৫২. পূর্বাভাস

তসলিমা নাসরিন

পূর্বাভাস

অনেকে বলে পূর্বাভাস পত্রিকাটি তোমার সঙ্গে এত শক্রতা করল, তারপরও এতে লেখ! ‘শক্রতা’ শব্দটির ব্যাপারে আমি অবশ্য আপত্তি করি না, কারণ একথা সত্য যে একজন লেখককে যে ন্যূনতম মর্যাদা দেওয়া উচিত—পূর্বাভাস তা দেয়নি—যদিও আমি পূর্বাভাসেরই নিয়মিত লেখক বা কলামিস্ট ছিলাম। এই শক্রতার বিরুদ্ধে আমার করণীয় কিছুই ছিল না, আমার পক্ষে সম্ভব নয় লোক লাগিয়ে পূর্বাভাসের কব্জির হাড় ভেঙে ফেলা, অথবা কষে দুই থাপ্পড় লাগানো। সম্ভব নয় এইজন্য বলছি যে, আমাকে তা মানায় না, আহিরিটোলা থেকে মস্তান জোগাড় করা কোনও মেয়েমানুষের কৰ্ম্ম নয়।

আমি কোথাও কোনও মিত্রতার আশা করি না। আমি যদি পথচারী হই, পথে নয়; আমি যদি বধু হই, গৃহে নয়। আমি যদি কর্মী হই, কর্মক্ষেত্রে নয়। আমি যদি লেখক হই, পত্রিকায় নয়। মিত্রতার আশা করা নেহাত বোকামো ছাড়া কিছু নয় জানি। কারণ মেয়ে জাতীয় মানুষগুলো নিতান্তই ব্যবহারের জিনিস। যতক্ষণ এরা ব্যবহার উপযোগী, ততক্ষণ কদর। কাঠে ঘুণ ধরলে, লোহয় মরচে ধরলে—সেই কাঠ বা লোহার কদর আর তেমন থাকে না। তেমনি মেয়ে নামক দ্রব্য যখন অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে ব্যবহারের, সেও কাঠ বা লোহার মত, জুতো বা জামার মত নিক্ষিপ্ত হয়।

নিক্ষিপ্ত হওয়াই সম্ভবত মেয়েদের নিশ্চিত নিয়তি। আর তাই হলে মান-মর্যাদা, শ্রদ্ধা-ভক্তি ইত্যাদি দামি ব্যাপারগুলো যত প্রতিভাবান মেয়েই হোক, দাবি করতে পারে না। তাই পূর্বাভাসের আশোভন আচরণেও আমি নীরব থেকেছি। নীরব থাকবার একটিই কারণ যত বড় কলামিস্টই হই না কেন, আমি মেয়ে। আমার মেয়ে নামের পরিচয়টিই সব ফুড়ে, সব ভেঙে উজিয়ে ওঠে। যেহেতু মানুষের ইতিহাসে নেই, চরিত্রে নেই, নীতি ও নিয়মে নেই যে মেয়েরা মূলত মানুষ, সে যখন আইনজীবী—আইনজীবীই, সে যখন চিকিৎসক—চিকিৎসকই, সে যখন লেখক–লেখকই। তাই ওই উজিয়ে ওঠা ‘মেয়ে’, ওই প্রধান এবং একমাত্র ‘মেয়ে’ পরিচয় নিয়ে সকলে ধুন্ধুমার নেচে ওঠে। পূর্বাভাস সকলের চেয়ে পৃথক কিছু নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই, ঘরে নেই, বাইরে নেই। যতক্ষণ অন্যের সম্পদ হিসেবে সে অন্যের স্বার্থসাধন করবে—ততক্ষণ তার স্তুতি গাইবে লোকে, নিরাপত্তার নামে তাকে আবৃত করবে, আড়াল করবে। মুঠো খুলে বেরোতে চাইলেই ফুসে ওঠে স্ততিকারিরাই, মুখোশ ছিড়ে বেরিয়ে পড়ে তাদের আসল আদল।

নারী এই মুখোশগুলো চেনে না। নারী এই মুখোশগুলোকে বার বার প্রকৃত মুখ বলে ভুল করে। কারও ছায়ায় নারী নিজেকে নিরাপদ ভেবে ভুল করে। নারী ভুলে যায় পুরুষ কোনও বৃক্ষ নয়, যে কেবল ছায়াই দেবে। পুরুষের ছায়ার ছুতোয় শেকড় বাড়িয়ে নারীর রূপরস শোষণ করে, নারীর গুণগন্ধ শোষণ করে।

অনেকে বলে—আপনার লজ্জা হয় না পূর্বাভাসে লিখতে, যে পূর্বাভাস আপনাকে এমন ডোবাল। ডুবিয়েছে যে একথা অস্বীকার করি না। এ জগতে নারী হচ্ছে জীবন্ত খড়কুটো, কেউ ইচ্ছে করলে তাকে ডোবাতে পারে, ইচ্ছে করলে ভাসাতেও পারে। আজ তাকে এ ডোবাবে, কাল ও ডোবাবে, কেউ আবার করুণা করে একদিন তাকে হঠাৎ ভাসাবে। নারী তো নিজের নিয়ন্ত্রক নয়। ডুবে-ভেসে তাকে পার করতে হয় জলজ জীবন। হ্যাঁ লজ্জা হয় আমার, তবে নিজের জন্য নয়, লজ্জা হয় ওদের জন্য যারা যখন খুশি নারীকে ডোবায়-ভাসায়, মূলত নারীকেই। লজ্জা হয় ওই প্রগতিবাদিদের জন্য, যারা সামাজিক শৃঙ্খল ছিড়ে বেরিয়ে আসা প্রগতির পক্ষের নারীকেই পুনরায় পণ্য করে তোলে, লজ্জা হয় ওদের জন্য, যারা নিজেরাও একবার নিজেদের কৃতকর্মে লজ্জিত হয় না।

আমাকে কেউ সম্মান দেবে কি না দেবে সে আমার ভাববার বিষয় নয়। এই সমাজ-প্রদত্ত ঠুনকো সম্মানের জন্য যদি আমি প্রাণ পেতে বসে থাকি—সে আমারই ক্ষতি। এ শুধু আমারই ক্ষতি নয়, সকল নারীর ক্ষতি—যে নারী দাঁড়ায়, যে নারী পথ হাটে, সিড়ি ভাঙে, যে নারী সত্য ও সাম্যের পক্ষে স্পষ্ট বাক্য উচ্চারণ করে। এ শুধু আমার ক্ষতিই নয়, সকল নারীর ক্ষতি।

নারীর জন্য যে সম্মান রক্ষিত থাকে, তা কথিত ওই মাতৃত্বের সন্মান, বার্ধক্যের সন্মান, পুরোমাত্রায় সামাজিক রীতিমাফিক নারীত্ব অর্জন করবার সম্মান, সৌন্দর্যের সম্মান। এছাড়া নারীকে অন্য সম্মান দিতে মানুষের কাপণ্য হয়, কাপণ্য হয় কারণ অভ্যেস নেই, রীতি নেই, প্রচলন নেই। ওদের আমি দোষ দিই না। ওরা ওদের পিতাকে দেখেছে, পিতার পিতা তস্য পিতাকে দেখেছে। ওদের রক্তে, ওদের হাড়ে-মজ্জায় মিশে আছে পূর্বপুরুষের সংক্রামক অসুখ, যে অসুখে অন্ধ হয়ে ওরা নারীকে মানুষ বলে দেখে না, যে অসুখে স্নায়ুবিকৃতি ঘটিয়ে ওরা নারীকে ‘মানুষ’ বলে চেনে না। ওদের আর দোষ দেব কী?

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন