লীলা মজুমদার
এ মুলুকে রাতবিরেতে বাস ফেল করলে ছক্কামিয়ার টমটম ছাড়া আর উপায় ছিল না। ঝড় বৃষ্টি হোক, মহাপ্রলয় হোক, রাতের বেলা ভীমপুর গদাইতলা দশ মাইল পিচের সড়কে যদি কষ্ট করে একটু দাঁড়িয়ে থাকা যায়, ছক্কা মিয়ার টমটমের দেখা মিলবেই মিলবে। অন্ধকার ঝড় বৃষ্টির মধ্যে প্রথমে ঠাহর হবে এক চিলতে আলো। তারপর আলোটা এগিয়ে আসবে আর এগিয়ে আসবে মেঘের ডাকাডাকি যতই থাক, কানে বাজবে অদ্ভুত এক আওয়াজ টং লং …টং লং …টং লং। বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়বে কালো এক এক্কাগাড়ি তেরপলের চৌকা একটা টোপর চাপানো। সামনে কালো এক মূর্তি আর নড়বড় করে দৌড়ানো এক টাট্টু।
মুখে কিছু বলার দরকার নেই। ছক্কা মিয়ার টমটম সওয়ারি দেখামাত্র থেমে যাবে। তখন একলাফে পেছনের তেরপল চালিয়ে চৌকা টোপরে ঢুকলেই নিশ্চিন্ত। আবার টলতে টলতে চলতে থাকবে ছক্কা মিয়ার টমটম – টং লং …টং লং।
টমটম কথাটা এসেছে ইংরেজী ‘ট্যান্ডেম’ থেকে–যে গাড়ির সামনে কয়েক সার ঘোড়া যোতা। কিন্তু ভীমপুরের ছক্কা মিয়ার এক্কাগাড়ির ঘোড়া মোটে এক। তবু আদর করে লোকে নাম দিয়েছিল টমটম।
ছক্কা মিয়ার চেহারাটি কিন্তু ভারী বদরাগী। ঢ্যাঙ্গা, টিঙটিঙে রোগা, একটু কুঁজো গড়ন। লম্বাটে মুখের বাঁকানো নাকের তলায় পেল্লায় গোঁফ। চামড়ার রঙ রোদপোড়া তামাটে।
তেমনি তার টাট্টুও। যেমন মনিব, তেমনি ঘোড়া। হাড় জিরজিরে লম্বাটে গড়ন। ঠ্যাং চতুষ্টয় যেন চারখানি কাঠি। মাথাটা দেখে সময় সময় ঠাহর করা কঠিন, এই প্রাণীটি সিংঙ্গি, না প্রকৃত একটি ঘোড়া। হ্রেষাধ্বনি করলেই পিলে চমকে ওঠে। ভীমপুর বাজারের তাবৎ নেড়ি কুকুর দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায় লেজ গুটিয়ে।
লোকে আজকাল রাস্তা চলতে বাস-রিকশোই পছন্দ করে। ছক্কা মিয়ার টমটম চড়লে হাড় মাংস দলা পাকাতে থাকে বলেও না। কালের রেওয়াজ আসলে।
কিন্তু ওই যে বলেছি, রাতবিরেতে বাস ফেল করলে তখন উপায়? ছক্কা মিয়া এটা বোঝে এবং দিনে তার টমটমের বাহনটিকে নিয়ে বনজঙ্গল বা ঝিলে চরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। রাতের বেলা ছোট্ট বাজারের চৌরাস্তায় শিরীষ গাছের তলায় ঘাপটি পেতে বসে থাকে। পাশেই টমটম রেডি। …
সেবার পূজোর সময় কলকাতার থেকে ছোটমামার সঙ্গে আসছি। মাঝপথে একখানা ট্রেন দাঁড়িয়ে রইল তো রইল। আর নড়ার নাম নেই। ব্যাপার কী? না—আগের স্টেশনে মালগাড়ি বেলাইন। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। তারপর যখন ট্রেনের চাকা গড়াল, ছোটমামা বেজার মুখে বললেন, ‘বরাতে আবার হতচ্ছাড়া ছক্কা মিয়ার টমটম আছে। বাপস্!’
ওই টমটমে কখনও চাপিনি। তাই কথাটা শুনে আমার আনন্দ হয়েছিল। বললুম, ‘খুব মজা হবে তাই না ছোটমামা?’
ছোটমামা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘মজা হবে! বুঝবে ঠ্যালাটা ’খন।’
ঠ্যালাটা কিসের বুঝলাম না আগেভাগে। দেখলাম, ছোটমামা ট্রেনের জানলা দিয়ে মুন্ডু বাড়িয়ে বারবার যেন আকাশ দেখছেন। একটু পরে বললেন, ‘খুব ঝড় বৃষ্টি হবে। কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলাম! বড়দা অত করে বললেন, তবু থাকলুম না। ছ্যা ছ্যা, আমার কী আক্কেল।’
ভীমপুর স্টেশনে যখন নামলুম, তখনও কিন্তু ঝড় বৃষ্টির পাত্তা নেই। রাত একটা বেজে গেছে। বাজার নিশুতি। চৌমাথায় শিরীষতলায় গিয়ে দেখি, ছক্কা মিয়ার টমটম দাঁড়িয়ে আছে। বলা-কওয়া নেই, দরদস্তুর নেই, ছোটমামা টমটমের পেছন দিকে তেরপল তুলে ঢুকে ডাকলেন, হাঁ করে দেখছিস কী? উঠে আয়। এক্ষুণি একগাদা লোক এসে ভাল জায়গা দখল করে ফেলবে যে।’
ভেতরে খড়ের পুরু গাদার উপর তেরপল পাতা। কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ অন্ধকারও বটে। যেন এক গুহায় ঢুকেছি। সামনে সরে গিয়ে ছোটমামা পর্দাটা ফাঁক করে রাখলেন। একটু পরে আরও জনা দুই লোক ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে এক ঠাসাঠাসি অবস্থা।
আর তারপরই আচমকা চিক্কুর ছেড়ে মেঘ ডাকল এবং শনশন করে এসে গেল একটা জোরালো হাওয়া। ছোটমামা বললেন, ‘ওই যা বলেছিলুম। হল তো?’
ছক্কা মিয়া সামনের আসন থেকে ঘোষণা করল, ‘আরাম করে বসুন বাবুমশাইরা। এবার রওনা দিই।’ তার ঘোড়াটাও মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চি হি হি ডাক ছেড়ে যখন পা বাড়াল, তখন টের পেলাম কেন ছোটমামা ‘বাপস্’ বলে মুখখানা তুম্বো করেছিলেন।
সত্যি ‘বাপস্’। হাড়গোড় মড়মড়িয়ে ভেঙে যাবার দাখিল। বাইরে হাওয়ার হইচই আর মেঘের হাঁকডাক যত বাড়ছে, ছক্কা মিয়ার ঘোড়াটাও তত যেন তেজী হয়ে উঠছে। একটু পরেই দড়বড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টপ্পরের তেরপলে পড়তে শুরু করলে ছোটমামা ফাঁকটুকু বন্ধ করে দিলেন। আমি তখন অবাক। ছক্কা মিয়া বাইরে বসে চাবুক হাঁকাচ্ছে। ওর বৃষ্টির ছাঁট লাগবে না?
রাস্তাটা ঘুরে রেল লাইন পেরুলে দুধারে বিশাল আদিগন্ত মাঠ। ফাঁকা জায়গায় ঝড় বৃষ্টিটা ছক্কা মিয়ার টমটমকে বেশ বাগে পেল। প্রতি মুহূর্তে মনে হছিল এই বুঝি উল্টে গিয়ে রাস্তার ধারে গভীর খালে নাকানি চুবানি খাবে। আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেও ভাববার কথা।
কিন্তু আশ্চর্য, টমটম সমান তালে নড়বড়িয়ে টলতে টলতে চলেছে। মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টির শব্দের ভেতর শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত এক শব্দ – টং লং … টং লং টং লং …। কখনও ছক্কা মিয়ার টাট্টু ঘোড়া বিকট চি হি হি করে চেঁচিয়ে উঠছে। তারিফ করে আমার পেছন থেকে এক সওয়ারি বলে উঠলেন, ‘পক্ষিরাজের বাচ্চা।’
এতক্ষণে তেরপলের টোপর থেকে ফুটো দিয়ে জল চোঁয়াতে থাকল। সওয়ারিরা নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সরবে কোথায়? বেহদ্দ ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছিল জামাকাপড়। এক সময় ছোটমামা হঠাৎ বাজখাঁই চেঁচিয়ে বললেন, ‘আঃ হচ্ছে কী, হচ্ছে কী মশাই? আমার ওপর পড়ছেন কেন?
‘আপনার ওপর আমি পড়লুম, না আপনি আমার ওপর পড়লেন?’
‘কী বাজে কথা বলছেন? আমায় ঠান্ডা করে দিয়ে আবার তক্ক? আপনি মানুষ, না বরফ?’
‘আমি বরফ? আপনিই তো বরফ। ইস। কী ঠান্ডা! হাড় অব্দি জমে গেল দেখছেন না।’
আমার পিছনের সওয়ারি চাপা খিকখিক করে হেসে আমার কানের ওপর বলল, ‘ঝগড়া বেধে গেছে। বরাবর যায়, বুঝলেন তো মশাই? ছক্কা মিয়ার টমটমের এই নিয়ম। খিকখিক খিকখিক।’
এমন বিদঘুটে হাসি কখনো শুনিনি। কিন্তু এঁর শ্বাসপ্রশ্বাসও যে বরফের মত হিম। বললুম, ইস। একটু সরে বসুন না! বড্ড ঠান্ডা করে যে!’
লোকটা ভারি অদ্ভুত। সে ওই বিদঘুটে খিক্ ধিক্ ধিক্ হাসতে হাসতে আরও যেন ঠেসে ধরল আমাকে। চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ছোটমামা! ছোটমামা।’
কিন্তু ছোটমামার কোন সাড়া পেলাম না। টোপরের ভেতরটা ঘন অন্ধকার। ফের ডাকলুম, ‘ছোটমামা! কোথায় তুমি?’
লোকটা সেই খিক্ খিক্ হাসির মধ্যে বলল, ‘আর ছোটমামা বড়মামা! মামারা এখন রাস্তায় পড়ে কুস্তি করছে।’
হতভম্ব হয়ে হাত বাড়িয়ে ছোটমামাকে খুঁজলাম। স্যুটকেসটা হাতে ঠেকল। কিন্তু সত্যিই ছোটমামা নেই। তারপর পেছনের দিকে চোখ পড়ল। ওদিককার পর্দাটা যেন ফর্দাফাঁই। বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢুকছে। আমি প্রচন্ড চেঁচিয়ে বললাম, ‘ছক্কা’, মিয়া। ছক্কা মিয়া। গাড়ি থামাও! গাড়ি থামাও!
পেছনের সওয়ারি ফের সেই বিদঘুটে হেসে উঠল। এবার আমি সামনের পর্দা সরিয়ে ছক্কা মিয়ার ভেজা জামাটা খামচে ধরলুম। ‘গাড়ি থামাও, গাড়ি থামাও বলছি।’
এতক্ষণে যেন ছক্কা মিয়া আমার কথা শুনতে পেল। ঘুরে বলল, ‘কী হয়েছে বাবুমশাই?’
‘ছোটমামা পড়ে গেছেন কোথায়।’
ছক্কা মিয়া বলল, ‘বালাই ষাট! পড়বেন কোথায়? ঠিকই আছেন। খুঁজে দেখুন না।’
‘নেই। তুমি গাড়ি থামাবে কিনা বলো!
‘সামনে একটা মন্দির আছে। সেখানে থামাব।’ ছক্কা মিয়া চাবুক নেড়ে ঘোড়াটাকে খুঁচিয়ে দিয়ে বলল, ‘যেখানে সেখানে থামলে ঝড় বৃষ্টিতে কষ্ট পাবেন বাবুমশাই। বুঝলেন না? ওইখানে থামিয়ে আপনার ছোটমামাকে খুঁজবেন বরঞ্চ।’
মন্দিরের আটচালার সামনে গাড়ি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ছক্কা মিয়ার পাশ দিয়ে লাফ দিলুম। তারপর আটচালায় ঢুকে পড়লুম। বুদ্ধি করে ছোটমামার স্যুটকেস আর আমার কিটব্যাগটাও দুহাতে নিয়েছিলাম।
কিন্তু আটচালায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম, ছক্কা মিয়ার টমটম বৃষ্টির মধ্যে আচমকা গড়াতে শুরু করেছে। ঘোড়াটা চি হি হি ডাক ডাকে তেমনি নড়বড়ে পায়ে দৌড়তে লেগেছে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। মুখে কথাটি পর্যন্ত আর ফুটল না। ভারি অদ্ভুত লোক তো ছক্কা মিয়া।
এখন ঝড়টা প্রায় কমে এসেছে। বৃষ্টি সমানে পড়ছে। নির্জন আটচালায় দাঁড়িয়ে আছি। প্যান্ট শার্ট ভিজে চবচব করছে। প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা আর কি।
কিছুক্ষণ পরে বিদ্যুতের আলোয় দেখি, কে যেন আসছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘কে কে?’
ছোটমামার সাড়া এল। অন্তু নাকি রে?
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম, হ্যাঁ। তোমার কী হয়েছিল ছোটমামা? ছোটমামা আটচালায় ঢুকে বললেন, ‘কী হবে আবার? যা হবার, তাই হয়েছিল। তবে ব্যাটাকে এবার যা জব্দ করেছি, আর কখনো ছক্কা মিয়ার টমটমে ভুলেও চড়তে আসবে না।’
ছোটমামা আমার কাছে স্যুটকেসটা দেখে খুশি হয়ে বললেন, ‘জানতুম, তুই ঠিকই নেমে পড়ে আমার অপেক্ষা করবি কোথাও।’
‘কিন্তু লোকটা কোথায় রইল?’
হাসলেন ছোটমামা। ‘ওকে তুই লোক বলছিস এখনও? ওটা কি লোক নাকি?’
‘তবে কে?’
‘বুঝলিনে? ওর ঘাড়ে একটা চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দে, তাহলে বুঝবি। থাকগে, এখন রাতবিরেতে ও নিয়ে আলোচনা করতে নেই। ব্যাপারটা কী জানিস অন্তু? রাতবিরেতে অমন দু একজন সওয়ারি ছক্কা মিয়ার টমটমে উঠে পড়বেই পড়বে। তারপর কী করবে জানিস? অন্ধকারে ঘাড় মটকানোর তাল করবে। যেই টের পেয়েছি আমার পেছনের লোকটার মতলব কী, অমনি ওকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যাটা পড়বার সময় অ্যায়সা টান মেরেছে যে আমি ওর সঙ্গে তেরপলের ফাঁক দিয়ে নিচে পড়েছি।’
‘তারপর? তারপর ছোটমামা?’
‘তারপর আর কী? ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় কুংফু জুডো যা সব এ্যাদ্দিন কষ্ট করে শিখেছি, চালিয়ে গেলুম। এক প্যাচে ওকে এমন করে ছুঁড়লুম যে একেবারে বিশ ফুট গভীর খাদে গিয়ে পড়ল। এতক্ষণ কোন বাজ পড়া ন্যাড়া গাছের ডগায় বসে হিঁপিয়ে হিপিয়ে কাঁদছে। ছোটমামা হাসতে হাসতে গায়ের জামা খুলে নিঙড়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘ঘন্টা তিনেক কাটাতে পারলেই ফার্স্ট বাস পেয়ে যাব। জামাটা নিঙড়ে নে। ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে ট্যাস। বাপস্।’
আমি শুধু ভাবছিলুম, তাহলে আমার পেছনের সওয়ারিও কি লোক নয়? সেই লোকটিও কি আমার ঘাড় মটকানোর তালে ছিল? অন্য লোকটার মতো?
আমার মুখ দিয়ে ছোটমামার প্রতিধ্বনি বেরিয়ে গেল, ‘বাপস্।’ …
ছক্কা মিয়ার টমটমে তারপর আর ভুলেও চাপার কথা ভাবতুম না। কিন্তু বছর দশেক পরে, যখন কিনা আমি পুরোপুরি সাবালক, এক রাতে ভীমপুর স্টেশনে নেমে শুনলাম, লাস্ট বাস চলে গেছে।
স্টেশন বাজার তখন নিঃঝুম। সময়টা শীতের। আকাশে এক টুকরো চাঁদও আছে। কিন্তু কুয়াশার ভেতর তার দশা বেজায় করুণ। একটা চায়ের দোকান খোলা ছিল। শীতের রাত বারোটায় চাওলা সবে ঝাঁপ ফেলার যোগাড় করছিল, আমাকে দেখে তার বুঝি দয়া হল। এক কাপ চা খাইয়ে দিল। শেষে বলল, ‘বাবুমশাই তাহলে যাবেন কিসে গদাইতলা?’
‘কিসে আর যাব? বরং দেখি যদি ওয়েটিং রুমে কাটানো যায়।’
চাওলা মুচকি হেসে বলল, ‘ছক্কা মিয়ার টমটমেও যেতে পারেন।’
ছক্কা মিয়ার টমটমের কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। সেবার ঝড় বৃষ্টি ছিল, কম। ছোটমামাও বড় গল্পে মানুষ ছিলেন।
হনহন করে চৌমাথায় চলে গেলুম। গিয়ে দেখি, শিরীষতলায় আগুন জ্বেলে বসে আছে সেই আদি অকৃত্রিম ছক্কা মিয়া। পাশেই তার টমটম তৈরী। ঘোড়াটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শীত বাঁচাতে তার পিঠে এক টুকরো চটের জামা। বললুম, ‘গদাইতলা যাবে নাকি ছক্কা মিয়া?’
ছক্কা মিয়া ইশারায় টমটমে চড়তে বলল।
আজ আ কোন সওয়ারি এল না দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল। টমটম তেমনি নড়বড় করে চলতে শুরু করল। ঘোড়াটাও বিকট চি হি হি ডাকতে ভুলল না। অবিকল সব আগের মতোই আছে। এমন কী ছক্কা মিয়ার পেল্লায় গোঁফটারও ভোল বদলায় নি। আর সে অদ্ভুত ঘন্টার শব্দ, টংলং … টংলং… টংলং।
কনকনে ঠান্ডা হাওয়া তেরপলের ঘেরাটোপের ছেঁদা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে উত্যক্ত করছিল। জড়সড় হয়ে কোণা ঘেঁসে রইলুম। সামনের মোটা ছেঁদা দিয়ে বাইরে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় ঝিম ধরা মাঠ ঘাঠ চোখে পড়ছিল। গাছগুলো আগাপাছতলা কুয়াশার আলোয়ান চাপিয়েছে, আর মাথায় পড়েছে কুয়াশার টুপি। টুকরো চাঁদখানা ছেঁড়া ঘুড়ির মতো একটা ন্যাড়া তালগাছের ঘাড়ে আটকে গেছে দেখতে পাচ্ছিলুম।
মাইলটাক চলার পর রাস্তার ধার থেকে কে বাজখাঁই হাঁক ছাড়ল, ‘রোখো, রোখো।’ অমনি টমটম থেমে গেল। ঘোড়াটাও স্বভাবমতো সামনে দুঠ্যাং তুলে একখানা চিঁ-হি ছাড়ল। তারপর ছক্কা মিয়ার গলা শুনলাম। দারোগাবাবু নাকি? সেলাম, সেলাম!’
মুখ বাড়িয়ে দেখি, বিশাল এক ওভারকোট পরা মূর্তি। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কোনো এক দারোগাবাবু। বললেন, ‘রোসো।’ সাইকেলখানা তুলে দিলেন। তারপর যখন টপ্পরের ভেতর ঢুকলেন, মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে। ঢুকেই আমাকে টের পেয়ে চমকানো গলায় বলে উঠলেন, ‘কে? কে?’
বললুম, ‘আমি।’
‘আমি? আমি কি মানুষের নাম হয় নাকি?’ বলে দারোগাবাবু টর্চ জ্বেলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিলেন। নাম ধাম বলতেই হল। পুলিশের লোক বলে কথা। সব শুনে উনি বললেন, ‘আমি আপনাদের গদাইতলা থানার চার্জে। কিন্তু আপনাকে কখনও দেখিনি।”
বেগতিক দেখে বললুম, ‘কলকাতায় আছি বহুকাল। তাই দেখেন নি। তা আপনার নামটা জানতে পারি স্যার?’
‘বংকুবিহারী রায়।’
‘আসামী ধরতে বেরিয়েছিলেন বুঝি?’ ওঁকে খুশি করার জন্যই বললাম।
বংকু দারোগা জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হুম। ব্যাটা এক দাগী বেগুন চোর ভীষণ ভোগাচ্ছে। আজ একটা বেগুনক্ষেতে দু’জন সেপাই নিয়ে ওত পেতেছিলুম। তাড়া খেয়ে সটান একটা তালগাছের ডগায় উঠে গেল। তাকে আর নামাতে পারলুম না।
তখন সেপাই দুজনকে তালগাছের গোড়ায় বসিয়ে রেখে এলুম। আসতে আসতে হঠাৎ সাইকেলের বেয়াদপি।’
দাগী বেগুন চোর এই শীতকালে সারা রাত তালগাছের ডগায় বসে আছে। কিন্তু তার জন্য নয়, হতভাগা সেপাই দুজনের কথা ভেবে আমার উদ্বেগ হচ্ছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আহা!’
‘আহা মানে?’ আমাকে ফের টর্চ জ্বেলে সন্দিগ্ধ নজরে দেখে বংকু দারোগা বললেন, ‘হুম! আপনি মশাই এই মড়া-বওয়া গাড়িতে এত রাতে চাপলেন যে! আপনি জানেন, আজকাল সওয়ারি জোটে না বলে ছক্কা মিয়া মড়া বয়ে নিয়ে যায় গঙ্গার ঘাটে।’
‘বলেন কী। তাহলে তো ভয়ের কথা।’ অবাক হয়ে বললুম, ‘সত্যি ভয়ের কথা। আগে জানলে …’ কথা কেড়ে বংকু দারোগা বললেন, ‘হয়তো জেনেশুনেই চেপেছেন। কিছু বলা যায় না।’
‘কেন এ কথা বলছেন?’
‘বলছি আপনার চেহারা দেখে। এমন শুটকো রোগা চিমসে বাসি মড়ার মতো লোক সচরাচর দেখা যায় না কিনা।’
এবার আমার খুব রাগ হল। ‘কী বলতে চান আপনি?’
‘রাতবিরেতে আজকাল ছক্কা মিয়ার টমটমে কে জ্যান্ত, কে মড়া বোঝা যায় না মশাই।’
হাত বাড়িয়ে বললুম, ‘এই আমার হাত। পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, আমি মড়া না জ্যান্ত।’
বংকু দারোগা আমার হাত সরিয়ে দিলেন জোরে। ‘বাপস। এ যে বেজায় ঠান্ডা!’
‘ঠান্ডা হবে না? শীতের রাতে এই মাঠের মধ্যে হাত কি গরম থাকবে?”
না মশাই। এমন রাতে বিস্তর সেঁদেল চোরের হাত পাকড়েছি। তারা কেউ এমন ঠান্ডা ছিল না।’
‘কী? আমায় সিঁদেল চোর বললেন?’
বংকু দারোগা গলার ভেতরে বললেন, ‘সিঁদেল চোরের ভূত হতেও পারেন। কিছু বলা যায় না। তখন আহা বলা শুনেই সন্দেহ জেগেছে।’
আর সহ্য হল না। খাপ্পা হয়ে চেঁচালুম, পুলিশ হোন, আর যাই হোন, আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি মশাই।’
দারোগাবাবু ফের মুখের উপর টর্চ জ্বেলে বললেন, “উহুঁ হুঁ! বড্ড এগিয়ে এসেছেন। সরে বসুন। সরে বসুন বলছি।’
মুখের ওপর টর্চের আলো কারই বা সহ্য হয়! টর্চ নেভান ‘ বলে টর্চটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলুম। টর্চটা নিভে গেল। এবং কোথায় ছিটকে পড়ল। কিন্তু এটাই বোধহয় ভুল হল। বংকু দারোগা বিকট গলায় ‘ভূত! ভূত।’ বলে চিক্কুর ছেটে আমাকে এক রামধাক্কা মারলেন। টপ্পরের এক পাশের জরাজীর্ণ তেরপলের ওপর কাত হয়ে পড়লুম। তেরপলটা ফরফর করে ছিঁড়ে গেল এবং টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলুম। কানের পাশ দিয়ে চাকা গড়িয়ে গেল প্রচন্ড বেগে। পলকের জন্য দেখলুম কুয়াশা ভরা নীলচে জ্যোৎস্নায় কালো টমটম দূরে সরে যাচ্ছে। ভেসে আসছে অদ্ভুত এক শব্দ টংলং … টংলং …টংলং …
ভাগ্যিস রোডস দফতরের লোকেরা রাস্তা মেরামতের জন্য কিনারায় বালির গাদা রেখেছিল। আঘাত টের পেলুম না। সামনে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। লোকেরা লণ্ঠন লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। তখন ঘটনাটা তাদের আগাগোড়া বলতে হল।
কিন্তু সব শুনে ওরা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। একজন বলল, ‘বাবু, ছক্কা মিয়ার টমটম পেলেন কোথায়? কাল ভীমপুরের কাছেই একটা ট্রাকের ধাক্কায় ছক্কা মিয়া আর তার ঘোড়াটা মারা পড়েছে যে। ভাগ্যিস টমটমে একটা মড়া ছিল শুধু। সঙ্গের লোকেরা বাসে চেপে গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিল। কিন্তু অবাক কান্ড দেখুন, মড়াটা একেবারে আস্ত ছিল। তুলে নিয়ে গিয়ে ভালয় ভালয় চিতেয় তুলতে পেরেছে।’
বংকু দারোগার ওপর সব রাগ সঙ্গে, সঙ্গে ঘুচে গেল। বরং উনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওঁর নিজের ভাগ্যে কী ঘটল কে জানে! আহা বেচারা!
কী ঘটল পরদিন শুনলাম। বংকুবাবু তখন হাসপাতালে। লোকে বলছে, আসামী ধরতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে কোমড়ের হাড় ভেঙেছে। সাইকেলও অক্ষত নেই। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো আমি জানি। তবে যাই হোক আমার ওপর যেটুকু ফাঁড়া গেছে তার জন্য দায়ী স্টেশন বাজারের সেই ধড়িবাজ চাওলা। কেমন হেসে বলেছিল ছক্কা মিয়ার টমটমেও যেতে পারেন। সব জেনে শুনেও কী অদ্ভূত রসিকতা।
অবশ্য এমন হতে পারে, সে বলেছিল ‘ছক্কা মিয়ার টমটমেও যেতে পারতেন।’ আমিই হয়তো ভুল শুনেছিলাম। ক্রিয়াপদের গোলমাল স্রেফ! …
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন