লীলা মজুমদার
আমি বা আমরা, মানে, আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে আমরা সাত ভাই, ভাইপো ভাইঝিরা আর দু-তিনটি ভাগ্নে-ভাগ্নী। মিলেমিশে থাকতাম সবাই। হই- হুল্লোড়-পড়াশোনা-গল্পগুজব-খেলাধূলা সবকিছু নিয়ে দিব্যি মেতে থাকতাম।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। ক্রমে বৃষ্টিটা জাঁকিয়ে এল।
সারপেন্টাইল লেনের এখনকার চেহারার সঙ্গে ষাট বছর আগের চেহারার খুব একটা ফারাক দেখি নে। ‘সারপেন্ট’ মানে, সাপের মতই এঁকে বেঁকে এই গলিপথটা কখন যে কোনদিক থেকে কোনমুখো বেঁকে গিয়েছে, দশ নম্বর বাড়িটার পর তেইশ নম্বর বাড়িটা যে কোনখানে, কোনদিকে তার হদিশও পাড়ার পাকাপোক্ত বাসিন্দা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। এর উপর এদিকের ‘নেবুতলা’ – শশীভূষণ দে স্ট্রীট-এর চেহারা মানেই আম-জাম-কাঁঠাল আর সুপারি-নারকেল মিলে এক জঙ্গুলে চেহারা। চোর ডাকাতের ভয় যত না, সাপ খোপ পোকা মাকড়ের ভয়ে ওই বিস্তীর্ণ এলাকাটা সন্ধ্যের আগে থেকেই কেমন ‘ভয় ভয়’ চেহারা নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকত। তার মধ্যে ভরসন্ধ্যেয় অমন বৃষ্টি।
কিন্তু মুষলধারে ঐ বৃষ্টির মধ্যে, তখনও আমাদের গল্প-গুজবের শেষ হয়নি- দুম্-দুম্ শব্দে সদর দরজায় জোর ধাক্কা। দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে রাত আটটা বাজল। স্বাভাবিকভাবেই আমরা চমকে উঠলাম। আমাদের বাচ্চাকাল থেকেই বড্ড ভূতের ভয়। নড়লাম না। নদা আমাদের মধ্যে রেশ মোটাসোটা জোয়ান জোয়ান চেহারা। তিনিই গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। আমাদের মধ্যে যাঁরা দাদা কাকা বড় সবাই, তাঁরা যে যার ঘরে বিশ্রাম করছিলেন। তাঁরা তখনও জানেন না ঐ বৃষ্টিতে কেউ একজন সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এদিকে নদা দরজাটা খুলে দিয়েই দেখলেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যে ভদ্রলোক তাঁর গায়ের ওয়াটার প্রুফটা ভিজে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা অমন অঝোর ধারায় বৃষ্টির মধ্যেও নেভেনি–এটা কেমন করে সম্ভব হল? পায়ের জুতো-টুতো ভিজে জবজবে। মাথায় একটা সাবেকি ধরণের ফেল্ট ক্যাপ। ভদ্রলোক বললেন, তোমার কাকা-টাকাকে বল নিরঞ্জন বাবু এসেছেন।
ভদ্রলোক যে আমাদের পরিচিত, সেটা তাঁর কথায় বোঝা গেল। আমাদের বাবা যে মারা গেছেন, নেই, এটা না জানলে নিরঞ্জনবাবু কাকার কথাই বা বলবেন কেন?
ভদ্রলোক, মানে নিরঞ্জনবাবু বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। নদা গিয়ে বড় কাকাকে খবর দিলেন। বড় কাকা বেশ ভারিক্কি মানুষ। কত্তা কত্তা ভাব। রাশভারি চেহারা। কম কথা বলেন, কিন্তু কথাগুলো সবই দরকারী। তবে নিরঞ্জনবাবু নামটা শুনেই সেই বড় কাকা কিছু ব্যস্তসমস্ত হয়েই দোতলা থেকে নিচে নেমে এলেন। কী ব্যাপার। আমরা তখন একটা নতুন কিছু ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছি। একেবারে চুপচাপ সবাই। বড় কাকা দরজার এপার থেকেই হাত বাড়িয়ে নিরঞ্জনবাবুর হাত ধরলেন। বললেন, আরে নিরঞ্জনদা তুমি। একবারে ভিজে গেছ। এসো এসো ভিতরে এসো।
বড় কাকার পিছন পিছন তখন বাড়ির বড়রা অনেকেই এসে দাঁড়িয়েছেন। কিছু সুস্থ হয়ে বসলেন নিরঞ্জনবাবু। ভিজে জামাপ্যান্ট খুলেছেন। ওয়াটার প্রুফটা, জুতো জোড়াও। আমাদের বাড়ির কারো পাজামা পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে দিব্যি ভদ্র হয়েছেন এবার বড় কাকা-কাকীমাদের কৌতূহল মেটাতে, আমাদের সবাই এর উৎসুক মুখগুলোর দিকে চেয়ে গড়গড় করে বলে গেলেন তোমরা সবাই আমাকে দেখে, বিশেষ করে, বৃষ্টির ভিতর এই রাতে, হতভম্ভ হয়ে গেছ, তাই না? হ্যাঁ, হতভম্ব হবারই কথা। নইলে কোথায় ডেনমার্ক–সাত সমুদ্দুর তের নদীর পার আর কোথায় এই কলকাতার একটা এঁদো গলি সারপেন্টাইন লেন—
আকাশ ভাঙা বর্ষা বাদলের মধ্যে ঝিমঝিম করা প্রায় অন্ধকার রাতে কথাগুলো চট করে বলে ফেললেন সেজদা। আসলে সেজদাই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতু। ভীষণ ভূতের ভয় তার। ব্যাপারটার মধ্যে সেজদা ইতিমধ্যেই একটা ‘ভূত ভূত’ গন্ধ পেয়ে গেছেন বুঝি। কাকীমা আর বড়বৌদির গা ঘেসে বসেই কথাগুলো বললেন।
সেজদার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে, বড় বড় চোখে চেয়ে দেখলেন বড় কাকার নিরঞ্জনদা। বললেন, হঠাৎই আসতে বাধ্য হলাম। মধ্য কলকাতায় একটা বাড়ি কেনার ইচ্ছে ছিল আমার বরাবরই। কারণ মধ্য কলকাতাটাকেই আমরা আসল কলকাতা বলে জানি। আমার এক এদেশীয় বন্ধু এ ব্যাপারে আমাকে ডেনমার্কে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল মধ্য কলকাতার শাঁখারিটোলায় নাকি একটা দোতলা বাড়ি অনেক বছর ধরে খালি পড়ে আছে। অনেকগুলো ঘর, কল বাথরুম রান্নাঘর বারান্দা এবং ছাদ। সব মিলে দারুণ পছন্দসই বাড়ি। আমি যদি অবিলম্বে এসে বায়নাপত্তর করি, কেনার ব্যবস্থা করি, ভাল হয়। তা, আমি ভাবলাম, মানে, চট করে তোমাদের কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম তোমরা কাছে থাকবে–ভালই হবে।
তাই, তড়িঘড়ি পরশুর ফ্লাইটেই চলে এলাম। এসে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করলাম। আমার যে বন্ধু খবরটা লিখেছিল তাঁকে চিনতেন বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। তিনি আমাকে অবাক করে বললেন, হরিহর সামন্ত, মানে আমার ঐ বন্ধু ভদ্রলোক ২৭শে জুন ট্রামে কাটা পড়েন এবং মারা যান। আমি বিস্মিত হলাম, হরিহরবাবুর লেখা চিঠিতে তারিখটা দেওয়া ছিল তিন জুলাই। মানে, বাড়িওয়ালার কথানুযায়ী বন্ধু ভদ্রলোক নিজের মৃত্যুর ছদিন পর চিঠিটা লিখেছিলেন। এ কেমন করে সম্ভব?
গোঁজামিলের নিয়মে একটা কিছু ভেবে নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে নিলাম। এ্যাডভান্স হিসাবে পাঁচ হাজার টাকাও দিলাম বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে। তারপর মনে হল তোমাদের পাড়াতে আসাই যখন, শুভ সংবাদটা তোমাদের জানিয়ে যাই। তা আসি আসি করে এমন সময় রওনা দিলাম মুষলধারে বৃষ্টি। কী বৃষ্টি। ভিজে নেয়ে একেবারে জ্যাবজেবে হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস পায়জামাটা দিলে–
বড় কাকা-কাকীমারা খাওয়ার কথা বললেন, নিরঞ্জনবাবু রাজী হলেন না। বললেন, গৃহপ্রবেশের দিন তোমাদের নিয়ে যাব, এখন যাই।
উঠে পড়লেন নিরঞ্জনবাবু। সেজদা বললেন, আপনার কোটপ্যান্ট এসব কি করে নেবেন?
জুজুল চোখে ভদ্রলোক সেজদার দিকে চেয়ে বললেন, কী বলতে চাও তুমি? আমার ঠিকানা দিয়ে গেলাম। এতগুলো ছেলে আছ। সামান্য পোশাকটাও কাল-টাল দিয়ে আসতে পারবে না?
যেন ভীষণ রেগে গেছেন নিরঞ্জনবাবু। মেজাজী কথাবার্তায় জুলুম জুলুম ভাব। আরও অবাক যেটা সেজদা ছেলেটাকে উনি যেন কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। গট গট করে চলে গেলেন। বলে গেলেন, শীগগিরই তোমার সঙ্গে দেখা হবে, মঙ্গলবার।
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর বাড়ির সবাই খাওয়া দাওয়ার পাট সেরে একে একে যে যার মত শুয়ে পড়লাম। রাত দশটা বেজে গেছে। আমার ঘুম এল না, নানা কথা ভাবতে লাগলাম।
শাঁখারীটোলার সেই অভিশপ্ত বাড়িটি এখান থেকে বেশ অনেকটা দূরে। সেখানেই আজ রাত কাটাবেন নিরঞ্জনবাবু। বাড়িটার একটা বদনাম আছে। অনেকে বলে ভুতুড়ে বাড়ি। নিশিরাত্রের দুই প্রহরে কি করছেন তিনি কে জানে? কেমন আছেন তাই বা কে জানে?
একটা ‘বল হরি হরি বোল’ চীৎকার শোনা গেল। ঐ বৃষ্টিতে কার ঘরে কী সর্বনাশ হয়ে গেল বুঝি।
রাত তখন দুটো। “বল হরি’ শব্দটায় কাঁটা দিয়ে উঠল সারা শরীরে। কে জানে এরপর কোন সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর
এক সময় অনেক বেলায় ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠেই শুনি একটা চাপা গুঞ্জন বাড়ির সবার মুখে। কী হল।
শোনা গেল, ভোর ভোর রাতে সেই ভিজে কোটপ্যান্টগুলো নিতে এসেছিলেন নিরঞ্জনবাবু। সেজদাই দরজা খুলে দিয়েছিলেন। সেজদা বলছেন, ঘুম আসছিল না ভাল। হঠাৎ সদর দরজার কড়াটা নড়ে উঠল। মনে হল কেউ এসেছে বুঝি। ভয় ভয় করছিল। তবু কে যেন আমার পা দুটোকে টেনে নিয়ে গেল সদর দরজায়। দরজাটা খুলে দিলাম। চমকে উঠলাম। সামনে দাঁড়িয়ে সেই ভদ্রলোক, নিরঞ্জনবাবু।
বড় কাকীমা বললেন, আমাদের কাউকে ডাকলি নে কেন?
নদার পালোয়ান পালোয়ান চেহারা। প্রায় উত্তেজিত হয়েই বললেন, সেজদার এত ভয় তার উপর সব তাতেই ওস্তাদ্দি সেজদার। থামিয়ে দিয়ে বড় কাকা বললেন, তারপর কি করলি তুই?
সেজদা বললেন, আমাকে বললেন, “আমি ভেতরে যাব। তোদের পাঞ্জাবী পায়জামা রেখে আমার কোটপ্যান্ট পরে যাব। আমি সকালের প্লেনেই ডেনমার্ক চলে যাচ্ছি।”
আমার আগে ভাগেই যেখানে রাখা ছিল সেই ভিজে কোট প্যান্ট-টাই সেখানে এসে ওগুলো পরলেন। রেখে গেলেন পাজামা পাঞ্জাবী। আমার দিকে জানিনে কেন কটমট করে চেয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি দরজাটা দিয়ে দিলাম।
আমরা সবাই অবাক। ছোটকাকীমা বললেন, কী কান্ড। এত সব ঘটল। আমরা কেউ জানলাম না। বড় কাকা গম্ভীর মেজাজের মানুষ। আরও গম্ভীর হলেন। কী বুঝলেন কী ভাবলেন বললেন নদাকে, “তুই আমার সঙ্গে আয়।” নদাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বড় কাকা।
ঘন্টাখানেক সময়ও গেল না। ফিরে এলেন দুজনেই। হাঁপাচ্ছিলেন বড় কাকা। বললেন সবাইকে “নিরঞ্জনবাবু ভোর ভোর সময় এখানে আসতে পারেন না।” সেজদাকে দেখিয়ে বললেন “ও যা বলল, কী করে ব্লল বুঝতে পারছি না। কারণ রাত একটার সময়ই নিরঞ্জনবাবু মারা গেছেন। তাঁর ‘ডেডবডি’ ঘিরে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। শাঁখারিটোলার বাড়িওয়ালা বললেন, “নিরঞ্জনবাবু যে ঘরে শুয়েছিলেন রাত একটা নাগাদ একটা চীৎকার শুনে পাড়ার লোকেরা ছুটে গিয়েছিলেন সেই ঘরে। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে সবাই দেখেছেন নিরঞ্জনবাবুর মৃতদেহ মেঝেয় পড়ে আছে।”
ছোটকাকা ব্যস্তসমস্তভাবেই প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তাঁর পরনে তখন কী পোশাক ছিল, শুনলে কিছু?
বড় কাকা বললেন, হ্যাঁ, আমরা তো দেখেই এলাম। আমাদের দেওয়া সেই পাজামা-পাঞ্জাবী। আর আশ্চর্য! সেজদার কথার সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। নিরঞ্জনবাবুর ছেড়ে রাখা সেই ভিজে কোর্ট-প্যান্ট-টাই ফেরত নিয়ে যাননি তিনি ভোর রাতে। আমাদের বাড়িতেই ওগুলো পড়েছিল। এবং আমাদের অনেক অনেক আদরের ভালবাসার শ্রদ্ধার সেজদা নিরঞ্জনবাবুর অদ্ভুত মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় একটা দুর্ঘটনায় মোটর চাপা পড়ে মারা গেলেন। সেদিন ছিল মঙ্গলবার।
নিরঞ্জনবাবু বলেছিলেন, সেজদার সঙ্গে দেখা হবে, মঙ্গলবার
উপসংহার :
এ ঘটনার আলোচনায় যাঁরা মৃত্যু রহস্য নিয়ে অভিজ্ঞ তাঁরা বলেছিলেন– আসন্ন মৃত্যু সম্বন্ধে কেউ কেউ আগাম জানতে পারেন। নিরঞ্জনবাবু নামের ভদ্রলোক সত্যিই ডেনমার্ক থেকে শাঁখারিটোলার বাড়ি কিনতে এসেছিলেন, সত্যিই তিনি এক রাতে বৃষ্টি ঝরা দুর্যোগ মাথায় নিয়ে সার্পেন্টাইন লেনে আমাদের বাড়িতে এসে তাঁর পোশাক ছেড়ে আমাদের দেওয়া পাজামা পাঞ্জাবী পরে গিয়েছিলেন। তাঁর অবচেতন মন জানতে পেরেছিল শাঁখারিটোলার ঐ ‘ভুতুড়ে’ বাড়িতেই ওঁর মৃত্যু হবে। এবং আমাদের সেজদাকেও অ্যাকসিডেন্টেই মঙ্গলবার দিনেই মরতে হবে। তাই …
শুধু জানা যায়নি এত লোক থাকতে সেজদাকেই কেন নিরঞ্জনবাবুর পছন্দ হয়েছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন