লোকসান না লাভ – আশাপূর্ণা দেবী

লীলা মজুমদার

লোকসান না লাভ? – আশাপূর্ণা দেবী

একেই বলে ললাটলিপি।

কবে থেকে ঠিক হয়েছিল এবার পুজোয় গ্যাংটক। পরপর দু’বছর সমতলে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে, এবারে পাহাড় চাই।

এই চাওয়াটি অবশ্য নীতু আর পিতু দুই ভাইবোনের। ক’বছর আগে একবার দার্জিলিংয়ে যাওয়া হয়েছিল তখনই ওরা গ্যাংটক গ্যাংটক করেছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। বাবার ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল।

এবার ওরা নাছোড়।

নীতুর বাবা বলেছিলেন, এত দেশ থাকতে গ্যাংটক! কী যে মাথায় চাপে তোদের।

তাহলেও রাজি হয়েছিলেন।

সমস্ত ঠিক। হোটেল বুক করা টিকিট কেনা সব প্রস্তুত, হঠাৎ বাবা অফিস থেকে ফিরে বলে উঠলেন গ্যাংটক যাওয়া হবে না।

–হবে না মানে!

নীতুর মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল আর পিতু বসেই পড়ল।

— ও বাপী হবে না মানে?

— হবে না মানে হবে না। ওদিকে এখন দারুণ গোলমাল চলছে।

নীতু পিতুর মাও প্রায় বসে পড়ে বললেন, অফিসের লোক বলেছে বুঝি? তাই একেবারে বেদবাক্য।

–শুধু অফিসের লোক কেন, দেশসুদ্ধ সবাই বলবে। কাগজ পড়ছ না? দেখছ না কী হচ্ছে ওদিকে।

–কাগজে অমন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে। যাবার জন্যে পা বাড়ানো, আর এখন বলে বসলে যাওয়া হবে না। গেলে দেখবে তেমন কিছুই গোলমাল নেই।

নীতু পিতু অবশ্যই মায়ের সমর্থক।

কিন্তু ভাগ্য ওদের সমর্থক নয়।

পরদিনই ওদের সেই সিট বুক করে রাখা গ্যাংটকের হোটেল থেকে একটি টেলিগ্রাম এসে হাজির : ‘খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি – অনিশ্চিতকালের জন্যে আমাদের হোটেল বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। অতএব আপনারা …’

অর্থাৎ পৌঁছে গেলে যাতে না অসুবিধেয় পড়তে হয় খদ্দেরকে, তাই এই অগাধ বিবেচনা।

নীতুদের বাবা বললেন, বলতেই হবে লোকটা খুব ভদ্র।

নীতু পিতু আড়ালে এসে বলল, বলতেই হবে লোকটা অতি অভদ্র।

কিন্তু সে তো হল। এখন কিংকর্তব্য?

ছুটি শুরু হতে তো মাত্র তিনটি দিন। এর মধ্যে নতুন আর একটা জায়গায় যাওয়ার কথাই ওঠে না। টিকিট কোথায়? গিয়ে ওঠা হবে কোথায়? বলে দেড় দু’মাস আগে থেকে এসব ব্যবস্থা করতে হয়। এখন নো হোপ।

কিন্তু তাই বলে কোথাও যাওয়া হবে না?

বিজয়বাবু, মানে নীতুদের বাবা বললেন, তবে আর কী হবে? তোমরা চন্দননগরে গিয়ে ছুটিটা কাটিয়ে এস – আমি যা হোক করে চালিয়ে নেব।

চন্দননগরে নীতুদের মামার বাড়ী।

নীতুদের মা রেগে বললেন, আহা, মা, বাবা, পিসিমা …., আগে থেকে বেনারসে গিয়ে বসে আছেন না? চন্দননগরে কার কাছে যাব?

ওহো তাও তো বটে।

মিনিট খানেক টেবিলের ওপর আঙুলের টোকা মেরে বিজয়বাবু বলে উঠলেন, তাহলে এক কাজ করা যাক, ছুটিটা গাড়িতে কাটিয়ে আসা হোক।

–গানুডি!

–গানুডি!

–হ্যাঁ গাড়িই। কেন নয়? ওখানে যেতে ট্রেনের টিকিট, রিজার্ভেশন এত সব চিন্তা করতে হবে না, গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাবে। আর কোথায় গিয়ে ওঠা হবে তারও চিন্তা নেই। নিজেদের বাড়ি রয়েছে। যাওয়া তো হয় না সাতজম্মে। তোরা তো জীবনে দেখিস নি।

হ্যাঁ, নিজেদের বাড়িই!

নীতু পিতুর পরলোকগত ঠাকুর্দা না কি ওই ‘গানুডি’ নামের একদা দেহাতি জায়গায় একদা একখানা বিরাট বাড়ি বানিয়ে বসেছিলেন মাঝে মাঝে হাওয়া বদলাতে যাবেন বলে। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাগ্যে বেশি বার আর হাওয়া বদলাতে যাওয়া হয়নি সেখানে। অনেক দূরে চলে যেতে হল।

শেষে যখন গিয়েছিলেন সবাই মিলে, পিতু তখন বছর চারেকের আর নীতু এক বছরের।

নীতুদের ঠাকুমা বহুকাল আগেই চন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন।

বিজয়গিন্নী রেগে বললেন, সেই বাড়িতে এখন হঠাৎ গিয়ে থাকা যাবে? সাপ খোপ কী চোর ডাকাতের আড্ডা হয়ে বসে আছে কিনা কে জানে!

বিজয় বললেন, কেন সাপখোপের আড্ডাই বা হবে কেন? মালি নেই? বাবা তাকে ঘরবাড়ি করে দিয়ে চিরকালের জন্য পুষে রেখে যাননি? আর দরাজ হুকুম দিয়ে যাননি ওই বাগানে সে যত ফল ফুল ফলাতে পারবে সব নেবে। তাই থেকেই তার খাওয়া দাওয়া চলবে। মস্ত বাগান তো। চেষ্টা করলে কত কী ফল তরকারী ফলানো যায়।

পিতু হেসে বলল, তা সে সব হয়তো ঠিকই চলছে, তবে বাড়িটা থাকার যোগ্য করে রেখেছে কিনা সন্দেহ।

তারপর বলল, বাড়িটা আমার একটু একটু মনে পড়ছে। মস্ত বড় বাগান, বাগানের মধ্যে একটা মস্ত পরী-পুতুল। আর খুব উঁচু গেট। সেই গেটের লোহায় পা রেখে রেখে গেটের মাথায় উঠে পড়তাম। খুব উঁচু গেট তাই না বাপী?

বাপী হেসে বললেন, এমন কিছু উঁচু না। তবে খুব ছেলেবেলায় একটু বড়কেই অনেক বড় লাগে। তোর দাদুকে মনে পড়ে না?

পিতু বলল, সেও একটু একটু। আমায় পিতু না বলে ডাকতেন প্রীতিরানী, আর পাকা পাকা গোঁফ – এই যা মনে পড়ে।

চল। গিয়ে হয়তো আরো কিছু মনে পড়বে।

নীতুর কাছে কোন স্মৃতি নেই। না দাদুর, না দাদুর বাড়ির। কাজেই নীতু বেজার মুখে বলল, মনে পড়েই বা কী হবে? গ্যাংটকের বদলে গাড়ি। ধুস! একদম মার্ডার কেস। সেই নাকের বদলে নরুনের মত।

মন মেজাজ খারাপ ওদের মায়েরও। প্রতি বছর কোন না কোন ভাল জায়গায় যাওয়া হয়। ভাল ভাল হোটেলে ওঠা হয়, আরাম আয়েস বিশ্রাম। আর এ কিনা একটা দেহাতি গ্রামে পোড়ো বাড়িতে গিয়ে পড়া। জলের কল বলে কিছু নেই। ইঁদারা থেকে তোলা জলে যা কিছু কাজ!

–আর নিজেকে রান্না বান্নাও করতে হবে।

পিতু বলল, তা শশীদাকে নিয়ে চল না মা?

— চমৎকার। এখানের বাড়িটি আগলাবে কে অ্যাঁ? আমার কান্না পাচ্ছে!

বেচারী বিজয়বাবুর অবস্থা যেন চোরের মত।

যেন গ্যাংটকে গোলমালটি তিনিই বাধিয়েছেন। সেখানকার ‘সোনালী উপত্যকা’ হোটেলটি তিনিই বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এখন বৌ আর ছেলেমেয়েদের দুর্গতি ঘটাবার জন্যেই তাঁর বাবার রেখে যাওয়া একটা পোড়ো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে যাচ্ছেন। যেখানে নাকি সাপখোপ আর ডাকাতের আড্ডা।

একরাশ বেজার বিরক্তি, আর একগাদা বেডিং সুটকেস, ব্যাগ, টিফিন কৌটো, বেতের টুকরি, ওয়াটার বটল, ফ্লাস্ক এবং ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার আর গাদাগুচ্ছের গানের ক্যাসেট নিয়ে গাড়িতে চেপে বসা হল। কিন্তু সত্যি বলতে খানিকক্ষণ চলার পর মনটা বেশ ভালই হয়ে গেল দুই ভাইবোনের। বাবার ওপর একটু কৃপা করুণাও এল।

মাঝে মাঝেই বলতে লাগল, বাপী এতক্ষণ গাড়ি চালাতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না? বাপী ঠিক রাস্তা চিনে যেতে পারছ তো? ভুলে গিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে না তো?

এইসবের মাঝখানে ক্ষণে ক্ষণেই খাওয়া চলছে। কলা, কমলা লেবু, কেক, ফাইভ স্টার, সল্টেড কাজু, পটেটো চিপস্ আরো কত কী!

বিচ্ছিরি একটা গাঁইয়া জায়গায় যাচ্ছেন বলে ওদের মা ‘টুকটাক’ সঙ্গে নিয়েছেন বিস্তর। ডালমুটই তো এক বস্তা।

এই সবেতেই মনটা কিন্তু কিঞ্চিৎ ভাল হয়ে উঠেছিল। তবে এমন একটা ভয়ঙ্কর আহ্লাদের ঘটনা যে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সেটা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। এক মিনিট আগেও নয়। আবিষ্কারের গৌরব পিতুর।

বাড়ির কাছ বরাবর আসা মাত্রই হঠাৎ উল্লাসে চিৎকার করে উঠল পিতু, পল্টু কাকা!

পল্টু কাকা। মানে পল্টু।

পল্টু। সে কী? আরে? অ্যাঁ। তুই কোথা থেকে?

বলতে বলতে গাড়ির স্পীড কমিয়ে ফেলে বিজয়বাবু ডাক দেন, আয় উঠে আয়।

পল্টু হেসে হাত নেড়ে বলল, এই তো বাড়ি এসেই গেছে।

সত্যিই এসে গেছে বাড়ি।

বুড়ো মালি ব্যাসদেও ব্যস্ত হয়ে গেট-এর দুটো পাল্লাই দুহাট করে খুলে ধরে পিঠ গোল করে ‘সালাম’ জানায়।

কিন্তু সেদিকে কে তাকাচ্ছে? এখন আর কেউ নয় শুধু পল্টু

পল্টুকাকা।

মানে গ্যাংটকে যেতে না পারার দুঃখটা মোচন তো বটেই বরং মনে হল ভাগ্যিস গ্যাংটকে যাওয়া হয়নি। ভাগ্যিস গাড়িতে আসা হয়েছে। নইলে তো পল্টুকাকাকে মিস করা হত!

পল্টুকাকা যে কি নিধি সে তো এরা ভালই জানে।

আর বিজয়বাবু?

প্রায় বছর দু-তিন পরে হঠাৎ এই চিরদিনের স্নেহ আদরের মামাতো ছোট ভাইটিকে দেখে তো আনন্দে বিহ্বল। যেন হাতে আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে।

পল্টু সেই যে সেবার বললি ‘ম্যাজিক শো’ দিতে না কি জাভা না বোর্ণিও কোথায় যাচ্ছিস তারপর একেবারে নো পাত্তা হয়ে গেলি কেন? অ্যাঁ? নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হয়ে ছিলি কোথায় এতদিন? চেহারাখানি তো ঠিকই রেখেছিস দেখছি। যেমনটি ছিল তেমনটি। তা এখানে হঠাৎ মানে এই গাঁইয়া গাডিতে। —বলে ছেলেমেয়েদের দিকে একবার নজর ফেললেন বিজয়বাবু।

পল্টু বলল, কেন, গাডিটা কি খারাপ জায়গা? আমার তো এই কদিনেই স্বাস্থ্য ভাল হয়ে উঠেছে।

ভাল ভাল। তা কোথায় আছিস?

বাঃ। কোথায় আর। তোমাদের এই ‘চারুকুটিরেই’। আফটার অল আমার নিজের পিসির বাড়ি তো? নিজের পিসের তৈরী। থাকাটা দোষ হয়েছে? হা হা হা।

বিজয়বাবু অপ্রতিভ হয়ে বলেন, ছি ছি। কী যে বলিস। মানে বলছিলাম, এখানে একা, খাওয়া দাওয়ার কী করছিস?

কেন, ব্যাসদেও তো রয়েছে। ও আমায় চেনেনা না কী? আমাকে দেখে তো আনন্দে কেঁদেই ফেলল। বলে কেউ তো আসে না। আমি বুড়োবাবুর এই বাড়ি বাগিচা আগলে পড়ে আছি। ওঃ কী যত্ন যে করছে। আর যা ফার্স্টক্লাস রান্না। হা হা হা! মুখ ছেড়ে যায়।

—তো এতদিন ছিলি কোথায়?

—কোথায় নয়?

—মানে খুব ঘুরেছিস?

–হুঁ!

—এখনো ম্যাজিক দেখাস?

—বা। ওটাই তো আমার পেশা। পেশা আর নেশা এও হচ্ছে স্বভাবের মত। মরলেও ছাড়ে না।

মায়ের তাড়নার এতক্ষণে পিতু আর নীতু হাত মুখ ধোয়া সেরে ছুটে এসেছে। এখন দুজনে পল্টুকাকার দুদিকে।

—ও বাপী তুমি আর কতক্ষণ পল্টুকাকাকে নিয়ে আটকে রাখবে? ও পল্টুকাকা সব গপপো তোমার প্রাণের বন্ধু বিজুদার সঙ্গে করে ফেলছো? ইস, আমরা বলে তোমার জন্য ইঃ। তোমায় দেখে না আমাদের।….. জান পল্টুকাকা, আমাদের গ্যাংটকে যাওয়ার কথা ছিল …।

পল্টু চমকে বলল, কেন? গ্যাংটকে কেন?

—বাঃ। কেন আবার, এমনি। তো সেখানে যাওয়া হল না—

—ভালই হয়েছে।

—তা সত্যি। ভাগ্যিস যাওয়া হয়নি।

দুই ভাইবোনে একযোগে কথা বলে চলেছে, তাই না বাপীর বাবার এই গানুডিতে আসা হল। আর তোমাকে পেয়ে যাওয়া হল। ও পল্টুকাকা কী মজা! নাচতে ইচ্ছে করছে আমাদের।

—ও পল্টুকাকা, তাস আছে তোমার সঙ্গে? ম্যাজিক দেখাবে তো? ইস। আমরা যে তাসগুলো কেন আনলাম না! ও বাপী তোমার এই গাড়িতে তাস পাওয়া যায় না? যদি না পাওয়া যায়? যদি পল্টুকাকার কাছে না থাকে?

পল্টু বলে ওঠে, আরে বাবা, আগে থেকেই হতাশ হচ্ছিস কেন? আছে আছে। ভানুমতীর খেলের অনেক কিছুই আছে সঙ্গে। ভেবেছিলাম আর ম্যাজিক ফ্যাজিক নয়। কিন্তু আমি ছাড়তে চাইলেও ম্যাজিক আমায় ছাড়তে চায় না।

—বাঃ ছাড়তে চাইছিলে কেন?

পল্টু একটু রহস্যময় হেসে বলল, সে অনেক কথা। গিয়েছিলাম জাভায়। সেখানে ম্যাজিক দেখে একটা দল হঠাৎ আমায় যাদুকর ভেবে …..

—ও মা! ম্যাজিক দেখানোওয়ালারা তো যাদুকরই। পি সি সরকার, জুনিয়ার পি সি সরকার এঁরা সব ‘যাদুসম্রাট’, ‘যাদুর রাজা’ এই সব নয়?

—আরে সে তো আমরা জানি। ওরা ভাবে যাদুকর মানে ডাইনী।

—হি হি। পুরুষ মানুষ আবার ডাইনী হয়?

পল্টু গম্ভীরভাবে বলে, বোকাদের কাছে এমন কত হয়। সে যাকগে, তোরা খাওয়া দাওয়া করবি না? সেই কখন ভোরবেলা বেরিয়েছিস।

পিতুর মা হেসে গড়িয়ে পড়েন, আহা, পল্টু ঠাকুরপো, ওরা যেন সারা রাস্তা নির্জলা উপোসে এসেছে। সারাক্ষণ মুখ চলেছে–

সঙ্গে সঙ্গে নীতু হৈ চৈ করে ওঠে, ও পল্টু কাকা সল্টেড কাজু খাবে? ‘মুখরোচক মুড়মুড় ভাজা’? পটেটো চিপস্‌? মা, বেতের সেই টুকরিটা?

পল্টু বলল, হবে হবে। এখন দেখ গিয়ে ব্যাসদেও তোদের জন্য কী ব্যবস্থা করে উঠতে পেরেছে।

নীতুদের মা কতই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, বাড়িটা সাপখোপের আড্ডা হয়ে আছে, হয়তো গিয়ে নিজেকে রান্নাবান্না করতে হবে, বেড়ানোর বারোটা বেজে যাবে, মনের কষ্ট আরো কত কী!

কিন্তু দেখে লজ্জাতেই পড়ে গেলেন।

অতবড় বাড়ি, অতবড় বাগান সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফিটফাট। কোথাও নেই একটু ধুলোবালি। তবে বাগানের মাঝখানের সেই আস্ত মানুষের মাপে কংক্রিটের তৈরী সেই পরী-পুতুলটার যদি এতদিনের রোদে জলে নাক খেঁদিয়ে যায়, আর সর্বাঙ্গে ফাটল ধরে, তাহলে ব্যাসদেও কী করবে? আর গেটের লোহার রেলিংগুলো মরচে পড়ে খসে খসে পড়তে চাইলেই বা বেচারী বুড়ো মানুষ কী করবে? বাড়ির আসবাবপত্রও জীর্ণ হয়ে গেলে উপায় কী? তবুতো সব ঝেড়ে মুছে রেখেছে।

আর রান্না?

এরা আসামাত্রই কি করে যে সব বানিয়ে ফেলল।

ভোরবেলা বেরিয়ে বেলা একটা নাগাদ এখানে পৌঁছানো গেছে, আর বেলা দুটোর মধ্যে সব রেডি। টেবিলে খাবার সাজানো।

এরা তো হাঁ।

—ও বাসদেও —! তুমি তো জানতে না আমরা আসব। কি করে এতসব করলে? ব্যাসদেও চিরকালই অল্পভাষী। এখন আরো বেশী। কাজেই তার উত্তর শুধু দাড়ির খাঁজে একটু হাসির মত।

নীতুদের বাবার এখন আর ‘চোর’ ভাব নেই। বরং রাজার ভাব। যেন, কী? এখানে আনাটা খুব খারাপ হয়েছে?

—এ কী! শুধু আমাদের খালা? পল্টু তুই খাবি না?

—আরে আমায় তো ব্যাসদেও সেই বারোটার আগে খাইয়ে দিয়েছে।

—আচ্ছা পল্টু তোরা কি করে জানলি আমরা আসছি।

—মনে মনে!

—তাজ্জব। আসা মাত্রই চা। গোসলখানার চৌবাচ্চা ভর্তি জল। আর এই সব রান্না। নীতু দেখছিস? গোবিন্দভোগ চালের ভাত, ভাজা মুগের ডাল, আলু ভাজা, কপি কড়াইশুঁটির তরকারি, মুরগি, টমেটোর চাটনী। ভাবা যায় না। বল? পল্টু, বাজার করলো কে? আর কখনই বা? এখানে তো মাত্র হাটবার এর ওপরই নির্ভর।

ব্যাসদেও বলল, বাজার লাগবে কেন? সবই তো আপনার বাগানের। বাদে চাউল। ওটা স্টকে থাকে।

—সব বাগানের?

—জী হাঁ।

—আর মুরগী? সেও গাছে ফলে? হা হা হা।

—ও তো পোষা আছে।

বিজয়বাবু বললেন, পল্টু দেখছিস। বাবা কত বুদ্ধির কাজ করে রেখে গেছেন। আর আমার পুত্রকন্যা বাড়ি দেখে বলছিল কিনা এইরকম একটা অজজায়গায় এতবড় একখানা বাড়ি বানানোর কোনো মানে হয় না। দাদুর বাপু বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন ছিল না।

পল্টু তার স্বভাবগতভাবে হেসে ওঠে। বলেছে বুঝি? হা হা হা। ওদের খুব বুদ্ধি? হো হো হো।

অনেকদিন পড়ে থাকা বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে যেন সেই হাসিটা ধাক্কা মেরে মেরে আরো অনেকক্ষণ আওয়াজ তুলতে থাকে।

নীতু আর পিতুর গা ছমছম করে ওঠে!

মায়ের দিকে তাকায়। দেখে মাও কেমন ভয় ভয় চোখে দেওয়ালগুলোর দিকে তাকাচ্ছেন।

খেয়ে উঠে তো অনেকক্ষণ গল্প, বাগানে গিয়ে ফটো তোলা, পল্টু কাকাকে ক্যাসেট শোনানো হল। আর তার ফাঁকে ফাঁকে জোর আবদার — ও পল্টুকাকা, কখন তাস বের করবে, কখন ম্যাজিক দেখাবে?

–হবে হবে। একেবারে বিকেলের চা খেয়ে দোতলায় ওঠা হবে। অতঃপর সব ঘরে তো তালা চাবি লাগানো। শুধু ওই পিসেমশাইয়ের বড় ঘরটায় বসে ঘরটাই আমি খুলিয়ে নিয়েছি।

— বাপী কটা ফিল্ম এনেছ?

— চারটে।

–বেশ বেশ। পল্টুকাকা কাল ভোরবেলা বেড়াতে বেরিয়ে ছবি তোলা হবে কী বল?

— আরে আজ তো তুললি কতগুলো?

–ও তো বাড়ির লোকের। কাল প্রাকৃতিক দৃশ্যের তোলা হবে। ব্যাসদেও তুমি কিন্তু আজ ফাঁকি দিয়েছ। গ্রুপ ফটো তোলার সময় ‘কাজ আছে’ বলে পালিয়েছ। কাল সকালে তোমার লম্বা দাড়ির একটা ফটো তোলা হবে। হি হি হি।

বিকেলে চা খেতে খেতে নীতুদের মা বললেন, একটা আশ্চর্য! এতবছর কেবল মাত্তর নিজের ডালরুটি পাকিয়ে চালিয়ে এসেও ব্যাসদেওয়ের রান্নার হাত কী চোস্ত রয়েছে।

বিজয়বাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। বললেন, বাবা ওকে নিজে তালিম দিয়ে ভাল ভাল রান্না শিখিয়েছিলেন।

–রাত্রে কী খাওয়াবে ব্যাসদেও। বলল নীতু।

–যা আপনাদের মর্জি।

পিতু হি হি করে হেসে উঠে বলে, যা আমাদের মর্জি? যদি বলি বিগ বিগ চিংড়ির মালাইকারী, মাটন রোল, আর মোগলাই পরোটা?

ব্যাসদেও দাড়ির ফাঁকে একটু হাসি দেখায়, হোবে। সব হোবে।

হো হো হাসির রোল উঠল অর্থাৎ ব্যাসদেও ও ঠাট্টা তামাসা করতে জানে।

কিন্তু শুধুই হাসি গল্প চালালে চলবে কেন?

–ও পল্টুকাকা, তাস বের কর।

–বলছিস?

— বলছিই তো। আর দেরি করলে কিন্তু আমরা গিয়ে তোমার বাক্স হাতড়ে বের করে আনব।

পল্টু বলে ওঠে, আনবি কী, এনেই তো ফেলেছিস।

— অ্যাঁ। কই? কোথায়?

হঠাৎ দেখা গেল ঝড়ের সময় শুকনো পাতা ছিটকে আসার মত জানলা দিয়ে বাইরে থেকে সাহেব বিবি গোলামরা ছুটাছট ছিটকে চলে আসছে ঘরের মধ্যে।

দারুণ! – তার মানে শুরু হয়ে গেছে পল্টু কাকার ম্যাজিক।

এটি যে পল্টুর ‘নতুন অবদান’ তাতে সন্দেহ নেই। এরকমটি আগে কখনো দেখেনি এরা।

কিন্তু কী মুশকিল! এ যে এসেই চলেছে। ঘরের মেঝে, খাট, বিছানা, টেবিল, চেয়ার, আলমারির মাথা সব বোঝাই হয়ে গেল তাসে।

–ওরেব্বাস। বিজয়বাবু চেঁচিয়ে ওঠেন, ও পল্টু, এবার থামা। একী খেলা শিখে এসেছিস বাবা জাভা থেকে না কোথা থেকে? কশো জোড়া তাস এনেছিস বাবা?

নীতুদের মাও কোলের ওপর থেকে সাহেব বিবি টেক্কা দশদের ঝাড়তে ঝাড়তে বলেন, সত্যি বাবা। ও পল্টু ঠাকুরপো, এগুলো তাস না আমাদের চোখের ভ্ৰম? স্রেফ ইন্দ্রজাল?

নীতু আর পিতু কথাই বলতে পারছে না। দুজনে দুজনের সরে, প্রায় সেঁটে গেছে।

তারা সেই চিরাচরিত খেলাই দেখতে চেয়েছিল। যেমন ম্যাজিক দেখানেওয়ালার হাতের ছড়ানো তাস থেকে মনে মনে ভাবা একটি তাস, দশ হাত দূর থেকে চলে এল তার নিজের পকেটে। কিংবা প্যাকেটের বাহান্নখানা তাসই হয়ে গেল নীতুর ভাবা তাসটি। অর্থাৎ সবগুলোই চিড়িতনের টেক্কা বা ইস্কাবনের বিবি।

অথবা নীতু নিজে সাফল করে কোনো একটি তাস বেছে নিজের হাতের মধ্যে রেখে প্যাকেট ফেরত দিয়ে দেখল সেই তাস পল্টুকাকার সেই প্যাকেটের মধ্যে।

আর নীতুর কাছে রাখা তাসটা? সেটা একটা তাসই নয়। একখানা তাসের মাপের সাদা কার্ড।

এই সমস্তই দেখেছে নীতুরা আগে। তাতেই মোহিত হয়েছে, হৈ চৈ করেছে, চোখ গোল করেছে। এটা আবার কেমন বাবা!

আজ তো ওরা দুই ভাইবোন পরামর্শ করে রেখেছিল ভীষণভাবে চোখ ঠিকরে লক্ষ্য করে হাত সাফাই দেখবে পল্টুকাকার। এ খেলা সেদিক দিয়েই গেল না। গেল না মানে কী? যাচ্ছে না। ঘরের শিলিং থেকে বালি চাপড়া খসে পড়ার মত এখনো তাস ঝরছে।

পিতু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কেবল তাস জমে জমে পাহাড় হচ্ছে, ম্যাজিক দেখব কখন?

— কী মুশকিল, এটা ম্যাজিক নয়? হো হো করে হেসে উঠল পল্টু।

আবার সেই পুরনো বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে হাসির প্রতিধ্বনি।

এখন বেলা পড়ে গিয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে।

পল্টু বলল, তো দেখ বাবা বাহান্নখানার খেলাই দেখ। বলে হুশ করে একবার কাক তাড়ানোর মত হাত নাড়ল পল্টু। আর সেই তাসের পাহাড় এক পলকে গুছিয়ে একটি ছিমছাম প্যাকেট হয়ে পল্টুর বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে। ঘরে আর কোথাও নেই একখানিও তাসের চিহ্ন।

এখন হাততালির ধূম।

বিজয়বাবু বললেন, নাঃ অনেক নতুন খেল্‌ শিখে ফেলেছিস দেখছি এই দু- তিন বছরে। এসব খেলা কোথা থেকে শেখা রে পল্টু?

পল্টু হেসে ওঠে, কেন? তুমি সেখানে গিয়ে শিখে নেবে? অমন কাজটি করো না।

নীতুর মা হেসে ওঠেন, হ্যাঁ, তোমার দাদাটি নইলে আর কে তাসের ম্যাজিক শিখবে। কোনটা কী তাস তাই জানে কিনা সন্দেহ।

এই সময় হঠাৎ কে যেন ঘরে একটা পেট্রোম্যাক্স বসিয়ে দিয়ে গেল।

কিন্তু কে ও? ও তো ব্যাসদেও নয়। দাড়ি কই ওর?

বিজয়বাবু একটু চমকালেন, কে লোকটা?

পল্টু বলল, আরে ব্যাসদেওয়ের একটা ভাইপো আছে কাছাকাছি। কাকার সাহায্য করতে আসে। কাল ও আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল। আসলে বুড়ো এই আলোটা জ্বালাতে জানে না।

হেসে ওঠে পিতু, এত ভাল ভাল রান্না করতে পারে আর একটা হ্যাজাক জ্বালতে পারে না?

–সবাই কি সব পারে?

পল্টু আবার হেসে ওঠে, আর বলে, এই যে বিজুদা এত মোটরগাড়ি চালাতে পারে, আমি একটা গরুর গাড়িও চালাতে পারি না।

এই রকমই কথাবার্তা পল্টুর। না হাসিয়ে ছাড়ে না। বিয়েটিয়ে করেনি, কেবল বাউন্ডুলের মত ঘুরে বেড়ায় আর ম্যাজিক শেখে এবং দেখায়।

ম্যাজিকের একটা দলও আছে তার।

তবে সে সব তো জগঝম্প আসবাব পত্র নিয়ে। এমন ঘরোয়া আসরে চলে না। তাসই বেস্ট। সর্বত্র চলে।

সেই তাসের পাহাড়কে বাহান্নখানায় দাঁড় করিয়ে পল্টু এবার তার সেই পুরনো খেলা দেখাল কিছু কিছু। যাতে সকলের আনন্দ। তবে তার সঙ্গে নতুন কিছুও জুড়ল, রীতিমত রোমাঞ্চকর।

যেমন নীতুর পকেটে রাখা হরতনের নহলাকে একটা একশো টাকার নোট করে দেওয়া।

আবার তাসকে দোকানের ক্যাসমেমো, লন্ড্রির বিল, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, বাসের টিকিট, ছেঁড়া শালপাতা বানানো এইরকম সব অনেক খেলা।

নিথর পাথর হয়ে বসে দেখতে দেখতে কখন যে রাত দশটা বেজে গেছে কেউ টের পায়নি। সিঁড়ির সামনে একটা গলা খাঁকারি। দরজার কাছে সাদা দাড়ির আভাস।

বিজয়বাবু বলে উঠলেন, ছি ছি, কত রাত হয়ে গেল। চল চল খেয়ে নেওয়া যাক। বেচারা বুড়োমানুষ এতক্ষণ বসে আছে।

বসে আছে কী? হি হি দু’ভাইবোন একসঙ্গে হি হি করে হেসে ওঠে, ও এতক্ষণ বাগানের গাছ থেকে বিগ বিগ গলদা চিংড়ি পেড়ে মালাইকারী রাঁধছিল।

সিঁড়িতে নামার সময় পল্টু আবার একটু নতুন খেলা দেখিয়ে মাৎ করে দিল। তাসেদের অর্ডার দিল, এই তোরা সব যেখান থেকে এসেছিলি, সেখানে ফিরে যা।

আর বলা মাত্রই তাসগুলো বোঁ বোঁ করে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বিজয় গিন্নী সরে এসে মেয়ের হাত ধরলেন। মেয়ে ভাইয়ের হাত। এ কী সাঙ্ঘাতিক খেলা বাবা। পি সি সরকারের মানুষকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলার থেকে কিছু কম নয়। যেন অলৌকিক। অথবা ভৌতিক

যাই বলিস পল্টু, এই বছর দুই তিন বাইরে ঘুরে এসে অনেক লাভবান হয়েছিস।

— লাভবান? তা হবে?

আবার সেই পেটেন্ট হাসি পন্টুর হা হা হা। যেটা কলকাতার বাড়িতে খুবই আনন্দের আর মজাদার। কিন্তু গাড়িতে ঠাকুর্দার আমলের এই খাঁ খাঁ করা বিশাল বাড়িটায় যেন গা ছমছমানো।

কিন্তু খাবার টেবিলে বসে তার শতগুণ গা ছমছমানি।

টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে ব্যাসদেও।

ফুটখানেক করে লম্বা সাইজের গলদা চিংড়ির কারি, মটনরোল, মোগলাই পরোটা।

নীতু বলল, আমার খেতে ভয় করছে।

পিতু বললো, লোকটা ভূত না ভগবান?

ওদের মা বললেন, ওকেও কি ম্যাজিক শিখিয়ে ফেলেছ পল্টু ঠাকুরপো? তাসের মত কারবার। ডাল রুটিকে এইসব দেখছি। যেমন বাহান্নখানা তাস বারশো হয়ে যাওয়া।

শুধু বিজয়বাবুই তারিফ করে খেতে লাগলেন। এবং রাত্রে তিনি আর পল্টু একটা ঘরে এবং বাকিরা আর একটা ঘরে শুয়ে পড়ল।

কথা হল পরদিন ভোরে সবাই মিলে গাড়ি নিয়ে বেড়াতে বেরনো হবে। বারান্দার ওধারে হাতমুখ ধোবার জন্যে দু বালতি ভর্তি জল।

মা বললেন, লোকটা ময়দানব না কী রে বাবা?

–ও মা, এ সেই সিনেমার ‘গল্প হলেও সত্যি’র কাজ করার লোকের মত।

— যা বলেছিস।

–ব্যাসদেও। আমাদের কিন্তু পাঁচটার সময় চা চাই।

–জী হাঁ! সেলাম ঠুকে চলে গেল ব্যাসদেও।

আর বলব কী পাঁচটার আগে উঠে পড়েও নীতুরা দেখল দোতলায় বারান্দায় বেতের টেবিলের ওপর টিকোজি ঢাকা দিয়ে চা আর কাপ ডিশ চিনি-টিনি ইত্যাদি সাজানো।

বিজয়বাবু বললেন, হোটেল বলে আক্ষেপ করছিলে, কটা ভাল হোটেলে তুমি এমন সার্ভিস পাবে? কোন একটা জিনিস চাইলে তো দিতে ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। যাক চটপট রেডি হও।

কিন্তু পল্টুকাকা?

–বাপী পল্টুকাকা কই?

বিজয়বাবু বললেন, সে তো বাপু কখন উঠে পড়েছে জানি না। ঘুম ভেঙে তো দেখছি না।

–বাঃ চা খাবে না? দেখ কোথায়?

–সে হয়তো ব্যাসদেওর সঙ্গে চা খেতে লেগে গেছে। পল্টু দাদাবাবুর ওপর ভারি ভক্তি ব্যাসদেওর।

বিজয়বাবু সিঁড়ির ধারে এসে গলা তুলে হাঁক পাড়লেন, পল্টু! পল্টু! ব্যাসদেও। বাসদেও।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। কোথায় বা পল্টু কোথায় বা ব্যাসদেও। রান্নাঘরের দরজায় শুধু শেকল তোলাই নয়, তাতে একটা মর্চে পড়া তালাও লাগানো। এই ভোর সকালে দুটোতে গেল কোথায়

— আর কোথায়। এতজনের ‘ভোজ’-এর রসদ জোগাড় করতে।

–এত ভোরে এখানে বাজার বসে?

–আরে না না, এসব দেহাতি জায়গায় চাষীদের বাড়ি থেকে জিনিষ নিয়ে আসা যায়। সব্জি, ফল, ডিম, দুধ, মাখন। দেখেছি; আগে।

পিতু হি হি করে হেসে বলে ওঠে, আর চুপি চুপি এনে রেখে বলা যায়, বাগানে ফলেছে।

কিন্তু কই রে বাবা আসছে কই?

–নাঃ। বেড়ানোটা মাটি করল দুটোয়।

—নাঃ। মার্ডার কেস। রোদ উঠে গেল। দেখা নেই ওদের।

এদের সাজা গোজা রেডি। গাড়িতে ক্যামেরা তোলা হয়ে গেছে। কিছু খাবার দাবারও।

–ও বাপী, কী হবে? জমিতে চাষ করিয়ে সব্জি টজি আনছে না কী তোমার ব্যাসদেও?

বাপী বললেন, সত্যি এত দেরি করছে কেন? যাক, এক কাজ করা যাক, গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়া হোক। চারদিকে তাকাতে তাকাতে যেতে হবে। নিশ্চয় দেখা হয়ে যাবে।

তবে তাই! ছটফটানিটা তো কাটুক। কোথাও বেরবার সময় যদি কারো জন্যে অপেক্ষা করতে হয় তার থেকে যন্ত্রণা আর নেই।

বেরনো হল। এবং চারজনের চার দুগুণে আটটা চোখ রাস্তার আশপাশ সামনে পিছনে তদন্ত করতে করতে চলল।

কিন্তু কোথায় কী? নো পাত্তা। দু দুটো মানুষ যুক্তি করে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। অন্য কোন রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেনি তো? দূর আবার রাস্তা কোথায়? আচ্ছা বাগানে ছিল না তো? দূর! অত চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করা হলো।

এইসব বলাবলির মধ্যে হঠাৎ এক কান্ড হয়ে গেল। বিজয়বাবুর গাড়িকে ‘ভুলভুলাইয়া’ পেয়ে বসল। যেদিক দিয়েই এগোতে যান ঘুরে ফিরে সেই একই রাস্তা।

–কী হল বাপী?

— বুঝতে পারছি না তো। বিজয়বাবু বলেন, গাড়ির ওপর কন্ট্রোল রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন নিজের ইচ্ছে: চলছে।

— বাপী কোন কিছু না ভেবে কোনো একদিকে সোজা বেয়ে যাও।

— তাতে কী হবে?

— এই গোলকধাঁধাটা থেকে বেরিয়ে পড়া যাবে।

— কিন্তু তারপর? রাস্তাটা চেনাবে কে?

–চেনাবে রাস্তার লোক। জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে।

–কিন্তু জিজ্ঞেস করার মত লোকই বা কোথায়? এমননিতেই তো ফাঁকা মেঠো রাস্তা। যাও বা দুএকজন যাচ্ছে, তারা নেহাতই বোবা মত।

দেখতে দেখতে অনেক দূর আসা হয়ে গেল। কী ভাগ্যি হঠাৎ একটি ভব্যিযুক্ত লোককে দেখতে পাওয়া গেল। মধ্য বয়সী। বোধহয় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এই অক্টোবরেও গলায় কার্টার মাথায় টুপি। গায়ে ধুতির ওপর লম্বা কোট।

বিজয়বাবুর প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন।

— গানুডি এখান থেকে কত দূর? গাডিতেই তো রয়েছেন মশাই।

বিজয়বাবু নিজে মনে মনে অবাক হন। এতখানি গাড়ি চালিয়ে এসেও তবে চটপট সামলে নিয়ে বলেন, না মানে গাড়ির ‘চারুকুটিরের’ রাস্তাটা …

–চারুকুটির। ভদ্রলোক আরও অবাক হয়ে বলেন, চারুকুটির? কোন চারুকুটির?

বিজয়বাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, চারুকুটির এখানে কটা আছে মশাই আমার জানা নেই। আমি খাসনবীশদের চারুকুটিরের কথা বলছি। স্বৰ্গীয় অজয় খাসনবীশের বাড়ি।

–মাই গড। অজয় খাসনবীশের চারুকুটির। সেইখানে আপনারা উঠতে যাচ্ছেন?

নীতু আর পারে না। টনটনে গলায় বলে ওঠে, উঠতে যাব কেন? সেইখানেই তো আছি। শুধু সকালে বেড়াতে বেরিয়ে একটু রাস্তা গুলিয়ে ফেলে …

–সেইখানে আছো? মানে চারুকুটিরে? মানে খাসনবীশের চারুকুটিরে?

নীতু গলা আরো টনটনে করে, তা এত অবাক হচ্ছেন কেন? থাকব না কেন? বাড়িটা তো আমাদের নিজেদেরই। ওই অজয় খাসনবীশ তো আমাদের দাদু ছিলেন।

ভদ্রলোক মুখটা পাথুরে করে বললেন, কতদিন পরে এসেছ এখানে?

–অনেকদিন পরে।

–হ্যাঁ সে তো বুঝতেই পারছি। তো করে এসেছ? এই বাড়িতে ছিলে নাকি?

— ছিলামই তো।

ভদ্রলোক যেন একদল পাগলকে দেখছেন, এইভাবে এদের দলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ছিলে, কোথায় শুয়েছিলে?

–কেন দোতলার ঘরে। কত ঘর। খাট বিছানা সবই আছে।

–বটে। তো খাওয়া দাওয়া কোথায় করেছিলে?

বিজয়বাবু বিজয়গিন্নী এবং পিতু তিনজনেই বুঝে ফেলেছেন লোকটা সুবিধের নয়। নীতুর সঙ্গে চালাকি খেলছে।

পিতু অলক্ষ্যে নীতুকে একটা চিমটি কাটল। কিন্তু নীতু এখন মরীয়া। রাগের গলায় বলল, কোথায় আবার বাড়িতেই। বুড়ো মালি রান্না বান্না করে দিল। সে যা ফার্স্টক্লাস রান্না

–বুড়ো মালি? ব্যাসদেও? পাকা দাড়ি?

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, চেনেন তাকে?

— চিনতাম।

ভদ্রলোক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সে তোমাদের রান্না করে খাইয়েছে। সে তো অনেক দিন হল মারা গেছে।

বিজয়বাবু এখন হাল ধরেন। বলেন, এ কী তামাসা মশাই? ব্যাসদেও কাল দুবেলা আমাদের চব্যচোষ্য খাইয়েছে। আজও সকালে চা বানিয়ে …

ভদ্রলোক শিউরে উঠে বলেন, এখনো আপনারা টিকে আছেন? খুব লাকের জোর বলতে হবে। যে লোক আজ সাত-আট বছর, কি দশ বছর আগে বাগানে কাজ করতে করতে ইঁদারায় পড়ে মারা গিয়েছিল। পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও আসেনি। পাড়ার কেউ ও মুখো হতে যায়নি। কাজেই লাশ উদ্ধার হয়নি। ইঁদারার মধ্যেই সলিল সমাধি। এবং সেই থেকে ওইখানেই তার প্রেতাত্মা বসবাস করছে।

–কী?

–কী আর? সোজা বাঙলায় ভূত হয়ে রয়ে গেছে। ইদানিং নাকি আবার রাতের দিকে খুব হা হা হাসির শব্দ শোনা যায়। অবশ্য বাড়ি বলতে আর তেমন কিছু নেই। বিশাল বাগান শুকিয়ে যাওয়ায় জঙ্গলে ভরে গেছে। বাড়িটা গাছপালা আর জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য। লোকে ও রাস্তা দিয়ে বড় একটা হাঁটে না।

রাগে মাথা জ্বলে যায় নীতুর। তীক্ষ্ণ গলায় বলে, আপনি বোধ হয় অন্য কোন চা রুকুটিরের কথা বলছেন।

ভদ্রলোকও কড়া গলায় বলেন, তা হবে, আমরা মানে এখানের সবাই অজয় খাসনবীশের চারুকুটিরের হিস্ট্রি জানি। ইচ্ছে করলেই আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন। ওই ভাঙা মসজিদের মোড়টা ঘুরলেই …

হতভম্ব বিজয়বাবু আস্তে বলেন, আমারই বোধহয় ভুল হচ্ছে। আমাদের সেই চারুকুটির তো অনেক দূরে। প্রায় আধঘন্টা গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছি। … কিন্তু বাড়ির নাম, মালির নাম দুই মিলে যাবে। স্ট্রেঞ্জ। কাইন্ডলি যদি গাড়িটায় উঠে এসে আমায় দেখিয়ে দেন। বড় ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছি।

আসলে কিন্তু বিজয়বাবু এই লোকটাকেই সন্দেহ করছেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে লোকটা ভাঁওতাবাজ। অকারণ বিভ্রান্ত করতে চায়। এই রোগ থাকে অনেকের।

ভদ্রলোক উঠে এলেন গাড়িতে। তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, শুধু ধাঁধা! সে তো রক্ষে। মারা যে পড়েন নি এই ঢের। চারুকুটিরে থেকেছেন, রাত কাটিয়েছেন, বুড়ো মালির হাতের রান্না খেয়েছেন। ওরে বাপ! শুনেই মাথা ঘুরছে মশাই। … ওই তো সামনে। ওই ঝোপঝাড় জঙ্গল গজানোর মধ্যে সামনের গেট। আমায় এখানেই নামিয়ে দিন মশাই। আর যাচ্ছি না।

প্রায় চলন্ত গাড়িটা থেকে নেমে পড়ে ভদ্রলোক উল্টোমুখো চোঁ চোঁ দৌড়তে থাকেন।

আর সপরিবার বিজয়বাবু? নীতু পিতু আর তাদের মা?

স্তম্ভিত হয়ে দেখতে পান পোড়োবাড়ির লতাগুল্ম গাছগাছালির আড়ালের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কব্জা ভাঙা গেটটার ঝুলে পড়া একটা পাল্লায় কোণ ছিঁড়ে বাঁকা হয়ে ঝুলছে কাঠের নেম প্লেটটা। কালো জমিতে সাদা দিয়ে লেখা।

‘চারুকুটির’।

এ কে খাসনবীশ!

নিচে একটা তারিখ রয়েছে যেটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এবং এই খানিক আগে যেটা দেখে নীতু বলেছে বাপী, উনিশশো কত? গেটের ফাঁক থেকে সেই নাক খ্যাঁদা হাত ভাঙা ফাটাচটা পরী-পুতুলটা দেখা যাচ্ছে। সকালের রোদে ভরা আকাশ। দেখে বুঝতে ভুল হয় না এ বাড়িতে বহুকাল মানুষের পা পড়েনি।

নীতু মাথা উঁচু করে ওপর দিকে তাকালো। দোতলার ঘরটা দেখা যাচ্ছে। আগাছার জঙ্গল অতটা পর্যন্ত উঠতে পারেনি। কার্নিশ ভাঙা, খড়খড়িটার একটা জানলার পাল্লা হাট করে খোলা। ওই ঘরটায় বসেই না তারা কাল রাত্রে তাসের ম্যাজিক দেখছিল।

— দিদি। দেখছিস

—কী দেখবে দিদি?

আচমকা একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠল। আর সাঁই সাঁই করে মুঠো মুঠো শুকনো পাতারা সেই জানলা দিয়ে ঢুকতে লাগল। কিন্তু ওগুলো কী গাছের পাতা? না তাসের সাহেব বিবি গোলাম টেক্কার দল?

কিভাবে কোন পথে গাড়ি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ফিরে আসতে পেরেছেন বিজয়বাবু তা তিনিই জানেন। বিজয়গিন্নী তো সারা রাস্তা কপাল চাপড়েছেন, তাঁর রাশি রাশি শাড়ি ভরা সুটকেসটা আর গাদা জিনিস সেই ভূতের বাড়িতে পড়ে রইল। আর পিতু নীতু মাঝে মাঝেই ডুকরে উঠছে, ও বাপী! আমরা যে ভূতের হাতে খেলাম। আমাদের কী হবে? ও বাপী সেই মোগলাই পরোটা, চিংড়ির কারি যে আমাদের পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে।

বাপী বললেন, রাতদিন কত ভুতুড়ে জিনিস আমাদের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ছে তার হিসেব জানিস? এই যে লোকজন সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে কে মানুষ আর কে ভূত কে জানে?

যাক একটা জিনিস বেঁচেছে। সেটা হচ্ছে ক্যামেরা। গাড়িতেই ছিল। কিন্তু গাড়ির পেছনে এসব কোথা থেকে এল? নীতুদের মার সেই শাড়ির সুটকেস, বাক্স, বিছানা, ব্যাগ ব্যাগেজ। … কে কখন রেখেছিল এর মধ্যে?

একটি জিনিসও খোয়া যায়নি। মায় বিজয়বাবুর সিগারেট কেসটা পর্যন্ত। সব কিছু সযত্নে রাখা রয়েছে।

সেসব নামাতে নামাতে বিজয়বাবু গম্ভীরভাবে বলেন, বুঝতে পারছ জগতে কে মানুষ কে ভূত বোঝা শক্ত। যার মধ্যে ‘মনুষ্যত্ত্ব’ থাকে সে মরে ভূত হয়ে গিয়েও মনুষ্যত্ব বজায় রাখে। এখন বল গ্যাংটকের বদলে গাড়ি গিয়ে তোমাদের

লোকসান হল? না লাভ হল?

নীতুরা দু ভাইবোনেই চেঁচিয়ে উঠল, লাভ লাভ। আর কেউ কখনো আমাদের মত ভূতের সঙ্গে থেকেছে? ভূতের হাতে খেয়েছে? কপালে লেখা না থাকলে এমন হয়? আহা ― বন্ধুরা কি বিশ্বাস করবে?

কিন্তু পল্টুকাকাও কী?

না কি ওঁর চলে যাওয়াটা ওঁর স্বভাবগত খেয়ালীপনা? কে বলতে পারে আবার হঠাৎ কোনদিন কোথাও উদয় হয়ে বলে উঠবেন, কি রে নীতু চিনতে পারিস?

সকল অধ্যায়

১. টমসাহেবের বাড়ী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৩. দিনে দুপুরে – বুদ্ধদেব বসু
৪. ঠিক দুপুরে আকাশকুসুম – স্বপন বুড়ো
৫. রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬. লোকসান না লাভ – আশাপূর্ণা দেবী
৭. মাঝরাতের কল – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. ওয়ারিশ – লীলা মজুমদার
৯. তান্ত্রিক – ধীরেন্দ্রলাল ধর
১০. বোধহয় লোকটা ভূত – শুদ্ধসত্ত্ব বসু
১১. ছক্কা মিঞার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১২. ভূতেরা বিজ্ঞান চায় না – অদ্রীশ বর্ধন
১৩. হুড়কো ভূত – অমিতাভ চৌধুরী
১৪. ভূতে পাওয়া হরিণ – সংকর্ষণ রায়
১৫. মড়ার মাথা কথা বলে – রবিদাস সাহারায়
১৬. ফ্রান্সিসের অভিশাপ – শিশিরকুমার মজুমদার
১৭. সত্যি ভূতের মিথ্যে গল্প – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. শব্দের রহস্য – বিমল কর
১৯. পুরনো জিনিষ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২০. ভাড়া বাড়ি – মঞ্জিল সেন
২১. জ্যোৎস্নায় ঘোড়ার ছবি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. শাঁখারিটোলার সেই বাড়িটা – লক্ষ্মণকুমার বিশ্বাস
২৩. হাসি – বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ভূতুড়ে রসিকতা – আনন্দ বাগচী
২৫. ভূতেশ্বরের দরবারে কোয়েল – জগদীশ দাস
২৬. ভূত আছে কি নেই – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৭. ভূতের সঙ্গে লড়াই – শেখর বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন