৭৪. দাসী ছহবত

তসলিমা নাসরিন

দাসী ছহবত

সমাজের এক বিশিষ্ট ভদ্রলোকের কথা বলছি। ভদ্রলোক ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ইহকাল এবং পরকাল বিষয়ে সামান্যও অতৃপ্ত নন। তিনি সকালবেলা নাস্তা করে অফিসে যান, এক টেবিলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দুপুরের খাবার খান, বিকেলে মাঝে মধ্যে আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি বেড়াতেও যান, ভদ্রলোক তাঁর অতীত ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন নন।

ইদানীং এই ভদ্রলোকের একটি অঘটন ঘটে। অঘটনটি প্রথম ঘটে আসরের নামাজ প্রায় শেষ হবে হবে, তখন। ভদ্রলোক জায়নামাযে বসে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতউল্লাহ’ বলে যে-ই ঘাড় ফিরেয়েছেন ডানদিকে, তখনই চোখে পড়ে একলা জরিনা—পনেরো বছরের সরল কিশোরী, বাড়ির কাজকর্ম করে, বিকেলে বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে খানিক জিরোচ্ছে। ভদ্রলোকের চোখ ও ঘাড় ডানদিকেই পড়ে থাকে, বায়ে তো ফেরেই না, মোনাজাতও শেষ হয় না ।

এরপর বাড়ির সকলকে আড়াল করে ভদ্রলোক জরিনাকে দেখেন, দেখেন আর তার শরীরের আগুনে কে যেন লোভের পেট্রল ঢেলে দেয়। ভদ্রলোক তার অদম্য ইচ্ছেকে দিনের পর দিন শাসন করে চলেন। ঘরে সুন্দরী শিক্ষিত বউ, তবু তার মন পড়ে থাকে সারাদিনের ঘাম ও ক্লান্তিমাখা দুৰ্গন্ধ শরীরে। মন তাঁর শাসন মানে না।

একদিন তাঁর দুর্দমনীয় ইচ্ছের বিস্ফোরণ এভাবেই ঘটে যে, সেদিন, ভর দুপুরবেলা, বাড়ির সকলে যার যার প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে, আর সময়ের কিছু আগেই ভদ্রলোক বাড়ি ফেরেন, বাড়ি জুড়ে একটি কেবল প্রাণী—জরিনা। ভদ্রলোক প্রথমেই জরিনার হাতে একশ’ টাকা গুজে দেন এবং বলেন কেউ যেন না জানে। ভদ্রলোকের শরীরের ভেতর একটি সাপ কেবল গোঙরায়।

অঘটন তো একরকম আগুনই, ছাই চেপে একে রাখা যায় না। একদিন জানাজানি হয়ে যায়। বউ কাঁদে, ছেলেমেয়ে কাঁদে। পাড়াপড়শি সকাল বিকেল ভিড় করে। ভদ্রলোক এই ভিন্ন স্বাদের আকর্ষণে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন, তিনি জরিনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কঠোর হাতে দমন করেন।

একসময় আত্মীয়স্বজন আসেন, গুরুজন আসেন। বৈঠক ঘরে সকলে মিলে শলা-পরামর্শ হয়। শেষ অবধি সিদ্ধান্ত হয়—এ তো একেবারে জাত যাওয়ার কাণ্ড কিছু নয়, হাজার হলেও পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষের নানা রকম সাধ আহ্লাদ থাকতেই পারে। বাইরে এত খাটাখাটি করে এসে ঘরে যদি নীতির বাইরে দু-একটা ঘটনা তারা ঘটানও, এমন কোনও অন্যায় তাতে নেই। আর নীতির বাইরেই বা বলি কেন, পবিত্র কোরানেই তো দাসী-বাদীকে ভোগ করবার কথা লেখা আছে।

শেষে এমনই সাব্যস্ত হয় যে, যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে এতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করিতে পারবে না, তবে বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাহাকে তোমাদের ভাল লাগে; দুই, তিন অথবা চার, আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করিতে পারবে না তবে একজনকে এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে (সূরা নিসা ও আয়াত ১ রুকূ) এবং নারীর মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত সকল সধবা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। তোমাদের জন্য ইহা আল্লাহর বিধান। (সূরা নিসা ২৪ আয়াত ৫ রুকু)

অর্থাৎ একথা স্পষ্ট যে দাসী নিষিদ্ধ নয়। সূরা আহযাবের ৫২ আয়াতে লেখা ‘তোমার জন্য কোনও নারী বৈধ নহে এবং তোমার স্ত্রীদিগের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নহে যদিও উহাদিগের সৌন্দর্য তোমাকে বিস্মিত করে, তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে।‘

‘এবং যাহারা নিজদিগের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। তাহাদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ক্ষেত্র ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না।‘ (সূরা মাআরিজ আয়াত ২৯/৩০ রুকু ১)

অর্থাৎ দাসী বৈধ। দাসীকে ভোগ করায় কোনও পাপ নেই। যুদ্ধে পরাজিত সৈন্যদের ঘরবাড়ি-অর্থ-শস্য-অশ্ব-নারী বিজেতার দখলে আসে এবং সকলই তাদের ভোগের জন্য বৈধ। শুধু তাই নয় আল্লাহতায়ালা এও বলেছেন ‘আমি তোমার জন্য বৈধ করিয়াছি তোমার স্ত্রীগণকে, যাহাদিগের মাহর তুমি প্রদান করিয়াছ এবং বৈধ করিয়াছি ‘ফায়’ (যে সম্পদ যুদ্ধ ব্যতীত হস্তগত হয়) হিসেবে আল্লাহ তোমাকে যাহা দান করিয়াছেন তন্মধ্যে হইতে যাহারা তোমার মালিকানাধীন হইয়াছে, তাহাদিগকে।‘ (সূরা আহ্যাঁব আয়াত ৫০ রুকু ৬)

এই যদি হয় আইন তবে সে আইনে পুরুষের জন্য ক্রীতদাসী বা ভাড়াটে দাসী কোনও দিক থেকে অসঙ্গত বা অবৈধ নয়।

ভদ্রলোক সমাজের উঁচুমাথাদের সায় পেয়েছেন। তাই এ ব্যাপারেও তাঁর কোনও অতৃপ্তি নেই। এখনও তিনি সকালবেলা নাস্ত করে অফিসে যান, এক টেবিলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দুপুরের খাবারও খান, বিকেলে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, বন্ধুর বাড়ি সকলই সারা হয়। এবং ইচ্ছে হলে জরিনা হোক ফাতেমা হোক, আয়শা কিংবা সেলিনা হোক সকলকেই তার নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। ভদ্রলোক তার এই বর্তমান নিয়ে সামান্যও উদ্বিগ্ন নন।

ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রতিবাদ করতে চান, ক্ষোভে কষ্টে তিনি কাঁদেন। কিন্তু তাতে কী? একসময় তার নিজেকেই সান্তুনা দিতে হয় এভাবে যে কোরানের কথা তো অমান্য করা যায় না। পুরুষমানুষকে আল্লাহ যে সুবিধা দিয়েছেন সেই সুবিধা তারা নেবেন না কেন, আর সুবিধা তো দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহই।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন