৭২. ফুলের মত পবিত্র

তসলিমা নাসরিন

ফুলের মত পবিত্র

‘ফুলের মত সুন্দর এবং পবিত্র’—এই উপমাটি প্রায়শই ব্যবহার হয়, ব্যবহার হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে। যে মেয়েটি ছেলেপিলের দিকে চোখ তুলে তাকায় না, ছাদে ওঠে না, হাসে না, পোশাক-আশাকে পর্দানশিন, হাঁটাচলায় মন্থর, কণ্ঠস্বর অনুচ্চ, সাধারণত সেই মেয়েকেই ‘ফুলের মত পবিত্র’ বলে রায় দেওয়া হয়।

পবিত্রতার গাঢ় অর্থ নারীকে কোনও পুরুষের স্পর্শ না করা, বিশেষ করে পর-পুরুষ। ফুলের সঙ্গে কখনও কোনও পুরুষের উপমা হয় না, হয় নারীর। ফুল দেখতে বাহারি, সুগন্ধ ছড়ায়। নারীকে দেখতে নানা রঙের হতে হয়। গোলাপের পাপড়ির মত ঠোট, ভ্রমর কালো চোখ, গোলাপি গাল, ঘনকালো রেশমি চুল, দুধে আলতা অথবা কাচা হলুদ রঙের ত্বক, মুক্তোর মত সাদা দাঁত। মেয়েদের চুল ও ত্বক থেকে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ না বেরোলে মেয়েদের ঠিক মেয়ে বলে মানায় না। তাই প্রতিদিন ঘষে মেজে গায়ের দুর্গন্ধ দূর করবার জন্য সাবান তৈরি হচ্ছে, সেসব সাবানে কমনীয় রমণীরা সৌন্দর্য রক্ষার বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। নানা রকম সুগন্ধিতেও বাজার ছেয়ে গেছে। মানুষেরা ফুলের সুগন্ধ নেয়, এক্ষেত্রে ফুল যদি নারী হয়, মানুষ তবে পুরুষ। মানুষরূপী পুরুষেরা ফুলরাপী নারীর ঘ্রাণ গ্রহণ করে, নানা রঙে মুগ্ধ হয়। ফুলকে কেউ ছলে-ছিড়লে ফুল যেমন নেতিয়ে পড়ে বা মরে শুকিয়ে যায়, নারীকে তেমনি পুরুষ স্পর্শ করলে নারীর পবিত্রতা নেতিয়ে পড়ে বলে মনে করা হয়। নারীকে সুগন্ধি ফুল ভাবা হয় বলেই তাকে ভ্রাত বা অনাঘ্ৰাতা বিশেষণে চিহ্নিত করা হয়। অনাঘ্ৰাতা নারী অর্থ যে নারীর ঘ্রাণ কেউ নেয়নি। নারী যে কোনও সুগন্ধি উদ্ভিদ বা সুগন্ধি দ্রব্য—যা একই সঙ্গে বর্ণে ও গন্ধে মানুষ’-কে মুগ্ধ করে, মোহিত করে, তুষ্ট করে ও তৃপ্ত করে।

আজ অবধি কোনও পুরুষকে এরকম বর্ণ গন্ধযুক্ত উদ্ভিদের উপমায় অলস্কৃত করা হয়নি। আজ অবধি কোনও নারী চিত্রকর বা ভাস্কর পুরুষের শরীরকে নানা ঢংয়ে, রঙে ও রেখায় স্পষ্ট করেনি—যেরকম করেছে পুরুষ চিত্রকর বা ভাস্কর নারী-শরীর নিয়ে। আজ অবধি কোনও নারী-কবি বা ঔপন্যাসিক পুরুষের শরীরের নানা প্রত্যঙ্গের লোভনীয় বর্ণনা করেনি—যেরকম করেছে পুরুষ কবি বা ঔপন্যাসিক নারী-শরীর নিয়ে। এর কারণ পুরুষ-শরীরের প্রতি নারীর আকর্ষণ কিছু কম–তা কিন্তু নয়। এ হচ্ছে এক ধরনের লজ্জার অনুশীলন—যে লজ্জা নারীকে মোহনীয় করে তোলে বলে মনে করা হয়।

পুরুষের চুল, চোখ, বাহু, বুক, নিতম্ব দেখে নারীও মুগ্ধ হয়, যেরকম নারীর কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরুষের মুগ্ধতা ও কামের কারণ। কিন্তু নারীর মুগ্ধতার কোনও স্বচ্ছন্দ প্রকাশ নেই, না সমাজে, না সাহিত্যে। বিয়ে করতে গেলে ছেলে এবং ছেলের জ্ঞাতিগোষ্ঠী টিপে-টুপে পরখ করে মেয়ে নিয়ে আসে ঘরে। মেয়ের ত্বক, দাঁত, চুল, চোখ, আকার, আকৃতি, কোমর, নিতম্ব কিছুই পরখ করতে বাকি রাখা হয় না। কিন্তু ছেলেকে পরখ করবার নিয়ম নেই। অথচ ছেলের শরীর যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় কোনও মেয়ের কাছে—তা কিন্তু নয়। এও হচ্ছে সেই লজ্জার নিরলস চর্চা। মেয়েরা জন্মেই সবটুকু ‘মেয়ে’ হয় না, এইসব লাজ ও লজ্জার সফল চর্চার পর পূর্ণাঙ্গ ‘মেয়ে’ হয়ে ওঠে। পুরুষের লোমশ বাহু, কাল গভীর চোখ, ঘন ভ্রু, খাড়া নাক, ঘন কালো চুল, প্রশস্ত কাঁধ, মসৃণ পিঠ, লোমশ বুক—ইত্যাদির আকর্ষণ নারীর কাছে ঠিক তেমন—যেমন নারীর লম্বা কালো রেশমি চুল, আয়ত চোখ, খাড়া নাক, পাতলা ঠোট, উন্নত বুক, সরু কোমর ও ভারী নিতম্বের প্রতি আকর্ষণ পুরুষের। নারীও পুরুষের নিতম্ব ও উরুর প্রতি একই আকর্ষণ অনুভব করে, যে আকর্ষণ নারীর নিতম্ব ও উরুর প্রতি পুরুষের।

নারীর মোহ আছে, কিন্তু মোহের বর্ণনা নেই। পুরুষের অঙ্গ দেখে নারীর শিহরণ লাগছে—এই সত্য উচ্চারণ আমি কোনও নারীর মুখে শুনিনি। কিন্তু নারীর কোনও অঙ্গ দেখে বা ছয়ে পুরুষের কী ধরনের পুলক লাগে–তা এত ভাষায়, এত বিশদ বর্ণনায়, এত নিদ্বিধায় উচ্চারিত হয়েছে এতকাল যে নির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ করবার দরকার হয় না।

আমি নারী চিত্রকরকে দেখি নারীর কামময় ছবি আঁকছে, আমি নারী ঔপন্যাসিককে দেখি নারীর রূপ বর্ণনায় অবিকল পুরুষের মতই সিদ্ধহস্ত। তবে পুরুষের রূপের বর্ণনা করবে কে? পুরুষের শরীর থেকে দুৰ্গন্ধ দূর করবার পরামর্শ দেবে কে? পুরুষের শরীরকে এমনই আকর্ষক দ্রব্যে তৈরি করা উচিত, যেন তারা রোজ সাবান মেখে শরীর পরিচ্ছন্ন রাখে, যেন নারী তাদের শরীরে কোনও ধুলো ময়লার অস্তিত্ব না দেখে। যেন তারা চুলের চাষে ও চর্চায় মনোনিবেশ করে, যেন তার ত্বককে সতেজ ও কোমল রাখে, উরুকে সুঠাম ও নিতম্বকে সুগঠিত রাখে, যেন তারা বুককে লোমশ ও প্রশস্ত রাখে, যেন তারা পা ও পায়ের গোড়ালিকে মসৃণ ও তাজা রাখে। পুরুষের শরীরকে পণ্য করে তুললে পুরুষের ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রিও বেশ জমজমাট হবে।

ক্রেতা কেবল চিরকাল এক পক্ষই কেন? ক্রেতা এবং বিক্রেতা তাদের পণ্য নিয়ে উল্টো দিকে বিক্রেতা ও ক্রেতাও বটে। তা না হলে এই বাণিজ্যের জগতে এক পক্ষেরই কেবল লাভ, ক্ষতি অন্য পক্ষের।

নারীর জন্য এখন চমৎকার চাহিদা হোক কামরাঙার মত পুরুষের ঠোঁট, মরিচ-চেরা কালো চোখ, করমচার মত জিভ, কাঠালের কোষের মত গায়ের রঙ, নাশপাতির মত দাঁত, মাচার লাউ-এর মত সুঠাম উরু, রজনীগন্ধার মত গায়ের ঘ্রাণ। নারীর চাহিদামাফিক পুরুষ এখন সর্বাঙ্গে উপযুক্ত হয়ে উঠুক। সম্পূর্ণ হয়ে উঠুক। নারীর শরীরের প্রতি তৃষ্ণ যদি পুরুষের জন্য বৈধ হয়ে থাকে—তবে কেন একইভাবে নারীর জন্যও বৈধ নয় পুরুষের সর্বাঙ্গ? কেন নারী উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করে এই কথা–তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাদে প্রতি অঙ্গ মোর? পুরুষ তো এ কথা লিখতে লজ্জা করেনি।

ফুল ও ফলের সঙ্গে নারী অঙ্গের তুলনা চলে। ফুল ও ফলের আয়ু খুব অল্প, ঘ্ৰাণ নিলে, খেলে ফুল ও ফল দুটোই আবর্জনার ঝুড়িতে চলে যায়, একই রকম নারীও। নারীকেও খেয়েদেয়ে এঁটো-কাটার মতই ফেলে দেওয়া হয়। পুরুষকে কেউ শত খেলেও ছিবড়ে হয় না, কারণ সে ফুল বা ফল নয়, সে মানুষ। এক্ষেত্রে নারীও যে ফুল বা ফল নয়, সেও যে মানুষ তা বোঝাতে গেলে মানুষ নামের পুরুষকেও একই কাতারে নামিয়ে এনে তাকেও ফুল বা ফলের উপমায় দাঁড় করতে হবে, যেন প্রমাণ হয়—ফুল ও ফল যদি কারুকে বলা যায় তবে নারী ও পুরুষ দু’জনকেই বলা যায়। আর না হলে কারুকেই নয়।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন