১৩. নারীর শরীর

তসলিমা নাসরিন

যুগে যুগে পুরুষের কাছে নারীর আবেদন তার রহস্যময়তার। সেই রহস্যের আড়ালে যে রক্তমাংসের নারী সে আসলে কেমন? কলকাতা থেকে প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ১৯৯০ সংখ্যা সানন্দার প্রচ্ছদে একটি নারীমূর্তি এবং এই প্রশ্ন এইটুকু বুঝতে সাহায্য করে যে, রক্তমাংসের নারীকে যারা বর্ণনা করতে চায়, আর যাই হোক নারী নিয়ে তারা সস্তা রসিকতা করে না।

নারীর শরীর, শরীর নিয়ে নারীর উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা, শরীর সমস্যার সমাধান–প্রচ্ছদ কাহিনিতে আলোচিত হয়েছে এই সব মৌলিক বিষয়। এই সংখ্যার নারী সম্পর্কিত প্রতিটি রচনাই শিক্ষামূলক ও অত্যন্ত মূল্যবান। এই সংখ্যায় কাব্যে, সমাজে মহিলা কবিদের স্থান কোথায় তাই নিয়ে আছে বিশেষ নিবন্ধ। আছে আর যা থাকে, ফ্যাশন, ধারাবাহিক, গল্প, বিতর্ক, খেলা, রান্নাবান্না, বাবুবিবি সংবাদ, সংস্কৃতি ইত্যাদি।

এই সানন্দা নারী সংখ্যাটি বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি পায়নি। কেনো এই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ হয়েছে, কোন রচনায় অশ্লীলতার দোষ পড়েছে জানতে গিয়ে আমি যে কারনটি শুনেছি তা আমাকে অবাক করেছে। নারীর শরীর সম্পর্কিত ছবি ও আলোচনায় নাকি দেশের পত্র-পত্রিকার ভালো মন্দ লক্ষ্য রাখবার কর্তাব্যক্তিরা বড় নাখোশ হয়েছেন তাই এই পত্রিকাটি দেশে ঢোকার ছাড়পত্র পায়নি। যদিও এর আগে পুরুষ সংখ্যাটির ব্যাপারে কোনো বাধা ছিলো না।

নারীর শরীরের গঠন, শারিরীক বিকাশের প্রথম পর্যায়, প্রতিটি ধাপ বয়:সন্ধি রিতুস্রাব, যৌন প্রক্রিয়া গর্ভাধান,গর্ভধারণ, রজ:নিবৃত্তি, রজ:নিবৃত্তের পরে সমস্যা ও চিকিৎসা, বার্ধক্য, বার্ধক্যের বাহ্যিক চিহ্ন, মানসিক চাপ ইত্যাদির আলোচনা যদি নিষিদ্ধ হয়, তবে বিজ্ঞান নিষিদ্ধ হবে, চিকিৎসাশাস্ত্র নিষিদ্ধ হবে, নারীর জীবনযাপন নিষিদ্ধ হবে।

নারী নিয়ে নানা রস রচনা, ব্যংগ, কৌতুক, অশ্লীলতা যৌনসংগম এর নোংরা বর্ণনা সম্বলিত পত্র পত্রিকা এদেশে বড় জনপ্রিয়। কাতারে সাজিয়ে রাখা অভিসারিকা, জলসা, কামনা, বাসনা, যৌবন মধু, প্রেমতরংগ, রসের হালুয়া ইত্যাদি দেদার বিক্রি হচ্ছে। আমাদের শ্লীল-অশ্লীল যাচাইয়ের কর্তাব্যক্তিরা এ জাতীয় অসুস্থ জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করেন না।

তাঁরা প্রতিবাদ করেন সুস্থতা ও সুন্দরের বিরুদ্ধে, জ্ঞান ও রুচির বিরুদ্ধে, জীবন ও শিল্পের বিরুদ্ধে। নারী সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যাপারে সকলে সচেতন হয়ে উঠলে সম্ভবত আমাদের কর্তাব্যক্তিদের সমুহ ক্ষতি। এখনও যারা বিশ্বাস করে নারী শরীর অস্তিমজ্জায় দুর্বল, তারা আবার মানসিক দিকে সবল না হয়ে উঠে, কিভাবে ডিম্বাণুর ক্রোমোজোম শুক্রকীটের এক্স ক্রমোজম এর সংগে মিলিত হয়ে নারী ভ্রুণ এবং ওয়াই ক্রোমোজোম এর সাথে মিলিত হয়ে পুরুষ ভ্রুণ গঠন করে তা জেনে বুঝে বন্ধ্যাত্বের এবং নারী পুরুষ সন্তান জন্মানোর দায় দায়িত্ব যদি নারী তার কাঁধে না নেয় তবে কি হাল হবে কুসংস্কারের, অসম্মানের ও নির্যাতনের?সন্তান এবং পুরুষ সন্তানের উদ্দ্যেশে শাহজালাল থেকে খাজা মইনুদ্দিন পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ যদি না করতে হয় তবে দেশ সুদ্ধ গজিয়ে উঠা সহস্র মাজার ব্যবসারই বা কি গতি হবে?তাবিজ, মাদুলি,পানি-পরা,যদি নাই প্রয়োজন হয় তবে রাজনৈতিক পীর ব্যবসাই বা কোথায় দাঁড়াবে?

অধিকাংশ নারী যারা মনে করে রজ:নিবৃত্তি যৌনমিলনের অন্তরায়, তারা যদি জেনে ফেলে রজ:নিবৃত্তির পর একজন নারীর শুধু বন্ধ্যাত্বই আসে,যৌনক্ষমতা লোপ পায় না তবে তারা প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবে; যে সমাজে নারীর শারিরীক মুক্তি নেই, সেই সমাজ কেন দিবে নারীকে মানসিক মুক্তি?

যৌন-প্রক্রিয়ায় এমন অনেকেই আছে যারা জানে যে এতে নারীর চূড়ান্ত সম্ভোগের কোন ব্যবস্থা নেই।তারা কেবল পুরুষের ব্যবহারের জন্য তৈরি, তারা সানন্দার ওই নারী সংখ্যা থেকে নারীর শীর্ষসুখ যদি সচেতন হয়,শিক্ষিত হয়,তবে নিশ্চই কতিপয় পুরুষের বিপদে পরবার আশংখা আছে। আর তাতে সানন্দার ছাড়পত্র দেবার কর্তা ব্যক্তিদেরও বিপদ কম নয়।

নারী সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ মন্তব্য করেছেন। সত্যজিৎ রায় বলেছেন-মেয়েদের সম্বন্ধে আমার অবচেতনে একটি বিশ্বাস আছে যে তারা মূলত বেশি সৎ বেশি স্পষ্টভাষী। বীর সাংভি বলেছেন পুরুষের খুব গর্ব যে তারা সবজান্তা। এমনকি তারা নারীর ও নাড়িনক্ষত্র সব জানে।তাই বদান্যতা করে জানাতে চায় যে তারা মেয়েদের খুব ভালবাসে, তাদের দেখবাল করে, তারাই মেয়েদের রক্ষাকর্তা। হায়! যদি তারা একটু ও জানতো যে আসলে তারা খুব বেশি কিছু একটা জানে না। সবচেয়ে কম বুঝে নারীকে।

মেয়েরা রাঁধবে, বাড়বে,সন্তান ধারণ করবে। কবিতা লেখা নারীর কম্ম নয়। সমাজের প্রায় সকল মানুষের এই ধরনের সংস্কারের ভিতরে বাস করে যারা কবিতা লেখে, সেই কবিরা নিজ নিজ ক্ষোভ ও বিশ্বাসের কথা লিখেছেন,লিখেছেন-কবি, সে যদি পুরুষ হয় তবে বলা হবে কিঞ্চিৎ লাজুক আর নারী হলে কিঞ্চিৎ বেহায়া। নারীর শরীর চিরদনেই নারীর পক্ষে সামাজিক বিঘ্নের কারণ হয়ে এসেছে।তাই মধ্যযুগের ভারত বর্ষের নারী কবিরা ছিলেন তাপসী। তাঁরা সকলেই চেস্টা করেছেন নারী দেহকে যেকোন উপায়ে উত্তীর্ণ হয়ে একটা লিংগ চিহ্নবিহীন ব্যাক্তিত্ব অর্জন করতে। পুরুষকে তো তার লিংচিহ্ন গুছিয়ে তবে শিল্পির স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় না? আমরাই বা কেন নারীত্বের পূর্ণ পরিচয়ে অহংকৃত হয়ে কলম ধরব না?

লিখেছেন–পুরুষ বন্ধুরা চায়, আমি চা- জলখাবার করি, জলের বোতল এগিয়ে দিই। তারা আমার তৈরী চায়ের এবং সংরক্ষিত চেহারার সুখ্যাতি করবে কিন্তু প্রতি-কবিতা বা উত্তর আধুনিক কবিতা বিতর্কে আমার আংশগ্রহণ মানবে না। নির্বাচনের গতি, প্রকৃতি বিষয়ে অভিমত কিংবা কবিতার সংগে অডিও ভিস্যুয়ালের সম্পর্ক নির্ধারন তারা আমার মুখে শুনতে মোটেও রাজি নয়।

লিখেছেন–আমার মনে হয় আমি সেই মেয়ে, চার হাজার বছর আগে যার হাত থেকে বেদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল,বাধ্য করা হয়েছিল সংস্কৃতের বদলে প্রাকৃত বলতে। ধিক সেই পূর্বপুরুষ কে যিনি একটি মেয়েকে গৃহবন্দি বধু করে অন্যকে করেছিলেন জনভোগ্য দেবদাসী। একজনকে নগরনঢী অন্যজনকে সেবাদাসী।

স্তনের অসুখ হলে সানন্দায় স্তন পরীক্ষার করবার নিয়মাবলী দেখে ছি ছি করেছেন যে ভদ্রলোকেরা আমি নিশ্চিত সেখানে উপস্থিত নারীটির স্তনের দিকে তাঁরা আড়চোখে তাকিয়েছেন এবং তৃষ্ণার্ত হয়েছেন।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন