পৃথ্বীরাজ সেন
মঙ্গলকাব্যের দেবী
বাংলার শাক্তদেবমণ্ডলীটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে সকল দেবতাই মনুষ্য কল্পনার ফসল। মঙ্গলকাব্যের অধিকাংশ দেবতাই—নারীদেবতা। প্রধান তিনটি মঙ্গলকাব্যের মধ্যে ধর্মঠাকুর পুরুষ দেবতা হলেও তাঁর মধ্যে নারী শক্তিদেবতার নানা লক্ষণ ফুটে ওঠে। বিশেষত রঞ্জাবতীর শালে ভর দেওয়া এবং লাউসেনের নিত্যের মস্তকছেদ করে পূজা দেওয়া—এর মধ্যে নরবলি প্রথাটিই যেন বক্রভাবে প্রতিফলিত হয়ে উঠছে। মধ্যযুগের শেষভাগে বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়ও পুরুষদেবতা। এখানেও নরবলি প্রথা দৃশ্যমান। কিন্তু এই অর্বাচীনত্বের সঙ্গে মঙ্গলদেবতাদের মূল ধারাটির বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই।
মনসা, চণ্ডী, অন্নদা, শীতলা, ষষ্ঠী, কালিকা প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা হলেন মূল শক্তিদেবীর বিভিন্ন রূপ মাত্র। হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে বহু প্রাচীনকাল থেকে যে শাক্ত প্রবণতা বর্তমান ছিল তারই একটা গার্হস্থরূপ এই মঙ্গলদেবীরা ধরে রেখেছেন। এই দেবীদের এবং তাঁদের পূজক গোষ্ঠীর মুখ্য প্রবণতাগুলি নিম্নরূপ—
(১) মঙ্গলকাব্যের নারীদেবতাদের মহিমা কাব্যমধ্যে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যেন এঁরা আদি শক্তির রূপভেদ বা তারই কোনও বিশেষ প্রকাশ। সকল স্থানেই পুরুষ দেবতার সঙ্গে সংঘাতে নারীদেবতার জয়ধ্বনি শোনা গেছে। বিষ্ণুদেবতা বা তার আশ্রিত ভক্ত নয়, শিবদেবতা ও তাঁর আশ্রিতের সঙ্গেও সংঘাত বেঁধেছে অনিবার্যভাবে। শেষ পর্যন্ত সেখানেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেবী—মহিমা। শুধু অন্নদামঙ্গলে বেদব্যাসের বৈষ্ণবতা পরাভূত থেকেছে এবং মনসামঙ্গলে মনসার সঙ্গে বিবাদে যমরাজ নির্জিত। শিবপূজক চাদ সদাগরও মনসার পূজা করতে বাধ্য হন।
(২) আরাধ্য মঙ্গলদেবীদের স্তব—স্তোত্র বিশেষভাবে উল্লেখ্য। চৌতিশা অর্থাৎ চৌত্রিশ বর্ণকে আদ্যক্ষর ধরে দেবীমহিমা কীর্তন বর্ণনা শাক্তভাবনার অনুরূপ। বর্ণমালার অক্ষরগুলিকে সাধনক্ষেত্রে সংকেতরূপে গণ্য করা তন্ত্রসাধনার এক বিশেষ পদ্ধতি রূপে স্বীকৃত।
অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যে বিশ্ব ও জীব উৎপত্তির যে বিবরণ আছে তাতে আদিকারণ রূপে দেবীকেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অযোনিসম্ভূত আদিদেবের কল্পনাস্থলে শাক্ত ভাবুকেরা পুং বীজ নিরপেক্ষ আদিমাতার গর্ভজাত ব্রহ্মা—বিষ্ণু—শিব—এই তিন দেবতার কল্পনা করেছেন। সর্বপ্রধান প্রজ্ঞাবান বলে শিব জন্মদাত্রী জননীর পতি হতে রাজি হয়েছেন। যার ফলস্বরূপ এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। শক্তিদেবীর এই জননী স্বরূপত্ব কিন্তু পত্নীরূপেও লোপ পায়নি। সমুদ্রমন্থনে মুমূর্ষু শিবকে পত্নী—জননী তারা ক্রোড়াসীন করে স্তনদানে পুনর্জীবিত করে তোলেন। আবার কখনও দেখা যায়, উপবাসী ভিখারী শিব অন্নদার অন্নদানে প্রাণ ফিরে পান। মনসার স্তবেও বলা হয়েছে—
নমোনমঃ জগতমাতা সর্বসিদ্ধিদায়িনী।
তুমি সূক্ষ্ম তুমি মোক্ষ তুমি বিশ্বজননী।।
তুমি জল তুমি স্থল চরাচরবন্দিনী।
বৃষ্টি—স্থিতি—প্রলয় তুমি মূলবারিণী।।
(৩) মঙ্গলদেবীদের পূজা প্রথা শাস্ত্র অনুমোদিত। পুষ্প নৈবেদ্যসহ বিভিন্ন খাদ্যবস্তুর উপচার, শঙ্খ—ঘণ্টাদির ধ্বনি, বলিদান, অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ গ্রহণ প্রভৃতি এইসব পূজার মুখ্য পদ্ধতি। এর মধ্যে বলিদান প্রথাটি শক্তিদেবীর পূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ, যা যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত। তবে বৈষ্ণবী প্রভাবের ফলে কোথাও কোথাও বলিপ্রথায় কিছু রদবদল হয়েছে। শাক্ত পূজা ও শাক্ত যৌনাচার ভিত্তিক সাধনা শাক্ততান্ত্রিক বিশ্বাসের সঙ্গে ভোগবাদকে সংযুক্ত করেছে। পার্থিব ভোগ ও কামনা—বাসনাই যেন শাক্ত ভক্তের মূল লক্ষ্য। শক্তিময়ী দেবীই ভক্তের কামনা—বাসনা পূর্ণ করতে পারেন, প্রেমভক্তিময়ী দেবী তা পারেন না। শত্রু বিনাশের জন্য সুদর্শনধারী বিষ্ণুর প্রয়োজন— বংশীবাদনরত কৃষ্ণের নয়। মঙ্গলকাব্যের দেবীরা কেউ দুরারোগ্য ব্যাধি দূর করেন, কেউ সর্পাঘাত থেকে রক্ষা করেন, কেউ পুত্র দান করেন, কেউ অন্নদান করেন—সবাই শত্রু বিনাশ করেন। শাক্তসাধনার শেষ কথা জীবনব্যাপী ভোগ নয়, মঙ্গল কাব্যেও আছে ইহলোকে সুখভোগ এবং পরিণামে মোক্ষপ্রাপ্তি। মঙ্গলকাব্য জনসাধারণের বিশ্বাস—ভক্তির কাব্য বলে এই মোক্ষপ্রাপ্তি বলতে পরলোকে স্বর্গভোগকে বোঝানো হয়েছে। তবে ভারতচন্দ্রের মতো তত্ত্ববিদরা মোক্ষ বলতে মোক্ষকেই বুঝিয়েছেন।
(৪) মঙ্গলকাব্যের শক্তিময়ী দেবীরা মাঝে মাঝেই উগ্ররূপ ধারণ করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেন সাধারণ মানুষকে ভক্ত করে তোলার জন্য। ভক্ত হতে রাজি না হলে চলে উৎপীড়ন।
প্রতিবাদী নয় এমন ভক্তের ওপর পীড়ন দেখিয়ে শক্তি প্রদর্শন এইসব শক্তিদেবতার বিশেষত্বরূপে গণ্য হয়।
নারীসমাজে প্রচলিত লৌকিক ব্রতের আরাধ্য বহু ক্ষেত্রেই কোনও পূর্ণাবয়ব দেবতা নয়, একটা শক্তি—যাদু শক্তি, প্রজনন শক্তি প্রভৃতি। তারা চেতন না নিশ্চেতন বোঝা না গেলেও ব্রতীকে কাম্যবস্তু দানের ক্ষমতা তাঁরা রাখেন। এই ‘শক্তি’ই শাক্ততত্ত্বের ভিত্তি রচনায় সাহায্য করেছিল বলে মনে করা হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন