লীলা মজুমদার
চাণক্য চাকলাদার চিরকালই উটের মত হাঁটে। কিন্তু সেদিন দু দুটো চাণক্য চাকলাদারকে পিঠ কুঁজিয়ে লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ঘরে ঢুকতে দেখে চোখ কপালে তুলে ফেললাম।
এক্কেবারে একই রকমের চাণক্য চাকলাদার ―এক জোড়া। যেন সন্দেশের ছাঁচ থেকে তৈরী। আমি চোখ গোল গোল করে দুজনের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাচ্ছি দেখে দুজনেই হাসলো। এবং তখনি লক্ষ্য করলাম পার্থক্যটা।
একজন হাসল কাষ্ঠহাসি, আড়ষ্ট বদনে। আর একজন হাসল উল্লাসের হাসি, উৎফুল্ল আননে।
দ্বিতীয় জনই তাহলে আসল চাণক্য। চাণক্য চিরকাল হাসে এবং হাসায়। একটু গুলপট্টি মারে ঠিকই, তা আমার গা সওয়া হয়ে গেছে।
অতএব কেশে গলা সাফ করে নিয়ে (আসলে ঘাবড়ে যাওয়াটা কাটিয়ে নিয়ে) বললাম তেড়েমেড়ে আসল চাণক্যকে–ছদ্মবেশী দু নম্বরকে এনেছো কেন? মতলবটা কী?
উৎফুল্ল চাণক্য আমার টেবিলের কোণে বসে পড়ে লম্বা ঠ্যাং দুটোকে দোলাতে দোলাতে ম্রিয়মান চাণক্যকে ধমকে বললে দাদা রেগেছেন দেখতেই পাচ্ছো। তখনই বললাম পেছন পেছন এসো না। যাও, ওই চেয়ারটায় বসো। কাছে এসো না।
সুড়সুড় করে নকল চাণক্য গিয়ে বসল আমার ভাঙা চেয়ারটায়। চেয়ারের বেত ছিঁড়ে গেছে। গর্তের মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গিয়ে আটকে গেল। এবং সেইভাবেই হাঁটু দুটো প্রায় চিবুকে ঠেকিয়ে বসে রইল। জুলজুলে চাহনি কিন্তু আটকে রইল নাম্বার ওয়ান চাণক্যর দিকে।
আমি এবার বললাম “বৎস চাণক্য, কহ অকস্মাৎ কেন এহেন রঙ্গ?”
আসলি চাণক্য বলল “দাদা, ক্লোনিং সম্ভব হয়েছে শুনেছেন নিশ্চয়?”
“ক্লোনিং!”
“আকাশ থেকে পড়লেন মনে হচ্ছে।”
“না, না, আকাশ থেকে পড়ব কেন? ডেভিড রোরভিক-এর ‘ইন হিজ ‘ইমেজ’ বইটা আমারও পড়া আছে, এই তো সেদিন, মানে ১৯৫২ সালে রবার্ট ব্রিগস আর টমাস কিঙ আফ্রিকান চিতা-ব্যাঙ-এর নকল তৈরি করেছেন গবেষণাগারে। প্রকৃতিকে টেক্কা মেরেছেন।”
“শুরুটা হয়েছিল প্রফেসার এফ সি স্টুয়ার্ডের কর্নেল ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে — ১৯৬০ সালে। মনে পড়ে? হাসল চাণক্য। হাসিটা আমার মোটেই ভাল লাগল না। কিরকম যেন গা ছমছম করতে লাগল।
চাণক্য যেন আমার মনের ভয় আঁচ করে নিয়ে হাসির ধরণ পাল্টে নিল চট করে। মোলায়েম হেসে বলল “গাজরের গা থেকে কোষ চেঁচে নিয়ে নারকেলের দুধ মেশানো পোষ্টাই সলিউশনে ডুবিয়ে রেখেছিলেন প্রফেসর আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিয়ে ছেড়েছিলেন। কোষ থেকে সত্যিকারের গাজর তৈরি হয়েছিল।”
“এরই নাম ক্লোনিং”, বলেছিলাম আমি।
ঝুঁকে পড়ে হঠাৎ চোখ দুটো শক্ত করে চাণক্য (মানে আসল চাণক্য) বলল— ১৯৬৮ সালে ক্যালটেক বায়োলজিস্ট ডক্টর রবার্ট এল সিনশিমার বলেছিলেন, আর বছর দশেকের মধ্যেই মানুষ ক্লোন সম্ভব হবে। মানে এ মানুষের কোষ চেঁচে নিয়ে হুবহু ঐরকম গাদা গাদা মানুষ কারখানায় তেরি করা যাবে।”
নড়েচড়ে বসলাম – “কিন্তু হুঁশিয়ার করেছিলেন জেমস ওয়াটসন, ডি এন এ গবেষণায় নোবেল পুরস্কার জিতেও তাঁর মাথা ঘুরে যায়নি। মানুষ ক্লোন করতে বারণ করেছিলেন।”
চোখ পাকিয়েই বলল চাণক্য “চোখের রঙ, নাকের গড়ন, ব্রেন, মন—সবই এক হবে, কিন্তু আত্মা তো এক হবে না। ফ্রাঙ্কেস্টাইনের গড়া দানব সৃষ্টি হতে পারে এই ভয় করেছিলেন।”
ঠিক কথা। কিন্তু জে বি এস হ্যালডেনের মত বৈজ্ঞানিক মনে করতেন মানুষ ক্লোন অনেক অসাধারণ গুণের অধিকারী হবে। রাত্রে দেখতে পাবে, যন্ত্রণাবোধ থাকবে না, আলট্রাসনিক সমরাস্ত্রর আওয়াজ শুনতে পাবে না, বেঁটে বামন করে গড়ে তুলতে পারলে মানুষ ক্লোন বড় বড় গ্রহের মাধ্যাকর্ষণকে কলা দেখিয়ে কলোনি গড়ে তুলতে পারবে
এবার দাবড়ানি দিয়ে বলল চাণক্য (কখনো আমাকে অন্তত দেয় না) “থামুন থামুন, প্রত্যেকটা কোষের মধ্যে এমন তথ্য থাকে যা দিয়ে গোটা শরীরটাকে ফের গড়া যায় লাখে লাখে গড়া যায় তাও মানছি কোষের জেনেটিক অ্যাপারেটাসের সুইচটা বন্ধ রেখেছেন প্রকৃতি যাতে এই অঘটন না ঘটে—মানুষ ঘটাতে চায় সেই বিপর্যয়। গোপনে মানুষ ক্লোন তৈরি করে ফেলেছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’
চাণক্যর কটমটে চাহনি আর সহ্য হল না। খেপে গিয়ে বললাম “তাতে অত চেল্লাচেল্লি করার কি আছে? আইনস্টাইনের রেখে দেওয়া ব্রেনের একটা কোষের বায়োকেমিক্যাল সাপ্রেসর হটিয়ে দিয়ে লাখ লাখ আইনস্টাইন তৈরি করা যাবে—”
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চাণক্য বললে “মিশরীয় ম্যমী রাজা তুতানখামেনের দেহে যেটুকু ডি এন এ এখনও আছে, তা থেকে লাখ লাখ তুতানখামেনও তৈরি করা যাবে।”
“অ্যাঁ।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনারা যদি মানুষ ক্লোন করতে আরম্ভ করেন, আমরাও তাহলে কবরের মড়া তুলে লাখে লাখে জ্যান্ত মড়া বানিয়ে চলব।”
“তো-তো-তোমরা মানে?” আড়চোখে তাকালাম দুনম্বর চাণক্যর দিকে। সে দেখলাম একেবারে নীল হয়ে গেছে। মুখে রক্ত টক্ত কিচ্ছু নেই।
অট্ট হেসে এবার বললে আসল চাণক্য (সেকি অট্টহাসি … হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার) “দাদা, বিজ্ঞান নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করুন। বড় বড় বৈজ্ঞানিকরাও যা জানে না, আমরা তা জানি। আমাদের ভাত মারতে এলে সর্বনাশ করে ছাড়ব।”জবাব দিলাম একটা বটে, কিন্তু চিঁ চিঁ গলায় “কি-কি জানো তোমরা?”
“হাইপার গ্র্যাভিটি নিয়ে খুব তো লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ছে আপনাদের বৈজ্ঞানিকরা! পৃথিবীর মাটি থেকে ছশো ফুট উঁচু পর্যন্ত সব কিছুকেই মাধ্যাকর্ষণের উল্টো একটা শক্তি ওপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিব্বতের সাধুরা অনেক আগেই জানত এই হাইপার-গ্র্যাভিটির খবর। যোগাসনে বসে শূন্যে উঠে পড়ত। জানি আমরাও। দেখবেন?”
বলেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চাণক্য টেবিলে টেড়ে বসা অবস্থাতেই ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেল কড়িকাঠের কাছে। আবার নেমে এল টেবিলের ওপর।
বললে “দেখলেন? এরই নাম লেভিটেশন। আপনাদের উজবুক বৈজ্ঞানিকদের দেওয়া নাম। এসব শক্তি আমাদের হাতের মুঠোয় বলেই আমরা—”
গোঁ গোঁ শব্দ শুনে চেয়ে দেখি চেয়ারে গেঁথে থাকা চাণক্য অজ্ঞান হয়ে গেছে।
দেখে কেমন জানি মায়া হল টেবিলে বসে থাকা চাণক্যর “বেচারা। ঐ তো মুরোদ। ক্লোনিং নিয়ে খুব কপচাচ্ছিল গাছতলায় বসে। গাছটা যে নিমগাছ খেয়াল নেই। আমি ভূতলৌকিক কমিটির প্রেসিডেন্ট, মগডালে বসে অলৌকিক আর অপবিজ্ঞানের গবেষণা করছি জানেও না। প্রফেসার ঝিঁ ঝিঁ ঝাঁকতালের সঙ্গে চ্যাংড়ামি। দিলাম একটা ডোজ দিয়ে। হুবহু একখানা চাণক্য চাকলাদার হয়ে লাফিয়ে নামলাম সামনে।”
“তারপর?” গালে হাত দিয়ে বললাম আমি।
“তখনি অক্কা পেলে ল্যাটা চুকে যেত, দল ভারি করা যেত। বজ্জাত মানুষ বৈজ্ঞানিকগুলো এমন সব দাওয়াই বার করেছে, মানুষ মরছেও না ভূতদের পপুলেশন বাড়ছে না। তা আপনার এই আখাম্বা লম্বা সাগরেদটা ‘দাদারে বাঁচান বাঁচান’ বলে অসভ্যের মত এমন চ্যাঁচাতে লাগল যে আপনাকেও একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার মনে করলাম। চলে এলাম ঠিকানা নিয়ে। কিরকম বুঝছেন?”
“খু-উ-ব ভাল”, বললাম কষ্টেসৃষ্টে। “ভূতেদের আজকাল দর্শন পাওয়াও ভার। এত ভীতু মানুষের ভয়ে দেশছাড়া, আবার আম্বাকত লাখে লাখে মড়া জাগাবে ছোঃ।”
তড়াক করে লাফিয়ে মেঝে থেকে কড়িকাঠের কাছে পৌঁছে গেল চাণক্যরূপী প্রফেসর ঝিঁ ঝিঁ ঝাঁকতাল। কড়িকাঠে মাথা লাগিয়েই লাটুর মত ঘুরতে লাগল বন্ বন্ করে।
দেখলাম সেই অসম্ভব অবিশ্বাস্য দৃশ্য। ঝাঁকতালের ঘূর্ণমান দেহ থেকে রাশি রাশি চাণক্য চাকলাদার ছিটকে যাচ্ছে ঘরময় এবং ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে মেঝের ওপর। দেখতে দেখতে ঘর গিজগিজ করতে লাগল অজস্র চাণক্য চাকলাদারে। একই রকম দেখতে। এক রকম চাহনি। একই রকম হাঁটা।
এইটুকু ঘরে এতজনের জায়গা হবে কি করে যখন ভাবছি, প্রফেসর ঝিঁ ঝিঁ ঝাঁকতাল চোঁ করে নেমে এল আমার টেবিলের ওপর। বড়ি ঘোরা থেমে গেছে। শুধু চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে চর্কিবাজির মত ঘুরছে। (রাগে নিশ্চয়) আর কোটর থেকে ফুলকি ঠিকরোচ্ছে!
পাছে আবার অপবিজ্ঞানের খেলা দেখিয়ে বসে, তাই তাড়াতাড়ি বললামঃ “মাই ডিয়ার প্রফেসর, মাঝে মাঝে আসবেন। পি সি সরকারের ম্যাজিক টিমে আপনাকে ঢুকিয়ে দেব। এখন বিদেয় হোন চ্যালাচামুন্ডাদের গায়ে ঢুকিয়ে নিন। চামসে গন্ধ ছাড়ছে।”
“আর হবে না তো?” ভৌতিক খোনা স্বরে বললে ঝাঁকতাল।
“কি হবে না?”
“মানুষদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা?”
“বলে দেখব। যা ঠ্যাটা ওরা।”
“ভূত সাম্রাজ্য গড়ে তুলব গোটা পৃথিবীতে – খেয়াল থাকে যেন।”
“থাকবে প্রফেসর, থাকবে। এখন নিমগাছে ফিরে যান– গবেষণা অসমাপ্ত রেখে এসেছেন—”
“তাই তো!” আঁতকে উঠল প্রফেসর ঝিঁ ঝিঁ ঝাঁকতাল– পচা মাছের টনিকটা গেল বোধহয় বারোটা বেজে। গন্ধ শুঁকলেই শরীর যাদের নেই, তারা শরীরী পাবে এখন থেকে। একটোপ্লাজমের দরকারই হবে না। গুডনাইট, দাদা।”
“গুডনাইট ঝাঁকতাল।”
একটা ঝড় বেরিয়ে গেল ঘরের ভিতর থেকে বাইরে। কালো ঝড়।
চেয়ারের গর্ত থেকে উঠে বসল আসল চাণক্য চাকলাদার–যাকে এতক্ষণ নকল মনে করেছিলাম।
বললে–“অজ্ঞান হইনি। মটকা মেরে পড়েছিলাম।”
“চ্যাংড়ামি করতে গেলে কেন?” এতক্ষণে ফাটলাম বোমার মত।
“না করলে এমন একখানা গল্প পেতেন কোথায়?”
বলে একটা লম্বা চুরুট ধরাল চাণক্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন