৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে

তসলিমা নাসরিন

অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে

প্লেবয়-এর জেফ কলিন্স এখন উল্লাসে নৃত্য করছেন। কারণ মিশন তার সাকসেসফুল। মস্কোর মেয়েদের তিনি উলঙ্গ করে ছেড়েছেন। সূক্ষ্ম পোশাক পরে মস্কোর মেয়েরা রেড স্কোয়ারে ছবি তুলেছে। জেফ কলিন্স মস্কোর মেয়ে সম্পর্কে বলেছেন—‘সারা ইউরোপের মত তারা দ্বিধাহীন, শরীর নিয়ে লজ্জিত নয়। একঘর লোকের মধ্যে ঝটপট কাপড় খুলে ফেলতে তাদের মোটেই সঙ্কোচ নেই।‘

জেফ কলিন্স ভেবেছিলেন, আগ্রাসী পাঠকের খাদ্যতালিকায় নতুন মেনু হিসেবে চমৎকার হবে রুশ-সুন্দরীরা। তিনি এতটা আশাও করেননি যে, হুড়মুড় করে এক ডাকে মডেল হবার জন্য দাঁড়িয়ে যাবে এতদিনকার সমাজতন্ত্রী মেয়েরা, যারা অন্তত নিজের শরীর নিয়ে ব্যবসা করতে শেখেনি। গর্বাচেভ ও ইয়েলেৎসিনের ধ্বংসযজ্ঞকে পুঁজি করে জেফ কলিন্স স্রেফ সুযোগ নিতে মস্কো গিয়েছিলেন। তার গোপন ইচ্ছে ছিল, এই ফাঁকে কায়দা করে কিছু রুশ-সুন্দরীকে ভজানো যায় কি না।

না কোনও ছল-চাতুরির দরকার হয়নি। মেয়েরা প্লেবয়-পত্রিকার মডেল হবার জন্য রীতিমত লাইন দিল। শুধু রেড স্কোয়ারে নয়, সেন্ট বাসিলস-এর সামনে, স্পা-টাউন সোচিতে, পুশকিন ফাউন্টেইনে, রোসিয়া হোটেলের সুইমিং পুল, করিডোর, রেস্তোরায় অর্ধনগ্ন রুশ-সুন্দরীর ছবি তোলা হল। লেনিনের ছবির সামনে নগ্ন সুন্দরীরা নিতম্ব দেখিয়ে ছবি তুলল। যেন লেনিন নয়, লেনিনের চেয়ে মহান হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ রুশ-নারীদের নিতম্ব। জেফ কলিন্স জয় গ্লাসনস্ত, জয় ইয়েলেৎসিন বলে দেশে ফিরেছেন। লেনিন তো সেই মানুষ, যে মানুষ নারীকে পণ্য করতে চাননি, নারীকে গার্হস্থ্য বাদিগিরি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। লেনিন তো সেই মানুষ, যে মানুষ নারীকে মানুষ বলে ভেবেছেন, পুঁজিবাদীর শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে নারীকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। লেনিন নিশ্চয় সেই মহান মানুষ, নারীকে যে মানুষ ধর্ম ও সামাজিক সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। নারীকে রান্নাঘর ও আঁতুড়ঘর থেকে কলে এনেছেন, কারখানায় এনেছেন, মিছিলে এনেছেন, পাঠশালায় এনেছেন। সেই লেনিনকে সামনে রেখে আজ রুশ-নারীরা উরু উদোম করে ছবি তুলবার পোজ দিচ্ছে। ধিক, ধিক্ এই পশ্চিমী মোহে, ধিক এই নারী-দেহের বীভৎস বাণিজ্যে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রামে-গঞ্জেও এখন ডিস্কো চলে, চলে মিস সুন্দরী প্রতিযোগিতা । রাশিয়ার মেয়েরা এখন মেধার অনুশীলনের চেয়ে শরীরের সৌন্দর্য প্রদর্শনকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। তারা বুক, কোমর ও নিতম্বের মাপ নিয়ে এখন ভীষণ ব্যস্ত। রাস্তাঘাটে পর্ণে-পত্রিকার স্তৃপ, ঘরে ঘরে ব্লু-ফিল্‌ম চলছে।

বার্লিন-প্রাচীর ভেঙে ফেলবার পর পূর্ব জার্মানীর তরুণেরা প্রথম ঢুকেছে পশ্চিম জার্মানীর ব্রেথেলে। স্বাধীনতার স্বাদ ওরা ব্রেথেলে ঢুকেই পেয়েছে, এবং দুঃখ এই যে, অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে। রাশিয়ায় এখন নারীকে পণ্য বানাবার পশ্চিমী কায়দাকানুন চলছে। নারী এখন আর মানুষ নয়, ভোগের বস্তু, নারী-সম্ভোগ এখন স্বাধীনতার অন্য নাম।

এই যদি হয় গ্লাসনস্তের চূড়ান্ত ফলাফল, তবে ধিক্‌ গ্লাসনস্তে, ধিক্‌ তাদের স্বাধীনতায়। কম্যুনিজমকে ধূলিসাৎ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিমি ক্লেদই তারা ঘরে নেবে—এর বেশি কিছু নয়। এর বেশি প্রাপ্তি তাদের নেই।

সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বার পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে নারী-দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয়। নারীকে পণ্যের শেকলে বেঁধে বোকা নারী-পুরুষ উভয়েই এখন উল্লাস করছে। ধুন্ধুমার নৃত্য করছে। নারী এখন ওদেশে, অবিকল পুঁজিবাদী দেশের মত, সুস্বাদু খাদ্য। খাদকেরা লেনিনের আদর্শ আগুনে পুড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিকৃত সভ্যতার দিকে।

হায় পতন! হায় দানবীয় উচ্ছাস! লেনিন, আপনি ক্ষমা করুন। আপনার এই নির্বোধ উত্তরাধিকারিদের ক্ষমা করুন। যে গার্হস্থ্য বাদিগিরি থেকে নারীকে আপনি মুক্ত করেছিলেন, সেই নারীই এখন সাধ করে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াচ্ছে, সেই নারীই শখ করে এখন নিজের শরীরকে প্রলোভনের বস্তু বানাচ্ছে। লেনিন, আপনি লজ্জায়, ঘৃণায় আপনার চোখ বন্ধ করুন। যেন এই বিকৃতি, যেন এই নোংরা সভ্যতা আপনাকে দেখতে না হয়।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
২. ৭৩. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
৩. ০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
৪. ০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
৫. ০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
৬. ০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
৭. ০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
৮. ০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
৯. ০৮. বিয়ের বয়স
১০. ১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১১. ১১. প্রোসটেটনামা
১২. ১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
১৩. ১৩. নারীর শরীর
১৪. ৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১৫. ১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১৬. ১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
১৭. ১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
১৮. ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১৯. ১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
২০. ১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
২১. ২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
২২. ২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
২৩. ০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
২৪. ২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
২৫. ২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
২৬. ২৪. মেয়েদের পরিচয়
২৭. ২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
২৮. ২৬. রামায়ন-মহাভারত
২৯. ২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
৩০. ২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
৩১. ২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
৩২. ৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
৩৩. ৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
৩৪. ৩২. ওড়না
৩৫. ৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
৩৬. ৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
৩৭. ৩৫. সংসার
৩৮. ৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
৩৯. ৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
৪০. ৩৯. নারীর শ্লীলতা
৪১. ৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
৪২. ৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
৪৩. ৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
৪৪. ৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
৪৫. ৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
৪৬. ৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
৪৭. ৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
৪৮. ৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
৪৯. ৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
৫০. ৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
৫১. ৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
৫২. ৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
৫৩. ৫২. পূর্বাভাস
৫৪. ৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
৫৫. ৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
৫৬. ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
৫৭. ৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
৫৮. ৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
৫৯. ৫৮. শব্দের অপচয়
৬০. ৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
৬১. ৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
৬২. ৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
৬৩. ৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
৬৪. ৬২. দর্জির স্পর্শ
৬৫. ৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
৬৬. ৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
৬৭. ৬৫. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
৬৮. ৬৬. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
৬৯. ৬৭. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
৭০. ৬৮. স্মৃতিতে লেনিন
৭১. ৬৯. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
৭২. ৭০. বহুবিবাহ
৭৩. ৭১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
৭৪. ৭২. ফুলের মত পবিত্র
৭৫. ৭৪. দাসী ছহবত
৭৬. ৭৫. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
৭৭. ৭৭. কুমারীর ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন