৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’

তসলিমা নাসরিন

নির্বাচিত কলাম – ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’

পুরুষ পাঠককে বলছি, ধরুন কোনও এক মেয়ে আপনার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছে বলে আপনার মনে হল অথবা করেনি, দেখে শুনে আপনার বোধ হল মেয়েটির বড় অহঙ্কার, মাটিতে পা পড়ে না, উটে হেঁটে বেড়ায়, কোথাও ফিরে তাকায় না, কারুকে পাত্তা-টাত্তা দেয় না—তখন প্রতিশোধ নিতে চাইলে ভাল একটি উপায় আপনার হাতে আছে। মেয়েটি আপনাকে গ্রাহ্য করে না, না করুক—এতে আপনার কিছু অসুবিধে নেই। আপনি মোটেও এ নিয়ে ভাববেন না। আপনি পুরুষ–পৌরুষ আপনার রক্তে টগবগ করে ফুটছে। আপনার হাতে মারাত্মক একটি অস্ত্র আছে যা ব্যবহার করে মেয়েটির সমস্ত অহঙ্কার অথবা সারল্য যা-ই বলুন না কেন একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারেন। শুধু তাই নয়, মেয়েটির মেরুদণ্ড যদি দৃঢ় হয়, তবে তা গুঁড়িয়ে দেবার এবং মেয়েটির মাথা যদি উঁচু হয় তবে তা নত করবার ক্ষমতাও আপনি রাখেন।

কোনও রামদা বা ছোরার দরকার নেই, ওসবের ঝামেলায় যাবেন না, কারণ কুপিয়ে মারলে আবার কি সব মামলা-মোকদ্দমা শুরু হবে, খামোক কিছু গাটের পয়সা খরচা পিস্তলেও বিপদ কম নয়। গুলির শব্দে একশ একটা লোক এসে হাজির হবে। আজকাল নাকি এসিডও তেমন ভাল ফল দিচ্ছে না। চোখ ঠিক অন্ধ হচ্ছে না—গালটা জুতসই মত পুড়ছে না—হাতের টিপ ভাল না হলে ওতে কোনও ফায়দা নেই।

নিশ্চয় খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি সেই মোক্ষম অস্ত্ৰ ! কি সেই অস্ত্র—যে অস্ত্র আধুনিক কোনও আয়ুধ নয়—যা সচরাচর ব্যবহৃত হয়। ফাঁসির দড়ি নয়, শক্ত কব্জির যে দুই হাত—যে হাতে সুযোগ মত টিপে ধরা যায় কণ্ঠদেশ–তাও নয়। নাকি গলা কাটার ব্লেড, নাকি জুতো–ফাঁক বুঝে ছুঁড়ে মেলা যায় ? না, ওসবের কিছু নয়। আমি নিশ্চিত, পুরুষ পাঠক যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদের শতকরা একশ জনই জানতে চাচ্ছেন হাতের মুঠোয় আছে অস্ত্রটি কি। আসলে হাতের মুঠোয় বলা ঠিক হবে না, অস্ত্র আপনার জিভের ডগায়। বেশি নয়, আপনাকে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করতে হবে। কেবল একজন কারও সামনে আপনি বাক্যটি উচ্চারণ করবেন। ওই বাক্যটিই আপনার অস্ত্র, যে অস্ত্র দ্বারা আপনি আপনার গন্তব্যে অগ্রসর হবেন। যে বাক্যটি ঘটনার চূড়ান্ত সাফল্য ডেকে আনবে তা হল— মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়। ব্যস, কেল্লা ফতে। এবার আপনি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরুন কি দরজা বন্ধ করে নিরিবিলি ঘুমিয়ে পড়ুন—আপনার আর দরকারই পড়বে না ওমুখে হবার কারণ বাক্যটি একই বাকি কাজ সেরে নেবে। যাকে বলে ‘একাই একশ’ । যে কোনও পার্থিব অস্ত্ৰ-বস্তুর চেয়ে সে অধিক ধারালো, অধিক তীক্ষ্ণ।

বাক্যটি একই সঙ্গে এত সুমিষ্ট যে, মানুষ তাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় এক ঘর থেকে আরেক ঘরে, এক উঠোন থেকে আরেক উঠোনে, এক আড্ডা থেকে আরেক আড্ডায়, এক শহর থেকে আরেক শহরে। চরিত্ৰ—যদি সে নারীর চরিত্র হয় তবে তার মত ঠুনকো কাচ আপনি কোথাও পাবেন না। সে এত ঠুনকে যে তার উদ্দেশ্যে ফুঁ দিলেই তা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে। আপনার চিন্তিত হবার কিছু নেই। কারণ এর জন্য কোনও সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার হয় না, কোনও কাঠগড়া নেই, কোনও জেল জুলুম নেই।

পুরুষ পাঠক, ধরুন, আপনি অস্ত্রটি ব্যবহার করলেন। এবং এর ফলে মেয়েটিকে কি কি অসুবিধে ভোগ করতে হচ্ছে তা কেবল আপনি তখনই উপলব্ধি করবেন, যদি আপনি নতুন করে মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তা না হলে আমার কোনও সাধ্য নেই আপনাকে বোঝাই মেয়েটি এখন সামাজিকভাবে এই এই অবস্থায় আছে। একেবারে যে আপনার বুঝবার কোনও উপায় নেই তা নয়—উপায় একটি আছে, যদি কোনও পরিবারে আপনি বসবাস করেন এবং আপনার একটি বোন সেই পরিবারে বড় হয় তবে তার নামে এরকম একটি বাক্য আপনি নিজে ছড়িয়ে দিয়ে বেশ চমৎকার উপভোগ করতে পারেন এই বাক্য কোথায় এবং কতদূর যায় এবং কী কী ঘটায়। বাক্যটির পেছনে আপনি লেজের মত লেগে থাকুন এবং লক্ষ্য করুন, নিশ্চয় আপনি নিশ্চিত হবেন যে, যে অস্ত্রটির কথা আজ আপনাকে শোনালাম তা নেহাত মন্দ নয়।

‘চরিত্র’ খুব মূল্যবান একটি জিনিস। পুরুষের জন্য তা আগলে রাখবার প্রয়োজন না হলেও নারীর জন্য প্রয়োজন। নারী তাকে সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রাখলে গচ্ছিত জিনিসটি চড়া দামে বিক্রি হয়। চরিত্র এখন একটি লাভজনক বাণিজ্যের ব্যাপারে দাড়িয়েছে। আর তা নিয়ে বাণিজ্য করছে আমাদের সমাজের ধুরন্ধর সওদাগরেরা।

পুরুষ পাঠকের সঙ্গে কথা আপাতত শেষ। এবার মেয়ে পাঠককে বলছি—পুরুষদের যে কায়দা-কানুনগুলো শেখালাম আসলে কিন্তু তারা আমার চেয়েও এর প্রয়োগ প্রক্রিয়া ভাল জানে। তবু শেখালাম এই কারণে যে তারা জানুক যে তাদের প্রক্রিয়া আমি অর্থাৎ মেয়েরাও জেনে গেছি। যে রহস্যটা ফাঁস হয়ে যায় তার ধার আপনাতেই কিছু কমে আসে।

সবশেষে মেয়ে পাঠকের উদ্দেশ্যে চরিত্র নামের একটি কবিতা নিবেদন করছি—

‘তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখ
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে,
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।

যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে,
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।’

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন