রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

লীলা মজুমদার

রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বুড়ো মাঝি বললো, বাবু, বেড়াতে এসেছেন, বেড়িয়ে ফিরে যান। ঐ দ্বীপে যাবেন না। ওখানে দোষ লেগেছে।

আমরা একটু অবাক হলুম। দোষ লেগেছে মানে কী? দ্বীপের আবার দোষ লাগে কী করে?

বিমান বললো, বুড়ো কর্তা, তুমি যা টাকা চেয়েছো, তাই দিতে আমরা রাজি হয়েছি। তবু তুমি আমাদের নিয়ে যাচ্ছো না কেন? ঐ দ্বীপে কি আছে?

বুড়ো মাঝি তার সাদা দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বললো, কিছুই নেই। সেই কথাই তো বলছি। শুধু শুধু ওখানে গিয়ে কী করবেন?

বুড়ো মাঝি হাল ধরেছে, আর দাঁড় বাইছে নাতি। এই নাতির বয়স তো চোদ্দ বছর হবে, ওর নাম সুলেমান। সে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

বুড়ো মাঝি যতই না বলছে, ততই আমাদের জেদ চেপে যাচ্ছে। একটা সাধারণ দ্বীপ, সেখানে কি এমন ভয়ের ব্যাপার থাকতে পারে? কত জাহাজ যাচ্ছে এখান দিয়ে, সে রকম কিছু থাকলে সবাই জানতে পারত।

হলদিয়াতে বিমানের দাদা চাকরি করে। আমি আর বিমান কয়েক দিনের জন্য এসেছি এখানে বেড়াতে। হলদিয়া জায়গাটা বেশ সুন্দর। নতুন বন্দর নতুন শহর গড়ে উঠেছে। চারদিকে সবই নতুন নতুন বাড়ি আর অনেক ফাঁকা জায়গা। শহরটার একদিকে গঙ্গা আর একদিকে হলদি নদী।

সকালবেলা নদীর ধারে জেলেরা মাছ বিক্রি করতে আসে। আমরা সেই মাছ কিনতে গিয়েছিলুম। ঘাটে অনেকগুলো নৌকো বাঁধা। নৌকো দেখেই আমাদের মনে হলো, একটা নৌকো ভাড়া করে নদীতে বেড়িয়ে এলে কেমন হয়। একজন মাঝিকে জিজ্ঞেস করতেই সে রাজি হয়ে গেল। তিরিশ টাকা দিলে সে যতক্ষণ ইচ্ছে আমাদের ঘুরিয়ে আনবে।

আমি আর বিমান দু’জনেই সাঁতার জানি, সুতরাং আমাদের জলের ভয় নেই। বিমান তো সুইমিং কমপিটিশনে অনেকবার প্রাইজ পেয়েছে।

আমি আগেই শুনেছিলাম যে হলদিয়ার কাছে একটা দ্বীপ আছে, তার নাম আগুনমারির চর। আগে সেই চরটা মাঝে মাঝে জেগে উঠতো। এখন আর ডোবে

না। এখন সেখানে গাছপালা জন্মে গেছে। কোনো মানুষজন অবশ্য সেখানে এখনো থাকে না।

নৌকো দেখেই আমার ঐ দ্বীপটার কথা মনে এসেছিল। নতুন দ্বীপ মানেই তো নতুন দেশ। ওখান থেকে ঘুরে এলেই একটা নতুন দেশ দেখা হয়ে যাবে। অনেকদিন বাদে, যখন ঐ দ্বীপেও অনেক ঘরবাড়ি হয়ে যাবে, কলকারখানা বসবে, তখন আমরা বলবো, জানো, যখন আমরা আগুনমারিতে গিয়েছিলুম তখন এসব কিছুই ছিল না, শুধু গাছপালা আর …।

গাছপালা ছাড়া আর কী আছে সেই দ্বীপে? বুড়ো মাঝি ভয় পাচ্ছে কেন?

নৌকোয় চড়বার সময় মাঝিদের কক্ষনো চটাতে নেই। সেই জন্য আমি অনুনয় করে বললুম, ও বুড়ো কর্তা, বলো না সেখানে কী আছে? কেন আমাদের যেতে বারণ করছো?

বুড়ো মাঝি বললো, কিছু নেই তো বলছি গো বাবু, শুধু কয়েকটা গাছ আর বালি। আর ঐ শামুক ঝিনুক ভাঙা

বিমান বললো, তাহলে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে চাইছো না কেন? সেখানে কি ভয়ের কিছু আছে?

বুড়ো মাঝি বললো, আকাশে মেঘ দ্যাখো না বাবু, এখন আর অতদূরে যাওয়া ঠিক নয়। এই কিনারায় কিনারায় থাকা ভালো।

বিমান বললো, তুমি কি আমাদের ছেলেমানুষ পেয়েছো? সামান্য মেঘ, এতে কখনো ঝড় ওঠে? তুমি আমাদের নিয়ে যেতে চাওনা তাই বলো!

আমি বুড়ো মাঝির নাতিকে জিজ্ঞেস করলুম, সুলেমান তুমি গেছো সেই দ্বীপে? সেখানে ভয়ের কিছু আছে?

সুলেমান দাদুর দিকে তাকালো একবার। তারপর বললো, ভয়ের কিছু নেইকো। অন্য কিছু দেখা যায় না। তবে সেখানে গেলি মনটা কেমন কেমন করে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।

এ তো আরও অদ্ভুত কথা, একটা দ্বীপে গেলে মন খারাপ হয়ে যাবে? আমি আর বিমান দুজনেই হেসে উঠলুম। তা হলে তো যেতেই হবে সেখানে।

বুড়ো মাঝিকে বললাম, তুমি যদি না যেতে চাও তো আমাদের ফেরত নিয়ে চলো। আমরা অন্য নৌকো ভাড়া করবো।

বুড়ো মাঝি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি সে টাকা ফেরত দেওয়া পাপ। তবে চলেন নিয়ে যাই। পরে যেন আমাকে দোষ দেবেন না। ওরে সুলেমান ভালো করে টান।

আকাশে মেঘ আছে বটে কিন্তু জমাট কালো নয়। সেই মেঘের ছায়া পড়েছে জলে। রোদ নেই, বেশ ছায়া ছিল। নদীতে বড় বড় ঢেউ। এখানে নদী প্রায় সমুদ্রের মতন। এপার ওপার দেখাই যায় না। পাশ দিয়ে জাহাজ কিংবা স্টিমার গেলে আমাদের নৌকোটা দুলে দুলে উঠছে।

খানিকক্ষণ পরে বুড়ো মাঝি ডান দিকে হাত তুলে বললো, ঐ যে দেখেন, আগুনমারির চর। দেখলেন তো?

আমি আর বিমান দু’জনেই ঘাড় ফেরালুম। মনে হলো নদীর বুকেই যেন কয়েকটা গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মাটি দেখা যাচ্ছে না।

বুড়ো মাঝি বললে, দেখা হলো তো? এবারে নৌকো ঘোরাই?

আমি আর বিমান একসঙ্গে বলে উঠলুম, সে কি আমরা কাছে যাবো না!

–কাছে গিয়ে আর কি করবেন? আর তো দেখার কিছু নাই।

বিমান এবারে বেশ রেগে গিয়ে বললো, তোমার মতলব কি বলো তো, বুড়ো কর্তা? ঐ দ্বীপে কি তোমার কোনো জিনিষপত্তর আছে? ওখানে আমাদের যেতে দিতে চাও না কেন?

বুড়ো মাঝি আমতা আমতা করে বললো, দেখা তো হলোই, আরও কাছে গিয়ে লাভটা কী।

বিমান বললো, লাভ-লোকসানের কথা নয়। আমরা ঐ দ্বীপে নেমে হাঁটতে চাই।

বুড়ো মাঝি এবারে খুব জোরে হাল ঘোরাতেই নৌকোটা তরতরিয়ে এগিয়ে গেল। দ্বীপটার একেবারে কাছে পৌঁছে নৌকোটার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বুড়ো বললো, এবারে নামুন।

সেখানটায় অন্তত এক হাঁটু জল। তারপর কাদামাটি। বিমান বললো, আর একটু এগোও, এখানে নামবো কি করে?

বুড়ো মাঝি এবার রাগে গড়গড়িয়ে বললো, আপনাদের বাবু এখানেই নামতে হবে। আমার নৌকো ঐ চরের মাটি ছোঁবে না। ও মাটি অপয়া।

বিমান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি বললুম ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরা এখানেই নামবো।

জুতো খুলে রাখলুম নৌকোয়। তারপর হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লুম জলে। ছপ ছপ করে এগিয়ে গেলুম দ্বীপটার দিকে। বুড়ো মাঝি নৌকোটাকে আরো গভীর জলের দিকে নিয়ে গিয়ে ঝপাং করে নোঙর ফেলে দিল।

দ্বীপটাতে ছাড়া ছাড়া গাছপালা রয়েছে। তারপর ধূ ধূ করছে বালি। সেই বালিতে কোথাও কোথাও ঘাস হয়েছে। একটা খড়ের চালাঘরও রয়েছে একপাশে। সেই ঘরে কিন্তু কোনো মানুষ নেই।

কাদা মাখা পায়ে ওপরে উঠে আমরা বালিতে পা ঘসে নিলুম। বিমান বললো, একটা কিছু ফ্ল্যাগ নিয়ে এলে হতো। তাহলে সেই ফ্ল্যাগটা পুঁতে আমরা এই দ্বীপটা দখল করে নিতুম।

আমি বললুম, তা কী করে হবে। আগেই তো এখানে মানুষ এসেছে। দেখছিস না, ঘর রয়েছে।

আমরা ঘরটার কাছে গিয়ে দেখলুম, তার মধ্যে পাতা আছে একটা খাটিয়া। আর চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে শুকনো গোবর। জায়গাটায় বিচ্ছিরি গন্ধ।

বিমান বললো, এখানে লোকেরা গরু চরাতে আসতো। কিন্তু গরুগুলোকে নিয়ে আসতো কি করে?

আমি বললুম, বড় বড় নৌকোয় করে নিয়ে আসতো। আমি নৌকোয় গরু মোষ পার করতে দেখেছি।

তারা এখন আর আসে না কেন?

— বর্ষাকাল এসে গেছে, সেইজন্য এখন আসে না। এতো সোজা কথা।

— দ্বীপটা কী রকম চুপচাপ লক্ষ্য করছিস? কোনো শব্দ নেই।

মানুষজন নেই, শব্দ হবে কি করে? তবু আমি কিন্তু একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কান পেতে শোন।

দু জমেই চুপ করে দাঁড়ালুম। সত্যি খানিকটা দূরে গাছপালার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলছে খুব জোরে। কোনো মানুষ অবশ্য অত জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। বিমানের মুখটা শুকিয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বললো, ওটা কিসের শব্দ বলতো সুনীল? সাপ নাকি?

আমি বললুম, সাপ অত জোরে ফোঁস ফোঁস করে?

সমুদ্রে বড় বড় অজগর সাপ থাকে শুনেছি। সমুদ্র থেকে যদি এখানে চলে আসে, ঐ জন্যই বোধহয় মাঝিরা এখানে আসতে ভয় পায়।

একটা অজগর সাপ থাকলে সেটাকে মেরে ফেলতে পারতো না? চল, এগিয়ে গিয়ে দেখি।

সঙ্গে লাঠি ফাঠি কিছু একটা আনলে হতো।

ভয় পাচ্ছিস কেন, বড় সাপ তো আর তাড়া করে এসে কামড়াতে পারে না।

ডান দিকে খানিকটা দূরে দু’তিনটে বড় বড় গাছের পাশে কিছুটা ঝোপ ঝাড়ের মতন। শব্দটা আসছে সেদিক থেকেই।

আমরা গুটি গুটি পায়ে এগোলুম সেদিকে। শব্দ মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে। কাছাকাছি গিয়ে আমিই ভয় পেয়ে বিমানের হাত চেপে ধরলাম। ঝোপের মধ্যে কী যেন বিশাল একটা জন্তু রয়েছে।

বিমান বললো, ওটা তো একটা মোষ। কাত হয়ে শুয়ে আছে।

এবারে আর একটু এগিয়ে আমরা মোষটার মাথাটা দেখতে পেলাম। দেখলেই বোঝা যায়, মোষটা মরে যাচ্ছে। মোষটার দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। ওরকম করুণ চোখ আমি কখনো দেখিনি। মোটা মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন তার পেটটা ফুলে উঠছে। ঐটুকুতেই বোঝা যায় যে ও বেঁচে আছে।

আমি বললুম, এতো বড় একটা মোষ … কী হয়েছে ওর? সাপে কামড়েছে? বিমান বললো, অসুস্থ হতে পারে। মোষেরাও তো অসুস্থ হয়।

–কিন্তু কোন লোকজন নেই? একলা একলা একটা মোষ এখানে পড়ে আছে?

–মোষের মালিক বুঝতে পেরেছে, ও আর বাঁচবে না। সেইজন্য একে ফেলে রেখে চলে গেছে।

আমরা আর ঝোপটার মধ্যে না ঢুকে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। যতবার মোষটার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি, ততবার মন খারাপ লাগছে।

বিমান বললো, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, এখানে গাছের পাতাগুলো কেমন যেন শুকনো শুকনো। এখন বর্ষাকালে তো গাছের পাতা শুকিয়ে যায় না।

আমি বললুম, গাছগুলোর ছাল খসে পড়েছে অনেক জায়গায়। এখানে তো জল নোনা, তাই বোধহয় গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে না।

বিমান বললো, বাজে কথা বলিস না। সুন্দরবনে অত গাছ রয়েছে না? সেখানকার জল তো আরও বেশি নোনা। এখানকার গাছগুলোর বোধহয় কিছু একটা রোগ হয়েছে। ওটা কী রে?

ওটা তো একটা পাথর।

— আশ্চর্য তো। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার!

–কিসের আশ্চর্য?

— তুই বুঝলি না? গঙ্গানদীর দ্বীপে পাথর আসবে কি করে?

–কেন?

–এখানে কি কোথাও পাথর আছে? এদিকে কি কোথাও পাহাড় আছে? এখানে এত বড় একটা পাথর কে নিয়ে আসবে?

পাথরটা এমনিতে খুবই সাধারণ। একটা মাঝারি ধরণের আলমারির সাইজের। যে-কোন পাহাড়ী জায়গায় গেলে এরকম পাথরের চাই পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু নদীর ওপরে একটা নতুন দ্বীপে ওরকম পাথর তো দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক নয়।

আমরা পাথরটার কাছে গেলুম। সেটার গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে। আমি পাথরটার গায়ে হাত দিয়ে বললুম, সমুদ্রের তলায় অনেক জায়গায় ডুবো পাহাড় থাকে। হয়তো গঙ্গার এখানটাতে ডুবো পাহাড় আছে। দ্বীপটা তৈরী হবার সময় পাথরটা উঠে এসেছে।

বিমান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললো, তোর কি বুদ্ধি! পাথর কি হাল্কা জিনিস যে জলের উপরে ভেসে উঠবে? তাছাড়া দ্যাখ, এর তলায় কিছু ঘাস চাপা পড়ে আছে। এই দ্বীপটা হবার পরে কেউ পাথরটা এখানে এনেছে। কিন্তু শুধু শুধু কেন এত বড় একটা পাথরকে এখানে বয়ে আনবে?

আমি পাথরটার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললুম, উল্কা নয় তো। অনেক সময় উল্কার টুকরো পৃথিবীতে এসে পড়ে–

বলতে বলতে আমি মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলুম।

বিমান দারুণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, কী হলো, সুনীল? কী হলো তোর?

আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলুম। আমিও অবাক হয়ে গেছি খুব। কী হলো কিছুই বুঝতে পারছি না। এ রকম তো আমার কখনো হয় না।

বিমান আমায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে লাগলো, কী হলো রে, কী হলো? আমি বললুম, জানি না। হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে গেল।

— চুপ করে বসে থাক, উঠিস না।

— আমার কিছু হয়নি।

–তবু বসে থাক। একটা জিনিস দ্যাখ, সুনীল, এই পাথরের নিচের ঘাসগুলো দ্যাখ? কেমন যেন খয়েরি হয়ে গেছে। ঘাস চাপা পড়লে হলদে হয়ে যায়, কিন্তু খয়েরি? তুই কখনো খয়েরি ঘাস দেখেছিস?

–এ বোধহয় অন্য জাতের ঘাস।

পাশের এই গাছটা দ্যাখ। এই গাছটার গা-টা লাল। আমি লাল রঙের গাছ কখনো দেখিনি।

বিমান, ঐ যে মোষটা মরে যাচ্ছে, ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

–আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে রে! এমনি এমনি একটা মোষ মরে যাচ্ছে ইস! মোষটাকে ওর মালিক কেন যে ফেলে গেল।

—বিমান, আমার ইচ্ছা করে এখানে শুয়ে পড়তে।

–মন্দ বলিসনি। এখানে খানিকক্ষণ শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলে বেশ হয়।

—যদি নৌকোটা চলে যায়?

—ইস, গেলেই হলো, পুরো পয়সা দিয়েছি না। তাছাড়া যদি যায় তো চলে যাক। আমরা এখানেই থেকে যাবো।

হঠাৎ আমি লাফিয়ে উঠে পড়লুম। দারুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলুম, বিমান, বিমান, এই পাথরটা জ্যান্ত।

বিমান বললো, কী বলছিস? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

–না রে, আমি সত্যি দেখলুম। পাথরটা নড়ে উঠল।

–কী বলছিস যা-তা। পাথরটা নড়বে কি করে?

–আমি স্পষ্ট দেখলুম, পাথরটার পেটের কাছে একবার যেন চুপসে গেল, আবার ফুলে উঠলো। ঠিক ব্যাঙের মতন।

—দূর। পাথরের আবার পেট কী? তুই ভুল দেখেছিস।

—মোটেই ভুল দেখিনি।

বিমান গিয়ে পাথরটার গায়ে হাত দিতেই আমি বিমানের অন্য হাতটা ধরে এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনলুম ওকে। আমার বুকের মধ্যে দুম্ দুম্ আওয়াজ হচ্ছে। ঐ পাথরটার গায়ে হাত দিয়েই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলুম। ঐ পাথরটার কিছু একটা ব্যাপার আছে।

দূরে শুনতে পেলুম বুড়ো মাঝি আর সুলেমান চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে, বাবু। বালু।

আমি বললুম, চল, বিমান নৌকোয় ফিরে যাই।

বিমান বললো, না— এক্ষুণি যাবো না। এখানে শুয়ে থাকবো বললুম যে।

না, আমার মোটেই ভালো লাগছে না। চল, নৌকোয় ফিরে যাই।

বিমানকে প্রায় জোর করেই আমি টানতে টানতে নিয়ে চললুম। তারপর নৌকোয় উঠেই বুড়ো মাঝিকে বললুম, চলো, শিগগীর চলো।

নৌকোয় উঠে বিমান লম্বা হয়ে শুয়ে রইলো। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। ভাঙ্গা গলায় বলল, আমার কিছুই ভালো লাগছে না রে।

সুলেমান আমাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ঐ দ্বীপে গেলে তোমাদের কী হয় বলো তো?

সুলেমান বললো, কী জানি বাবু, ওখানে গেলেই মনটা কেমন কেমন করে। কাজ করতে ইচ্ছে করে না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

বুড়ো মাঝি বললো, বাবু, আগে তো আমরা ঐ চরে যেতাম। বেশি ঝড় বৃষ্টি হলে ওখানে নৌকো বেঁধে চালা ঘরটায় বসে জিরোতাম। অনেক লোক আগে ওখানে গরু-মোহিষ চরাতে আসতো। এখন আর কেউ যায় না।

–কেন যায় না বলো তো?

—ওখানে গেলেই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গরু-মোষগুলোও আলসে হয়ে পড়ে। কেমন যেন মনমরা লাগে।

—আমাদেরও সেই রকমই লাগছিল। কিন্তু কেন হয় ওরকম বলো তো?

–কী জানি! গাছপালাগুলো কেমন ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে দেখলেন না? ও দ্বীপে খারাপ নজর লেগেছে।

—ওখানে একটা বড় পাথর আছে দেখেছো? আগে ওটা ছিল?

—না, আগে ছিল না। এই তো মাসখানেক ধরে দেখছি।

–কী করে পাথরটা ওখানে এলো?

—কেউ তা জানে না। কেউ কেউ বলে ওটা আকাশ থেকে খসে পড়েছে। আমার মাথাটা এখনও দুর্বল লাগছে। আমি আর কথা বলতে পারলুম না। শুয়ে পড়লুম বিমানের পাশে।

হলদিয়ায় ফিরে এসে আমরা দু’জনেই সোজা চলে গেলুম বিছানায়। রাত্তিরে কিছু খেতেও ইচ্ছে করলো না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলুম। তার মধ্যে বারবারই দেখতে লাগলুম সেই পাথরটাকে। ঠিক একটা ব্যাঙের মতো তার পেটটা একবার চুপসে যাচ্ছে। একবার ফুলছে। একটা জ্যান্ত পাথর। আমি শিউরে শিউরে উঠতে লাগলুম।

সকালবেলা বিমানের দাদা স্বপনদা জিজ্ঞেস করলেন, তোদের কাল কী হয়েছিল? সন্ধে থেকে খালি ঘুমোচ্ছিলি?

স্বপনদাকে সব কথা বলতেই হলো। স্বপনদা সবটা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বললেন, গাঁজাখুরি গল্প বলার আর জায়গা পাসনি। একটা জ্যান্ত পাথর .. সেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মন খারাপ হয়ে যায়, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। দূর! যত সব।

বিমান বললো, দাদা আমি পাথরটাকে নড়তে দেখিনি। সুনীল দেখেছে। কিন্তু আমারও ওখানে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল।

—বেশ করছিল। শুয়ে থাকলেই পারতিস।

–তাহলে আমাদেরও নিশ্চয়ই ঐ মোষটার মতন অবস্থা হতো।

আমি বললুম, স্বপনদা, নৌকোর মাঝিরাও কেউ ঐ দ্বীপটায় এখন যেতে চায় না। ওরাও ভয় পায়। পুলিশে একটা খবর দেওয়া দরকার।

স্বপনদা বললেন, পুলিশও তোদের কথা শুনে আমার মতন হাসবে। দেখবি, মিঃ দাসকে ডাকবো?

হলদিয়ার এস ডি পি ও মিঃ দাস স্বপনদার বন্ধু। স্বপনদা তাঁকে টেলিফোনে ডেকে পাঠালেন। বললেন, মিঃ দাস, একবার আমার বাড়িতে চলে আসুন, ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাবেন। আর একটা মজার গল্প শোনাবো!

দশ মিনিটের মধ্যেই মিঃ দাস এসে গেলেন। তিনি বললেন, শুধু এক কাপ চা খাবো। বড় কাজ পড়েছে, এক্ষুণি যেতে হবে। কাল রাত্তিরে একটা লঞ্চ ডুবি হয়েছে গঙ্গায়।

স্বপনদা বললেন, বসুন, বসুন। কাল দুপুরে এই দুই শ্রীমান নৌকো ভাড়া করে গিয়েছিল আগুনমারির চরে। সেখানে নাকি ওদের এক সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওরা দু’জনে–

স্বপনদাকে থামিয়ে দিয়ে পুলিশ সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা দু’জনে কাল আগুনমারির চরে গিয়েছিলে? আশ্চর্য ব্যাপার ঐ দ্বীপটার পাশেই তো কাল রাত্তিরে লঞ্চটা ডুবেছে। ঝড়-বৃষ্টি কিছু নেই। শুধু শুধু একটা লঞ্চ ডুবে যাওয়া খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।

স্বপনদা জিজ্ঞেস করলেন, কেউ মারা গেছে?

পুলিশ সাহেব বললেন, নাঃ। মরেনি কেউ। সবাইকে উদ্ধার করা গেছে। আমাদের পুলিশের লঞ্চ খুব তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছোয়। কিন্তু লঞ্চটা যে কী করে ডুবলো তা ওরা কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারছে না। সবাই বলছে, কী যেন হলো কিছুই জানি না। হঠাৎ একটা ধাক্কাতে লঞ্চটা কেঁপে উঠলো, তারপরই হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকতে লাগলো।

স্বপনদা বললেন, লঞ্চটা একদম ডুবে গেছে বলতে চান?

পুলিশ সাহেব বললেন, হ্যাঁ। সেটা তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। ঐ লঞ্চের একজন খালাসি শুধু অদ্ভুত একটা গল্প বলছে। আগুনমারির চর থেকে একটা মস্ত বড় পাথর নাকি উড়ে এসে প্রচন্ড জোরে লঞ্চটাকে ফুটো করে দেয়। এরকম গাঁজাখুরি কথা কেউ শুনেছে? গঙ্গার ওপরে দ্বীপ। সেখানে পাথর আসবে কী করে? যদি বা পাথর থাকে, সেটা কেউ না ছুঁড়লে এমনি এমনি উড়তে উড়তে আসবেই বা কী করে?

স্বপনদা বললেন, এরাও ঐ দ্বীপে একটা বড় পাথর দেখেছে বলছে।

পুলিশ সাহেব বললেন, ভোরবেলা আমি আমার লঞ্চে সেই দ্বীপটা ঘুরে দেখে এসেছি। সেখানে পাথর টাথর কিছু নেই। মানুষজনের কোন চিহ্ন নেই। শুধু একটা মরা মোষ রয়েছে দেখলুম।

আমি আর বিমান চোখাচোখি করলুম। আগুনমারির চরের পাথরটাই যে লঞ্চটাকে ডুবিয়েছে তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

সকল অধ্যায়

১. টমসাহেবের বাড়ী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৩. দিনে দুপুরে – বুদ্ধদেব বসু
৪. ঠিক দুপুরে আকাশকুসুম – স্বপন বুড়ো
৫. রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬. লোকসান না লাভ – আশাপূর্ণা দেবী
৭. মাঝরাতের কল – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. ওয়ারিশ – লীলা মজুমদার
৯. তান্ত্রিক – ধীরেন্দ্রলাল ধর
১০. বোধহয় লোকটা ভূত – শুদ্ধসত্ত্ব বসু
১১. ছক্কা মিঞার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১২. ভূতেরা বিজ্ঞান চায় না – অদ্রীশ বর্ধন
১৩. হুড়কো ভূত – অমিতাভ চৌধুরী
১৪. ভূতে পাওয়া হরিণ – সংকর্ষণ রায়
১৫. মড়ার মাথা কথা বলে – রবিদাস সাহারায়
১৬. ফ্রান্সিসের অভিশাপ – শিশিরকুমার মজুমদার
১৭. সত্যি ভূতের মিথ্যে গল্প – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. শব্দের রহস্য – বিমল কর
১৯. পুরনো জিনিষ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২০. ভাড়া বাড়ি – মঞ্জিল সেন
২১. জ্যোৎস্নায় ঘোড়ার ছবি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. শাঁখারিটোলার সেই বাড়িটা – লক্ষ্মণকুমার বিশ্বাস
২৩. হাসি – বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ভূতুড়ে রসিকতা – আনন্দ বাগচী
২৫. ভূতেশ্বরের দরবারে কোয়েল – জগদীশ দাস
২৬. ভূত আছে কি নেই – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৭. ভূতের সঙ্গে লড়াই – শেখর বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন