধনার ঐতিহ্যকে নব উন্মাদনায় উদ্বোধিত করেছেন। আর এইভাবেই বাংলার মাতৃসাধনা এক নতুন পরিচয় পেয়েছে।
বাংলার মাতৃসাধনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমরা যে মহান সাধকের কথা বলব, তিনি হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁর হাত ধরেই আমরা সর্বপ্রথম কালীমূর্তিকে কল্পনা করতে পেরেছিলাম। তারপর একে একে আমরা বাংলার আর কয়েকজন বিখ্যাত মাতৃসাধকের কথা বলব। এই তালিকাতে যেমন আছেন সাধক বামাক্ষ্যাপা, তেমনই আছেন সাধক কবি রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত। বামাক্ষ্যাপার মাতৃসাধনার মধ্যে একটি উদ্বেল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি সদাসর্বদা মাতৃনামে বিভোর থাকতেন। তারাপীঠের ঘনঘোর শ্মশানের কালো অন্ধকারের মধ্যে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন।
রামপ্রসাদ এবং কমলাকান্ত আবার ভক্তিগীতির মাধ্যমে মাতৃ আরাধনা করেছেন। তাঁদের কাছে জগজ্জননী নিজস্ব জননীতে পরিণত হয়েছেন। এইভাবেই তাঁরা মাতৃসাধনার ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র ধারার স্রষ্টা। এই পথের ভিন্ন পথিক হলো ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ। সাংসারিক জীবনযাপন করা সত্ত্বেও যে মাতৃনামে বিভোর হওয়া যায়, শত—সহস্র মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর বৃত্তে নিয়ে আসা যায়, সাধক রামকৃষ্ণ তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত মহামানব। তাই হিন্দুপদ্ধতির পাশাপাশি তথাকথিত অন্যান্য পদ্ধতিকেও আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। এই ব্যাপারে তাঁর মধ্যে আমরা কোনওরকম কুসংস্কার দেখিনি। এর পাশাপাশি রাজা রামকৃষ্ণের কথাও আলাদাভাবে উল্লিখিত হয়েছে। একজন মানুষ এত সম্পত্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সবকিছু ত্যাগ করে মাতৃসাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। তাই তাঁর কথা একটু বিশেষভাবে বলা উচিত।
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
আসুন, আমাদের এই পর্বের পথ চলা শুরু হোক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরে। মানস ভ্রমণে আমরা ফিরে যাই আজ থেকে অনেক বছর আগের পৃথিবীতে। মনে করা যাক, আমরা একটি নিস্তব্ধ রাত্রির গভীর যামে পৌঁছে গিয়েছি। চারদিকে অমানিশার সূচীভেদ্য অন্ধকার। নবদ্বীপের এক প্রান্তে গঙ্গাতীরে নির্জন শ্মশানে বসে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ধ্যানমগ্ন।
লোকালয় থেকে অনেক দূরে এই শ্মশানের অবস্থিতি। এখানে শুধুই মৃত্যুর হাহাকার শ্রুত হয়। আসে পেঁচা, শিয়াল আর কুকুরের দল। বট, পাকুড় আর শেওড়ার শাখায় শাখায় অন্ধকার বুঝি চারপাশকে গ্রাস করেছে। এ শ্মশান বড়ো বিচিত্র স্থান। গভীর রাতে এখানে কেউ আসে না। এমনকি মধ্যদিনেও সহসা কারো পদচিহ্ন আঁকা হয় না শ্মশানপথে।
প্রতি অমাবস্যা নিশীথে কৃষ্ণানন্দ এখানে বসে একান্ত মনে শ্যামামায়ের পুজো সম্পন্ন করেন। তারপর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একটির পর একটি মন্ত্রোচ্চাণ করেন।
এত করা সত্ত্বেও তাঁর মনে বড় ক্ষোভ, কারণ তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন যে তন্ত্রসাধনা আজ একেবারে অবনতির পথে এগিয়ে চলেছে। তন্ত্রসাধকেরা নানাধরনের যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছেন। তাই শক্তিসাধনার পথ হয়েছে পঙ্কিল।
আর একটি অভাব বোধ জেগে আছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের অন্তরে। তিনি ঘট বা যন্ত্র ইত্যাদি প্রতীকে মাকে আরাধনা করতে চান না। তাঁর মনোগত বাসনা মায়ের একটি মৃন্ময়ী রূপ প্রত্যক্ষ করবেন। তারপর সাধনগুণে সেই মৃন্ময়ী প্রতিমাকে চিন্ময়ী হিসাবে পরিণত করবেন। শক্তিসাধনার মধ্যে যদি মাতৃভাবনা না থাকে, তাহলে এই সাধনা সাধারণ মানুষের প্রাণকে কীভাবে স্পর্শ করবে? আর এর জন্যই বাংলার মাতৃসাধনা আজ যথেষ্ট সঙ্কুচিত অবস্থায় আছে। কয়েকজন সংসারত্যাগী মাতৃসাধক ছাড়া অন্য কেউ এই সাধনায় মন দিতে বিন্দুমাত্র রাজি নয়। তাঁদের কাছে মাকে গ্রাহ্য এবং স্বীকৃত করতে হলে এমন একটি মূর্তি দরকার।
তখন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে মায়ের নামে ডাক। মধ্য রাতে বাতাসের বুক চিরে ভেসে যাচ্ছে সেই শব্দতরঙ্গ। হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে এক বিস্ফোরণ ঘটে গেল বুঝি। তিনি দেখতে পেলেন এক জ্যোতির্বলয় ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নীচে নেমে আসছে। সেই জ্যোতির্বলয়ের মধ্যে থেকে উৎসারিত আলোককণা তাঁর দৃষ্টিশক্তিকে একেবারে আচ্ছন্ন করে দিল বুঝি। তাঁর মনে হল চারপাশে বুঝি ভয়ঙ্কর ভূকম্পন শুরু হয়েছে। তিনি আকাশ থেকে দৈববাণী শুনলেন—”বৎস, তন্ত্রধুত এই বাংলার তন্ত্রসাধনার মূল ধারাটি কেউ কখনও সামান্যতম আঘাতপ্রাপ্ত করতে পারবে না। বীর সাধকেরা বংশপরম্পরায় এই ধারাটিকে বহন করে নিয়ে চলেছেন। কিন্তু আজ তার বহিরঙ্গে নানা কলঙ্ক জন্মেছে। তাই আমি বলি, তুমি আমার মাতৃরূপিণী বিগ্রহের পুজো শুরু করে আমাকে মা হিসাবে মেনে নেবে। আর একটা বড়ো কাজ তোমাকে করতে হবে, তোমাকে তন্ত্রশাস্ত্রের গূঢ় বিষয়গুলিকে সংকলিত করতে হবে। এই সংকলন গ্রন্থের রচয়িতা হবে তুমি। প্রত্যেকটি মন্ত্রের সাথে উপযুক্ত ভাষ্য সংযোজন করবে। আর এমনভাবে এই গ্রন্থ রচনা করবে যাতে তা সাধারণ মানুষের মনকে স্পর্শ করতে পারে।”
কিন্তু কৃষ্ণানন্দ এই দৈববাণী শুনেও কেমন যেন ইতস্তত। তিনি কোন মূর্তিকে মা হিসাবে পুজো করবেন? মা কীভাবে ভক্তদের সামনে প্রতিভাত হতে চান? এই বিষয়টির একটি সন্তাোষজনক মীমাংসা হওয়া দরকার। তিনি আকুল কণ্ঠে বললেন—”মা, তুমি বলো কোন মূর্তি সর্বজনগ্রাহ্য হবে। ধ্যানের ধারণায় নয়। স্থূলজগতের আরাধ্য বিগ্রহকেই ঘরে ঘরে পূজা হতে দেখব।”
”তাই হবে, যে মূর্তিতে এবং যে ভঙ্গিতে আমার এই বিগ্রহের পূজা হবে, তা মানবদেহের মাধ্যমে তোমাকে আমি দেখিয়ে দেব। কাল সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে তুমি প্রথম যে নারীটিকে দেখতে পাবে, তার কথা মনে রেখো। তার রূপ, তার ভঙ্গিমা সব কিছু নিয়েই তৈরি হবে আমার প্রতিমা। আমি সুনিশ্চিত বাংলার মানুষ তাকে আদরে বরণ করে নেবে।”
পরদিন সকাল হল। কালো রাত্রির অন্ধকার কোথায় যেন হারিয়ে গেল। পুব আকাশে সাতটি ঘোড়ার রথে চড়ে আবির্ভূত হলেন সূর্যদেব। তখন কৃষ্ণানন্দের মন আনন্দে বিহ্বল। যাক, তাঁর অনেক দিনের সাধনা এবার ঈপ্সিত সফলতার দিকে পৌঁছে যাচ্ছে। তিনি ভাবতেই পারেননি যে, এত সহজে তিনি সিদ্ধিলাভ করবেন। কিন্তু কোথায় সেই নারীমূর্তি? যে মূর্তির মধ্যে বিশ্বজননী নিজেকে প্রতিভাত করবেন? কেমন হবে সেই মূর্তিটি? তিনি কি হবেন ঐশ্বর্যশালিনী? সালঙ্করা? বিত্তবতী? প্রজ্ঞাবতী? নাকি তিনি হবেন নিঃস্ব—রিক্ত ভিখারিণী? এসব কথা ভাবতে ভাবতে দ্রুতপদে কৃষ্ণানন্দ এগিয়ে চললেন গঙ্গার দিকে। রোজ সকালে গঙ্গা স্নান করা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও কর্তব্য। এই অবগাহনের মাধ্যমে তিনি গতরাত্রির সমস্ত মালিন্য এবং কলঙ্ক দূরীভূত করেন। মনে হয়, তিনি বুঝি নবকলেবরে উজ্জীবিত হয়েছেন।
হঠাৎ দেখলেন অদূরে এক শ্যামাঙ্গিনী গোপকুমারি অপরূপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। তার ডান পা—টি কুটিরের অনুচ্চ বারান্দার ওপর স্থাপিত। বাম পা—টি রয়েছে ভূতলে। দক্ষিণ হাতে রয়েছে একতাল গোবর, এমন ভাবে সে ওই গোবরকে মুঠি করে ধরে আছে, মনে হয় সে হাত থেকে একটা বরাভয় প্রতিচ্ছবি নির্গত হচ্ছে। বাঁ হাতটি তার কর্মচঞ্চল। এই হাত দিয়ে বেড়ার গায়ে মাটির প্রলেপ দিচ্ছে। তার কৃষ্ণবর্ণ কেশরাশি নিটোল দেহের চারদিকে আলুলায়িত হয়ে ছড়িয়ে আছে। এই শ্যামাঙ্গী মেয়েটির পরিধানে অপরিসর একটি শাড়ি। আচার্য কৃষ্ণানন্দের মতো এক অচেনা পুরুষকে দেখামাত্র সে লজ্জায় জিভ কেটে ঘুরে দাঁড়াল।
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণানন্দের মন—আকাশে বুঝি বিদ্যুতের চমক দেখা দিল। কৃষ্ণানন্দ ক্ষণকালের জন্য চোখ দুটি বন্ধ করলেন। তারপর প্রত্যক্ষ করলেন মহামায়ার সেই শক্তিকে, যে শক্তি নিজ ব্রহ্মাণ্ডকে এক শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই শ্যামাঙ্গিনী মেয়েটিকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন সার্থক হবে। তিনি ঠিক করলেন যে, এই নারীমূর্তিটির মাধ্যমেই তিনি তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেন। এই ভঙ্গিমাতে জগন্মাতার বিগ্রহ তাঁকে তৈরি করতে হবে।
এবার তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, তিনি কোন কর্মপদ্ধতি নিয়ে কাজ করবেন? ঠিক করলেন, তিনি প্রতিমা পূজার মাধ্যমে দেবী আরাধনার একটি নতুন পন্থা নির্ধারণ করবেন। এতদিন ধরে বাংলার ঘরে ঘরে ঘট এবং যন্ত্রের দ্বারা শক্তিরূপিণী মহামায়ার আরাধনা করা হতো। তাতে মায়ের সাথে ছেলের কোনও সাধারণ সাযুজ্য থাকত না। মনে হতো সামনে বোধহয় পর্বত প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা দাঁড়িয়ে আছে। আজ কৃষ্ণানন্দ একটি বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটাতে চলেছেন। তিনি মাতৃ—আরাধনার প্রচলন করবেন বাংলার গ্রামে গ্রামে, হাটে—বাটে—বাজারে এবং বারোয়ারিতলায়। এর পাশাপাশি তিনি আর একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। এতদিন পর্যন্ত বাংলার মাতৃসাধকেরা শুধুমাত্র শক্তিরসের প্রাবল্য দেখিয়েছেন, কিন্তু মায়ের মধ্যে একদিকে আমরা যেমন রাগী রূপটি দেখতে পাই, এর পাশাপাশি মায়ের মধ্যে একটি স্নেহ—মমতা পূর্ণ রূপও আছে। মা যখন সন্তানকে শাসন করেন, তখন হয়তো তাঁর প্রথম রূপটি প্রতিভাত হয়, আবার যখন তিনি সন্তানকে সোহাগ বর্ষণ করেন, তখন মনে হয়, তাঁর মতো স্নেহময়ী জননী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। তাই কৃষ্ণানন্দ ঠিক করেছিলেন যে, তিনি শক্তিরসের সঙ্গে ভক্তিরসের সংমিশ্রণ ঘটাবেন। আর এইভাবে বাংলার বুকে এক নতুন শক্তিসাধনার সূত্রপাত করবেন।
তাঁর এই সঙ্কল্প অচিরেই সিদ্ধ হয়েছিল। অনতিবিলম্বে তাঁর প্রবর্তিত এবং প্রচারিত শ্যামাপূজার পদ্ধতি বাংলার আপামর জনসাধারণ সশ্রদ্ধ চিত্তে গ্রহণ করলেন। এতদিন পর্যন্ত তান্ত্রিক আচার—আচরণের মধ্যে যে শুষ্কতা লুকিয়ে ছিল, তা দূরীভূত হল। কৃষ্ণানন্দ এক্ষেত্রে গঙ্গারূপিণী স্নেহধারাকে মর্ত্যে নিয়ে এলেন। তাই আজও আমরা বাংলার মাতৃসাধকদের কথা আলোচনা করতে গেলে সর্বাগ্রে তাঁর কথা উচ্চারণ করি। তিনি যদি এইভাবে ওই কৃষ্ণাঙ্গিনীকে আমাদের চোখের সামনে না আনতেন, তাহলে কি শ্যামা মা আজ বাংলার ঘরে ঘরে এতখানি স্বীকৃতি এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারতেন?
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ মহেশ্বর ভট্টাচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁদের আদি নিবাস ছিল উত্তরবঙ্গে। একসময় তিনি পণ্ডিত হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নবদ্বীপের বাগেশ্বরীতলাতে গেলে আজও আমরা কৃষ্ণানন্দের পবিত্র স্মৃতি দেখতে পাব।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, একই সময়ে নবদ্বীপে আর এক মহাপণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটেছিল। যিনি সারা বঙ্গদেশে প্রেমধর্মের প্লাবন এনেছিলেন। তিনি হলেন শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব। বিদ্যাচর্চার একই ক্ষেত্রে এবং একই রকম সামাজিক পরিবেশের মধ্যে তাঁদের কৈশোর এবং প্রথম যৌবনকাল অতিক্রান্ত হয়। পরবর্তীকালে তাঁরা দুই পৃথক ধারার অগ্রদূত হয়ে মহাজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে এক দূরতিক্রম্য ব্যবধান রচিত হয়।
দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। তিনি তন্ত্রশাস্ত্রের সংস্কার সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে হয়তো তাঁকে কিছুটা উগ্রপন্থার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কৃষ্ণানন্দ বৈষ্ণবপন্থীদের সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্যাম এবং শ্যামা ভিন্ন পথের পথিক। কিন্তু তাঁর সামনে একদা একটি অলৌকিক নাটক অভিনীত হয়। আর তখনই কৃষ্ণানন্দের মনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। এক মধ্যরাতে তিনি তাঁর ভাইয়ের গৃহে গিয়ে যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা আমরা হয়তো দিতে পারব না, কিন্তু আমরা বুঝতে পারব এই বিশ্বের অন্তরালে এমন একটি অলৌকিকত্ব জেগে আছে, যাকে সহজে চিহ্নিত করা যায় না। সেদিন তিনি দেখেছিলেন, সেখানে স্থাপিত গোপাল মূর্তির সাথে শ্যামামূর্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শ্যামা জননী রূপে বালগোপালকে ভোগ নিবেদন করছেন। কৃষ্ণানন্দ এই দৃশ্য দেখে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। আসলে এক ধর্মমতের সঙ্গে অন্য ধর্মমতের কোনও পার্থক্য নেই। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন পথের পথিক হয়ে একই পর্বতে আরোহনের চেষ্টা করছি।
জগন্মাতার কৃপায় তখন কৃষ্ণানন্দের অধ্যাত্ম জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। তিনি মহাকৌল সাধকের শক্তি অর্জন করতে পেরেছিলেন। জটাধারী পরমহংস নামে এক তন্ত্রসাধক তাঁকে এই মতে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ওই মহাপুরুষ ছিলেন অসম্ভব যোগবিভূতির অধিকারী। তাঁর জীবনে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
সেদিন ছিল কার্তিকী অমাবস্যা। জঙ্গলাকীর্ণ বাগিচার মধ্যে বসে কৃষ্ণানন্দ শ্যামাপূজার আয়োজন করছেন। অনেক ভক্ত ইষ্ট বিগ্রহের সামনে বসে অছেন। পূজার অবস্থায় তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত ‘মা’, ‘মা’ ধ্বনি ইথার তরঙ্গে এক অদ্ভুত অনুরণনের সৃষ্টি করত। মুহূর্তে মৃণ্ময়ী মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হতো। সেদিনও একই ঘটনা ঘটে গেল।
তখন কৃষ্ণানন্দের অর্ধচেতন অবস্থা। যন্ত্রচালিতের মতো তিনি একটির পর একটি কাজ করে চলেছেন। পূজা শেষ হল, ভোগ নিবেদন করা হল। হঠাৎ অরণ্য প্রান্ত থেকে কে যেন বললেন—”কৃষ্ণানন্দ, দেখছো না মায়ের ভোগ গ্রহণ এখনও সম্পন্ন হয়নি। তুমি কি এখন তাঁর হাতে আচমনের জল তুলে দেবে? ভালো করে তাকিয়ে দেখো, তোমার নিবেদিত পায়েসান্ন, পুষ্পপত্র আর নির্মাল্যর ভিড়ে হারিয়ে গেছে।”
কৃষ্ণানন্দ এই বাণী শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। কেমন সেই মহাপুরুষ, যিনি এতদূরে থেকেও সবকিছু দেখতে পান? কৃষ্ণানন্দ দেখতে পেলেন, সত্যি, মায়ের ভোজন এখনও শেষ হয়নি। হঠাৎ পেছন ফিরে এক দীর্ঘদেহী পুরুষকে দেখতে পেলেন। সেই মানুষটির কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। মাথায় শুভ্র জটাজাল এবং পরিধানে লালবস্ত্র। নিষ্পলক নেত্রে তিনি কৃষ্ণানন্দের দিকে তাকিয়ে আছেন। কৃষ্ণানন্দ ভাবলেন, এ কোন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী? আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন কেন?
তিনি সবিনয়ে ওই আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাইলেন।
স্মিত হাসি হেসে ওই মহাপুরুষ বলেছিলেন—”বাবা, তোমরা যাঁকে ঝুটিয়া জাদু বলে জানো, আমি সে—ই। আমার নিজের জাদু থাক বা না থাক, শ্যামা মায়ের জাদুতে আমি পড়েছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কৃষ্ণানন্দ, আমি দীর্ঘদিন ধরে তোমার সাধন এবং তন্ত্রসংস্কারের কথা শুনেছি। তাই তো ভাবলাম আজ একবার তোমার সাথে দেখা করব। তোমার পূজার আকুতি আমি দেখেছি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তুমি মায়ের কাছে যা প্রার্থনা করেছিলে তার সবকিছুই পেয়েছো। বাংলার শক্তিসাধনা তোমার স্পর্শে নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠুক।”
জটাধারী পরমহংস বেশ কিছুদিন কৃষ্ণানন্দের আতিথ্যে নবদ্বীপে অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁর অধীনে থেকে কৃষ্ণানন্দ কৌল সাধনার গূঢ় বিষয়গুলি শিক্ষা করেন। তন্ত্রসিদ্ধির আলোতে তাঁর জীবন আলোকিত হয়ে ওঠে।
এইভাবে কৃষ্ণচন্দ্র আগমবাগীশ মাতৃ—আরাধনায় নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন। তিনি আপন শক্তি বলে মাতৃসাধনার কন্টকসঞ্চারী ধারাকে সর্বজনের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
রামপ্রসাদের মাতৃসাধনা সঙ্গীত—সাধনা। তিনি ছিলেন বাংলার শক্তিসাধনার এক চলিষ্ণু চারণ কবি। মাতৃনাম যজ্ঞের অন্যতম ঋত্বিক হিসাবে তাঁকে আমরা প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করি। আজও যখন ইথার তরঙ্গে স্পন্দিত হয়, তাঁর ‘আমায় দে মা তবিলদারি। আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী …’ গানটি, তখন আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে কোথায় যেন বেজে ওঠে রাগসঙ্গীত। আমরা বুঝতে পারি যাকে অনুভব করতে হলে শুধু আচার—বিচার আর ধ্যানমগ্নতা থাকলে চলবে না মনের মধ্যে ভক্তিরসের প্লাবন আনতে হবে, তবেই তো মায়ের সাথে ছেলের নিভৃত আলাপন সুসম্পন্ন হবে।
বাংলার ঘরে ঘরে তাই আজও মাতৃসাধক রামপ্রসাদ এক জীবন্ত সত্তা স্বরূপ বিরাজ করছেন। আজও গ্রামবাংলার পথে—প্রান্তরে, আকাশে—বাতাসে তাঁর লেখা সঙ্গীত শোনা যায়। পণ্ডিত—মুর্খ, ধনী—দরিদ্র সকলেই তাঁর মধুস্রাবী সঙ্গীত মাধুর্যে চমকিত এবং পুলকিত হল।
এইভাবেই মাতৃসাধক রামপ্রসাদ প্রমাণ করেছেন যে, বাংলার মাতৃসাধনার শুধুমাত্র তাত্ত্বিক দিকগুলি পরিস্ফুটিত হয়নি, এর পাশাপাশি ভাববাদী এবং ভক্তিবাদী বিষয়গুলিও যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
শ্যামা মা ছিলেন রামপ্রসাদের ইষ্টদেবী। তত্ত্বদর্শী সাধকের দৃষ্টিতে এই মা হলেন ব্রহ্মরূপিণী মহাশক্তি। এই মহাশক্তিকে রামপ্রসাদ বারবার তাঁর সঙ্গীতের মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন। চিন্ময়ী রূপে হয়েছেন তিনি আবির্ভূত। আর শিশুর মতো রামপ্রসাদ তাঁর কাছে ইহজীবনের সকল দুঃখ—কষ্ট, জ্বালা—যন্ত্রণার কথা নির্দ্বিধায় নিবেদন করেছেন।
রামপ্রসাদের মা অসুরনাশিনী। তিনি ভীমা ভয়ঙ্করা এবং প্রলয়ঙ্করী। কিন্তু রামপ্রসাদের কাছে তাঁর অন্য একটি পরিচয় আছে। সেই পরিচয়ের মধ্যে আমরা আমাদের জন্মদাত্রী মাকে সন্ধান করে থাকি। রামপ্রসাদের মাতৃসাধনা তাই সন্তান আর জননীর মধ্যে অবস্থিত এক অমলিন সম্পর্কের পরিচয় প্রদান করছে। মাতৃভাবনায় উদ্বুদ্ধ সাধক রামপ্রসাদ তাই মান—অভিমানের লীলাখেলায় মেতে উঠেছিলেন। মায়ের কোলে বসে গেঁথেছেন ভক্তিসঙ্গীতের মালা। এই মালা কণ্ঠে ধারণ করেছেন অগণিত সাধারণ মানুষ। আর রামপ্রসাদের স্পর্শ পেয়ে তাঁরাও ঈশ্বরসাধনায় মগ্ন হয়েছেন।
প্রসাদী গান আমাদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ। আবার এই গানের মাধ্যমে রামপ্রসাদের যে দার্শনিক অভিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল, তার যথার্থতাকে আমরা আজও অনুভব করে থাকি।
এহেন সঙ্গীত সাধকের জন্ম হয়েছিল ভাগীরথীর পূর্বতটে হালিশহরে। চৈতন্যের দীক্ষাগুরু বৈষ্ণবাচার্য ঈশ্বরপুরীর জন্ম হয়েছিল এই অঞ্চলে। মনে হয় এইভাবে বোধহয় শ্যাম ও শ্যামা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।
রামপ্রসাদের পিতা ছিলেন রামরাম সেন। সেন মহাশয় এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি সাধন—ভজনে ছিলেন উৎসাহী। তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের জন্য তাঁর পূর্বপুরুষরা ওই অঞ্চলে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
পিতার ইচ্ছানুসারে রামপ্রসাদ প্রথম জীবনে বৈষয়িক বিষয়গুলির সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর আসল টান ছিল জগজ্জননীর প্রতি। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি সংসারিক সুখ পরিত্যাগ করে ঈশ্বর ভাবনায় ব্রতী হয়েছিলেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর সোনার কলম থেকে যে—সমস্ত সঙ্গীত ঝরণা নির্ঝরিত হয়েছিল, সেগুলির সাহিত্যমান আজও আমরা নিরূপণ করতে পারিনি। আমরা বুঝতে পারি কত বড়ো কবিত্ব শক্তির অধিকারী হলে এবং দার্শনিক অভিজ্ঞান থাকলে এমন রূপকধর্মী সঙ্গীত রচনা করা সম্ভব। যেমন, রামপ্রসাদ শহর কলকাতায় কার্যরত অবস্থায় কাজের খাতায় লিখেছিলেন তাঁর এই গানখানি—”আমায় দে মা তবিলদারি, আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী”।
পরবর্তীকালে তাঁর কবি প্রতিভার পরিচয় পেয়ে শহর কলকাতার জমিদার তাঁকে হালিশহরে ফিরে যেতে বলেন। সেখানে এসে নতুন করে মাতৃসাধক রামপ্রসাদ মাতৃ—আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি সবসময় সঙ্গীতময় জগতের বাসিন্দা হয়ে বসবাস করতে ভালোবাসতেন। কখনও গঙ্গায় নিমজ্জিত অবস্থায় দেবীর নির্দেশে গানের অর্ঘ্য ঢেলে দিতেন। আবার কখনও নিজের নিভৃত সাধন কুটিরে বসে ভাব—তন্ময় হয়ে যেতেন।
রামপ্রসাদের গানের মধ্যে একদিকে আছে ভক্তপ্রাণের আকুতি, অন্যদিকে নিরবচ্ছিন্ন দার্শনিকতা। মাতৃসঙ্গীত যে কত আন্তরিক এবং মর্মস্পর্শী হতে পারে, রামপ্রসাদ তাঁর অসংখ্য গানে তা প্রমাণ করেছেন। শুধুমাত্র শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা হিসাবেই যে তিনি বিখ্যাত তা নয়, তাঁর আগমনী গানও আমাদের মনকে আকর্ষণ করে। এই দু—ধরনের গানের মধ্যে দু—ধরনের প্রকৃতি লুকিয়ে আছে। তবে রামপ্রসাদের সঙ্গীত সাধনার সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল তিনি জগজ্জননীরূপে ঈশ্বরীকে প্রার্থনা করেছেন।
তাই তাঁর গানের প্রবাহ আজও একইরকমভাবে চলেছে। তাঁর সঙ্গীতসাধনার আকর্ষণে হাজার হাজার মানুষ হালিশহরে এসে সমবেত হতেন। এই সঙ্গীত সাধনার পাশাপাশি রামপ্রসাদ তাঁর নিজস্ব সাধনার দিনটিকেও পরিস্ফুটিত করেন। তিনি তাঁর গৃহসন্নিহিত জঙ্গলে পঞ্চবটী প্রস্তুত করেছিলেন। তার উপর স্থাপিত হয়েছিল বিখ্যাত পঞ্চমুণ্ডির আসন।
তখন তাঁর হৃদয় ভাবৈশ্বর্যের দ্যুতিতে উদভাসিত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে মাকে উদ্দেশ্য করে সঙ্গীত নিবেদন করেন। সাধনসাগরের গভীরে ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হতে থাকেন। কিন্তু দার্শনিক কবি বুঝতে পেরেছিলেন সহজে মা—র সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বললেন—
”কে জানে গো কালী কেমন।
ষড়দর্শনে না পাই দরশন।”
মা কালীর ভেতর যে ব্রহ্মময়ী সত্তা লুকিয়ে আছে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ না করেও রামপ্রসাদ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই লিখেছিলেন—
”মায়ের উদর ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড
প্রকাণ্ড তা জানো কেমন।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম
অন্য কেবা জানে তেমন।”
এই মহাসিন্ধু শেষ কোথায় তা কে জানে? সীমাহীন ব্রহ্মময়ীকে তিনি সীমার মধ্যে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। নিরাকারকে দিতে হবে আকার। তাই তাঁর প্রাণের ভেতর সেই সুর বারবার পরিস্ফুটিত হয়েছে। তিনি মায়ের সাথে আত্মিক এবং আন্তরিক যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। জগতের খুব কম ধর্মসাহিত্যেই এই ভাবময়তার তুলনা পাওয়া যায়।
প্রসাদ গেয়েছিলেন—
”অভয়পদ সব লুটালে
কিছু রাখলে না মা তনয় বলে
হারার জিম্মা যার কাছে মা
সে জন তোমার পদতলে।”
গভীর রাতে সাধনা করতে করতে রামপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মা হলেন ব্রহ্মময়ী বিশ্বপ্রসবিনী, বিশ্বপালয়েত্রী, আবার বিশ্বসংহারিণী। কিন্তু তাঁর কাছে এই মায়ের সাথে জন্মদাত্রী মায়ের কোনও তফাৎ নেই।
মায়ের চরণ বন্দনা করতে করতে রামপ্রসাদ মাঝে মধ্যে সমাধিতে মগ্ন হতেন। আর সমাধি ভেঙে গেলে মায়ের সাথে চলতো মান—অভিমানের পালা। কথিত আছে, তিনি নাকি জগজ্জননীকে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এইভাবে দিন এগিয়ে যায়। রামপ্রসাদ তখন তাঁর সাধনার একটির পর একটি সোপান পার হচ্ছেন। তাঁর অন্তর তখন নব নব প্রেম উন্মাদনায় উদ্বেলিত হয়ে উঠছে। এই সময় তাঁর জীবনে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়। এইসব ঘটনার মাধ্যমে রামপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিশ্বজননী সর্বত্র একইভাবে অবস্থান করেন। তাঁকে দর্শন করার জন্য কোনও তীর্থস্থানে যাওয়ার দরকার নেই।
রামপ্রসাদের অন্তরাত্মা তখন ঈশ্বরানুভূতিতে একেবারে পরিপ্লাবিত হয়েছে। অন্তরে দেখা দিয়েছে তীব্রতম বৈরাগ্য। মনে হচ্ছে তাঁর দেহাঙ্গ বুঝি সীমাহীন নবলোকে উড়ে চলেছে। তখন রামপ্রসাদ বীরাচারী সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন।
তাঁর প্রাণে আকাঙ্ক্ষা জেগেছে যে করেই হোক মা জগদম্বার চিন্ময়ীমূর্তি দর্শন করতে হবে। তামসী অমাবস্যা আসে এবং চলে যায়, রামপ্রসাদ পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে জপধ্যানে মগ্ন থাকেন।
একবার পঞ্চবটীর সিদ্ধাসনে বসে তিনি একমনে মাতৃ—আরাধনা করছিলেন। সেই সময় তাঁর সামনে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। জননী আবির্ভূতা হলেন ধ্যানমগ্না পুত্রের সামনে। অনন্ত জ্যোতির প্লাবন দেখা দিল চারপাশে। মাতৃমূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হয়ে রামপ্রসাদ এক বাধাতীত চিন্ময় রাজ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন।
পরদিন অচেতন দেহে সংজ্ঞা ফিরে এল। অবাক চোখে তিনি দেখলেন চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমেছে।
এরপর থেকে মাঝেমধ্যে তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতেন। তখন তাঁর মনে এক নতুন চেতনার জন্ম হয়েছে। তাঁর রচিত সঙ্গীতের মধ্যে এসেছে অন্যরকম প্রতীতি। দিব্যদেহে ফুটে উঠেছে এক দিব্যকান্তি এবং সূর্যসদৃশ উজ্জ্বলতা। তখনই এক শক্তিমান কালীসাধক হিসাবে রামপ্রসাদের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
রামপ্রসাদ এইভাবে বীরাচারী শক্তিসাধনার এক—একটি স্তর অতিক্রম করেছিলেন। এবার এক নতুন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। কিন্তু কে হবেন সেই সিদ্ধপুরুষ? একদিন শ্যামনগরে গঙ্গার ধার দিয়ে রামপ্রসাদ একা হেঁটে চলেছেন। হঠাৎ দিব্যাকান্তি দীর্ঘকায় এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি শবসাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন। ইছাপুর ও শ্যামনগরের মাঝখানে বরতিবিলের কাছে ছিল এক পুরাতন শ্মশান। সেখানে বসে ওই মহাপণ্ডিত অমাবস্যার নিশীথে তন্ত্রসাধনা করতেন। এই তন্ত্রাচার্য রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
মাতৃসান্নিধ্যে সঞ্জীবনী শক্তিতে তখন বীরাচারী সাধকের মন ভরে গেছে। শ্যামা ও শ্যামের সমন্বয়তত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন। গানের মাধ্যমে তা প্রকাশ করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সর্বভেদ ও দ্বন্দ্বের অতীত এক পরম দর্শনকে অনুধ্যানের মাধ্যমে জানতে হবে।
এবার তিনি পৌঁছে গেলেন সাধন জীবনের পরবর্তী স্তরে। তখন তাঁর সমস্ত চেতনা এক অখণ্ড চৈতন্যের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছিল। এই সময় রামপ্রসাদ যে—সব গান লিখেছিলেন সেখানে ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তির অভেদতত্ত্বের বর্ণনা আছে। ‘তারা আমার নিরাকার’ অথবা ‘এবার শ্যামার নাম ব্রহ্ম জেনে ধর্মকর্ম সব ছেড়েছি’ প্রভৃতি গানগুলি শুনলে আমরা তাঁর চরম অনুভূতির পরিচয় পাব।
প্রথম জীবনে তিনি তাঁর ইষ্টদেবী শ্যামা মাকে ভক্তির ডোরে বাঁধতে চেয়েছিলেন, তারপর তান্ত্রিক গুরুর নির্দেশে বীরভাবে অধ্যাত্মস্রোতে তাঁর হৃদয় ভেসে গিয়েছিল। অবশেষে এসেছিল দিব্যভাব আর কৌলসাধনার চরম সাফল্য।
শেষ জীবনে রামপ্রসাদের অধ্যাত্মচিন্তায় এক রূপান্তর দেখা দিল। এই সময় তিনি জগন্মাতার এক অবোধ শিশুতে পরিণত হয়েছিলেন। চিন্ময়ী জননীর সঙ্গে শুরু হয়েছিল তাঁর চিরকালের খেলা। ভক্তির ভাবে বিভোর হয়েছিলেন রামপ্রসাদ। বালকবৎ এই ব্রহ্মপুরুষ তখন তাঁর কণ্ঠ থেকে শুধুমাত্র মায়ের নাম উচ্চারণ করছেন। তখন গেয়েছিলেন—
”আমার অন্তরে আনন্দময়ী সদা করিতেছেন কেলি
আমি যে—ভাবে যে—ভাবে থাকি নামটি কভু নাহি ভুলি।”
দেখতে দেখতে যৌবনসূর্য অস্তাচলের দিকে এগিয়ে গেল। এই সময় মাতৃসাধক রামপ্রসাদ শুদ্ধভক্তির এক রসভাণ্ডার বুঝি উজাড় করে দিয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শক্তি এবং জ্ঞানমার্গের পথ মোটেই দুর্গম নয়। ঈশ্বরকে প্রাণপণে ডাকলে ঈশ্বর শেষপর্যন্ত আমাদের সামনে প্রকটিত হন। তখন রামপ্রসাদ লিখছেন—
”প্রসাদ বলে, ভক্তের আশা পুরাইতে অধিক বাসনা
সকারে সাযুজ্য হবে নির্বাণে কী গুণ বলো না।”
আবার কখনও লিখছেন—
”ওরে সকলের মূল ভক্তি
মুক্তি হয় মন তার দাসী।
নির্বাণে কী আছে ফল
জলেতে মিশায়ে জল।
ওরে চিনি হওয়া ভালো নয়
মন চিনি খেতে ভালোবাসি।”
এই হলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ। কথিত আছে, তিনি গঙ্গায় আত্মবিসর্জন দিয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছিলেন। এইভাবেই রামপ্রসাদ বাংলার মাতৃসাধনার ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করলেন, যে ধারায় বিশুদ্ধ চৈতন্য আনন্দের সাথে ভক্তিরসের সংমিশ্রণ ঘটে গেছে। তাইতো হালিশহরে গেলে আজও সেই মহাসঙ্গীতসাধকের কথাই মনে পড়ে যায় আমাদের।
সাধক বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে যে সিদ্ধপীঠের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেটি হল তারাপীঠ। তারাপীঠ বশিষ্ট—সিদ্ধপীঠ। মহাচীনাচার—এ এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত আছে—
”ব্রহ্মণো মানসপুত্রো বশিষ্ঠ স্থির সংযমঃ
তারামায়াধয়ামাস পুরা নীলাচলে মুনিঃ
জপম সন্তারিণীং বিদ্যাং কামাখ্যা যোনিমণ্ডলে
নানুগ্রহং চকারাসৌ তারা সংসারতারিণী।
অথাসৌ পিতরং গত্বা ব্রহ্মানং পরমেষ্ঠিনম্
কোপেন জ্বলিতো বিদ্বান উবাচ পিতুরন্তিকে।”
—ব্রহ্মার মানসপুত্র মহামুনি বশিষ্ঠদেব দীর্ঘদিন কঠোর সাধনা করেছিলেন। তিনি সাধনমার্গের সবকটি স্তর অতিক্রম করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য তাঁর এই প্রয়াসে সফল হতে পারেননি। ব্যথা ও হতাশ হয়ে তিনি পিতার কাছে এসে উপস্থিত হলেন। পিতা ব্রহ্মা তাঁকে কামাখ্যাযোনিমণ্ডলে গিয়ে কঠিন কঠোর তপস্যায় রত হতে বলেছিলেন। এতেও বশিষ্ঠদেব সিদ্ধিলাভ করতে পারলেন না। রাগে—দুঃখে ব্রহ্মপ্রদত্ত তারাবীজকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, এখানে কোনও সাধক কোনওদিন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন না।
বশিষ্ঠের এই আচরণ দেখে সহসা দৈববাণী হল। বলা হল, ”হে বশিষ্ঠ, তুমি আমার সাধনভূমি সম্পর্কে সব কিছু না জেনে বৃথা আমাকে দোষারোপ করছো। এই প্রসঙ্গে জ্ঞানলাভ করতে হলে তোমাকে মহাচীনে গমন করতে হবে। সেখানে বুদ্ধরূপী জনার্দনের অবস্থান। তুমি তাঁর শরণাপন্ন হও। তিনিই তোমাকে আমার সাধন পদ্ধতির গূঢ় বিষয়গুলি বুঝিয়ে বলবেন।”
বশিষ্ঠদেব চলে গেলেন মহাচীনে। বাঞ্ছিত সাধক জনার্দনকে আবিষ্কার করলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন জনার্দন মাংস, সোমরস, মুদ্রা এবং কামিনী রেখে যোগ্যসাধনায় নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। এই বিষয়টি বশিষ্ঠদেবের ভালো লাগেনি। এক বুক হতাশা নিয়ে তিনি ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার দৈববাণী শোনা গেল—”এই হল আমার সাধন পদ্ধতি।”
এবার বুদ্ধরূপী জনার্দনের কাছে নিজেকে নিবেদন করলেন বশিষ্ঠদেব। তাঁরই আশীর্বাদে নানা জ্ঞানতত্ত্ব লাভ করলেন। তারপর বুদ্ধরূপী জনার্দন বলেছিলেন—”বশিষ্ঠ, বক্রেশ্বরের ঈশান কোণে, বৈদ্যনাথধাম থেকে পূর্বে, দ্বারকা নদীর পূর্ব তীরে একটি শ্বেতশিমূল বৃক্ষ আছে। সেখানে গিয়ে শিলাময়ী দ্বিভুজা তারিণীদেবীর সাধনায় নিজেকে নিয়োগ করবে।”
ওই মহাত্মা পুরুষের কথা মতো বশিষ্ঠ শেষ পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত শ্বেতশিমূলতলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারপর শুরু হল তাঁর সাধনা। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন অর্থাৎ শুক্লাচতুর্দশী তিথিতে তিনি তারা মায়ের দর্শন লাভে ধন্য হন। তখন থেকেই এই পীঠ এক বিশেষ পীঠের মর্যাদা লাভ করেছে।
এহেন দেবীর কাছে সারাজীবন ধরে সাধনা করেছেন বামাক্ষ্যাপা। তাঁর সাধন পদ্ধতির মধ্যে যেসব রহস্য লুকিয়ে আছে তা সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। একেবারে ছোটোবেলা থেকে তাঁর মনের ভিতর এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব এসেছিল। তিনি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই পৃথিবীর সবকিছুই নশ্বর। একমাত্র সত্য ওই ব্রহ্মময়ী তারা। তাঁর জীবনে এত বেশি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে যা আমাদের অবাক করে দেয়। কোনও কোনও সময় তিনি ভাবসমাধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যেতেন। একেবারে কিশোর বয়স থেকেই তিনি এই বিষয়টি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। তাঁর কানের কাছে মা তারার নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবসমাধি ভেঙে যেত। এভাবেই সেদিনের শিশু বামা হয়ে উঠলেন সাধক বামাক্ষ্যাপা।
তাঁর সাধন পদ্ধতি বড়ো অদ্ভুত। তিনি যোগসাধনের নিয়মনীতি কিছুই মানতেন না। তাঁর কাছে স্বর্গ—মর্ত্য—পাতাল সর্বত্র তারা মায়ের উপস্থিতি। আপন পদ্ধতিতে মাকে পূজা করতেন। তাঁর পূজা পদ্ধতি দেখে অনেকে তাঁর ওপর রুষ্ট হয়েছেন। অনেকে তাঁকে মন্দির থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেছেন। তা সত্ত্বেও বামাক্ষ্যাপাকে কেউ এই পথ থেকে সামান্যতম বিচ্যুত করতে পারেননি।
সাধক বামাক্ষ্যাপার সাধক জীবনের সঙ্গে তারাপীঠের মহাশ্মশান ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে—
”পীঠং যথা :—শ্মশানং তত্র সঞ্চিন্ত্য তত্র কল্পদ্রুমং স্মরেৎ!
তন্মুলে মণিপীঠঞ্চ নান্যমণিবিভূষিতং।
নানালঙ্কার ভূষাত্যাং মুনিদেবৈশ্চ ভূষিতং শিবাভির্ব্বামাংসাস্থিমোদসা— নাভিরস্ততঃ।
চতুর্দ্দিক্ষু শবমুণ্ড চিতাঙ্গরাভি ভূষিতং।”
ব্রজবাসী নামে এক মহাসাধক ওই মহাশ্মশানে বেশ কিছুদিন কঠোর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি হলেন সাধক বামাক্ষ্যাপার গুরু। ব্রজবাসীর রীতিনীতি একেবারে আলাদা। তিনি শিয়াল—কুকুরের এঁটো নির্দ্বিধায় গলধঃকরণ করেন। তাঁর এই পদ্ধতি একেবারে পৈশাচিক। বামাক্ষ্যাপা তাঁর কাছ থেকে সাধন পদ্ধতি অনুধ্যান করেছিলেন বলেই বোধহয় তাঁর সাধনার মধ্যে আদি বিষয়গুলি রয়ে গেছে। বামাক্ষ্যাপা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতেন না। মনুষ্যেতর সারমেয়রা ছিল তাঁর অতি প্রিয়।
ব্রজবাসীকে সকলে পিশাচসিদ্ধ বাবা বলে মনে করত। ধীরে ধীরে তাঁর এক—একটি বিভূতি প্রকাশ পেতে থাকল এবং তা দেখে সমবেত জনগণ একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কখনও কখনও মরা তুলসী গাছের ওপর জল ছিটিয়ে তাকে জীবন্ত করতেন। আবার জলের নীচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। পাখির মতো শূন্যে বিচরণ করতেন। এই পিশাচসিদ্ধ মহাপুরুষ বামাচরণের প্রথম এবং প্রধান গুরুরূপে আবির্ভূত হলেন।
শক্তিসাধনার ক্ষেত্রেও ওই তারাপীঠ মহাশ্মশানে বামাক্ষ্যাপার অনেক বিনিদ্র রাত কেটে গেল। এখানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন মহামুনি বশিষ্ঠদেব, ব্রজবাসী, কৈলাসপতি, রাজা রামকৃষ্ণ, কমলাকান্ত, দয়ানন্দ সরস্বতী, বিশেক্ষ্যাপা এবং নিগমানন্দ সরস্বতী প্রমুখ সাধকরা। সেখানে পাতা হল বামাক্ষ্যাপার পঞ্চমুণ্ডির আসন।
ঘর—সংসার থেকে দূরে বসবাস করতে ভালোবসতেন তিনি। তাই বোধহয় তাঁর চরিত্রের মধ্যে বেশ কিছু চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছিল। কখনও কোনও কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে পারেননি। সবসময় দেবী তারা মায়ের অর্চনায় ব্যস্ত থাকতেন।
ছেলের এ হেন অবস্থা দেখে তাঁর মা রাজকুমারিদেবী খুবই চিন্তান্বিত ছিলেন। বয়স সবেমাত্র কৈশোরে পদার্পণ করেছে, অথচ এখনই তারা মায়ের জন্য সে কী আকুল আর্তি। মাঝরাত পর্যন্ত নির্ঘুম অবস্থায় কাটিয়ে বামাচরণ মাকে বিরক্ত করতে থাকেন।
একদিন রাজকুমারীদেবী বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। সেদিন তিনি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই কিশোরকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী রাখা উচিত হবে না। অনন্ত আকাশেই তার মুক্তি। সেদিন তিনি তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন—”আশীর্বাদ করলাম, তোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। মা তারার চরণে আত্মনিবেদন কর। তারাপীঠই হবে তোর শান্তির নীড়।”
মধ্যরাতে বামাচরণ বেরিয়ে এলেন বাইরে। মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—”দুঃখ করো না মা, আজ আমার কাছে পৃথিবী তারাময় হয়ে গেছে। শয়নে—স্বপনে—জাগরণে শুধুই তারা। সুখে—দুঃখে তারা ব্রহ্মময়ী। তারা বিনা কোনও কিছুতেই শান্তি নেই। নেই এতটুকু স্বস্তি। আমার কেবলই মনে হয় মা বোধহয় আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে আমি থাকব কেমন করে?”
রাত্রির অন্ধকার অগ্রাহ্য করে তিনি ছুটছেন। মাঠঘাট পার হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে পৌঁছোলেন দ্বারকা নদীর পাড়ে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাঁতরে দ্বারকার অপর পাড়ে গিয়ে উঠলেন। শ্মশানের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ এক অভাবিত দৃশ্য দেখে বাকহারা হয়ে গিয়েছিলেন বামাচরণ।
কী দেখলেন তিনি? দেখলেন এক বিশাল পুরুষ মূর্তি তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সর্বাঙ্গে বুঝি বিদ্যুতের ঝিলিক। মুখে ‘জয় তারা’, ‘জয় তারা’ মন্ত্র।
বামাচরণ লুটিয়ে পড়লেন সেই পুরুষ মূর্তির চরণে। তারপর আচ্ছন্নের মতো বলতে থাকলেন—”তুমি সৃষ্টি—স্থিতি—লয়। তুমিই ব্রহ্ম। তুমি অগ্নি, তুমি বারি, তুমি বায়ু। তুমি মন্ত্র, তুমি তন্ত্র, তুমি মোক্ষ। তুমি সাকার হয়েও নিরাকার। তুমি আমার ইহকাল এবং তুমিই আমার পরকাল। তুমি গুরু, আমার অন্ধকারের দিশারী, তুমি শ্মশানবাসী, তুমি শ্মশানভৈরব।”
তখনই ব্রজবাসী সস্নেহে বামাচরণকে তুলে ধরলেন, বললেন—”বামা, আমিই তোমার গুরু, জন্ম—জন্মান্তর ধরে আমি তোমাকে অলৌকিক পথের সন্ধান দিয়ে যাব। আমার একমাত্র আশা—আকাঙ্ক্ষা শুধু তুমি।”
এই ঘটনায় অবাক হয়ে গেলেন বামাচরণ। তিনি বললেন—আমার কাম্যকর্ম ত্যাগ করে তোমার চরণে নিজেকে উৎসর্গ করছি গুরুদেব। যাবতীয় কর্মের ফল ত্যাগ করে আজ আমি নিজেকে সন্ন্যাস গ্রহণের উপযোগী করে তুলেছি।
একটু হেসে তাঁর গুরু বলেছিলেন—হে বৎস, আমি বুঝতে পারছি, তুমি সকল পার্থিব বিষয় থেকে নিজেকে মুক্ত করেছো। আমি যোগবলে তোমার যাবতীয় বৃত্তান্ত অবগত হয়েছি। আজ তুমি যথার্থই ত্রিবিধৈষণাবিনিমুক্ত। লোকৈষণা, বিত্তৈষণা এবং পুত্রৈষণা—এই তিনটি আকাঙ্ক্ষাবদ্ধ জীবকে আরও অন্ধকার বিবরের দিকে নিয়ে যায়। তুমি এই বয়সেই এই তিনটি আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছো।
এই কথা শুনে বামাক্ষ্যাপার দু’চোখে আনন্দাশ্রুধারা নেমে এসেছিল।
ব্রজবাসী বলেছিলেন—”আমি বেশ বুঝতে পারছি—তুমি একদিন পরম মোক্ষ লাভ করবে। তুমি পিছুটান রেখে আসোনি। শাস্ত্রমতে বলা হয়, বৃদ্ধ পিতামাতা, ধর্মপত্নী, শিশু—পুত্রকন্যা বা অসহায় প্রতিবন্ধী বান্ধবকে ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে মোক্ষ লাভ হয় না, বরং নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তাই অনুশোচনা করার মতো কোনও কারণ তোমার নেই।”
ক্ষ্যাপা হলেন শ্মশানবাসী। আরাধ্যদেবী তারার নামগান আর গুরু ব্রজবাসীর সেবা হল তাঁর জীবনের দুটি উদ্দেশ্য। এইভাবে দিনের পর দিন কাটতে থাকে। আর সাধনার এক—একটি স্তর পার হতে থাকেন বামাক্ষ্যাপা।
এই অবস্থায় তাঁর এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল যা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কখনও তিনি দেখতেন, তাঁর গুরু ব্রজবাসীকে ঘিরে প্রেতযোনিদের উল্লাস। শুধু তাই নয়, কখনও আবার চোখের সামনে হঠাৎ আলোকশিখা জ্বলে উঠত। এই বিষয়গুলির ব্যাখ্যা ব্রজবাসী দিয়েছিলেন। যাঁরা সাধক ছিলেন, তারা মায়ের সাধনা করার জন্য শ্মশানে এসেছিলেন, অথচ মহাশ্মশানের ভয়ঙ্করতা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছিলেন, তাঁরাই এখন প্রেতযোনি হিসাবে তাঁর চারপাশে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
এর পাশাপাশি বামাক্ষ্যাপা নানাবিষয়ে শাস্ত্রজ্ঞ জ্ঞানার্জন করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বীজমন্ত্র বারবার উচ্চারণ করলে শরীর এবং মনে এক প্রবল আশার সঞ্চারণ ঘটে। মনে হয়, আমার শরীরটা বুঝি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে। কখনও কখনও বামাক্ষ্যাপা শিমূল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একদিন তাঁর গাঁজার আগুনে গাছের গোড়াটি পুড়তে শুরু করে। গাছটি ধ্বংস হয়ে গেলে বামাক্ষ্যাপার চোখের সামনে একটি বিবর প্রস্ফুটিত হল। এটি বাতায়ন পর্যন্ত চলে গেছে। বামাক্ষ্যাপা প্রত্যক্ষ করলেন সেখানে অত্যুজ্জ্বল নীলাভ জ্যোতি বিরাজ করছে। যা চন্দ্র—সূর্যের কিরণকেও হার মানায়। বামাচরণ যখন তন্ময় হয়ে সেই জ্যোতি প্রত্যক্ষ করছিলেন, তখন সেখান থেকে এক দিব্যমূর্তির আবির্ভাব ঘটে। সেই মূর্তি দেখে তিনি একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। এই মূর্তির ডানহাতে খর্পর আর খড়্গ শোভা পাচ্ছে। আর বামহাতে কপালপাত্র ও নীলপদ্ম। তাঁর কণ্ঠদেশে মহাশঙ্খমালা। বরাভয় প্রদায়িনী এবং সদা অট্টহাস্যময়ী তারাদেবী বামাচরণের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তখন বামাচরণ নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন বহু আকাঙ্ক্ষিতা তারা মায়ের দিব্যমূর্তির দিকে। তাঁর চোখের সামনে ত্রিনয়না দেবী তারা! সাকারা ও নিরাকারা দেবী তারিণী। ক্ষ্যাপা বামাচরণ দীর্ঘসময় দেবীমূর্তি প্রত্যক্ষ করতে পারলেন না। ‘মা তারা’ বলে আর্তনাদ করে ধরাশায়ী হলেন। সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। চেতনাশূন্য হলেন তিনি।
পূর্ব আকাশে দেখা দিল লাল আলোর ঈশারা। বামাক্ষ্যাপা সংজ্ঞা ফিরে পেলেন। দেবীর কৃপায় তিনি পূর্বজন্মের স্মৃতির কথা মনে করতে পেরেছেন। তিনিই ছিলেন মহামুনি বশিষ্ঠদেব। এখানে তাঁর সিদ্ধিলাভ হয়েছিল। আর এজন্মে তিনি হয়েছেন সাধক বামাক্ষ্যাপা।
এরপর থেকে তাঁর সাধন—পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে এখন সৎ—চিৎ—আনন্দ স্বরূপিণী আদ্যাশক্তির প্রতিমূর্তি মায়ের কাছে সর্বক্ষণ থাকতে হবে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে মাতৃ—আরাধনাকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে। এ বড়ো শক্ত সাধনা। মা তারা রিপু—বিনাশিনী। তিনি বগলামুখী। তিনি মায়ামোহ বিনাশিনী মা ভৈরবী। আছেন মা’র আত্মা দেবীসতী পার্বতী। অসুরমর্দিনী দুর্গা। পরমাত্মার প্রতীক পরমা এবং আদ্যাশক্তি ব্রহ্মময়ী। আছেন উত্তমাগতি দেবী বীণাপাণি, সরস্বতী, সন্তানের বিদ্যাদাত্রী এবং মা’র অধমাগতি ধূমাবতী।
এইভাবেই দেবীমূর্তি বামাচরণের কাছে এক—একটি প্রতীক হয়ে এক এক রূপ ধারণ করতে লাগল। বামাক্ষ্যাপা বুঝতে পরলেন যে, এ বিশ্ব মায়াময়। একদিন না একদিন পৃথিবী মহাপ্রলয়ে ধ্বংস হবে। তাইতো বিশ্বকে জ্ঞানীরা অসৎ আখ্যা দিয়ে থাকেন। সগুণ ব্রহ্ম হচ্ছেন সৎ। সৎ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ করা হয়েছে সতী। এই সতী শক্তির আরাধনা করতে হবে।
শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, ব্রহ্মের রূপ হচ্ছে প্রকৃতি, পুরুষ এবং কাল। প্রকৃতিকে আখ্যা দেওয়া হয় ব্রহ্মশক্তি বলে। আর তাঁর অবস্থা হচ্ছে পুরুষ এবং কাল। কাল আমরা কাকে বলব? কালই হলেন ব্রহ্ম এবং কালই প্রকৃতি। কালই শক্তি আর প্রকৃতি হল চিন্ময়ী রাত্রি।
আকাশসংহিতায় বলা হয়েছে, বিশ্ব থেকে পঞ্চাশটি শূন্যের অবস্থান রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি শূন্যে চিন্ময়ী মা তারা আর আদিতে মহাপ্রলয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা বিদ্যমানা। দেবী কালিকা কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করে চলেছেন। আবার এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে তিনিই ধ্বংস করেন।
দেবী তারার অষ্টরূপ আছে—তারাদেবী, বজ্রা, সরস্বতী, মহোগ্রতারা, উগ্রতারা, ভদ্রকালী, কাবেশ্বরী এবং নীলা। শ্রীশ্রীশ্যামার আর একটি প্রকাশ হল বংশীধারী শ্যামারূপ। বংশী প্রেম এবং শব্দের প্রতীক। মা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে জয়ী হয়েছেন, নিবৃত্তি আনয়ন করেছেন। মা’র বুদ্ধি হল তারা নিরাকার। মা’র সুতীব্র কটাক্ষ দৃষ্টিই দেবী ছিন্নমস্তা। পরমাত্মা থেকে জীবাত্মার বিচ্ছিন্ন অবস্থাই—এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়। মা ষোড়শী, কারণ তিনি আনন্দময়ী। মার ভুবনমোহিনী রূপের প্রকাশ দেবী ভুবনেশ্বরী রূপের মধ্যে দিয়ে। স্নেহ এবং বাৎসল্যের প্রতীক হলেন দেবী কমলা। দেবী প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করে জয়যুক্ত হয়েছেন, আর এর ফলে নিবৃত্তির আনয়ন ঘটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে। মা আদ্যাশক্তি বলে মহাশক্তি—অর্থাৎ ব্রহ্মশক্তি। বামাচরণ ব্রহ্মসাধনায় নিরাকার তারাসাধনা সিদ্ধ হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। ব্রহ্ম ভিন্ন এজগতে যা কিছু আছে সবই মায়া। জগৎ মিথ্যা। জীব ব্রহ্মের মায়া বুঝতে অক্ষম। তাই অবস্তুকে বস্তু জ্ঞান করে থাকে। জীব অজ্ঞানতাবশত ‘আমি’, ‘আমার’ বলে থাকে। জাগতিক সুখ—দুঃখ, মঙ্গল—অমঙ্গল প্রভৃতি বোধ অজ্ঞানতাবশতই প্রকাশ পায়, কিন্তু যখন জ্ঞানোদয় হয়, আত্মবুদ্ধি নাশের মাধ্যমেই জীবের অহংবোধ নাশ হয়, তখন কেবলই আনন্দ উপলব্ধি লাভ করে, ঈশ্বর মঙ্গলময় ও করুণাময়। সৃষ্টির আদিতে অমঙ্গল বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। জীবকুল স্বীয় কর্মের মধ্যে দিয়েই অমঙ্গল সৃষ্টি করে।
আশ্রমিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার সাধক—সাধিকা শীত—গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে ঈশ্বর—সাধনায় লিপ্ত হয়েছেন। তাঁরা কৃচ্ছ্বসাধনের মাধ্যমে ইষ্টলাভে ব্রতী হয়েছেন। এমনকি ভগবানও অবতার হয়ে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে মর্ত্যবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। হিমালয়ের অত্যুচ্চ বরফের রাজ্য থেকে গভীর অরণ্যের মধ্যে সাধক—সাধিকাদের দেখা গেছে। বামাক্ষ্যাপা কিন্তু এর জন্য কোনও পর্বত বা জঙ্গলে প্রবেশ করেননি। তিনি তারপীঠকেই তাঁর সাধনক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন। তাঁর মধ্যে এমন একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল, যা তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাধন শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল।
এইভাবেই তিনি তাঁর মাতৃসাধনা সম্পূর্ণ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঈশ্বর অনুধ্যানের জন্য সেইভাবে ত্যাগ স্বীকার করা উচিত নয়। যদি মনে সাহস থাকে এবং আত্মবিশ্বাস থাকে, তাহলে আমরা ঘরে বসেও ঈশ্বরের সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারব।
শিবসংহিতার এক জায়গায় লেখা আছে—
”মন্ত্রোযোগে হঠশ্চেব লয়ে যোগস্তৃতীয়ক।
চতুর্থো রাজযোগ স্যাৎ দ্বিধাভাব বর্জ্জিত।”
এখানে বলা হয়েছে যোগ চার প্রকার—রাজযোগ, হঠযোগ, মন্ত্রযোগ ও লয়যোগ। তারাপীঠ—ভৈরব বামাক্ষ্যাপা ছিলেন রাজযোগী। রাজযোগে সিদ্ধপুরুষদের আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার প্রভৃতি অনুশীলন করতে হয় না। তাঁরা মন্ত্রাদি ও জপ করেন না। বামাক্ষ্যাপা জন্ম—জন্মান্তরে রাজযোগে সিদ্ধ বলে তিনিও জপতপ—সন্ধ্যা আহ্নিকে বিশ্বাস করতেন না। তাই তাঁকে আমরা সিদ্ধসাধক বলে থাকি।
আসন সম্পর্কে শাস্ত্রে একটি সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। সাধকরা কাজের চরিত্র ও প্রকৃতি অনুযায়ী যে অঙ্গভঙ্গিমা করে থাকেন, তা—ই আসন নামে চিহ্নিত।
প্রাণায়াম সম্পর্কে শাস্ত্রের মত হল মানসিক স্থিরতা আনয়নের জন্য আমরা প্রাণশক্তিকে কেন্দ্রস্থ করতে সক্ষম হই। এই প্রাণশক্তিকে কেন্দ্রাভিমুখী করার প্রক্রিয়াই হল প্রাণায়াম।
মানুষের মন নানা কারণে বিক্ষিপ্ত থাকে। মনঃশক্তিকে নিষ্ঠার মাধ্যমে গুটিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি স্থাপন করাই হল প্রত্যাহার।
মন্ত্র কী? সংক্ষেপে বলা যায়, মন—প্রাণ ঈপ্সিত বস্তু বা চেতনাকে উপলব্ধি করতে পারে, তাই হল মন্ত্র।
বামাক্ষ্যাপা এই সবকটি বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি বারবার বলতেন জ্ঞান এবং ভক্তিই হল সারবস্তু। ভক্ত আর ভক্তি হচ্ছে ভগবানের দুটি অভিব্যক্তি।
কাকে আমরা প্রকৃত জ্ঞানীর আখ্যা দেবো? আত্মজ্ঞানীকে প্রকৃত জ্ঞানী বলা চলে। ভক্তি থেকে জ্ঞানের উদ্ভব। জ্ঞানের উদয়ের মধ্যেই ভক্তি সঞ্চারিত হয়।
তারাপীঠ ভৈরব বামাক্ষ্যাপা মাঝে মধ্যেই সেই গানখানি গাইতেন, যে গানের মাধ্যমে স্বীয় জীবনের উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন—
”মরিব আর অমনি যাইব
ব্রহ্মে মিশায়ে।
তারার চরণে লুকায়ে।
ক্ষেপা মরিবে, অমনি যাইবে,
ব্রহ্মে মিশায়ে।
কাজ কি রে মন ভোগাশ্রয়ে
এ দেহ ধরিয়ে।”
এটাই হল তাঁর মাতৃসাধনার মূল মন্ত্র। তিনি নিজেকে মন্ত্র স্বরূপ বলে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এটিই হল তাঁর অনন্যতা এবং বৈশিষ্ট্য।
রামপ্রসাদের মতো তিনিও অধ্যাত্ম সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে তাঁর মাতৃসাধনা সমাপ্ত করেছিলেন। তাঁর লেখা অসংখ্য সঙ্গীত আজও আমরা পরম শ্রদ্ধাভক্তি— সহকারে গেয়ে থাকি। বাংলা অধ্যাত্ম সঙ্গীত জগতে তিনি এক অনন্য পুরুষ। তিনি হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।
একেবারে ছোটোবেলা থেকে নানা বিষয়ে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল কমলাকান্তের। পাঠ্য বিষয়গুলি সম্পর্কে মনে ছিল তীব্র অনুসন্ধিৎসা। এর পাশাপাশি তখন থেকেই তাঁর মধ্যে অধ্যাত্ম চিন্তনের অনুপ্রবেশ ঘটে। তখন বাংলার অধ্যাত্ম জগতে রামপ্রসাদের প্রভাব ছিল বড়ো বেশি। রামপ্রসাদ তাঁর অনন্য সঙ্গীত সম্ভারের মাধ্যমে বাঙালিকে ঈশ্বর—অভিমুখী করে তুলেছিলেন। রামপ্রসাদী গানে সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল এখানে শুধু দার্শনিক অভীপ্সার কথা বলা হয়নি, এর পাশাপাশি তদানীন্তন সমাজের বিভিন্ন ঘটনাবলিকেও তুলে ধরা হয়েছে। তাই রামপ্রসাদের গান আপামর বাঙালি জনগণের হৃদয়ে স্পর্শ করেছিল। কমলাকান্ত কিশোর বয়সে উদাত্ত কণ্ঠস্বরে রামপ্রসাদ লিখিত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এই সঙ্গীতের প্রতিটি অর্থের মধ্যে যে আলাদা প্রতীতী লুকিয়ে আছে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতেন। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, রামপ্রসাদের অপ্রত্যক্ষ উপস্থিতি কমলাকান্তকে উদ্দীপ্ত করেছিল। যে গানটি তিনি পরিবেশন করতে খুবই ভালোবাসতেন সেটি হল—
”কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন
মূলাধারে সহস্রারে সদাযোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংসসনে হংসীরূপে করে রমণ।।
আত্মারামে আত্মকালী, প্রমাণ প্রণবের মতন।
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।।
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড—ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জান কেমন।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম অন্য কেবা জানে তেমন।।
প্রসাদ ভাসে লোকে হাসে সন্তরণে সিন্ধু তরণ।।
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন।।”
নির্জন নিরালায় বসে এই গানগুলি গাইতেন তিনি। সামনে কোনও শ্রোতা আছে কিনা সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতেন না। কিন্নর কণ্ঠের অধিকারী হওয়াতে তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত সঙ্গীত, মানুষের মনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। অনেকে তাঁকে কাছে ডেকে বসিয়ে এইসব গান শুনতে ভালোবাসতেন। এইভাবে উদীয়মান শিল্পী হিসাবে তখন কমলাকান্ত যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
এই সময় তাঁর মধ্যে আর একটি প্রতিভার স্ফুরণ চোখে পড়ল। এই বয়স থেকেই কমলাকান্ত নিজে অধ্যাত্ম সঙ্গীত রচনা করতে শুরু করেন। তাঁর লেখা পদগুলি পড়লে আমরা তাঁর সাধন—পদ্ধতির বিশেষ ক্রিয়া—প্রক্রিয়া বিষয়গুলি সম্পর্কে অবহিত হই। রামপ্রসাদ যেভাবে কালীবন্দনা করেছেন, কমলাকান্ত কিন্তু সেভাবে করেননি। কমলাকান্তকে বোধহয় একটু অন্য ধারার কালীসাধক বলা উচিত। রামপ্রসাদী কালীসাধনার সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল সারল্য এবং সহজবোধ্যতা। কমলাকান্ত ছিলেন বিপরীত নামের পথিক। তিনি তাঁর অধ্যাত্ম সাধনাকে একটি অনির্দিষ্ট চূড়ায় উন্নীত করতে চেয়েছিলেন। এবং জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত কমলাকান্ত এই কঠিন প্রয়াসে সফল ও সার্থক হয়ে ওঠেন। কৈশোর বয়সে তাঁর লেখা একটি শ্যামাসঙ্গীত হল এইরকম—
”সব আলো করে কার কামিনী!
সজল জলদ জিনিয়া কায়, দর্শনে প্রকাশে দামিনী।।
এলায়ে চাঁচর চিকুর পাশ, সুরাসুর মাঝে না করে ত্রাস,
অট্টহাসে দানব নাশে, রণপ্রকাশে রঙ্গিনী।।
কিবা শোভা করে শ্রমজ বিন্দু, ঘন তনু ঘেরি কুমুদবন্ধু,
অমিয় সিন্ধু হেরিয়া ইন্দু, মলিন এ কোন মোহিনী।।
একী অসম্ভব ভব পরাভব, পদতলে শব সদৃশ নীরব,
কমলাকান্ত কর অনুভব, কে বটে ও গজগামিনী।।”
এই গানটি শুনলে মনে হয় কোনও কবিত্বসম্পন্ন গীতিকারের রচনা। সত্যি কথা বলতে কী, সংখ্যার বিচারে হয়তো কমলাকান্তের পদ রামপ্রসাদী পদের তুলনায় নগণ্য, কিন্তু অন্তর ঐশ্বর্যে সে—সব যথেষ্ট ঐশ্বর্যশালী, একথা স্বীকার করতেই হবে।
কমলাকান্তের উপনয়ন সংস্কার হয়েছিল অনাড়ম্বর ভাবে। তখন থেকেই তাঁর মনের ভেতর ব্যাপক মানসিক পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। বিষয়সম্পত্তির প্রতি তীব্র অনীহাবোধ করতে থাকেন কমলাকান্ত।
প্রতিবেশী গ্রাম চান্নাতে ছিল দেবী বিশালাক্ষীর মন্দির। সেখানে কমলাকান্তের মামার বাড়ি। সুযোগ পেলেই সেই মন্দির—প্রাঙ্গণে বসে ধ্যানমগ্নাবস্থায় থাকতেন। আবার কখনও কখনও পদ্মাসনে উপবেশন করে ধ্যানে ডুবে যেতেন। অপরূপ দেহাবয়ব ছিল কমলাকান্তের। আর ছিল সুললিত উদাস ব্যাকুল আচরণ। ধ্যানমগ্ন কমলাকান্তকে দেখে মানুষের মনে হতো, তিনি বুঝি সত্যি সত্যি এক দিব্যপুরুষ। পৃথিবীতে এসেছেন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোকবৃত্তে নিয়ে যাবার জন্য।
অভাব—অনটন ছিল তাঁর পরিবারের নিত্যসঙ্গী। মাঝে মধ্যেই দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু সংসারের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করেননি। সব সময় তিনি দেবী বিশালাক্ষীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
দেবী বিশালাক্ষীর কথা এখানে আলোচনা করা উচিত। তিনি হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার একটি প্রতীক। সুদীর্ঘ লেলিহান জিহ্বাসমেত কয়েকটি কালীমাতার মাথা বেদীর উপর রক্ষিত। লাল চেলি দিয়ে জায়গাটা মুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি কমলাকান্তের খুব একটা মনঃপুত হয়নি। তাঁর ধারণা ছিল, দেবীর পূর্ণাবয়ব মূর্তি মায়ের রূপদর্শন এবং ধ্যান—ধারণার ব্যাপারে অনেক সুবিধা হয়। তাঁর মনের কোণে সদা জাগ্রত আছেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার মূর্তি। আদ্যাশক্তিই তো জীবজগৎ আর চতুর্বিংশতি তত্ত্ব সব হয়ে বিরাজিত। অনুলোম বা লোম সবেতেই যে তিনি।
আদ্যাশক্তি ও পরব্রহ্মের মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। একটির কথা চিন্তা করলে স্বাভাবিকভাবে অন্য একটি চিন্তন আমাদের মনকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে।
দেবী বিশালাক্ষীকে দেখতে মনে হয় তিনি বুঝি বিশ্বপ্রপঞ্চের দিকে সজাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিয়েছেন। বিশ্বে এমন কোনও পাপ নেই, নেই এমন কোনও অন্ধকার, যা তাঁর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
তিনি তাঁর লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে কেন অবস্থান করছেন? এই বিষয়গুলি সম্পর্কে কমলাকান্ত বিশেষ ভাবে চিন্তাভাবনা করতেন। বিশ্বজননীর মধ্যে এত রক্তলোলুপ ইচ্ছা কেন লুকিয়ে আছে? কমলাকান্ত অনেক ভেবেচিন্তে বুঝতে পারলেন যে, মা কালী রজোরূপী জিহ্বা কর্তন করছেন সত্ত্বরূপী সমুজ্জ্বল দন্ত পংক্তির সাহায্যে।
এভাবেই তিনি মা কালীর রূপসৌন্দর্যের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা একাধিক গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেন মা তাঁর কণ্ঠদেশে নরমুণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেনই বা মা এই ধরনের নৃশংস রূপ ধারণ করেছেন?
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ তো মুণ্ডমালা নয়, এ হল মাতৃকার আদি বর্ণমালা। একান্নটি মুণ্ড বর্ণমালার একান্নটি বর্ণের প্রতীক রূপে অবস্থান করছে। নিত্য এবং সত্য শব্দব্রহ্ম একান্নটি অক্ষরে বিভক্ত হয়ে বিশ্বপ্রপঞ্চ গড়ে তুলেছে।
আর শ্যামামায়ের মুক্ত কেশী মায়া হল বন্ধনের প্রতীক। মায়াই জীবের সবথেকে বড়ো শত্রু। মায়ার মোহে অন্ধ হয়েই জীব মাকে ভোলে। সর্বপ্রকার বন্ধনের কারণ মায়াকে হ্রাস করতে না পারলে জীবের মুক্তি সম্ভব হবে না। মা কালীর মুক্তকেশ প্রমাণ করে তিনি সমস্ত মায়ার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন।
মা কালী চতুর্ভুজা। এর অর্থ কী? কমলাকান্ত এই বিষয়টির একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চারটি ভুজের মাধ্যমে মা কালী চারটি বর্গকে প্রতীকায়িত করেছেন। এই বর্গগুলি যথাক্রমে, ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ।
তাঁর চারটি হাতে যে চারটি বস্তু ধরা আছে, কমলাকান্ত তাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছিলেন। একটিতে অবস্থিত নীলপদ্ম হল শান্তির প্রতীক। অন্য হাতে আছে কপালপাত্র, এটি বরাভয়ের প্রতীক। আর একটি হাতে বিবেকের প্রতীক স্বরূপ কর্তরিকা এবং অন্য হাতে জ্ঞানের প্রতীক স্বরূপ খড়্গ অবস্থিত। মহাপ্রলয়ের পর বিশ্বের যাবতীয় কারণকে তিনি তাঁর হস্তস্থিত কপালপাত্রে ধারণ করেছিলেন। আর তাঁর আয়ত তীক্ষ্ন চোখের মাধ্যমে দেবী সকল পাপকে কলুষ মুক্ত করার চেষ্টা করেন।
শুভদিনে শুভক্ষণে কমলাকান্ত বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন। স্ত্রীকে তিনি ঐশ্বী শক্তির প্রতীক স্বরূপ ভাবতেন। তিনি জানতেন যে, নারীশক্তির মধ্যে ব্রহ্মময়ী জগজ্জননীর অংশ লুকিয়ে আছে। তাই বোধহয় নিজের স্ত্রীর মধ্যে মাতৃভাবের পবিত্র লক্ষণ খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই কারণেই স্ত্রীর প্রতি কখনও মুহূর্তের জন্যও অবজ্ঞা প্রদর্শন করেননি। অথচ কালের নিয়মে তাঁর স্ত্রী অকাল প্রয়াতা হলেন। এই ঘটনা কমলাকান্তের মনকে আরও বেশি বৈরাগী করে তুলেছিল। তখন জ্বলে উঠছে দাউদাউ আগুন শিখা। বালির ওপর বসে উদাসীন নির্লিপ্ত চোখে কমলাকান্ত চিতার উদ্গত ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে আছেন আর ভাবছেন জন্ম—মৃত্যুর অপার রহস্যের কথা। তখন পশ্চিম আকাশে প্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল বিদায়ী সূর্যের শেষ রশ্মিরেখা। আসন্ন সন্ধ্যার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে প্রকৃতির খেয়ালি খেলাঘরে। নদীর তীরে নেমে এসেছে চিরকালীন নীরবতা। কমলাকান্ত ফিরে এলেন। বুঝতে পারলেন এ হল স্বয়ং মহামায়ার নির্দেশ। তিনি আর কোনওদিন সংসার—বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করলেন না। বাধা—বন্ধনহীন কমলাকান্ত তখন উদভ্রান্তের মতো এখানে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে, প্রত্যেক আত্মার মধ্যে এক অনন্ত শক্তির আধার লুকিয়ে আছে। এই আত্মিক শক্তি স্তুতিবাচক পরিবেশের মধ্যে স্ফুরিত হয়। কিন্তু তাকে কীভাবে জাগ্রত করতে হবে? এর জন্য সুনির্দিষ্ট পথ এবং পদ্ধতি দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকতর প্রবল শক্তি এসে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। তখন সুপ্ত আত্মা ক্রমে জাগ্রত হয়। শুরু হয় আত্মোন্নতি। মানুষ তার অধ্যাত্মজীবনের একটির পর একটি সোপান অতিক্রম করে উন্নতি লাভ করে।
কমলাকান্তের সাধনায় এই বিষয়টি বারবার উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি পুঁথিপত্র থেকে আহৃত শক্তির সাহায্যে আত্মজ্ঞানী হয়ে উঠতে চাননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্যবহারিক অনুশীলন ছাড়া কখনও জীবনের সার্থকতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এর জন্য উপযুক্ত গুরুর সন্ধান করতে হবে। গুরুর মাধ্যমে উন্নতিকামী আত্মা ধীরে ধীরে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যের পথে পৌঁছে যায়। সদগুরুর মাধ্যমেই একজন শিষ্যের এই আত্মোপলব্ধি হয়ে থাকে। কিন্তু এমন গুরুকে নিষ্পাপ চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অশুদ্ধ চিত্তের কোনও ধারক কোনও ব্যক্তির মধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক আলোকশিখার পরিস্ফুটন সম্ভব নয়। আবার গুরুর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থাকা দরকার। মনের পবিত্রতা, ধৈর্য্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি না থাকলে কোনও মানুষ আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি করতে পারে না।
অবশেষে কেনারাম চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর ঈপ্সিত গুরুর সন্ধান পেলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই ভদ্রলোকের মধ্যে এমন ঐশ্বীক্ষমতার স্ফুরণ ঘটে গেছে, যা তাঁকে তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তন্ত্রসাধক কেনারামের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই কমলাকান্ত এই উপলব্ধি করেছিলেন। শুরু হল তাঁর নতুন পথে ঈশ্বরসাধনা। কমলাকান্তের প্রতি কেনারামের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণে। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীত শুনে তিনি ভাববিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কমলাকান্ত এইভাবে দেবীর আরাধনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধিলাভ করবেন।
কমলাকান্ত তখন মনের আনন্দে একটির পর একটি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করছেন এবং স্বরোপিত সুরের মাধ্যমে সেগুলিকে ঈশ্বরের কাছে পরিবেশন করছেন। এই অবস্থায় কমলাকান্ত লিখেছিলেন—
”শ্যামাধন কি সবাই পায়,
অবোধ মন বোঝে না এ কী দায়।
শিবেররই অসাধ্য সাধন মন মজাল রাঙা পায়
ইন্দ্রাদি সম্পদসুখ তুচ্ছ হয় যে তাকে পায়,
সদানন্দ সুখে ভাসে শ্যামা যদি ফিরে চায়।।
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্র সে চরণ ধ্যানে না পায়।
নির্গুণ কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়।।”
দীক্ষাগুরু কেনারাম সাধক কমলাকান্তকে নতুন পথের পথিক করে তুললেন। তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর আরাধনা করতে হলে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করা উচিত, এমনটি কখনও হতে পারে না। এ সংসারের সবকিছু মহামায়ার সৃষ্টি। সংসার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বহির্ভূত নয়। তাই সংসারে থেকেও তন্ত্রসাধনা করা সম্ভব।
কমলাকান্ত তখন চরম বৈরাগ্যের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন। তিনি স্থির করলেন কেবল শ্যামা মায়ের সাধন—ভজন করে দিনাতিপাত করবেন। মুক্তির আলোর সন্ধান ইতিমধ্যে পেয়েছেন, এখন আর সংসারের প্রতি অকারণ আসক্তি দেখিয়ে কী লাভ? কালী—অন্ত প্রাণ কমলাকান্ত সংসারে নিত্য থেকে তন্ত্রের নিগূঢ় সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তবে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য তাঁকে পূজারীর কাজ করতে হতো। তিনি স্থাপন করলেন তাঁর পঞ্চমুণ্ডীর আসন, বিশালাক্ষী মন্দিরের শিমূলতলে। রোজ কাক—ডাকা ভোরে শুরু হতো তাঁর সাধনপর্ব। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি দেবীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এই অবস্থায় তাঁর একাধিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কোনও সময় তিনি চোখের সামনে জ্যোতির্ময়ী আলোকশিখা দেখতে পেতেন। আবার কখনও মনে হতো তিনি বোধহয় নূপুর নিক্কণ শুনতে পাচ্ছেন। গুরু তাঁকে এই সাধনক্রিয়ার এক একটি বিষয় গুছিয়ে বলেছিলেন।
গুরু বলেছিলেন—মদ্যকে মধুজ্ঞানে কুলকুণ্ডলিনীর মুখে আহুতি দান করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত মদ্য পান করলে মাতৃসাধনায় বিঘ্ন দেখা দেবে।
সিদ্ধিলাভের গোপন কথাও তিনি কমলাকান্তকে শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেহস্থিত শক্তিরূপিণী কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে সহস্রার মধুপানে মগ্ন হলে তবে সাধকের জীবন সিদ্ধ হয়। এর জন্য মনের তীব্র আকুলতা থাকা দরকার। আর আকুলতা আসে বৈরাগ্যের দ্বারা। সাধনার সাহায্যে বিচ্ছিন্ন মনকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। এই সাধনা বড়োই কঠিন। তাই প্রতি মুহূর্তে স্খলনের সম্ভাবনা থাকে।
কমলাকান্ত ছিলেন সিদ্ধসাধক। শাস্ত্রবিধি মতো মন্ত্র পাঠ করে পূজার্চনা করতেন না তিনি। তাঁর একান্ত কাম্য ছিল শ্যামা মাকে একান্ত আপন করে পাওয়া। সন্তান যেমন সর্বদা মাকে কাছে পেলেই সন্তুষ্ট থাকে, ঠিক তেমনি করে তিনি তাঁর পরমাকাঙ্ক্ষিত শ্যামা মাকে কাছে পেতে চান। নির্বাণ তাঁর কাম্য নয়, মোক্ষের প্রতি কমলাকান্তের বিন্দুমাত্র আসক্তি ছিল না, স্বর্গের মোহে তিনি কখনও লালায়িত হননি, নরকের প্রতিও ছিল না এতটুকু বিতৃষ্ণা। পাপ—পুণ্য বোধ তাঁর মনকে চঞ্চল করতে পারেনি। শ্যামা মায়ের রাঙা চরণ ধরে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই সার্থক বলে তিনি মনে করতেন। জন্ম—জন্মান্তর ধরে মাকে কাছে পেতে চান। মার দর্শন এবং তাঁর স্নেহপূর্ণ স্পর্শ পেলেই তাঁর জীবন সার্থক হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাই বোধহয় কমলাকান্তের মাতৃসাধনা একটি অন্য রূপে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে।
এর পাশাপাশি কমলাকান্ত মাতৃজ্ঞানে নিজেকে নিবেদন করে একটির পর একটি অধ্যাত্ম সঙ্গীত রচনা করেছেন। আর এইভাবেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তাঁর মধ্যে কতখানি আধ্যাত্মিক ঈশ্বর লুকিয়ে ছিল।
মহাসাধক হওয়াতে তিনি তাঁর অন্তিম মুহূর্তটি আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। এমনকি তিনি জানতেন যে, রাজা তেজচন্দ্র সেখানে উপস্থিত না হলে তিনি ইহলোক ত্যাগ করতে পারবেন না। অবশেষে সেই মহাসন্ধিক্ষণ এসে গেল। মহাসাধক অনুচ্চ কণ্ঠে গাইলেন—
”জগৎ জুড়ে নাম দিয়েছো,
কমলাকান্ত কালীর বেটা
এমন মায়ে পোয়ে কেমন ব্যাভার
ইহার মর্ম জানবে কেটা?”
গানের শেষ কলিটি উচ্চারিত হতে না হতেই তাঁর চোখ দুটি ধীরে ধীরে মুদ্রিত হয়ে গেল। আর তখনই বোধহয় তিনি তাঁর পরম কাঙ্ক্ষিত মহাশক্তির সাথে একাত্মবোধ অনুভব করেছিলেন।
রাজা রামকৃষ্ণ ছিলেন এক দরিদ্র ঘরের সন্তান। অবশেষে দৈব আদেশে হয়েছিলেন রাণী ভবানীর দত্তক পুত্র। তিনি হলেন নাটোররাজ রামকৃষ্ণ। এত বৈভব—প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও শেষ অবধি তিনি নিস্পৃহ মনের অধিকারী হন। অধ্যাত্ম সাধনায় নিজেকে নিয়োগ করেন। তাঁর মাতৃসাধনার কথা তাই সবিস্তারে আলোচনা করা উচিত।
রাণী ভবানী দত্তক পুত্র গ্রহণ করলেন। আর এইভাবে মনে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করলেন। কিন্তু তাঁকে নানা ধরনের প্রশাসনিক অসুবিধার সামনে দাঁড়াতে হতো। আর এইসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের ওপর। রামকৃষ্ণ রাজকার্যের প্রতি তেমন উৎসাহ দেখাননি। মনে হতো তিনি বোধহয় সংসার ত্যাগের জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর যৌবনকাল কেটে গেছে সাধু—সান্নিধ্যে। সুযোগ পেলেই তিনি সাধুদের আখরায় চলে যেতেন। সেখানে গিয়ে প্রজ্জ্বলিত ধুনির সামনে বসে অধ্যাত্ম কথা শুনতেন। এইভাবে তাঁর অন্তরে ঈশ্বরপ্রেমের স্ফুরণ ঘটতে থাকে। ইচ্ছে করলে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারতেন। অথচ যে কোনও সাংসারিক বিষয়ের প্রতি তাঁর তীব্র অনীহা। ক্রমে তাঁর মন হয়ে ওঠে নির্জনতা—প্রিয়। উদ্যানের গাছের ছায়ায় কিংবা নদীর ধারে বসে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। উদাস ব্যাকুল চিত্তে ভাবেন কোলাহলমুখর রাজপ্রসাদ এবং বৈষয়িক বন্ধনের আধার রাজসভা তাঁর আসল স্থান নয়।
রাণী ভবানী ছিলেন বুদ্ধিমতী। পুত্র রামকৃষ্ণের এমন মতিগতি দেখে তিনি কেমন যেন সন্দিহান হয়ে উঠলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর পুত্র সর্বদা ঈশ্বরচিন্তায় আত্মনিবেদিত থাকেন। কিভাবে রামকৃষ্ণের ঈশ্বরমুখী মনকে ঘরমুখী করা যায়?
অনেকে বলেছিলেন যে, তোমার রামকৃষ্ণকে এবার বিয়ের আসনে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে অনতিবিলম্বে তিনি সংসার ত্যাগ করবেন। মহা ধুমধামে রামকৃষ্ণের বিয়ে হয়ে গেল। এবার দীক্ষাদানের ব্যাপারটি সমাপন করা দরকার। রাণী স্থির করলেন যে, কুলগুরু রঘুনাথ তর্কবাগীশকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হবে।
শেষ অবধি কুলগুরুর আদেশে রাণী ভবানী নিজেই তাঁর দত্তক পুত্রকে দীক্ষা দান করেছিলেন। এবার রামকৃষ্ণের ওপর সংসার এবং রাজত্ব—শাসনের যাবতীয় দায়িত্ব অর্পিত হল। রাজা রামকৃষ্ণ বাধ্য হয়ে নিজেকে বৈষয়িক কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। কুবেরের ধনভাণ্ডার ইতিমধ্যে তাঁর হস্তগত হয়েছে। হাজার হাজার বিঘা ভূ—সম্পত্তির একমাত্র অধিকারী হয়েছেন তিনি। বিলাস প্রাচুর্যের ব্যবস্থাও ছিল অপরিসীম। যথাসময়ে তাঁর একটি শিশুপুত্র জন্ম লাভ করল। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে তখনও সেই সাধন—বৈরাগ্য রয়ে গেছে।
একদিন হঠাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায় রাজা রামকৃষ্ণের। নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি কেমন যেন উদভ্রান্ত হয়ে গেলেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন। ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ে বাগসরের শ্মশানে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর? তারপর মনে হল, এইভাবে তিনি কেন বিষয়ের বিষে জর্জরিত হয়ে থাকবেন। সমস্ত রাত তিনি শ্মশানেই বসেছিলেন। সেটা ছিল এক পৌষের শীতার্ত রাত।
পরদিন নাটোরের অদূরবর্তী ভবানীপুরে পৌঁছে গেলেন। প্রবেশ করলেন জয়কালীর মন্দিরে। এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা। একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠ। দূর—দূরান্ত থেকে বহু পুণ্যার্থী আসেন মায়ের পুজো দিতে।
এরপর সময় ও সুযোগ পেলেই তিনি ওই পীঠে চলে আসতেন। তারপর এলেন বামাক্ষ্যাপার সাধনক্ষেত্র তারাপীঠে। এক সিদ্ধ তন্ত্রসাধকের সান্নিধ্যে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত করলেন। তাঁর অনুগ্রহে রামকৃষ্ণ সাধনার নিগূঢ় তত্ত্ব এবং তন্ত্র ক্রিয়াদি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এখানে এসে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানুষের নিত্যসঙ্গী হল হতাশা এবং দারিদ্রতা। এই দুটিকে দূর করতে হবে।
তখন রামকৃষ্ণের মধ্যে এক অন্যতর চেতনার জাগরণ ঘটে গেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কর্ম থেকে জ্ঞানের উদ্ভব হয়। জ্ঞান থেকে আসে ভক্তি। ভক্তি থেকে আসে বহুবাঞ্ছিত প্রেম। যদি আমরা আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রেমের উদয় ঘটাতে না পারি, তাহলে সাধকের অভীষ্ট সিদ্ধ সুদূরপরাহত থেকে যায়। চিদঘন প্রেমাস্পদকে লাভের আকুলতা থেকেই অন্তরে প্রেমের সঞ্চার ঘটে যায়। যেভাবে ছোট্ট শিশু তার মাকে কাছে পাওয়ার জন্য কেঁদে আকুল হয়, তেমন করে ব্যাকুলতা দেখাতে হবে।
আত্মভোলা রাজা রামকৃষ্ণ তারাপীঠ মহাশ্মশানে বসে এসব কথাই চিন্তা করেন। তাঁর মনে পড়ে যায় বায়বী সংহিতার সেই কথা—
”অসিদ্বিন্দুস্ব তো নাদো নাদাচ্ছক্তি সমুদ্ভবা।
নাদরূপা মহেশানি চিদ্রুপা পরমা কলা।।”
অর্থাৎ, আদি প্রকৃতিদেবী পরাপ্রকৃতি নামে চিহ্নিতা। পরাপ্রকৃতিকে আমরা আদ্যাশক্তি নাদরূপা বলতে পারি। এই প্রকৃতি থেকে পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ। আকাশের গুণ হচ্ছে শব্দ। তাই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টি—পূর্বে। আর এই সৃষ্টি থেকে উৎপন্ন হয়েছে বিশ্বচরাচর এবং অন্যান্য মহাভূত।
রামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন শ্যামা এবং শ্যাম একই মুদ্রার এপিঠ—ওপিঠ। আর মুরলীধরের মধ্যে আমরা শব্দতরঙ্গের রস দেখতে পাই। এইভাবেই তিনি বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে সাযুজ্য আনয়ন করার চেষ্টা করেছিলেন।
এইভাবে নাটোররাজ রামকৃষ্ণ যোগসাধনার এক—একটি স্তর অতিক্রম করতে থাকলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মায়ের বুদ্ধিতত্ত্ব হল তারা নিরাকারা। আবার দেবী ভুবনেশ্বরী হলেন মায়ের মোহিনী রূপ। দেবী ছিন্নমস্তা মায়ের সুতীব্র কটাক্ষ দৃষ্টি আর পরমাত্মা শক্তি থেকে জীবের আত্মার শক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
রিপুনাশিনী অনাদি শক্তিকে মা বগলা শক্তি হিসাবে ধরে রেখেছেন। মায়া মোহনাশিনী হয়ে মায়ের নিবৃত্তিভাব পেয়েছেন দেবী ভৈরবী। মায়ের উত্তম গতি হলেন দেবী সরস্বতী আর অধম গতি ধূমাবতী।
দেবী কালী শবের বুকের ওপর তাঁর শ্রীপাদদ্বয় স্থাপন করে দণ্ডায়মান। ‘শব’ শব্দের অর্থ কী? শব হচ্ছে তমোগুণ। সারা পৃথিবী একটি শব বিশেষ হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তমোগুণকে নাশ করতে হবে কী করে? সবসময় মায়ের শ্রীপাদপদ্ম চিন্তা করতে হবে। তমোগুণ হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং রজোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। সাধক প্রথমে রজোগুণ বৃদ্ধি করেন। পরে সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন হয়ে রজোগুণকে নাশ করেন। মা তখন সাধককে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ প্রদান করেন।
একে একে মায়ের তনুবাহারের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য রামকৃষ্ণ অনুভব করতে পারলেন। এইভাবে তারাপীঠে অবস্থান কালে তিনি তন্ত্রসাধনার নিগূঢ় পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দক্ষিণাচারিগণের শাস্ত্র আগম এবং বামাচারিগণের শাস্ত্র নিগম। দেবীর দক্ষিণ পদ শিবের বক্ষের ওপর প্রসারিতা বলে তিনি দক্ষিণা আর যাঁর বাম পদ শিবের বুকের ওপর প্রসারিতা, তিনি বামা। তিনি আরও জানতে পেরেছিলেন তন্ত্রের সংখ্যা একশো দুটি। যেসব তন্ত্র দেবীমুখ থেকে নিঃসৃত, সেগুলি হল নিগম। নিগমে দেবী গুরু এবং শিব শিষ্য হিসাবে বিরাজ করেন। আগমে শিব গুরু এবং দেবী শিষ্যা। এইভাবে সীমা এবং অসীমের মধ্যে মিলন কল্পনা করা হয়েছে। প্রেদগীত, বৈরোচন প্রভৃতি আঠাশটি তন্ত্র মুখনিঃসৃত বলে এরা আগম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। শিবের চারমুখ থেকে ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব, এই চারটি বেদ এবং পঞ্চম মুখ থেকে তন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে। শিবমন্ত্র, শক্তিমন্ত্র, বিষ্ণুমন্ত্রের দীক্ষাও তন্ত্রশাস্ত্রের অন্তর্গত। উপদেশ এবং যুক্তি—তর্কের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। একমাত্র তান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমেই ব্রহ্মজ্ঞানের বিকাশ হতে পারে।
এইভাবে নাটোররাজ তন্ত্রশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এখন থেকে তাঁকে আরও বেশি মাত্রায় অধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্ন থাকতে হবে।
তখন থেকেই তিনি মাঝে মধ্যে তারাপীঠে চলে যেতেন। সেখানে গিয়ে দেবী তারিণীর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেছিলেন। দেবী তারিণী হলেন ব্রহ্মের চিৎশক্তি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আত্মস্বরূপ। তিনি অরূপা তাই নিরাকারা, আবার সর্বরূপা, তাই তিনি ভগবতী। তিনি হলেন আধিদৈবিক, আধিভৌতিক এবং আধিতাপিক শক্তির অধিকারিণী।
এবার রামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধনার সব থেকে উচ্চ স্তর এবং সবথেকে শক্ত পদ্ধতির শবসাধনার প্রতি উৎসাহী হন। তখন বাগসরের শ্মশানে এক কৌলাচার্যের আগমন ঘটে। সেখানে কুটির বেঁধে রামকৃষ্ণ বেশ কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন। কৌলাচার্যের সাহচর্যে তিনি শবসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এলেন ভবানীপুরে জয়কালী মন্দিরে। শুরু হল কঠোর তপস্যা। ভবানীপুর একটি শক্তিপীঠ। রাজা রামকৃষ্ণ ভবানী মন্দিরে সাধনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই অবস্থায় তিনি নানা অলৌকিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। কখনও মধ্যরাতে এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে চোখের সামনে দেখতে পেতেন। আবার কখনও স্বয়ং কালিকা তাঁর সামনে উপস্থিত হতেন।
রাজকার্য থেকে মন সরে গেল রাজা রামকৃষ্ণের। একটির পর একটি তালুক তখন বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি ভাবোন্মাদ অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। কখনও ‘বড়মা’ বলে কিরীটেশ্বরীর মন্দিরে গিয়ে আকুল হয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। আবার কখনও জয়কালীর বেদীমূলে বসে বলছেন—”মা, তুমি আমাকে এমন শক্তি দাও, যা আমাকে তোমার সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবে।” মহাশ্মশানে দিনের পর দিন কেটে গেল গভীর ধ্যানে মগ্ন থেকে।
এক অমাবস্যার রাতে রাজা রামকৃষ্ণ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন। চারপাশে বিরাজ করছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। মধ্যরাত্রি উত্তীর্ণ প্রায়। সামনে এক ক্ষুদ্র আলোকশিখা দেখতে পেলেন তিনি। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেবীকণ্ঠ তাঁর কানে ভেসে এল। কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন।
তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর সামনে এমন এক আলোকশিখা উদ্ভাসিত হয়েছে যা কোটি সূর্যের থেকে বেশি উজ্জ্বল, চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধ নীল জ্যোতি। চোখের পলক ফেলার আগেই সেই জ্যোতিপুঞ্জ থেকে বরাভয় প্রদায়িনী দেবী আবির্ভূতা হলেন। তিনি ত্রিনয়না। স্বর্গ—মর্ত্য—পাতালের অধীশ্বরী। সাকারা আবার নিরাকারা। সাধক রাজা রামকৃষ্ণ মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন বিশ্বজননীর দিকে। তিনি বরাভয় সমন্বিতা কোমল হাত পুত্রকে আলিঙ্গনের জন্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিস্ময়ে পুলকে সাধক মায়ের নামে আর্তনাদ করতে লাগলেন। বেশিক্ষণ এ দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেননি।
পরদিন গ্রামবাসীরা এক অবাক করা দৃশ্য দেখলেন। মহাসাধক রাজা রামকৃষ্ণ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আসনের ওপর পড়ে আছেন। তাঁর দেহ থেকে দিব্যজ্যোতি নির্গত হচ্ছে।
এই হলেন নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ। সারাজীবন ধরে তিনি কৌলিক পদ্ধতি অনুসারে মাতৃসাধনা করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি মহাপ্রয়াত হন। তাঁর আত্মা অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। আর এইভাবেই বাংলার তন্ত্রসাধকের আকাশ থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র চিরকালের মতো হারিয়ে যায়। তবে আজও আমরা রাজা রামকৃষ্ণকে মনে রেখেছি তাঁর বিচিত্র পদ্ধতিতে মাতৃসাধনার জন্য।
এবার আমরা বাংলাদেশের এমন এক মাতৃসাধকের কথা বলব, যিনি মাতৃসাধনার ক্ষেত্রে নবদিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। যাঁর সাধন পদ্ধতি ছিল একেবারে আলাদা ও স্বতন্ত্র। যাঁর মাতৃসাধনা এবং মানবসাধনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চরম অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ এই মহাত্মা পুরুষ হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর নামাঙ্কিত সংগঠনের শাখা—প্রশাখা আজ বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই সংগঠনের সন্ন্যাসীরা জীবনকে মানব সেবার কাজে উৎসর্গ করেছেন। আর এইভাবেই রামকৃষ্ণের মাতৃসাধনার বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্তি লাভ করেছে।
রামকৃষ্ণের জীবনে নানা মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তিনি জীবনের যাত্রাপথে অসংখ্য সাধক—সাধিকার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মতে রামকৃষ্ণকে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁদের সান্নিধ্যে রামকৃষ্ণ বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে গূঢ় তত্ত্ব আহরণ করতে পেরেছিলেন। আর এইভাবেই বোধহয় তাঁর চিত্তে সমস্ত মালিন্য এবং শুষ্কতা দূরীভূত হয়েছিল। তিনি শুধুমাত্র হিন্দুধর্মের বিষয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে অবগত ছিলেন তা নয়। অন্যান্য প্রতিটি ধর্মমত সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা ছিল। তাই যত্ন করে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমতের নিয়মনীতিগুলি শেখার চেষ্টা করেছন। নিষ্ঠাভরে তা অনুশীলন করেছেন এবং স্বীয় জীবনে সেই নীতিগুলিকে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। এইভাবেই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্মসমন্বয়ের চলিষ্ণু প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
হুগলী জেলার কামারপুকুরে জন্ম নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন একটু অন্য স্বভাবের। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর জীবনে এক অদ্ভুত ভাবান্তর ঘটে গিয়েছিল। বেশির ভাগ সময় বসে থাকেন নদীর ধারে, শ্মশান অথবা নির্জন আমবাগানে। ঘুরে বেড়ান এখানে সেখানে অন্য কোনওখানে। শেষ পর্যন্ত কালের যাত্রাপথে এলেন শহর কলকাতায়। রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পূজারী হলেন। আমরা জানি নিয়মমতো পূজাপদ্ধতি অবলম্বন করতে হলে নানা শাস্ত্রে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ভাবতে ভালো লাগে, পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ কিন্তু সেইভাবে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না। মনের আকুতি আর ত্যাগের ভাবনা মিশিয়ে দেবীর আরাধনা করতেন। এক অলৌকিক শক্তিবলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বশাস্ত্রে বিদগ্ধ পণ্ডিত। সহজ সরল কথায় ভক্তিরসের প্লাবন দেখা যেত। নিরক্ষর মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
নিজের মতো করে দেবীর্চনা করতেন। মায়ের সাথে মেতে উঠতেন অন্তরঙ্গ সংলাপে। রাতে মন্দির বন্ধ হলে পঞ্চবটী সংলগ্ন বনে হতেন ধ্যানস্থ। বহিরঙ্গ জীবন থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আমরা জানি সাধক জীবনের মূল কথা হল সাধকের অহংভাব নাশ করতে হবে। সর্বজীবে আনতে হবে শিবজ্ঞান। ঠাকুর কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে এই বিষয়গুলি পালন করেছেন। তাই যখন তখন কাঙালিদের উচ্ছিষ্ট ভোজনে বসে যেতেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, এই জগতে সবকিছু মায়ের সৃষ্টি।
সাধনা সিদ্ধির পথে কোনও বাঁধাধরা পন্থা অনুসরণ করেননি। আসলে তিনি ছিলেন স্বভাবসাধক। তাই বোধহয় এমনভাবে ঈশ্বর—ভাবনায় মগ্ন থাকতে পারতেন। তাঁর মুখনিঃসৃত এক—একটি শব্দ বুঝি আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করত। এভাবেই তিনি দর্শনের কঠিন বিষয়গুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে দিয়েছিলেন।
তাঁর জীবনে একাধিক সাধকের সমাবেশ ঘটে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত আমরা তোতাপুরীর কথা বলব। তোতাপুরী ছিলেন ভারতবিখ্যাত মহাবৈদান্তিক। একদিন রক্তরাগে তিনি এসে পা দিয়েছিলেন গঙ্গাতীরবর্তী এই তীর্থক্ষেত্রে। তখন সাধক গদাধর ভাবতন্ময় হয়ে বসেছিলেন। সন্ন্যাসীর দৃষ্টি পড়েছিল তাঁর দিকে। পরবর্তীকালে এই সন্ন্যাসী বেশ কিছুদিন দক্ষিণেশ্বরে অতিবাহিত করেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণকে আরও বেশি করে অধ্যাত্ম চেতন পথে টেনে এনেছিলেন। মাঝে মধ্যে তাঁর সঙ্গে তোতাপুরীর মত পার্থক্য দেখা যেত। আসলে যেভাবে এবং যে পন্থায় ঈশ্বর—আরাধনা করতে চান, তোতাপুরীর তা পছন্দ নয়। শেষ পর্যন্ত তোতাপুরী বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঠাকুরের মধ্যে এক ঐশীশক্তি লুকিয়ে আছে। একবার তিনি ঠাকুরকে তালাবন্ধ ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। তিনদিন তিনরাত অতিবাহিত হয়ে গেল। বিস্ময় বিমুগ্ধ গুরুদেব দুয়ার খুললেন। দেখলেন শিষ্য তখনও সমাধিস্থ। নিজের আসনে জ্যোতির্ময় হয়ে বসে আছেন। দেহ নিশ্চল এবং নিস্পন্দ। একেবারে চৈতন্যবিহীন। তাঁর সর্বসত্তা যেন দীপশিখার মতো জ্বলছে।
তোতাপুরী নর্মদার তীরে চল্লিশ বছর ধরে কঠোরতম সাধনা করেছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, রামকৃষ্ণের ওপর বিশ্বজননীর অপার করুণা বিদ্যমান।
আসলে সাধক রামকৃষ্ণের মধ্যে ছিল তীব্র ভক্তিযোগ। মায়ের দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় উন্মাদের মতো ব্যবহার করতেন। শুরু হতো হৃদয়ভেদী কান্না। কখনও কখনও তিনি আবার রক্তপাতের মাধ্যমে নিজেকে কষ্ট দিতেন। অসহ্য যন্ত্রণায় সংজ্ঞা লোপ পেত। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি তাঁর মানসচোখের বরাভয় হস্ত এবং জ্যোতির্ময়ী মূর্তি দেখতে পেতেন। মনে হতো এই মূর্তি বুঝি তাঁকে সঠিক অধ্যাত্ম পথের সন্ধান দিচ্ছে।
ঠাকুরের সাধক জীবনে নানা ধরনের দর্শনের স্রোত বয়ে গেছে। তিনি ছিলেন ভক্তি এবং শরণাগতির মূর্ত বিগ্রহ। কখনও কখনও দিব্যোন্মাদ অবস্থায় মধুর সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। বেশ বুঝতে পারা যেত তাঁর অন্তরে ভক্তিরসের প্লাবন দেখা দিয়েছিল। অনেকে তাঁকে উন্মাদ বলে মুখ টিপে হাসাহাসি করতেন। আর যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে আসার বিরলতম সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি হলেন ভক্তি এবং ত্যাগের প্রতীক।
তাঁর জীবনে এক ভৈরবীর আগমন ঘটেছিল। বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। পরিধানে গৈরিক বেশ এবং দীর্ঘ কেশরাশি আলুলায়িত। তিনি কে? তিনি বোধহয় ঠাকুরের এক নতুন অভিভাবিকা। তাঁর কাছে ঠাকুর বালকবিশেষ হয়ে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরের অমোঘ নির্দেশেই ওই ভৈরবীর দক্ষিণেশ্বরে আগমন। ঠাকুরের মুখচ্ছবি দর্শন করা মাত্র তাঁর অন্তরে এক অদ্ভুত উদ্বেল ভাব বয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আপাতদৃষ্টিতে যাঁকে সহজ সরল ব্রাহ্মণ বলে মনে হচ্ছে, অন্তর্দৃষ্টিতে তিনি মহাশক্তিধারী মহাপুরুষ। এই সাধকের সাধন পদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। তাঁকে আর একটু পরিশীলিত হতে হবে। তবেই তিনি ইষ্টপথে পৌঁছোতে পারবেন।
ভৈরবী ঠিক করলেন এখন থেকে শাস্ত্রপন্থায় ঠাকুরের সাধন অগ্রসর হবে। প্রতিভাময়ী সাধিকা নিজে থেকে সেই ভার গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে আমরা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম লৌকিক শিক্ষাগুরু বলতে পারি। ভৈরবী তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত করলেন শক্তিসাধনার একটি নতুন ধারা। চৌষট্টি তন্ত্রের নানা ধরনের দুরূহ অনুষ্ঠান তিনি ঠাকুরকে দিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন। তন্ত্রমতে ঠাকুরের পুণ্যার্থী—ক্রিয়া উদ্যাপিত হয়েছিল। এইভাবে ঠাকুর তন্ত্রমতেও ঈশ্বর আরাধনায় ব্রতী হন। তাঁকে নানাধরনের তান্ত্রিক সাধনক্রিয়া করতে হয়েছে। ঠাকুরের স্থির বিশ্বাস ছিল তাঁর ওইসব কাজের অন্তরালে মা ভবতারিণীর আদেশ ও নির্দেশ আছে।
তান্ত্রিক ক্রিয়াতে বহু দুষ্প্রাপ্য দ্রব্যের দরকার হয়। ভৈরবী নিজে সেগুলো সংগ্রহ করতেন।
তন্ত্রসাধনার বলে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের ইতকর্তব্য জানতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে এবার লোকনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ তিনি যে শুধু নিজের চিত্ত উন্নতির জন্য সাধন—ভজন করবেন তা হবে না। জগতের এখানে সেখানে কত নিপীড়িত মুমূর্ষু মানুষের বসবাস। তাদের জীবন—আকাশে কে আশার প্রদীপ জ্বেলে দেবে? তাই ঠাকুরকে আমরা এক নতুন রূপে দেখতে পেলাম। সত্যি সত্যি তিনি লোকনায়ক হিসাবে খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের মাতৃসাধনার আর একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল, নিজের স্ত্রীর মধ্যে নারীশক্তিকে জাগরণ করা। তখনকার দিনে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের স্থান ছিল সবার নীচে। তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে কায়ক্লেশে কাল অতিবাহিত করতেন। পুরুষের প্রাবল্য সহ্য করতে হতো। আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোনও পন্থা তাদের জানা ছিল না। এই অবস্থায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী সারদাদেবীকে পুজো করেছিলেন দেবী প্রতিমা হিসাবে। তাঁর কাছে নিজের সমস্ত অহং বোধ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সমাজতাত্ত্বিকেরা বলে থাকেন, এভাবেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চা হয়ে উঠেছিলেন। সমাজে নারী—পুরুষ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবান, সহনশীল হবে, একে অন্যকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, তবেই তো আমরা এক উন্নত দেশের জন্ম দিতে পারব—ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই আধুনিক মনোভাবে বিশ্বাস করতেন। তাই তাঁর সাধনাকে আমরা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক চিন্তার দ্বারা বিশ্লেষণ করব না, এই আপাততুচ্ছ ঘটনাটির মধ্যে যে ঐতিহাসিক সত্যতা লুকিয়ে আছে, তার সঠিক মূল্যায়ন করা দরকার।
রামকৃষ্ণের মাতৃসাধনার মধ্যে বেদান্ত এবং নিরাকারবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তিনি মাঝে মধ্যে কথা ছলে যেসব বাণী উচ্চারণ করতেন, সেগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি কত বড়ো বৈদান্তিক ছিলেন। যেমন একবার নরেনকে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন—”জীবে দয়া? কীটাণু তো তুই। জীবকে আবার দয়া করে কী করবি? দয়া করবার তুই কে? না না, জীবে দয়া নয়—শিবজ্ঞানে জীবের সেবা।”
নরেনের মনে হয়েছিল, এ বুঝি বেদান্তের প্রজ্ঞাময় ভাষা।
সত্য হল ত্রিপথে মহাসাধক রামকৃষ্ণ ভক্তি, শক্তি ও জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টানের ভিন্নপন্থী সাধনা যে শেষ পর্যন্ত একই পরম প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। এই আপ্তবাক্যটি তিনি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করতেন। তাই বীরাচার্যের ভূমিকা গ্রহণ করে বলেছিলেন, ”যত মত তত পথ।”
জীবনের শেষ প্রহরেও তিনি এইভাবে সর্বসাধারণের মধ্যে ভক্তির ভাবধারা প্রচার করে গেছেন। এমনকি একবার ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত চৈতন্যবোধের জন্ম হয়েছিল। এই দিনটিকে স্মরণ করে আমরা কল্পতরু উৎসব করে থাকি। এই মুহূর্তের কথা স্মরণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, মহাত্মা রামকৃষ্ণ কীভাবে স্থল—জল—অন্তরীক্ষে বিরাজমান সর্বজীবকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
দেহাত্মবোধের ঊর্ধ্বে ছিল তাঁর অবস্থান। অদ্বৈতজ্ঞানে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর মাঝেমধ্যে এক—একটি বাক্যের মাধ্যমে স্বীয় অভিজ্ঞতার কথা সকলের সামনে ব্যক্ত করেছেন।
একবার রোগশয্যায় শায়িত হয়ে সংক্ষেপে বলেছিলেন—”ওরে, যে রাম যে কৃষ্ণ হয়েছিল, সে—ই ইদানিং এই খোলটার ভেতর, তবে এবার গুপ্তভাবে আসা। যেমন রাজার ছদ্মবেশে নিজরাজ্য পরিদর্শন। যেমন জানাজানি কানাকানি হয়, অমনি সে সেখান থেকে সরে পড়ে এইরকম।”
উপস্থিত সকলে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর মহাপ্রস্থানের দিনটি সমাগত। সত্যি, কদিন বাদেই তিনি অমৃতলোকের যাত্রী হলেন। আজও আমরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে মনে রেখেছি তাঁর কর্মপদ্ধতির মধ্যে। তিনি এমন এক মাতৃসাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন, যেখানে শুধুমাত্র ঈশ্বরীকে বন্দনা করা হয় না, সর্বভূতে যে প্রাণ প্রবহমান, সেই প্রাণের প্রতিটি কণাকে স্মরণ করা হয়। মনে মনে বলা হয়, হে মা, তুমি সর্বত্র বিরাজমানা। তুমি সর্বত্রগামিনী। আমি যেন কখনও তোমার সান্নিধ্যলাভে বঞ্চিত না হই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন