১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’

তসলিমা নাসরিন

১. একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেলে বাংলা একাডেমির গেটে প্রতি বছর খুব নীরবে ঘটে যাচ্ছে অশ্লীল সব ঘটনা। একাডেমির পরিচালক এই অশ্লীলতার খবর জানেন না এমন নয়, জানেন, কিন্তু প্রতিরোধের কোনও উদ্যোগ তাঁর নেই।

গেটের ভিড়ের মধ্যে মূলত যারা ভিড় তৈরি করে, মনে হয় তারা ঢুকছে কিংবা বেরোচ্ছে, আসলে তারা একাডেমিতে ঢোকেও না, একাডেমি থেকে বেরও হয় না। কেবল গেটের কাছে ভিড় পাকায়। হঠাৎ ধাক্কায় গায়ে গায়ে গড়িয়ে পড়ে সকলে, আবার উঠে দাঁড়ায়, ভিড়ের চাপে ও তাপে এক একজন মথিত হতে হতে যদি ছিটকে বেরোতে পারে তো সে যাত্রা সে বাঁচল। কিন্তু বাঁচে না ওই মেয়ে মানুষেরা। কিছু ছেলের, ওরা দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে, এই ভিড় সৃষ্টির পেছনে একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। ভিড়ের মধ্যে কোনও মেয়ে পড়লে, আমার বলতে বাধে না যে সেই মেয়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসে অসংখ্য হাত এবং মেয়ের স্তন, তলপেট, উরু ও নিতম্বে যে থাবা পড়ে তা তাকে শারীরিকভাবে তো অসুস্থ করেই, মানসিকভাবেও আর সুস্থ রাখে না।

শরীরে শাড়ি নেই, ব্লাউজ ছেড়া, এই অবস্থায় সেদিন ভিড় থেকে বেরিয়েছে একটি একুশ-বাইশ বছরের মেয়ে; এইমাত্র ধর্ষিতা হয়ে অবিন্যস্ত পায়ে হেঁটে আসা নারীর মত তাকে মনে হয়—দেখে আমি আমূল শিহরিত হই, এই যদি হয় একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেল, এই যদি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তবে যারা এই ভিড়ের বিকৃত যৌন-আনন্দ শেষে ভাল মানুষের মত মিশে যায় বই মেলায়, বই দেখে, কেনে, গান গায় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো—ধিক সেই বাঙালি, ধিক সেই মুখে একুশে ফেব্রুয়ারির গান।

এমন মেয়ে নেই, যে মেয়ে ভিড় পার হয়ে মেলায় ঢুকেছে অথচ তাঁর নারী অঙ্গে কারও অসৎ থাবা পড়েনি। আমি অনেক মেয়েকে ভিড়ের ভয়ে ফিরে যেতে দেখেছি, তারা ফিরে যায় কারণ জানে নিগ্রহের প্রকৃতি ওখানে কি রকম। যারা ভিড় পেরিয়ে যায়, তারা কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, কেউ লজ্জায় নত হয়, যেন সমস্ত গ্লানি তারই যেন নারী অঙ্গ ধারণের পাপ তার, যেন নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই হয়, একুশের চেতনায় উদ্দীপিত পুরুষ এভাবেই সহযাত্রী নারীকে স্বাগত জানায়।

বেশ কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হচ্ছে, ব্যাপারটিকে কেউ তেমন আমল দেয়নি। একটি মেয়েকে যদি প্রতিরোধ এবং প্রতিঘাতের দায়িত্ব দেওয়া হয় তবু কোনও মীমাংসা হয় না কারণ প্রথমত ভিড়ের মধ্যে চিহ্নিত করা যায় না প্রতিপক্ষ কে এবং এক মেয়ের উপর আক্রমণ হয় কম করে হলেও বিশ থেকে তিরিশ ছেলের। একা কোনও মানুষের পক্ষে এই সংখ্যাধিক্যের আক্রমণ প্রতিহত করবার প্রশ্ন ওঠে না।

যদি একাডেমি কর্তৃপক্ষ এই বিশেষ দিনটির দায়িত্ব না নিতে পারেন তবে সকল নারী একযোগে ঘোষণা করুক তারা ফেব্রুয়ারির বই মেলায় যাবে না। নিগৃহীত হয়নি বলে যে নারী পিছিয়ে যায়, তাঁর মত দুর্ভাগা আর কে আছে কারণ তাকে নিগ্রহ করবার জন্য সময় এগিয়ে আসছে। যে সমাজে নারীকে সম্মান করবার রীতি নেই, সেই সমাজের সকল দুনীতি আগলে বসে আর যাই হোক, নীতির আশা করা চলে না।

২. বাংলাদেশ টেলিভিশনে রজতজয়ন্তী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অভিনেতা আফজাল হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছেন—আফজাল হোসেন সেই খবর জানেন কি না যে তাঁর জন্য বাংলাদেশের তাবৎ ললনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই অরুচিকর প্রশ্ন শুনে আফজাল হোসেন হেসেছেন, হাসতে হাসতে বলেছেন—ললনাদের দীর্ঘশ্বাস নীরব না হয়ে সরব হলে তাঁর অর্থাৎ আফজালের আশেপাশে একটি ভূমিকম্প ঘটে যেত। নারী নিয়ে এ ধরনের স্থল রসিকতা করা একজন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক, শিল্পের নানা শাখায় যাঁর অবাধ বসবাস, তাকে মানায় না। একজন শিল্পী যদি নারীকে রঙ্গরস করবার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন, নারীকে যদি সেই শিল্পী মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে, সম্মান করতে না জানেন তবে তাঁর শিল্পের প্রতি, তাঁর শিল্পীতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতি আমি আশংকা প্রকাশ করি।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন