৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়

তসলিমা নাসরিন

নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়

বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা হচ্ছিল এক বিদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে। এদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী শুনে তিনি বিষম উচ্ছসিত, বললেন—তোমাদের দেশে নারী-স্বাধীনতা এত বেশি যে নারীও এখানে প্রধানমন্ত্রী হয়! লোকটির কথায় আমি আচমকা বোকা বনে গেলাম। নারী-স্বাধীনতা আছে বলেই কি দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলের নেত্রী নারী? এর অর্থ কি এই যে, দেশে নারী-পুরুষে আর ভেদ নেই, অধিকারে কোনও হেরফের নেই?

তা নয়। মোটেও তা নয়। আমি ভিনদেশি ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বললাম রাজনীতির উঁচু পদ ওঁরা পিতা ও স্বামীর গুণে পেয়েছেন, নিজের গুণে নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কী বলেন, এবং একই সঙ্গে বিরোধী দলের নেত্রী? আপনিও কি একথা অস্বীকার করবেন? আপনারা যদিও পিতা এবং স্বামীর নাম ভাঙিয়ে ওপরতলায় উঠেছেন, দেশের শাসনতন্ত্র এখন আপনাদেরই হাতের মুঠোয়, আমি তবু গর্বিত। গর্বিত এইজন্য যে আপনারা নারী। কিন্তু নারী হয়ে কী লাভ, যদি আইন নাড়লেন কিন্তু পাল্টালেন না, যদি রাষ্ট্রের নানা অব্যবস্থার ভেতর দিয়েই এগোলেন কিন্তু কিছুরই পরিবর্তন হল না, সকল নিয়মই অশিষ্ট এবং অসুস্থই রইল। সংবিধান সংশোধনী বিল, ইনডেমনিটি বিল, ভাট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ইত্যাদি সমস্যার কথা আমি বলছি না। আমার সমস্যা নারী। তৃতীয় বিশ্বের ক্লান্ত, ক্লিষ্ট, জীর্ণ, রুগ্ন, মূখ, অন্ধ, বধির নারী।

রাজনীতিতে নেমেই আপনারা মাথায় আঁচল তুলে দিয়েছেন। পুরুষ-নেতারা কিন্তু মাথায় টুপি লাগাননি। ইসলাম যদি মেয়েদের মাথায় কাপড় দেবার কথা বলে, ইসলাম পুরুষের টুপি দাড়ির কথাও বলে। কিন্তু এদেশে নারীকে যতটা ধর্ম পালনে বাধ্য করা হয়, পুরুষকে ততটা নয়; কী বলেন প্রধানমন্ত্রী এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের নেত্রী? আমি জানি, মাথা ঢাকতে আপনারা কেউই অভ্যস্ত নন। যে মেয়ে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছে, যে মেয়ে একজন লেফটেনেন্ট জেনারেলের স্ত্রী, সে নিশ্চয় শাড়ির আঁচলে চুল ঢেকে চলাফেরা করে না। আপনারা এখন চলছেন কারণ আপনাদের সহযাত্রী পুরুষেরা শিখিয়ে দিয়েছে মাথায় ঘোমটা না দিলে এদেশের সাধারণ মানুষের মন পাওয়া যাবে না। তাই ঘোমটায় মস্তিষ্ক আড়াল করে আপনারা সাধারণের পক্ষপাত কামনা করছেন।

এ কি নিজেকেই ফাঁকি দেওয়া নয়, যেমন আপনারা দিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আপনারা একথা ভুলে যাননি, আর এ তো ভুলবার নয়, কারণ মেয়ে হয়ে জন্মালে এ সমাজ তাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয় যে সে মেয়ে, সে মেয়ে বলে তার ডানে নিষেধ, তার বামে নিষেধ, তার ঈশানে নিষেধ, তার নৈঋতে নিষেধ—এ কথা তো ভুলে যাবার কথা নয় যে তারা সেই নানা নিষেধের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ। এবং একবারও কি যাবতীয় নিষেধের জন্য আপনাদের ক্ষোভ হয়নি? আমি জানি, হয়েছে। মেয়েমাত্রই হয়। যদি হয়েই থাকে, তবে এখন কি করণীয় কিছু নেই তাবৎ নিষেধের বিরুদ্ধে, কর্তৃত্ব তো আপনাদের হাতে, ক্ষমতা এখন আপনাদের হাতের মুঠোয় নারী। এ যদি সত্য না হয় গুটিকয় পুরুষ-নেতার অঙ্গুলি নির্দেশে আপনারা চলছেন, ফিরছেন, কথা বলছেন তবে নারীকে অবদমনের নানা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপনারা একবার রুখে উঠন না কেন? আপনাদের কি লজ্জা হয় না, সাক্ষী দিতে দাঁড়ালে কলিমুদ্দিন অথবা রইসউদ্দিন একাই যে কথা বলতে পারে, আপনাদের যে কোনও একজনের সে কথা খাটবে না, দুজন লাগবে। অর্থাৎ খালেদা হাসিনা দু’জন মিলে একজন আবুল কালাম হয়।

আজ এসিড, কাল ধর্ষণ, পরশু খুন—এ কিন্তু এদেশের নিত্যদিনের ঘটনা। আর এ জাতীয় ঘটনার নানা ফাক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আসল অপরাধী। এই ফোকরগুলো এখনও কি তেমন খোলাই পড়ে থাকবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বীরাঙ্গনা বলে আমাদের খুব গর্ব হয়। আপনার জন্য এ মুহুর্তে নিবেদন করছি সর্বোত্তম শ্রদ্ধা।

সামনে পেছনে পুঁ পুঁ বাজিয়ে গাড়ি যায় আপনার জন্য। আমাদের ওসব পাহারার ব্যবস্থা নেই। একবার আসুন না শহরের রাস্তায়, সন্ধ্যার অন্ধকারে ফুটপাতে একবার হাঁটতে আসুন—গণিকা ভেবে আপনাকে কেমন খামচে ধরে পুরুষের লোভাতুর থাবা দেখুন, আমি আপনাকেও বলছি বিরোধীদলের নেত্রী। এই শহরের ফুটপাতে কত অসংখ্য নারী দশ বিশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে নিজ চোখে দেখেছেন কখনও? দেখে কি মনে হয় না এ আসলে নিজেদেরই জলের দরে বিক্রি হয়ে যাওয়া? মনে হয় না নারী আসলে পটল কুমড়ো আলু জাতীয় কিছু? এবং আপনারাও, যত ওপরেই উঠুন না কেন, আসলে এর বাইরে নন।

দেশ থেকে পতিতালয় উঠিয়ে মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা যদি নারী হয়ে না নিন, তবে নেবে কে? আপনার প্রতিনিধিত্ব করছেন একজন স্বামীর, একজন পিতার। যদি ও দু’জনের মৃত্যুর শোধ নিতেই ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, সে আলাদা কথা। যদি আরও কিছু বোধের জন্ম হয়, আরও কিছু চেতনার সঞ্চার, যদি মনে হয় এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে—বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ বধূহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী-পাচার রোধ করা প্রয়োজন—তবে আমার গভীর বিশ্বাস এই যে, এ বিষয়ে যতটা না পুরুষ শাসক উদ্যোগী হবে, তার চেয়ে অধিক উদ্যোগী হবেন আপনারা, এবং সেটিই সঙ্গত।

সম্পদ এবং সম্পত্তি জীবনযাপনের জন্য অবশ্য প্রয়োজন, এবং মানুষের মর্যাদা বাড়াবার জন্যও । মুসলিম উত্তরাধিকারী আইন মেয়েদের অসম্মান করবার নানাবিধ ব্যবস্থা নিয়েছে। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী তার সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পান, তাদের কোনও সন্তান না থাকলে স্বামী দুই ভাগের এক ভাগ পান—অথচ স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ পান, তাদের কোনও সন্তান না থাকলে স্ত্রী চার ভাগের এক ভাগ পান। স্ত্রী এবং স্বামীর ক্ষেত্রে সম্পত্তি বণ্টনের এমন অসাম্য কেন? অসাম্য কেন সন্তানের ক্ষেত্রে? ছেলে ও মেয়ে থাকলে মেয়ে ছেলের অর্ধেক সম্পত্তি পান। মৃত বাবা ও মায়ের অন্যান্য উত্তরাধিকারীর অবর্তমানে একমাত্র ছেলে তার বাবা ও মায়ের সব সম্পত্তির মালিক হন এবং এ ক্ষেত্রে একমাত্র মেয়ে হলে তিনি মৃত বাবা মায়ের সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ পান। স্বামী এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে, ছেলে এবং মেয়ের ক্ষেত্রে সম্পত্তির এমন অসম বণ্টন কেন, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেত্রী? ধনী দরিদ্রে পার্থক্য ঘোচানো যেমন প্রয়োজন, পুরুষ এবং নারীতেও কি নয়? যদি এই ব্যবধান, এই অসাম্য ঘোচানো সম্ভব না হয় তবে জমিজমার রাষ্ট্ৰীয়করণই করুন না কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যেটি সবচেয়ে মঙ্গলময়। নাকি এ সম্ভব নয় যেহেতু চারপাশের পুরুষ-উপদেষ্টার চাপ, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মের চাপ, সাম্রাজ্যবাদের চাপ, বিদেশি সাহায্যের চাপ আপনাকে ক্ষমতায় আসীন রাখবে। এবং আপনি নেহাতই আপনার স্বামীর নির্জলা প্রতিনিধি—আপনার নিজস্ব কোনও বিচারণ নেই, বিবেচন নেই, বোধ নেই, ধর্ম নেই, আদেশ নেই, অধ্যাদেশ নেই!

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন