লীলা মজুমদার
আমার মেজ পিসিমার বাড়িতে একবার ভূতের উপদ্রব হয়েছিল। ঠিক ভূত নয়, শিবের চ্যালা নন্দী-ভৃঙ্গীর উৎপাত। এই উৎপাতে সারা গাঁ যেমন ভীত, তেমনি বিস্মিত।
ছেলেবেলার কথা বলছি। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার ঘটনা। আমি তখন আছি মামাবাড়িতে। গ্রামের নাম শ্রীগৌরী। ওখানকার ইস্কুলে পড়ি। আমার মামাবাড়ির ঠিক পিছনটাতে ফার্লংখানেক দূরে মেজ পিসিমার বাড়ি। পিসিমা সাদা-সিধে ভালো মানুষ। দেব-দেবী ভূত-প্রেত সাধু সন্ন্যাসীতে অগাধ বিশ্বাস। পিসেমশাই আরও ভালো মানুষ। গ্রামের পাঠশালার গরীব মাষ্টার। মাস মাইনে বারো টাকা। ছোট্ট বাড়ি অল্প জমি সামান্য চাকরি নিয়ে কষ্টে সৃষ্টে দিন চলে।
তাঁদের একমাত্র ছেলে বেণুলাল আমার রাঙাদা।
রাঙাদা বয়সে আমার চাইতে আড়াই বছরের বড়। পড়াশোনার নাম নেই, টো টো করে ঘুরে বেড়ান, গুলতি দিয়ে পাখি মারেন, অদ্ভুত সব গল্প বলেন এবং চক- খড়ি দিয়ে বাড়ির যত্রতত্র ছবি আঁকেন।
ছোট্ট একতলা বাড়ি। টিনের চাল, একটি ঘরকেই দরমার বেড়া দিয়ে তিন ঘর। সামনে দুটি ঘরের একটিতে রাঙাদা, অন্যটিতে পিসিমা-পিসেমশাই এবং পেছনের তিনদিক খোলা টানা লম্বা ঘরে রান্নাবান্না। রান্নাঘর দরমার বেড়া দিয়ে আলাদা করা। বাড়ির পেছনে গাছপালা আগাছার জঙ্গল। ছোট্ট একটা মজা পুকুরও সেই জঙ্গলের গায়ে।
টানাটানির সংসার, কিন্তু এক ছেলে বলে রাঙাদার আদরের শেষ নেই। তার আবদারেরও শেষ নেই। ‘অমুকটা চাই’ বলামাত্র এনে দিতে হবে। বেচারা পিসেমশাই। যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে আদুরে ছেলের আবদার মেটাতে গিয়ে তিনি জেরবার।
মেজ পিসিমার বাড়িতে হঠাৎ হাজির হলেন এক সন্ন্যাসী। গায়ে লাল কাপড়, মাথায় জটা, হাতে ত্রিশূল। সাক্ষাৎ শিব। পিসিমা তো তাই ভেবে বসলেন। সাধুবাবা বললেন, এইমাত্র কৈলাস থেকে তিনি আসছেন। একটু আশ্রয় দরকার এই গ্রামে পাপ ঢুকেছে। পাপ তাড়াতে কিছুদিন থাকতে হবে।
পিসিমা তো বিশ্বাস করার জন্যে বরাবরই প্রস্তুত। লম্বা প্রণাম ঠুকে সাধুবাবাকে আশ্রয় দিলেন। তাঁকে শাক ভাত ডাল খাইয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন।
সাধুবাবা ওই বাড়িতে থেকে গেলেন। খানদান, মাঝে মাঝে ‘দেহি ভবতি ভিক্ষাং’ বলে গাঁয়ে ঘোরেন এবং কেউ কটু কথা বললে ত্রিশূল নিয়ে তাড়া করেন। গাঁয়ের অবিশ্বাসীরা সন্দেহের চোখে তাকায়, ভাবে কোন ফেরারী আসামী নয় তো? সাধু সেজে গাঁ ঢাকা দিয়ে আছে? আর বিশ্বাসীরা তো শিব জ্ঞানে ফুল বেলপাতা দিয়ে পূজো করতে লাগলো।
সাধুবাবার কাছে আমিও যাই। তিনি আমাদের প্রায়ই কৈলাসের কথা শোনান। তোফা জায়গা। ওয়েদার ভাল, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট নেই। নেহাৎ এক কঠিন প্রয়োজনে তাঁকে কৈলাস ছেড়ে আসতে হল। পিসিমার ভাইপো বলে আমাকে অধিক স্নেহ করেন, বলেন, কিছু ভাবিস না, তোর হবে। আমার কী যে হবে আমি নিজেই জানি না। তবে সাধুবাবাকে পুরো অবিশ্বাসও করি না। বলা যায় না, হয়ত শিবই। নইলে সেদিন রূপসী গাছের তলা থেকে সাপ ধরে আনলেন কী করে?
সাধুবাবা মেজ পিসিমার বাড়িতে থেকে গেলেন। তাঁর আনা ভিক্ষের চাল সংসারে লাগে। তিনি নানা রকম গল্প শোনান এবং মাঝে মাঝে ‘বোম বোম’ বলে কৈলাসের স্মৃতি রোমন্থন করেন। সাধুবাবা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, একদিন তিনি আমাকে কৈলাস দেখিয়ে আনবেন।
আমার সোনা নামা থাকতেন বাইরে। সেবার পূজোর সময় বাড়িতে এসে সাধুবাবার খবর পেলেন। তিনি দেখেই বললেন, ভন্ড প্রতারক। সাধুবাবাকে একদিন বাড়িতে ডেকে এনে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিলেন। আমি তো ভয়ে মরি, যদি শাপ দিয়ে ভস্ম করে ফেলেন সোনা মামাকে।
সাধুবাবা কিছু মনে করলেন না, স্মিত হেসে চলে যান। সোনামামাও ভস্ম হন না। বিশ্বাস অবিশ্বাস মিলিয়ে সাধুবাবা গ্রামে থেকে গেলেন। আর আমার মেজ পিসিমা ও পিসেমশাই শিব ঠাকুরের দয়ায় অচিরে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকেন। আগের জন্মে কী কী অপরাধের জন্য তাঁদের আর্থিক দুর্দশা, একথা সাধুবাবা স্মরণ করিয়ে দেন এবং আশ্বাস দেন, এত বছর এত দন্ড এত পল পেরিয়ে গেলে সব দুঃখ মোচন হয়ে যাবে।
ইস্কুল ফেরৎ আমি মাঝে মাঝে সাধুবাবার কাছে যাই। আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন, আমি যেন শাপভ্রষ্ট দেবশিশু। সাধুবাবা কথা বলতে বলতে কী যেন বিড়বিড় করেন। পিসিমা বলেন, মা দুর্গার সঙ্গে কথা বলছেন। হতেও পারে। প্রলাপেই সংলাপ।
রাঙাদার দুষ্টুমিতে গ্রামের লোকজনেরা তিতিবিরক্ত হলেও সাধুবাবা ক্ষমাশীল। বলেন, ওটা হনুমান ছিল ত্রেতাযুগে। বাঁদরামি করলেও ভক্ত মানুষ। একথায় আমারও বিশ্বাস হয়েছিল। কেননা, দেখতাম রাঙাদা হনুমানের ছবি খুব ভালো আঁকতে পারেন।
রাঙাদা আমায় খুব ভালোবাসেন। অনেক সময় আমাকে তাঁর দুঃসাহসী অভিযানের সঙ্গী করতে চান। অন্যের নৌকা নিয়ে নদী পাড়ি কিংবা আম গাছের ডগায় উঠে পাখির ছানা ধরে আনা কিংবা পানাপুকুর সাঁতরে এপার ওপার হওয়া তার কাছে নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি ভীতু মানুষ, কোনটাতেই রাজি হই না। আর যদিও বা সাহস করে সঙ্গী হতে চাই, জানি তাহলে দিদিমা ও সোনামামা বকবেন। ওদের ধারণা বেণুলাল বকাটে ছেলে।
রাঙাদার উপর মাঝে মাঝে ভড় হত। ঘুমের মধ্যে কী সব বিড়বিড় করতেন। সাধুবাবা মন্ত্র পড়ে ঠান্ডা করতেন। একবার রাঙাদা মাঝরাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে সামনের বড় পুকুরে ঝাঁপ দেন। পেছন পেছন ছোটেন পিসেমশাই ও সাধুবাবা পিসেমশাই জলে নেমে তাকে ধরবার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারবেন কেন! বাকি রাত জলের মধ্যে দাপাদাপি চলল। বেচারা পিসেমশাই। রাঙাদা যখন পাড়ে উঠলেন, তখন চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন ঘাটে। যেন ঘুমের মধ্যেই সব কিছু হয়েছে। অনেক দিন পরে রাঙাদা আমার কানে কানে বলেন, মজা করার জন্যে রাতভোর সাঁতার কেটেছিলেন।
সেই রাঙাদার বাড়িতে হঠাৎ শোনা গেল ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে। রোজ রাত্তিরে সবাই যখন ঘুমে অচেতন, ঠিক তখন শোবার ঘর আর রান্নাঘরের মাঝের দরমার দরজা ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা হয়। এ পাশের লম্বা বাঁশের হুড়কো নড়তে থাকে এবং হাতে হুড়কো চেপে না ধরলে ভূত হুড়মুড় করে শোবার ঘরে ঢুকে যেতে পারে। ওই লম্বা বাঁশের হুড়কো এমনিতেই নড়বড়ে। চোর আটকাবার জন্যে নয়, শেয়াল কুকুর যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্যেই।
সারা গ্রামে আতঙ্ক। এমনিতে ভূত-প্রেতরা সব গ্রামের রাস্তাতেই ঘুরে বেড়ায়। বেহ্মদত্যি বেলগাছের ডালে বসে থাকে, শাঁকচুন্নি বোয়াল মাছ ভাজা খাবার জন্য লম্বা হাত বাড়ায়, পেত্নী বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে ভয় দেখায়। অন্ধকার, ঝোপঝাড়, ঝি ঝি পোকার ডাক, হুতোম প্যাঁচার ডানা ঝটপটানি – সব মিলিয়ে সব রাত্রেই এক ভৌতিক পরিবেশ। তার মধ্যে দু-চারজন ভূতের ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী পিসিমার বাড়িতে প্রবেশ বিচিত্র নয়।
গ্রামের লোকেদের আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে গেল ওই ভূতের উপদ্রব। হাটে মাঠে বাজারে পুকর ঘাটে রেল স্টেশনে আরও রঙ চড়িয়ে ও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ওই ভূতের কাহিনী বলা হতে লাগল। মেজ পিসিমা কিঞ্চিৎ ভীতু, তবে তার ভরসা সাধুবাবা। শ্মশানচারী শিব যখন বাড়িতে, তখন দু-চারটে ভূতের উপদ্রব তো হবেই। ভূতের হাত থেকে বাঁচাবেনও সাধুবাবা। সুতরাং ভয় কিসের! বেচারা ভালোমানুষ পিসেমশাই, তার হয়েছে মুশকিল। রোজ মাঝরাত্তিরে ওই হুড়কো ধরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একদিকে ভূত, অন্যদিকে পিসেমশাই। সাধুবাবা অবশ্য বলেন, নন্দী ভৃঙ্গী বড় জ্বালাচ্ছে। কৈলাসে নিয়ে যাবার জন্য রাত্তিরে এসে হামলা করছে। আরে বাবা, বললেই তো আর যাওয়া যায় না। কাজ ফুরোক তবে তো — বোম্ বোম্!
সরল বিশ্বাসী পিসিমা এসব কথা শুনে আরও নির্ভয় হয়ে গেলেন। স্বামী পুত্র সাধুবাবা ও নন্দী ভৃঙ্গীর হামলা নিয়ে স্বচ্ছন্দে সংসার করতে লাগলেন।
গ্রামের লোকদের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। রোজ রাত্রে পালা করে অনেকে ওই বাড়িতে আসতে লাগলেন স্বচক্ষে ভূতের হুড়কো টানার ঘটনাটা দেখার জন্যে। প্রথমে একটু একটু নড়ে। শব্দ পাওয়া যাত্র ছুটে গিয়ে হুড়কো ধরে ফেলতে হয়। তারপর চলে লড়াই। খুব জোরে ধরে না রাখতে পারলে কেলেংকারি। ভূত দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়বে। যেন ভূতেরা অন্য কোন রাস্তা দিয়ে বা দেয়াল ফুঁড়ে আসতে পারে না।
এসব ব্যাপারে নির্বিকার কেবল রাঙাদা। ভূত টুত নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। যখন পাশের ঘরে তুলকালাম কান্ড চলছে, তখন তিনি গভীর ঘুমে। পিসিমা বলেন, ‘আমার বেণুলাল বড় ঘুম কাতুরে। ভূত দূরের কথা, বাড়িতে ডাকাত পড়লেও তার ঘুম ভাঙে না।’
হবেও বা। রাঙাদা যে রকম অদ্ভুত লোক, কোন কিছু কেয়ার না করে ঘুমিয়ে থাকতেই পারে।
তবে আর একটা ব্যাপারে সবাই ভূতের আগমন সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয়ে গেল। যখন হুড়কো নড়ে না, তখন বাড়ির টিনের চালে দুম দাম ঢিল পড়ে। এও যে রাগী ভূতের বা শিবকে কৈলাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নন্দী ভৃঙ্গীর কান্ড, তাতে কোন সন্দেহ রইল না। সাধুবাবা শোন সামনের এক ফালি বারান্দায়। তিনি সব শুনে মুচকি মুচকি হাসেন এবং হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার পাড়েন ‘বোম বোম।” বাড়ির চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার, পেছনের বাঁশ গাছের ক্যাচ ক্যাচ এবং তারই মাঝখানে বোম-বোম আওয়াজ সব মিলিয়ে গা ছমছম ব্যাপার। এমন অবস্থায় ভূত প্রেত আসতেই পারে।
এক রাত্তিরে সাহস সঞ্চয় করে আমিও হাজির হলাম ভূতের আসরে। আমার তখন বয়সই বা কত, আট নয়, সব কিছু বিশ্বাস করার সময়। শুধু ভয়, যদি সত্যি সত্যি ভূত ঘরে ঢুকে পড়ে? পরক্ষণে ভরসা পাই সাধুবাবাকে দেখে। তিনি নিশ্চয়ই একটা কিছু বিহিত করবেন।
আমি প্রথমে বললাম, রাঙাদার বিছানায় থাকব। রাঙাদা বললেন, ‘না না, তুই যা অন্য ঘরে। এখানে আমার অসুবিধা হবে।’
আমার একটু খটকা লাগল, রাঙাদা ভূতের ব্যাপারে এতো নিরুত্তাপ কেন? কিন্তু সবাই ভূতের নড়াচড়া গতিবিধি নিয়ে এতো ব্যস্ত যে রাঙাদাকে নিয়ে তত মাথা ঘামায় না।
আমি যেদিন গেলাম, সেদিন একটু বাড়াবাড়ি হল। আমার মতো আরও কয়েকজন গ্রামবাসী ছিলেন ঘরে। সেদিনও হুড়কো নড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিসেমশাই ছুটে গেলেন। কিন্তু এমন বাড়াবাড়ি যে পিসেমশাই আচমকা মাটিতে পড়ে গেলেন। পিসিমা সাধুবাবাকে হাঁক পেড়ে ডাকলেন। সাধুবাবা তাঁর বিছানা ছাড়লেন না। গাঁয়েরই আর একজন ছুটে গিয়ে হুড়কো ধরলেন। ভাগ্যিস ধরলেন, নইলে ভূত দেখে মুর্ছা যেতাম।
এইভাবে চলছে। সাধুবাবা ভূত হুড়কো টানাটানি নিয়ে গ্রামের মানুষ মেতে রইলেন। মেজ পিসিমার বাড়িতে এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নেওয়া হল। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে। শুধু রাঙাদা যেন গম্ভীর। দিনের বেলা ভূত নিয়ে নানা রকম কথা তিনিও বলেন, কিন্তু রাত্রে চুপচাপ। পিসেমশাই হুড়কো ধরার জন্য তাকে ডেকেও ভূতের কাছাকাছি নিয়ে আসতেপারেন নি। মেজ পিসিমা অবাধ্য ছেলের ঘুম ভাঙাতে নারাজ। সব ঝক্কি পোয়াতে হচ্ছে পিসেমশাইকে।
ভূতের খবর রটে গেল গ্রামের বাইরেও। অবশ্যই পল্লবিত হয়ে। সেই খবর শুনে শিলচর থেকে একদিন আমার বড় কাকাবাবু এসে হাজির। আমার বড় কাকাবাবু মানে রাঙাদার মামাবাবু। তিনি পিসিমা পিসিমশাইয়ের কাছে সব কথা শুনে শুম মেরে রইলেন। প্রথমেই পিসিমাকে বললেন, ‘বুঝলে দিদি, যত গন্ডগোলের মূল ওই সাধুবাবা। ওকে বাড়ি থেকে তাড়াও, নইলে উপদ্রব কমবে না।’
পিসিমা জিব কেটে বলেন, ‘ওরে ভূপেন্দ্র, এমন কথা বলিস না। বাবা সাক্ষাৎ শিব।’
বড় কাকাবাবু : ‘শিব তো এখানে কেন? ওকে শ্মশানে পাঠিয়ে দাও।’
পিসিমা : ‘শ্মশানে যেতেই পারেন, কিন্তু আমার কত সৌভাগ্য বল দিকিনি, তিনি আমার বাড়িতে অন্নগ্রহণ করেছেন।’
বড় কাকাবাবু : ‘নিজের অন্ন জোটে না,আবার অন্যকে অন্নদান! হু! তোমার বুদ্ধি সুদ্ধি কোন দিনই হবে না।
রাত্রে বড় কাকাবাবুর উপস্থিতিতে আবার ভূতের আবির্ভাব হলো। সেই হুড়কো নড়া, পিসেমশাইয়ের ছুটে গিয়ে ধস্তাধস্তি, নিস্তব্ধতার মাঝখানে সাধুরাবার ‘বোম বোম’ চিৎকার। বড় কাকাবাবু সব ভালো করে দেখলেন। তিনি বরাবরই সাহসী মানুষ, ভূতপ্রেতকে মনে করেন বুজরুকি। তিনি হুড়কো খুলে নিজে যেতে চাইলেন রান্নাঘরের দিকে। কিন্তু পিসিমার মিনতিতে নিরস্ত হলেন।
বড় কাকাবাবু দেখলেন সবাই ব্যতিব্যস্ত, কেবল তাঁর ভাগনে শ্রীমান বেণুলাল কোন কথাটি না বলে নিজের ঘরে শুয়ে আছে। তিনি ‘বেণু বেণু’ ডাকলেন, কিন্তু পিসিমা বললেন, ওকে ডাকিস না, বড় ঘুমকাতুরে। আর ভূতের ভয় ভীষণ। কেন মিছিমিছি বেচারাকে কষ্ট দেওয়া।
বড় কাকাবাবু কী যেন আন্দাজ করলেন, পরের রাত্তিরে তিনি বললেন, বেণুর সঙ্গে এক বিছানায় আমি শোব। রাঙাদা খুব আপত্তি করলেন, কিন্তু বড়কাকাবাবুর তিন ধমকে রাজি হতে হল।
দু’জনে একসঙ্গে শুলেন, তবু যে কে সেই। আবার একইভাবে হুড়কোর হামলা। তবে সেই রাত্তিরে টিনের চালে ঢিল পড়ল না।
বড় কাকাবাবু একটু চিন্তিত হলেন। তাহলে। ব্যাপারটা কী? তাঁর সন্দেহ কি ঠিক নয়? সাধুবাবার ওপর কড়া নজর রাখলেন এবং রান্নাঘর, দরমার বেড়া, হুড়কো, রাঙাদার ঘর, তার ঘরের বেড়া ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। পিসিমা এসব দেখে একটু বিরক্ত হলেন, কিন্তু ছোটভাইকে কড়া করে কিছু বলতেও পারলেন না।
ওদিকে বড় কাকাবাবু রাঙাদাকে বললেন, চল আমার সঙ্গে শিলচরে। কয়েকদিন থেকে আসবি।
রাঙাদা কিছুতেই রাজি না। বলেন, ‘অনেক কাজ আছে মামাবাবু, পরে যাব’খন।’
বড় কাকাবাবু আর কিছু বললেন না, শুধু রাত্রে রাঙাদার সঙ্গে এক বিছানাতেই শুতে গেলেন। আগের দিনের চেয়ে একটু তফাৎ করলেন। রাঙাদাকে অন্যপাশে দিয়ে নিজে শুলেন দরজার বেড়ার দিকটায়। তক্তপোষটা বেড়ার গা ঘেষেই। ওপাশে রান্নাঘর এবং তিন চার হাত দূরে অন্য শোবার ঘরে যাওয়ার জন্যে রান্নাঘরের সেই দরজা।
বড় কাকাবাবু লণ্ঠন জ্বালিয়ে ঠায় বসে রইলেন বিছানায়। কড়া নজর রাঙাদার দিকে। মাঝরাত্তির আসে। ও ঘরে পিসিমা পিসেমশাই ও গাঁয়ের দু’চার জন লোক বসে। কিন্তু আশ্চর্য, হুড়কো নড়ল না। আরও অপেক্ষা। তবু নড়াচড়া নেই। সবাই কেমন হতাশ হয়ে গেলেন। একটু বাদে গাঁয়ের লোকেরা চলে গেলেন যে যার বাড়ি। পিসিমা পিসেমশাই বসে রইলেন হুড়কোর দিকে তাকিয়ে। যদি নড়ে
নড়লো না। এবং রাতও পুইয়ে আকাশ ফর্সা হলো। বড় কাকাবাবু রাঙাদার কান ধরে টেনে এনে হাজির করলেন পিসিমা পিসেমশাইয়ের কাছে, তারপর দুই গালে বড় দুই চড়।
সবাই হতভম্ভ। রাঙাদা ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন। বড় কাকাবাবু তাঁকে তখনও ধমকে চলেছেন।
আরও অবাক কান্ড। পিসিমা পিসেমশাইকে রান্নাঘরে নিয়ে দেখালেন, হুড়কোর সঙ্গে বাঁধা একটা শক্ত কালো গুলি সুতো। সেই সুতো দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে রাঙাদার বিছানার পাশে এক খুঁটিতে বাঁধা।
বড় কাকাবাবু বললেন, ‘এবার বুঝলে তো দিদি, ভূতটা কে? তোমার গুণধর পুত্র। আমি তো বলি, সারা বাড়ি তোলপাড় আর বেণু কী করে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। তোমরা যখন ভূতের অপেক্ষায় বসে থাকো, তখন সে শুয়ে শুয়ে ওই কালো সুতো ধরে টান মারে। মারলেই হুড়কো নড়ে। বুড়ো বাপ ওর গায়ের জোরের সঙ্গে পারবে কেন? তোমরা তো বিশ্বাস করার জন্য বসেই আছ, আর ওই পাজিটা শুয়ে শুয়ে তোমাদের নাকাল করেছে। আর তোমরা যখন হুড়কো টানাটানিতে ব্যস্ত তখন একবার অন্ধকারে বাইরে গিয়ে চালে ঢিল মেরে আবার এসে শুয়ে পড়ে এবং আবার ওর সুতোর কেরদানি দেখায়। দেখো, আজ রাত থেকে আর কিছু হবে না। এই দেখো সেই সুতো। যত বদ বুদ্ধি সব মাথায়। কোথায় গেল সেই হতভাগা।
হতভাগা ততক্ষণে বাড়িতে নেই। ছুটে বাইরে। বড় কাকাবাবু সকালের ট্রেনেই শিলচরে ফিরে গেলেন। রাঙাদা হেলতে দুলতে তারপর বাড়ি এলেন : মুখের ভাবখানা এমনই যেন কিছুই হয়নি।
তবে সত্যি সত্যিই সেদিন রাত থেকে মেজ পিসিমার বাড়িতে ভূতের উপদ্রব থেমে গেল। মেজ পিসিমা বললেন, ভূপেন্দ্র বললে! বটে, সুতোটাও দেখাল, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না, আমার বেণুলাল এইসব করেছে।
সাধুবাবা বললেন, অবিশ্বাসী নাস্তিকদের কথা : বিশ্বেস রাখতে নেই। নন্দীভৃঙ্গীই এসেছিল। না, আর এখানে নয়, কালই কৈলাসে ফিরে যেতে হবে দেখছি।
কোন কথা বললেন না শুধু পিসেমশাই। বহুদিন পর তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতেও পারলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন