উপাস্যতত্ত্ব

পৃথ্বীরাজ সেন

শক্তিতত্ত্ব

নির্গুণ নিঃশক্তিক এবং নিরাকার ব্রহ্মের বৈদান্তিক তত্ত্বকে শাক্তরা ভ্রান্ত বলে মনে করেন। শাক্ততান্ত্রিক সাধনা ও সাহিত্য ও বৈষ্ণবদের সঙ্গে এখানে তাদের ঘনিষ্ঠ মিল আছে। শাক্তদের মতে আদ্যাশক্তিই ঈশ্বরতত্ত্ব। যিনি জগৎ সৃষ্টি করেন, পালন করেন—তিনি নিঃশক্তিক এবং নির্গুণ হতে পারেন না।

মহাভাগবতে ভাগবতী গীতায় শক্তিতত্ত্বের মূল কুঞ্চিকা রূপে পিতা হিমালয়ের সঙ্গে কথোপকথনকালে দেবীর মুখনিঃসৃত বাণী—

সৃষ্ট্যর্থমাত্মনো রূপং ময়ৈব স্বেচ্ছয়া পিতঃ।
ভূতং দ্বিধা নগশ্রেষ্ঠ স্ত্রীপুমানিতি ভেদতঃ।। ১।।

দেবী বলেছেন—হে পর্বতশ্রেষ্ঠ পিতৃদেব, যদিও আমি এক কিন্তু সৃষ্টির নিমিত্ত আমি স্বেচ্ছায় আপনাকে দ্বিধা বিভক্ত করেছি, এক রূপ স্ত্রী অন্য রূপ পুরুষ, আসলে দুই—ই আমি। এই প্রসঙ্গে শাক্ত মতের সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনি স্মরণীয়। আদ্যাশক্তি কিভাবে ব্রহ্মা—বিষ্ণু—শিবকে প্রসব করলেন এবং শিবকে পতিরূপে গ্রহণ করে বিশ্ব সৃষ্টি করলেন সেই কাহিনি বাঙালি শাক্তগণ কাব্যের আদিতে বিবৃত করেছেন—

শিবঃ প্রধানঃ পুরুষঃ শক্তিশ্চ পরমা শিবা।
শিবশক্ত্যাত্মকং ব্রহ্ম যোগিন—স্তত্ত্বদর্শিনঃ।
বদন্তি মাং মহারাজ তত্ত্ববেম পরাৎপরম্।। ২।।

এই স্ত্রী—পুরুষ ভেদের প্রধান রূপটি হল শিব প্রধান পুরুষ এবং শিবা পরমা শক্তি। তত্ত্বযোগীরা জানেন এই দুইয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনও ভেদ নেই, এই তত্ত্বকে তাঁরা ‘পরাৎপর ব্রহ্মতত্ত্ব’ বলেন। শক্তপুরাণে এই অদ্বৈত তথা দ্বৈততত্ত্বটি বোঝাতে গিয়ে দ্বিদলবিশিষ্ট বীজের উপমা আনা হয়েছে। ছোলা অভঙ্গ অবস্থায় একটি নিটোল শক্ত পদার্থ। কিন্তু বাইরের খোসাটি সরিয়ে ফেললেই দেখা যায়, দুটি দল যে পরস্পর অচ্ছেদ্যভাবে সংলগ্ন হয়ে আছে, দল দুটি পৃথক হয়েও যেন পৃথক নয়। ঠিক সেইরকমই যা মূলত শক্তিতত্ত্ব তাই—ই শিবশক্তি।

সৃত্যামি ব্রহ্মরূপেণ জগদেতচ্চরাচরৎ।
সংহরামি মহারুদ্র—রূপেণান্তে নিজেচ্ছয়া।। ৩।।

দেবী বলেছেন, পুরাণাদিতে ব্রহ্মাকে সৃষ্টিকর্তা এবং শিবকে সংহার কর্তা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমিই ব্রহ্মা, আমিই শিব। ব্রহ্মরূপে আমি বিশ্ব—স্রষ্টা। আবার প্রলয়কালে আমিই রূদ্ররূপে নিজের সৃষ্টি সংহার করি। ব্রহ্মা বা শিবকে শক্তি থেকে স্বতন্ত্রভাবে দেখে স্রষ্টা বলে মনে করা ভুল। আসলে দেবীই ব্রহ্মারূপে স্রষ্টা এবং শিবরূপে সংহর্তা।

দুর্ব্বত্তশমনার্থায় বিষ্ণুঃ পরমপুরুষঃ।
ভূত্বা জগদিদং কৃৎস্নং পালয়ামি মহামতে। ৪।।

দেবী বলেছেন, বিষ্ণু বিশ্বের পালনকর্তা। কিন্তু স্বয়ং শক্তি নিখিল জগতকে পালন করেন বিষ্ণুরূপে। বিষ্ণু শক্তিরই একটি রূপভেদ মাত্র। অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি এবং সংহার বিশ্বনিখিলের এই তিনটি পর্যায় সর্বশক্তিময়ী দেবীরই দান। স্বতন্ত্ররূপে তিনি এই কার্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিবকে প্রধান পুরুষরূপে প্রথম শ্লোকে বিবৃত করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শিবের মতোই ব্রহ্মা ও বিষ্ণুও পরমাশক্তি শিবার অচ্ছেদ্য রূপ। দেবীর সঙ্গে তাঁদের ভেদাভেদও নির্ণীত।

অবতীর্য্য ক্ষিতৌ ভূয়ো ভূয়ো রামাদিরূপতঃ।
নিহত দানবান পৃথ্বী পালয়ামি মহামতে।। ৫।।

এই স্থানে দেবী হিন্দুপুরাণে প্রতিষ্ঠিত ভগবানের বিভিন্ন অবতার সম্পর্কে শাক্ততত্ত্বটি ব্যাখ্যা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে ত্রেতাযুগের রামচন্দ্রের আবির্ভাব এবং রাবণাদি সংহার করে বিশ্বের ভার লাঘব করার কথা বলেছেন। যখনই দুর্জনের শক্তি বড় হয়ে উঠেছে, মিথ্যাচার ও পাপে পৃথিবী ভরে গেছে, তখনই দেবী বিভিন্ন রূপ ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছেন। দশাবতার স্তোত্রে যাদের বলা হয়েছে পালনকর্তা বিষ্ণুর অবতার। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, অধর্ম প্রাধান্য পায়, তখনই দুষ্কৃতীকে বিনাশ করে সাধুজনের পরিত্রাণের জন্য বিভিন্নরূপে বিভিন্ন অবতার বিশ্বে আসেন। কিন্তু পালনকর্তা বিষ্ণু স্বয়ংই শাক্তমতে দেবীর একটি রূপভেদ। সুতরাং বলা যায় ঈশ্বরের বিভিন্ন অবতার রূপে অবতরণ প্রকৃতপক্ষে দেবীশক্তিরই বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ।

রূপং শক্ত্যাত্মকং তাত প্রধানং তত্র চ স্মৃতঃ।
যতস্ময়া বিনা পুংসঃ কার্য্যাং নেহাত্মনঃ স্থিতম্।। ৬।।

পুরাণে অবতরদের পুরুষরূপে দেখানো হলেও দেবী বলেছেন—এই যে নৈমিত্তিক রূপে ভূ—ভার হরণের জন্য বামন, রাম ইত্যাদি রূপে ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশ, কিন্তু এই নৈমিত্তিক রূপগুলির কোনও পুরুষাত্মক সামর্থ্য নেই, যদি না তারা শক্তির বিশিষ্ট প্রকাশ হয়ে ওঠে। দেবী তাঁর নিত্যরূপ এবং নৈমিত্তিক রূপ, স্থূলরূপ ও সূক্ষ্মরূপ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলেছেন তিনটি শ্লোকের মধ্যে দিয়ে—

রূপাণ্যৈতানি রাজেন্দ্র তথা কন্যাদিকানি
স্থূলানি বিদ্ধি সূক্ষ্মন্তু পূর্ব্বমুক্তং তবালয়ে।। ৭।।
অনভিধ্যায় রূপন্তু স্থূলং পর্ব্বতপুঙ্গবে।
অগম্যং সূক্ষ্মরূপং মে যদৃষ্টা মোক্ষ ভাগ্ভবেৎ।। ৮।।
ভস্মাৎ স্থূলং হি মে রূপং মুমুক্ষুঃ পূর্ব্বমাশ্রয়েৎ।
ক্রিয়া—যোগেন অন্যেব সমভ্যর্চ্চ্য বিধানতঃ।
স্বল্পমালোচয়েৎ সূক্ষ্মং রূপং মে পরমব্যয়ম্। ৯।।

উপরিউক্ত এই তিনটি শ্লোকের আপাত অর্থ হল পূর্বে উল্লেখিত দেবগণ ও অবতারগণ এবং বিভিন্নরূপ ধারণ করে দেবীর মর্ত্যযাপন সবই তাঁর সূক্ষ্ম ও নৈতিমত্তিক রূপ। এই স্থূলরূপগুলির অভিধ্যান অর্থাৎ পূজা—অর্চনা, সাধনভজন ইত্যাদি করে তবেই ভক্ত সূক্ষ্মরূপের অনুভাবনায় সমর্থ হয়। রূপ—দর্শন ব্যতিরেকে জীবের পক্ষে নির্বাণ কৈবল্য লাভ করা অসম্ভব। যে সাধক কৈবল্য লাভের অভিলাষী তিনি সর্বপ্রথমে স্থূলরূপকে আশ্রয় করবেন এবং শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী ক্রিয়াকর্মাদির দ্বারা সম্যকভাবে সেই সমস্ত স্থূলরূপের উপাসনা করবেন এবং তার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে দেবীর অব্যয় পরম সূক্ষ্মরূপের বোধ অল্প অল্প করে আয়ত্ত করতে পারবেন।

স্থূল—সূক্ষ্ম—নৈমিত্তিক ও নিত্য এই ভেদকে অবলম্বন করেই এবার দেবীর নিত্য ও সূক্ষ্মরূপের তন্ত্রোক্ত স্বরূপটি বোঝবার চেষ্টা করা যেতে পারে—

সূক্ষ্ম ও স্থূল এই দুই মিলেই শক্তিতত্ত্ব হল নিত্যস্বরূপ কৈবল্যদায়িনী ঈশ্বরী। শক্তির এই নিত্যতত্ত্ব হল ‘ব্রহ্ম কৈবল্যরূপা’, তিনি নির্গুণা জ্ঞানগম্য, ঈশ্বরী এবং বিশ্বরূপা। তিনিই অনন্য সিদ্ধি শরণাগতের মহামন্ত্র। তিনি সচ্চিদানন্দ মূর্তি এবং সকল বিধাতার বিধাত্রী। একই সঙ্গে তিনি আবার ভক্তবাৎসল্যপূর্ণা। আর্ত—বিপন্নের কাছে তিনি আশার আলো। তাই তন্ত্র বলে তিনি বাচ্য—শক্তিস্বরূপিণী নিত্য চৈতন্যময়ী। তাঁরই বাচক শক্তিস্বরূপে লীলাময়ী মূর্তি পরিগ্রহ। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’ দেবীর লীলা মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—

নিত্যৈব সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্ব্বমিদং ততং।
তথাপি তৎ সমূৎপত্তি র্ব্বহুধা শ্রূয়তাং মম।।
দেবানাং কার্যসিদ্ধ্যর্থমাবির্ভবতি সা যদা।
উৎপন্নেতি তদা লোকে সা নিত্যাপ্যবিধীয়তে।।

জগন্মুক্তি স্বরূপিণী দেবী নিত্যা। তিনি সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। তথাপি বহু মূর্তিতে তাঁর আবির্ভাবের কথা পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। দেবগণের কার্যসিদ্ধির জন্য বহুধা বিভক্ত হয়ে আবির্ভূত নিত্যদেবী ভক্তগণের কল্যাণের জন্য মুক্তিবিধানের পথপ্রদর্শন করেন।

যদিও দেবীর বহুবিধ স্থূলরূপ ভজনাই সাধকের মোক্ষমুক্তির উপায় বলে মনে করা হয়। তবে তার মধ্যে দেবীর মহাবিদ্যার মূর্তিগুলি ভজনার দ্বারাই অতি শীঘ্র মুক্তি লাভ সম্ভব বলে শাক্তশাস্ত্রে বলা হয়েছে। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, বগলা, ছিন্নমস্তা, কমলাত্মিকা, ধূমাবতী, ভৈরবী ও মাতঙ্গী—এঁরা সকলেই জীবের মোক্ষফল প্রদায়িনী দেবী। এই সকল মূর্তিতে পরম ভক্তি স্থাপন করলে জীব নিঃসংশয়ে মুক্তিলাভ করে। প্রকৃতপক্ষে দেবীর এইসব স্থূলরূপ আশ্রয় মাত্র, আশ্রয়ী নিত্যরূপা ভগবতী। অর্থাৎ প্রকৃত সাধক যে মূর্তিই অবলম্বন করুন না কেন তিনি নিত্যদেবীকেই লাভ করবেন। সাধকের সাধনার লক্ষ্য অবশ্যই মোক্ষপ্রাপ্তি।

দেবীর দশ মহাবিদ্যার বিবরণ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম ‘কালী’র কথাই স্মরণযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ শক্তিসাধনা তথা মন্ত্রসাধনার প্রাচীন পীঠস্থান। সেখানে শাক্তদের নিত্য আরাধ্যা দেবী হলেন কালী। ‘মহানির্বাণ তন্ত্র’ নামক গ্রন্থে দেবীর কালীরূপকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে কালিকার যে শতনাম কীর্তিত হয়েছে তার প্রত্যেকটি শ্লোকে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি আদ্যক্ষর ‘ক’—কার। অতি প্রাচীন কাল থেকে বঙ্গদেশে দেবী দুর্গা বাৎসরিক উৎসবের নিত্যদেবী। আর নিত্য পূজ্য দেবী হলেন কালী এবং কালীর বিচিত্র রূপ। কোনও কোনও স্থানে অন্যান্য মহাবিদ্যার পূজা প্রচলিত থাকলেও সর্বত্র সারা বছর ধরে কালীপূজাই প্রধান শক্তিপূজা রূপে চলে আসছে। দেবী কালিকার প্রাধান্য বর্ণনা করে দ্বাদশ শতকে রচিত ‘কালিকাপুরাণ’ সম্ভবত পূর্বাঞ্চলেই লেখা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য’ গ্রন্থে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত দেখিয়েছেন বিভিন্ন পুরাণ উপপুরাণে কালিকাকেই কিভাবে দেবীর আদ্য ও নিত্যরূপ বলে গণ্য করা হয়েছে। দেবী চামুণ্ডার সঙ্গে অভিন্ন এবং দেবীর অন্যান্য রূপ তারই রূপভেদ।

বিভিন্ন উপপুরাণ ও পুরাণে কালীর কথা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে যে মনে হয়, এই উপপুরাণকারগণ নানাভাবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, কালী এবং দেবী পার্বতী অভিন্ন এবং এই জন্যই কালীকে প্রথমে মহাদেবীরূপে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। এবং দেখা যায়, কালীকে মূল দেবী ও পার্বতীদেবী তাঁর উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী প্রভৃতি সর্বরূপেই সর্বমূলা কালীদেবীর থেকেই প্রসৃতা দেবী করে তুলবার চেষ্টা করা হয়েছে। খিল হরিবংশে দেখা যায়, বাণপুরে ঊষাসহ অনিরুদ্ধ রাজা বাণরাজা কর্তৃক বন্দী হয়ে ‘কোটবী’ দেবীর স্তব করেন। এই স্তবের মধ্যে একদিকে যেমন কাত্যায়নী, চণ্ডী, বিষ্ণুভগিনী, ‘গোকুলসম্ভূতা নন্দগোপস্য নন্দিনীং’ প্রজ্ঞা, দক্ষা, শিবা, সৌম্যা—আবার অন্যদিকে ‘কালীং কাত্যায়নীং দেবীং ভয়দাং ভয়নাশিনীম’। ‘দেবীপুরাণে’ কালিকা বা কালীকে অনেক স্থানে মূলদেবীর সঙ্গে অভিন্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এক স্থলে দেখা যায়, পূর্বকালে নন্দী মহৎ যোগাভ্যাসের দ্বারা জগদগুরু দেবাদিদেবকে আরাধনা করেছিলেন, আরাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবেশ্বর শম্ভু নন্দীকে বর প্রার্থনা করতে বলেন, নন্দী উমাদেহার্ধধারী শিবের সামনে ‘পদমালা বিদ্যা’ বর্ণনা করলেন। যার শুরুতেই আছে—”ওঁ নমো ভগবতি চামুণ্ডে শ্মশানবাসিনি, খটুরঙ্গ—কপাল—হস্তে—মহাপ্রেত— সমারূঢ়ে”— ইত্যাদি। এই জাতীয় মন্ত্র থেকে বোঝা যায় যে এই যুগে চামুণ্ডা কালী মহাদেবের সঙ্গে অতি সহজেই অভিন্নতা লাভ করে আছে।

কালীর অনন্য রূপ বর্ণনায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ যে ধ্যানমন্ত্র সঙ্কলন করেছেন তা কালীমূর্তি নির্বাণে এবং সাধকের সাধ্যবস্তুরূপে গৃহীত—

দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালা বিভূষিতা। বামহস্তযুগলের অধোহস্তে সদ্যচ্ছিন্ন শির, ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ, দক্ষিণের ঊর্ধ্বহস্তে বর, অধোহস্তে অভয়। দেবী মহামেঘের বর্ণের ন্যায় শ্যামবর্ণা এবং দিগম্বরী; তাঁর কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা থেকে ক্ষরিত রুধিরের দ্বারা দেবীর দেহ চর্চিত; দুটি শবশিশু তাঁর কর্ণভূষণ। তিনি ঘোরদ্রংষ্টা, করালাস্যা, পীনোন্নত পয়োধরা; কাঞ্চী পরিহিতা দেবী হসন্মুখী। ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় থেকে গলিত রক্তধার দ্বারা দেবী বিস্ফূরিতাননা; ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী—শ্মশান গৃহবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের মতো দেবীর ত্রিনেত্র; তিনি উন্নতদন্তা, আর কেশরাশি দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়ের উপর সংস্থিতা, চতুর্দিকে ঘোরেরবকারী শিবাকূলের দ্বারা সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সঙ্গে ‘বিপরীতরতাতুরা’ সুখপ্রসন্নবদনা এবং স্মেরাননসরোরূহা।

ভারতচন্দ্র ‘মহানির্বাণ তত্ত্ব’ অনুসারে দশমহাবিদ্যার ভাষাচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। ভারতচন্দ্রের সেই বর্ণনা নিম্নে উদ্ধৃত করা হল—

কালীরূপা

মুক্তকেশী মহামেঘবরণা দন্তুরা।
শবারূঢ়া করকাঞ্চী শবকর্ণপুরা।।
গলিতরুধিরধারা মুণ্ডমালা গলে।
আর বাম করেতে কৃপাণ খরশান।
দুই ভুত্যে দক্ষিণে অভয় বর দান।।
লোলজিহ্বা রক্তধারা মুখের দু পাশে।
ত্রিনয়ন অর্ধচন্দ্র ললাটে বিলাসে।।

তারারূপা

নীলবর্ণা লোলজিহ্বা করালবদনা।
সর্পবান্ধা উর্দ্ধ একজটা বিভূষণা।।
অর্দ্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত কপাল।
ত্রিনয়ন লম্বোদপরা বাঘছাল।।
নীলপদ্ম খড়্গকাটি সমুণ্ড খর্পর।
চারি হাতে শোভে আরোহনণ শিবোপর।।

রাজরাজেশ্বরী

রক্তবর্ণা ত্রিনয়না ভালে সুধাকর।
চারি হাতে শোভে পাশাঙ্কুর ধনুঃশর।।
বিধিবিষ্ণু ঈশ্বর মহেশ রুদ্র পঞ্চ।
পঞ্চপ্রেতনিরমিত বসিবার মঞ্চ।।

ভুবনেশ্বরী

রক্তবর্ণা সুভূষণা আসন অম্বুত্য।
পাশাঙ্কুশ বরাভয়ে শোভে চারি ভুজ।।
ত্রিনয়ন অর্ধচন্দ্র ললাটে উজ্জ্বল।
মণিময় নানা অলঙ্কার ঝলমল।।

ভৈরবীরূপা

রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কমল আসনা।
মুণ্ডমালাগলে নানা ভূষণভাষণা।।
অক্ষমালা পুঁথি বরাভয় চারি কর।
ত্রিনয়ন অর্দ্ধচন্দ্র ললাট উপর।।

ছিন্নমস্তা

বিকশতি পুণ্ডরীক কর্ণিকার মাঝে।
তিনগুণে ত্রিকোণ মণ্ডলভাল সাজে।।
বিপরীত রতে রত রতি কামপোরি।
কোকনদবরণা দ্বিভুজা দিগম্বরী।।
নাগযজ্ঞোপবীত মুণ্ডাস্থিন্দুমালা গলে।
খড়্গে কাটি নিত্য মুণ্ড ধরি করতলে।।
দুই দিকে দুই সখী ডাকিনী বর্ণিনী।
দুই ধারা পিয়ে তারা শব আরোহিনী।।
চন্দ্র সূর্য্য অনল শোভিত ত্রিনয়ন।
অর্দ্ধচন্দ্র কপালফলকে সুশোভন।।

ধূমাবতী

অতি বৃদ্ধা বিধবা বাতাসে দোলে স্তন।
কাকধ্বজরথারূঢ়া ধূমের বরণ।।
বিস্তারবদনা কৃশা ক্ষুধায় আকুল।
এক হস্তে কম্পমান আর হস্তে কুলা।।

বগলামুখী

রত্নগৃহে রত্নসিংহাসনমধ্যস্থিতা।
পীতবর্ণা পীতবস্ত্রাভরণভূষিতা।।
এক হস্তে এক অসুরের জিহ্বা ধরি।
আর হস্তে মুদ্গর ধরিয়া উর্দ্ধ করি।।
চন্দ্র সূর্য্য অনল উজ্জ্বল ত্রিনয়ন।
ললাট মণ্ডলে চন্দ্রখণ্ড সুশোভন।।

মাতঙ্গী

রত্নপদ্মাসনা শ্যামা রক্তবস্ত্র পরি।
চতুর্ভুজা খড়্গ চর্ম্ম পাশাঙ্কুশ ধরি।।
ত্রিলোচন অর্দ্ধচন্দ্র কপালফলকে।

মহালক্ষ্মী

সুবর্ণ সুবর্ণ বর্ণ আসন অম্বুজ।
দুই পদ্ম বরাভয়ে শোভে চারিভুজ।।
চতুর্দন্ত চারি শ্বেত বারণ হরিষে।
রত্নঘটে অভিষেকে অমৃত বরিষে।।

দেবীর উল্লিখিত মহাবিদ্যাগণ ভক্তকে অতিশীঘ্র মুক্তিদান করতে পারেন। শাস্ত্রানুমোদিত ক্রিয়াযোগে এঁদের কোনও এক মূর্তি আশ্রয় করলে মূল দেবীতেই মন—বুদ্ধি অর্পণ করা হয়। মন—বুদ্ধি দেবীতে অর্পণ করলে ভক্তগণের কদাচ পুনর্জন্ম লাভ হয় না। দেবী স্বয়ং ভগবৎ গীতায় বলেছেন—হে রাজন, অনন্য হৃদয় হয়ে যে আমাকে স্মরণ করে আমি সেই ভক্তিযুক্ত যোগীরই মুক্তির বিধান করি। এমনকি যে মৃত্যুকালে আমাকে ভক্তিপূর্বক স্মরণ করে প্রাণত্যাগ করে সেও কখনও আর সংসারে দুঃখরাশিতে আবর্তিত হয় না। হে মহারাজ, আমি নিত্যমুক্তি প্রদায়িনী। আমার শক্তিরূপ আশ্রয় করো, তাহলেই মোক্ষলাভ হবে। এ জগতে আমার থেকে, স্বতন্ত্র কোনও পদার্থ নেই। এমনকি যে দেবতারই উপাসনা করা হোক সে সব দেবতাই আমার বিভূতিমাত্র। যে যজ্ঞই অনুষ্ঠান করা হোক আরাধ্য দেবতারূপে আমিই সেই পূজা গ্রহণ করি। কিন্তু যে পূজক অন্য দেবতাকেই শেষ বলে মনে করে এবং তাঁকে স্বতন্ত্র জ্ঞান করে তাঁর মুক্তি নিতান্ত দুর্লভ। ‘মোহিনীতন্ত্রে’ বলা হয়েছে মহাকালীর প্রলয় নৃত্যে আতঙ্কিত হয়ে মহাকাল দেবীর বিরাটকায় দেহের মধ্যে আশ্রয় নিলেন। তিনি দেবীর দেহমধ্যে বহুকোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও বিনাশ মুহুর্মুহু দেখতে পেলেন। দেবীর সেই বিশ্বরূপই তাঁর মহাস্বরূপ।

মহামায়া তত্ত্ব

মায়াতত্ত্বকে বেদান্তে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বৈষ্ণব বা শাক্তরা কেউই সেভাবে এটিকে গ্রহণ করে না। বেদান্তে মায়া ব্রহ্মকে আবৃত করে, তার ফলে নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্ম সগুণ সাকার বলে প্রতীয়মান হয়, এই প্রতীতি একটি ভ্রান্তি। শাক্ত মতানুযায়ী মায়া নিত্য পরাশক্তি এবং চিৎশক্তি থেকে অভিন্ন। মায়াকে তাঁরা বলেন মহামায়া এবং অঘটন—ঘটনপটিয়সী। দেবী মহামায়া স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর থেকে শুরু করে সমগ্র জীবজগতকে মোহগ্রস্ত করে, কামনাবাসনা যুক্ত করেন। তন্ত্র মতে মহামায়ার দুটি রূপ—বিদ্যা ও অবিদ্যা। ব্রহ্মার স্তবে—

মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতি।
মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।।

ভোগ ও মুক্তি; ভববন্ধন ও মোক্ষ—দুইয়েরই মূলে রয়েছেন দেবী মহামায়া।

মহামায়াকে ভক্তরা ইচ্ছাময়ী বলেছেন। ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই নির্গুণ দেবী সগুণা হন, অনন্তব্যাপিনী বিস্তারিত হন। নিরাকার সাকার হন, এক বহু হন। মহামায়ার বিচিত্র ইচ্ছা থেকেই তিনি লীলাময়ী। এই লীলা প্রকাশের জন্যই তিনি কখনও ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর রূপে আবার কখনও তাদের ভার্যারূপে প্রকট হন। এই সমগ্র সংসার তাঁর লীলাক্ষেত্র, তবে মহামায়ার রূপ—গুণ—লীলা সবই রহস্যময়।

শাক্ত ভক্তরা মহামায়াকে যেমন কখনও ইচ্ছাময়ী, লীলাময়ীরূপে আবার কখনও করুণাময়ী, ভয়হারিণী রূপে অনুভব করেন। দেবীর মূলমূর্তি কালিকার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর ভীষণ রূপ আছে। ভক্ত—তান্ত্রিকরা জানেন, জীবের করুণায় পূর্ণ বলেই তিনি এই ভীষণবদনা রূপ ধারণ করেন। সমস্ত পাপ—তাপ, বিপদ—আপদ থেকে জীবকে রক্ষা করে অনন্ত করুণায় ভক্তকে তিনি মুক্তির পথে আকর্ষণ করেন। তাই পরম ভক্ত করালবদনা রক্তবিভূষিতা খর্পরধারিণী বালিকাকে ‘করুণাময়ী মা’ বলে অনুভব করেন।

মৃত্যুর দেবতা মহাকাশ, তিনি জগতের সবকিছু সংহার করেন। মহাকালী মহাকালকেও পদদলিত করেন। সেইজন্যই মহাকাল স্বরূপ মহাদেবের বুকের উপর বিরাজ করছেন মহাকালী। তান্ত্রিক যোগীদের মতে, যোগ দ্বারা জীব মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারে। মোক্ষমুক্তি যে সাধনার লক্ষ্য তা তো মৃত্যুকে জয় করেই লাভ করা যায়। বাস্তব দৈহিক মৃত্যু একটা সামান্য ব্যাপার, তাকে অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছনোই সাধনার মূলতত্ত্ব।

সপ্তাচার ত্রিভাব

শাক্তসাধনার মূল লক্ষ্য মোক্ষলাভ। শাক্ত ভক্ত মোক্ষের মধ্যে সার্ষ্টি, সাযুজ্য, স্বারূপ্য, সালোক্য প্রভৃতি স্তরভেদ করেছেন। এর মধ্যে কোনওটি উপাস্যতত্ত্বের সঙ্গে ব্রহ্মালোকে বিহারের ক্ষমতা লাভ, কোনওটি উপাস্যতত্ত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়া, কোনওটি আবার কৌন্তিক মোক্ষতত্ত্বের অনুরূপ, কোনওটি উপাস্যতত্ত্বের সঙ্গে সমরূপতা প্রাপ্তি, কোনওটি আবার অতিনৈকট্য। কোনও কোনও তন্ত্রে মোক্ষতত্ত্বের এই বিভাজনগুলি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। এখানে শাক্তদেব দেবীতত্ত্বের এক মূল বিষয় কার্যকর। দেবী নির্গুণ হলেও সগুণ এবং লীলাময়ী। তার এই সাকারত্ব, সগুণত্ব এবং লীলাময়ীত্ব তাঁকে মহামায়া তত্ত্বে উপলব্ধ করায়। সুতরাং সাধক জীব তাঁর সাধনার ক্রমিক উন্নতির পর্যায় হিসেবে দেবীমধ্যে লীন হয়ে যাবার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত সার্ষ্টি, সাযুজ্য ও সালোক্য—এই পর্যায়গুলির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। তখন মহামায়ার সঙ্গে জীবের লীলাপ্রবাহ চলতে থাকে। ক্রমে বিশ্বপ্রপঞ্চের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি হতে থাকে। উপাস্যের লীলাসঙ্গী হিসেবে মোক্ষলাভে ইচ্ছুক সাধকের তন্ত্রসাধনার এই লক্ষ্যটি একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বৈদান্তিক মোক্ষের সঙ্গে এর যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।

তন্ত্রসাধনার মধ্যে একটি ক্রমিক ও ঊর্ধ্বগামীতা আছে। স্থূল থেকে আরম্ভ করে ক্রমশ সূক্ষ্মের দিকে তার গতি। মহাশক্তি নির্গুণ বা অতিসূক্ষ্ম। সেখান থেকে স্থূলের দিকে তার অভিব্যক্তি। মহাশক্তির সাধনা সম্পূর্ণ এর বিপরীতমুখী। স্থূল থেকে ক্রমশ সূক্ষ্মে এবং সূক্ষ্ম থেকে ক্রমশ পরমতত্ত্বে। চরম স্তরে মোটের মধ্যে ক্রমিবন্যাসে এর প্রকাশ ঘটে।

পণ্ডিত, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র, দ্বিজ, চণ্ডাল সকলেই তন্ত্র সাধনার অধিকারী। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই। সকাম ও নিষ্কাম এই দুই ভাবেই দেবীর আরাধনা করা যায়। তন্ত্রসাধনায় ভুক্তি ও মুক্তি দুইয়েরই সাধনা হতে পারে। এখানে বাহ্যপূজা, মানসপূজা এইরূপ ক্রমবিকাশ লক্ষণীয়।

শাক্ত তান্ত্রিকেরা ধর্মসাধনাকে আচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এই সাতটি আচার হল—বেদাচার, বৈষ্ণবাচার, শৈবাচার, দক্ষিণাচার, বামাচার, সিদ্ধান্তাচার ও কৌলাচার। প্রতিটি আচার ক্রমান্বয়ে পরবর্তী আচারের দিকে উন্নয়নমুখী। হিন্দু ধর্মাচারের প্রতিটি পর্যায়কে তারা এর মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁদের মত অনুযায়ী যাবতীয় দেবতা যেহেতু আদ্যাশক্তির বিচিত্র প্রকাশ তাই পূজাচারই শক্তিসাধনার অঙ্গ রূপে গ্রাহ্য। শাক্তসাধনার শুরুতে রয়েছে বেদাচার এবং শেষ সিদ্ধি কোলাচারে।

এই সাতটি আচারকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। পশুভাব, বীরভাব ও দিব্যভাব। পশুভাবের মধ্যে আবার চারটি আচার—বেদাচার, বৈষ্ণবাচার, শৈবাচার, দক্ষিণাচার। এই আচারগুলির দ্বারা ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে দেহ ও মনকে শক্তিপূজার উপযোগী করে গঠন করেন, মদ—মাংসাদি খান না। ফলে পঞ্চ ‘ম’—কার সাধনা হয় অনুকল্প বিধানে। এখানে পশু শব্দের অর্থ জন্তু নয়, সাধারণ জীব। যে সকল জীব স্থূল জৈব প্রবৃত্তিকে জয় করতে পারে না, এবং সে কারণে শক্তিসাধনার নিগূঢ় তাৎপর্য ও সংকেতগুলি অনুধাবন করতে পারে না তাদেরকেই পশু বলা হয়েছে। বেদাচার, বৈষ্ণবাচার, শৈবাচার ও দক্ষিণাচারের মধ্য দিয়ে পশুভাবের সাধক নিজেকে উন্নততর পর্যায়ে সাধনার জন্য প্রস্তুত করেন। পশুভাবের সাধকের জন্য প্রত্যক্ষ পঞ্চ ‘ম’কার নয়। ব্রহ্মচর্য পালন করাই এক্ষেত্রে করণীয়। কারণ সে এখনও জৈব প্রবৃত্তির বশীভূত। প্রকৃত সাধক পশুভাবের স্তব ঠিকমতো অতিক্রম করে তবেই বীরভাবের স্তরের সাধনায় উপস্থিত হতে পারেন। বামাচার ও সিদ্ধাচার এই দুটি বীরভাবেরই অন্তর্গত। প্রকৃতির স্থূল জৈব—প্রবৃত্তি যারা অতিক্রম করতে পারেন তাঁরাই প্রকৃত বীর। এই বীরভাব তন্ত্রসাধনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। পঞ্চ ‘ম’ কারকে সাধনরীতিরূপে ব্যবহার করলেও নিজে জৈব প্রবৃত্তিকে জয় করেছেন, সেইজন্য এগুলি তাঁর কাছে সাধন, ভোগ নয়। এই পঞ্চ ‘ম’কার হল—মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। শবসাধনা, চিতাসাধনা, চক্রসাধনা প্রভৃতি ভয়াবহ এবং দুরূহ সাধনা করার ক্ষমতা একমাত্র বীরভাব সাধকদেরই থাকে। বীরভাবের সাধকরা যেহেতু ব্রহ্মচর্যে বলীয়ান এবং আত্মিক শক্তিতে শক্তিমান সেহেতু পঞ্চ ‘ম’—কারের স্তূলভোগ ও আসক্তিও তাঁর কাছে পরম নিরাসক্ত সাধনার পথ হয়ে ওঠে। তান্ত্রিক সাধনার চূড়ান্ত স্ফূর্তি ঘটে দিব্যভাবে। কৌলাচার হল দিব্যভাবের সাধনা। বীরভাবের মধ্য দিয়েই দিব্যভাবে পৌঁছতে হয়। তিনি উদাসীন, নিরাসক্ত এবং সদানন্দময়। তাঁর মধ্য দিয়েই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি স্বভাবত ইড়া—পিঙ্গলা—সুষুম্না—এই ত্রিধারার সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়। দিব্যভাবের সাধকের এই কুলকুণ্ডলিনী সাধন হল তান্ত্রিক সাধন পদ্ধতির চরমতম পর্যায়।

দেহসাধনা ও কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্ব

তান্ত্রিক সাধনার প্রধান অঙ্গ হল কায়াসাধনা। ধাতু বা পাষাণমূর্তির ধ্যানে এবং বিভিন্ন উপচারে যে পূজা হয় তার সঙ্গে যুক্ত থাকে ভুজ শক্তি, ন্যাস, প্রাণায়াম ও মানসপূজা। এরই সঙ্গে তান্ত্রিক সাধক দেহসাধনাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সাধারণ দেহতত্ত্বের মতো সাধারণ সাধকের কাছেও এই মনুষ্যদেহ শক্তিসাধনার প্রধান অঙ্গ। দেহভাণ্ডই ব্রহ্মাণ্ড সপ্তসাগর, সপ্তদীপ। সমস্ত গ্রহমণ্ডলই মনুষ্যদেহে বর্তমান। শাক্ততান্ত্রিকের এই দেহসাধনা একটি যৌগিক সাধনা। তাত্ত্বিকগণরা একে হঠযৌগিক সাধনা বলে।

ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না এই তিনটি দেহমধ্যস্থ নাড়ীকে সাধকেরা সাধন তাৎপর্যে ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের গুহ্যদেশ থেকে শুরু করে শিরোদেশ পর্যন্ত এই নাড়ীগুলি প্রসারিত। মেরুদণ্ডের বামপার্শ্বে অবস্থিত ইড়াকে কখনও চন্দ্র, কখনও বা গঙ্গা বলে অভিহিত করা হয়। মেরুদণ্ডের দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত পিঙ্গলা নাড়ীকে কখনও সূর্য, কখনও যমুনা বলা হয়। আর মেরুদণ্ডের মধ্যভাগ বরাবর বিস্তৃত নাড়ী হল সুষুম্না। একে অগ্নি বা সরস্বতী নামে অভিহিত করা হয়। এই তিনটি নাড়ী গুহ্যদেশ ও শিরোদেশের এক একটি কেন্দ্রে সমন্বিত। এই দুটি মিলনস্থলকে তন্ত্রের পরিভাষায় বলা হয় ত্রিবেণী।

যোগসাধনার দেহতত্ত্বের বিশ্লেষণ ষটচক্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে ছয়টি চক্র বা পদ্ম আছে। এগুলি হল—মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা। পদ্মগুলি কলিকার আকারে বিভিন্ন পাপড়ির সঙ্গে সংযুক্ত। এই ছয়টি পদ্ম ছাড়াও শিরোদেশে একটি সহস্রদল পদ্ম আছে, এই নিম্নমুখী পদ্মটির নাম সহস্রার পদ্ম। ষটচক্রের প্রত্যেকটিতে আছে এক—একটি মাতৃকাশক্তি। ডাকিনী, রাকিনী, লাকিনী, কাকিনী, শাকিনী, হাকিনী—এঁরা হল মাতৃকাশক্তি। ষটচক্রের প্রত্যেকটির বিচিত্র বর্ণ আছে এবং প্রতিটি পদ্মের সঙ্গে বাংলা বর্ণমালার কতকগুলি বর্ণ সন্নিবিষ্ট আছে। শাক্ত সাধক যখন বর্ণমালার বিভিন্ন বর্ণের উল্লেখ করেন তখন তিনি আসলে নিগূঢ় তত্ত্বের কথাই বলেন।

ষটচক্রের অবস্থান নিম্নরূপ—গুহ্য বা লিঙ্গদেশের মধ্যে সুষুম্না নাড়ীর মুখে মূলাধার পথ। লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান, নাভিমূলে মণিপুর, হৃদয়দেশে অনাহত, কণ্ঠদেশে বিশুদ্ধ, ভ্রূর মধ্যে আজ্ঞা। দুই, চার, ছয়, দশ, ষোলো—প্রতিটি পদ্ম পাপড়ির সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। এই পাপড়ির সংখ্যা অনুসারেই বর্ণমালার বর্ণগুলি সংশ্লিষ্ট। যেমন মূলাধারের চারটি পাপড়ির বর্ণ চারটি হল—ব, শ, ষ, স। স্বাধিষ্ঠানে ছটি বর্ণ হল—ব, ভ, ব, ম, য, র, ল।

মণিপুরে দশটি বর্ণ হল—ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, ঝ, ঞ, ট, ঠ।

বিশুদ্ধে ষোলোটি পাপড়ি হল—অ থেকে অঃ।

আজ্ঞাপদ্মের দুটি বর্ণ হল—হ এবং ক্ষ।

সহস্রারে পদ্মের সহস্রটি পাপড়ি। এই সহস্রার পদ্ম হল শিবপুর। সহস্রার পদ্মই হল সগুণ ব্রহ্ম শিবের স্থান। আবার একই সঙ্গে নির্বাণশক্তির মধ্যস্থিত ব্রহ্মরূপ নরশিবের আধার।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করাই হল তান্ত্রিকের দেহসাধনার মূল লক্ষ্য। কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে এবং তাকে ঊর্ধ্বমুখে চলমান করতে হবে। কুণ্ডলিনী যতই ঊর্ধ্বমুখী হবে ততই সাধক—চিত্তে উচ্চতর বৃত্তিগুলি বিকশিত হতে থাকবে। ন্যাস, প্রাণায়াম পদ্ধতির উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই সাধক কুলকুণ্ডলিনীকে ঊর্ধ্বমুখী করেন। সুষুম্নার পথ ধরে কুলকুণ্ডলিনীর গতি ঊর্ধ্বমুখী। ঊর্ধ্বগতির পথে কুলকুণ্ডলিনী চক্রগুলি ভেদ করে পদ্মগুলি পাপড়ি মেলে বিকশিত হতে থাকবে। এক—একটি পদ্ম বিকশিত হতে থাকে আর সাধকের দেহের মধ্যে বিভিন্ন শক্তি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। অবশেষে সহস্রারে শিবের সঙ্গে কুণ্ডলিনী শক্তি যুক্ত হন, তখন সাধকের সিদ্ধি ঘটে। অমৃতরূপ স্রোতে আপ্লুত হয় সাধক—চিত্ত। সহস্রারে কুলকুণ্ডলিনীর সঙ্গে শিবের মিলনের যে বর্ণনা তন্ত্রশাস্ত্রে আছে এক কথায় তা অভিনব এবং বিপরীত রতির এক চমৎকার বিবরণ। যখন কুলকুণ্ডলিনী ষটচক্রভেদ করে সহস্রারে উপস্থিত হন শিব তখন শবের ন্যায় নিরীহভাবে শুয়ে থাকেন। পরম রূপবতী কুলকুণ্ডলিনী দেবী কামোদ্রেককারিণী এবং কামোল্লাসকারিণী। তিনি তাঁর মুখপদ্মে সুরভিত নিষ্ক্রিয় শিবকে জাগ্রত করে, তাঁর আপাত নিরীহ নিরুত্তাপ ভাবকে উত্তেজিত করে তোলেন। দেবীর পুনঃপুনঃ মুখচুম্বনে শিব তখন আত্মহারা—দিশেহারা। এই রতিক্রিয়ায় শিব কোনও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন না। দেবী কুলকুণ্ডলিনী শিবের ওপর আরোহণ করে তাঁর সঙ্গে রমণ করেন। এই সামরসের বোধ সাধকের সমগ্র চিত্তকে এক অনির্বচনীয় আনন্দরস দান করে—

অমৃতংজয়তে দেবি!
তৎক্ষণাৎ পরমেশ্বরি।
তদুম্ভবাণ্মৃতং দেবি!
লাক্ষারস সমারুণম্।।

কিন্তু প্রকৃত তান্ত্রিকের সাধনা এখানেই শেষ হয় না। কুলকুণ্ডলিনীকে আবার সহস্রার থেকে ফিরিয়ে ধীরে ধীরে ষটচক্রের পথ ধরে মূলাধারে ফিরিয়ে এনে পুনস্থাপন করতে হয়। সাধক তখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেও তিনি যে দিব্যচেতনা লাভ করেছেন তা তাঁর অন্তরে থেকে যায়। এইভাবে সাধনার মধ্যে দিয়ে সাধক নিত্য আনন্দ, নিত্য চৈতন্য এবং অদ্বৈত শিব—শক্তিময় অবস্থায় তুরীয় মার্গে বিচরণ করেন। আর সেই দুর্লভ অবস্থা হলো জীবিত অবস্থায় সাধকের মুক্তির অবস্থা। যাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। কবির ভাষায়—

‘করি শিবশিব যোগ বিনাশিব ভবরোগ
দূরে যাবে অন্য ক্ষোভ ক্ষরিত সুধার সনে।
মূলাধারে বরাসনে ষড়দলে লয়ে জীবনে
মণিপুরে হুতাশনে মিলাইব সমীরণে।।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন