পৃথ্বীরাজ সেন
শক্তিসাধনার অন্যতম অঙ্গ হল শ্রীশ্রীচণ্ডীর পূজা। বাঙালি সমাজে মায়ের পুজো করে এবং শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করা যায়। তাই যুগে যুগান্তরে বাঙালি সাধক—সাধিকারা দেবীমূর্তির উদ্দেশে প্রণাম করেছেন।
তন্ত্রে যাকে শক্তিপুজো বলে অভিহিত করা হয়েছে বেদে তাঁকে পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম বলা হয়েছে। শক্তি এবং শক্তির ক্রিয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। বিজ্ঞান সাধকরা বলে থাকেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড হল মহাশক্তির বিচিত্র খেলা। এই অনন্ত নক্ষত্র—জগৎ, সূর্য, চন্দ্র, বাতাস, সমুদ্রের জলরাশি, মনুষ্যজীবন, মন—প্রাণ— বুদ্ধি—বোধ—চেতন প্রভৃতি সবই সেই শক্তির তরঙ্গায়িত রূপ। শাস্ত্রে লেখা আছে যখন চিত্তশুদ্ধিবশত নরনারী শক্তিকে এমনভাবে অনুধাবন করতে পারে তখন তাদের মনের গতি অন্তর্মুখী হয়। সেই প্রাণসত্তা অনন্ত চৈতন্য সত্তার সঙ্গে মিলিত হয়।
এই শক্তিকে অগ্রাহ্য করলে মনের গতি বহির্মুখী হয়। তখন আমাদের অন্তরে লোভ, লালসা, কামনা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে যে আমরা কিভাবে আমাদের মনের গতিকে অন্তর্মুখী করব। এবং এর ফলে সুসন্তানদের দেবতাদের দ্বারা আরাধ্য সত্য, পবিত্রতা, প্রেম, সেবা, ক্ষমা প্রভৃতিকে শুভ এবং বহিঃপ্রকৃতিজনিত মনের ভেতর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহকে অশুভ বলে চিহ্নিত করব।
সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে কু এবং সু—এর মধ্যে লড়াই চলেছে। এই সংগ্রামকে বলা হয় দেবাসুর সংগ্রাম। মর্ত্যলোকে নরনারীরা নিজেদের চিত্তে এই সংগ্রামের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন। সমগ্র চণ্ডীশাস্ত্রে দেবী এবং অসুরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের কথাই বারবার বর্ণিত হয়েছে। তাই বলা হয়েছে যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সৎ, শোভন, সুন্দর করতে হলে নিয়মিত চণ্ডীপাঠ করা দরকার। কিন্তু চণ্ডীপাঠ করতে হলে তার অর্থও অনুধাবন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় অধ্যাত্ম—সাধনার সঙ্গে তন্ত্রসাধনা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে আছে। তন্ত্রসাধনায় মহা দান হল শ্রীশ্রীচণ্ডীর দিব্যমন্ত্র। এই মন্ত্রগুলিকে সংক্ষেপে আমরা চিন্ময়ীমন্ত্র বলতে পারি। যদি আমরা শুদ্ধ মন নিয়ে নিয়মিত এই মন্ত্রগুলি পাঠ করি তাহলে দেবী চণ্ডী সর্বদা আমাদের সমস্ত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। দেবী চণ্ডী হলেন বিশ্বজগতের এক অনন্য মহাশক্তি, স্থল—জল—অন্তরীক্ষ সর্বত্রই তিনি বিদ্যমান। সন্তানের মনোগত বাসনার কথা তিনি সম্পূর্ণ অবগত আছেন। সন্তানের মনোব্যথা দূর করে তাকে স্বীয় জগতের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দেওয়াই চণ্ডীর বাসনা। তিনি এই জন্য সদা তৎপর থাকেন। যাতে সন্তানরা দৈনন্দিন জীবনের সকল বাধা—প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে পারে, সেজন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট। জীবনের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, আনন্দ, সফলতা আনতে হলে চণ্ডীর কৃপা দরকার। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কীলকস্তবে বলা হয়েছে যদি চণ্ডীর প্রসাদে ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য, আরোগ্য, শত্রুনাশ এবং পরমোক্ষ লাভ হয়, তাহলে কেন আমরা নিয়মিত চণ্ডীপাঠ করব না। যে ব্যক্তি হৃদয়ে সতত চণ্ডীকার স্মরণ করেন, তার হৃদয়ের সকল কামনা পূর্ণ হয় এবং তার হৃদয়ে দেবী সর্বদা বিরাজ করেন।
আবার আমরা যদি কোনও কারণে চণ্ডীর সাথে সম্পর্ক রহিত হয়ে বসবাস করি, তাহলে প্রতি মুহূর্তে আমাদের অনভিপ্রেত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। জীবনে দুঃখ, জ্বালা—যন্ত্রণা আসে। বিফলতার আঘাতে আমরা জর্জরিত হই। সংসার ভেঙে পড়ে। তখন আমরা নতুন করে চণ্ডীর সাথে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব।
সারা বছর আমরা নিয়মিত ভাবে শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠ করব। দুর্গাপূজার সময় শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠের বিধান দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে সত্যদ্রষ্টা ঋষি হৃদয়—সঞ্জাত মহামন্ত্রগুলি পাঠ করলে মায়ের প্রতি প্রেম ভালবাসার জাগরণ ঘটে। মাতৃহৃদয়ের অপরিমিত স্নেহ, করুণা, ভালোবাসা আমরা লাভ করতে পারি।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ হল শ্রীশ্রীচণ্ডী। মহামতি ব্যাসদেব এই পুরাণ লিখেছিলেন। তিনি মার্কণ্ডেয় মুনির মুখ দিয়ে চণ্ডীকথা পরিবেশন করেছেন। এই পুরাণের একাশি থেকে তিরানব্বই অধ্যায় পর্যন্ত অংশটিকে আমরা শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবী—মাহাত্ম্য বলে থাকি। এই দেবী—মাহাত্ম্য হল দেবী পূজার মূল অঙ্গ। সারা ভারতবর্ষে যথেষ্ট শ্রদ্ধা—ভক্তি সহকারে দেবী—মাহাত্ম্য পাঠ করা হয়। শ্রীশ্রীগীতার মতোই শ্রীশ্রীচণ্ডী হল হিন্দুধর্মের আদর্শ গ্রন্থ। চণ্ডী সাক্ষাৎ পরমাত্মাময়ী। বেদমাতা গায়ত্রী চণ্ডীরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন। আবার তাঁকে শ্রীশ্রীদুর্গারূপে কীর্তিত করা হয়েছে।
শ্রীশ্রীদুর্গার পাশাপাশি লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং কালীমায়ের কথাও সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। এইসব দেবীশক্তির কৃপালাভের ফলে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সুন্দর ও এবং সার্থক করতে পারব। সংসারের সংশয় এবং মোহ দুরীভূত হবে। আমরা জগজ্জননী সর্বদুঃখহারী মায়ের পূজাপাঠ করে আমাদের জীবনকে দুঃখের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব।
বাঙালি সাধক—সাধিকারা দীর্ঘদিন ধরে যে শক্তিসাধনা করেছে সেখানে শুধু তন্ত্র—মন্ত্রের সাধনাই করা হয়নি, যাতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনচর্চার সাথে আধ্যাত্মিক ভাবধারার সংমিশ্রণ ঘটে যায়, আমাদের সাধক—সাধিকারা সেদিকেও লক্ষ রেখেছেন। দেবীর ‘অপরাধ ক্ষমাপণ’ স্তবে আছে, ”হে দেবী সুরেশ্বরী, আমি মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন, ভক্তিহীন হয়ে যে পূজা করছি, সেসব তোমার কৃপায় পূর্ণতাপ্রাপ্ত হোক। সহস্র অপরাধ করেও যে শরণাগতি নিয়ে ‘মা জগদম্বা’ বলে ডাকে, ব্রহ্মা প্রমুখ দেবতাদের কাছে যে গতি সুলভ নয়, সে সেই গতি তোমার প্রসাদে প্রাপ্ত হয়।” তবে এই ডাক হবে আন্তরিক এবং ব্যাকুলতাপূর্ণ। এখানে কোনও কৃত্রিমতা বা ছলনা থাকবে না। এক মহাসাধক এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন—’তোমার সমগ্র জীবন হবে সেই পরমেশ্বরীর কাছে নৈবেদ্য ও বলিস্বরূপ। তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে তোমার প্রতিটি কর্মের মাধ্যমে তাঁর সেবা করা, তাঁকে গ্রহণ করা, নিজেকে পূর্ণ করা এবং সেই দিব্যশক্তির কর্ম সম্পাদনে নিজেকে তাঁর যন্ত্ররূপে তুলে ধরা। তোমাকে এমন এক পুণ্য চেতনার অধিকারী হতে হবে যখন তোমার অনুভব হবে যে তোমার ইচ্ছা এবং তাঁর ইচ্ছার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া তোমার মধ্যে আর কোনও অভীপ্সা নেই, এমন কোনও কর্ম নেই যা তাঁর চেতনা প্রণোদিত কর্ম নয় এবং যা কিছু তোমার মাধ্যমে এবং তোমার দ্বারা সাধিত হচ্ছে, সবই তাঁর। তোমার সকল গতিবিধি তাঁরই প্রেরণা, তোমার সকল শক্তি তাঁরই শক্তি, তাঁরই ক্রিয়ার ফলে তোমার মন, প্রাণ এবং এই বিশ্ব—সংসারে তাঁরই প্রকাশের জন্য তিনি তোমাকে গড়ে তুলেছেন।’
এই ক’টি কথা মনে রাখতে পারলে আমাদের মাতৃসাধনা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সার্থক হবে। মাতৃসাধনার মূল কথাই হলো মায়ের ইচ্ছা ও শক্তির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা। আমরা এমন এক মনের অধিকারী হবো যেখানে কামনা, লোভ, ক্রোধ, ভয়, ঈর্ষা, হতাশা, হিংসা, দ্বেষ, আসক্তি, মিথ্যা, ছলনারূপ অশুভ গুণাবলি থাকবে না। অনেকে বলে থাকেন এই জাতীয় মনের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। এই অসম্ভবতার কারণেই বোধহয় আমরা প্রতি মুহূর্তে অশান্তির লেলিহান শিখায় দগ্ধ হচ্ছি। অবিদ্যা আমাদের আক্রমণ করছে। মোহের বাড়বাড়ন্তে আমরা বড়ই অসহায় হয়ে উঠছি। আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব দেখা যাচ্ছে। আমাদের চিত্ত সংকীর্ণতার জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। তাই এখন এই চিত্তকে জাগ্রত করতে হলে নতুনভাবে মাতৃসাধনায় ব্রতী হতে হবে। তা না হলে আমরা কখনওই আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর মতে মা মহামায়া হলেন ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিস্বরূপা। এই জগতের যা কিছু আছে, সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর এবং সূক্ষ্মতম শক্তি—সবই হল এই মহাশক্তির খেলা। এই মহাশক্তি স্থূলরূপে জড়দেহ ও জগৎ, সূক্ষ্মরূপে প্রাণ, মন ও বুদ্ধি এবং সূক্ষ্মতম কারণরূপে চৈতন্যশক্তিতে বিদ্যমান। ঈশ্বরের বা মায়ের শক্তিকে তাই সব সময় স্বীকার করা উচিত—শাস্ত্রে একে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডিকা মা কিন্তু শুধুমাত্র স্বীকৃত শক্তির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করেননি, তিনি স্বীকৃত বা অস্বীকৃত সমস্ত শক্তিতেই বিদ্যমান।
দেবী-মাহাত্ম্যে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি
দেবী—মাহাত্ম্যের প্রথম চরিত্রটিতে কর্মভাব, মধ্যম চরিত্রে জ্ঞানভাব ও উত্তম চরিত্রে ভক্তিভাব ব্যক্ত করা হয়েছে।
ভোগ আসক্তি যুক্ত মনকে সংযমী ও বৈরাগ্য মুক্ত করে ভগবৎমুখী হয়ে ধর্মাচরণ বা কর্মসাধনা করতে হয়। এই উদ্দেশ্যে সিদ্ধির নিমিত্ত সৎগুরুর আশ্রয় গ্রহণ করতে পারলে ভালো হয়। কেন না সামান্য অ—আ—ক—খ শিখতে বা উচ্চ শিক্ষা করতে গেলে আচার্য বা শিক্ষাগুরুর সাহায্য নিতে হয়। অতএব সব প্রকার অপরাবিদ্যার কারণস্বরূপ ব্রহ্মবিদ্যা বা ভগবৎবিদ্যা আয়ত্ত করতো তাহলে, গুরুবল ছাড়া তা লাভ করা কঠিন হয়। তবে কারও পূর্বজন্মের সাধন ও সুকৃতির ফলে এই জন্মে গুরুপ্রাপ্তিতে কিম্বা অন্য কোনও বিশেষ কারণে, মানুষী গুরুর আশ্রয় ছাড়া আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা যায় না। তবুও সার্বভৌমিক ভগবৎবিধান মতে সর্বসাধারণের পক্ষে প্রত্যেকেরই শ্রীগুরুর আশ্রয় গ্রহণ করে নিজ নিজ সাধনায় এগোনো উচিত ও কর্তব্য।
‘শিষ্য’ উক্তি দ্বারা অর্জুনের শরণাগতি, ‘আচার্য্যে পাসনং’ ‘গুরুপ্রাজ্ঞ পূজনং’ তত্ত্বদর্শী—জ্ঞানীগণকে প্রণাম ও সেবা প্রভৃতির উক্তি দ্বারা গীতাতেও গুরু—শিষ্যভাব নিঃসন্দেহ রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত।
দেবী—মাহাত্ম্যের প্রথম চরিত্রে এই গুরুকরণস্বরূপ কর্মভাবটি সুন্দরভাবে প্রকটিত, তাই বৈরাগ্যযুক্ত সাধকগণ শান্তিলাভের জন্য জ্ঞান—গুরুর শরণাপন্ন হলেন এবং ‘ভগবান’ বলে তাঁকে সম্বোধন করলেন। তারপর জ্ঞান—গুরু ঋষি নিজ শক্তিময় উপদেশ দ্বারা শিষ্যগণের জ্ঞানচক্ষু খুললেন। তাঁদের ক্রমে সত্যে, জ্ঞানে ও আনন্দে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সবশেষে তাঁরা মাতৃদর্শনে কৃতার্থ হলেন এবং তাঁদের সর্ববিধ অভীষ্ট সিদ্ধ হল।
নিজ নিজ আচরিত কর্ম মাত্রকেই ব্রহ্মময় করে উপাসনা করা প্রয়োজন। এই চণ্ডীসাধনার অন্য একটি বিশিষ্ট এবং আবশ্যকীয় পর্যায়।
গীতাতেও ভগবান বলেছেন, ”স্বকর্মণা তমভ্যচ্চ সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ”। অর্থাৎ মানুষ নিজ নিজ আচরিত কর্মদ্বারা ভগবানকে পূজা করে সিদ্ধিলাভ করেন। ভগবান শঙ্করাচার্য বলেছেন, ”যৎ করোমি জগন্মাত স্তদেব তব পূজনম। হে জগজ্জননী, যে কিছু কর্ম করে থাকি, তাহাই তোমার পূজাস্বরূপ।” মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ গেয়েছেন, ”আমি ভোজন করি মনে করি, আহুতি দেই শ্যামা মাকে।” এটাই কর্মসাধনার অতি উজ্জ্বল নিদর্শন।
প্রথম চরিত্রে ব্রহ্মার মাতৃ—জাগরণী স্তব, বিষ্ণুকে প্রবোধিত করবার চেষ্টা, মধু—কৈটভের দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ বা কর্মময় ভাবের আদান—প্রদান, অসুরিক ভাবসমূহ বিলয় দ্বারা সত্য—প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সমস্তই সত্ত্বগুণময় কর্ম সাধনা। এইভাবে কর্মদ্বারা সব জায়গায় সমদর্শন এবং অভেদাত্মক ব্রহ্মভাব বা সত্য—প্রতিষ্ঠা প্রথম চরিত্রের অন্যতম উদ্দেশ্য, এটাই দেবী—মাহাত্ম্যের কর্ম সাধনা।
এরপর মধ্যম চরিত্রে সব জায়গায় প্রাণের ও জ্ঞানের ছড়াছড়ি; দেবগণ নিজ নিজ শক্তিরূপ তেজ নির্গত করছেন ও একসঙ্গে প্রাণময় ও জ্ঞানময় মহাশক্তিরূপে ব্যক্ত হচ্ছেন। চিন্ময়ী মায়ের সর্বব্যাপী এবং সর্বান্তর্যামী রূপটি উদঘাটিত করে এবং অপূর্ব প্রাণময় চরিত্র কথন শুনে, জ্ঞান—গুরু ভক্ত—শিষ্যদের প্রাণে ও জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এজন্যে মধ্যম চরিত্রটি জ্ঞানপ্রধান এবং এটি আত্মোভাবলব্ধির কারণস্বরূপ, এটাই দেবী—মাহাত্ম্যের জ্ঞান সাধনা।
এরপর উত্তম চরিত্রে, প্রথমেই দেবগণের শরণাগতি এবং স্তুতি দ্বারা ভক্তিভাবের বিকাশ, মহাশক্তির অনন্তরূপে বিলাস এবং অসীম আনন্দের অভিব্যক্তি।
এরপর অসুর দলনরূপ অভীষ্ট সিদ্ধিতে দেবগণের পুনরায় প্রেম ও ভক্তিময় স্তুতি। এইভাবে রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য জ্ঞান—গুরুর উপদেশ মতো একাগ্র ও একনিষ্ঠভাবে পরমাত্মময় মাতৃপূজায় আত্মনিয়োগ করলেন।
ভক্তগণের পূজাতে শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে প্রসন্না হয়ে পরমাত্মাময়ী মহামায়া ভগবতী তাঁদের দর্শন দানে কৃতার্থ করে অভীষ্ট পূরণ দ্বারা সংসিদ্ধি প্রদান করেন। ইহাই দেবী—মাহাত্ম্যের ভক্তি সাধনা।
এইরূপে প্রথম চরিত্রে কর্মদ্বারা পূর্ণ মানবত্ব লাভ করে ব্রহ্মভাব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মধ্যম চরিত্রে, জ্ঞান দ্বারা আত্মভাব উপলব্ধি করা হয়।
উত্তম চরিত্রে, ভক্তিদ্বারা আত্মস্বরূপ মহাশক্তিময় ভগবানকে পেয়ে পরমানন্দ লাভ ও চরম কৃতকৃতার্থতা হয়।
চৈতন্য কথামৃতের উক্তি, ”কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি তিন সাধনের বশে, ব্রহ্ম আত্মা ভগবান ত্রিবিধ প্রকাশে।”
প্রথম চরিত্রে বিশুদ্ধ সত্ত্ব গুণের সঙ্গে রজো এবং তমোগুণের সংঘর্ষ বা সংগ্রাম, এটাই আধ্যাত্মিক সাধনার প্রথম স্তর, এর জন্য এটি কর্মপ্রধান।
কর্মদ্বারা অসত্য এবং অজ্ঞানতা অপসারিত হলেই জ্ঞানের বিকাশ হয়। জীবন সংগ্রামে এই দ্বিতীয় স্তরটি হল জ্ঞানপ্রধান এবং এটাই মধ্যম চরিত্রের অভিব্যক্তি।
জ্ঞান উৎপন্ন হলেই ভেদভাব দূর হয়ে যায় এবং স্বরূপপ্রাপ্তির জন্য পরম বৈরাগ্য ও পরাভক্তির উদয় হয়। তখন প্রেমভক্তির উৎকর্ষ ও আত্মভাবে তন্ময়তা হেতু অচিরে ভগবৎপ্রাপ্তি ও স্বরূপত্ব লাভে সাধক কৃতার্থ হন।
জীবন—সংগ্রামের এই তৃতীয় স্তরটি হল ভক্তিপ্রধান। এটাই উত্তম চরিত্রের অভিব্যক্তি।
এইভাবে দেবী—মাহাত্ম্যে, কর্মজ্ঞান সঞ্জাত ভক্তির অপূর্ব বিকাশ ও সমন্বয় সংঘটিত হয়েছে।
দেবী-মাহাত্ম্যে গায়ত্রী রহস্য
গায়ত্রী সাধক প্রাতে অর্থাৎ ভোরবেলায় রজগুণময় ব্রহ্মা এবং বালিকা বা কুমারী রূপে ব্রাহ্মী শক্তির ধ্যান করেন। মধ্যাহ্নে, সত্ত্বগুণময় যুবকরূপী বিষ্ণু এবং তাঁরই শক্তি যুবতীরূপী বৈষ্ণব শক্তির ধ্যান করেন আর সায়াহ্নে তমোগুণময় জ্ঞানবৃক্ষ রুদ্র এবং তাঁরই শক্তি সর্বসাধিকে বৃদ্ধা রুদ্রাণীর ধ্যান করেন।
বেদের ঋক বা মন্ত্রাংশ সৃষ্টির আদিতে বীজ রূপে উদ্ভুত হয় ”সসর্জ বীজং” অর্থাৎ বেদ তখন বীজরূপে সৃষ্টি হয় বা ছড়ানো ছিল। তাই আদিতে ঋক্বেদে কুমারী গায়ত্রী রূপ চণ্ডী—সাধকের প্রাথমিক ধর্মভাব সব ঐক্য ও ভাবপূর্ণ বা সুশৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে না। কারণ তা আদান—প্রদান রূপ বাহুযুদ্ধ এবং প্রত্যাহারের বিশেষ অপেক্ষা করে।
তাই দেবী—মাহাত্ম্যের প্রথম চরিত্র হল ‘ঋক্বেদ’।
এরপর বিশৃঙ্খল বীজগুলি কুড়িয়ে একসঙ্গে করে সজ্জিতভাবে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করো।
বীজ থেকে অঙ্কুর করিয়ে তা পুষ্ট, শ্রীবৃদ্ধি সম্পন্ন ও পূর্ণ বিকশিত করা হয়। এটাই গায়ত্রীর পালনকারী যুবতী মূর্তি। পাদ ও ছন্দ দ্বারা সুগ্রন্থিত মন্ত্র সব বিশেষত্ব পাওয়া যায়।
এই পাদ ও ছন্দময়ী যজুর্বেদরূপী যুবতী মূর্তিই দেবী—মাহাত্ম্যের মধ্যম চরিত্রের দেবতা মহালক্ষ্মী। সমষ্টিগত ভাবে দেবতারা নিজেদের বিভিন্ন ও বিক্ষিপ্ত ব্যক্তিদের একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করে মহাশক্তিরূপে পরিণত করত, যেভাবে মহিষাসুরকে বধ করা সম্ভবপর হয়েছিল। তেমনি সাধক যখন বিক্ষিপ্ত চিত্তবৃত্তি ও সর্বশক্তি একত্রিত করে মহাশক্তিতে পরিণত করতে পারেন, তখন আসুরিক ভাবাবেগ বিনষ্ট করে প্রাণময় ও চৈতন্যময় অবস্থা লাভ করা সুলভ ও সহজ হয়। সাধনার এই স্তর মধ্যম চরিত্রে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই জন্য দেবী—মাহাত্ম্যের মধ্যম চরিত্রের স্বরূপ—যর্জুবেদ।
তারপর পাদ ও ছন্দময়ী সুগ্রন্থিত মন্ত্রগুলি তাল—মান—লয়ের সঙ্গে গীতের দ্বারা প্রকাশিত হল। যেমন সামবেদ ঝঙ্কৃত এবং অলঙ্কৃত, সেইভাবে উত্তম চরিত্রে উল্লিখিত মহাশক্তির সমষ্টি অনন্ত ও অপূর্ব লীলা—বিলাস সমূহ ঐক্যতানযুক্ত এবং সমন্বয়ভাবে পরিপূর্ণ অতি উজ্জ্বল প্রেমানন্দের চিত্তস্বরূপ বিরাজ করে। ব্যষ্টি লীলার ক্ষেত্রে মা স্বয়ং শরণাগত সাধকের চিত্তের কারণ হিসাবে আসুরিক বৃত্তি বা বীজগুলির বিনাশ করেন। আর অবশিষ্ট বৈচিত্র্য ও বৈষম্যযুক্ত ভাবগুলিকে ঐক্যতানযুক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে দেবভাবে পরিবর্তিত করেন—তখন সাধকের হৃদয়ে ও বাইরে প্রেমানন্দের প্রতিষ্ঠা হয়। বিশুদ্ধ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার কিংবা ভক্তের সাথে ভগবানের মিলন সম্ভব হয়। সাধকের অভীষ্ট প্রাপ্ত হলে তিনি ‘স্বয়ংসিদ্ধি’ লাভ করেন। এইসব কারণে সর্ববিলয়কারিণী, প্রেমানন্দদায়িনী, সামবেদরূপিণী মাহেশ্বরী শক্তিই দেবী—মাহাত্ম্যের উত্তম চরিত্রের দেবতা হলেন মহাসরস্বতী। সমন্বয়পূর্ণ অনন্ত লীলা—বিলাস এবং সাধনার নিগূঢ় সামঞ্জস্য পরিপূর্ণ তত্ত্ব দ্বারা উত্তম চরিত্র উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই এর স্বরূপ হল সামবেদ।
প্রথম চরিত্রে—মহাকালী মায়ের বিকাশ হলেও, সেখানে তাঁর সম্যকরূপে কার্য শুরু হয়নি। তাই প্রথম চরিত্রের মহাকালী কুমারীরূপী গায়ত্রী।
মধ্যম চরিত্রে—মহাশক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছে। তাই মধ্যম চরিত্রের মহালক্ষ্মী যুবতীরূপিণী গায়ত্রী।
আর উত্তম চরিত্রে—মহাশক্তির অনন্তভাবে ও রূপে বিকাশ, বিলাস সমন্বয় এবং একত্রে মহসম্মেলন ঘটেছে। তাই উত্তম চরিত্রের মহাসরস্বতী, জ্ঞানময়ী বৃদ্ধা গায়ত্রী রূপিণী।
সাধনশীল জীবনেও তিনটি স্তর বা অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
প্রথমত, সাধনার প্রাক্কালে বা বাল্যকালে কুমারীর মতো বীজ ধারণ করার উপযোগী সামর্থ লাভ অর্থাৎ ধর্মবীজ সংগ্রহ করা বা ব্রহ্মচর্য আশ্রমে সবরকম নিয়ম পালন করে সাধনার মধ্যে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
দ্বিতীয়ত, সাধনার মধ্যাহ্নকালে অর্থাৎ যৌবনে যুবতীর মতো গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করা ও রক্ষা করা। অর্থাৎ সাধকের ধর্মভাবগুলি সম্যকরূপে পুষ্ট ও সম্পদময় করে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান লাভ করা।
তৃতীয়ত, সাধনার সায়াহ্ন কালে বা বৃদ্ধকালে অর্থাৎ সাধনার চরম অবস্থায় বাণপ্রস্থকারীর মতো বৈরাগ্যযুক্ত হয়ে ক্রমেই স্বরূপত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং সবশেষে আত্মস্বরূপে বা ভগবৎভাবে তন্ময় হয়ে সন্ন্যাসীর মতো অমৃতময় ফল আস্বাদন করা।
এইভাবে প্রথম স্তরে কার্যের আরম্ভ হয়, দ্বিতীয় স্তরে সেই কার্যের পূর্ণ পরিণতি ঘটে অর্থাৎ জ্ঞানলাভ হয়। আর তৃতীয় স্তরে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি অর্থাৎ মোক্ষ বা ভগবৎ প্রাপ্তি হয়। এটাই দেবী—মাহাত্ম্যে চণ্ডী সাধনার উজ্জ্বল তিনটি চরিত্র এবং গায়ত্রী সাধনারও তিনটি বৈশিষ্ট্য স্তর বা অবস্থা। সুতরাং দেবী—মাহাত্ম্যের তিনটি চরিত্র বেদমাতা প্রণবরূপিণী গায়ত্রীর অত্যুজ্জ্বল ত্রিধা—মূর্তিরূপে বিকাশ প্রাপ্ত হয়েছে। শাস্ত্রেও আছে ”ঋগভি স্তুবন্তি যজুভি যজন্তি সামভি গাঁয়ন্তি”। অর্থাৎ ঋকবেদ দ্বারা পরমাত্মাকে স্তব করা হয়, যজুর্বেদ দ্বারা তাঁর পূজা করা হয়, আর সামবেদ দ্বারা তাঁর গুণগানে তন্ময়ত্ব বা স্বরূপত্ব লাভ করা হয়।
এইভাবে সর্বার্থসাধিনী, ত্রিলোকতারিণী, সর্বানন্দদায়িনী, প্রণবময়ী, গৌরীরূপিণী মহাদেবী চণ্ডীমাতার অতুল রাতুল অভয় চরণপদ্মে ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে প্রণাম জানিয়ে প্রথম চরিত্রের বক্তব্য সমাপন করা হল।
ওঁ নমস্তুভ্যং মহাদেবি তারে ত্রৈলক্যতারিণী।
তাবয় মাং মহামায়ে বন্দেত্বাং জগদম্বিকে।।
হৃদি সিংহাসনে গৌরী নিবেশ্য চরণাম্বুজে।
অর্পয়ে ভক্তি পুষ্পানি গৃহাণ হরবল্লভে।।
নমস্তে ভুবনেশানি নমস্তে প্রণবাত্মকে।
সর্ব্ববেদান্ত সংসিদ্ধে নমো হ্রীংকার মূর্ত্তয়ে।।
ওঁ নমশ্চাণ্ডকায়ৈ ও শান্তিঃ ওম্।
চণ্ডীপাঠে সার্বজনীন অধিকার
ধীর—ভাবে সুস্পষ্টভাবে এই স্তোত্র পাঠ করলে মহাসম্পদ লাভ করা সম্ভব হয়। তাই এই স্তোত্র প্রথমেই পাঠ করা একান্ত কর্তব্য।
যেহেতু চণ্ডীপাঠে, দেবীর দয়ায় ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য ও আরোগ্য, শত্রুনাশ ও পরম মোক্ষ লাভ হয়, তাই জনসাধারণের চণ্ডীপাঠ করার অধিকার থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
সঙ্কল্প ও বিধি অবলম্বন করে চণ্ডীপাঠ ও চণ্ডীমন্ত্র দ্বারা বলি ও হোম করতে ইচ্ছুক হলে অভিজ্ঞ পুরোহিতের সাহায্যে করাই আবশ্যক। তবে সাধকদের নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য গীতার মতো চণ্ডীপাঠ নিত্যপাঠ্য করা উচিত। তার ফল হবে খুবই মঙ্গলজনক। চণ্ডীর এইভাবে অনেক জায়গায় সার্বজনীনভাবে উক্তি আছে। যেমন—
চতুর্থ অধ্যায়ে দেবতাদের বর প্রার্থনা—”যশ্ব মর্ত্ত্য স্তবৈরেভিস্তাং স্তোয্যতি।” (যে কোনও মর্ত্যবাসী এই সকল স্তবের সাহায্যে তোমার পরিতোষ সম্পাদন করেন।)
দ্বাদশ অদ্যায়ে মা চণ্ডীর উক্তি—”প্রভিঃ স্তবৈশ্চ মাং নিত্যং স্তোষ্যতে বঃ সমাহিতঃ।” (যে ব্যক্তি ভক্তি সহকারে এই সকল স্তব দিয়ে নিত্য আমার আরাধনা করে) : ”জানতাজানতা বাপি … তথাকৃতম” (যথাবিধি পাঠ করতে জানুক বা না জানুক প্রীতি সহকারে পূজা ঠিকমতো করলে আমি তা সবই গ্রহণ করে থাকি।)
”স্মরণ মমৈতচ্চর্চরিতং নরো মুচ্যেত সঙ্কটাৎ” (যে কোনও মানব আমার এই চরিত্র স্মরণ করে সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেয়ে থাকে।) এই সব উক্তির সাহায্যে সকলেই নিজের মঙ্গলের জন্য চণ্ডীপাঠ করার অধিকার প্রাপ্ত হয়েছে।
দেবী-কবচ ব্যাখ্যা বা ”তত্ত্ব সুধা”
কবচ অর্থাৎ বর্মের উদ্দেশ্য হল শত্রুর আক্রমণ ও অস্ত্রের আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করা। আর আধ্যাত্মিক উৎস হল দেহের অন্তরে, বাইরে সবদিকে সর্বত্র মাতৃকা শক্তিকে স্মরণ করা। নিজের মনকে সর্বদা মাতৃময় ও শক্তিময় করে রাখা। মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর শাসন রেখে অর্থাৎ সমাহিত ও একাগ্রচিত্ত হয়ে সত্ত্বগুণে নিজেকে পরিপূর্ণ করা। তারপর সপ্তশতী—মন্ত্র জপ করে শিবত্ব লাভ করা। অঙ্গন্যাস, করন্যাস প্রভৃতির মতো এখানেও কবচ জপের মধ্যে সাধকেরা দেহ ও ইন্দ্রিয়কে সত্ত্বগুণময় করে শক্তি সঞ্চারিত করেন। এভাবে অন্তরে ও বাইরে শক্তিময় ও মাতৃময় হলে, সাধকের মনে আসুরিক ভাবপ্রবণতাগুলি আপনা থেকে দূরীভূত হয়।
”আমি” বা জীবাত্মার আত্মার রক্ষা বাহ্য অঙ্গত্রাণকারী পদার্থ দ্বারা হতে পারে না কেন না, পদার্থ জড়িত থাকাই হল জীবাত্মার বন্ধন। আর পদার্থ চণ্ডীপাঠ করবেই। তাহলে চণ্ডীমন্ত্র জপ করে সিদ্ধিলাভ করা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে।
যতদিন পর্যন্ত পাহাড়, বন, কামনাগুলি যুক্ত পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত চণ্ডীপাঠকেরা বংশ পরম্পরায় পৃথিবীতে অবস্থান করবে।
যে ব্যক্তি চণ্ডীপাঠ করেন তিনি দেহত্যাগের পরে মহামায়ার কৃপায় দেবতাদের সুদুর্লভ নিত্য পরমস্থান প্রাপ্ত হবেন।
সেই ব্যক্তি সেই পরম লোকে গমন করবেন। তাঁকে আর মর্ত্যধামে ফিরে আসতে হবে না। সেখানে তিনি শিবের ন্যায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবেন, অর্থাৎ তিনি শিবতুল্য হবেন।
পদার্থকে যতক্ষণ জড় বলে বোধ থাকবে ততক্ষণই জীবের বন্ধন। আবার যখন পদার্থ মাত্রকেই শক্তিময় বা মাতৃময় বলে জীব উপলব্ধি করবে তখনই মুক্তি বা শিবত্ব লাভ হবে, চণ্ডীসাধকদের এরকম পরমভাব মনে আনাই হল কবচ জপের মূল উদ্দেশ্য।
দেবী—কবচ সম্বন্ধে আলোচনা করাই এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। প্রথমে শৈলপুত্রী (শক্তি বিকাশের শুরু) থেকে সিদ্ধিশক্তি পর্যন্ত, শক্তির ক্রমবিকাশরূপ সঙ্কট—তারিণী সিদ্ধিদায়িনী ‘নবদুর্গা’কে প্রণাম করে তাঁর মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। তারপর ‘চামুণ্ডা’ প্রমুখ মহাশক্তির বিভূতি—রূপ নবশক্তিকে এবং সৃষ্টি স্থিতি লয়কারিণীকে, সরস্বতী, লক্ষ্মী ও বৃষবাহনা ঈশ্বরীকে স্মরণ করা হয়েছে। এই সকল মাতৃশক্তিরা সালঙ্কারা এবং জগতের কল্যাণ সাধনের জন্য অস্ত্রদ্বারা সুশোভিতা হয়ে আছেন। শরণাগত, দেবভাবাপন্ন ভক্তদের অভয় দেবার জন্য এবং তাঁদের কল্যাণের জন্য, দৈত্য বিনাশের জন্য মাতৃশক্তিরা অস্ত্রধারণ করেন; এইরকম মহিমা কীর্তনের পর সত্ত্ব, রজঃ, তম এবং ত্রিগুণ সমষ্টির প্রণাম ও প্রার্থনা—মহার্ঘ্যের পরাক্রমা মহারৌদ্রা (তমোগুণ); মহাবল (রজগুণ); মহোৎসাহ (সত্ত্বগুণ); মহাভয়বিনাশিনী (ত্রিগুণময়ী মহাশক্তি বা অভয়া)—তাঁদের স্মরণ, মনন ও প্রার্থনার দ্বারা উৎসাহ এবং বলসঞ্চয় করার পরে, দেহের চতুর্দিক রক্ষা বা দিকপাল শক্তিবর্গের স্মরণ করা হয়েছে। ক্রমে জ্ঞানাঙ্গ স্বরূপ মাথা থেকে পা ও রোমকূপাদিতে পর্যন্ত শক্তির বিভিন্ন বিকাশ চিন্তায় মাতৃময় পরম ভাব উপলব্ধি করা যায়। দেহের ভিতর পর্যন্ত সমস্ত রক্ত—মাংস প্রভৃতি সাত ধাতু, কফ—পিত্ত, বায়ু, প্রাণ, ইন্দ্রিয় এবং দেহের ত্রিগুণ প্রভৃতিতে মাতৃময় চিন্তাশক্তি সঞ্চার; ক্রমে আয়ু, ধর্ম, কীর্তি প্রভৃতি দেহের ঐশ্বর্য সমস্ত মাতৃময় করার পর, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, গবাদি ও পারিবারিক সম্পদ সবকিছুই শক্তিময় চিন্তা করা হয়েছে।
সবশেষে দুর্গতিহারিণী দুর্গা মাকে সবদিক রক্ষার ভার সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত কবচের অপূর্ব মহিমা কীর্তিনান্তে ফললাভ সমস্ত প্রকাশিত হয়েছে। দেবী—কবচের ফলে সাধক সবদিক থেকে পার্থিব সম্পদ ভোগ করেছেন এবং শিবত্ব লাভ করেছেন। এটাই মন্ত্রশক্তির তাৎপর্য এবং অভিপ্রায়।
অর্গলা—স্তোত্র, কীলক স্তব, দেবী—কবচ প্রভৃতি পাঠ করার প্রধান উদ্দেশ্য হল যে, তত্ত্বময়, শক্তিময় ও মাতৃময় মহিমা পড়ে এবং মাতৃশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবগুণের অধিকারী ও একাগ্রচিত্ত হওয়ার পর, সাধক দেবী মহিমার মন্ত্র সব জপের সাহায্যে মাতৃকৃপায় অভীষ্ট ফল লাভ করে নিজে ধন্য ও কৃতার্থ হবেন।
পরমাত্মার স্বরূপ
মহর্ষি অনভূনের কন্যা বাক্দেবী, যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে সম্যকরূপে আত্মদর্শন করে স্বয়ং সচ্চিদানন্দময় পরমাত্ম স্বরূপা ও মন্ত্র শিখে ঋষি হয়েছেন, তিনিই মহাশক্তি রূপিণী পরমাত্মময়ী ভগতী মহামায়ার সঙ্গে অভেদাত্মক অনুভূতিতে দেবী—মাহাত্ম্যের ব্রহ্মজ্ঞানময় আটটি মন্ত্র ঋক্বেদে প্রকাশ করেছেন। এটিই ”দেবীসূক্ত” নামে প্রচলিত।
এই দেবীসূক্তের প্রতিপাদ বিষয়ে দেবী—মাহাত্ম্যের কথা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
চণ্ডী—সাধকের আসল উদ্দেশ্য অবিশুদ্ধ ‘আমি’ ও ‘আমার’ ভাব দুটি নষ্ট করে এই ‘আমিকে’ সচ্চিদানন্দ রূপে প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বপ্রেমে ‘আমার’ ভাবটিও বিস্তারিত করা।
সমাধি বৈশ্যও মায়ের কাছ থেকে ‘অহংসমেতি’ (আমি—আমার) এই সব জীব—ভাব নাশক ব্রহ্মজ্ঞান প্রার্থনা করেছিলেন।
‘আমি’ ও ‘আমার’ প্রেমভাব অবস্থাই দেবীসূক্তে প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও আত্মার পঞ্চকোষযুক্ত দেহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্থূল ও সূক্ষ্ম কারণ এই দেহ থেকে আত্মাও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং দেহের ত্রিগুণময় সব কাজেও জীবাত্মা বা ‘আমি’ নিঃসঙ্গ ও নির্বিকার, তবুও মহামায়া মায়ের প্রভাবে দেহের সঙ্গে জীবাত্মারূপী ‘আমি’ এমনই ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ যে, স্থূলদেহটি অসুস্থ হয়ে গেলেও, সূক্ষ্ম দেহটি অসুস্থ হয়ে যায়। তখন ‘আমি’র নির্লিপ্ত ও নির্বিকার ভাব বোঝা যায় না। এইভাবে সাধারণ প্রাণী দেহের সমস্ত সুখেই সুখ, ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিই তার আত্মতৃপ্তি এবং আনন্দ পায় বলে অনুভব করে এবং সবকিছুই সত্যি মনে করে দেহটির উৎকর্ষ সাধন ও আনন্দ সম্পাদনেই আত্মনিয়োগ করে।
এইসব দেহময় ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত স্বার্থময় ‘আমার’—’আমার’ ভাবকে নষ্ট করে দিয়ে ‘আমি’কে সচ্চিদানন্দরূপে এবং ‘আমার’ ভাবকে বিশ্বপ্রেমে প্রতিষ্ঠা করাই দেবীসূক্ত বা দেবী—মাহাত্ম্যের উদ্দেশ্য।
অদ্বিতীয়ত্ব ও সচ্চিদানন্দই পরমাত্মার স্বরূপ। পরমাত্মার অংশেই জীব। ত্রিগুণময় প্রকৃতি দ্বারা অভিভূত এবং অবিদ্যার দ্বারা বিড়ম্বিত হয়েছে। কিন্তু তাদের স্বরূপভাব থেকে বঞ্চিত হয় না।
জীবমাত্রই ‘অদ্বিতীয়’। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য আছে। একটা জীবের সাথে আর একটি জীবের দেহের কোনও মিল নেই বা মানসিক মিলও দেখা যায় না। কোনও না কোনওভাবেই মিল থাকবে না। এই বিশ্বলীলার সৃষ্টিতে একটি গাছের পাতার সঙ্গে অন্য গাছের পাতার মিল নেই। এমনকি একটি ধূলাকণার সঙ্গে অন্য ধূলারও মিল নেই। এটাই সৃষ্টির লীলা এবং জীবের অদ্বিতীয়ত্ব। জীব—জগতে সমস্ত কিছুর মধ্যে ভগবানের সত্তা, চৈতন্য ও আনন্দ ভাব সব জায়গায় বিরাজ করছে। তেমনই ভগবানের সৃষ্টিলীলা ও প্রতিটি জীবের মধ্যেই ‘আমি আছি’ খুব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা যায়। এটাই সেই জীবের ‘সৎ ভাব’।
আমি সচেতন বা সব কাজেই সাক্ষী হিসেবে জেগে আছি। এটাই জীবের চিন্ময় ভাব। জেগে থাকা, স্বপ্ন দেখা বা সুষুপ্তি এইসব অবস্থাতেই আত্মা বা আমি চৈতন্যময়। জেগে থাকা অবস্থায় ‘আমির’ চেতনা স্বতঃসিদ্ধ, কারণ স্বপ্ন দেখার পর বলি, আমি এই রকম স্বপ্ন দেখেছি, সুতরাং স্বপ্ন দেখার সময় জেগে না থাকলে, আমার স্মৃতি থাকতো না। এরপর সুষুপ্ত অবস্থার পরও জেগে ওঠে বলি, আজ আমি সুখে ও শান্তিতে ঘুমিয়েছি।
এই সুখ—শান্তি, আরাম ও অজ্ঞানবোধ ওইসব অবস্থার আমি সাক্ষী স্বরূপ। অতএব সব অবস্থাতেই আমি চৈতন্যময়। এটাই ‘আমি’র ‘চিৎভাব’।
আনন্দের জন্যই জীবের এদিক—ওদিক ছুটোছুটি বা সচেতন ভাব। নিজের আমিকে আনন্দ দেবার জন্যই সংসার, লীলা, জীবন—সংগ্রাম ও ধর্মজগতের সাধ্যসাধনা। এটাই ‘আমি’র ‘আনন্দভাব’। সুতরাং পরমাত্মার সচ্চিদানন্দ ভাব ‘আমি’তেই সর্বদা বর্তমান।
এই অদ্বিতীয় সচ্চিদানন্দ ‘আমি’ চলচ্চিচত্র দেখার মতো, অর্থাৎ সাদা পর্দায় যখন আমরা সিনেমা দেখি তখন সেই পর্দাটিতে নানা রকম সুখ—দুঃখ, হাসি—কান্না অভিনয় দেখতে পাই তখন ওই পর্দাটি আলাদা ভাবে দেখতে পাই না। কিন্তু সিনেমা শেষ হলে পর্দাটি আবার তার সত্তা ফিরে পায়।
সেইরূপ মানুষের জীবনে সংগ্রামে ‘আমি’র সঙ্গে ত্রিগুণময় ভাব—সকল জড়িয়ে আছে। এইভাবে ‘আমি’ সুখ—দুঃখের অভিনয়ও করে। এই অভিনয় কালে ‘আমি’ অভিনয় লীলার সাথে জড়িয়ে পড়ে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে ‘আমি’ সাক্ষী স্বরূপ।
ছোটো বয়স থেকে বুড়ো পর্যন্ত দেহের ও মনের মধ্যের পরিবর্তন, এমনকি রোগ, শোক এবং সুখ—দুঃখের ভোগের মধ্যেও ‘আমি’ চিরকাল অপরিবর্তনশীল, নির্বিকার ও দ্রষ্টা।
এই পরম সত্যকে অনুভব করে ‘আমি’কে ত্রিগুণের আবরণ ও ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত করে সচ্চিদানন্দ হয়ে প্রতিষ্ঠা করাই চণ্ডী সাধনার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
দেবী—ভাগবতে দেবগুরু বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, ”আমি চতুর্বিংশতি তত্ত্বের অতীত অতএব আমার সুখই বা কি, দুঃখই বা কি। প্রাণের ধর্ম—খিদে ও তেষ্টা, মনের ধর্ম—সুখ ও দুঃখ, শরীরের ধর্ম—জন্ম ও মৃত্যু। আমি এই ছয় তরঙ্গ থেকে সবসময় মুক্ত অর্থাৎ শিব স্বরূপ।”
এই শুদ্ধ ‘আমি’ই দেবী—মাহাত্ম্য এবং দেবীসূক্তের অহংরূপী পরমাত্মা বা মহামায়া।
গীতা ও চণ্ডীর সমন্বয়
সাবর্ণিঃ সূর্য্যতনয়ো যো মনুঃ কথ্যতে হষ্ট মঃ।
নিশাময় ভদুৎপত্তিং বিস্তরাদ্গদতো মম।।
মার্কণ্ডেয় বলেছিলেন—সূর্য—তনয় সাবর্ণি, যিনি অষ্টম মনু বলে খ্যাত, তাঁর জন্মের বিবরণ আমার কাছ থেকে শোনো; আমি সবিস্তারে তাঁর নাম গান করছি।
তত্ত্ব সুধা : সত্যদর্শী জ্ঞানগুরু বললেন, সূর্যরূপী পরমাত্মার অংশরূপী জীবাত্মা, অর্থাৎ গীতাতে ভগবান বলেছেন, জ্যোতির্মণ্ডলে অমিই রবি বা সূর্য। সংসারে সব জীবই আমারই অংশ।
”আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্জোতিযাং রবিরংশুমান”।
”মমবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ”।
পরমাত্মা—শক্তি সকর্ণা রূপিণী প্রকৃতি;
অর্থাৎ,
”সবর্ণা লোহিতশুক্ল—কৃষ্ণবর্ণসহিতা প্রকৃতিঃ
তস্যা অগত্যবৎ সম্বন্ধি তদ্বাচক ঈকারঃ সাবর্ণিরিভি।”
মার্কণ্ডেয় বললেন, দেহমনের বিকার থাকা সত্ত্বেও কিভাবে অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনার দ্বারা অর্চ্চসিদ্ধি ও পরমাত্মার প্রতি ভক্তি দিয়ে তর্কবিদ্যার সাত্ত্বিকতা পাওয়া যায় ও অষ্টপাশ মুক্ত হয়ে মহামানব হবে, সেই সম্বন্ধে আমার কাছ থেকে শোনো।
সৃষ্টির আগে ব্রহ্মানন্দ পরমাত্মা এক এবং অদ্বিতীয় ছিলেন। তিনি সচ্চিদানন্দময়ী তিনভাবে রয়েছেন। তিনি সর্বশক্তিরূপে আপনাকে আস্বাদন করবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন অর্থাৎ, স্বকীয় অধিষ্ঠানে এবং তিনগুণের প্রকৃতি বা প্রধানের সহায়তায় চর্তুর্বিংশতি তত্ত্বে বিকাশ হয়েছেন। এইভাবে আপনার সাথে এক হয়ে বহুরূপে ব্রহ্মের ঈশ্বরও দর্শন করবেন।
তিনি ক্রমে উদ্ভিজ, স্বেদজ, অন্তজ, ও জরায়ুজ শ্রেণীর জীব সৃষ্টি করলেন। এই জরায়ুজ শ্রেণীর জীব থেকে ভগবৎ বিধান অনুসারে মানুষের সৃষ্টি হয়। মানুষের জন্মেই জীবের বিবেক জেগে ওঠে। তার আগে অবধি জীবের বিবেকের অধিকাংশ হেতু জীবকে কর্মফল ভোগ করতে হতো না। কিন্তু মানুষ বিবেকের সাহায্যে ভাল—মন্দ, পাপ—পুণ্য প্রভৃতির বিচার করতে সক্ষম হয়। এই জন্য মানুষ নিজস্ব কর্মফল অবশ্যই ভোগ করে থাকে।
গীতার উপদেশগুলি মানুষ তাদের কাজের ও জীবনধারাতে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে। আর তখনই সাধকের চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ লাভ বা চণ্ডীলীলার আরম্ভ হয়।
জীবের প্রবৃত্তি ও উদ্দাম গতির নিরোধ বা সংযমী না হলে, গীতার মধুময় উপদেশ ও চণ্ডীর আনন্দময় সাধনা সাধকের জীবনে কার্যকরী হয় না। করুণাময় ভগবানের অপূর্ব নিয়মানুবর্তিতায় জন্ম—জন্মান্তরের কর্মভোগের, তাঁর কৃপার সাহায্যে উদ্ভুত হয়, তখন আত্মচৈতন্যের সৃষ্টি হয়। যখন মানুষ গীতার উপদেশগুলিতে আকৃষ্ট হয়ে প্রতিপালন করবার জন্য চেষ্টা করে তখনই চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ করার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হয়।
গীতার সাহায্যে মানুষের জীবন গঠনের সুদৃঢ় ভিত্তি গঠিত হয়, তেমনই চণ্ডীসহায়ে সুদৃশ মন্দির গঠনে আত্মময় ও মাতৃময় পূজা করে সিদ্ধিলাভ করা যায়।
গীতাতে কুরুক্ষেত্রে জীবনযুদ্ধের সূচনা বা উদ্যোগ; আর চণ্ডীতে সেই যুদ্ধের আরম্ভ ও ক্রিয়াশীলতা, পরিণতি এবং সিদ্ধি।
গীতাতে যোগ, কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির স্বরূপ নামগান, আর চণ্ডীতে তার প্রয়োগ কৌশলাদি আচরণ দ্বারা চতুবর্গ ও সচ্চিদানন্দ লাভ।
গীতাতে যা শিক্ষা বা শোনা, চণ্ডীতে তারই অভ্যাস ও মননের সাহায্যে আনন্দ লাভ করা। গীতাতে আর্ত, জিজ্ঞাসু, অর্তার্থী এবং জ্ঞানী—এই চার রকম ভগবৎ উপাসকের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। কিন্তু চণ্ডীতে তাদের বিস্তারিত ভাবে এবং বিশেষ সুন্দর উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা আছে। আসল কথা, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে উপদিষ্ট বা প্রবর্তিত, তারই বিস্তারিত প্রয়োগ কৌশল, সাধনা ও সিদ্ধি দ্বারা সমস্ত চণ্ডী উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মহামায়ার স্বরূপ
আন্দরূপিণী মহামায়া হলেন মহাশক্তি। যিনি অনন্তরূপে জীব ও জগতে প্রকটিতা হয়ে আছেন। তিনিই এক লীলা দ্বারা অনন্তরূপ ও রসের বিষয়রূপ প্রতিভাত হয়ে আছেন। তিনি এই সংসারে আবদ্ধ জীবদের আনন্দরূপ মধু পান করে সম্মোহিত করে রেখেছেন। আবার তাঁর আরেক লীলায় মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়। বহুত্বের লীলা সাঙ্গ করে অখণ্ড একরস পরমাত্মময় দান করে সৌভাগ্যবান সন্তানদের ধন্য ও কৃতার্থ করেছেন। তাই এই আদ্যাশক্তি মহামায়ার অনুভব বা অনুকম্পা আকর্ষণ করাই সাধনার প্রথম স্তর। তাঁর কৃপায় মায়াজাল সরে গিয়ে সাধকের মনের আকাশ আনন্দময় হয়ে ওঠে। তাই সাধক ভক্তদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ব্রজগোপীরা এই মহামায়া কাত্যায়নীর মায়ের পূজা করে ব্রজলীলায় প্রবেশ করে সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে স্বরূপে লাভ করে পরমানন্দ লাভ করেন।
আত্মসমর্পণ করে সাধক যেভাবে ভগবানের কৃপায় দেবত্ব ঈশ্বরত্ব ও ব্রহ্মত্ব লাভ করে মহামানব হতে পারেন, সেইভাবে মা মহামায়ার ইচ্ছায় বীরভক্ত শক্তি—জ্ঞান লাভ বা মহামায়ার তত্ত্ব উপলব্ধি করে ধন্য ও কালাতীত হতে পারেন। দেবী—মাহাত্ম্যের এই সকল পরমতত্ত্বই সুশৃঙ্খলভাবে সুবিন্যস্ত।
দেবী—মাহাত্ম্যে বর্ণিত মহামায়া হলেন প্রকৃতি—পুরুষাত্মক ব্রহ্ম বা পরমাত্মা। তিনি একাধারে ত্রিগুণের আশ্রয়রূপা, আবার তিনিই ত্রিগুণময়ী মহাশক্তি বা সত্ত্ব, তমো, রজঃ গুণময়ী মূল প্রকৃতি। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় কাজে তিনি সগুণা আবার স্বরূপত তিনি নির্গুণা পরমাত্মস্বরূপা। তিনিই হলেন মহাকারণ স্বরূপা প্রকৃতি। আবার তিনি হলেন প্রকৃতিতে উপস্থিত চৈতন্যস্বরূপ পরম পুরুষ। কারণ শক্তি ও শক্তিমান হলেন অভেদ। তিনি ক্রিয়া—শক্তিরূপে সৃজন করেন, ইচ্ছা—শক্তিরূপে পালন করেন আর জ্ঞান—শক্তিরূপে লয় করেন। তিনি সন্ধিনী—শক্তিরূপে, ‘সৎভাব’ প্রতিষ্ঠা করেন, সম্বিদা—শক্তিরূপে ‘চিৎ’ ভাবের বিকাশ সাধন করেন। তিনি স্বরূপভাবে ভগবানের সঙ্গে একাত্মভাবে অখণ্ড সচ্চিদানন্দ রূপে বিরাজ করেন। আবার জাগতিকভাবে তিনি নিজের সচ্চিদানন্দ স্বরূপকে অনন্তভাবে ও রূপে বিভক্ত করে বিশ্বরূপ ধারণ করে লীলার আনন্দে নিমগ্ন থাকেন। প্রকৃতি—পুরুষাত্মক মহামায়া মা যখন সৃষ্টি কার্যে মনোনিবেশ করলেন তখন মূলা প্রকৃতি থেকে মহৎ, (সত্ত্বগুণের আদি বিকার) তারপর মহত্তত্ব থেকে অহংতত্ত্ব (রজোগুণের আদি বিকার) সৃষ্টি হল। এই সপ্তমূল তত্ত্বই অনন্ত বিশ্ব—ব্রহ্মাণ্ড প্রভৃতি সৃষ্টির সমষ্টি মহাকারণ স্বরূপ। এই সপ্ততত্ত্ব থেকে জীবজগতের সমষ্টি মন, বুদ্ধি, প্রাণ, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি সৃষ্টি হল। তারপর ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চ সূক্ষ্ম মহাভূত মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ—এই পঞ্চস্থূল মহাভূত, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় প্রভৃতি উদ্ভব হল। এইভাবে মা চতুর্বিংশতি তত্ত্বময় অর্থাৎ মূলা প্রকৃতি, মহতত্ত্ব, অহংতত্ত্ব, পঞ্চতন্মাত্র তত্ত্ব মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং পঞ্চমহাভূত বিরাট দেহ নিয়ে ‘সৎ’ মূর্তিতে জীব—জগত আকার প্রাপ্ত হয়েছেন এবং চিৎশক্তি ও আনন্দ শক্তিরূপে বিশ্বের সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট হয়ে চিদানন্দের লীলা করছেন।
সর্বত্র রসময়ী মা যে আনন্দরস ছড়িয়ে দিয়েছেন তা থেকেই বিন্দু বিন্দু রস মদিরা পান করে জীব—জগত আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গেছে। এই চাঞ্চল্যভাব বাইরের বন্ধনরূপে আত্মপ্রকাশ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা মুক্তির পথেরই সন্ধান দেয়। মহাশক্তি মায়ের মহা আকর্ষণে জীবমাত্রই জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে মুক্তির দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। করুণার বন্যায় প্রেমময়ী মা জীব ও জগতকে প্লাবিত করে রেখেছেন। মায়ের অমৃতপুত্রা সদা সর্বদা মায়ের আনন্দ সুধা পান করে চলেছেন। প্রকৃতিরূপিণী মা চারিদিকে তাঁর সন্তানদের জন্য আনন্দের ডালা সাজিয়ে রেখেছেন। সন্তানদের রুচি অনুযায়ী অনন্ত দ্রব্য সম্ভার সমৃদ্ধ করেছেন যাতে সন্তানদের পুষ্টি ও মনের তুষ্টি সম্পাদন করছেন। মায়ের সন্তানরা ততই মায়ের আদরের সন্তান। তাই প্রত্যেক সন্তানকে জ্ঞানময় দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে হবে যে সন্তানের সামনে অনন্ত বেশ ধারণ করে বিশ্বরূপে দাঁড়িয়ে আছেন। বসুন্ধরা রূপে মা সন্তানদের কোলে নিয়ে যত্নে লালন পালন করছেন এবং সন্তানদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করার জন্য শষ্য ভাণ্ডার তৈরি করে রেখেছেন। সন্তানদের আত্ম—স্বরূপে জাগাবার জন্য মা সবরকম সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সচকিত দৃষ্টিতে করুণাময়ী মা সন্তানদের দিকে চেয়ে আছেন। তিনি কাতরভাবে তাঁর সন্তানদের স্নেহময়ী আলিঙ্গন জানাচ্ছেন। কিন্তু বধির সন্তানরা মায়ের স্নেহময় বাণী শুনতে পায় না। সন্তানদের জড়তা জড়ানো ত্বক মায়ের স্পর্শ অনুভব করতে পারে না। সন্তানদের অন্ধ নয়ন মাতৃরূপ ঠিকমতো করে দর্শন করতে পারে না। বিষয়সম্পত্তির আনন্দে বিভোর হয়ে থেকে সন্তানরা অনন্ত রসময়ী মায়ের আনন্দ লাভ করতে পারে না। ভাবময় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যাবে—শব্দরূপে মা, স্পর্শরূপেও মা, রূপের আকারে মা, রসের মধ্যেও মা, গন্ধরূপেও মা। দেহের ইন্দ্রিয় ও বৃত্তিগুলির মধ্যে মা, দেহ—রূপেও মা। এইভাবে মনের ভ্রান্তিকে দূর করে বিশ্বময়, আত্মময় ও ব্রহ্মময় পরা—মাতৃ পূজা করতে সকলকে অভ্যস্ত হতে হবে। শিশুর মতো আত্মহারা হয়ে ‘মা’ ‘মা’ বলে কাঁদতে হবে। বিশ্বরূপিণী বিশ্বেশ্বরী মাকে বিশ্বের সব স্থানে দর্শন ও অনুভব করতে হবে। এইভাবে মায়ের কৃপায় আত্মানন্দ লাভ করে ব্রহ্মময়ী মায়ের চিরশান্তিময় কোলে থেকে আনন্দ লাভ করতে হবে। চিরকল্যাণময়ী আশীর্বাদ সর্বদাই বর্ষিত হবে।
দশমহাবিদ্যারূপের স্তব
মহাবিদ্যারূপিণী মা! তুমি কালশক্তিরূপে ভক্তের কালজনিত ভেদ এবং অসত্য ভাবসকল নষ্ট করে তাঁকে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করো। এই জন্য তোমার সত্যস্বরূপিণী মৃন্ময়ী কালীমূর্তিটি ভক্তের কাছে ‘সৌম্যা’।
সত্য প্রতিষ্ঠার পরে, তুমি ভক্তকে সর্বভাবে প্রাণময় ও চৈতন্যময় করে নিজ চিন্ময়ী ও ব্রহ্মময়ী তারারূপটি তাঁর কাছে প্রকাশ করো তোমার সৌম্যভরা রূপে।
এরপর ভক্তকে সর্বপ্রকারে অখণ্ড আনন্দরস পান করিয়ে ধন্য ও কৃতার্থ করো—এটাই তোমার সৌম্যতমা অতিসুন্দরী আহ্লাদিনী ষোড়শী মূর্তি।
হে আনন্দময়ী ষোড়শীরূপী মা!
আব্রহ্ম কীটাণু পর্যন্ত সকলেই আনন্দের জন্য সব সময়েই লালায়িত, তুমিই সেই আনন্দের ঘনীভুতা মূর্তি।
শিবাদি পঞ্চদেবতারা তোমাকে মাথার উপর রেখে তোমারই চিন্তায় ধ্যানমগ্ন, তাই তুমি ”রাজরাজেশ্বরী” ও ”ত্রিপুরসুন্দরী” নামে অভিহিত ও পূজিতা হও। তুমি এই জগতে কালী, তারা ও ষোড়শী রূপে প্রকট, তাই ভক্তগণকে কৃতার্থ করো।
হে জগদম্বে, তুমিই তেজতত্ত্ব থেকে উদ্ভুত দেবগণ দ্বারা আরাধিতা পরা শক্তিরূপিণী মহাতেজস্বিনী ভৈরবী রূপা। ত্রিগুণময় জীব, প্রকৃতিরূপিণী মাতৃদেহরূপ জগত—দেহ থেকে আহার্য ও বিষয়াদি গ্রহণ করতে দেহের ও মনের পুষ্টি সাধন করে থাকো অর্থাৎ একটি জীব অপর জীবকে ভক্ষণ করে পুষ্ট হয়—এটাই তোমার জগতপালিনী ভীষণা অপরা শক্তিরূপা ছিন্নমস্তা। ভোক্তা, ভোগ্য ও ভোগরূপ ত্রিগুণময় তিনটি পালনের দ্বারা আত্মশক্তিদ্বয় সহ তুমিই স্বয়ং পান করছো।
হে মাতঃ, তুমি মোক্ষ প্রতিকূল অসুরতুল্য ভাবসকল আত্মশক্তি বলে বিলয় করে ভক্তকে মোক্ষ প্রদান করে থাকো, এটাই তোমার পরমা বগলা মূর্তি! হে মহাদেবী এইভাবে একদিকে তুমি ভীষণাদর্পী ভীষণ, আবার অন্যদিকে প্রেমফুল্লাননা, ত্রিভুবনের শান্তিদায়িনী, বিশ্বজননী, তোমার এই পরমেশ্বরী মূর্তি হল ভুবনেশ্বরী।
যে সর্বরূপে তুমিই অখিলের আত্মস্বরূপিণী, চৈতন্যময় আত্মারূপে তুমিই বিশ্বের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। সুতরাং তোমার চৈতন্যময়ী জ্ঞান স্বরূপিণী মাতঙ্গীরূপেই বিশ্বের আত্মরূপা বা অখিলাত্মিকা।
হে মাতঃ, সৎ—স্বরূপ জগৎ মূর্তিতে তোমার অনন্ত ঐশ্বর্যের বিকাশ, তুমি অনন্তভাবে অফুরন্ত সম্পদ বিশ্বের সর্বত্র বিতরণ করে দিয়েছো; তোমার সেই জগন্মোহিনী ঐশ্বর্যময়ী সৎমূর্তিই ষড়ৈশ্বর্যশালিনী কমলা। হে মাতঃ, তুমিই আবার প্রলয়কারিণী ভীষণ—সংহারিণী মূর্তিতে অসৎরূপে প্রকট হয়ে সৎকে তোমার বিশ্বগ্রাসিনী তামসী তনুতে নষ্ট করে দাও; এই অসৎরূপা তামসী প্রলয়রূপী মূর্তিই ধূমাবতী।
হে মহাশক্তি রূপিণী; এইভাবে দশমহাবিদ্যারূপে, মহাশক্তিই ভগবান বিষ্ণুর দশাবতার যেমন, কৃষ্ণই—কালী, তারা—রাম, ষোড়শী—জামদগ্ন্য, ভুবনেশ্বরী— বামন, ভৈরবী—বরাহ, ছিন্নমস্তা—নরসিংহ, ধূমাবতী—মীন, বগলা—কুর্ম, মাতঙ্গী—বুদ্ধ, কমলা—কল্কী। এসবেই স্বয়ং ভগবতীই ভগবান।
সর্বত্র সব বস্তুতে এবং সকল প্রকার ভাবের মধ্যে জীবজগতের অন্তরে বাহিরে তুমিই আত্মপ্রকাশ করেছো দাক্ষায়ণি মা, তোমার এই বিশ্বমোহিনী দশবিধামূর্তি। একমাত্র তোমারই অদ্বিতীয়া মহাশক্তিময়ী মাতৃরূপের বিভিন্ন বিকাশ মাত্র; তোমাকে আর কি স্তব করব? তুমি যে অবাঙমানসগোচরা স্তবাতীত।
”যয়া ত্বয়া জগৎ স্রষ্টা জগৎ পাতাত্তি যো জগৎ।
সোহপি নিদ্রাবশং নীতঃ কস্ত্বাং স্তোতুমিহেশ্বরঃ।।
বিষ্ণু শরীরগ্রহণ মহ্মীশান এব চ।
কারিতা স্তে যতোহ তস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান ভবেৎ।।
অর্থাৎ—যিনি জগৎস্রষ্টা, জগৎ পালক ও জগন্নাশক, তিনি যখন তোমা দ্বারা নিদ্রাভিভূত তখন কে তোমার স্তব করতে সমর্থ হবে? আমি বিষ্ণু ও মহাদেব যখন তোমা হইতে জন্মগ্রহণ করেছি। অতএব কোনও ব্যক্তি তোমার স্তব করতে সমর্থ হবে কি?
হে মাতঃ! তুমি যখন সৃষ্টি—স্থিতি—লয়ের কর্তা নারায়ণকেও যোগনিদ্রাতে বশ করেছ, এবম্বিধ মহাশক্তিসম্পন্ন তোমাকে কেউই স্তব করতে সমর্থ হবে না। বিশেষত ক্ষুদ্র বা অংশ—শক্তি দ্বারা মহাশক্তি সম্যকরূপে প্রভাব বর্ণনা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। মা! জগতপালক বিষ্ণু, জগতস্রষ্টা আমি ব্রহ্মা এবং জগত সংহারক ঈশানকেও যিনি শরীর ধারণ করিয়েছেন, সেই সর্বজননী ইচ্ছাময়ী তোমাকে স্তব করতে কে সমর্থ হবে। তোমার শক্তি ও প্রভাব অনির্বচনীয়া!
মা তুমি দেহের প্রাণ চৈতন্যরূপী নারায়ণকে মূলাধার পদ্মে ঘুমিয়ে রেখে ব্রহ্মানন্দ ভোগ করাচ্ছো; স্থিতি, সৃষ্টি, লয়ের ক্ষমতাসম্পন্ন স্নেহের আত্মনারায়ণকেও তুমি যোগনিদ্রা প্রভাবে তাঁর স্বাভাবিক সত্ত্বগুণের বহির্মুখী বিকাশ রুদ্ধ রেখেছ! তোমার এই অপ্রতিহত শক্তি এবং অনতিক্রমনীয় প্রভাব কেউই বর্ণনা করতে পারবে না
হে বিশ্বজননী! তুমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরেরও জনয়িত্রী, সর্বকারণে কারণরূপা।
প্রাণময়ী মা, দেহের সত্ত্বগুণময় প্রাণই জীবের জীবন রক্ষার একমাত্র হেতু দেহের পালনকারী এবং সুখ—দুঃখের অনুভূতিময় প্রাণরূপী বিষ্ণু, তোমারই ইচ্ছাশক্তি বলে সর্বদা পরিচালিত হয়ে থাকে।
হে জগন্মাতা! তোমারই ক্রিয়াশক্তি দ্বারা প্রভাবিত জীবদেহের রজোগুণাত্মক মনোময় ব্রহ্মা অনন্ত কল্পনার মধ্যে দিয়ে সংসার রচনা কাজে ব্যস্ত থাকেন। আবার যখন তোমার কৃপায় বহির্মুখী চাঞ্চল্য নষ্ট হয়, তখন এই মনই একাগ্র ও বিশুদ্ধ হয়ে আত্মাভিমুখী এক লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। মা! তোমার প্রতি বিমুখ হলে, সাধকের মনোময় ধর্মভাব সৃষ্টিকারী ব্রহ্মাকেও মধু—কৈটভ স্বরূপ আসুরিক বৃত্তির অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আবার তোমার পাদপদ্মে মনটি সংযুক্ত হলে, সর্বপ্রকার আসুরিক ভার লয় হয়। এইরূপ ভক্তের চিত্তক্ষেত্র শুদ্ধ করে তুমি প্রেমানন্দ উৎসাহিত করো।
হে জ্ঞানময়ী মা! নিত্যানিত্য বস্তুর পার্থক্যকারী, অজ্ঞানতা লয়কারী তোমারই তমোগুণাত্মক জ্ঞানশক্তি বা বিবেকরূপী মহেশ্বর, চৈতন্যরূপী জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থেকে, তাকে সতত মঙ্গলের দিকে আকর্ষণ করে সৎভাবে প্রেরণা দিচ্ছে। হে জগদম্বে! দেহ—ব্রহ্মাণ্ডের এই ত্রিগুণময় ব্রহ্মাদি দেবতাময় তোমার গুণসাম্য ব্যষ্টি মূলাপ্রকৃতি হতে উদ্ভুত, এইজন্য তুমিই সকলের জননীরূপা।
মহাশক্তি মা। তুমিই কার্যরূপা, আবার তুমিই কারণরূপা, অতএব কে বা কার স্তব করবে?
চণ্ডীতে শাক্ত—বৈষ্ণব মিলন
সব সাধনায় মিলনক্ষেত্র রূপ চণ্ডীতে শাক্ত ও বৈষ্ণবগণের অপূর্ব মিলন হয়েছে। যেমন, দেবী—মাহাত্ম্যের প্রথম চরিত্রে ঐশ্বর্যপূর্ণ মহাশক্তিময় বিষ্ণুর মধু—কৈটভ বধ লীলার বর্ণনা, মধ্য চরিত্র—ব্রহ্মা, বিষ্ণু রুদ্র প্রভৃতি সমস্ত দেবগণ নিজ নিজ শক্তি সব এক হয়ে মহাশক্তিরূপে পরিণত হন। তারপর সেই মহাশক্তির সঙ্গে মহিষাসুরের যুদ্ধ হয়। আর উত্তম চরিত্রে—মহাশক্তির দেহ হতে কারণরূপা চণ্ডিকা দেবীর আবির্ভাব। তারপর বিভিন্ন শক্তির আবির্ভাব ও যুদ্ধ দেখিয়ে পরিশেষে সমস্ত বিভূতি বা শক্তিকারণরূপী মা চণ্ডিকার দেহে লয় হয়ে শুম্ভ—বধ হয়েছে। অতএব শক্তি ও শক্তিমানের অপূর্ব সংমিশ্রণ বিভিন্ন সমন্বয় পূর্ণ লীলা একমাত্র চণ্ডী—গ্রন্থেই অতি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শক্তি ও শক্তিমান যে অভেদ এটা সব বেদে সর্বশাস্ত্র সম্মত।
দেবী ভাগবতে মা ব্রহ্মাকে উপদেশ দিয়েছেন, ”হে ব্রাহ্মণ! সেই পুরুষের এবং আমার সর্বদাই একত্বভাব, আমাদের মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই, যেই পুরুষ, সেই আমি এবং সেই আমি সেই পুরুষ। তবে যে শক্তি ও শক্তিমানের ভেদ বুদ্ধি হয়, একমাত্র মতিভ্রমকেই তার কারণ বলে জানবে”।
এইরকম ভ্রান্তি নাশ করে সর্বত্র মহাশক্তিময় ভগবানের স্বরূপ ভাব উপলব্ধি করে, সচ্চিদানন্দময় আত্ম—রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই চণ্ডী সাধনার অন্যতম উদ্দেশ্য।
ভগবান বললেন, যদি তোমরা তুষ্ট হয়ে থাকো, তবে উভয়েই আমার বধ্য হও। যুদ্ধে অন্য বরের আর প্রয়োজন কী? এটাই আমার অভিলাষিত বর।
তত্ত্ব সুধা : মধু—কৈটভ বধ হওয়ার বর যাচ্ঞা করলে—এটাই তাদের পক্ষে মহামায়া বিমোহিত অবস্থা হলেও তা বরণীয় বটে, কেন না তারা ধর্মরূপী ব্রহ্মাকে পর্যন্ত খেতে উদ্যত হয়েছিল। অতএব জগতের ও সাধকের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠাকল্পে ওই প্রকার অসুরিক ভাবসমূহ বিলয় কিম্বা বিনাশ একান্ত প্রয়োজনীয় এবং তা সকলের পক্ষেই মঙ্গলজনক। পক্ষান্তরে ভগবৎ সাক্ষাৎকার অভিলাষী কিংবা আত্মানন্দ লাভের ইচ্ছার সাধকগণ, ধর্মভাবে বিরোধী সব বিলয় করার ইচ্ছা ও প্রার্থনা করে থাকেন যে, এটাই তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় ও শ্রেয়স্কর; কেন না, মাতৃ কৃপায় যখন সাধকের আত্মনারায়ণ জেগে ওঠেন, তখন তাঁর স্বভাবতই ইচ্ছা হয় যে অসত্য ধ্বংস হোক। মমত্বের স্বার্থময় ভাব চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে, সত্য ও প্রেমের ভাব প্রতিষ্ঠিত হোক।
সুতরাং বুদ্ধির ক্ষেত্রে অবস্থিত সর্বগুণময় সাধকের পক্ষে অসত্যের প্রতীক বিশুদ্ধ অহংকার, দম্ভ এবং হিংসাত্মক মমতা বিনাশের জন্য তীব্র ইচ্ছা বা চেষ্টা অতি প্রয়োজনীয় ও লোভনীয়।
রাসলীলাতে দর্পহারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরমভক্ত গোপীগণেরও প্রেম—গর্ব নষ্ট করে অহংকারের সমাধি দিয়েছিলেন এবং এর উপরে প্রতিষ্ঠিত ত্রিগুণময় ত্রিধাপযুক্ত দোল মঞ্চের উপরে অর্থাৎ ত্রিগুণের অতীব অবস্থায়; প্রেমদোলাতে আত্মারাম ভগবান প্রেমানন্দে অধিষ্ঠিত হয়ে জ্ঞানে, প্রেমে ও আনন্দে সতত দোলায়িত। সুতরাং অহংভাব অবিশুদ্ধভাব নষ্ট করে—’আমি’কে সত্যময়, জ্ঞানময়, আনন্দময় এবং প্রেমময় রূপে পরিণত করা রাগ—মার্গের সাধনার প্রয়োজন। আর এটাই চণ্ডীসাধনার প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন