টমসাহেবের বাড়ী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

লীলা মজুমদার

টম সাহেবের বাড়ি – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

প্রকান্ড অট্টালিকা। একতলা, দোতলা, তেতলা, কত যে কামরা তাহা বলিতে পারি না। দেখিতে দেখিতে আমরা বৃহৎ একখানি ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। মেঝেতে নিবিড় ধূলা পড়িয়াছিল। কোথাও কিছু নাই, হঠাৎ দেখিলাম আমার ঠিক সম্মুখে একটি পায়ের দাগ পড়িল। শিশুর পদচিহ্ন। তাহার আগে, কি আশেপাশে আর দাগ নাই। কেবল সেই একটি দাগ মাত্র। অগ্রসর হইয়া সেই পদচিহ্নের উপর আমার নিজের পা রাখিলাম।

অমনি ঠিক সেই সময় আমার সম্মুখে আর একটি পায়ের দাগ পড়িল। আমি আমার সঙ্গী ভৃত্যের গা টিপিলাম। সেও আমার গা টিপিল। এইরূপে যতই যাই, আগে ধূলার উপর ততই একটি শিশুর পদচিহ্ন অঙ্কিত হইতে থাকে। কেবল এক পায়ের চিহ্ন; দুই পায়ের দাগ পড়ে না। যখন ঘরের অপর প্রান্তে প্রাচীরের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম তখন আর দাগ পড়িল না।

সেঘর হইতে বাহির হইয়া আমরা অন্যান্য ঘর পরিদর্শন করিতে লাগিলাম। ক্রমে একখানি বড় ঘরে গিয়া বসিলাম। তখন রাত্রি হইয়াছিল। ভৃত্য বাতি জ্বালাইয়া আমার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিল। সহসা ঘরের অন্য দিক হইতে একখানি চৌকি যেন হাওয়ায় ভাসিতে ভাসিতে ঠিক আমার সম্মুখে আসিল। আমি বলিয়া উঠিলাম, বাঃ। একি!

ক্রমে দেখিলাম, সেই চৌকির উপর যেন কি বসিয়া রহিয়াছে। মানবের আকৃতি বটে। কিন্তু তাহার দেহ যেন অতি তরল ধূম দ্বারা গঠিত। তখন সেই ঘর পরিত্যাগ করিয়া আমরা দ্বিতলে গিয়া উঠিলাম। আমার শয়নঘর এই তলায় নির্দিষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু তখনও নিদ্রা যাইবার সময় হয় নাই। সুতরাং এই তলায় অন্যান্য ঘর পরিদর্শন করিতে লাগিলাম। একটি ক্ষুদ্র কামরার নিকট গিয়া উপস্থিত হইয়া আমার সঙ্গী ভৃত্য বলিল – এ কি হইল? এ ঘরের দরজা বন্ধ কেন? আমি এইমাত্র চাবি খুলিয়া কপাট উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছি।

বিস্ময়ে দ্বারের দিকে চাহিয়া আছি এমন সময়ে কি আশ্চর্য, দ্বার আস্তে আস্তে আপনি খুলিয়া গেল। আমরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। এক প্রকার অমানুষিক গন্ধে ঘর ক্রমে পরিপূরিত হইতে লাগিল। এক প্রকার ভৌতিক ত্রাসে হৃদয় অবসন্ন হইতে লাগিল। আশঙ্কা যে কি তাহা বর্ণনা করিতে পারি না। নব জীবনের প্রতিকূল কোন একটা ভীষণ পদার্থ যেন সেই ঘরে আছে, এইরূপ আমাদের মনে হইল। সর্বনাশ। সহসা ঘরের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল।

সে ঘরে আর অপর দ্বার কি জানালা ছিল না। প্রথমে দুইজনে দ্বায় টানাটানি করিয়া দেখিলাম, কিছুতেই খুলিতে পারিলাম না। আমার সঙ্গী বলিল, অতি পাতলা তক্তা দিয়া কপাট জোড়াটি গঠিত। দুই লাথিতে ভাঙিয়া ফেলিব। দেখি ভূতে কি করিয়া রক্ষা করে।

দুই লাথি নয়, হাজার লাথিতেও সে কপাট ভাঙিল না। আমি অনেক চেষ্টা করিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে ভঙ্গপ্রবণ কপাট ভাঙিতে পারিলাম না। শান্ত হইয়া আমরা নিবৃত্ত হইলাম। তখন খলখল করিয়া বিকট হাসির শব্দ হইল। দ্বারটি আস্তে আস্তে আপনি খুলিয়া গেল। সেই ভয়াবহ ঘর হইতে ভাড়াতাড়ি বাহির হইলাম।

সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া আমরা বারান্দায় দাঁড়াইলাম। এক পার্শ্বে মিটমিট করিয়া কেমন একটি নীলবর্ণের অলৌকিক আলো জ্বলিতেছিল। কি আলো, কোথায় যাইতেছে দেখিবার নিমিত্ত আমরা তাহার পশ্চাদগামী হইলাম। সিঁড়ি দিয়া আমাদের আগে আগে আলোটি তেতলায় উঠিতে লাগিল। তেতলার উপরে উঠিয়া একটি সাধারণ শয়নাগারে প্রবেশ করিলাম। যে বৃদ্ধা এই বাড়িতে একাকী বসবাস করিত, এই ঘরটি তাহার ছিল, আমরা এইরূপ অনুমান করিলাম। ঘরের ভিতর একটি দেরাজ ছিল। খুলিয়া দেখিলাম, তাহার ভিতর একখানি রেশমের রুমাল ও দুইখানি চিঠি রহিয়াছে। দ্বিতলে আসিবার নিমিত্ত সিঁড়ি দিয়া নামিতে লাগিলাম।

মনে হইল, আমার পাশে পাশে চিঠি দুইখানি কাড়িয়া লইবার নিমিত্ত কে যেন বারবার চেষ্টা করিতেছে। দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ করিয়া আমি তাহার সে চেষ্টা বিফল করিলাম। আমার শয়নঘরে উপস্থিত হইয়া প্রথমে ঘড়ি ও পিস্তল টেবিলের উপর রাখিলাম। নিকটস্থ ছোট একটি ঘরে ভৃত্যকে শুইতে বলিলাম। মাঝের দ্বার খোলা। যে পত্র দুইখানি উপর হইতে আনিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহা পড়িতে লাগিলাম।

পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে চিঠি দুইখানি কোন একটি পুরুষ তাহার প্রিয়জনকে লিখিয়াছিল, কিন্তু নাম ধাম কাহারও ছিল না। তাহাতে কোন একটি বিভীষিকার আভাস ছিল। কে যেন কাহাকে খুন করিয়াছে, এই ভাবের কথা। পত্ৰ দুইখানি পাঠ করিয়া আমি চৌকির উপর বসিলাম। ঘরে দুইটি বড় বড় বাতি জ্বলিতেছিল। শীত প্রধান দেশ। ঘরের আগুন জ্বালিবার জায়গায় দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলিতেছিল। সহসা টেবিলের উপর হইতে আমার ঘড়িটি শূণ্য পথে চলিয়া যাইতে লাগিল। হাতে পিস্তল লইয়া তাড়াতাড়ি আমি ধরিতে দৌঁড়াইলাম। কিন্তু সোঁৎ করিয়া ঘড়ি যে কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেল, আর আমি দেখিতে পাইলাম না।

ভৃত্য এই সময় সহসা তাহার ঘর হইতে দৌড়িয়া আসিল। চক্ষু রক্তবর্ণ, যেন কোটর হইতে বাহির হইয়া পড়িতেছে। তাহার সর্বশরীর রোমাঞ্চ হইয়াছে, মাথার চুলগুলি সব খাড়া হইয়া উঠিয়াছে। বলিল মহাশয়, পলায়ন করুন, পলায়ন করুন! এই স্থানে আর তিলার্ধকাল থাকিলে মারা পড়িবেন। বাপরে, ধরিল রে! এইরূপ চিৎকার করিতে করিতে সে আমার ঘর হইতে বাহির হইয়া তড়তড় করিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিতে লাগিল।

তাহাকে ফিরাইবার নিমিত্ত আমি পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়াইলাম। কিন্তু ধরিতে না ধরিতে সে দরজা খুলিয়া উর্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। সেই ভয়াবহ শ্মশান সদৃশ অট্টালিকার ভিতর আমি এখন একা পড়িলাম। প্রাণে আমার অতিশয় ত্ৰান্স হইল। একবার মনে ভাবিলাম, আমিও পলায়ন করি। কিন্তু বন্ধুবান্ধব সকলে হাসিবে ও বিদ্রূপ করিবে। যা থাকে কপালে, এই মনে করিয়া পুনরায় আমি উপরে উঠিলাম।

আমার সম্মুখে তাল গাছ প্রমাণ কৃষ্ণবর্ণ একটি মানুষের আকৃতি দাঁড়াইল। তাহার মস্তক ছাদে ঠেকিল। সেই মস্তকে চক্ষু দুইটি জ্বলিতে লাগিল। সর্বশরীর আমার শিহরিয়া উঠিল। পিস্তলটি হাত হইতে পড়িয়া গিয়াছিল। আমি তাহা লইবার নিমিত্ত হাত বাড়াইলাম। অসাড় ও অবশ হাত উঠিল না। আমি দাঁড়াইবার চেষ্টা করিলাম। পা অসাড় ও অবশ। পা উঠিল না। চিৎকার করিতে চেষ্টা করিলাম। মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। জ্ঞান হত হইবার উপক্রম হইল।

কিন্তু তখনও একটা চিন্তাশক্তি আমার মনে ছিল। ভাবিলাম যদি ভয় করি, তাহা হইলে নিশ্চয় আমি প্রাণ হারাইব। এইরূপ মনে করিয়া অনেক চেষ্টা করিয়া ধৈর্য ধরিয়া রহিলাম। বাতি নিবিল না, অগ্নিস্থানে অগ্নি নির্বাণ হইল না। তথাপি ঘর অন্ধকারে আবৃত হইয়া গেল। আমি ভাবিলাম, যেমন করিয়া হউক, ঘরে আলো রাখিতে হইবে। অন্ধকারে থাকিলে মারা পড়িব।

পুনরায় উঠিতে চেষ্টা করিলাম। এবার উঠিতে পারিলাম। আস্তে আস্তে গিয়া একটা জানালা খুলিয়া দিলাম।

জ্যোৎস্না রাত্রি ছিল। অল্প অল্প চাঁদের আলো ঘরে প্রবেশ করিল। সেই আলোকে দেখিলাম যে তালবৃক্ষ প্রমাণ কৃষ্ণবর্ণের বিকট মূর্তি তখন সম্পূর্ণভাবে ঘরে নাই, কেবল তাহার ছায়াটি এক পার্শ্বে দন্ডায়মান রহিয়াছে। পুনরায় গিয়া চৌকিতে বসিলাম। পীত, হরিৎ, লোহিত নানা বর্ণের গোলাকার আলোক এক্ষণে ঘরের চারিদিকে ঘুরিয়া ও গড়াইয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার পর ভূমিকম্প হইলে যেমন হয়, ঘর সেইরূপ দুলিতে লাগিল। যে চৌকির উপর চিঠি দুইখানি রাখিয়াছিলাম তাহার নীচে হইতে ঠিক জীবন্ত মানুষের রক্তমাংসের হাতের ন্যায় একখানি স্ত্রীলোকের হাত বাহির হইল। তাড়াতাড়ি আমি সেই হাতখানি ধরিতে গেলাম। খপ করিয়া চিঠি দুইখানি লইয়া নিমেষের মধ্যে হাতখানি অদৃশ্য হইয়া গেল।

মাঝে মাঝে গলা টিপিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবার জন্য কে যেন চেষ্টা করিতে লাগিল। আমার ঘাড় ভাঙিয়া দিবার জন্য মাঝে মাঝে হাতও আসিতে লাগিল। সাহসে ভর করিয়া আমি বরাবর সেই ভৌতিক হাত ঝাড়িয়া ফেলিতে লাগিলাম। সে রাত্রিতে আমি যে কি করিয়া প্রাণে বাঁচিলাম, তাহাই আশ্চর্য!

অধ্যায় ১ / ২৭

সকল অধ্যায়

১. টমসাহেবের বাড়ী – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৩. দিনে দুপুরে – বুদ্ধদেব বসু
৪. ঠিক দুপুরে আকাশকুসুম – স্বপন বুড়ো
৫. রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬. লোকসান না লাভ – আশাপূর্ণা দেবী
৭. মাঝরাতের কল – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. ওয়ারিশ – লীলা মজুমদার
৯. তান্ত্রিক – ধীরেন্দ্রলাল ধর
১০. বোধহয় লোকটা ভূত – শুদ্ধসত্ত্ব বসু
১১. ছক্কা মিঞার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১২. ভূতেরা বিজ্ঞান চায় না – অদ্রীশ বর্ধন
১৩. হুড়কো ভূত – অমিতাভ চৌধুরী
১৪. ভূতে পাওয়া হরিণ – সংকর্ষণ রায়
১৫. মড়ার মাথা কথা বলে – রবিদাস সাহারায়
১৬. ফ্রান্সিসের অভিশাপ – শিশিরকুমার মজুমদার
১৭. সত্যি ভূতের মিথ্যে গল্প – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. শব্দের রহস্য – বিমল কর
১৯. পুরনো জিনিষ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২০. ভাড়া বাড়ি – মঞ্জিল সেন
২১. জ্যোৎস্নায় ঘোড়ার ছবি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. শাঁখারিটোলার সেই বাড়িটা – লক্ষ্মণকুমার বিশ্বাস
২৩. হাসি – বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ভূতুড়ে রসিকতা – আনন্দ বাগচী
২৫. ভূতেশ্বরের দরবারে কোয়েল – জগদীশ দাস
২৬. ভূত আছে কি নেই – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২৭. ভূতের সঙ্গে লড়াই – শেখর বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন