পৃথ্বীরাজ সেন
বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সমাজকে হিন্দুধর্ম মতের যে দু’টি ধারা বারে বারে প্রভাবিত করেছে সে—দু’টি হল বৈষ্ণবধর্ম এবং অপরটি শাক্তধর্ম। শক্তিসাধনার আবির্ভাব কবে হয়েছে সেই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বিখ্যাত পণ্ডিতরা মন্তব্য করেছেন যে তুর্কি বিদায়ের বহুপূর্ব থেকে বাংলাদেশে শক্তিপুজোর প্রচলন শুরু হয়েছিল। তারপর দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। বাঙালি সমাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একটির পর একটি বিবর্তন সূচিত হয়েছে। আর তারই প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে শক্তি সাধকদের গবেষণায়।
বৈষ্ণবতা ও শৈব ধ্যান—ধারণার মধ্যে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কখনও বৈষ্ণবপন্থীরা শাক্তসাধনার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন, আবার এর প্রত্যুত্তরে শাক্তপন্থীরা নানা ভাবে বৈষ্ণবপন্থীদের আক্রমণ করেছেন। হিন্দুধর্মের উদারনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা অনভিপ্রেত। কোনও কোনও সময়ে আবার এই দুই ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা দেখা গেছে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলে শাক্তসাধনা এবং আনুষাঙ্গিক তন্ত্রাচার দীর্ঘদিন ধরে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। এর আগেই আমরা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের কথা বলেছি। যখন মহাপ্রভু শ্রীশ্রীচৈতন্য বৈষ্ণবপ্রেমের প্লাবনে অবিভক্ত বঙ্গদেশকে স্নাত করেছিলেন, কৃষ্ণনাম স্মরণ করে মানুষকে সংসার সমুদ্র থেকে উদ্ধারের পথ নির্ণয় করেছিলেন, তখনই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ লিখলেন বৃহৎতন্ত্রসার নামে এক মহাগ্রন্থ। এই গ্রন্থকে আজও আমরা তন্ত্রসাধনার আকর গ্রন্থ হিসাবে মর্যাদা দিয়ে থাকি। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি তন্ত্রসাধনার স্বরূপ এবং রূপকল্পনার কথা আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থের একেবারে শুরুতে তিনি বামাকালীর যে ধ্যানমন্ত্র সংযোজিত করেছেন তা যেকোনও শাক্তসাধকের কাছে সাধ্যবস্তু। এই ধ্যানমন্ত্র এবং তার সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদটি এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে—
বিদ্যুৎকান্তিসমানাভ—দন্তপংক্তিবলাকিনীম্।
নমামি তাং বিশ্বমাতাং কালমেঘসমদ্যুতিম্।
মুক্তমালাবলীরম্যাং মুক্তকেশীং দিগম্বরাম্।
লোলজিহ্বাং খোররাবামারক্তলোচনত্রয়াম্।
কোটিকোটিকলানাথ—বিগলন্মুখমণ্ডলাম্।
অমাকালাসমুল্লাসকিরীটোজ্জ্বলমালাম্।
শবদ্বয়কর্ণভূষাং নানামণিবিভূষিতাম্।
সূর্য্যকান্তেন্থকান্তৌঘ—প্রোল্লাসকর্ণভূষণাম্।
মৃতহস্তসহস্রৈস্তু কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীম্।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত—ধারাবিস্ফূরিতানশাম্।
খড়্গমুণ্ডবরাভীতি—সংশোভিতচতুর্ভূজাম্।
দন্তরাং পরমাং নিত্যাং রক্তমণ্ডিতবিগ্রহাম্।
শিবপ্রেতসমারূঢ়াং মহাকালোপরি স্থিতাম্।।
বামপাদং শবহৃদি দক্ষিণে লোকলাঞ্ছিতম্।
কোটিসূর্য্যপ্রতীকাশং সমস্তভুবনোজ্জ্বলম্।।
বিদ্যুৎপুঞ্জসমানাভোজ্জ্বলজ্জটাবিরাজিতম্।
রজতাদ্রিনিভং দেবং স্ফটিকাচলবিগ্রহম্।।
দিগম্বরং মহাঘোরং চন্দ্রার্কপরিমণ্ডিতম্।
নানালঙ্কারভূষাঢ্যং ভাস্বৎস্বর্ণত্তনূরুহম্।
যোগনিদ্রাধরং শম্ভূং স্মেরাননসরোরূহম্।
বিপরীতরতাসক্তাং মহাকালেন সপ্ততম্।।
অশেষব্রহ্মাণ্ডভাণ্ড—প্রকাশিতমহোজ্জ্বলাম্।
শিবাভির্ঘোররাবাভি—চের্ব্বষ্টিতাং প্রলয়োদিতাম্।।
কোটিকোটিশরচ্ছন্দ্র—ন্যক্কৃতানখমণ্ডলাম্।
সুধাপূর্ণশীর্ষহস্তু—যোগিনীভির্ব্বিরাজিতাম্।।
আরক্তিমুখমদ্যাভি—র্স্মত্তাভিরম্বগাং চ বৈ।
ঘোররূপৈর্ম্মহানাদৈ—শ্বস্বতাপৈশ্চ ভৈরবৈঃ।।
গৃহীতশবকঙ্কাল—জয়শব্দপরায়ণৈঃ।
নৃত্যদ্ভির্বাদনপরৈ রণিশঞ্চ দিগম্বরৈঃ।
শ্মশনেলায়মধ্যস্থাং ব্রহ্মাদ্যুপনিষেবিতাম্।।
বঙ্গানুবাদ : যাঁর বদনমণ্ডলে বলাকাবলীতুল্য বিদ্যুৎকান্তির ন্যায় আভাযুক্ত দন্তপংক্তি শোভা পাচ্ছে, যাঁর দেহ মুণ্ডমালাবলীদ্বারা শোভিতা, যিনি দিগম্বরা, মুক্তকেশী, যিনি বিশ্বমাতা, বিশ্বেশ্বরী ও কালোমেঘের ন্যায় যাঁর কান্তিবিশিষ্টা, সেই কালিকাদেবী আমি নমন করি। যিনি লোলজিহ্বাযুক্ত, যাঁর নেত্রত্রয় অলক্তবর্ণ এবং রব অতি ভয়ংকর, যাঁর—মুখমণ্ডল হতে কোটি কোটি শশধের বিগলিত হয়ে চলেছে, যাঁর শিরোদেশে সমুজ্জ্বল কিরীটমণ্ডল অতিশয় উল্লাসযুক্ত ও প্রফুল্ল শোভা বিস্তার করছে, যাঁর কর্ণযুগলে শবদ্বয় বিভূষিত হচ্ছে এবং যাঁর অঙ্গসকল নানাবিধ মণি দ্বারা বিভূষিত এবং সূর্যকান্ত ও চন্দ্রকান্ত মণি যাঁর উল্লসিত কর্ণভূষণ, যাঁর কটিতট শবহস্ত—সহস্র দ্বারা বিরচিত কাঞ্চীমালার ন্যায় পরিবেষ্টিত, যাঁর মুখমণ্ডলে উচ্চকলধ্বনিকৃত হাস্য শোভা পাচ্ছে, যাঁর সৃক্কিনীযুগল হতে শোণিতধারা বিগলিত হয়ে মুখমণ্ডল স্ফূরিত করছে, যাঁর ভূজ্যচতুষ্টয়, খড়্গ, মুণ্ড এবং বর, অভয় দ্বারা সুশোভিত, যাঁর বিগ্রহ শোণিতচ্ছটায় মণ্ডিত, দন্তপংক্তি উচ্চ ও বিকট, যিনি শিবপ্রেতোপরি আরূঢ়া এবং মহাকালোপরি সংস্থিতা—সেই পরমা নিত্য সনাতনী দেবীকে প্রণাম জানাই।
তাঁর বামপদ শবহৃদয়ে সংস্থিত এবং দক্ষিণ চরণে লোক—লাঞ্ছিত কোটি সূর্যতুল্যপ্রভ সমস্ত ভুবন উজ্জ্বলকারী বিদ্যুৎপুঞ্জিত সমুজ্জ্বল জটাজালমণ্ডিত রজতগিরির ন্যায় শুভ্র স্ফটিকতুল্য, দিগম্বর, মহাঘোর দর্শন, চন্দ্র—সূর্য পরিভূষিত এবং নানাবিধ ভূষণে শোভিত, প্রদীপ্ত সুবর্ণ—সদৃশ লোমরাশি বিশিষ্ট যোগনিদ্রারত, ঈষৎ হাস্যযুক্ত মুখণ্ডল, অখিলব্রহ্মাণ্ড প্রকাশকারী মহাকাল শঙ্কর বিদ্যমান।
মহাকালের সঙ্গে যিনি বিপরীত সুরেতে আসক্তা, ঘোররাবী শিবাগণে পরিবেষ্টিতা, যিনি প্রলয়কালের ন্যায় সংহার—মূর্তি, যিনি নখমণ্ডল প্রভাদ্বারা কোটি কোটি শরচ্ছন্দ্রকে তুচ্ছীকৃত করছেন, যিনি মস্তকমণ্ডলে ও করসমূহে সুধাধারিণী আরক্তামুখমণ্ডলা ও মদমত্তা যোগিনীগণে বিরাজিতা এবং যিনি মহানাদ, ঘোররূপ প্রচণ্ড প্রতাপ দিগম্বর বেশ নিরন্তর নৃত্যবাদনিরত শবকঙ্কাল জালগ্রাহী ও জয়শব্দপরাণ ভৈরবনিকারে অনুগতা অর্থাৎ ভৈরবগণবেষ্টিতা শ্মশানালয়মধ্যস্থা, ব্রহ্মাদি দেবগণে পরিসেবিতা, সেই মহাকালী দেবীকে নমস্কার করি।
এই ধ্যানমন্ত্রটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে শাক্ত সাধকের সমস্ত শরীরে এক অবর্ণনীয় শিহরণের জন্ম হয়। কোষে কোষান্তরে পৌঁছে যায় সেই বার্তা যা তাকে দেবী বন্দনায় আরও বেশি উজ্জীবিত করে তোলে। তিনি যে ভীষণা দেবীর পুজো করতে ইচ্ছুক, সেই দেবী প্রকৃতির মূলে অবস্থান করছেন। তাঁর সাধনা করা সহজ নয়। শাক্ত আরাধ্যদেবী কালিকা ভীষণা হলেও তিনি বরাভয়দাত্রী। তাঁর অভ্যন্তর মাধুর্য্যে পরিপূর্ণ।
বাংলা সাহিত্যে তন্ত্র এবং শাক্তসাধনার প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে আছে। সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকেরা বোধহয় এই প্রভাবকে আরও পরিব্যাপ্ত করেছিলেন। তান্ত্রিক বৌদ্ধরা কিন্তু হিন্দু কালিকা তত্ত্বের উপাসক নন। কিন্তু তারা কিভাবে তন্ত্রের দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হলেন তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। গৌতম বুদ্ধ অহিংস ধর্মমতের প্রবর্তক প্রচারক ছিলেন। প্রাণী হত্যাকে তিনি সর্বতোভাবে পরিহার করতেন। অথচ তাঁর অনুগামীরা কেমনভাবে বলিদান প্রথায় মেতে উঠলেন তাও ভেবে দেখার মতো। বৌদ্ধ তন্ত্রসাধকেরা সাধনার ক্ষেত্রে হিন্দু সাধকদের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল সাধনপথ আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। বাংলা ভাষায় যে আদিকাব্য গ্রন্থটি রচিত হয়েছে, অর্থাৎ চর্যাপদ, এটিকে আমরা তন্ত্রোক্ত দেহসাধনার উপর নির্ভরশীল একটি গ্রন্থ বলতে পারি। এই গ্রন্থের পরবর্তী পর্যায়ে আমরা হিন্দুতন্ত্র এবং বৌদ্ধতন্ত্রের তুলনামূলক আলোচনা করব। এই আলোচনার দর্পণে প্রতিফলিত হবে এই দুই তন্ত্রমতের সাধকদের ধর্মচর্চার ইতিহাস।
এখন সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে হিন্দুতন্ত্র আগে না বৌদ্ধতন্ত্র? শাক্ত ও হিন্দুতন্ত্রের গ্রন্থগুলি হয়তো খুব একটা প্রাচীন নয়। তাহলে কি পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠার আগেই বৌদ্ধধর্মতন্ত্রবাদের জয়গান গেয়েছিল? কিন্তু বৌদ্ধ তান্ত্রিকরা এই তন্ত্রসাধনার কথা জানলেন কোথা থেকে? পূর্ব—ভারত এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে বৈদিক দেব বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত তান্ত্রিক বিশ্বাসে পরিণত হয়। বৈদিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে একে আগম বলে নির্দেশ করতেন। তারা কখনওই তন্ত্রসাধনাকে খুব একটা প্রাধান্য দিতে চাননি। তারা বলতেন এই ধর্মসাধনার উৎস হিন্দুধর্মের মধ্যে নিহিত নেই। এটি বাইরে থেকে এসেছে। অর্থাৎ এই ধর্মসাধনের ওপর বেদ—তান্ত্রিক নিয়মনীতি প্রবর্তিত হতে পারে না। তাই বোধহয় তখন থেকে শাক্তপন্থীদের সাথে বৈদিকপন্থীদের তর্কবিতর্ক শুরু হয়। সমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা গভীর প্রত্যয় সহকারে হিন্দু শাক্ত এবং বৌদ্ধমহাজানীতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধমহাজনীদের মধ্যেও নানা সাধকগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে যায়। তারা তান্ত্রিক আচারের মাধ্যমে সিদ্ধির পথে পৌঁছবার চেষ্টা করেন। তাদের তন্ত্রসাধনা সম্পর্কে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত ‘তান্ত্রিক বুদ্ধিজিম’ নামে একটি অসাধারণ গ্রন্থ লিখেছেন।
বাংলায় অসংখ্য যোগ এবং তান্ত্রিক ধর্মগোষ্ঠী বেশ কয়েকশো বছর ধরে ধার্মিক এবং আধ্যাত্মিক প্রভাব ফেলেছিল। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বহিরাগত মুসলিম সুফীরা। এসেছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া এবং বৈষ্ণব বাউলেরা। তাছাড়া গুরুবাদী গুহ্যাচারী ধর্মসম্প্রদায় এই জাতীয় তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাস করতেন। তারা দেহভাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ড, নাভিমূল থেকে দেহাভ্যন্তরস্থ শক্তিকে জাগ্রত করতেন। এটি বড় কঠিন সাধনা। ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এই শক্তিকে ঊর্ধ্বমুখী করা উচিত। তারপর তা মস্তক শীর্ষে অবস্থিত শবের সঙ্গে মিলিত হয়ে শিবে রূপান্তরিত হবে। সাধনার এই রূপরেখাটি সকল সম্প্রদায় গ্রহণ করেছিলেন। আবার অধিকাংশ সাধক সম্প্রদায় উত্তরসাধিকা হিসাবে নারীকে গ্রহণ করতেন। এই সাধনার মধ্যে পৈশাচিক যৌনাচারের প্রভাব ছিল।
বাঙালির ধর্মসাধনায় শুধু যে বৈষ্ণবপন্থীরাই অংশ নিয়েছিলেন তা নয়, কালী, দুর্গা প্রভৃতি শক্তি মুখ্য দেবীর আরাধনা একসময়ে বাংলায় যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। জনমানসে তাই শাক্তসাধনার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যারা দেবী কালিকার দক্ষিণাচারী বা গৃহীপূজক তাঁদের সাধনার মধ্যেও তন্ত্রের অবস্থান ঘটে যায়। এমনকি যখন শ্রীচৈতন্যদেবের ডাকে হাজার হাজার মানুষ নামসংকীর্তনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তখনও শতাধিক আউল—বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। তারা প্রেম—ভক্তির পূজারি হলেও তন্ত্রের নির্দেশাবলীকে সাধনার ক্ষেত্রে গ্রহণ করতেন। যেমন আমরা তান্ত্রিক মতে যৌনাচারের উৎকট প্রকোপ দেখতে পাই, বৈষ্ণবীয়রাও সেইভাবে সাধনসঙ্গিনী রাখতে শুরু করেন, তবে তাদের পারস্পরিক দেহগত সম্পর্ক শাক্তদের মতো এতখানি উৎকট বা যৌন অভিমুখী নয়। সেখানে হয়তো শারীরিক আকর্ষণের পাশে মানসিক আকর্ষণের একটা আলাদা স্থান ছিল। যাকে আমরা দেহাতীত ভালোবাসা বা ‘প্লেটোনিক লাভ’ বলে থাকি, তার প্রচ্ছন্ন প্রকাশ ঘটে এই বৈষ্ণবপন্থী নারী ও পুরুষের মধ্যে।
এখানে আমরা চৈতন্যপন্থীদের দর্শনতত্ত্ব সম্পর্কেও আলোচনা করব। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তারা যে ধর্মমত প্রচার করেন সেখানে বলা হয় রাধা বিনা কৃষ্ণ অসিদ্ধ। অর্থাৎ তারা নারীশক্তির জাগরণের দিকে নজর দিয়েছিলেন। এই প্রথম বোধহয় নারীশক্তিকে এতখানি প্রাধান্য দেওয়া হল। একজন শাক্তসাধক মাতৃ আরাধনা কল্পে কালীর উপাসনা করে থাকেন। তিনি সন্তানবৎ দেবীর সেবা করেন। কিন্তু এক বৈষ্ণব সাধক যখন রাধা এবং কৃষ্ণের মধ্যে অমিল দর্শন করতে চান, তখন রাধা তার কাছে মাতৃ রূপে প্রতিভাত হন না। রাধা হলেন চিরন্তন প্রেমের পূজারি। এখানেই বৈষ্ণব ও শাক্তসাধনার তফাৎ।
শাক্তের শক্তি কালিকা এবং বৈষ্ণবের শক্তি রাধিকা। এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। রাধিকা ছাড়া কৃষ্ণের কথা কোনও গোড়ীয় বৈষ্ণব ভাবতেও পারতেন না। অর্থাৎ একজন গৌড়ীয় সাধকের ক্ষেত্রে আমরা তিনটি সত্তা বা শক্তির উপস্থিতি দেখতে পাই—রাধা, কৃষ্ণ এবং সাধক। আর শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে সাধক এবং দেবী কালিকা ছাড়া তৃতীয় কোনও ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব যখন তাঁর অবতারত্ব প্রকাশ করছেন, তখন তাঁর শিষ্যরা রাধিকার ভাব ও কান্তিতে অঙ্গীকার করেছেন। আর এইভাবেই বৈষ্ণব চেতনার মধ্যে শক্তিতত্ত্বের প্রকাশ ঘটে গিয়েছিল।
বাংলা ধর্মসাধনায় কিছুতেই আমরা শাক্তসাধনার প্রভাব উপেক্ষা করতে পারিনি। কৃত্তিবাস রামায়ণে দেখা গেছে যে রাম দেবীকে পুজো করছেন। দেবী চামুণ্ডা ও লঙ্কাপুরীর যে বিবরণ আছে সেটি পাঠ করলেও আমরা বাংলার সমাজে শাক্তধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে জানতে পারব। এই সংক্রান্ত স্তোত্রটি হল এইরকম—
দুর্গে দুঃখহরাবারা দুর্গতিনাশিনী।
দুর্গমে শরণ্যা বিন্ধ্যগিরি—নিবাসিনী।।
দুরারাধ্যা ধ্যানসাধ্যা শক্তি—সনাতনী।
পরাৎপরা পরমা প্রকৃতি—পুরাতনী।।
নীলকণ্ঠপ্রিয়া নারায়ণী নিরাকারা।
সারাৎসারা মূলশক্তি সচ্চিদা সাকারা।।
মহিষমর্দিনী মহামায়া মহোদরী।
শিবনিতম্বিনী শ্যামা সর্ব্বানী শঙ্করী।।
বিরূপাক্ষী মাতাঙ্গী সারদা শাকম্ভরী।
ভ্রামরী ভবানী ভীমা ধূমা ক্ষেমঙ্করী।।
কালী কালহরা কালাকালে কর পায়।
কুলকুণ্ডলিনী কর কাতরে নিস্তার।।
লম্বোদরী বাঘাম্বরা কলুষনাশিনী।
কৃতান্তদলনী কাল—উরুবিলাসিনী।।
ইত্যাদি অনেক স্তব করিলা শ্রীহরি।
তুষ্টা হৈলা হৈমবতী পরম ঈশ্বরী।।
বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র। অথচ তিনি দেবী দুর্গার আরাধনা করছেন। এতেই কি প্রমাণিত হয় না যে এক সময় শাক্তধর্মের জনপ্রিয়তা এবং ব্যাপকতা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়েছিল? বাংলার বাইরে রামায়ণ কথায় এমন প্রসঙ্গ থাকার কথা ভাবাই যায় না। যেহেতু বাঙালি শক্তিবাদের প্রচারক এবং উপাসক, তাই বোধহয় বাঙালি লেখকের পক্ষে এমন কথা বলা সম্ভব হয়েছে। প্রবল বৈষ্ণব প্রভাবেও বাঙালি রামায়ণ থেকে এই শাক্ত আনুগত্য মুছে দিতে পারেনি।
বাংলার শক্তিদেবীর পূজা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। দুর্গাপূজা বাঙালির জাতীয় জীবনে শ্রেষ্ঠ উৎসব হিসাবে কয়েকশো বছর ধরে গণ্য হয়ে আসছে। মনে হয় চৈতন্যযুগের সমবয়সী হল এই জাতীয় উৎসব। এখন অবশ্য আমরা অনেক ক্ষেত্রে দুর্গাপূজায় পশু বলিদানের পরিবর্তে চালকুমড়ো, আখ প্রভৃতি বলির ব্যবস্থা করি। কিন্তু বলির বিষয়টি এই পূজার সঙ্গে অঙ্গীভূত রয়েছে। বাঙালির মনকৃষ্টির এই বিশেষ প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ধীরে ধীরে শক্তিসাধনার বৈচিত্র্য, তন্ত্র, শাক্ত এবং বাংলা সাহিত্যে তার ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করব। এই আলোচনা থেকেই প্রমাণিত হবে যে আধুনিক যুগেও অন্তসলিলা ফল্গুর মতো বাঙালি চেতনার মানসিকতায় শাক্ত ভাবধারা প্রবাহিত আছে।
এখন মানুষ আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের অন্ধকার বিবর থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। এখন তাকে বিশ্বমানবতার নীল আকাশ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তা সত্ত্বেও তার মনের গহন কোণে এখনও কি শাক্ততন্ত্রের প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ লুকিয়ে নেই? কোনও বাঙালি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে মাতৃশক্তি তাকে সেইভাবে আকর্ষণ করে না? নাকি নতুন কোনও প্রেক্ষাপটে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে এই প্রজন্মের তরুণ—তরুণীরা শাক্তবাদের পূজারি হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন