ভূতের সঙ্গে লড়াই – শেখর বসু

লীলা মজুমদার

ভূতের সঙ্গে লড়াই – শেখর বসু

ডিসেম্বরের গোড়াতেই জাঁকিয়ে শীত পড়ে গেল কলকাতায়। এত শীতে বেলা পর্যন্ত লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করে। দুপুরের চমৎকার রোদে ক্রিকেট খেলতে ইচ্ছে করে জমিয়ে। বড় এই দুটো ইচ্ছের বাইরে আছে ছোট ছোট অগুনতি ইচ্ছে। কিন্তু এতগুলো ইচ্ছের একটাও মেটানোর উপায় নেই। আজ তো শনিবার, সামনের সোমবার থেকেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে রমু আর সোমুর।

রমু পড়ে ক্লাস সিক্সে আর সোমু থ্রিতে। দুজনের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে একসঙ্গে, শেষও হবে একইসঙ্গে। সোমুর অবশ্য মধ্যিখানে কয়েকটা দিন বাড়তি ছুটি থাকলেও খেলার সুযোগ নেই একটুও। মার শাসন খুব কড়া। সারা দিন পড়ার পরে একটুখানি খেললেও গজগজ করে মা – সারা দিন শুধু খেলা আর খেলা। খেলা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, পরীক্ষার পরে যত পারিস খেলিস।

পড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি খেলে নিলে পড়া যে কত ভাল হয় এই কথাটা কিছুতেই বোঝান যায় না মাকে। অগত্যা চোখে জল নিয়ে দুই ভাইকেই আবার বইয়ের ওপরে ঝুঁকে পড়তে হয়।

তবে আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ সকাল থেকেই দু-ভাইয়ের মন খুশিতে ভরে আছে। বিকেলবেলায় মা আর বাবা ঝুমা মাসীর বিয়েতে যাবে সেই ছোট জাগুলিয়ায়। এখান থেকে অনেকটা দূর, রাত্তিরে আর ফিরতে পারবে না। ফিরবে কাল সকালে।

সকাল থেকে মা দুই ছেলেকে একই কথা বলেছে বার দশেক—শোন, ঝুমুর বিয়ে বলেই যাচ্ছি। অন্য কারও হলে কিছুতেই যেতাম না এখন। তোরা কিন্তু খুব মন দিয়ে পড়বি, একদম খেলবি না। কী রে পড়বি তো?

কথার উত্তরে রমু আর সোমু প্রতিবারই লম্বা করে মাথা কাত করেছে একপাশে। ওই মাথা নাড়া দেখলে যে কেউ ভাববে, ইস! এত বাধ্য ছেলে আর বুঝি হয় না!

আসল ব্যাপারটা ওদের মা জানে না। সকাল থেকেই দুভাই মতলব আঁটছে ফিসফিস করে। বিকেলে ব্যাডমিন্টন, সন্ধ্যেয় টেবল-টেনিস আর রাত্তিরে টিভির কুইজ। ওদের মতলবের সামনে স্কুলের বইটইগুলোকে কেমন যেন অসহায় দেখাচ্ছিল। ভাগ্যিস, বইরা কথা বলতে পারে না। না হলে ওদের মতলবের কথা এক্ষুণি গিয়ে মাকে লাগাত

আজ রাত্তিরের জন্য ওদের অভিভাবক মান্তু কাকা। পাশের বাড়িতেই থাকে মান্তু কাকা। অভিভাবক হওয়ার গুরুদায়িত্ব পেয়ে মান্তু কাকা বলল, বৌদি আপনি একদম চিন্তা করবেন না, একদিনের বদলে সাতদিন থেকে আসুন। আমি আছি এ বাড়িতে, আপনার বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে একটা চোর ডাকাতও আসার সাহস পাবে না।

কথাটা বলে হাতের গুলি নাচাল মান্তু কাকা। বডিবিল্ডার মাস্ত কাকার চেহারা ঠিক দৈত্যের মত, আর কী মাসল। ক্রিকেট বলের মত হাতের গুলিটার দিকে তাকিয়ে মা হাসতে হাসতে বলল, আমি চোর তাড়াবার জন্য তোমাকে বাড়িতে থাকতে বলছি না। তুমি দেখবে শুধু ছেলে দুটো যেন পড়াশুনা করে। যা বাঁদর–।  

বাঁদর বললে যে কোন মানুষেরই রাগ হবে, রমু আর সোমুরও হয়েছিল, কিন্তু ওরা রাগ দেখাল না একটুও। রাগ দেখালে মা যদি আরো রাগ দেখিয়ে বিয়ে বাড়ি যাওয়াই বন্ধ করে দেয়।

মান্তু কাকা হাসতে হাসতে বলল, আপনি একটুও ভাববেন না বৌদি। না পড়লে দুটোকে অ্যায়সা তুলে আছাড় দেব যে এ বছর আর পরীক্ষাই দিতে পারবে না।

বিকেল ঠিক সাড়ে চারটের সময় মা আর বাবা রমু আর সোমুকে আর এক দফা উপদেশ দিয়ে বিয়েবাড়িতে রওনা হয়ে গেল। রওনা হতেই প্রথম প্ল্যানটা কাজে লাগাল রমু আর সোমু।

ওরা মান্তু কাকার দু-হাত ধরে ঝুলে পড়ে বলল, মান্তু কাকা খাবে চল, ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে।

মান্তু কাকা খেতে ভীষণ ভালবাসে, কিন্তু একটু লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, নৃ-না, আমি খাব না। তোদের খাবারে ভাগ বসালে।

রমু আর সোমু প্রায় একসঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠল, ভাগ বসাবে কেন? মা তো অনেক খাবার রেখে গেছে। চাউমিন আছে, মিষ্টি আছে একগাদা।

মান্তু কাকা এবার আর আপত্তি করল না। মিনমিন করে বলল, ঠিক আছে, অল্প দিবি কিন্তু।

রমু আর সোমু তাই শুনে ছুটে গিয়ে টেবিল সাজাতে শুরু করে দিল। চাউমিন, টোম্যাটো সস আর কত রকমের মিষ্টি। খাবার থেকে খিদে বাড়িয়ে দেবার মত গন্ধ উঠছিল। দুই ভাই মান্তু কাকাকে টেনে এনে টেবিলের মধ্যিখানে চেয়ারটায় বসিয়ে দিল। এত খাবার দেখে মান্তু কাকার চোখমুখ জ্বলজ্বল করছিল খুশিতে।

রমু আর সোমু একটুখানি চাউমিন মুখে দিয়েই বলল, আমাদের পেট ভরে গেছে, মান্তু কাকা তুমি খাও আমরা আসছি।

মধ্যিখানের চেয়ার থেকে কোন জবাব আসার আগেই দু-ভাই ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

সন্ধে গড়িয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট হাতে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরল রমু আর সোমু। মাত্র কাকা বসার ঘরের দরজার সামনে চেয়ার টেনে থমথমে মুখ করে বসেছিল, ওদের দেখেই গম্ভীর স্বরে বলল, কাল বাদে পরশু পরীক্ষা, আর তোরা তিন ঘন্টা ধরে খেলে এলি। তোদের মা আসুক আমি সব বলে দেব।

রমু আর সোমু আগে থেকেই জানত এই ধরণের কথার সামনে পড়তে হবে ওদের, সুতরাং লাগসই জবাব ওদের ভাবাই ছিল। সোমু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, খেললে না ভীষণ খিদে পেয়ে যায়, মান্তু কাকা স্যান্ডউইচ খাবে, চিজ স্যান্ডউইচ?

চিজ-স্যন্ডউইচের কথায় মাস্ত কাকা শাসন করার কথা ভুলে গেল একদম। লাজুক লাজুক মুখে বলল, খেলাধুলো করলে খিদে তো পাবেই। আমি তো রোজ এক্সারসাইজ করি, আর এক্সারসাইজ করার পরেই যা খিদে পেয়ে যায় না। তা তোদের ভাগে কম পড়ে যাবে না তো?

না না, অনেক স্যান্ডউইচ আছে। – কথাটা বলেই সোমু ছুটল খাবার ঘরে।

আগের অত খাবার মান্তু কাকা একাই সাফ করে রেখেছিল। খালি প্লেটগুলো সরিয়ে টেবিলের ওপর চিজ-স্যান্ডউইচের ছোট্ট একটা পাহাড় বানিয়ে ফেলল সোমু। রমু নিয়ে এল কৌটো ভর্তি কাজুবাদাম আর সরেস মুড়কি।

খাবারদাবার টেবিলে সাজিয়েই দু ভাই ছোট্ট একটা শর্ত করে নিল মান্ত কাকার সঙ্গে। শর্তটা হল : একটু বাদেই টিভিতে দারুণ একটা কুইজ প্রোগ্রাম আছে, ওটা দেখার পরেই আমরা পড়তে বসব। তুমি কিন্তু মাকে আমাদের খেলতে যাওয়ার কথা, টিভি দেখার কথা বলতে পারবে না।

মস্ত বড় একটা স্যান্ডউইচ একসঙ্গে মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে মান্তু কাকা বলল, কিন্তু আমি মিথ্যে কথা বলব কীভাবে?

চটপট জবাব দিল সোমু, তোমাকে মিথ্যেও বলতে হবে না, সত্যিও না। তুমি শুধু মাকে বলবে আমরা লক্ষ্মী হয়ে ছিলাম, কী বলবে তো?

স্যান্ডউইচের শেষের দিকে একমুঠো কাজুবাদাম মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে মান্তু কাকা বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, দেখা যাবে। কই, তোরা খা। রমু আর সোমু এবারও একটুখানি খেয়েই বলল, পেট ভরে গেছে। এদিকে মান্তু কাকা খাব না খাব না করেও পুরো খাবারটা একাই শেষ করল। তারপর ঢকঢক করে দু গ্লাস জল খেয়ে বলল, আহ!

সব কিছুই দু-ভাইয়ের প্ল্যান মত চলছিল, কিন্তু কপাল খারাপ, টিভি প্রোগ্রামের মাঝপথেই পাওয়ার কাট হয়ে গেল। এইরকম সময় আলো চলে

যাওয়ার কোন মানে হয়।

মান্তু কাকা আড়ামোড়া ভেঙে বলল, নে নে ঢের হয়েছে, এবার হ্যারিকেন ট্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বোস।

কথাটা যেন দু-ভাইয়ের কানেই গেল না। কুইজ দেখতে না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে হায় হায় করতে লাগল ওরা। তারপর সোমু হঠাৎই বলে বসল, মান্তু কাকা গল্প বল, ভূতের গল্প। ওর কথায় সায় দিল রঘু।

মান্ত কাকা হা হা করে হেসে উঠে বলল, অন্ধকার রাত্তিরে ভূতের গল্প শুনলে তোরা ভয় পাবি।

— মোটেও না, ভূত তো আর সত্যি সত্যি নেই।

— কে বলেছে নেই, জানিস তো ছোটবেলায় ভূতের সঙ্গে আমার লড়াই হয়েছিল একবার, ওহ! সে কী লড়াই!

খিলখিল করে হেসে উঠে রমু বলল, সেই গল্পটাই বল মান্তু কাকা।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বল বল। বায়না ধরার সুরে ভাইয়ের গলায় গলা মেলাল সোমু।

আর একবার হেসে উঠে মান্তু কাকা বলল, ঠিক আছে বলছি, তবে ভয় পেতে শুরু করলেই বলবি, আমি এমনি গল্প থামিয়ে দেব।

কথার উত্তরে দু-ভাই হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে তুমি বল।

শীতের রাত। বাইরে বোধহয় বেশ কুয়াশা পড়ছে। এক কুচিও আলো ভেসে আসছে না কোনও জায়গা থেকে। মান্তু কাকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, এটা কিন্তু সত্যি ঘটনা। গল্পের মত শোনালেও গল্প নয়।

গল্পের ভূমিকাটুকু করতেই দু-ভাই মাস্ত কাকার গা ঘেঁষে বসল। ওদের গায়ে সোয়েটার, মান্তুর গা মাথা জড়ান চাদরে। আশেপাশের বাড়ির জানালা দরজা বন্ধ বলেই বোধহয় কোনরকম শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

মান্তু কাকা শুরু করল তার সত্যি ঘটনা–আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। থাকতাম বেলেঘাটায়। ওখানে তখন আজকের মত এত লোকজন ছিল না। আমাদের পাড়া ছিল আরও ফাঁকা। জানিস তো ছোটবেলায় আমি খুব ডানপিটে ছিলাম। ভয় কাকে বলে জানতাম না। এক্সারসাইজ করতাম, কুস্তি লড়তাম, বক্সিং লড়তাম। আমাদের পাড়ার কাছেই ছিল রামসেবক সঙ্ঘ। রোজ বিকেলে ওখানে আমি এক্সারসাইজ করতাম। সেদিন এক্সারসাইজ করতে করতে বেশ মেজাজ এসে গিয়েছিল। ভাবলাম অনেকক্ষণ ধরে ওয়েটলিফট করব। সন্ধ্যে হতে না হতেই ক্লাবের মেম্বাররা এক এক করে চলে গেল। ক্লাবে আমি একা। আমাদের ক্লাবের ছাদ ছিল না, চারদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাশেই বিরাট একটা বটগাছ। বটগাছের ডালপালা ক্লাবের যেদিকে ঝুঁকে পড়েছে সেদিকে বেশ অন্ধকার। হঠাৎ ওই অন্ধকার থেকে কে যেন নাকিসুরে বলল, কী রে খুব তো এক্সারসাইজ করছিস, পারবি আমার সঙ্গে। আমি তো অবাক। কে ওখানে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি কুচকুচে কালো, রোগা, হাড্ডিসার একটা ছেলে। ধমকে বললাম, এই তুই এখানে কী করছিস রে? যা ভাগ। ছেলেটা তার জবাবে বলল, এক্সারসাইজ করে খুব তো জোর বাড়াচ্ছ গায়ে, পারবে আমার সঙ্গে লড়াই করতে? রোগা লিকলিকে ছেলেটার আস্পদ্দা দেখে রাগে আগুন জ্বলে উঠল মাথায়। বললাম, দাঁড়া তোকে পাঁচিলের ওপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।

— তারপর? থমথমে গলায় প্রশ্ন করল সোমু।

আর একবার কেশে নিয়ে মান্তু কাকা বলল, তারপর আবার কি, শুরু হয়ে গেল লড়াই। অত লিকলিকে চেহারা, কিন্তু ওকে জাপটে মাথার ওপরে তুলতে গিয়েই টের পেলাম ওর গায়ে অসুরের মত শক্তি।

— আচ্ছা, কার গায়ে বেশি শক্তি মাত্ত কাকা, ভূতের না অসুরের?

রমুর প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে মাত্ত কাকা বলল, শোন না আগে। অসম্ভব জোর লিকলিকে ছেলেটার গায়ে। অত জোর দেখেই আমার সন্দেহ হল– এ নির্ঘাত ভূত। গাছের নিচেটা অন্ধকার -অন্ধকার, ওই অন্ধকারে আমার ছায়া পড়ছে কিন্তু ছেলেটার কোন ছায়া নেই। ভূতদের তো ছায়া পড়ে না। ও যে ভূত সে ব্যাপারে আমার আর কোন সন্দেহই থাকল না। কিন্তু তখন যদি লড়াই ছেড়ে পালাতে যাই, ও নির্ঘাৎ আমার ঘাড় মটকে দেবে। শুনেছি, মানুষ ভয় পেয়েছে জানলে ভূতদের গায়ের জোর অনেক বেড়ে যায়। সেই জন্যে ভয় পাওয়ার কথা ভূতটাকে জানতে না দিয়ে ওর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গেলাম আমি।

—সত্যি-সত্যি লড়াই?

সত্যি-সত্যি লড়াই না তো কী। বললাম না এটা গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। লড়াই বলে লড়াই, ওরকম লড়াই কোথাও দেখা যায় না। একবার আমি ওকে আছাড় মারি, একবার ও আমাকে আছাড় মারে। শুধু কুস্তির প্যাঁচই নয়, ওই সঙ্গে বক্সিংও চালাতে লাগলাম আমি। ভূতটা বক্সিং জানত না, বক্সিংয়ের জবাবে ও কিল মারতে লাগল। ভূতের কিল যে একবার খেয়েছে সেই জানে ওই কিলের কী জোর! ওখানে আমার জায়গায় আর কেউ থাকলে তাকে আর বেঁচে ফিরতে হত না। তা, আমি ঠিক করলাম, লড়াই করতে করতে ওকে আমি ক্লাবের ভেতর দিকে এনে ফেলব। ভেতরদিকে একবার এনে ফেলতে পারলে আমার আর কোন ভয় নেই।

–কেন কেন? দু-ভাইই প্রশ্ন করল একসঙ্গে।

ক্লাবের ভেতরদিকে মহাবীরের সিঁদুর মাখানো মূর্তি ছিল। মহাবীর তো ভগবান, ভগবানের সামনে ভূত কি দাঁড়াতে পারে? সেই মতলবে গায়ের সব শক্তি জড়ো করে মারলাম এক জব্বর প্যাঁচ, আর সেই প্যাচেই ভূতটা ছিটকে গিয়ে পড়ল মহাবীরের মূর্তির ঠিক সামনে, ব্যাস।–

— ব্যাস কী?

–ব্যাস, ভূতটা বাঁবাগো মাগো বলে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।

ভূতের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ওই লড়াইয়ের কাহিনী শুনতে শুনতে অত শীতের রাতেও উত্তেজনায় দুই ভাইয়ের গা ঘেমে উঠেছিল।

গল্পের শেষে হ্যারিকেন জ্বালান হল, আর তারপরেই শোনা গেল রাস্তার মোড়ের ট্রান্সফর্মারটা পুড়ে গেছে, সূতরাং আজ রাতে আলো আসার আর সম্ভাবনা নেই।

হ্যারিকেনের আলোয় বেশিক্ষণ বোধহয় রাত জেগে থাকা যায় না, ভাত খাওয়ার পরেই তাই ঘুমে চোখ ভেঙে এল দু-ভাইয়ের। রমু বলল, মাস্ত কাকা আমরা এখন ঘুমিয়ে পড়ছি, কাল খুব ভোরে উঠে পড়তে বসব।

হাসতে হাসতে জবাব দিল মাস্ত কাকা – ঠিক হ্যায়।

রমু, সোমু শোবে এ ঘরে, মান্তু ও ঘরে।

ঘরের দরজা দেবার আগে রমু বলল, মান্তু কাকা ওই ভূতটা তোমাকে আর তাড়া করেনি কখনো?

গুণগুণ করে গান গাইছিল মান্তু কাকা, গান থামিয়ে জবাব দিল, না, ওই ঘটনার পরে ক্লাবটা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর ভূতটা তো ওই বটগাছ ছেড়ে আর কোথাও যেত না।

–কেন?

— বাহ্ জানিস না, অপঘাতে মরার পরে কেউ ভূত হলে সে মরার জায়গাটা ছেড়ে আর কোথাও যেতে চায় না। আমি ওই বটগাছের কাছেও আর যেতাম না, ব্যস মিটে গেল সব।

–আহা তাই আবার হয় নাকি?

মান্তু কাকা গম্ভীরভাবে বলল, আমার কাছ থেকে শুনে রাখ – তাই হয়।

রমুর চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ – তাই হলে তো ও ঘরে নায়ারের ভূত থাকার কথা।

–নায়ার কে?

–আমরা এই ফ্ল্যাটে আসার আগে নায়াররা এখানে ভাড়া থাকত। ভদ্রলোক ও ঘরে খাট থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিল। কথাটা বলতে বলতে লম্বা করে হাই তুলল রমু। তারপর শুয়ে পড়ছি বলেই দরজায় খিল দিয়ে দিল।

দু-ভাই এ ঘরে দুটো সিঙ্গল খাটে ঘুমোয়। বিছানায় পড়া মাত্তর দু-ভাইই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারেনি, দরজায় দুমদুম শব্দ। দরজার ওপাশে মাস্ত কাকার গলা – এই দরজা খোল, দরজা খোল, ও রমু ও সোমু।

দরজা ধাক্কার শব্দে দুজনেরই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দরজা খুলতেই মান্তু কাকা কেমন যেন ছিটকে ঘরে ঢুকে পড়ে বলল, আমি এ ঘরে শোব। ও ঘরে নায়ার, ও ঘরে নায়ারের ভূত।

এ ঘরে ছোট দুটো সিঙ্গল খাট। মান্তু কাকা দুটো খাটের মাঝখানের মেঝেয় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে মান্তু কাকা লাজুক মুখে বলল, ভূতে আমার ভয় নেই, তবে ওই নায়ারের ভূতটা কাল রাতে ঝড়ের মত মালয়ালমে কী যে বলছিল কে জানে। তোরাই বল, ভাষা না বুঝলে কি লড়াই করে সুখ আছে। তাই রাগ করে আমি এ ঘরে চলে এসেছিলাম। তোরা কিন্তু এই ব্যাপারটা কাউকে বলবি না। না বললে তোদের দুটো ক্রিকেট বল আর এক ডজন শাটল কক্‌ কিনে দেব।

বেলা আর একটু বাড়তেই রমু সোমুর মা, বাবা ফিরে এল বাড়িতে। আর ফিরতেই মাস্ত কাকা বলল, বৌদি, ওরা একটুও দুষ্টুমি করেনি, ভীষণ লক্ষ্মী হয়ে ছিল। আর পড়ায় কী মন। কতবার বলেছি যা একটু খেলে আয়, কিন্তু–।

ওকে থামিয়ে দিয়ে রমু সোমুর মা বলল, থাক থাক ওদের আর অত গুণকীর্তন করতে হবে না।

মা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে রমু আর সোমু মিটিমিটি হাসছিল।

***

অধ্যায় ২৭ / ২৭

সকল অধ্যায়

১. টমসাহেবের বাড়ী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৩. দিনে দুপুরে – বুদ্ধদেব বসু
৪. ঠিক দুপুরে আকাশকুসুম – স্বপন বুড়ো
৫. রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬. লোকসান না লাভ – আশাপূর্ণা দেবী
৭. মাঝরাতের কল – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. ওয়ারিশ – লীলা মজুমদার
৯. তান্ত্রিক – ধীরেন্দ্রলাল ধর
১০. বোধহয় লোকটা ভূত – শুদ্ধসত্ত্ব বসু
১১. ছক্কা মিঞার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১২. ভূতেরা বিজ্ঞান চায় না – অদ্রীশ বর্ধন
১৩. হুড়কো ভূত – অমিতাভ চৌধুরী
১৪. ভূতে পাওয়া হরিণ – সংকর্ষণ রায়
১৫. মড়ার মাথা কথা বলে – রবিদাস সাহারায়
১৬. ফ্রান্সিসের অভিশাপ – শিশিরকুমার মজুমদার
১৭. সত্যি ভূতের মিথ্যে গল্প – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. শব্দের রহস্য – বিমল কর
১৯. পুরনো জিনিষ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২০. ভাড়া বাড়ি – মঞ্জিল সেন
২১. জ্যোৎস্নায় ঘোড়ার ছবি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. শাঁখারিটোলার সেই বাড়িটা – লক্ষ্মণকুমার বিশ্বাস
২৩. হাসি – বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ভূতুড়ে রসিকতা – আনন্দ বাগচী
২৫. ভূতেশ্বরের দরবারে কোয়েল – জগদীশ দাস
২৬. ভূত আছে কি নেই – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৭. ভূতের সঙ্গে লড়াই – শেখর বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন