২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত

তসলিমা নাসরিন

নির্বাচিত কলাম – স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত

‘পতি ধর্ম, পতি কর্ম পতি সারাৎসার।
পতি ভিন্ন রমণীর গতি নাহি আর।
পতি আজ্ঞা, সতী পক্ষে, বেদের সমান।
পতি তুষ্ট হলে, তুষ্ট প্রভু ভগবান।’

বাঙালি গৃহস্থ ঘরের দেওয়ালে এক সময় এ জাতীয় সচিত্র ‘সতীর সার কথা’ সযত্নে শোভা পেত। মেয়েরা রঙিন সুতোয় লিখে রাখত—‘পুরুষ তমাল তরু প্রেম অধিকারী, নারী যে মাধবীলতা আশ্রিতা তাহারি।’ পৃথিবী বার বার আবর্তিত হচ্ছে, তবু পতি প্রাণ, পতি মান, পতিই ভূষণ সেই যে কবে মানুষের মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেথে ছিল তা আজও অমলিন।

‘রমণীর পতি বিনা গতি নাই।
পতির বিষয়ে বিশেষ জানাই।
পতি যা বলেন তাহাই করিবে।
পরম যতনে পতিকে সেবিবে।
পতি খেলে খাবে, না খেলে খাবে না।
পতি শুলে শোবে, না শুলে শোবে না।’

এ ধরনের হিতোপদেশ মেয়েরা ধর্মের বাণীর মত মুখস্থ করত। নতমুখে বলত—‘পতির মহিমা আমি কী বণিতে পারি। না পারেন ভাগীরথি, আমি ক্ষুদ্র নারী।’ নারী নিজে মানে সে ক্ষুদ্র। নারী এই কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করে যে সে ক্ষুদ্র, অতিশয় ক্ষুদ্র। যে স্বামীভক্তি বা পাতিব্ৰত্য চিত্র সেকালের নারীরা লালন করত, একালের নারীরা তাদের থেকে কোনও অংশে কম যায় না। কত সংস্কার ভাঙে, বদলায়—কিন্তু নারী নিয়ে যে সংস্কার তার কেবল বিস্তার আছে, বিলুপ্তি নেই। স্বামী শব্দের অর্থ প্রভু, মনিব, অধিপতি, মালিক ইত্যাদি। স্বামী শব্দটি বাংলা ভাষায় যতদিন ব্যবহৃত হবে পুরুষ ততদিন সঙ্গত কারণেই কর্তা, প্রভু, মনিব ও মালিক। বেগম রোকেয়া যুক্তি দিয়েছিলেন–‘দাসী শব্দে অনেক শ্ৰীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, স্বামী শব্দের অর্থ কী? দানকর্তাকে দাতা বলিলে যেমন গ্রহণকর্তাকে গ্রহীতা বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর বলিলে অপরকে দাসী না বলিয়া আর কী বলিতে পারেন?’

মানুষকে দ্বিচক্র শকটের সঙ্গে তুলনা করে রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে লিখেছেন– ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না—সে কেবল একই স্থানে (গৃহ কোণেই) ঘুরিতে থাকে।’

এদেশে বংশ নির্ধারণ হয় পৈত্রিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। পৈত্রিক পরিচয়ই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নারীর সতীত্বের উপর রাখা হয় কড়া নজর তাই যৌন শুচিতা পুরুষের জন্য না হলেও নারীর জন্য প্রয়োজনীয়। এইসব যুক্তি দেখিয়ে সমাজের ধূর্ত লোকগুলো নানা রকম সুবিধে নিচ্ছে, যারা সুবিধে নিচ্ছে তারা ‘স্বামী’ দলভুক্ত।

ধর্ম তাদের যথেচ্ছাচারী করেছে। আদিম থেকে আধুনিক সমাজ–সব সমাজই তাদের বিস্তর সুবিধে দিয়েছে। কারণ এ সবের রচয়িতা এবং নির্মাতা স্বামীদলভুক্ত পুরুষ। ইসলাম তাদের চার বিয়ে করবার অধিকার দিয়েছে। অনিতা নামে পাকিস্তানের এক মেয়ে সেদিন মেয়েদের চারটি বিয়ের কথা বলেছিল। শুনে আঁতকে উঠেছে স্বামীদলভুক্তরা। স্বরচিত আসন আবার টলে যায় কী না কে জানে।

শুধু ইহকালই নয়, পরকালেও নিজেদের ব্যবস্থা আরামপ্রদ করে রেখেছে তারা। সত্তর জন হুর বেষ্টিত জীবন শুধু তারাই ভোগ করবে, আর মেয়েদের কপালে ইহকালের স্বামীটিই জুটবে। যে কোন সচেতন মানুষের জন্য এই পক্ষপাতিত্ব অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু মানুষ সচেতন নয়। মানুষ সুবিধাভোগী, মানুষ স্বার্থপর। মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এখন শুভ কাজে নয়, অশুভ কাজেই বিকশিত হয় বেশি। আর কিছু মানুষ, যাদের মেয়ে মানুষ’ বলতেই মানুষেরা পছন্দ করে, ওরা কেবল হাততালি দেয়। সবার নিচে, সবার পিছে, সবহারাদের কাতারে দাড়িয়ে ওদের কাজ শুধু হাততালি দেয়া। যে যা-ই বলে মেনে নেয়া।

ওরা আসলে মানুষ নয়। ওরা ভোগ্যবস্তু। ‘নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং খেতখামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হইয়াছে। এইসব ইহ জীবনের ভোগ্যবস্তু।’ এই কথা আমার নয়। এই কথা সূরা আল ইমরানের চৌদ্দ আয়াতের কথা। আয়াতের উল্লিখিত মানুষ—যারা কখনও নারী নয়—যারা পুরুষ, নারী তাদের ভোগ্যবস্তু। নারী শুধু ভোগ্যবস্তুই নয়। নারী শস্যক্ষেত্রও বটে। ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতঃপর তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিবে।’ (সূরা বাকারা ২২৩ আয়াত)

বাংলাদেশে একদিকে চলে ইসলাম চর্চা, অন্যদিকে নারীমুক্তি আন্দোলন। অনেকে বলে দুটোতে বিভেদ নেই। বলে, ইসলাম নারীকে যত সন্মান দিয়েছে, আর কোনও ধর্ম নারীকে তত সম্মান দেয়নি। সূরা নিসার ৩৪ আয়াতে আছে—‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাহদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহদের ধন সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধবী স্ত্রীরা অনুগত, এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে উহারা স্বামীর অনুপস্থিতিতে সতীত্ব ও স্বামীর আর সব অধিকারের হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাহদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর।’ সম্মানের মাত্রা সম্ভবত এটুকুতেই বেশ অনুমান করা যায়।

ধর্ম ব্যবসায়ীরা ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ নামক গ্রন্থ বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছে। আমাদের অর্ধশিক্ষিত ছেলেরা ভালবেসে স্ত্রীকে উপহার দেয় ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য’। শিক্ষিতরা হয়ত হাতে হাতে কিছুই দেয় না, মনে মনে কিন্তু দেয়। আর সেই দেওয়া হাতে দেওয়ার চেয়ে কম মারাত্মক নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এর কারণ, ঘরের পুরুষদের খাবার পর উচ্ছিষ্ট যা থাকে, মেয়েরা তাই খেয়ে উদর পূর্তি না হলেও হৃদয় পূর্তি করে।

স্বামীর এঁটো উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সংস্কার বাঙালি সমাজে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের যে সামাজিক চিত্র বৈদিক সাহিত্য বহন করছে তাতে দেখি–‘ভুক্তোচ্ছিষ্টং বধৈব দদাৎ’ অর্থাৎ খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে (গৃহ্যসূত্র ১/৪/১১)। জীর্ণ জুতো কাপড় দাসকে দেবার এবং খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবার বিধান শাস্ত্রে আছে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত। আর এ কথা স্বীকার্য যে, অশিক্ষিত মানুষ ভাল মন্দ শিক্ষা নেয় ধর্ম থেকে। আর আমাদের ধর্ম যেখানে নারীর বিরুদ্ধে খড়গ উচিয়ে আছে, সেখানে নারী স্বাধীনতা নিয়ে এই সব লেখালেখি পুরুষ পাঠকদের জন্য অবসরের মজাদার খোরাক জোটানো ছাড়া আর কিছু নয়।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন