৬৮. স্মৃতিতে লেনিন

তসলিমা নাসরিন

স্মৃতিতে লেনিন

পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ ধনী ও দরিদ্রের, নারী ও পুরুষের কোনও অসাম্য দেখতে চাননি। পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, প্রাতঃকালে স্মরণযোগ্য মানুষ–সে মানুষ বলেছিলেন–‘নারী-শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য শুধু নারীদের আনুষ্ঠানিক সমতা নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার জন্যও সংগ্রাম। প্রধান কর্তব্য হল মেয়েদের সামাজিক উৎপাদনশীল শ্রমে আকর্ষণ, ‘গার্হস্থ্য বাঁদিগিরি’ থেকে তাদের উদ্ধার, রান্নাঘর ও শিশুঘরের চিরন্তন আবহাওয়ার কাছে বিদঘুটে ও হীন আত্মসমপণ থেকে মুক্তি।‘ (প্রাভদা ৮ মার্চ, ১৯৯০)

পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ বলেছিলেন–‘পৃথিবীর সমস্ত পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, স্বাধীনতা—এই সব জাকালো কথার সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষদের জন্য বিশেষ সুবিধা, মেয়েদের জন্য হীনতা ও লাঞ্ছনার সব আইন অনুসারে জড়িয়ে থাকা নারীদের প্রতি আসাম্যের অভূতপূর্ব রকমের পৈশাচিক, জঘন্য রকমের নোংরা, পাশবিক রকমের কদর্য সব বিধি।‘

সে মানুষ আরও বলেছিলেন– এই মিথ্যা ধ্বংস হোক। যতদিন পর্যন্ত নারী-জাতি নির্যাতিত, যতদিন পর্যন্ত অত্যাচারী শ্রেণী বর্তমান, যতদিন পুঁজি ও শেয়ারের ওপর থাকছে ব্যক্তিগত মালিকানা, আর যতদিন ভূরিভোজিরা বাড়তি শস্যের জোরে ক্ষুধার্তদের গোলামি খতে বেঁধে রাখছে, ততদিন পর্যন্ত যারা সকলের জন্য স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে, সেই মিথ্যাবাদিরা নিপাত যাক। চাই নিপীড়িত নারীজাতির স্বাধীনতা ও সমান অধিকার চাই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে পুঁজিপতির বিরুদ্ধে, চোরাবাজারী কুলাকের বিরুদ্ধে লড়াই।‘ (প্রাভদা ৬ নভেম্বর, ১৯৬৯)

পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ বলেছিলেন–‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু গালভরা কথার, জমকালো বুলির, সাড়ম্বর প্রতিশ্রুতির আর স্বাধীনতা ও সাম্যের বড় বড় ধ্বনির গণতন্ত্র। কিন্তু কাজের বেলায় এই গণতন্ত্র মেয়েদের স্বাধীনতা-হীনতা ও অসাম্য, মেহনতী ও শোষিতের স্বাধীনতা-হীনতা ও অসাম্যকে আড়াল করে। ধ্বংস হোক এই জঘন্য মিথ্যা ! অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মধ্যে, শোষক ও শোষিতের মধ্যে কখনও সাম্য হতে পারে না, নেই, হবে না। যতক্ষণ না পুরুষের আইনগত বিশেষ সুবিধা থেকে মেয়েরা স্বাধীনতা পাচ্ছে, যতক্ষণ পুঁজির কবল থেকে শ্রমিকের, এবং পুঁজিপতি, জমিদার ও বণিকের জোয়াল থেকে মেহনতী কৃষকের স্বাধীনতা না থাকছে, ততক্ষণ প্রকৃত ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে না, নেই, হবে না।‘ (প্রাগুক্ত)

পৃথিবীর কিছু অসভ্য ও উন্মাদ মানুষ আজ সেই প্ৰণম্যকে পায়ের তলায় ফেলে নৃত্য করছে। প্রাচুর্য ও জৌলুসের মোহে অন্ধ উন্মাদের আজ সেই মহান মানুষের ভাস্কর্য ছড়ে ফেলে দিচ্ছে। গলায় দড়ি বেঁধে ওরা নামিয়ে ফেলছে সকল সন্মানিত স্মৃতি। ওরা ‘সমতাকে’ ছুঁড়ে নামাচ্ছে, ওরা ‘স্বাধীনতা’ নামাচ্ছে। ভুলুষ্ঠিত লেনিন, আপনি বলেছিলেন, ‘মেয়েদের সামাজিক জীবনের প্রত্যেকটি জাগরণ ও ক্রিয়াকলাপকে সাহায্য করা চাই যাতে তারা তাদের কুপমণ্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক, ঘরোয়া ও সাংসারিক মনস্তত্ত্বের সঙ্কীর্ণতা ছাড়িয়ে উঠতে পারে। ভলাদিমির ইলিচ লেনিন, আপনি বলেছিলেন–দিয়াবতী মাসিমার মত মিউমিউ করা চলবে না, কথা বলা চাই জোর গলায়, যোদ্ধাদের মত, কথা চলা চাই পরিষ্কার করে। দেখিয়ে দিন যে আপনারা লড়াই করতে পারেন।‘ (ডঃ ক্লারা সেৎকিনের ‘আমার স্মৃতিতে লেনিন’)

আমরা তো লড়াই করতে শিখছিলাম মহামতি লেনিন। যে পুঁজিবাদ নারীকে ‘সাংসারিক বাঁদিগিরি’-তে ঠেলে দেয়, যে পুঁজিবাদ নারীকে ‘গণিকাবৃত্তি’-তে ঠেলে দেয়—আমরা সেই পুঁজিবাদের বিপক্ষে কথা বলছিলাম। ‘ঘরোয়া দাসত্ব’ থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছিলাম, একই আদর্শ সামনে রেখে আমরা আপনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম— ‘মেয়েদের দাবিয়ে রাখছে, শ্বাসরুদ্ধ করছে, বিমূঢ় করছে, হীন করে রাখছে খুঁদে সাংসারিক গৃহস্থালি, বেঁধে রাখছে তাকে পাকশালায় তার শিশুপালন-ঘরে, অমানুষিক রকমের অনুৎপাদক, তুচ্ছ, পিত্তি-জ্বালানো, মন ভোতা করা, হাড়-গুড়ানো কাজে অপচয় হচ্ছে তার শ্রম।‘ আমরা এই শৃঙ্খল থেকে নারীর মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাদের সব স্বপ্ন, সব সাধ সব স্বাধীনতার গলায় দড়ি বেঁধে হেঁচকা টানে টানছে উন্মাদ শাসকেরা আর তাদের অসংখ্য লোভাতুর অনুসারী।

একদা সমাজতন্ত্র নামে পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে একপ্রকার রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি ছিল। সমাজতন্ত্র এখন বিপর্যন্ত, বিকলাঙ্গ—এতে সভ্যতা ও মানবতার ক্ষতি কতটুকু হয়েছে, এতে তৃতীয় বিশ্বের ওপর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের আশঙ্কা কতটা ভয়াবহ হল, তা হিসেব করে দেখিনি; কেবল একথা স্পষ্ট জানি নারীর বড় ক্ষতি হল। নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য কল্যাণকর একটি নীতি বা আদর্শের নির্মম মৃত্যু হল।

এখন ধুলোয় লুটোচ্ছে লেনিন, ভ্‌লাদিমির ইলিচ লেনিন। এখন চুড়ো থেকে খসিয়ে ফেলা হচ্ছে তার আপাদমস্তক। নারীকে পণ্য করবার বিরুদ্ধে, নারীর গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে, নারীর ক্ষুদ্র তুচ্ছ সাংসারিক দাসত্বের বিরুদ্ধে ইতিহাসে যে কণ্ঠটি সবচেয়ে সোচ্চার ছিল সে লেনিনের কণ্ঠস্বর, যে হাতটি সবচেয়ে কর্মঠ ছিল, সে লেনিনের হাত। অপদার্থ মানুষেরা আজ সেই ইতিহাসকে দলিত করছে—এতে ক্ষতি কার কত জানি না,তবে নারীর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।

আমরা, নারীরা আজ পতিত লেনিনের জন্য, পতিত আদর্শের জন্য, পতিত সাম্যের জন্য শোকস্তব্ধ মাথা নত করছি।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন